#প্রেমনগর
পর্বঃ১৮
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
আফতাব চৌধুরীর মুখোমুখি হতে নীলার বাবা মা এবং তাদের কিছু দলবল সঙ্গে নিয়ে হাতপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছেন। হাতপাতালের সামনে বেশ কয়েকটা মাইক্রো এসে জড়ো হয়েছে। তারা দ্রুত বেগে হন হন করে হেটে সিড়ি দিয়ে উঠছে। তিন তলায় এসে আটকে গিয়ে এদিক ওদিক ছুটে ওদের কেবিন খুঁজতে থাকে। দলবল গুলোও হাতে লাটি গুলি নিয়ে পিছু পিছু আসছে। হাসপাতালে থাকা অনান্য রোগীরা এই দৃশ্য গুলো দেখে ভয় পেয়ে গেল। হাসপাতালের ম্যানেজার তাড়াতাড়ি পুলিশ সুপার বাহিনীকে খবর দিলেন। এদের সামলাতে দুই একটা সিকুরিটি পুলিশে কাজ হবে না। ওরা সামলাতে গিয়ে পরে হাসপাতালে না কোন বাজে ঘটনা ঘটে যায়।
.
কাঙ্খিত আফতাব চৌধুরীর খোঁজ তারা পেয়েছেন। আফতাব চৌধুরীর মুখোমুখি হতে গিয়ে নীলার মা নীহারিকার এবার চোখ গেল মনিরা বেগমের দিকে। মনিরা বেগমও নীহারিকাকে দেখে উঠে দাড়ালেন। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ এবং একে অপরকে সুক্ষ্ণ ভাবে দেখে চেনার চেষ্টা করছেন। নীহারিকার চোখ গুলো গোল গোল হয়ে গেছে। নীহারিকা চিল্লিয়ে বলে উঠলো, মনিরা!!
মনিরা বেগমঃ নীহারিকা তুই!
মনিরা বেগম ছুটে এসে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরলেন। দুইজনের মুখেই ছড়িয়ে পরছে মুক্তোর হাসি।
নীলার বাবা আর আফতাব চৌধুরী একবার একে অপরের দিকে তাকালেন। তারা ঘটনার কোনো কিছুই বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
.
মনিরা আর নীহারিকা দুইজন স্কুলের বান্ধুবি। দীর্ঘ সাতাশ বছর পর তাদের আজ আবার দেখা হলো। সেই ষোল বছর বয়সে মনিরা আফতাবের প্রেমে পরে। এবং সেই প্রেমের টানে এক পর্যায়ে ঘর ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। ঘটনার কিছুদিন পর নীহারিকার স্কুল পাশ হলেই নীহারিকার পরিবার নীহারিকাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। পররর্তীতে দুই বছর পর মনিরা তার নিজ শহরে এসে নীহারিকাকে আর দেখতে পায় নি এবং আর কোন যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি৷
.
মনিরা যখন ক্লাস নাইনে ওঠে তখন থেকেই আফতাব মনিরার পিছু লাগে। আফতাব ছিল তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া তরুণ। মনিরা স্কুলে যাওয়া আসার পথে আফতাব রোজ দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতো৷ এভাবে ছিলো ওদের দুজনের প্রথম দেখা হওয়া৷ মনিরা ঘরে এসে আফতাবের ওই মায়াবি চোখ কিছুতেই ভুলতে পারতো না। আর আফতাব তো কিশোরী মনিরার ওই মিষ্টি চেহারায় বাধা পরেই গেছে৷ এরিমধ্যে মনিরা ক্লাস টেনে উঠে গেল। এরপর একদিন হুট করে শুরু হয়ে যায় চিঠি দেয়া নেয়া। রোজ রোজ চিঠির আশা করতো মনিরা। একদিন চিঠি না পেলে মন খারাপ থাকতো। ওইরাতে আর ঘুম হতো না। এভাবে মনিরাও আস্তে আস্তে আফতাবের প্রতি দুর্বল হতে থাকে। দুইজনই দুইজনের প্রেমে পরে গেছে। এটা ছিলো দুইজনের জীবনেই প্রথম প্রেম৷ আর মনিরার বয়স ছিল খুবই অল্প। মনিরার ষোল এবং আফতাবের উনিশ বছর চলছিলো তখন। শুরু হলে গেল তাদের রঙিন দিন। সেই মিষ্টি প্রেমের সাক্ষী নীহারিকা নিজেও ছিলো। মনিরার চিঠি দেয়া নেয়া এবং স্কুল ফাকি দিয়ে প্রেমিকের সাথে ঘুরতে যাওয়া সবই নীহারিকা জানতো। এমনকি মনিরা বাহিরে বের হতে না পারলে ওর প্রেমিকের চিঠি পর্যন্ত নীহারিকা নিজ হাতে বহন করেছিলো।
.
প্রেম এতোটাই গভীর হয়ে গিয়েছিলো যে মনিরা নিজেকে সামাল দিতে পারলো না৷ ধরা পরে গেল পরিবারের কাছে। পড়ার টেবিল,বিছানা আর বই খাতার মধ্য গাদা গাদা অনেক চিঠি পাওয়া গেল। মনিরার বাবা মনিরাকে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন। স্কুল ফাকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ঘটনাতেও ধরা পরে গিয়েছিলো মনিরা। মনিরার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় মনিরার স্কুল পাশের পর মনিরাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে৷ কিন্তু এরিমধ্যে ঘটে যায় আরেক বিপদ। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর দুইজনের আবেগ আরও বেড়ে যায়। প্রায়ই লুকিয়ে দেখা করার সময় মনিরা এসে আফতাবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। দুইজনই দুজনকে হারানোর কথা কল্পনাতেও আনতে পারতো না। লুকিয়ে লুকিয়ে খুবই গভীর ভাবে দুজনের মেশামেশা শুরু হলো আর আবেগে দুইজনই দুজনের কাছে সপে দিলো।
.
এভাবেই দুই মাস চললো তাদের গোপন প্রনয়। মনিরাকে মারধর করার পর মনিরা বলেছিলো সে আর আফতাবের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখবেনা৷ কিন্ত তাই কি হয়? তার প্রাণ হারাতে হবে যে তাকে! একদিন আফতাবকে দেখতে না পেলে সে পাগলের মতো হয়ে যেত। হঠাৎ মনিরা একদিন ক্লাসে মাথা ঘুরে পরে যায়। আর কয়েকদিন থেকেই সব সময় বমি বমি ভাব আসছে। ভালোভাবে কিছু খেতেও পারছেনা আর বমি করছে। মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার পর স্কুলের ম্যাডাম একজন মহিলা ডাক্তারকে স্কুলে আসতে বললো। উনি মনিরাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি টেস্ট করালেন। মনিরা সন্তান সম্ভাবনা। স্কুলের ম্যাডামও এটা শুনে ভিমরি খেয়ে গেলেন। ভয়ে মনিরা ওইদিন আর বাসায় না ফেরার সিধান্ত নেয়৷ এটা বাসায় জানলে ওকে আজ মেরেই ফেলবে৷ তাই বাড়ি না ফিরে স্কুল থেকেই মনিরা সোজা আফতাবের কাছে চলে গেল।
.
সব শুনে আফতাবের মাথায়ও আকাশ ভেঙে পরে। ভয়ে মনিরা খুবই কান্নাকাটি করতে শুরু করে দিয়েছে। আফতাবও এখন ছাত্র অবস্থায়। সবে কলেজের এক বছর পার হলো। এখনি নিজের বাড়িতে বিয়ের কথা জানানোর সাহস তারও যে নেই। বাবা মা এই কথা জানতে পারলে তাকেও চড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেবে নিশ্চিত। সিধান্ত নিলো আফতাবও আজ বাড়ি ফিরবে না।
.
ছোট্ট কিশোরী মনিরা তার বড় ছেলে আকাশকে পেটে নিয়েই ওইদিনই প্রেমিক আফতাবের হাত ধরে ওই শহর ছেড়ে পালিয়ে এলো। নতুন শহরে পালিয়ে এসে আফতাব তার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে। ঘটনার সব কিছু খুলে বলার পর সে এবং আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করলো। সেই রাতেই বিয়ে হয় মনিরা আর আফতাবের। এবং আপাতত ওরা বন্ধুর বাড়িতে গিয়েই উঠলো। সবাই সেখানে ঘর বাড়ি সুন্দর করে সাজায়। এবং বাসর ঘরের ব্যবস্থাও করলো। কিশোরী মনিরার কাছে এখন সব কিছু রঙিন রঙিন লাগছে। সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে পালিয়ে এসে ভালোই করেছে৷
.
কিছুদিন পর আফতাব বন্ধুদের সহায়তায় সেখানে ছোট একটি ব্যবসা শুরু করলো এবং পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালালো৷ এরপর কিছু টাকা হলে ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া করে বন্ধুর বাড়ি থেকে দুজন সোজা সেই ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠলো। তখন থেকেই শুরু হলো এই প্রেমনগরে তাদের সাজানো ছোট্ট সংসার। সেখানেই জন্ম নিলো তাদের আদরের সন্তান বড় ছেলে আকাশ।
.
আকাশের বয়স এক বছরের কাছাকাছি আসতেই মনিরা আর আফতাব নিজেদের শহরে গিয়ে বাবা মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। এবং তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। ছেলে মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার কারণে দুইজনের পরিবারই এতোদিন ছিলো পাগল প্রায় তাই ওদের ফিরে পেয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে দুই পরিবারই ওদের বুকে জড়িয়ে নেয়৷ এরপর মনিরা আর আফতাব তাদের সন্তান আকাশকে নিয়ে প্রেমনগরে ফিরে আসে ওদের এতোদিনের সাজানো ছোট্ট সংসারে। ধীরে ধীরে মনিরা এবং তার সন্তানও বড় হতে থাকে এবং আফতাবও পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। সব কিছুই সম্ভব হয়েছে দুইজন দুইজনের প্রতি প্রেম আর সহযোগীতায়। এরিমধ্যে জন্ম নিলো ওদের মেজো ছেলে মেঘ।
.
আফতাবের সুনামে এখন বেশ খুশি মনিরার পরিবার। আফতাবের পরিবারও মনিরাকে বউ হিসেবে পুরোপুরি মেনে নিয়েছে৷ বিখ্যাত বড় বিজনেসম্যান আফতাব চৌধুরীর সুনাম এখন চারিদিকে। আফতাব প্রেমনগরই নিজস্ব অনেক জায়গা জমি কিনে ফেলেছে। বিশাল বড় বাড়িও করে ফেললো। আফতাব তার স্ত্রী মনিরা এবং দুই পুত্রকে নিয়ে সেখানে গিয়ে উঠলো। নতুন বাড়িতে উঠেই আরও একটি সুখবর এলো। মনিরা আবারও মা হতে যাচ্ছে। কিছুদিন পর নতুন চৌধুরী মহলেই জন্ম নিলো ওদের ছোট ছেলে রৌদ্র। তখন থেকেই চলতে থাকে প্রেমনগরের এই চৌধুরী মহল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সব এবং বড় হয় ছেলেরাও।
.
আজ এতো গুলো বছর পর আবার সেই ছোট্ট মনিরার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি নীহারিকা। মনিরাও ভাবেনি নীহারিকার সাথে এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে৷ তবে মনে মনে চেয়েছে কোথাও কোনো দিন দেখা হোক। অনেক খুঁজেছে সে স্কুলের বান্ধুবিদের কিন্তু যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। আজ দুইজন দুইজনকে এভাবে দেখে দুইজনই আবেগে আপ্লুত। কে জানত এই আফতাব চৌধুরীই আসলে সেই আফতাব যে ছিলো মনিরার জীবনের স্কুলের প্রেমিক৷ যার সাথে মনিরা পালিয়ে গিয়েছিলো।
.
এদিকে তুলি রৌদ্রের কেবিনে বসে খুবই বিরক্তবোধ করছে। কেননা সেখানে একের পর এক সুন্দরী মেয়েরা এসে ভিড় জমাচ্ছে। রৌদ্রের সাথে যে একটু আলাদা ভাবে কথা বলবে সেই সুযোগ টুকুও পাচ্ছে না। রৌদ্রের ডিপার্টমেন্টর সব মেয়েরা এসে হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছে। তাদের মোস্ট হ্যান্ডসাম বয় যে এখন এখানে। ওরা ভাবছে এই অবস্থায় হ্যান্ডসাম বয়ের একটু খেতমত করতে পারলে যদি মনটা জয় করে নেওয়া যায়!
.
চলবে….