প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব -০৪

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৪)
লাবিবা ওয়াহিদ

রায়াফ নিস্তব্ধ হয়ে টিভির পর্দায় তাকিয়ে আছে। আজ ওয়ান্ডে সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। বাংলাদেশের অবস্থা বেশ খারাপ, বলা চলে। রায়াফের সঙ্গী হিসেবে পাশে জিনিও বসে আছে। খেলার আগা মাথা না বুঝলেও সেও তার মাহাজনের সাথে একইভাবে টিভির পর্দায় তাকিয়ে আছে। আরেকটা উইকেট!
এবারও রায়াফের মধ্যে কোনোরকম ভাবান্তর হলো না, রায়াফ চুপচাপ খেলা দেখছে। আর মাত্র দুই ওভার বাকি। রায়াফ এক পলকের জন্যেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরায়নি। অবশেষে মাত্র ২ রানের জন্য বাংলাদেশ হারলো।
রায়াফ সাথে সাথে টিভি অফ করে দিলো এবং টিম ক্যাপ্টেন ইমনকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে বললো,

-“দেশে ফিরলে ইমিডিয়েটলি আমার সাথে দেখা করবা। আর্জেট কাজ আছে।”

ম্যাসেজটা দিয়ে ফোন রাখতেই তার ফোনে ম্যাসেজ, ফোনকল আসতে লাগলো। ই-মেইলেও একই অবস্থা। এসব ম্যাসেজ, ফোন-কল করছে সব রিপোর্টাররা। কারণটা আজ বাংলাদেশের খেলাকে কেন্দ্র করেই৷ রায়াফ ধৈর্যের সঙ্গে সব ম্যাসেজ, ইমেইল চেক করে তার সুবিধামতো একটি চ্যানেলের লাইভে গেলো এবং কোনোরকমে তাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো দিলো। অতঃপর শেষে বললো,

-“খেলায় হার-জিত আছে এবং ভাগ্যে যা নির্ধারণ করা থাকে তাই ঘটে। ভাগ্যে ছিলো আজ আমরা হারবো, হেরেছি। আমার ইঞ্জুরড হওয়ার কথা ছিলো, হয়েছি৷ কেউ তো তার ভাগ্যকে বদলাতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সামনে এগোনো৷ এখন নেক্সট ম্যাচে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটাই দেখার বিষয়। আমি হয়তো মাঠে নামতে পারবো না, তবে বাংলাদেশের জন্য আমার মনের গহীন হতে শুভকামনা।”

-“কেমন লাগছে মিস্টার রায়াফ খেলতে না পেরে?”.

রায়াফ ম্লান হেসে বলে, “খারাপ লাগলেও তো কিছু করার উপায় নেই।”

-“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।”

রায়াফ হেসে লাইভ থেকে বেরিয়ে ল্যাপটপ অফ করে দিলো। সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজে ইমনের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগলো। কমপক্ষে আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। জিনি জিহবা দিয়ে রায়াফের গালে লেহন করলো। রায়াফ হেসে একহাত দিয়ে তার সঙ্গীকে জড়িয়ে ধরলো।

এদিকে সবাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমি একবার সকলের রিয়েকশন দেখছি আর ফোন ইউস করছি। আফনা কোণা চোখে বললো,

-“কী সমস্যা? এটা কী মরা বাড়ি নাকি রেজাল্টের রুম যার জন্য সব সেন্টি খেয়ে বসে আছিস?”

-“দেখ আফনা! তুই কথা না বললেই নয়? আমরা আমাদের ক্রিকেটের জন্য শোক পালন করছি, শান্তিতে তো একটু করতে দে! রায়াফ ইঞ্জুরড আর ম্যাচটাও হারলো, কষ্ট লাগবে না?”

-“তা কয় বছর খেলবে না? শুনেছি ইঞ্জুরড প্লেয়াররা ২-৩ বছরের জন্য হারায় যায়!”

-“মাতলামি করিস? আমরা মরছি নিজের জ্বালায় আর তুই এসব আজেবাজে কথা বলিস? লাইক সিরিয়াসলি? থাপড়িয়ে ওপারে পাঠায় দিবো বলে দিলাম!”

-“টাচ করার মতোই তো তোর সাহস নাই! তুই আর আমায় থাপড়াবে হাহ!”শুরু হলো বালিশ ছুঁড়াছুঁড়ি। বালিশ ছুঁড়ার এক পর্যায়ে আম্মু এসে সকলকে থামালো।

-“এই তোরা বারংবার বাচ্চাদের মতো লাগিস কেন হ্যাঁ?”

-“তো কী করবো, তোমার মেয়েই তো মাথা খারাপ করে দেয়। এরে জলদি শ্বশুড়বাড়িতে পাঠাও তো!”

-“এহ! আসছে আমার মহামন্ত্রী! তা তুই কোন হাড়ি রে আমার বিয়ে, শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে চিল্লাবি!? আমার যেদিন ইচ্ছা আমি সেদিন বিয়ে করবো!”

-“হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই বুড়ো আঙ্কেলের সাথেই!”

-“ফ্লুইড দিয়ে মুখ থেতো করে দিবো!”

-“আরেহ! থাম বলছি, থাম!”

ইমন আজ রায়াফের বাসায় এসেছে। রায়াফ তাকে স্বাগতম জানিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যায় এবং তার সাথে কিছু কথা শেয়ার করলো! ইমন আঁখিপল্লব গোল গোল করে বলে,

-“এ কী করে সম্ভব? খেলায় ফিক্সিং!?”

-“হু! নাহলে জেতা ম্যাচ কীভাবে হেরে যায়? দেখো ইমন আমি ফুল খেলা বেশ খেয়াল করে দেখেছি। পুরো ম্যাচটাই ছিলো ফিক্সিং এর, আমি চোখ বুজে বলতে পারবো।”

ইমন চিন্তায় পরে গেলো। চিন্তিত সুরে বললো,

-“কিন্তু, কে এমন বেইমানি করলো ধরবো কী করে?”

-“আমার উপর ছেড়ে দেও। এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট করো, তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।”

-“তোমার হাতের কী অবস্থা?”

-“আজ আবার নতুন করে প্লাস্টার করেছি। চিন্তা করিও না আই এম ফাইন!”

ইমন জিনিকে আদর করে টুকটাক খাবার খেয়ে চলে গেলো। এদিকে রায়াফ তার নিখুঁত প্ল্যানটা করে কাউকে ম্যাসেজ করলো।

কিছুদিন পর ঠিকই ধরা পরলো, কে করেছে ফিক্সিং। রায়াফ সেদিন ভালোভাবেই বুঝিয়েছে সাথে ভালোভাবেই ভয় দেখিয়েছে। ফিক্সিং-এর ঘটনাটি প্লেয়ারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, উপরমহলের কানে যায়নি। কারণ, কেউ ভুল বা অন্যায় করলে রায়াফ তাকে প্রথম সুযোগ দেয়, দ্বিতীয়বার একই ভুল করলে হি/শি উইল ফিনিশড!

-“তোকে কতবার বলবো সাবধানে থাকতে? হাত আবার মচকালো কী করে? বলতে বলতে আমি শেষ! নিজের খেয়াল রাখতে না পারলে বিয়ে কর, বউ তোমার ২৪ ঘন্টা সেবা করবে। এই ফাহান সবসময় তোর পাশে থাকবে না!”

-“তুই না থাকলে আমার কী? আমি কী তোরে বেঁধে রেখেছি আমার কাছে? যা গিয়ে নিজের কাজ কর। আমারটা আমি বুঝে নিবো!”

-“কতো যে বুঝেন তা দেখাই যাচ্ছে। এখন মা স্যুপ নিয়ে আসছে, তা খেয়ে চুপচাপ মেডিসিনগুলো নিয়ে নিবি, আমি অফিস গেলাম!”

বলেই হাত ব্যাগটা নিয়ে ফাহান চলে গেলো। রায়াফ তার বামহাতটি নাড়াতে চেয়েও পারলো না। কঠিন ব্যথা সে চোখ-মুখ খিঁচে রইলো। কিছুক্ষণ পর চাচী এসে সযত্নে তাকে স্যুপ এবং ওষুধ খাইয়ে চলে গেলো। রায়াফ স্থির দৃষ্টিতে একটা ফটো ফেমের দিকে তাকিয়ে আছে। সেটায় রায়াফ ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত। কী সুন্দর এবং মেমোরিয়াল প্লে ছিলো কিন্তু আজ! ভেবেই রায়াফ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ তার সোনালী ছোটবেলার দিনগুলো খুব করে মনে পরছে। মনে পরে গেলো সেই কালো দিনগুলো। ভাবতেই রায়াফ চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। নাহ সে এখনো পারে না শক্ত হতে। দম আটকে আসছে তার। হুট করে মনে পরে গেলো সেই দিনটার কথা যেদিন সে একটা মেয়ের মুখে নিজের দুর্নাম শুনেও হেসে ছিলো। রায়াফ চোখ মেলে তাকালো।

মিরপুর স্টেডিয়ামে আজ জাকজমক ভীর! একে একে সকল বাংলাদেশ সাপোর্টাররা টিকিট দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। রায়াফ থাকলে হয়তো আরও বেশি হতো! দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসেছে শুধুমাত্র তাদের প্রিয় খেলোয়াড়দের সাহস জুগানোর জন্য, তাদের চিয়ারআপ করার জন্য। আজ এসেছে আফনার পুরো পরিবারও। যদিও রায়াফ নেই, তো কী হয়েছে? স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার মজাই আলাদা। বাবাই, আদনান আরও কিছু কাজিন বাংলাদেশের জার্সি পরেছে। এদিকে এতো ভীরের মধ্যে আফনার ঢুকতে ইচ্ছা করলো না তাই সে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে রয়েছে বললে ভুল হবে, সে চারপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিরপুর প্রথম এসেছে আফনা, তাই আশপাশটা একটু আকটু চিনে নিচ্ছে। তার ঘুরাঘুরির মাঝে কখন যে ভীর কমে গেছে আর কখনই বা খেলা শুরু হয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। আজ ওয়েস্টেন্ডিসের বিপক্ষে বাংলাদেশের টি-টুয়েন্টি ম্যাচ। ভেতর থেকে বাহিরে হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ কানে আসছে। আফনা বুঝলো ভেতরে খেলা শুরু হয়ে গেছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় ৯টা। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো,

-“যাক, ভালো হয়েছে এতো কোলাহলের ভেতরে যাইনি। আরেকটু ঘুরাঘুরি করি, শীতল বাতাসটা আসলেই জোস!”

বলেই চারপাশটা ঘুরায় মন দিলো। মাঝেমধ্যে কয়েকটা সেল্ফিও তুলে নিলো। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? আফনা হাঁপিয়ে গেছে একা বেড়াতে বেড়াতে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সে একা ঘুরবে না, ভেতরে যাবে। কিন্তু কীভাবে? সে তো জানেই না তার বাবা-মা আদনানরা কোথায় বসেছে। স্টেডিয়ামেও তো কখনো আসেনি। তখনই দেখলো একজন হুডি পরিহিত যুবক স্টেডিয়ামের সদর দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। আফনা কী ভেবে সেদিকে দৌড় দিলো।

রায়াফ দর্শকদের মাঝে থেকে কিছুক্ষণ খেলা দেখছিলো৷ আজ কেন যেন তার স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখার ইচ্ছে হলো তাই সে কাউকে কিছু না বলে ছদ্মবেশে চলে আসে। কিন্তু সড়গোলে কেন যেন থাকতে পারছিলো না। হাতের প্লাস্টার খুলেছে কিছুদিন হলো, এর মাঝে হাতেও চাপ খেয়েছে। তাই রিস্ক না নিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে। ফোনের দিকে তাকাতে তাকাতে বের হচ্ছিলো তখনই কোনো একজন অনাকাঙ্ক্ষিত মানবী বলে উঠে,

-“আপনিও আমার মতো ক্রিকেট লাইক করেন না রাইট?”

রায়াফ হতভম্ব হয়ে সামনের মানুষটির দিকে তাকালে আরও বড় ঝটকা খেলো। চোখ বড় বড় করে আফনার দিকে তাকিয়ে রয় সে। সেইদিনের মেয়েটি না? আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা। রায়াফ আমতা আমতা করে বললো,

-“এক্সকিউজ মি!”

-“বললাম আপনিও ক্রিকেট অপছন্দ করেন। যেখানে সবাই ভেতরে লাফাচ্ছে আর এখানে আমি আর আপনি ঘুরছি। ফানি না? দুজনেই অপছন্দ করি, হেহে। তবে…”

অতঃপর আফনার যতো রকমের বকবকানি। সবটাই ক্রিকেটকে ঘিরে। ক্রিকেট এবং রায়াফকে নিয়ে দুর্নাম। আজ রায়াফের বিরক্ত লাগছে এসবকিছু। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোরে চেঁচিয়ে বললো,

-“জাস্ট শাট আপ! কতোটুকু জানো তুমি রায়াফ সানভির সম্পর্কে? আজাইরা বকবক একদম করবা না! স্টুপিড একটা!!”

বলেই রায়াফ হনহন করে তার গাড়ির দিকে গিয়ে গাড়ির পেছন সিটের ডোর খুলে বসে পরলো। আফনা কিছুক্ষণ সেখানে বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে ফোঁস করে উঠলো,

-“মতিগতি তো বড়লোকের মতোই, তাহলে ব্যবহার এতো জঘন্য কেন? স্টুপিড আমি না আপনি, সাদা ইলিশের প্রসংশাকালা বিলাই বেশি করে যেমন আপনি করসেন। সাহস কতো আমায় স্টুপিড বলে গেলো হাহ! বলি আমি কী তোর বাপের খাই নাকি?”
কিছুক্ষণ ইচ্ছেমতো বকে নিজেই জিহবায় কামড় দিলো।

-“শিট! এই লোক তো আমার অচেনা। কেন যে উল্টো পাল্টা বকবক করলাম ধুর! আমি নিজেই একটা মাথামোটা।”
ভেবেই একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো আফনা।

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here