প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব -১৪+১৫

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১৪)
লাবিবা ওয়াহিদ

আফনা নিশ্চুপ হয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আর আর তার পাশে রায়াফ ভ্রাইভিং করছে এবং আড়চোখে আফনাকে দেখছে। সে যে গাড়ি নিয়ে ভার্সিটির সামনেই বসে ছিলো তা আফনার অজানা। এতক্ষণ আফনার সাথে তার ফ্রেন্ডরা ছিলো বিধায় সে আফনার সামনে আসেনি। কে জানে, হয়তোবা এই আফনার জন্য সে সারাজীবনই অপেক্ষা করতে প্রস্তুত?
আফনা বেচারী ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। যতোই হোক রায়াফ একজন ফেমাস মানুষ! ফেমাস মানুষের গাড়ি আবার পাশাপাশি সিট সত্যিই স্বপ্নের মতোন। রায়াফের কথায় আফনার ভাবনায় ছেদ ঘটলো।

-“এখন থেকে রেগুলার তোমায় ড্রপ করে দিবো!”

আফনা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে রায়াফের দিকে তাকালো। আফনা চোখ বড় বড় করে বললো,

-“মানে?”

-“কানে শুনোনি?”

-“আপনার আবার আমায় নিয়ে কেমন ঠ্যাকা পরলো যে আপনি আমার জন্য রেগুলার খাটবেন?”

-“ড্রাইভিং এ খাটনির কী আছে? জাস্ট তোমায় হেল্প করতে চাইলাম!”

-“ইশ! হেল্প মাই ফুট! হালা, এমনেই কালো টি-শার্ট পরে মাথা গরম করে রাখসিস আবার প্রতিদিন তোর এই চেহারা আমি দেখবো? জিন্দিগিতেও না, তোরে দেখে মরার সখ নাই!” মনে মনে বললো আফনা। মুহূর্তে আবার ভাবলো সে এসব কী ভাবছে? সে কী কোনোরকম ক্রাশ ব্রাশ? নাহ! সম্ভব না কখনোই।

-“কী হলো চুপ করে গেলে কেন?”

-“আমি আপনার সাথে যাবো না!”

-“সেটা নাহয় কালই বোঝা যাবে!” বলেই ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো রায়াফ। এদিকে আফনা পরেছে চিন্তায়। ওর বান্ধুবিরা যদি কোনোভাবে রায়াফের কথা জানতে পারে? তাহলে তো আফনা ফিনিশড!

-“গাড়ি থেকে নামো।”

-“মানে?” চোখ বড় বড় করে বললো আফনা।

-“কেন? আমার সাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি? নামো, তোমার বাসায় চলে এসেছি!”

আফনা বাইরে তাকালো। আফনা নিজের ব্যবহারে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। কী করতে গিয়ে কী করে ফেললো। রায়াফ মুগ্ধ হয়ে আফনার লজ্জামাখা মুখটার দিকে। এই মুখশ্রীতে যেন হাজারো অনুভূতি, অন্যরকম মায়া। ঝাঁঝলঙ্কা তাহলে লজ্জায় লাল হতেও জানে। রায়াফ মনে মনে ভাবলো,

-“এই লজ্জাবতীকেই যে আমার সারাজীবনের মতো চাই। কী আদুরি, তোমার আপত্তি নেই তো?”

আফনা বিনা বাক্যে ডোর খুলে ভোঁ দৌড় দিলো। আফনার বাচ্চামোতে রায়াফ না হেসে পারলো না। মেয়েটা পুরোই পাগলি!

রাতে আফনা ঘুমোতে নিবে ওমনি দেখলো আননোন নাম্বার থেকে তার কল এসেছে। আফনা বিরক্ত হয়ে প্রথমে রিসিভ করলো না। আফনা বালিশ গুছিয়ে কাঁথা টেনে শুতেই আবারও রিং বাজা শুরু। তাও আফনা রিসিভ করলো না। এভাবে কন্টিনিউ চলতে থাকলো। এক পর্যায়ে আফনা চরম বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে দিলো এক ধমক!

-“কান্ড-জ্ঞান কী নেই আপনার? এভাবে রাত-বিরাতে পাগলা কুত্তার মতো কল দিচ্ছেন কেন? আপনি রাত জেগে মশা মারছেন তাই বলে অন্যরাও মশা মারার জন্য বসে আছে বুঝি? ইডিয়েটের দল!”

-“শাট আপ!”

অপর প্রান্তের বিকট ধমকে আফনা চুপ হয়ে গেলো। আফনা বিড়বিড় করে অপরপ্রান্তের লোকটির ১৪ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগলো।

-“কে আপনি যে আমায় এই অসময়ে ডিস্টার্ব করেন?”

-“তো সেটা না জিজ্ঞেস করে পাগলের প্রলাপ বকছিলে কেন? কান্ড-জ্ঞানের অভাব তো তোমার।”

আফনা ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে মুখ বাঁকালো। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে অপর প্রান্ত হতে কেউ বললো,

-“আমি রায়াফ!”

আফনা চোখ বড় বড় করে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো।

-“নাম্বার পেলেন কোথায়?”

-“পাওয়া লাগে না, আপনা-আপনি চলে এসেছে!”

-“মজা নিচ্ছেন?”

-“একদম না, তুমি কি সুইটস নাকি?”

আফনার মুখে হাসি চলে আসলেও সে একদম চুপ হয়ে শুনলো।

পরেরদিনও একইভাবে আফনার পথ আটকে দাঁড়ায় রায়াফের গাড়ি। আফনা একদিনেই এই গাড়িসহ গাড়ির মালিককে চিনেছে। তবে আজ কলি এবং ইরাও ছিলো তার পাশে। কলি তো চোখ বড় বড় করে বললো,

-“কে রে আমাদের পথ আটকালো?” ইরা পাশ থেকে টিটকারি মেরে বললো,

-“হয়তো ভেতরে তোর জামাই আছে!!”

কলি রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকালো। আর আফনা, সে তো নখ কামড়াচ্ছে। একবার গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ইরা, কলিদের দিকে। এদিকে আফনার ফোনে রায়াফ মেসেজের ধুম উড়িয়ে দিচ্ছে। আফনা না পেরে ওদের কিছু একটা বুঝিয়ে দ্রুত রায়াফের গাড়িতে উঠে পরলো। কলি এবং ইরা বেক্কলের মতো আফনার গাড়িতে ওঠা দেখলো। এভাবে প্রতিদিন চলতে শুরু করলো। ইরা, কলি হাজার জিজ্ঞেস করেও আফনার পেট থেকে কোনো কথা বের করতে পারে না। তাদের মূল রহস্য হচ্ছে গাড়ির ভেতর কে থাকে? আফনা কার সঙ্গে বাড়ি ফেরে ব্লা ব্লা ব্লা। এদিকে আফনা আর সইতে না পেরে রায়াফকে বললো,

-“আপনি আর কতদিন আমায় জ্বালাবেন হু? কী সমস্যা কী আপনার, আমায় নিয়ে? সবকিছুর লিমিট থাকে মিস্টার রায়াফ!”

-“সমস্যা থাকলে তোমায় নিয়ে পরে থাকতাম নাকি?”

-“তাহলে কেন এমন করছেন?” রায়াফ ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,

-“এতোকিছু করেও কিছু বুঝলে না? এই তোমার অনার্সে পড়ার নমুনা? বুঝো না আমি কেন এমন করি?”

রায়ফের কথাগুলোতে কী যেন ছিলো, যা আফনাকে শিউরে তুলেছে। সে চোখ বড় বড় রায়াফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফনার মতে, কেউ কাউকে পছন্দ করলে এরকম ডিস্টার্ব করে, রাতে ফোন দিয়ে কথা শুনায় আবার পরেরদিন ঠিকই ড্রপ করে বাসা অবধি পৌঁছে দেয়। রায়াফের তো এসব ছাড়া অনেক কাজ আছে, সে সেগুলা ফেলে কেন আফনার পিছে ঘুরবে? এর মানে কী রায়াফ তাকে পছন্দ করে?
এই কথাটি আফনার মন বললেও তার মস্তিষ্ক বলছে, এতোদিন আফনা যেমন রায়াফকে জ্বালিয়েছিলো তেমনই রায়াফ তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু এখানে সে প্রতিশোধ দেখছে না, সামান্য প্রতিশোধের জন্য নিশ্চয়ই কেউ এতো কেয়ার করে না। এমন নানান ব্যাখ্যার সাথে যুদ্ধ করতে করতে আফনা বাসায় এসে পৌঁছালো। তার মাথায় এখন রাজ্যের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যাওয়ার সময় যে রায়াফকে বাই বলে যাবে সেদিকেও খেয়াল নেই তার!

রায়াফ স্টিয়ারিং এ কনুইয়ের ভর দিয়ে হাতটি গালে রেখে আফনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললো,

-“আহারে আমার আদুরিটা! তার ছোট্ট মাথায় তো আজ আমি রাজ্যের চিন্তা ঢুকিয়ে দিলাম? তবে চিন্তা করিও না আদুরি, তোমায় ইঙ্গিতে নয়, প্রকাশ্যে তোমায় প্রপোজাল দিবো এবং একেবারে আমার বউ করে ঘরে তুলবো! তুমি শুধুই আমার বউ হবে, শুধুই এই রায়াফের বউ!”

আফনার মা বেশ কিছুদিন খেয়াল করেছে তার মেয়ে এক বিশাল সাদা গাড়ি থেকে বাসার সামনে নামে। যা তার মনে অন্যরকম সন্দেহের ঝড় তুলেছে। আজও সে একই ঘটনার সাক্ষী। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মেয়েকে সে সবটা জিজ্ঞেস করবে। যতোই হোক মা তো, মেয়েদের নিয়েই যে বাবা-মা বেশি চিন্তিত থাকেন। মায়ের ভাবনায় ছেদ ঘটলো কলিংবেলের শব্দে। তিনি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বেশ সুন্দরভাবে গিয়ে সদর খুললেন। আফনা তার মায়ের পাশ কেটে ভেতরে ঢুকতেই মা বলে উঠলো,

-“দাঁড়াও আফনা!”

আফনা দাঁড়িয়ে গেলো এবং সে ভাবনা থেকেও বাস্তবে ফিরেছে। আফনা চমকে পিছে ফিরে বললো,

-“বলো, মা। কিছু বলবে?”

-“ব্যাগ রেখে লিভিংরুমে আসো, কথা আছে!”

আফনা খানিক অবাক হলো। জরুরি কথা হলেও তার মা বলতো ফ্রেশ হয়ে আস্তে-ধীরে আসতে কিন্তু আজ ফ্রেশ হওয়ার কথা না বলে ডিরেক্ট ব্যাগ রেখে আসতে বলছে? আফনা অস্ফুট সুরে বললো,

-“কী হয়েছে আম্মু?”

-“ব্যাগ রেখে আসো বলছি!”

বলেই লিভিংরুমের দিকে চলে গেলেন। আফনা বিনা বাক্যে রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে আসলো।

-“হু, এখন বলো কী বলবে?”

-“কার গাড়ি দিয়ে প্রতিদিন আসো তুমি?”

আফনা কিছুটা চুপসে গেলো। মাথা নিচু করে রইলো, কিছু বলার সাহস পেলো না!

-“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি আফনা?”

আফনা এবারও চুপ। মা হালকা ধমক দিতেই আফনা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বললো,

-“রারারায়াফ সানভির গাড়িতে আসি।”

দূরে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনছিলো রিক্তা। যখন রায়াফের কথা শুনলো তার ভেতরটা শীতল হয়ে গেলো। এর মানে সে যা ভাবছে তা-ই ঘটছে?

-“মজা নিচ্ছো? সে একজন সেলিব্রিটি, তোমার সাথে তার কী কাজ? কী ভেবেছো আজেবাজে কথা বুঝিয়ে দিলেই পার পেয়ে যাবে? আজই তোমায় লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি আফনা, তোমার বিয়ের কথা উঠাতে আমায় বাধ্য করো না। এখন নিজের ঘরে যাও!”

বলেই আম্মু হনহন করে কিচেনে চলে গেলো। আফনা ছলছল নয়নে নিজের রুমে চলে গেলো। তার মা তাকে মুহূর্তের মাঝে মিথ্যেবাদী বানিয়ে দিবে সে কখনো কল্পনাও করেনি। আফনার কী লাভ, মাকে মিথ্যে বলে? একসময় তো সে এই রায়াফ সানভিকে সহ্যই করতে পারতো না, আর এখন? নাহ যতটা সম্ভব রায়াফকে এভোয়েড করে চলতে হবে। সে এই বিয়ে নামক ঝামেলায় পরতে চায় না! তখনই তার কাঁধে কেউ আলতো করে হাত রাখলো। আফনা চোখ মুছে পিছে ফিরতেই দেখলো রিক্তা আন্টি। উনি আশ্বাস দিয়ে বললেন,

-“আমি তোমায় বিশ্বাস করি! চিন্তা করো না, ভাবীর মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে।”

আফনা শক্ত পাথরের ন্যায় রিক্তা আন্টিকে জড়িয়ে ধরলো। এই মানুষটাকে তার বড্ড আপন লাগে, সবসময় তার সঙ্গে থাকে এবং সঠিক পরামর্শও দেয়।

রাতে ঘুমানোর সময় আফনা ফোন সুইচড অফ করে শুয়ে পরলো। এদিকে রায়াফ আফনাকে কতগুলো যে কল দিয়েছে বলার বাইরে, আফনার চিন্তায় রায়াফের সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না। ভোরের দিকে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পরে রায়াফ। মেডিসিনের ডোজ তাকে আর জাগতে দেয়নি। ইঞ্জুর্ড হাতের জন্য তাকে এখনো একটি ক্যাপসুল খেতে হয়। সেদিন সে ঘুমের চটে আর আফনাকে নিতে যেতে পারেনি।

ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো মাস্ক পরিহিত একটি যুবক। চোখে সানগ্লাস এবং মাথায় ক্যাপ থাকায় কেউ তাকে চিনতে পারলো না। সে চারপাশে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে আফনাকে দেখতে পেলো। একটি পৈশাচিক হাসি দিয়ে কাউকে কল দিলো শাকিল!

-“রায়াফের প্রেমিককে পেয়ে গেছি পার্টনার, রায়াফের পছন্দ কিন্তু খারাপ না!”

-“এই তোমায় জিজ্ঞেস করেছি রায়াফের পছন্দ ভালো নাকি খারাপ? মূর্খের মতো কথা বলবে না ইডিয়েট! জলদি এর ব্যবস্থা নাও, আমি কিছুদিনের মধ্যেই বিডিতে আসছি!”

-“ওকে পার্টনার। তবে এরে কী করার প্ল্যান করেছো?”

-“ডাই!”

শাকিল হাসতে হাসতে বললো,”ওকে, ওকে।”
অপরপাশের মানুষটি কল কেটে দিলো। শাকিল আবারও হেসে বিড়বিড় করে বললো,

-“ফিক্সিং এর জন্য আমায় সকলের সামনে অপমান করেছিস, তোর পা ধরতে বাধ্য করেছিস! এখন তোকে নিঃস্ব করে আগের চেয়েও দ্বিগুণ টাকার ফিক্সিং করবো। তুই কাঁদবি তোর প্রেমিকের জন্য আর আমি হাসবো বিজয়ের হাসি। এবার মাঠে নয়, সামনাসামনি খেলা হবে। দেখি তুই তোর প্রেমিককে কীভাবে বাঁচাস!”#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১৫)
লাবিবা ওয়াহিদ

একহাতে পাসপোর্ট, টিকিট কাগজ এবং অন্য হাতে ট্রলি টেনে এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছে সোনিয়া। তার চোখে বিশাল সানগ্লাস, চুলগুলোও ছেড়ে দেয়া। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে সে তার বাবাকে কল করলো,

-“ড্যাড! বিডিতে পৌঁছে গেছি!”

-“গুড! এখন কোথায় উঠবে? হোটেল নাকি আমার ফার্মহাউজে!”

-“কোথাও না ড্যাড! শ্বশুড় বাড়ি যাবো!”

বলেই কল কেটে একটি ক্যাব ডেকে রওনা হলো রায়াফের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

রায়াফ বিষন্ন মনে তার দাদীর কোলে শুয়ে আছে। তার চোখদুটো ছলছল করছে। দাদী রায়াফকে সান্ত্বনার বুলি দিয়ে বললো,

-“এভাবে মন খারাপ করে বসে থেকো না নাতি, কিছু অর্জন করতে হলে বাধা আসবেই এভাবে থেমে গেলে তো চলে না?”

-“আর কতো দাদী বলবা? ৩টা দিন ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাড়খাড় হচ্ছি আমি। ও আমায় এভোয়েড করছে। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কীভাবে কী করবো আমি বলো তো? এখন নিজের প্রতি-ই রাগ লাগছে, কেন নাম হলো আমার? কেন এতো মানুষ আমায় চিনে, আমায় জানে? কেন আমি আর ৫টা ছেলের মতো সকলের মাঝে চলাচল করতে পারি না?”

-“কারণ, তুমি স্পেশাল! তাই আল্লাহ তোমায় সকলের মাঝে স্পেশাল করে পাঠিয়েছে। অনেকের আইডলও তুমি নাতি। এভাবে ভেঙ্গে পরিও না, যেভাবে পারো আফনাকে একটা টাইট দেও, ওর ফ্যামিলি আমি সামলে নিচ্ছি!”

এবার রায়াফ মাথা উঁচু করে দাদীর দিকে তাকালো। রায়াফ অস্ফুট সুরে বললো,

-“তুমি পারবে দাদী?”

দাদী চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো সে পারবে। রায়াফের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা গেলো। সে একমুহূর্তে না বসে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ছুটলো।

আফনা ক্যান্টিন থেকে ক্লাসে ফিরছিলো তখনই তাকে কেউ হেঁচকা টানে একটি ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনাটি আফনার মাথার উপর দিয়ে গেলো। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের আগন্তুক তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আফনা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো এবং নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো।

-“কে আপনি? সাহস তো কম না আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন। ছাড়ুন!”

-“হুঁশ…!” খুবই শীতল সুরে বলে উঠলো রায়াফ। এমন শীতল কন্ঠ শুনে আফনা যেন জমে গেলো। কিছু বলতে পারলো না।

-“আমার সাহস অনেক, বুঝলে? এতোই সাহস যে তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি এখনই তোমায় বিয়ে করতে পারি!” রায়াফের এমন কথায় আফনা থমকে গেলো। আফনা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-“আআপ…নি?”

-“তো কাকে আশা করছিলে?”

-“কাউকেই না। আর বিবিবিয়ে ককককরবেন মামামানে ক..কী?” রায়াফ হাসলো আফনার তোতলানো শুনে। হাসিটা খুবই ক্ষুদ্র, খুব। রায়াফ আবারও শীতল কন্ঠে বললো,

-“এত তোতলাচ্ছো কেন হু? মজা করছি নাকি আমি!”

-“সেটা তো আপনি ভালো জানেন!”

-“ওকে, বেশ। তাহলে আজ আমি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিবো!”

-“ন..নাহ! আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন!”

রায়াফ আফনার আরেকটু কাছে গিয়ে বললো,

-“আবার বলো!”

এভার আফনা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলো। আফনার নিঃশ্বাসও ভারী হয়ে আসছে ভয়ে। এখন কী রায়াফ তাকে গলা টিপে মেরে দিবে? এ বিষয় তো অবিশ্বাসও করা যায় না! আফনা মিনমিন করে বললো,

-“আপনার জন্য আম্মু এই প্রথম আমায় অবিশ্বাস করেছে, আমার বিয়ে নিয়ে কথাও উঠিয়েছে তাই প্লিজ দূরে থাকুন!”

রায়াফ আরেকটু আফনার দিকে ঝুঁকে বললো,

-“তোমার মায়ের এতো সাহসও নেই যে আমার পারমিশন ছাড়া তোমায় বিয়ে দিবে। চিন্তা করো না, সব ঠিকঠাক আছে!”

-“এতো নিশ্চয়তা কী করে দিচ্ছেন?”

-“বিকজ আই উইল ম্যারি ইউ! বাহিরে অপেক্ষা করছি, ক্লাস শেষে চলে এসো!!”

বলেই এক অপ্রস্তুত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো রায়াফ। অতঃপর সে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আফনা কপালে হাত দিয়ে সেখানেই পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার কপালটা যেন বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আছে। তার শিউরে উঠায় ওষ্ঠ জোড়া মৃদ্যু কাঁপছে। তার মনে অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনা আসছে। আফনা কাঁপা গলায় মিনমিন করে বললো,

-“ডি ডি ডিরেক্ট বি বি বিয়ে? মানুষ ফাস্ট হয় জানতাম তাই বলে এতো? আচ্ছা আমি কেন তাকে এসব করতে বারণ করলাম না? কেন প্রতিবাদী হতে পারলাম না? উনি এতো বড় মাপের মানুষ হয়ে কেন আমার মতো সাধারণ মানুষকে..? আর পরিচয়ও যে সবে ৬ মাসের!!”

সোনিয়া অনেকক্ষণ রায়াফের বাড়িতে অপেক্ষা করেও যখন রায়াফকে দেখলো না সে রেগেমেগে রায়াফের রুমে চলে গেলো। তার ধারণা কাজের লোকগুলি তাকে মিথ্যে বলছে। সে রায়াফের রুমে গিয়ে অনেক খুঁজেও রায়াফকে পেলো না। এর মানে কী সত্যিই রায়াফ বাড়িতে নেই? সোনিয়া রায়াফের বিছানার বসতে নিবে ওমনি জিনি কোথা থেকে এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। জিনিকে দেখে সোনিয়ার ভয়ে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগান। এই একটা কুকুরই বারবার তাকে ঝামেলায় ফেলেছে। সোনিয়া দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিয়ে জিনির দিকে তাকিয়ে বললো,

-“হেই ডগ! হুঁশ হুঁশ! এটা আমার রায়াফের রুম সো আমি এখানে থাকবো, তুই সর এখান থেকে। হুঁশ হুঁশ!”

বলে তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। জিনিকে আবারও কুকুর বলায় জিনি ক্ষেপে গেলো। সে গিয়ে সোনিয়ার হাঁটু অবধি পরা টপসটা দাঁত দিয়ে টানতে লাগলো। সোনিয়া চিৎকার করে তার টপস ছাড়াতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। একপর্যায়ে সোনিয়ার টপসের অনেকাংশ জিনি ছিঁড়ে ফেললো। সোনিয়া রেগেমেগে এক লাথি দিতে গেলেই জিনি তার পেছন দুই পা উঁচু করে সোনিয়াকে ধাক্কা দিলো যার ফলে সোনিয়া মেঝেতে লুটিয়ে পরলো।

আফনা আজ ভয়ে ভয়ে বাসায় প্রবেশ করে দেখলো এক বৃদ্ধ তাদের লিভিংরুম ছেড়ে উঠছে। ওনার গেটআপে বেশ আভিজাত্য ভাব ফুটে উঠেছে। তার সামনেই আফনা মা হাসিমুখে তাকে আরও কিছুক্ষণ বসতে বলছে। বৃদ্ধ মহিলা সামনে এগোতেই আফনাকে দেখতে পেলো। উনি মুচকি হেসে আফনার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“তুমিই কী আফনা?”

আফনা তার মায়ের দিকে তাকালো। আম্মু তাকে ইশারায় কিছু বললো। আফনা সেসব বুঝতে পেরে নম্র সুরে বললো,

-“আসসালামু আলাইকুম, জ্বী। আমি-ই আফনা!”

-“মাহশাল্লাহ!”

বলেই থুঁতনিতে হাত রেখে চলে গেলেন উনি। উনি চলে যাওয়ার পরপর আম্মু আফনার দিকে এসে আফনার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,

-“তুই বড়ই ভাগ্যবতী রে মা!”

-“হঠাৎ এসব বলছো কেন? আর উনি কে?”

-“উনি তোর এক দাদী হন, আর এমনিই বললাম। এখন যা ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার বাড়ছি।”

আফনা মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। সে যেন আজ শূন্যে ভাসছে। তার সাথে কী ঘটছে না ঘটছে আফনা কিছুই বুঝতে পারছে না।

পরেরদিন আফনা ব্যাগে বই ভরছিলো ভার্সিটির জন্য। তখনই আম্মু এসে বললো,

-“তুই সেদিন বলেছিলি না, তুই রায়াফ সানভির সাথে বাড়ি ফিরিস? আজ তুই আমায় প্রমাণ দিবি। তুই আজ রায়াফ সানভিকে বাসায় নিয়ে আসবি। যদি আনতে পারিস তাহলে মানবো আর যদি না পারিস তাহলে মানবো না!”

আফনা খুশি হয়ে বললো,
-“ঠিক আছে আনবো। আমি প্রমাণ করে দিবো তোমার মেয়ে মিথ্যেবাদী না!”

বলেই আফনা ব্যাগ নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
ভার্সিটি ছুটির পর গাড়িতে রায়াফ আড়চোখে বারংবার আফনার চিন্তিত মুখশ্রী খেয়াল করছে। অবশেষে কৌতুহল দমাতে না পেরে রায়াফ বললো,

-“এমন চিন্তিত লাগছে কেন তোমায়?”

-“আম্মু বলেছে আপনাকে যদি বাসায় নিয়ে যাই তাহলেই আমার কথা বিশ্বাস করবে নয়তো না!”

-“ও এই ব্যাপার? তা এই সামান্য ব্যাপারে এতো আপসেট হওয়ার কী ছিলো? শ্বাশুড়িকে বলে দিও শ্বশুড়বাড়িতে যাওয়ার জন্য এই রায়াফ দুই পায়ে রাজি!”

-“মোটেও আমার আম্মু আপনার শ্বাশুড়ি নন! তাই ফাউ চিন্তা বাদ দেন!”

রায়াফ হাসলো এবং গাড়ি ঘুরিয়ে আফনার বাসার দিকে চলে গেলো।

-“কী ভাবী আজ আপনাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে!”

-“আজ আমি অনেক খুশি ভাবী…!” আফনার মা পরেরটুকু বলার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো। আফনার মা রিক্তা আন্টিকে বসতে বলে বললো,

-“আপনি বসুন, আমি দেখি গিয়ে হয়তো আফনা চলে এসেছে।”

-“ঠিক আছে যান!” বলেই মুচকি হাসলো।

আফনার মা গিয়ে সদর দরজা খুললেন। আফনার পাশে দাঁড়ানো লম্বা করে ছেলেটাকে দেখে উনি বিস্মিত হলেন। কখনো কল্পনাও করেননি বাস্তবে এই রায়াফকে সে দেখতে পারবেন তাও একমাত্র তার মেয়ের কারণে। আফনা তার মায়ের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

-“ও আম্মু, ভেতরে ঢুকতে দিবে না?” আফনার মায়ের ধ্যান ভাঙলো এবং ব্যস্ত হয়ে বললো,

-“দুঃখিত আসলে বুঝতে পারিনি, এসো বাবা ভেতরে এসো।” রায়াফ মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো। রিক্তা লিভিংরুমে বসেই বাইরের মানুষের উপস্থিতি টের পেলো। সে উঠতে নিবে তখনই রায়াফসহ আফনার মা প্রবেশ করলো। রায়াফ এবং রিক্তার একমুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেলো। দুজনের দৃষ্টিই নির্বাক, স্থির একে অপরের পানে। রিক্তা অস্ফুটে সুরে বলে উঠলো,

-“রায়ু!”

রায়াফও অস্ফুট সুরে বলে উঠলো, “মা!”

আফনা এবং তার মা দুজনেই হতবাক হয়ে গেলো। এতো বছর পর রায়াফের মুখে “মা” ডাক শুনতে পেয়ে তার চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল পরতে শুরু করলো। রায়াফের কালো দিনগুলির কথা মুহূর্তেই মনে পরে গেলো। তার চেহারার ব্যাকুলতা ভাব নিমিষেই ক্রোধে রূপান্তরিত হলো। সে তার রাগ দমাতে না পেরে তৎক্ষণাৎ লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে চলে গেলো। রিক্তা রায়াফকে অনেকবার পিছু ডাকলো কিন্তু রায়াফ একবারের জন্যেও পিছে ফিরে তাকায়নি। ঘৃণা করে সে এই মানুষটাকে, চরম ঘৃণা!
রিক্তা তার কান্না থামাতে না পেরে মেঝেতে বসেই কেঁদে দিলো। এদিকে আফনা এবং আফনার মা কিছুতেই কিছু বুঝতে পারছে না। রিক্তা মিনমিন করে বলছে,

-“আমি আমার স্বামীর খুনি নই, তোর বাবার খুনি নই, বিশ্বাস কর। আমি কারো সাথে পালাইনি, আমার পৃথিবী যে তোকে ঘিরেই!”

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here