প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব -১২+১৩

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১২)
লাবিবা ওয়াহিদ

-“রায়াফ তখন এগারো বছর বয়সী ছিলো। জেম্মা তখন গোপনে পরকীয়া চালিয়ে গেছে এক খ্রিস্টান লোকের সাথে। চিন্তা করতে পারছো? পরকীয়ার ছয় মাসের মধ্যেই জেম্মা সেই লোকটির সাথে পালিয়ে গেলো। একবারও চিন্তা করেনি তার ছোট ছেলেটির কথা। কতরাত রায়াফ মা, মা করে কান্না করেছে, বাবা আর দাদী ছাড়া তার পাশে কেউ ছিলো না। জেঠু রায়াফকে বুকে জড়িয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতেন। সে যে সহ্য করতে পারতেন না ছেলের এই অবস্থা। রায়াফ একা হয়ে গেলো, কারো সাথে মিশতো না একমাত্র তার বাবা ছাড়া। দুই বছর বাদে জেঠুর বিজনেস আরও জমে গেলো, সেরা বিজনেস ম্যানদের তালিকায়ও চলে আসে। তার বিজনেস চলাকালীন সময় সে বিজনেস নিয়ে এতোই ব্যস্ত থাকতো যে চেয়েও রায়াফকে সময় দিতে পারতো না। সেও ছোট্ট রায়াফ তখন ক্রিকেটের প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে শুরু করে, অতঃপর ক্রিকেটটাকেই সে তার ধ্যান, জ্ঞান করে ফেললো। সেদিন রায়াফ বিপিএলে খেলছিলো, তখনো জাতীয় দলে সে যায়নি। ঢাকা থেকে খেলে জিতে বাসায় ফিরতেই শুনলো জেঠু ডেথ! তাকে কেউ খুন করে দিয়েছে। সে কেউ না “জেম্মা!” জেম্মা লোক লাগিয়ে তাকে খুন করেছে তাও কিছু সম্পত্তির লোভে। জেঠু সম্পত্তি দেয়নি দেখে… তখন বুঝে নাও এই ছেলেটার কী অবস্থা হয়েছিলো। এতো বড় বড় ধাক্কা রায়াফকে এক কঠিন মানুষে রূপান্তরিত করেছিলো। সে কারো সাথে মেশা একদমই পছন্দ করে না, প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কথার সাথে এই রায়াফ পরিচিত নয়। বিলিভ মি মন থেকে চাই আমার এই ভাইটা যেন তার এই আঁধার থেকে বেরিয়ে আসে, ওর তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়াটা আমি একদমই সহ্য করতে পারছি না!”

আফনার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে। যেই মানুষটার সাথে তার এতো ঝগড়া-লড়াই সেই মানুষটার জীবনই এতটা বিষাদময়? আর সে কি না ভেবেছিলো এই মানুষটা অহংকারী? আমরা মাঝে মধ্যে ভুলে যাই কারো খারাপ বা চুপ থাকার পেছনেও একটা গল্প থাকে, আমরা তা পেছনের গল্পটি না জেনেই তাদের ভুল বুঝি, আজেবাজে পদক্ষেপ নেই। আফনা অনুতপ্তে মাথা নিচু করে ফেললো। তবে সে এইটুকুনি বেশ ভালো বুঝলো রায়াফ বেশ স্ট্রং একজন মানুষ। আফনা চোখ মুছে ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,

-“আপনি বাড়ি যান আমি ওনাকে বাড়ি নিয়ে যাবো!!”

ফাহান ঘাড় ঘুরিয়ে আফনার দিকে তাকালো।

-“ভরসা করতে পারেন আমায়!” আশ্বস্ত করে বললো আফনা।

ফাহান আর দাঁড়ালো না চলে গেলো। আফনা ধীরপায়ে রায়াফের কাছে গেলো। রায়াফের কাঁধে আলতো হাত রাখতেই রায়াফ পিছে ফিরে তাকালো। আফনাকে দেখে রায়াফ তৎক্ষনাৎ আফনাকে আঁকড়ে ধরলো আর আফনা চোখ বড় বড় করে ফেললো। বিষয়টা যেন আফনার মাথার উপর দিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠেলে যে সরিয়ে দিবে তাও পারছে না। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। রায়াফ আবার নিজেই আফনাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। আফনা বিনাবাক্যে কিছু না বলেই দৌড়ে ঘাট থেকে উঠে গেলো।
আফনা চলে যেতেই রায়াফ একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো! আকাশের পানে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

-“মনের প্রশান্তির জন্যে হলেও তোমায় চাই আফনা। তুমি-ই আমার এই সাদা-কালো জীবনকে রঙিন করতে পারো, সাহায্য করবে না?”

এভাবেই বিয়ে সময়গুলো পার হলো। নিহা এলো ইসহাকের বউ হয়ে। নিহাকে হাসিমুখে বরণ করলো ইসহাকের মা। আফনা ব্যতীত এখনো কেউ জানে না দুজনের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিলো! আফনা এখন রায়াফের প্রতি অনেকটাই সাবধান। সে এখন আর রায়াফকে অসম্মান করে না বরং শ্রদ্ধা করে। এমন শক্ত মানুষদের সে কখনোই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না।
“বিবেকবান কখনো ভুল কাজে লিপ্ত হয় না।”
~লাবিবা ওয়াহিদ

আফনা চুপিচুপি রায়াফের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। আগামীকালই সকলে ঢাকা চলে যাচ্ছে। আর হয়তো তাদের দেখা হবে না। কেন যেন আফনার বেশ খারাপ লাগছে। আফনা রায়াফের ঘরে কিছুটা উঁকি দিয়ে দেখলো রায়াফ তার লাগেজ গোছাচ্ছে। আর তার মহামান্য কুকুর বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে জিহবা বের করে লেজ নাড়ছে। এছাড়া তার যেন কোনো কাজই নেই।জিনি দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো। আফনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। তখনই রায়াফ পিছে ফিরে আফনাকে সরে যেতে দেখে ফেললো। রায়াফ স্মিত হেসে বললো,

-“লুকানোর প্রয়োজন নেই। কিছু বলার থাকলে ইউ ক্যান সে।”

আফনা চোখ-মুখ খিঁচে ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। আফনার মুখশ্রী দেখে রায়াফের মধ্যে শীতল হাওয়া ছেঁয়ে গেলো। তবে রায়াফ উপর দিয়ে স্বাভাবিক। আফনা চোখ মেলে আমতা আমতা করে বললো,

-“একচুয়ালি আজই তো শেষ রাত এখানে, তাই ভাবছি ছাদ থেকে ঘুরে আসবো। আপনি কী আমার সাথে আসবেন?”

-“কেন একা যেতে ভয় পাও!”

আফনা নিজের রাগ দমিয়ে রেখে বললো, “জ্বী না! আজ আকাশের বুকে চাঁদের দেখা মিলেছে সাথে পরিবেশটাও সুন্দর। আপনি যেন এরকম পরিবেশ মিস না করেন তাই আপনাকে বলেছি। গেলে আসেন নয়তো বসে থাকেন!”

বলেই আফনা ঘুরে যেতে নিবে ওমনি রায়াফ পিছু ডাকলো!

-“রেগে চলে যাওয়া লাগবে না, আমি আসছি।”

আফনা থেমে গেলো এবং তার ওষ্ঠজোড়া প্রসারিত করলো। রায়াফ লাগেজের চেইন লাগিয়ে জিনিকে নিয়ে বের হতে নিলে আফনা থামালো!

-“এই কুকুরটাকে না নিয়ে গেলে হয় না?”

“কুকুর” বলাতে জিনি আফনার দিকে তেড়ে আসতে নিলে রায়াফ থামালো। আফনা তো সেখানেই ভয়ে কাচুমাচু হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই কুকুর জাতকে আফনা আজীবন ভয় করে এসেছে। রায়াফ আফনার দিকে তাকিয়ে নম্র সুরে বললো,

-“ওর নাম জিনি তাই ভুলেও কুকুর বলবেন না। আমার জিনি পছন্দ করে না।”

-“কুকুরটা কী বিদেশী?”

রায়াফ মাথা নাড়ায় যার অর্থ “হ্যাঁ!” রায়াফ জিনিকে রেখেই আফনার সঙ্গে ছাদে চলে গেলো। ফেমাস অলরাউন্ডার আফনার পাশে ভাবতেই আফনার ভেতরটা বারংবার কেমন কেমন করে উঠছে। সে কখনো কল্পনা করেনি এই মানুষটার সাথে তার লড়াই হবে, ঝগড়া হবে, পাশাপাশি হাঁটা হবে।

নিস্তব্ধ ছাদে পোকার ডাক এবং রাত জাগা পাখিরই গুনগুন কানে ভাসছে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো সাড়ে ১০টার বেশি বাজছে। বিশাল আকাশের বুকে থালা সমান চাঁদটা এদিকেই মুখ করে আছে। বাদলা দিনে চাঁদ খুব একটা দেখা যায় না। আফনা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাত চুলকাচ্ছে এবং রায়াফ আফনার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে। রায়াফ মনে মনে বললো,

-“গল্প-কবিতায় শুনতাম ছেলেরা তাদের প্রেমিকাকে জমিনের বুকের চাঁদের সাথে তুলনা করতো, তাকে আপন করে নিতো। এতদিন বিশ্বাস না করলেও আজ বাধ্য হচ্ছি, আমারই সামনে আল্লাহর দেয়া আরেক চাঁদ! তোমার এই চাঁদমুখী রূপ যে আমায়
কতো ঢেউয়ের ন্যায় ভাসাবে জানি না! তুমি কী বুঝবে আমায়, আদুরী!”

-“আচ্ছা তোমার নাম কী?”

রায়াফের এমন কথা শুনে আফনা চোখ বড় বড় করে রায়াফের দিকে তাকায়। কেমন ছেলে আজ অবধি নামটাই জানে না? তাহলে এতদিন কার সাথে লড়লো?”

-“কোথায় হারালে?”

-“নাম জানেন না?”

-“পুরো নাম জিজ্ঞেস করেছি!”

-“ওহ!” বলেই আফনা চাঁদের দিকে তাকালো। অতঃপর বললো,

-“আফনা লিলি!”

-“শাপলা পছন্দ করো?”

-“নাহ!”

-“তুমি তো লিলি, তো তুমি কেমন লিলি যে ন্যাশনাল লিলিকে লাইক করো না?”

-“লিসেন! আমি লিলি হলেও মানুষ, কোনো ফুল নই ওকে? আর সকল মানুষেরই ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ রয়েছে, আমার বেলায় তো ব্যতিক্রম হবে না?”

-“তো তোমার কী ফুল পছন্দ শুনি?”

-“বেলী!”

রায়াফ মুগ্ধ হয়ে তার আদুরীর দিকে তাকালো। তখনই তার মনে হলো আজই সে তার আদুরীর সাথে থাকবে, আগামীকাল থেকে আলাদা! ভাবতেই রায়াফ মনমরা হয়ে গেলো। রায়াফের মনের ব্যথা যেন আকাশে ভেলার ন্যায় ভেসে বেড়ানো মেঘগুলি উপলব্ধি করলো, জোর তারা গর্জন দিয়ে উঠলো। আফনা কিছুটা চমকে রায়াফের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“আমি তাহলে ওই বাড়িতে যাই, মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে!!”

বলেই দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলো আফনা। রায়াফ আফনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“এই প্রেমময়ী বর্ষণের শুভ্র ভোরে অতিথি পাখির ন্যায় আমায় জীবনে প্রবেশ করেছিলে তুমি, এই প্রেমময়ী বর্ষণেও যে শুধু তোমাকে চাই। আমার প্রেমময়ী বর্ষণে তুই, শুধুই তুই! তুমি বলো তো কী করে আমাদের গল্পের এতো জলদি সমাপ্তি ঘটাই? আমার জীবনের ইতি অবধি তোমায় চাই। ভালোবাসি, আদুরী!”#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১৩)
লাবিবা ওয়াহিদ

আধঘন্টা হয়ে গেলো আফনা এখনো আসছে না। এদিকে ইসহাক এবং নিহা চিন্তায় চিন্তায় শেষ। আদনান গাড়িতে বসে গেমস খেলছে আর ইসহাক আফনার ফোনে কল দেয়ার ট্রাই করছে, কিন্তু কল ঢুকছে না। বাকিরা তাদের গাড়ি করে চলে গেছে অনেক আগেই, আফনা এবং আদনান কিছুদিন ইসহাকদের বাড়িতে থাকবে তাই ইসহাকের সাথেই ওরা যাবে কিন্তু আফনারই খবর নেই। নিহা ইসহাকের কাঁধে আলতো হাত রেখে বললো,

-“ওর কোনো খবর পেয়েছো?”

-“না। কল ঢুকছে না, এই শেষমুহূর্তে কোথায় গেলো বলো তো? আমাদের একবারএ বলে গেলো না? ওদিকে মা বারবার কল করছে, রিসিভ করলে বলে তাদের পেছনে আমাদের গাড়ি কেন দেখছে না? আমি এটা সেটা বলে তাদের ম্যানেজ করছি!”

-“চিন্তা করিও না ইসহাক আফনা চলে আসবে এখনি, দেখো!”

কিছু সময় অপেক্ষা করার পর দেখলো আফনা এক মহিলাকে ধরে নিয়ে আসছে এদিকেই। মহিলার এক হাত আফনা আফনার কাঁধে। হাঁটার গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মহিলাটি দুর্বল অথবা অসুস্থ! আফনা তারে ধীরে-সুস্থে নিয়ে গিয়ে ইসহাকদের দিকে এলো। আফনা ইসহাকের উদ্দেশ্যে বললো,

-“সরি ভাইয়া, দেরী করার জন্য। এতিমখানা থেকে বের হতেই ওনাকে মাথা ঘুরিয়ে পরে যেতে দেখলাম, আন্টিটা ভীষণ দুর্বল৷”

-“তো দাঁড়িয়ে আছো কেন আফনা? ওনাকে জলদি গাড়িতে বসানোর ব্যবস্থা করো!”

-“হ্যাঁ ভাবী!” অতঃপর আফনার সাথে নিহাও মহিলাকে ধরে গাড়ির সিটে বসালো। মহিলা দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে। ইসহাক সামনের সিট থেকে কিছু খাবার এবং পানি নিয়ে মহিলাকে দিলো। আফনা তাকে পরম যত্নে খাইয়ে দিলো। ইসহাক চিন্তিত সুরে বললো,

-“ওনাকে এখন কী করবি? আমরা তো ঢাকার উদ্দেশ্যে এখনই রওনা হবো!”

আফনা মহিলার মুখ মুছে দিয়ে করুণ দৃষ্টি মহিলার দিকে নিক্ষেপ করে বললো,

-“আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবো!”

ততক্ষণে মহিলা আরামে শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে তাই ওদের কথোপকথন তার কানে লাগেনি! ইসহাক বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আফনার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট সুরে বললো,

-“মাথা খারাপ হয়েছে তোর?”

-“কেন হবে? আমি যা বলেছি তাই হবে। আগেরদিনও দেখেছি উনি খাবারের জন্য এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। আজ তো দুর্বলতায় ওনার এ অবস্থা। প্লিজ ভাই, আমি ওনাকে আমাদের সাথেই নিয়ে যাবো। ওনাকে এখানে অবহেলিত অবস্থায় রেখে গেলে আমি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না!”

আফনার জেদের কাছে হার মেনে ইসহাক রাজি হলো মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। নিহাও বেশ খুশি হয়েছে তার ননদের এমন কর্মে। আফনা জেদ না ধরলে সে নিজেই জেদ ধরে বসে থাকতো। ইসহাক ড্রাইভিং সিটে বসলো। আফনা মহিলার সঙ্গে পেছনের সিটে বসলো আর নিহা ইসহাকের পাশে। মহিলার অপরপাশে আদনান একমনে গেম খেলেই চলেছে। অবশেষে ওরা রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।

বাসায় আসার পর একমুহূর্তও রায়াফের কাটছে না আফনা বিহীন! বারংবার সকল স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। রায়াফ আর সহ্য করতে না পেরে তার দাদীর কাছে চলে গেলো। এই মানুষটাই তার সুখে-দুঃখে বেস্ট পরামর্শ দেয়।

-“কী নাতি, কেমন বেড়িয়েছো? এই বুড়ির কথা মনে পরেছে?” পরম আদরে রায়াফের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো।

-“ভালো, দাদী। আর তোমাকে ভুলি কী করে বলো? তুমি তো আমার চোখের মনি!”

-“তা হৃদয়ের মণির দেখা মিলেছে নাকি আগের মতোই?”

রায়াফ হাসলো। অদ্ভুত একটি হাসি যে হাসি দাদী এই অবধি রায়াফের ঠোঁটে দেখতে পায়নি। দাদী বিস্ফোরিত চোখে রায়াফের দিকে তাকালো।

-“আমি যা ভাবছি…”

-“ঠিক ধরেছো দাদী, তোমার সাদা-কালো নাতি রঙিন দুনিয়ার সন্ধান পেয়েছে। এর মূল উৎস এই বিয়েকে কেন্দ্র করেই!”

দাদীর আনন্দ যেন ধরে না। খুশিতে তার চোখের কোণ ভিঁজে গেছে। অবশেষে এই দুঃখের মাঝে এক টুকরো সুখ খুঁজে পেয়েছে তার আদরের নাতী। নয়তো সে যে কখনোই বুঝাতে পারতো না, পাঁচ আঙুল যেমন সোজা হয় না তেমনই দুনিয়ার সব মেয়ে এক হয় না! দাদী আঁচল দিয়ে আলতো করে ভিঁজে কোণ মুছে বললো,

-“দেখতে কেমন!”

-“পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ আরেক চন্দ্র।”

দাদী মুগ্ধ হয়ে তাকালো তার নাতীটার দিকে। ১৫ দিনে নাতীর এতটা পরিবর্তন একদমই আশা করেনি। মনেপ্রাণে বারংবার আল্লাহ’র নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করছে ওই মেয়েটির জন্য যে কিনা তার নাতীকে সম্পূর্ণ রূপে বদলে গেছে। সে বিশ্বাস করতো একদিন কোন এক মেয়েই পারবে তার নাতীর জীবনটা রাঙিয়ে তুলতে। দাদী সিদ্ধান্ত নিলো আর দেরী করবে না। ছেলেটার জীবনে আর কোনো নতুন ঝড় সে আসতে দিবে না। অনেক সহ্য করেছে আর নয়। দাদীর ভাবনার মাঝে রায়াফ হেসে বলে,

-“জানো দাদী, এই এক মেয়ে যে কিনা আমাকে পছন্দ করে না। ভাবতে পারছো? আমাকে সামনে থেকে দেখেও কোনোরকম রিয়েক্ট করেনি যেন আমি সাধারণ কেউ। অন্য কোনো মেয়ে হলে তো গায়ে ঢলে পরতো, বাট শি ইজ ডিফারেন্ট দাদী। দ্যাট ওয়াজ ভেরি হাই এক্সপারিয়েন্স ইন মাই হোল লাইফ! আমি কখনো আশাও করিনি কেউ এই রায়াফ সানভির বিরুদ্ধে বদনাম ছড়াবে আমারই সামনে আবার আমার সাথে ঝগড়াঝাঁটি করবে!”

-“কী সাংঘাতিক কথাবার্তা! আসলেই নাকি? তা আমার নাতী কীভাবে দুর্বল হলো শুনি?”

রায়াফ হেসে প্রথম থেকে সবটা তার দাদীকে খুলে বললো। দাদী সবটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ হাসলো। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,

-“হায়রে, বেশ দুষ্টু তো দেখছি। এখন আমার নাত বউকে কবে ঘরে তুলবি শুনি?”

-“খুব শীঘ্রই দাদী, তার আগে আমি ওকে কিছুটা সময় দিতে চাই!” স্মিত হেসে বললো রায়াফ।

-“ঠিক আছে বেশ, তবে বেশি দেরী যেন না হয়!” বলেই দাদী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো,

-“তুই ওর মতো করে নিজের মতো ওকে সময় দে এদিক দিয়ে আমিও আমার কাজ সারবো। যা ব্যবস্থা নেয়ার আমি-ই নিবো। পূর্বের ন্যায় ভুল এবার আর নয়!”

-“বিডিতে যাচ্ছো নাকি মাই ডটার?”

-“ইয়াহ, ড্যাড। যাচ্ছি কিছুদিন পর।”

-“আই থিংক ইওর…”

-“তোমার ধারণা ঠিক, লন্ডনে ওকে আপন করতে পারিনি তো কী হয়েছে? আমি নিজে যাবো বিডিতে। রায়াফ ইজ মাইন, অনলি মাইন। যে আমাদের মাঝে আসবে তাকেই শেষ করে দিবো আমি!”

-“দ্যাট’স লাইক এ গুড গার্ল! এই না হলে আমার মেয়ে? আই প্রাউড অফ ইউ মাই ডটার! তবে হ্যাঁ, যা ভেবে ভেবে চিন্তে করবে বুঝলে?”

-“আই নো দ্যাট ড্যাড! আমি আমার মিশনে সাকসেস হবোই!”

বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। রিক্তা(মহিলা) ওনাকে নিয়ে আফনা তার বাসায় ফিরেছে। মা, বাবাকে ম্যানেজও করেছে মহিলাকে রাখার জন্য। রিক্তা মনমরা হয়ে জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। আফনা ওনার ঘরে এসে তাকে বিষন্ন দেখতে পেয়ে এগিয়ে তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো। রিক্তা চমকে পিছে ফিরে তাকালো।

-“আপনার কী মন খারাপ আন্টি?”

-“না, ঠিক আছি আমি!”

-“আসুন বসে গল্প করি!”

রিক্তা ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করলো এবং বললো,”অবশ্যই!”
বলেই আফনাকে নিয়ে বিছানায় বসলো।

-“আন্টি একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কী আপনি মাইন্ড করবেন?”

-“না বলো!”

-“আপনার ব্যবহারে আমি প্রতিবারই একটা বড়লোক ভাব খেয়াল করি, আপনার মতো মিষ্টি মানুষ তো ওভাবে পথঘাটে হাঁটে না। ইভেন আপনার চরণ ধ্বনিও একদম শহুরে! আপনি কী আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন? কিছু মনে করবেন না আন্টি, আসলে আমি সেভাবে কিছু বলতে চাইছি না। শুধু সন্দেহ হলো তাই বললাম!”

রিক্তা স্মিত হাসলো।

-“তোমার মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তুমি আমায় অনেক সাহায্য করেছো এবং তুমি মানুষটাও উদার। স্বল্প নয়, অনেকটা। তাই এতটুকু ধারণা দিচ্ছি, তোমার ভাবনাগুলো ঠিক।”

-“তাহলে গ্রামে এতিমখানার সামনে এভাবে অভাগার মতো পরে রইতেন কেন? আপনার পরিবার কোথায়?” অবাক হয়ে বললো আফনা। রিক্তা একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“কারণ, ওটাই আমার আশ্রয়স্থল ছিলো। আর আমার পরিবার থেকেও নেই!”

রিক্তার কথাগুলো আফনার মাথার উপর দিয়ে গেলো। আফনা ভ্রু কুচকে বললো,

-“মানে?” রিক্তা আফনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

-“কিছু না জানার মধ্যেও সত্য থাকে, আবার কিছু মিথ্যের মাঝেও গল্প থাকে।”

~লাবিবা ওয়াহিদ।

আজ থেকে আফনা আবারও ভার্সিটি যাওয়া শুরু হলো। আফনা ভার্সিটি থেকে একা একাই ফিরছে। কলি এবং ইরা বাস পেয়ে চলে গেছে কিন্থ আফনার এই কাঠফাটা রোদে হাঁটতে হচ্ছে। কারণ একটাই আজ সে ভাড়ার টাকা আনতেই ভুলে গেছে। ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে একটি নিরব স্থানে আসতেই একটা গাড়ি তার সামনে এসে ব্রেক কষলো। আফনা ভয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে গেলো। তার চোখজোড়াও অটোমেটিক বড় হয়ে গেছে। এরকম আকস্মিক ঘটনা তার সাথে কখনোই হয়নি। তখনই জানালার কাঁচ নেমে গেলো। ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটিকে দেখে আফনা আরও অবাক হলো।

-“আ..আপনি?”

-“হু, কেন চমকে গেলে?” সানগ্লাস খুলতে খুলতে বললো রায়াফ।

-“না মানে হ্যাঁ। আপনি এখানে কেন আর পথ কেন আটকালেন?”

-“এদিকে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তোমায় দেখে গাড়ি থামালাম!”

-“তাই বলে এভাবে?”

-“হুম। ভার্সিটি থেকে ফিরছো বুঝি?”

-“হ্যাঁ!”

-“এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বকবকই করবে নাকি গাড়িতে উঠে বসবা? এদিকের মানুষ আমায় দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। জলদি গাড়ি উঠবো!”

আফনা চোখ বড় বড় করে বললো,”কেন উঠবো, আশ্চর্য!”

-“তোমায় বাসায় পৌঁছে দিবো। একলা একটা মেয়েকে একা ফেলে চলে যেতে তো পারি না?”

-“আমি আপনার সাথে যাবো না!” যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও অস্বস্তি থেকে বললো আফনা!

-“ওয়েল!” বলেই রায়াফ চোখে সানগ্লাসটা লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আফনার দিকে যেতে লাগলো। আফনা ভয়ে চেঁচিয়ে বললো,

-“কী করছেন কী?”

-“গাড়িতে না উঠলে এভাবেই তোমায় পিষে দিয়ে চলে যাবো!”

–“ওকে, ওকে। আমি উঠছি, গাড়ি থামান!”

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here