[#এলার্ট- প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
|১|
‘ শিক্ষক মানুষ হয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে এসেছেন! তবু কিনা নিজের জন্য পাত্রী দেখতে! কী ব্যাপার বলুন তো মশাই, মাথায় ব্যামো ট্যামো আছে নাকি? ‘
সম্মুখের ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি ছুঁড়ল মাম্পি। গাঢ় কাজলের প্রলেপ দেয়া চোখদু’টিতে তার গগনচুম্বী বিস্ময়। গাঢ় সাজ ভর্তি মুখশ্রীতে আজ অনন্ত কৌতূহল। ভদ্রলোকের নাম, হীরক মাহমুদ। হাইস্কুল মাস্টার। অনুমান করা যায় বয়স ত্রিশের কোঠায়। লম্বাটে দেহ, চওড়া বুক, শ্যামলাটে দৃঢ়, শান্ত মুখ। শক্ত চোয়াল দ্বয় ভর্তি খোঁচা, খোঁচা দাঁড়ি বেশ আকর্ষণীয়। পুরো ঠোঁটজোড়ায় জ্বলন্ত সিগারেটে ধরেছে বহুদিন। ঠোঁটদ্বয়ের কালচে তা আভায় স্পষ্টই বোঝা গেল। লোকটি দু’দিন আগে এই পল্লীতে এসে মাম্পিদের সর্দারনিকে নয় লাখ টাকা দিয়ে গেছে। বিনিময়ে চাই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে বেষ্টিত প তিতা পাত্রী। যাকে বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে নিজের ঘরের বউ করে নিয়ে যাবে মাস্টার হীরক মাহমুদ।
মাম্পি সদ্য তেইশে পা দিয়েছে। রূপে, গুণে সে যেন মহিমান্বিতা। জন্মসূত্রেই প তিতা সে৷ তার মায়ের বয়স যখন ছয় বছর তখন তাকে অপহরণ করা হয়। মায়ের ভাষ্যে যিনি মাকে অপহরণ করেছিলেন তিনি মায়ের আপনজনদের মধ্যেই একজন। কিন্তু সম্পর্কে কী হন মনে নেই মায়ের। বাবা, মায়ের নাম ছাড়া কিছুই মনে নেই তার৷ যাকগে, ভাগ্যদোষে মাম্পির মা মরজিনাকে প তিতা বৃত্তি গ্রহণ করতে হয়। এরপর কোনো এক ভদ্রলোকের মাধ্যমেই মরজিনা গর্ভবতী হয়ে যায়৷ এর আগে বহুবার গর্ভপাত করলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে মাম্পিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেনি৷ ফলশ্রুতিতে জন্ম হয় মাম্পির। ভদ্র সমাজে বাস করা বাবার পরিচয় নয় নিষিদ্ধ পল্লীতে বাস করা মায়ের পরিচয়ে বেড়ে ওঠে সে৷ মরজিনা সুন্দরী নয়৷ শ্যামলাটে মোটা আর বেঁটে নারী। অথচ মাম্পি অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের অধিকারে। লম্বায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। দেহের গড়ন, বর্ণ সব মিলিয়ে বাঙালি আর পাঁচজন সুন্দরীকে হার মানানোর মতোই রূপবতী। মা, মেয়েকে মেলানো যায় না। এ পল্লীর অন্যান্য মেয়েরা টিটকিরি দেয় খুব। মরজিনা রাগে না৷ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলে,
‘ ভদ্র সমাজের, ভদ্র পরিবারের অংশ এক প তিতার গর্ভে এসেছে। মাম্পি হলো সেই কন্যা যে ভদ্র সমাজের চোখে আঙুল দেখিয়ে দেয়৷ ওর গায়ে প তিতার চিহ্ন নেই আছে সেই ভদ্রলোকের চিহ্ন। ‘
বুঝদার হওয়ার পর থেকে মাম্পি বহুবার প্রশ্ন করেছে,
‘ মা তুমি তাকে চেনো; যার ঔরসজাত সন্তান আমি?’
মরজিনা এ উত্তর কোনোদিন দেয়নি। মাম্পি জানে কোনোদিন দেবে না৷ হয়তো তার মা চেনে, হয়তোবা না। এ নিয়ে বিশেষ ভাবে কখনো ভাবে না সে।
.
.
হীরক মাহমুদ মাম্পির কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। আর না একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখেছে মাম্পিকে। যাকে একটুক্ষণ পরই তিন কবুল পড়ে এবং আইনী স্বীকৃতি দিয়ে বউ করে নিয়ে যাবে। মাম্পি নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মহাবিরক্ত। লোকটা যে তার দিকে তাকাচ্ছে না খেয়াল করে বলল,
‘ কী মশাই, প তিতা বিয়ে করছেন আর তাকাতে ঘৃণা হচ্ছে? ‘
আকস্মিক প্রশ্নে নড়েচড়ে ওঠল হীরক। এক পলক তাকিয়ে দেখল, কাজল কালো চঞ্চলিত, আকর্ষণীয় চোখ দু’টো আর গোলাপি ফর্সা মুখশ্রী। মাম্পি আবেদনময়ী এক হাসি উপহার দিতেই চোখ নামিয়ে নেয় সে। বুঝতে পারে এই মেয়ে ভীষণ প্রফেশনাল। নত দৃষ্টিতে তাই হঠাৎ প্রশ্ন করে,
‘ কত বছর ধরে এই প্রফেশনে আছেন? ‘
‘ আমি জন্মসূত্রেই প তিতা। কিন্তু পুরুষালি শরীরের নিচে শুই আজ সাত বছর। ‘
সহসা শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল হীরকের। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠল, সোজাসাপটা এমন নিচু একটা কথা শুনে৷ মেয়েটা কী করে পারল এভাবে উত্তর দিতে? একটুও লজ্জাবোধ হলো না? তীব্র অস্বস্তি জাপ্টে ধরল তাকে। কিন্তু খানিক বাদে হঠাৎ মস্তিষ্কে এলো, সে কোথায় আছে? এখানকার মেয়েদের কাজ কী? তাদের চরিত্র কেমন? সবটা স্মরণ হতে নিমেষেই স্বাভাবিক হয়ে গেল৷ কেটে গেল সমস্ত অস্বস্তি। দ্বিতীয়বারের মতো তাকাল মাম্পির দিকে। এবারে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মাম্পিও আবেদনীয় ভঙ্গিমায় তার সম্মুখে বসে রইল স্থির হয়ে। কিন্তু তার অমন ভঙ্গিতে হীরকের চিত্ত চঞ্চল হলো না। সে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ বিয়ে না করা অব্দি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিব না আমি৷ ‘
‘ কেন দেবেন না? ‘
‘ আমি কোনো প তিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না। আমার যত উত্তর সব আমার বউয়ের জন্য। ‘
‘ ও বাবা আপনি তো দেখি খুব রহস্যে ঘেরা! প তিতা ঘৃণা করেন অথচ প তিতাই বিয়ে করতে এসেছেন। ‘
হীরকের মুখটা কঠিন হয়ে এলো। মাম্পি খেয়াল করে বলল,
‘ উত্তর যখন দেবেনি না একলা ঘরে কী করতে এসেছেন? পাত্রী দেখতে এলে তো তার দিকে তাকাতে হয়। আপনি তো তাকাচ্ছেনও না। ‘
‘ আমি দেখতে না দেখাতে এসেছি। ‘
‘ কী? ‘
‘ আমাকে। যার বউ হবেন তাকে বিয়ের পূর্বে একবার দেখবেন না? ‘
‘ ওও বাবা, আপনিত মশাই খুব রসিক। ‘
‘ আমার কথায় রসিকতা ছিল না। ‘
‘ আমি রসিকতাই নিলাম। ‘
এ পর্যায়ে চোখ তুলে আবারো তাকাল হীরক। মাম্পি তার দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে। সে তাকাতেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল৷ সীনা টান টান করে বসে ইঙ্গিত দিল বিছানায়। হীরক চোখ নামিয়ে ফেলল। অকপটে বলল,
‘ পরীক্ষা করছেন? লাভ নেই। আমি শুতে আসিনি। বিয়ে করে বউ নিতে এসেছি৷ ‘
অত্যাশ্চর্য মুখে তাকিয়ে রইল মাম্পি। মনের সব চঞ্চলতা দূর হয়ে গেল নিমেষে। হাসি হাসি মুখটাও মিলিয়ে গেল৷ ঢোক গিলল বারকয়েক। অধৈর্য্য হয়ে ফের শুধাল,
‘ আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন? কী উদ্দেশ্যে? ‘
বাঁকা হাসল হীরক। মাম্পির হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে ওঠল ওই হাসি দেখে৷ হীরক বলল,
‘ উদ্দেশ্য যাই থাকুক, নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনার জীবন পরিপূর্ণ ভাবে সুন্দর হবে। কারণ আপনি আমার শেষ জীবনের সঙ্গী হবেন। যদি চান আমার সন্তানের মাও হবেন। ‘
সহসা শিউরে ওঠল মাম্পি। হাত, পা কাঁপতে শুরু করল তার৷ এই লোক কী বলছে এসব! মাথায় সত্যি গণ্ডগোল নেই তো? কিঞ্চিৎ ভয় হলো তার৷ কান্না পেল মায়ের কথা ভেবে। তার মা চায় সে এই বিয়েটা করুক। ভদ্রঘরে ভদ্রলোকের বউ হয়ে যাক। সংসারি হোক। সর্বোপরি একটা সুস্থ জীবন উপভোগ করুক। মায়ের সে স্বপ্ন, সে আশাকে পূর্ণ করতে হলে এই লোকটার বউ হতে হবে তাকে। এক প তিতাকে কেউ কখনো ঘরের বউ করতে চায় না৷ লোকটার হয়তো মাথায় ব্যামো আছে। তাতে কী? ব্যামো অবস্থায় তার চাওয়াটুকুকে সায় দিলে নিজের ভবিষ্যত তো সুন্দর হবে। ভালোবাসাবাসি হয়তো হবে না কখনো। দিনশেষে একটা সুস্থ জীবন পাবে। নিত্যদিন বাহারি পুরুষের শরীরী ভাষা জানার থেকে হালালভাবে এক পুরুষের শরীরী ভাষা জানা ঢেড় ভালো।
নিষিদ্ধ পল্লীর বৈঠকখানায় কাজী ডেকে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে সম্পন্ন হলো হীরক আর মাম্পির। বিদায়বেলা রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার বদলে হাসল মাম্পি। এ প্রথম বোধহয় কনে বিদায়ে কাঁদল না কেউই। হাসল সবাই। সবচেয়ে বেশি হাসল মা আর মেয়ে।
শহরে একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে হীরক। সেই ফ্ল্যাটেই নিয়ে আসা হলো মাম্পিকে। সঙ্গে হীরকের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু রায়ান আর তার বউ জুঁই। বাসায় এসে বন্ধু আর তার বউ মিলে বাসর ঘর সাজালো। মাম্পি ততক্ষণে লম্বা শাওয়ার নিয়ে ভেজা চুলে বেরিয়ে এসেছে। সদ্য স্নাতা দেহে মাখিয়েছে সুগন্ধি। সে বেরুতেই রায়ান চলে গেছে। জুঁইও বাসরঘরের দেখিয়ে শুভকামনা জানিয়ে চলে গেল। মাম্পি কোথাকার মেয়ে জানে জুঁই৷ তাই আলাদা করে তাকে শেখানো, পড়ানোতে আগ্রহ পেল না৷ মাম্পি তাদের থেকে একশ ধাপ এগিয়ে জানে সে। নেহাৎই হীরক ভাই তাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে তাই আসা৷ নয়তো কখনোই আসত না৷ তবে মানতে হবে হীরক ভাই নিজের জেদে সর্বদা অটুট। তার মুখে জবান এক। নয়তো ক’জন পারে রাগের বশে, তীব্র জেদে মুখ ফস্কে বলে ফেলা কথাটাকে সত্যতা দিয়ে প তিতাকে ঘরে তুলতে!
ফুলে সজ্জিত বিছানায় চুপচাপ বসে আসে মাম্পি৷ এর আগে বহু পুরুষের সঙ্গে বিছানা মাতালেও এবারের অনুভূতি যেন একেবারেই আলাদা। কারণ এবার বিছানা মাতাতে হবে নিজের স্বামীর সঙ্গে। যদিও পুরুষ মানুষের প্রতি তার অনুভূতি নেই। তবু মনের ভিতর একটা বউ বউ ভাব এসেছে। হীরক মাহমুদের বউ সে৷ এ যেন রাতদিনের মতোই সত্য। একটুখানি বুক কাঁপল অকস্মাৎ। কারণ হীরক মাত্রই রুমে এসেছে। হাতের ঘড়ি খুলে রাখছে টেবিলে৷ পকেট থেকে ওয়ালেট বের করেও রাখল৷ এরপর তাকাল মাম্পির দিকে৷ মাম্পি কেন যেন একটুখানি লজ্জা পেল। অথচ তার লজ্জা পাওয়ার কথা নয়৷ এসবে সে অভ্যস্ত। হীরক পরনের শার্ট খুলে গায়ে সেন্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থায় বিছানায় ওঠে বসল৷ মাম্পির পাশে৷ মাম্পির বুকের ভেতর রক্ত ছলজে ওঠল যেন। কেন এমন হচ্ছে তার? হীরক বলল,
‘ আমার নাম হীরক মাহমুদ। হাইস্কুলের বাংলা শিক্ষক। ‘
‘ জানি। ‘
নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল হীরক। মাম্পির দিকে কিছুটা ঘেঁষে বসে ওর হাত ধরার আবদেন করল,
‘ হাতটা ধরতে পারি? ‘
বিস্মিত হলো মাম্পি। কী আশ্চর্য! এতকা কত পুরুষ বিনা প্রশ্নে, বিনাবাক্যে তার সাথে শুয়ে নরম শরীরটা ছিন্নভিন্ন করে গেল। আর আজ স্বয়ং তার স্বামী প্রশ্নে করছে হাত ধরবে কিনা? বিষয়টা হজম করতে পারল না মাম্পি। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বলল,
‘ আর কত রঙ্গ দেখব মশাই? পুরুষ মানুষের আর কত রঙঢঙ দেখব। যাকে বউ করে বাসর অব্দি নিয়ে এসেছেন, কিছুক্ষণ পর যার শরীরে ঝড় তুলবেন তার কাছে তারই হাত ধরার অনুমতি চাইছেন? ‘
কথাগুলো বলেই ফের অট্টহাসি। হীরক বিরক্ত হলো। চাপা ধমক দিয়ে বলল,
‘ আস্তে হাসুন, পাশের রুমে আমার বন্ধু আর তার বউ আছে। ‘
চুপসে গেল মাম্পি৷ মিটিমিটি হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে চটপটে গলায় বলল,
‘ শুধু ধরে ক্ষ্যান্ত দিবেন কেন? চেটেপুটে খেয়েও দেন। ‘
ফের অট্টহাসি। হীরক স্তব্ধ হয়ে গেল! কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। মাম্পি বোধহয় বুঝল একটুখানি। হাসি থামিয়ে ঘনঘন চোখের পলক ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
‘ রাগ করলেন? রসিকতা করলাম গো মশাই, রসিকতা করলাম।’
|চলবে|
<