প্রেমালাপ পর্ব শেষ

————-ড্রয়িং রুমের সোফায় গা হাত পা এলিয়ে ঝুঁকে বসে কলম চিবুচ্ছে অন্তি। ভাবছে যে ব্যাটা পরীক্ষার আবিষ্কারক তাকে যদি কেউ এখন ওর সামনে এনে দেয় তবে তার মুণ্ডুটা সমানে আছড়ে আছড়ে ফুটবল খেলা যেত ঘণ্টাখানেক! মুণ্ডু দিয়ে ফুটবল খেলার দায়ে এরপরে যদি ওর ফাঁসি ও হয় তো হবে কিন্তু পরীক্ষা নামক এই বালা থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে। অন্তির ফাঁসি হয়ে গেলে পৃথিবীর তরুণ তরুণীরা ওকে আজীবন কান্নাকাটি করে স্বরন করবে, অন্তিকে নিজেদের আইডল মানবে, বলবে পরীক্ষা পদ্ধতিকে নিয়ে আওয়াজ তোলা সেই মহীয়সী নারীর নাম কী জানো তোমরা? তার নাম অন্তি! অন্তির আত্মা তখন পৃথিবীর এ প্রান্ত সে প্রান্ত ঘুরে ঘুরে নিজের অমর হওয়াকে দেখবে। ভেবেই অন্তির একটু হাসি পেল কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার কোন যো নেই যে জগতের সকল সমস্যার মূলে ওই ব্যাটা, ঝামেলা পাকিয়ে নিজে মরে ভূত হয়ে গেছে আর ফ্যাসাদে ফেলে গেছে পুরো ছাত্রসমাজকে!আহাম্মক কোথাকার, আবিষ্কারের জন্য আর কিছু কি ছিল না!

কাল সকাল সকালই এডভান্সড একাউন্টিং-3এর এক্সাম,একাউন্টটিং এর মত একটা সাবজেক্টে কেন যে এমন বিশ্রী একটা কোর্সকে রুপবদলে দফায় দফায় প্রত্যেক সেমিস্টারে নিয়ে আসা হয় ভাবতেই রাগে অন্তির গা জ্বলে যাচ্ছে, ষড়যন্ত্র সব ষড়যন্ত্র! পরীক্ষা চাপিয়ে তরুণ সমাজকে হেনস্তা করা যাচ্ছে, প্রেসারে প্রেসারে ছাত্রকূলের হাড় কালা করে দেওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে পরীক্ষার আবিষ্কারক সহ মরে ভূত হওয়া তার চৌদ্দ গুষ্টিকে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিতে দিতে অন্তি এখন নিজেই ক্লান্ত। মন ভালো করতে তাই এই মুহুর্তে সৌরভ ই ওর একমাত্র ভরসা,

“আধাঘন্টা ধরে যে ফোন দিয়ে যাচ্ছি কোথায় ছিলে তুমি শুনি?”

ফোনের ওপাশ থেকে সৌরভ ওর অভ্যস্ততার অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠলে,

“আরে আমার অন্তি সোনা যে,তা কাল না তোমার এক্সাম আজও প্রেম করতে হবে? না বলছিলাম যে আমি কিন্তু কোন ফেল্টুস মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না বাবা,পরে আমার ছেলে মেয়ে গুলোও তাই হবে,আর আমি তো ঠিক করেই নিয়েছি আমার মেয়ে তিনটে ডাক্তার হবে,ছেলে দু’টো ইঞ্জিনিয়ার আর তারপরেও যদি ছেলে পেলে হয় তো তখন আমি আবার ভাববো তাদের কি গতি করা যায়,যাও যাও পড়তে বসো।ইস কতো দ্বায়িত্ব আমার অন্তি সোনার উপর,জ্ঞানী মা হতে হবে তো তাইনা বলো!”

“আচ্ছা তোমার সমস্যা কি?কি বলে যাচ্ছ এসব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে এভাবে ত্যক্ত করে কি মজা পাও তুমি বলো তো?দেখো কাল আমার এক্সাম আছে তাই এখন অন্তত এমন কোন কথা বলবে না যা শুনলে আমার মেজাজ খারাপ হয়,বুঝলে?”

“ও আচ্ছা আচ্ছা, তারমানে তুমি ইনডিরেক্ট বলছো যে তোমার আদর চাই, তাই কি?”

“প্লিজ এভাবে রাক্ষস এর মতো হেসো না,না আমার ওসব ছাই পাশ চাই না।অন্তি কোনকালেও লুতুপুতু
স্বভাবের গার্লফ্রেন্ড ছিলো নাহ,তার ওসব একদমই লাগে না”

“হ্যাঁ তাও ঠিক আমার অন্তি সোনা তো ঝাঁঝালো মরিচ একটা,ইস কি ঝাল -একটু পানি দাও, পানি দাও না,উহুহুহু”

“প্লিজ সৌরভ আজকে অন্তত আমার মেজাজটা এভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ করে দিও না,আই নিড রিফ্রেশমেন্ট।আমাকে রাগানো যে তোমার হবি হয়ে গেছে সেটা আর আমার বুঝতে বাকি নেই,বাট প্লিজ এখন এমন কিছু বলো যেটা শুনলে আমার মন ভালো হবে,আমি একটু হাসবো।তারপরে ইচ্ছে হলে আমি আবার পড়তে বসবো,নইলে ঘুমিয়ে যাব।এডভান্সড একাউন্টটিং এর মতো কুৎসিত একটা কোর্সের জন্য রাতজেগে পড়াশোনার কোন মানে হয়না,আমার মাথায় ঢুকে না জাস্ট”

“ও আচ্ছা এই কথা আগে বলবে তো,রিফ্রেশমেন্ট তো আমার বা হাতের কাজ।আচ্ছা শোনো চলো আজ তোমার একটা বুদ্ধির পরীক্ষা নিয়েই নি,দেখি ঝাঁঝালো মরিচের মাথার তেজ কেমন!”

“আবার!না আমি মোটেও কোন টেস্ট দিতে রাজি না,অন্যকিছু বলো”

“না শুনেই হার মেনে নিচ্ছো,মানে পারবে না হুহহহ্মম!”

“এমন বিশ্রী করে হাসছো কেনো আবার?,আচ্ছা বলো কিন্তু ৩০সেকেন্ডের ভিতরেই বলবে,এর বেশি সময় আমি দিতে পারবো না”

“ব্যাস,হয়ে গেলো! অনেক সময় তো,এতেই আমি একটা ছোটখাটো গল্প বলে দিতে পারি।মন দিয়ে শুনবে কিন্তু অন্তি,গল্পের শেষেই থাকবে তোমার জন্য মগজধোলাইয়ের কুইজ মানে” ধাঁধা “।

” শুনছি, বলো”

“হ্যা শোনো এক দেশে ছিলো দুই বন্ধু, এক পিঁপড়া আর এক হাতি,এখন ওদের দেশে আবার নতুন নতুন সুইমিংপুল বানানো হয়েছে,একেবারে আলিশান সুইমিংপুল বুঝলে! তো হাতি আর পিঁপড়া গেলো স্নান করতে।ওরা পানিতে নেমে সুন্দর স্নান করছে তো করছেই। লাফালাফি করতেছে, ঝাঁপাঝাঁপি করতেছে, সাঁতরে বেড়াচ্ছে।এক পর্যায়ে হাতি স্নান সেড়ে সুইমিংপুল এর উপরে রাখা গোল্ডেন কার্পেট এ রোদ পোহাচ্ছে কিন্তু পিঁপড়া তো আর আসে না,ঘণ্টার পর ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু নাহ পিঁপড়া আর আসে না।এখন তোমাকে বলতে হবে পিঁপড়া কেন উঠতেছে না!বলো বলো”

“পিঁপড়া উঠতেছে না?”

“হ্যাঁ পিঁপড়া উঠতেছে না,এখন বলো কেনো।ভাবো ভাবো”

অন্তি অনেক ভেবে উত্তর দিলো,
“উউউউ হতে পারে পিঁপড়াটা পানিতে ডুবে মারা গেছে”

” আরে নাহ পিঁপড়া কি তোমার মতো নাকি,ও তো সাতার জানে”

“উউউউ তাহলে হতে পারে পিঁপড়া ঘুমিয়ে গেছে”

“হ আর কাজ নাই সুইমিংপুল এ ঘুমাই যাবে,ওদের কি বাসাবাড়ি নাই নাকি?

” দাঁড়াও আর একটু ভাবি,উউউউ পিঁপড়া…….” নাহ মাথায় আসতেছে নাহ,তুমিই বলো কেনো?”

“মানে পারতেছো না তাই তো কিন্তু এভাবে বললে তো আর আমি বলবো না,জ্ঞান পেতে গেলে বিনয়ী হতে হয়,গুরুজনের কদর করতে হয়! এখন সুন্দর করে বলো সৌরভ আমি না পারছি না তুমি একটু বলে দাও না প্লিজ..জানু”

অন্তি রাগে দাঁত কটমট করে কোনক্রমে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

“হ্যাঁ জ্ঞানগুরু সৌরভ আমি না পারছি না, আপনি একটু বলে দ্যান না প্লিজ..”

“এটা কিন্তু বেটার ছিলো,তুমি বরং এক কাজ করো অন্তি বিয়ের পরে আমাকে আপনি করে “জ্ঞানগুরু সৌরভ” বলেই ডেকো,কেমন?”

“উফ বলো আগে ওইটার উত্তর কি?”

“আহা অস্থির হতে নেই উত্তর আছে তো কিন্তু বলা যাবে না, বললে আবার বলবে আমি অশ্লীল, তাই বলবো নাহ”

“মানে কি এতোক্ষন ধরে বলে এখন বলছ বলবে না,এটা কেমন কথা?আচ্ছা এটা বলো পিঁপড়া আর হাতি কে মেয়ে কে ছেলে?”

“উহু অন্তি যাহ কি দুষ্ট কথা বলে,ওরা তো বন্ধু,আমাদের মতো লাভবার্ড না তো!তারপরেও বলি পিঁপড়া টা আমার ছেলে আমার মতো সুপুরুষ”

” উফফফ তুমি এভাবে হাসবে না,বলো উত্তর টা কি? বলো?”

“বলতে পারি কিন্তু রাগ করা যাবে না”

“আচ্ছা ওকে,বলো’

” উঁহু বলো -আমি অন্তি সজ্ঞানে শপথ করতেছি যে উত্তর শুনে আমি রাগ করবো না”

“আমার কিন্তু এবার সত্যি মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে,আর পারতেছি না।এক্ষণ বলবা উত্তর না বললে ব্রেকাপ”

“না না বলি বলি,আসলে কি খুশিতে সাঁতার কাটতে কাটতে না পিঁপড়াটা ওর অন্তর্বাস হারিয়ে ফেলছে পানিতে,তাই উঠতে লজ্জা পাচ্ছে এই আর কি,সুন্দর না গল্পটা?”

“হোয়াট? আই মিন সিরিয়াসলি? তুমি এতোক্ষণ ধরে আমাকে এই গল্প বললে? এতো নোংরা তোমার মস্তিষ্ক? সৌরভ তুমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছো দিনেদিনে,আমার এখন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে কিন্তু,প্রচন্ড রাগ”

“আহাহা এতো রাগ করতে নেই তো,বোঝো না ক্যান রাগের ও তো একটা মানসম্মান আছে,এতো রাগ করলে তো রাগের মানসম্মানের ঘাটতি পড়ে যাবে,তাইনা বলো অন্তি”

অন্তি নিজের রাগকে চাপিয়ে দু’চোখ উলটে পালটে বললো,

“মানে আমি ভাবতে পারতেছি না তুমি এটা কি বললে!!”

‘আহা গভীরে যাও না,আগে বোঝো,গল্পটা ক্যান বললাম বলো তো? জানি তাও জানো না।এই যে দেখো এতে কি বোঝা গেলো ওই অতোটুকু পিঁপড়া সমাজের ও লজ্জা আচ্ছে দেখলা আর তুমি কিনা আমাকে সকাল সন্ধ্যা কথায় কথায় বলো আমার লজ্জা নাই,আমি অশ্লীল। কি ভয়াবহ রকমের একটা অপবাদ দাও তুমি আমায় বুঝতেছো?”

“তুমি এক্ষন ফোনটা রাখো আর কক্ষনো আমাকে ফোন দেবে না,আমি অন্তত আগামী এক মাসেও আর তোমার মুখ দেখতে চাই না বুঝলে?’

” ইস তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে গো”

“আহ্লাদ করবা না একদম, বলে দিচ্ছি”

“না ভাবতেছি যে তুমি ধাঁধাটাই বলতে পারলে না আর কালকের এক্সামটা না জানি কতোটা খারাপ দিবা,তার উপরে এখন ঘুমে দুলতেছো,বেশি না আগামী দশ মিনিটের মাথায়ই তুমি ঘুমিয়ে যাবে,আহারে আমার বাচ্চাগুলা একটা ফেলটুস মা পাবে রে ইসসস, ফেল্টুট মায়ের পেটে ফেল্টুস সব আণ্ডাবাচ্চা হবে গো, আমার তো কপাল পুড়লো বলস ”

“সাট ইওর মাউথ জাস্ট,আমি কালকের পরীক্ষা অনেক ভালো দেবো দেইখো, তোমার মতো নাকি আমি।”

“অন্তি……!”

***

অন্তি ইতোমধ্যেই ফোনটা কেটে দিয়েছে,সৌরভের উপর রাগটা কমে এসেছে যদিও কিন্তু কপালে মনখারাপের ভাঁজটাও স্পস্ট। মুখফুটে আহ্লাদ আবদার করার মতো সৌজন্যতাটা অন্তি আজও ঠিক করে উঠতে পারে না,তাই বলে কি সৌরভ ও বুঝবে না?
আজ রাতটা চিন্তাহীন প্রেমের রাত ও হতে পারতো,আজ রাতটা বকবক করেও কাটিয়ে দেওয়া যেতো,পুরোনো সব স্মৃতি গুলোকে রোমন্থন করেও কাটিয়ে দেওয়া যেত,কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ের দুজনের নিঃশ্বাসের গুনগুনানিতেই ঘুম আসতে পারতো কিন্তু না সেসব আর কই হলো! “বেছে বেছে ঠিক পরীক্ষার আগের রাত গুলোতেও যেমন অন্তির মনে বেশ প্রেমপ্রেম থমথমে আবহাওয়ার ভার জমে,আর বেছেবেছে পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে সৌরভ ও ঠিক তেমনি প্রেমহীন জ্ঞানময় হয়ে ওঠে।

অন্তি ইতোমধ্যেই পড়তে বসে গেছে,আর ভাবছে সৌরভের মুখে লাগাম টেনে দিতে কাল ওকে অবশ্যই ভালো এক্সাম দিতে হবে কারন ঠিক এই একটা ব্যাপার অন্তির খুব করে ইগোতে লাগে।

৷৷৷ ওপাশে সৌরভ বরাবরের মতো আজও বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে হেসে যাচ্ছে, মনে মনে ভাবছে,

” অন্তিকে বরং এখন থেকে “ফেল্টুস মা ” বলে ডাকা উচিত, এতে ভবিষ্যতে আর কোন প্রকার ঝামেলা থাকবে না………

অনুপ্রেম–
——————–
শারমিন আক্তার সেজ্যোতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here