#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত
#সাদিয়া_নওরিন
পর্ব—- ১৬
দুপুর এগারোটা, একেকজন চেহারার বেহাল দশা করে ঢুলতে ঢুলতে নেমে এলো বাস ছেড়ে। সাগরের চেহারা দিকে তাকিয়ে মনে হলো এখুনি যেন কেঁদে দিবে সে! আরশীও মুখ তেঁতো করে বন্যার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পড়লো।বমির কারনে শরীরটা দূর্বল লাগছে তার এখন। অন্যদিকে এতো সব দূর্বলতার মাঝে একদমই ক্লান্তিহীন চেহারা ইরশাদের! সে মুচকি হেঁসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
—- এমন এক ট্রিপে অবস্হা এতো খারাপ তোমাদের! আমি তো এমন না খেয়েই কতো ট্রিপ দি।
—- ভাই, তুই তো প্রতি সোমবার আর বৃহস্পতিবার রোজা রাখিস এমন মানুষ। তোর আবার খিদা কি?
—– ও সপ্তাহে দুইটা রোজা রাখে! কেন রে?
—– ভালো বৌ পাওয়ার জন্য।
বন্যার বিষ্মিত মুখটির দিকে তাকিয়ে রসিকতার স্বরে বলে উঠে সাগর! বন্যা যেন সত্যই ধরে নেই বিষয়টি। সে পরপর চোখ ঝামটা দিয়ে পুলকিত দৃষ্টি ফেলে তাকায় ইরশাদের দিকে। ইরশাদ মুচকি হেঁসে প্রতিউত্তরে আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
—– আরে দূর। এ দুদিন এমনিতেই নফল রোজা রাখা ভালো।আর সিঙ্গেল ছেলেরা রাখলে তা আরো ভালো হয়।কারণ অবিবাহিত ছেলেদের কিছু নফল রোজা রাখা উচিত৷ তাই আরকি রাখি সময় পেলে।
—– কেন? শুধু অবিবাহিত হলেই কেন রাখবে?এইটা আবার কেমন নিয়ম!
আনমনে অবাক হয়ে পচন্ড জোরে বলে উঠলো আরশী। ইরশাদ কথাটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে নিউমার্কেটের ওখানে কাছেই একটি হোটেলের ভেতরে ডুকে গেল! আরশী বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকাতেই মুচকি হেঁসে বলে উঠলো ইরহাম,
—– নিয়ম না। মূলত এটি নিজেদের গোনাহ থেকে সংযত রাখার জন্য রাখা হয়। ছেলেদের টেম্পটেশন তো একটু বেশীই। তাই।
আরশী তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইলো ইরহামের দিকে! ইরহামের বলা কথাগুলোর তাৎপর্য ও যেন চিন্তা করার লেগে গেল সে!
তারা একটি হোটেলে ডুকে তার মেনু ঘেঁটে দেখতে লাগলো। এখানে চিকেন, মাটন, হায়দ্রাবাদি, লখনৌ, মাটন-স্পেশালসহ বিভিন্ন ধরনের বিরিয়ানি ছাড়াও রয়েছে ভেজিটেবল বিরিয়ানি। যারা কোনো ধরনের মাছ, মাংস বা ডিম খান না তাদের জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা।
তারা পাশের ছয়জনের একটি দলের দিকে তাকালো।তারা হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একেকজন একেক ধরনের বিরিয়ানি অর্ডার দেবে, যেনো এখানকার কোন বিরিয়ানির স্বাদ কেমন তা বোঝা যায়। ইরশাদ ইরহামকে কিছুসময় অপেক্ষা করে ওদের প্লেটগুলো দেখতে বলল।কারণ বিরিয়ানির পরিমান দেখেই অর্ডার দিবে তারা।
পাশের টেবিলের ছেলেরা মাটন, হায়দ্রাবাদী, লখনৌ ও স্পেশাল বিরিয়ানি অর্ডার করলো। আর অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছয়টি প্লেটের বিরিয়ানি হাজির হলো তাদের সামনে!
একেকটি প্লেটে বিরিয়ানির পরিমাণ দেখে একদমই থ বনে গেল সবাই। এ যেনো বিরিয়ানির ঢিবি! পুরো প্লেট শেষ করা একজনের পক্ষে সত্যিই কঠিন। অগত্যা ফিরিয়ে দিতে হলো তাদের এক প্লেট।
ইরশাদ সেদিকে তাকিয়ে আলতো মাথা ঝাকালো।তার ভাষ্যমতে অর্ডার দেওয়া সব ধরনের বিরিয়ানিই বেশ মজার। তাই তারাও নিজেদের জন্য ও অর্ডার দিল।
বাসমতি চালে রান্না করা সবগুলো বিরিয়ানিতেই তেল-মসলার ব্যবহার ছিলো পরিমিত। তবে তুলনামূলক হালকা মসলায় রান্না মাটন বিরিয়ানি পছন্দ করলেন স্বাস্থ্য সচেতন ইরশাদ। হায়দ্রাবাদি ও মাটন-স্পেশাল বিরিয়ানিতে বিভিন্ন ধরনের বাদাম, খেজুর আর কিসমিস দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি রাঁধুনী। আর এইকারনেই বাকিরা এইটাই পছন্দ করলে।
এখানকার বিরিয়ানি খাওয়ার পর রেস্টুরেন্টে এতো ভিড়ের কারণ বোঝতে পারলো তারা।
কলকাতায় বিরিয়ানির জন্য প্রসিদ্ধ দুই রেস্টুরেন্ট হলো, নিজামস ও আমিনিয়া। এর মধ্যে নিউমার্কেট এলাকার নিজামসের নার্গিস বিরিয়ানিও বেশ সুস্বাদু। তবে স্বাদের দিক থেকে আরসালানের বিরিয়ানিই এগিয়ে মনে হলো তাদের। দাম ১৪০ রুপি থেকে ২৮০ রুপি পর্যন্তই। এ যাত্রায় আমিনিয়ায় খাওয়া হলো না তাদের।তারা আরসালানের বিরিয়ানিই খেল।সাথে বরহানী৷ ছেলেরা বরহানী খেলেও মেয়েরা সাফ মানা করে দিল বরং তারা লাচ্ছি নিল।অন্যদিকে ইরশাদ কোক কিনে তাতেই মুখ ডুবিয়ে দিল।তার মতে, কোক না খেলে খেলে বিরিয়ানি কে বিরিয়ানি মনে হয় না৷
—— আচ্ছা এখন আমরা কিভাবে যাব কাস্মীর আই মিন কোন পথে?
—– আমরা বিভিন্নভাবে শ্রীনগর যেতে পারি। যেমন, কলকাতা থেকে জম্মু হয়ে শ্রীনগর যেতে পারি ১২০০-১৫০০ টাকা। (নন-এসি স্লিপার ক্লাসে) আবার কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে জম্মু। সেখান থেকে বাসে শ্রীনগর এভাবে ও যেতে পারি। ১৫০০-২০০০ টাকা (নন-এসি স্লিপার ক্লাস) তাছাড়া কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে জাম্মু (থ্রি-টিয়ার এসি)। সেখানে থেকে প্রাইভেট কারে শ্রীনগর। ৬০০০-৭০০০ টাকা লাগবে এতে।আবার কলকাতা থেকে দিল্লী বাই এয়ার। দিল্লী থেকে শ্রীনগর বাই এয়ার। ১০০০০-১২০০০ টাকা।
—— আচ্ছা ইরশাদ, আমি বলছিলাম কি, আমাদের হাতে তো সময় আছে। চলনা আস্তে আস্তে ঘুরি। এখানে তো আরো অনেক জায়গা দেখা বাকি।আর আমরা তাজমহল দেখতে আবার কখন আসবো এখানে। তো তাজমহল দেখে জাম্বু ঘুরে তারপর শ্রীনগর যায়।
তিতাসের কথায় মেয়েরাও মাথা ঝাঁকালো। ইরশাদ আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।তার কোন আপত্তি নেই। তারপর তারা তাদের ঠিক করা হোটেলের দিকে রওনা দিল। তারা নিউমার্কেটের কাছেই একটা হোটেলে উঠলো। ভাড়া ১৮০০ রুপি। তারা তিনটি রূম ভাড়া করলো। একটি তিতাস আর তিশার৷ বাকি একটাতে বন্যা আর আরশী। আর অন্যটায় ইরহাম, ইরশাদ আর সাগর। সবাই যার যার রুমে পৌঁছেই দোর লাগিয়ে দিল।আপাতত যেন সবার ঘুমের সময় এটি।
আরশীর ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে পুরো আকাশজুড়ে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটছে নিড়ে। যেন সবার দিনজুড়ে খাবারের সমাপ্তি ঘটলো এখন।আরশী বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুসময় প্রকৃতিবিলাস করে, কাপড় নিয়ে ওয়াসরুমে ডুকে পড়লো।
গোসল শেষ করতেই বন্যাকে ওয়াসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। বন্যা আলতো ঘাড় কাত করে, আরশীকে আপাদমস্তক দেখে ওয়াসরুমে ডুকে গেল। আরশী আলতো ব্রু কুঁচকে কি হলো ভেবে টিভি দেখতে বসে গেল।
বেবি পিংক টপস পড়েছে এখন আরশী।সাথে হুয়াইট কালারের লং স্কার্ট। ওড়নাটি গলার সাথে পেচিয়ে দু’পাশে ঝুলিয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিল সে। তারপর পিঠ ছুঁইয়ে পড়া ভেঁজা চুলগুলো গামছা দিয়ে বারকয়েক বাড়ি দিতে লাগলো। একটুপী বন্যা বের হতেই তাকে সাথে বেরিয়ে গেল সে।
পথে তিতাস আর তিশারও দেখা মিলল তাদের। আর সবাই মিলে চলল ইরশাদদের রুমে দিকে।
রুমে ঢুকতেই জোরেশোরে এক ধাক্কা খেল আরশী! উপুড় হয়ে বালিশটা জড়িয়ে শুয়ে আছে ইরশাদ। পা বাঁকা করাই ত্রিকোয়ার্টার পেন্টটিও হালকা উঠে গিয়েছে তার। ফর্সা লোমশ পায়ের অনেকখানি দৃশ্যমান এতে তার পায়ের! আরশী আপাদমস্তক বার কয়েক চোখ বুলিয়ে নিল ইরশাদের! বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে তার ইরশাদকে এভাবে দেখে! অন্যদিকে বন্যা চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে ইরশাদের দিকে। তার কাছে ইরশাদকে মনে হচ্ছে এখন মাখনের মতো! একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে যেন তার ইরশাদকে!
হঠাৎ সে স্ব-শব্দে লাস্যহাসি দিয়ে বলে উঠলো,
—– ইশ্, ইরশাদটারে কতোটা হট লাগছে!
সাথে সাথেই গা জ্বালা দিয়ে উঠলো দুটি ব্যাক্তির। সাগর যেহেতু শুনে অভ্যাস্ত। সে নাক ফুলিয়ে চুপ করে রইলো। কিন্তু আরশী, সে দাঁতে দাঁত চেপে ইরশাদের দিকে তাকালো।তার এখন ইরশাদের এই দৃশ্যমান পা দুটিও যেন বিরক্ত লাগছে হুট করে! তার এখন খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে খুব জোরে খামচিয়ে দেয় সে ইরশাদের পা দুটিকে!
বন্যা যেন এখন হা হয়ে গিলছে ইরশাদকে! আরশীর এবার সহ্য হলো না বিষয়টি! সে সবার অলক্ষ্যে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ইরশাদের পায়ের লোম ধরে দিল এক জোরে টান!
ধরফরিয়ে উঠে বসলো ইরশাদ! ঘুম ভাবটা যেন একদমই কেটে গেল তার মুহূর্তেই! সে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে রইলো রুম জুড়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে। আসলে তার সাথে কি হলো তা যেন বুঝার চেষ্টা করলো সে কিছুসময় ধরে! সবার মুখপানে চোখ বুলিয়ে, আরশীর লাল চেহারার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো আরশী,
—– গোসল করে আসুন। সবাই আপনার জন্য বসে আছি।
আরশীর ঝাঁঝালো স্বর শুনে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো ইরহাম। কিন্তু আরশীর যেন আপাতত গা হাত সব জ্বলছে!
শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়েছে ইরশাদের চোখে মুখে। আকাশী হুয়াইট মিক্স টিশার্ট পড়েছে সে। ভেজা চুলগুলো জেল দিয়ে ভলিউম করেছে। হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে চোখ পড়লো তার আরশীর ওপর।আরশী এখনো রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে! ইরশাদ আলতো মাথা ঝাঁকালো তারপর সবাইকে সামনে এগুতে বলল।আর বলল সে তালা দিয়ে আসছে দরজায়।
সবাই একসাথে বেরিয়ে যেতেই ইরশাদ “ওহম” শব্দ তুলে কাশলো! মুহূর্তে জায়গাতেই জমে গেল আরশী! পদধ্বনিও যেন শুন্যে নেমে এলো তার!বাকিদের যেন সেদিকে কোন খবর নেই৷ গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছে তারা।
ইরশাদ দৌড়ে একদম আরশী পাশে এসে দাঁড়ালো। ইরশাদের জোরে নিশ্বাসের শব্দে কেঁপে উঠলো আরশী। ওরনার মাথা দুটি ও শক্তভাবে চেপে ধরলো সে! ইরশাদ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসির রেখা টেনে বলল,
—– মিস আরশী। আমার দ্বারা কি কোন ভূল হয়েছে? আপনি হয়তো আমার ওপর রেগে আছেন?
—– মিস নয় মিসেস বলুন।আমি মিসেস আরশী।
স্হির ভাবে একদম ইরশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো আরশী! ইরশাদ যেন বিষ্ময়ে পলক ফেলতে ভূলে গেছে! সে পরম বিস্মিত হয়ে বলল,
—- মিসেস! আসলে আপনার তো এঙ্গেজমেন্ট..
—– নো মি ইরশাদ মেহতাব। আমি বিবাহিতা। সাত বছর আগে পুরো একপার্ক মানুষের সামনে বিয়ে হয়েছে আমার। বিয়েটা কাজিই পড়িয়েছিলেন, কবুল ও বলা হয়েছিল আর সাক্ষী হিসেবে ছিল পার্কভর্তি মানুষ আর শতশত মুঠোফোন।
এখন আপনি বলুন।তার মানে কি আমি মিস?
ইরশাদ বাকরুদ্ধ ভাবে তাকিয়ে রইলো আরশীর পানে! বিষ্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছেছে যেন সে আজ! পেটের ভেতর কথার মালা থাকার শর্তেও কন্ঠনালী যেন একদমই কাঠ হয়ে উঠলো তার! পরপর ঢোক গিলে আরশীর পানে তাকালো সে
চলবে