প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ২৮

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত

#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—-২৮

নতশির লাজুক ললনার মুখের মিষ্টি হাসিটি, ইরশাদের ভেতরটা এফোঁড় ওফোঁড় করছে। অদ্ভুত নেশায় মজে যাওয়া হয়তো একেই বলে! নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর লোভটা চেপে বসছে তার মনে হুট করে! দুরুদুরু করা বুকের মিষ্টি টিপটিপ শব্দও শুনতে পাচ্ছে সে! এ যেন সুন্দর সংগীত!

ঘোর লাগানো নেশা কেটে তাড়াতাড়ি ইরশাদের পা থেকে সরে এলো আরশী। আর এতেই ঘোর কাটলো ইরশাদের। সে আলতো হাতে মাথা চুলকালো। তারপর কেবলার মতো হেঁসে বলল,
—– ভেতরে চলে যাও আরশী। আজকালকার ছেলেরা ভালো না।
আরশী ব্রু কুঁচকে এদিকে ওদিকে তাকালো।তারপর প্রশ্নবাচক দৃষ্টিতে তাকালো ইরশাদের মুখের দিকে। ইরশাদ তেতো খেয়েছে এমন মুখ করলো এতে।তারপর বলল,
—– আমাকে কি চোখে লাগে না! আমি ভেতরে বাইরে দুইদিকেই কিন্তু ছেলে।
—– তো মানুষ কি একদিকে ছেলে হয়!
বিস্মিত দৃষ্টিতে বলল আরশী৷ ইরশাদ আর কথা বাড়ালো না। মনে মনে কেবল এইটাই বলল,
” বাদ দে ইরশাদ, মাইয়াডা এখনো অবুঝ!”
তারপর সে হনহনিয়ে প্রস্হান করলো জায়গাটি। আর আরশী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে!

বুকের ওপর হাত গুঁজে দূরে দাঁড়িয়ে এক পলকে ইরশাদ-আরশীকে দেখছে ইরহাম। তার অজান্তেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা! প্রথম প্রেমের সর্গীয় অনুভূতি হারানো বেদনা যেন গভীরভাবে আঁচড় কাটছে তার হৃদয়ে। যেই প্রেম সায়রে সে দিন প্রতিদিন একটু একটু করে নিমজ্জিত হতো আগে৷ সেই সাগরের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে যেন সে আজ!
হঠাৎ তার গা ঘেঁসে দাঁড়ালো সাগর। ফোঁস করে হতাশার নিশ্বাস ফেললো সে।তারপর আলতোভাবে ইরহামের কাঁধে হাত রেখে, বলে উঠে সে,
” যা করছিস ভেবে করছিস তো?”

এই কয়েকদিনে অনেক বেশী ক্লোজ হয়ে গিয়েছে তারা দুইজন।আর এতে সম্মোধন ও পাল্টে তুই এ এসে দাঁড়িয়েছে।
সাগরের কথায় তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিল ইরহাম! তারপর বলল,
—— অবশ্যই, ইরহাম আহাম্মেদ সবসময় ভেবে কাজ করে। “ভাবিয়া করিও, কাজ করিয়া ভাবিও না” এই প্রবাদের বিশ্বাসী সে।
সাগর দুঃখী মুখ করে আলতো মাথা ঝাকালো। তারপর তারা পা বাড়ালো কামরার দিকে।

রুমে প্রবেশ করতেই মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে উঠলো বন্যার। বারান্দা গলিয়ে মিস্টি রোদ প্রবেশ করছে কক্ষে। মোটা নরম গদি।আর সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিছানায় শুয়েই দেখা যায় নীল আকাশে উড়ে যাওয়া মেঘের ভেলা। মেঘগুলো খেলতে খেলতে উড়ে গিয়ে সেই লম্বা পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, তারপর তারা আবার পাহাড়কে সরি বলে ফিরে আসছে নিজের জায়গায়! আরশী আর তিশার মন নেই আপাতত বন্যার দিকে।তারা বিভোর হয়ে ঘুমুচ্ছে যেন কতো কাল ধরে ঘুমোয় নি।

সময় দুইটা। ইরশাদ মিটিমিটি চোখ খুলে চারপাশে তাকালো। সে একা কক্ষে ঘুমিয়ে আছে! বাকি দুজন নেই! যেন হুট করে হাওয়া!ইরশাদ অবাক হয়ে পাশেরাখা ঘড়ির দিকে তাকালো ! তারপর আনমনে ভাবলো, তাদের আড়াইটায় বেরুনোর কথা! কিছুসময় পর কিছু ভেবে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো সেও৷
নিচে রিসেপশনে ম্যানেজারের সাথে দেখা গেল সাগর আর ইরহাম কে! কি এক বিষয় নিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় কথা বলছে তারা একে অপরের সাথে! ইরশাদ বিস্মিত দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে গেল সামনে। আর তখনই তার সাথে চোখাচোখি হলো ইরহামের! আর সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেল সে! কিন্তু সাগরের বলা শেষ কথাটি শুনতে পেল সে,
——- আপনি পাঁচটি ক্যাবিন দিতে পারবেন না আগে বলেন নি কেন? এখন কি করবো আমরা
—– সরি স্যার। আসলে!
তার কথাগুলো শেষ করার আাগেই বলে উঠলো সাগর,
—- আমাকে একটি ডাবল বেড আর দুইটা সিঙ্গেল বেড এরেন্জ করে দেন তাহলে আজকেই।

” এতো বেড দিয়ে হবে।?”!
ইরশাদের প্রশ্নে থমথমে চেহারায় তার দিকে ফিরে তাকায় সাগর। ইতস্তত অগোছালো তার চেহারা ভঙ্গিমা। ইরশাদ সুক্ষ্ম দৃষ্টি ফেললো তাতে। সাগর আর একটু মিইয়ে গেল। বরাবরের মতোই ইরশাদের সামনে মিথ্যা বলাটা কন্ঠনালী রুদ্ধ করে তার। আর তাছাড়া অন্যদের মতো গুছিয়ে মিথ্যে বলাটাও তার দ্বারা সম্ভব হয় নি কখনো।

” কিরে বল”
আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে ইরশাদ। এবার সাগরের বদলে ইরহাম কন্ঠস্বর ঝেড়ে বলে উঠে,
—– আমার কিছু ফেন্ডস আসবে আজ।ওদের জন্য।
—- ওহ! তো ওদের জন্য অন্য কোন হোটেলে রুম বুক করো। যেহেতু এখানে রুমের শর্ট।
—– কেন? ওরা এখানে থাকলে কি সমস্যা? ওদের আমি আমার কাছাকাছি রাখতে চাচ্ছি। তোমার কোন প্রবলেম?
মুখ শক্ত করে বলল ইরহাম। ইরশাদ হতাশ হয়ে তাকালো। সে ভেবেই পায় না এই নরমাল কথায় এতোটা রাগছে কেন ইরহাম! কিন্তু সে প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না।আর তখনি বাকিদের নেমে আসতে দেখলো সে।আর তারপর সে হেঁটে তাদের দিকেই রওনা দিল।

ফোঁস করে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটি ফেলে সাগর। তারপর হাসফাস গলায় বলে,
—– শালা, মিথ্যাতে পিএইচডি হোল্ডার তুই!
ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় হাঁসি দেয় ইরহাম প্রতিউত্তরে।তারপর বেরিয়ে পড়ে তারাও গন্তব্যের উদ্দেশে।

লাঞ্চ শেষ করে সবাই চেপে বসেছে গাড়িতে। গাড়ি চলছে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। গন্তব্য তাদের ভেতাবভ্যালি। ভেতাবভ্যালির কিছু ছবি আগেই নেটে দেখে নিয়েছিল তারা।কিন্তু সেখানে যাওয়ার রাস্তা এতোটা সুন্দর হবে একদমই কল্পনা করে নি তারা!সবুজের সমারোহ ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসছে পানির কুলকুল শব্দ! আরশী মুগ্ধ হয়ে কান পাতলো।তারপর মুচকি হেঁসে বলল,
—— এতো পানির শব্দ! আমরা কি কোন নদী দেখতে যাচ্ছি?
—–আমরা যেখানে যাচ্ছি ওখানে একটা নদী আছে। লিদার নদী। ঐটা ভেতাবভ্যালির মাঝ বরাবর বহমান। ঐ নদীর শব্দ ভেসে আসছে।
প্রতিউত্তরে বলল তিতাস।
একটুপর ই তারা নদীর কাছে পৌঁছে গেল। নদীটি ক্ষরশ্রোত নয়।কিন্তু এর সৌন্দর্য অপরুপ! পাহাড়ি নদীর বাঁকে বাঁকে বুনো ফুলের দেখা মিলে অনেক। রঙবেরঙে অপূর্ব সেই ফুলগুলো। আর তাছাড়া চোখ বুঝলে অনুভব করা যায় এক মিষ্টি গন্ধের! যা ভেসে আসছে পাহাড়ি লাল মাঠি থেকে! সত্যিই অপরুপ মনকাড়া এক অনূভূতি! দু’হাতে মেলে নিশ্বাস নিয়ে যা অনুভব করা যায় প্রচন্ডভাবে !

নদী দেখা শেষে একশরুপির টিকেট কেটে তারা প্রবেশ করলো ভ্যালিতে। আসলে প্রকৃতি মুঠোভরা সৌন্দর্য দুহাত মেলে দিয়েছে এই ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে! একেক স্হানের একেক রুপ, কেবল দৃষ্টিনান্দনই নয় বরং হৃদয়হরনেও পটু এই রূপসীর সৌন্দর্য। বন্যার বারবার ইচ্ছে হচ্ছে দু’হাত মেলে চিত হয়ে শুয়ে রয় সে এই সৌন্দর্যঘেরা ভ্যালির নরম ঘাসে! কিন্তু তাদের সময়ও কম।আর তাই তারা সেখানে কিছু ছবি তুলে রওনা দিল অন্য স্পটের উদ্দেশ্যে।

ভ্যালি থেকে একটু দূরে আরেকটি স্পট, চন্দনওয়ারী। আর এই চন্দনওয়ারী একদমই আলাদা ভ্যালী থেকে! যেখানে ভ্যালী কেবল সবুজের সমারোহ সেখানে চন্দনওয়ারী বরফে ঢাকা! কাছাকাছি দুইটি স্পটের মাঝে এতো পার্থক্য দেখে বিস্ময়ে থ বনে গেল সবাই! এই বরফের মাঝে ওপরে উঠতে হবে তাদের! বরফের সিঁড়ি কেটে পাহাড়ের ওঠার রাস্তা করে দিলেও এই রাস্তা বড্ড পিচ্ছিল। আরশী উঠতে গিয়ে খামচে ধরে ইরশাদের জ্যাকেট।আর সাথে সাথেই ইরশাদ মুচকি হেঁসে একদম বুকে টেনে নেয় তাকে। যেন কোন বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে সে!

অন্যদিকে বন্যা ভিতু দৃষ্টিতে একপা একপা করে সামনে পা বাড়াচ্ছে। টকটক করে কাঁপছে সে! আর তা শীতে নাকি ভয়ে তা যেন বোধগম্য হলো না করোরই।হুট করে সাগর মুচকি হেঁসে একঝটকায় কোলে তুলে নেয় তাকে! এতে বন্যা বড় বড় চোখ তুলে তাকায় সাগরের চেহারার দিকে! কিন্তু বন্যার বিষ্ময় ছাড়িয়ে সাগরের মুখে অমায়িক হাসি ঝুলছে ! সে বন্যার ভীতু চেহারার দিকে তাকিয়েই সামনে বাড়াতে থাকে! কিন্তু হঠাৎ ঘটলো দূর্ঘটনা!, হুট করেই পা পিছলে গেল তার।আর এই কারনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তারা দুজন একদম সিঁড়ি বেয়ে নিচে! বাকিরা সবাই ততক্ষণে উঠে গিয়েছে উপরে! তারা তাড়াতাড়ি নামতে চায়লো এদের অবস্হা দেখে। কিন্তু হাত উঁচিয়ে তারা ঠিক আছে এমন ইশারা করলো সাগর।

পুরো শরীর মাখামাখি হয়ে আছে দুজনের বরফে। বন্যা দাঁড়িয়ে বরফগুলো ঝেড়ে, নাক ফুলিয়ে তাকালো সাগরের দিকে। আর তা দেখে ক্যাবলার মতো হাসি দিল সাগর। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না তার। বন্যা নাক ফুলিয়ে আরো কয়েকদফা তাকে বকে, সাবধানে উঠে গেল উপরে।আর তার পিছুপিছু উঠে পড়লো সাগরও।
সাদা শুভ্রতার ভিড়ে অনাবিল সৌন্দর্য উঁকি দেয় এই চন্দনওয়ারীতে। যা মনে জাগায় প্রশান্তি। আর তাই সেই বরফে ঢাকা রাজ্য ছেড়ে আবার গন্তব্যে ফিরে আসতে গিয়ে মন করে সবার আনচান।

গাড়িতে ইরশাদের কাঁধে মাথা রেখে আরামে চোখ বুঝলো আরশী৷ আর ইরশাদ আলতো হাত ছুঁয়ালো আরশীর মাথায়। আরশী আরামে চোখ বুঝলো। তারপর বলল,
—– বাসার সবাই যদি না মানে আমাদের সম্পর্কটা!
—— আমি আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রতিউত্তরে চোখ মেলে অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে মৃদুশ্বাস ছেড়ে আবার চোখ বুঝলো আরশী। আর ইরশাদ আরশীর অলক্ষ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজেদের নিয়তির চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লো।

মুখ ফুলিয়ে রাখা বন্যার চেহারার দিকে মুচকি হেসে তাকালো সাগর। তারপর আলতোভাবে খোঁচা দিল সে তার হাতে। মুহূর্তেই তেড়ে উঠলো বন্যা।আর বলল,
—— কি সমস্যা? সুতাক্রিমি নড়েচড়ে? মানুষকে খোঁচাস কেন?
—— আমি তোমার হবু হাসবেন্ড লাগি সোনা। এইভাবে কেউ বলে!
—— কাদের বাড়ির বৌ বলল যে তুই আমার হবু হাফপ্যান্ট লাগিস?
বন্যার নির্লিপ্ত কথায় অতিরিক্ত অবাক হলো সাগর। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
—— তুমি ই তো বললে, ভালোবাসো আমাকে!
—– এখন ভালোবাসি বললেই কি গরুর ঘন্টার মতো কোমড়ের সাথে ঝুলিয়ে নিতে হবে তোকে?
এই বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো বন্যা। সে রওনা দিল হোটেলের দিকে। আর তার পিছুপিছু মুখ কালো করে দৌড়ে চলল সাগর।

ডিনার শেষ করে, সবার সাথে গল্প করতে করতে হোটেলে প্রবেশ করছে সবাই। হঠাৎ হোটেন গেইটে ঢুকতে গিয়ে জোরেসোরে হুঁচট খেল আরশী।আর সাথে সাথেই বিকৃত হয়ে গেল তার মুখ! ইরশাদ তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে দেখলো। বুড়ো আঙ্গুলের কাছটা খুব বেশী কেঁটে গিয়েছে আরশীর! বন্যা সেদিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পরিষ্কার করে দিল ক্ষতস্থানটি।আর এতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো আরশী।তিশা আরশীর ব্যাথাতুর চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
—– হাঁটতে পারবে সামনে?
—— হুম।
আলতোভাবে মাথা ঝাকালো আরশী।কিন্তু সামনে পা বাড়িয়েই দাঁতে দাত চেপে চোখ বুঝলো সে। আচমকা ইরশাদ একঝটকায় কোলে তুলে নিল তাকে! আর এতে বিস্মিয়ে চোখ বড় বড় করে ইরশাদের দিকে তাকালো আরশী! কিন্তু ইরশাদ অত্যান্ত স্বাভাবিক ভাবেই তাকে কোলে নিয়ে সামনে পা বাড়ালো। আরশী লাজুক দৃষ্টি ফেলে অপলকে তাকিয়ে আছে ইরশাদের পানে। বড্ড মিষ্টি লাগছে ইরশাদকে আজ! নেভিব্লু শার্টটির ওপর হুয়াইট ব্লেজার পড়েছে ইরশাদ। চুলগুলো ভলিউম করা। ঠোঁটের কাছটা হালকা দাবানো৷ যা হাসিতে টোলের সৃষ্টি করে। এই মিস্টি ইরশাদকে বারবার ছুঁইয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় আরশীর। আর তার সেই মিষ্টি স্মেল! তা যেন মাতাল করে দেয় তাকে!
আশেপাশের বাকিরা দুজনার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমিভরা আলাপ করতে লাগলো একের পর এক। আর এতে যেন আরো বেশী লাল হতে উঠলো আরশী!

হঠাৎ কিছুটা পথ সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ইরশাদ! বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সে সামনে! বাকিরাও দাঁড়িয়ে গেল ইরশাদের পাশেই! মৃদু ফিসফিসানীর শব্দ কানে আসতেই কনফিউশান নিয়ে, পাশ ফিরে তাকালো আরশী। সামনের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো নিয়ে ইরশাদের রিয়েকশন দেখে অবাক হলো সে! কিন্তু তখনি সে আরো একটি পরিচিত মুখ দেখলো ঐ মানুষগুলোর ভিড়ে ! আর তার সাথে দেখলো আরো অনেক পরিচিত মুখ!
সেদিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নামতে উদ্ধত হলো আরশী। চোখে মুখে ভীতি স্পষ্ট! ইরশাদ এতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে! কিন্তু আরশী বারবার অনুরোধ করলো তাকে যেন তাকে নামিয়ে দেয়।

আরশী নামার সাথে সাথেই দুজন একসাথেই বলে উঠলো,
” বাবা আসলে আমরা! ”
এবার চমকে একে অপরের দিকে তাকালো ইরশাদ আর আরশী। আর সাথে বাকিরাও! সবাই ভেবেই পাচ্ছে না হুট করে ইরশাদ আর আরশীর বাবা মা এখানে কেন!

_____******
ডুয়েল কেবিনের সামনের রুমে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত ইরশাদের পিতা-মাতা ইসফাক -জেসমিন আর আরশীর পিতামাতা শাওন-আফিয়া। আর পেছনের রুমে বাকিরা সবাই। ইরশাদ ফিসফিসিয়ে বোনদের জিঙ্গেস করলো কি হয়েছে। কিন্তু অনীলা আর অতশী যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে এমনভাবেই চুপ করে রইলো। ইরশাদের দুলাভাই একজন প্রবাসী আর আরেকজন ব্যবসায়ী।তবে দুজনই ইরশাদের সাথে ভালোই ফ্রেন্ডলী। কিন্তু তাদের একজনকেও দেখা গেল না আশেপাশে। ইরশাদের মনটা খারাপ হলো। তারা আসলে হয়তো কি হয়েছে জানতো সে।

আরশী নিঃশব্দে কেঁদেই চলেছে। বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছে তার ভয়ে। সে আয়মানের হাতদুটি চেপে ধরে অনুনয় স্বরে বলল,
—– বাবা হঠাৎ এখানে কেন আপু?
—– আমি কি করে বলবো কি করেছিস। হঠাৎ আমায় কল দিয়ে বলল কাশ্মীর আসছে আর সাথে আমাকেও আসতে বলল। জরুরি বলায় তোর ভাইয়াকে নিয়ে চলে এলাম। ছেলেটার স্কুলও বন্ধ আর বাবার বিষয়টাও সিরিয়াস মনে হলো তাই আসা। কিন্তু এসে তো অবাক! এই ছেলেটাই বা কে? আর ইরহাম! ওর সাথে কি করেছিস?

আরশী এবার ফুফিয়ে কেঁদে দিল। অশ্রুর ধারা বারবার চিবুক ছুঁয়ে পড়ছে তার। হঠাৎ সামনের রুম থেকে ডাক পড়লো তাদের সবার৷ আর ধিমিপায়ে মাথার ওপর কাপড়টা টেনে সামনে এগিয়ে গেল আরশী।আর তার পিছুপিছু গেল ইরশাদও।
মাথা নুইয়ে বাড়ির বড়দের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরশী ইরশাদ! ভয়ে গলা কাঁপছে দুজনেরই। কিন্তু ইরশাদ নিজের ভয়টা চেপে ইশারায় আরশীর বুঝালো,
” আমি আছি।কিছু হবে না!”

শাওন সাহেব আর ইসহাক সাহেব আঁড়চোখে সেদিকে তাকালো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো শাওন সাহেব,
—– আরশী। তুমি আমাকে ভয় পাও না ভালোবাসো?

ছলছল চোখে বাবার চেহারার পাণে তাকালো আরশী। মুহূর্তেই দুফোঁটা অশ্রু বয়ে গেল তার চিবুক ছুঁইয়ে। আরশী অশ্রুটুকু মুছে, আলতো নাক টেনে বলল,
—– আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি বাবা।
শাওন সাহেব আলতোভাবে মাথা ঝাকালো। তারপর আলতো কপাল কুঁচকে আবার প্রশ্ন ছুড়লো,
——- ইরহাম তো তোমার হবু হাসবেন্ড তাই না?
আরশী এবার মাথা নুইয়ে ফেলল। মুখ থেকে কোন কথায় বের হচ্ছে না তার৷

ঠিক তখনি কথা বলে উঠলো ইসহাক সাহেব,
—– তোমার কোন কথার বা আবদারের কি বরখেলাপ হয়েছে ইরশাদ? যে তুমি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলে! আমার থেকে জিজ্ঞেস করলে কি কোন সমস্যা হতো? আরেকজনের বৌ এর সাথে প্রেম করছো এখানে বসে!
—– সে আমার ও বৌ বাবা। আমার সাত বছর আগের সেই বৌ যাকে আমি এতো বছর খুঁজেছি।
—– কিন্তু তুমি তো তখন বলেছিলে মেয়েটিকে ভূলে যাবে। সে এতো মিথ্যে বলল, এতো অসম্মানিতে ফেলল আমাকে।আর এখন তুমি তাকে চাও?
—– যা ঘটেছে তা দূর্ঘটনা।

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইসহাক সাহেব।তারপর নরম স্বরে বলল,
—– আমাদের ইচ্ছের কোন দামই নেই তোমাদের কাছে!

ঠিক তখনি ধুপ করে মেঝেতেই বসে পড়লো ইরশাদ আর আরশী। তারপর মাথা নুইয়ে বলল ইরশাদ,
—– সন্তানের ওপর পিতামাতার অধিকার সবচেয়ে বেশী। আপনাদেরকে পূর্বেও অনেক কষ্ট দিয়েছি। সেইসব কিছু আবার পুনরাবৃত্ত হোক আমরা তা চায় না। হ্যা এইটা সঠিক, আরশীকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। তবে আপনাদের খুশীর জন্য আপনাদের ইচ্ছের অবাধ্য ও হবো না আমরা।

আফিয়া আর জেসমিন আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছে। আরশী সেদিকে তাকিয়ে কান্না আঁটকে বলল,
—– সবসময় আপনার বলা সকল কথা আদেশ সরুপ পালন করেছি, বাবা। এবার ও যা বলবেন মাথা পেতে মেনে নিব৷ টু শব্দও বের হবে না কন্ঠনালী থেকে। আর আন্কেল, আমার করা ভূলগুলোর জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। পারলে ছোট মানুষ ভেবে মাফ করবেন আমায়।

ইসহাক আর শাওন একে অপরের দিকে তাকালো।তারপর একসাথে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—– আজ আরশীর সাথে তার মা শুবে। আর ইরশাদের সাথে আরশীর দুলাভাই আশিক। আর তোমরা নিজেদের ফোনগুলো আমাদের কাছে জমা দিয়ে যাও। আমরা কাল জানাবো আমাদের মতামত। এবার যাও সবাই ঘুমাও।

সবাই বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে।আর পিতাদ্বয় নিজেদের মাঝে আলোচনা করতে লাগলো কি করা যায়।

চলবে

( সরি ফর লেইট। নেক্সট পর্ব কালকেই দিব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here