প্রেয়সী পর্ব – ১১+১২

#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখনীতেঃমুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১১

২১.

বাবা কে ইন্ডিয়া নেওয়ার সকল কার্যক্রম শেষ। রাত এখন ৩ টা। বাবার কেবিনের সামনে সবাই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু অপরিচিত মুখেরও দর্শন মিলছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কিন্তু আমি চিনতে পারছিনা তাদের। অবাক চোখে সবার পানে তাকাচ্ছি থেকে থেকে।
হঠাৎ কোনো পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলাম। সেদিন রাস্তায় যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো তাকেও দেখা যাচ্ছে। আন্টি রাফিদ ভাইয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। তার পাশেই দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোককে বারবার কিছু বলছেন। চিন্তার ভাজে তার ফর্সা মুখখানা র//ক্তশূণ্য হয়ে আছে। আমার পাশেই নিতু আপু দাঁড়িয়ে। তাই নিতু আপুকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম,

—-” উনারা কারা? আর ঐ ভদ্রমহিলাকে তো আমি চিনি। উনি রাফিদ ভাইয়ার সাথে কি করছেন?”

নিতু আপু ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন,

—-” উনারা রাফিদের বাবা-মা। আর ঐ পাশে সুন্দর মতো যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে উনি রাফিদের কাজিন। হিমাদ্র ভাই।”

আমি আবারও তাকালাম তাদের দিকে। আন্টিকে দেখে সেদিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেলো। উনি উনার ছেলে রাহিয়ান বলতে রাফিদ ভাইয়াকেই বুঝিয়েছিলেন? আর উনার পাশের ভদ্রলোক উনার হাজবেন্ড?

হঠাৎ আন্টির চোখে চোখ পড়লো। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে শুঁকনো হাসি দিলাম। উনি কিছুক্ষন টলমল চোখে তাকিয়ে থেকে বড় বড় ধাপ ফেলে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখে শুঁকনো হাসি দিয়েই তাকালাম তার দিকে। কিছু বলতে যাবো তার মধ্যেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। উনার ছোঁয়া পেয়ে সারা শরীর হঠাৎ শীতল হয়ে উঠলো আমার। মন যেন আত্নচিৎকার পেড়ে বলে উঠছে, এই ছোঁয়া কেবল আমার মায়েরই হতে পারে।” ভেতরটা ডুকরে উঠলো আমার। খুব ইচ্ছে হলো এই অপরিচিত আন্টিকে মা বলে ডাকতে। আমি মনে মনে ভাবলেও আন্টি মুখেই মা বলে ডেকে উঠলেন আমায়। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম আন্টির কার্যকলাপে। মনে মনে প্রশ্ন তৈরি করতে পারলেও মুখে আনতে পারলাম না সেসব। উনার কান্নাতে যেন আমার মনটাও ভেঙে যাচ্ছে। উনি শক্ত করে আগলে ধরলেন আমায়। কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলতে লাগলেন,

—-“আমার নিধি। তুই আামর নিধি! হিসেব নেই কতগুলো বছর ধরে পা/গ/লে/র মতো খুঁজে বেড়িয়েছি তোদের। না জানি কোথায় কোথায় খুঁজেছি আমার অভিমানি বোনটাকে। সেই যে গেলো বাড়ি ছেড়ে আর কখনো এমুখো ফিরলোই না! বাবা মা কেমন করে পথ চেয়ে বসে থাকতো ওর।”

কথা গুলো বলে আবারও কাঁদতে লাগলেন তিনি। আমি উনার কথা গুলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। শুধু শুনে যাচ্ছি। ভেবে যাচ্ছি কি বলছেন তিনি?

আমার ভাবনার মাঝে আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন তিনি,

—-” আজ যখন পেয়ে গিয়েছি তোদের আর কখনো কাছ ছাড়া করবো না দেখে নিস। তোকে আর তোর বাবাকে আমার কাছেই নিয়ে রাখবো। কখনো আর হারাতে দেবোনা রে মা। তাকে তো হারিয়েই ফেলেছি কিন্তু তোকে… তোকে আর কিছুতেই হারাতে দিবো না!”

আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,

—-” আপনি এসব কি বলছেন আন্টি?”

উনি হঠাৎ-ই হেসে ফেললেন। বোধকরি সুখের হাসি হাসলেন। আমার দু’গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,

—-” আন্টি কি রে? বল বড় খালামনি! আমি তোর অভাগী মায়ের বড় বোন রে।”

বুকের ভেতরটা ধক করে কেঁপে উঠলো। স্ব জোরে আ/ঘা/ত হেনে গেলো মনে। উনার কথাটা আরেকবার মাথার মধ্যে বেজে উঠতেই আরও এক দফা ধাক্কা খেলাম যেন। হকচকিয়ে উনার হাত চেপে ধরলাম। একরাশ বিষ্ময় আর উত্তেজনায় প্রশ্নবিদ্ধ মুখ নিয়ে উনার দিকে তাকাতেই উনি আবারও হেসে ফেললেন। চোখ থেকে ঝড়ে যাওয়া জল গুলো মুছতে মুছতে হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন,

—-” তুই আমার কলিজার টুকরার একমাত্র স্মৃতি মা। কতকত জায়গায় খুঁজেছি তাকে তার সত্যিই যে কোনো হিসেব নেই।”

আমি এবার কান্নার বেগ চেপে রাখতে না পেরেই ঝাপটে ধরলাম বড় খালামনিকে। শব্দ করে কেঁদে উঠতেই আরেকজোড়া স্নেহের হাত পড়লো আমার মাথার উপর। মাথা তুলে তাকাতেই দেয়ালে টানানো মায়ের ছবিটার অনুরূপ আরেকজনকে আবিষ্কার করলাম। মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতেই বড় খালা মনি বলে উঠলেন,

—-” এটা তোর মেঝ-খালামনি।”

আমার চোখ জোড়া আবারও ঝাপ্সা হয়ে এলো। আমার মা নেই কে বললো? এই তো পেয়ে গিয়েছি দু-দুটো মা। মেঝ-খালামনিও কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। ক্ষণিকের জন্য বাবার শোক ভুলে গেলাম। আস্তে আস্তে আরও অনেককে পেলাম। সবই আমার নানু বাড়ির মানুষ। জানতে পারলাম বড় খালামনির একজনই রাজপুত্র। রাহিয়ান রাফিদ। বাইরে তিনি রাফিদ নামে খ্যাত হলেও পরিবারের সবার কাছে তিনি রাহিয়ান নামেই খ্যাত। মেঝ-খালার দুই সন্তান। রিম্পি আপু আর ফাহিম ভাইয়া। ফাহিম ভাইয়া রাফিদ ভাইয়ার থেকে একবছর জুনিয়র আর রিম্পি আপু তিন বছরের। আমাদের মামুও আছেন নাকি তিন জন। কিন্তু কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ রাখেননি। তিনজনেই নানা-নানুকে ছেড়ে তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। নানা নানু মা//রা গিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। নানু নাকি মায়ের শোকেই প্যারালাইজড ছিলেন বহুবছর। হঠাৎ একদিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। আর নানুর শোকে নানাও গত হলেন। মায়ের তার পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার সঠিক কারন এখনো জানতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম, এতো সুন্দর একটা পরিবার রেখে কেউ কি এভাবে চলে আসতে পারে? সেদিন হঠাৎ বড় খালামনির সাথে যখন দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি কারোর একটা এনগেজমেন্টে যাচ্ছে বলেছিলেন সেটা রিম্পি আপুরই এনগেজমেন্টে ছিলো নাকি। হসপিটাল আপাতত আমাদের গুষ্ঠির মানুষ দিয়েই ভর্তি। বাবার সেন্স ফিরতে বড় খালামনি আর মেঝ-খালামনিকে দেখতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। মা-যে আর বেঁচে নেই সেই কথা স্বরণ করে আবারও কাঁদলেন সবাই।

আমি পা/থ/র হয়ে এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সবটা। বাবার কাছে যেতে সাহস হচ্ছিলো না। বাবাকে জোড় গলায় বলতেও ইচ্ছে করছিলো না “বাবা জলদি ঠিক হয়ে উঠো!” কেননা মানুষ তখনই কাউকে হারায় যখন সে তাকে খুব বেশি করে চায়। যাকে অতিরিক্ত ভালোবাসা হয় সেই ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। এই ভ/য়/টা/ই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো আমায়। বাবার সাথে কথা বলে এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলেন। গেলেননা শুধু বড় খালামনি আর রাফিদ ভাইয়া। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো? দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি বাবার কাছে যাবো?

বাবা টলমল চোখে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। বড় খালামনি কিছু একটা বলছেন বাবাকে। বাবা শুনছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। রাফিদ ভাইয়া মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে শুনছে মায়ের কথা। তাদের আলাপন আমার কান অব্দি এসে পৌঁছচ্ছে না অবশ্য। বাবা নিঃশ্বাস টেনে আবারও ছেড়ে দিলো। মুখে স্নিগ্ধ কোমল হাসি এঁটে আমাকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলো। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানিনা আমার পা আমার সঙ্গ দিচ্ছে না! আমায় বাবার কাছ অব্দি এগিয়ে যেতে সাহায্য করছেনা। রাফিদ ভাইয়া হইতো আমার অবস্থা বুঝে এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরে বাবার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” বাবার সাথে কথা বলো। কিছুক্ষণ বাবার সাথে থাকো।”

কথাগুলো আমায় বলেই তৎক্ষনাৎ বড় খালামনির উদ্দেশ্যে বললেন,

—-” মা চলো আমরা বাইরে অপেক্ষা করি।”

বড় খালামনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললেন,

—-” বাবার সাথে কথা বল মা। এভাবে গুমড়ে থাকিস না।”

কথাটা বলেই চলে গেলেন তারা। তাদের যাওয়ার পানে একবার তাকিয়ে বাবার দিকে তাকালাম আমি। বাবার চোখ মুখ শুঁকিয়ে আছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যতিরেকে বাবার শুঁকনো মুখটা দেখতে ক/ষ্ট হচ্ছে আমার। খুব ক/ষ্ট হচ্ছে। বড় খালামনির বসে থাকা জায়গাটায় বসে বাবার হাতের উপর হাত রাখলাম। কান্নার বেগ চেপে অভিযোগের সুরে বললাম,

—-” ভালোই তো পারো নিধিকে ভ/য় দেখাতে। মাঝেমধ্যে যে দশ বারো সেকেন্ডের জন্য চোখ বুঁজে বলতে নিধি তোর বাবা হারিয়ে গেছে! সে অব্দিই তো ঠিক ছিলো! তাহলে আজ হঠাৎ এতো গুলো ঘন্টা পার হওয়ার পরও কেন চোখ খুললেনা? কি ভেবেছিলে? সত্যিই হারিয়ে যাবে? নিধিকে একা নিঃসঙ্গ করে মিসেস খানের সঙ্গী হবে? শুনো মি. খান আমি তোমায় সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, নিধিকে একা নিঃসঙ্গ করে হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা এবার বাদ দাও। তোমায় ছাড়া নিধির খুব ক/ষ্ট হয়। সে-কথা হয়তো নিধি কখনো মুখ ফুটে বলবে না তোমায় কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে। বাবাকে ছাড়া নিধি একদিনও বাঁচতে পারবেনা মি. খান। এই কথাটা একদম মগজে ঢুকিয়ে নিবে। তুমি হয়তো জানো না মি. খান, তোমার ঐ দশ বারো সেকেন্ড চোখ বুঁজে থাকা সময়টাও নিধিকে কতটা নিঃসঙ্গ করে তুলতো? কি করে অসহায় করে তুলতো? খেলাটা হয়তো তোমার কাছে মজার ছিলো কিন্তু নিধির কাছে কখনোই মজার ছিলো না। খুবই
য/ন্ত্র/ণা/দা/য়/ক ছিলো। আজও বড্ড য/ন্ত্র/ণা/দা/য়/ক তোমার এই চোখ বুঁজে থাকার খেলাটা। আমি কিন্তু মিসেস খান কে অভিযোগ করবো। তুমি বড্ড বেশি করছো নিধির সাথ! ব..বড্ড বেশি…”

শেষ কথাগুলো খুব বিশ্রি ভাবে দলা পাকিয়ে গেলো গলায়। ঢোক গিলেও আর কিছু বলা সম্ভব হলোনা। বাবা হু হু করে কেঁদে উঠলো। বাবার কান্না দেখে এবার আর আমার পক্ষেও সম্ভব হলোনা নিজেকে সামলে রাখা। আমিও শব্দ করে কেঁদে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। নিধি কখনো কাঁদে না! কিন্তু আজ কেন জানি না কান্না না করে থাকতে পারছিনা! মনে হচ্ছে কান্না না করলে একবুক ক/ষ্ট নিয়েই ম/রে যাবো আমি। কিছুতেই এতো ক/ষ্ট নিয়ে বাঁচা সম্ভব হবেনা। কিছুতেই না!

২২.

—-” আমি বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা প্লিজ! আমাকেও নিয়ে চলো সাথে।”

আমার কথা শুনে সবাই এক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বাবাকে নিয়ে এক্ষনি বের হচ্ছেন বড় খালু আর বড় খালামনি। সঙ্গে মেঝ-খালামনিও যাবেন বলছেন। কিন্তু আমাকে কেউ যাওয়ার কথা বলছেনা! কেন বলছেনা? আমাকে কেউ নিবেনা বলেই মনে হচ্ছে! কিন্তু বাবাকে ছাড়া আমি একা কি করে থাকবো?

বড় খালামনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। স্নেহময় কন্ঠে বললেন,

—-” নিধি! তুই ওখানে গিয়ে কি করবি মা? এই দেখ আমি তো যাচ্ছি। তোর বড় খালুও যাচ্ছেন,হিমাদ্রও যাচ্ছে! আমরা কি তোর বাবার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট করাতে পারবো না? নাকি ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারবো না? আমাদের উপর কি তোর একটুও ভরসা নেই বলতো?”

—-” না গো খালামনি! তুমি প্লিজ এভাবে বলো না! তোমরা হয়তো আমার থেকেও ভালো যত্ন নিতে পারবে বাবার। কিন্তু আমি… আ..আমি তো এর আগে কখনো বাবাকে ছেড়ে থাকিনি!! আমি বাবাকে ছেড়ে থাকতেও পারবোনা প্লিজ… আমায় প্লিজ নিয়ে চলো খালামনি!”

মেঝ-খালামনি আমায় তার কাছে নিয়ে কোমল স্বরে বললেন,

—-” দেখ মা! আমিও যাচ্ছি বড় আপাদের সাথে! এতদূরের পথ আর তারউপর তোর শরীরটাও কিন্তু ঠিক নেই। তুই থাক এখানে। এই দেখ এই যে তোর রিম্পি আপু, রাহিয়ান ভাইয়া,ফাহিম ভাইয়া এরা সবাই আছে। তুই ওদের সাথেই থাকবি। সারাক্ষণ ওরা তোর সঙ্গে থাকবে মা। দেখবি একদমই তোর একা লাগবে না। বাড়িতে কিন্তু আরও লোক আছে। আদ্রিতা আছে। খুবই মিষ্টি মেয়ে ও। এতো গুলো মানুষের মাঝে দেখবি তোর বাবার কথা সেভাবে মনেই পড়বেনা। শোন মা, পাগলামি করিসনা লক্ষিটি। ওখানে তো বাবার ট্রিটমেন্ট হবে বল? এখন যদি তোকেও নিয়ে যাই তবে আমরা কতদিকে দেখবো? বাবাকে দেখবো নাকি তোকে দেখবো?”

রিম্পি আপু আর নিতু আপু আমায় বোঝাতে লাগল একই কথা। রিম্পি আপু বলল,

—-” এই নিধি যাস না বোন। ছোট খালু একদম ফিট হয়ে খুব জলদিই ফিরে আসবে রে। আমরা আছি তো তোর সাথে। প্লিজ যাস না তুই।”

নিতু আপু বলল,

—-” হ্যাঁ রে নিধি। চাচাকে ট্রিটমেন্ট করিয়ে তো খুব জলদিই নিয়ে আসবে তাই না? তুই থেকে যা বোন। যাস না। তোর যদি ঐ বাড়িতে বেশি খারাপ লাগে তবে সব্বাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসবি। আমরা খুব মজা করে কাটাবো। দেখবি বাবা কাছে নেই বলে তোর একদমই মন খারাপ হবেনা।”

সবার বলার মাঝে রাফিদ ভাইয়াও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

—-” সবাই যখন বলছে তখন থেকে যাওনা নিধি। হয়তো সময়টা তোমার ততটাও খারাপ কাটবেনা যতটা তুমি ভাবছো।”

বাবার কথা মনে পড়লেই কারোর বারন কান অব্দি আসছেনা। কিন্তু পারলাম না নিজের জেদ ধরে রেখে বাবার পিছু পিছু যেতে। সবার অনুরোধের ভারে রাজি হয়ে গেলাম তাদের সাথে থাকতে।

ঘন্টা খানিকের মধ্যে বড় খালামনিরা ইমারজেন্সি টিকেটে চলে গেলেন বাবাকে নিয়ে। এদিকে বাবাকে চলে যেতে দেখে আমি আবারও কাঁদতে লাগলাম। মনটা মানছে না বাবাকে একা ছেড়ে দিতে। মন বলছে বাবার কিছু একটা হয়ে গেলেও আফসোস হবেনা এই ভেবে বাবা যে আমার কাছেই আছে। আমার চোখের সামনে আছে। কিন্তু এখন যে তাও নেই। বাবার কিছু একটা হয়ে গেলে নিধি আর বাঁচবে না। একদমই বাঁচবে না।

দশ মিনিট হলো বড় খালামনিদের বাড়িতে এলাম। ওদিক থেকে হিমেল ভাইয়া আর নিতু আপু চলে গেলো বাসায়। আর এদিকে রিম্পি আপু আর ফাহিম ভাইয়া আমাদের সাথেই এলো। আমাকে পাঁচ জনে একসাথে থাকার মতো একটা রুম দিলো। এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যেতেও আমার কয়েকমিনিট অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তখনকার মতোই চারিপাশ গোলকধাঁধার মতো লাগছে। বাসায় ফিরে রাফিদ ভাইয়াকে আর দেখা গেলো না। আদ্রিতা আপু আর রিমলি আপু আমাকে এই রুমে দিয়ে গেলো। আমার হাতে কয়েক সেট ড্রেস তুলে দিয়ে বলল, এখান থেকে একটা ড্রেস পড়ে জলদি ফ্রেশ হয়ে নিতে। আমিও সেই মোতাবেক জলপাই রঙের স্কার্টটা নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হতে হতে ফজরের আজানের ধ্বনিতে বুক ফুলে উঠলো আমার। ফ্রেশ হয়েই জলদি ওজু করে বের হয়ে আসলাম। ভেবেছিলাম আদ্রিতা আপুর থেকে একটা জায়নামাজ চেয়ে নিবো। কিন্তু সেই কষ্ট আর করতে হলো না। হাতের ডানেই একটা জায়নামাজ ভাজ করা দেখে মনে শান্তি এসে গেলো যেন। আর সাত পাঁচ না ভেবেই জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজের সাথে সাথে বাবার সুস্থতা কামনায় আরও চার রাকা’ত নফল নামাজ পড়ে ফেললাম। আল্লাহর দরবারে হাত তুলতেই দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ কষ্ট যেন জড়ো হলো মনে। যত পারলাম সেজদা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ কে বললাম। দিন শেষে নিধি কিছুই চায়না কেবল তার বাবাকে ছাড়া।

#চলবে____________________

[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১২

২৩.

ভোর রাতের অন্ধকার টুকু কুয়াশার মতো আস্তে আস্তে উড়ে যাচ্ছে। বেডের পুর্ব দিকে বিশাল আকারের এক জানালা। আর তার পাশ ঘেঁষেই বিশাল ব্যাকলনি। ব্যালকনির থাই-টা চাপিয়ে ব্যালকনিতে পা রাখতেই বাইরের শীতল বাতাসে মনের বিষন্নতা কেটে গেলো আমার। কয়েক-ঘন্টা যাবত ঘটে চলা ঘটনা গুলো যেন নিস্তব্ধতায় হারিয়ে গেল। আমি মনে খুলে নিঃশ্বাস নিলাম। এই সাইড টা বাড়ির পেছনের দিক। আমার চোখের সামনেই অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে বড় বাগানটা স্পষ্ট হয়ে আসছে। বাতাসের সাথে সাথে ভেসে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলেদের সুগন্ধ। মনটা আরও ভরে উঠলো সেই সুবাসে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার হাতের ডান দিকেই একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমার ব্যালকনি ছাড়িয়েও আরও একটা ব্যলকনি জুড়ে তার বিচরন। চোখ আঁটকে গেলো আমার পাশের ব্যালকনিটায়। কতটা তাজা আর প্রাণোচ্ছল সম্পূর্ণ জায়গাটা। তার পুরো এক সাইড জুড়েই ফুল গাছ দিয়ে ভরে আছে। আর প্রত্যেকটা গাছের মাথায় তাজা ফুল। তাদের মিহি সুগন্ধে নিশ্চয়ই এর মালিক প্রতিনিয়ত মাতাল হয়। আমিও হচ্ছি। একদম মাঝ বরাবর দুজন মানুষ পাশাপাশি বসার মতো পার্ফেক্ট একটা দোলনা বাতাসের তালেই থেকে থেকে দুলছে। দোলনার উপর কালো গিটারটাও বেশ আয়েস করে বসেই যেন দোল খাচ্ছে। আর তাদের থেকেই যথেষ্ট দূরত্ব রেখে পাশাপাশি অবস্থান করছে একখানা বেতের মোড়া। তার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলটার উপর স্থান পেয়েছে এক খানা বই আর ধোঁয়া উড়ানো এক মগ কফি। ভেতরের রুমে আলো জ্বলছে। ভেতরের মানুষটার মুখ দর্শন না হলেও বেশ বুঝতে পারলাম এটা রাফিদ ভাইয়ার বিশিষ্ট রুম। রুমের প্রতিটি জিনিসই তা যেন গর্বের সাথে চিৎকার পেড়ে বলবে, “হ্যাঁ আমি রাহিয়ান রাফিদের সম্পদ।”

কথাটা ভাবতেই মনে মনে হেসে ফেললাম আমি। এসব কি ভাবছি আমি বোকার মতো। হাসতে হাসতেই উনার ব্যালকনি থেকে দৃষ্টি ফেরলাম। উনি খুব গোছালো মানুষ বোঝাই যায়।

—-” কফি খাবে?”

পেছন থেকে করোর কন্ঠ পেতেই চমকে উঠলাম আমি। এটা হলো নিজের খেয়ালে থেকে বেশি বেশি ভাবার ফল। আমার চমকে ওঠার দশা দেখে হয়তো পেছনের মানুষটাও ভড়কে গিয়েছেন। চটপট পেছনে ফিরে রাফিদ ভাইয়ার শুঁকনো মুখটা আবিষ্কার করলাম। মুখে জোরপূর্বক হাসি টানার চেষ্টা করে করে আমতাআমতা করে বললাম,

—-” হ..হাই!”

নিজের এমন আবুল মার্কা রিয়াকশনে নিজেই বোকা বনে গেলাম। উনি বিমল চাহনি দিয়ে বললেন,

—-” হ্যালো।”

—-” ক..কিছু বলবেন?”

—-” কফি।”

—-” জ্বী?”

—-” কফি খাবে?”

উনি আমাকে কফি নিয়ে সাধছিলেন। আমি উনার প্রস্তাবের কোনো জবাব দিতে পারলাম না। হঠাৎ-ই বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। কফি নিয়ে বাবার পাগলামি গুলো মনে পড়তে লাগল। এখন বাবা থাকলেও নিশ্চয়ই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে আসতো, নিধি কফি খাবি মা?” নিঃশ্বাস ভরে আসলো। টেনে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে রাফিদ ভাইয়া আবারও জিজ্ঞেস করলেন,

—-” খাবে?”

—-” না। আ..আচ্ছা বড় খালামনিরা কি পৌঁছেছে বাবাকে নিয়ে? ফোন করেছিলো? কিছু জানিয়েছে? বাবার শারীরিক কন্ডিশন এখন কেমন… কিছু…”

—-” রিলাক্স নিধি! এতো হাইপার হতে নেই। রিলাক্স। বসো এখানে, বসো বসো।”

আমি উনার কথায় হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললাম,

—-” বসবো? বসবো কেন?”

উনি পাশ থেকে ছোট্ট মোড়াটা টেনে আমাকে বসতে ইশারা করে বললেন,

—-” সিট। আমি এক্ষনি আসছি।”

এই বলেই বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলেন উনি। আমি বসতে বসতে উনার যাওয়ার পানে তাকালাম। উনি হঠাৎ আমাকে বসিয়ে এভাবে চলে গেলেন কেন? কাউকে ডাকতে? নাকি কিছু নিতে?

একটা ছোট্ট ট্রে-তে করে এক মগ কফি নিয়ে হাজির হলো রানির মতো দেখতে সেই মেয়েটি। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে আশেপাশে নজর বুলালো। হয়তো আমাকেই খুঁজছে। হঠাৎ আমাকে ব্যালকনিতে দেখতে পেয়ে যেন চমৎকার হাসলো। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

—-” আপনি এখানে? আমি তো আরও ভাবলাম ছোটসাহেবের ঘরে।”

মেয়েটার ভয়েস টোনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আর তার কথার ধরন। শুদ্ধ বাংলা। সচারাচর কাজের মেয়েরা কখনো এতো সুন্দর করে কথা বলে না। কারন অনেকেই বলে, কাজের মেয়েদের মুখে শুদ্ধ কথা নাকি শোভা দেয় না। যদিও আমি তা মানিনা। কেননা, সব মানুষই সমান। আর তাদের সব ভাষাতেই কথা বলার অধিকার আছে। হতে পারে তারা গরীব,তাদের যথেষ্ট অর্থ সামর্থ্য নেই যে, ধ্বনিদের মতো তারা চলাফেরা করতে পারে। তাই বলে ধ্বনিদের জু/লু/মে নিজের পরিশুদ্ধ ভাষাটাকেও বিসর্জন দিবে? এটা অ/ন্যা/য়।

মেয়েটা আমার সামনে হাঁটু ভে/ঙে বসলো। হাতে ধরে রাখা ট্রে-টা থেকে কফির মগটা উঠিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বলল,

—-” ছোটসাহেব বলল, আপনাকে কফি দিতে। খেয়ে নিন চটপট। ছোটসাহেবের মতে কফি নাকি শরীরের ক্লান্তি দূর করে। আপনিও তো খুব ক্লান্ত। আর তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। আপনি যখন ঘন্টা খানিক আগে আসলেন বাসায় তখনই আমার ইচ্ছে করছিলো আপনাকে সাস্থ্যসম্মত অনেক পদের খাবার বানিয়ে দেই। খেয়ে দেয়ে আপনি একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু ভাবি বলল,আপনার মন খুব খারাপ। কিছুক্ষন আপনাকে একা ছেড়ে দিতে। আপনি কিছুক্ষণ একা থেকে মনটা ভালো করুন তারপর সবাই মিলে আপনার সাথে থাকবে। আপনাকে সময় দিবে। যেন আপনার আর মন খারাপ না থাকে।”

মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি শুঁকনো হাসি দিলাম। মেয়েটা সত্যিই খুব চমৎকার করে কথা বলে। কিছুক্ষন শুনলে মন ভালো হওয়া সম্ভব।

আমাকে হাসতে দেখে মেয়েটাও হাসলো। হাতে ভর দিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেখিয়ে বলল,

—-” আপনি কফি টা খেয়ে এখানেই রেখে দিয়েন। আমি আবার এসে নিয়ে যাবো।”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই মেয়েটা মুচকি হেসে চলে গেলো। প্রকৃতিতে ততক্ষণে দিনের আলো ফুটে উঠেছে। এক্ষনি হয়তো সূর্য মামারও স্নিগ্ধ আলোতে ঝলমলে হয়ে উঠবে প্রকৃতি। এসব ভাবতে ভাবতেই চুমুক বসালাম কফিতে। কফিটাও বেশ ভালো হয়েছে। এই নিরস প্রাণহীন সকালটাতে যেন প্রান ঢেলে দিলো এক মগ কফি।

২৪.

—-” লিয়া এসেছিলো কফি নিয়ে?”

রাফিদ ভাইয়ার কন্ঠ পেয়ে প্রকৃতি থেকে মুখ ফেরালাম। উনার পরনের ধূসর রঙের টি-শার্টটার সাথে হাতে ধরে রাখা ধূসর রঙের ল্যাপটপ টা একদমই মিশে গিয়েছে। একই রঙ। অন্যহাতে কফির মগ। মগের চারপাশ জুড়ে উনার মনকাড়া হাসির চ্যাপ্টা আকারের একটা ছবি। হাঁটু সমান হাফ ট্রাউজার। ফর্সা পা টা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি আরেকটা মোড়া নিয়ে সেটার উপর ল্যাপটপ রাখতে নিলে একহাতে সম্ভব হলো না।

আমি আস্তে করে বললাম,

—-” এদিকে দিন আমি রেখে দিচ্ছি।”

আমার কথায় উনি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন। ল্যাপটপটা এগিয়ে দিতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। অন্য হাতে কফির মগটার দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বললেন,

—-” তুমি এটা ধরো।”

আমি ঘাড় কাত করে ছোট্ট করে বললাম,

—-” হু।”

উনি কফির মগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘুরে ফিরে ছোট্ট একটা টি-টেবিল নিয়ে এলেন। মোড়ায় বসে ল্যাপটপ টা টেবিলে রেখে ওপেন করে কয়েকটা ফোল্ডার ঘাটাঘাটি করে হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন। অপরাধী গলায় বললেন,

—-” সরি সরি! আমি তো ভুলেই গিয়েছি দুটো কফির মগই তোমার হাতে। খাচ্ছো কোন হাতে বলোতো?আমাকে বলবেনা একটা নিতে?”

আমি ছোট্ট করে হাসলাম। কিছু বললাম না। উনি এক মগ উনার হাতে তুলে নিয়েই তৎক্ষনাৎ চুমুক বসালেন। আমিও আর সাত পাঁচ ভাবলাম না। উনার ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে আমিও আবার চুমুক বসালাম। কিন্তু বিপত্তি হলো কফির স্বাদে। একটু আগে যেটা খেয়েছি তাকে হার মানিয়েই নিঃসন্দেহে বলা যায় এটাই হলো বেস্ট কফি। কিছু একটা মনে হতেই ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। আমি আমার কফি রেখে রাফিদ ভাইয়ার কফির মগটার দিকে তাকাতেই যেন আকাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়লাম। আমার কাশি লেগে গেল তৎক্ষনাৎ। কাশতে কাশতে কফির মগটা টে-টেবিলে রাখলাম। আমার কাশি দেখে রাফিদ ভাইয়া চমকে উঠলেন। উনি ল্যাপটপ ছেড়ে আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন ভেতরের রুমে, হয়তো পানি নিতে। আমি উনার অগোচরেই আবারও কফির মগ চেঞ্জ করে দিলাম। মনের অজান্তেই ভীষণ ভ/য় হচ্ছে। বিব্রত লাগছে। আমি উনার কফির মগ থেকে চুমুক দিয়ে খেয়েছি। আল্লাহ, একথা উনি যেন বুঝতে না পারেন! এটা সিক্রেট থাকুক তোমার আর আমার মাঝে। ছ্যা ছ্যা! কি কান্ড গো।

রাফিদ ভাইয়া হাজির হলেন পানির বোতল নিয়ে। আমার পাশে বসতে বসতে অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” পানিটা খেয়ে নাও। বিষম লাগলে কেন হঠাৎ?”

আমি মাথা নীচু করেই পানির বোতল হাতে নিলাম। কেন বিষম লাগলাম সে কথা বলার মতো হলে ঠিকই বলতাম। একদম গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম! কিন্তু সে কথা যে বলার মতো নয়!

উনার প্রশ্নবিদ্ধ মুখ চেয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। হয়তো উনিও বুঝে নিলেন এর জবাব আমার কাছে নেই। তাই উনিও আর কথা না বাড়িয়ে ল্যাপটপ ঘাঁটতে লাগলেন। ল্যাপটপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,

—-” আর মাত্র ত্রিশ মিনিট।”

আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,

—-” কিসের ত্রিশ মিনিট?”

—-” মা আর ত্রিশ মিনিট বাদে কল দিবে। আর তার জন্য আমাদের ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,

—-” বাবাকে নিয়ে সবাই পৌঁছে গিয়েছে?”

রাফিদ ভাইয়া অসহায় চোখে তাকালেন। বললেন,

—-” পৌঁছে যাবে নিধি। এতো টেনশন করো না।”

আমি মিইয়ে গেলাম। বাবার টেনশনে নিধি ঠিক পাগল হয়ে যাবে। উনি বোধকরি আমার মনের অবস্থা বুঝে নিলেন। কন্ঠে ভারী উৎসাহ নিয়ে বললেন,

—-” একটা জিনিস দেখবে?”

উনার উৎসাহ ঘেরা স্বরের সঠিক কারন খুঁজে পেলাম না। আমি নিজের মুখভঙ্গিমা একই রেখে বললাম,

—-” কি জিনিস?”

উনি মিষ্টি হেসে বললেন,

—-” ওয়েট দেখাচ্ছি।”

উনি ল্যাপটপে মনোযোগ দিলেন আর আমি কফিতে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা আরও একবার বারি খেলো মাথার মধ্যে। উনার মগের কফির স্বাদ এই কফির থেকে ভিন্ন। কিন্তু দুটোই ব্ল্যাক কফি। তবে স্বাদ আলাদা হওয়ার কারন কি হতে পারে বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সমস্যা হলো মনটা দু’দিকে ছুটছে। একবার মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি,তো আরেকবার মনে হচ্ছে ভুল করেও নয়!

—-” এই যে দেখো।”

উনি ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে ধরলেন আমার দিকে। ল্যাপটপের পুরো স্ক্রিন জুড়ে এক কিশোরীর চাঞ্চল্যকর ছবি ভাসছে। তার মুখ জুড়ে এক মন জুড়ানো হাসি। গাছ থেকে পেয়ারা পারছে। পেয়ারা গাছটা আহামরি বড় না। ছোটই বলা যায়। কিন্তু তার গাছের অগণিত পেয়ারা এক বিশাল গাছের প্রত্যাশিত ফলকেও হার মানিয়ে দিলো। কিশোরির চোখ জোড়া কোনো এক নির্দিষ্ট দিকে নিবদ্ধ। হয়তো গাছের মালিক যে পথ ধরে আসবে সেই পথেই তার ধুরুধুরু মন চোখ জোড়া নিবদ্ধ করেছে।

চোখের পলক পড়তেই ছবিটা পাল্টে গেলো। এবার আসলো আরেক মন জুড়ানো ছবি। এই ছবিতে তিনজন কিশোরী। মাঝে যে দাঁড়িয়ে তার লম্বা দুই বিনুনি টেনে ধরেছে দু’পাশের দুজন। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ফুঁসে ওঠা রা/গ। সে গাল ফুলিয়ে কোমরে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আর দু’পাশের দু’জন কিশোরী একহাতে তার বিনুনি টেনে অন্যহাতে মুখ টিপ হাসছে।

তাদের হাসি দেখে আমার ঠোঁটের কোনেও এক চিলতে হাসির রেখা ফুটলো। আমিও হাসলাম। আবারও ছবি পরিবর্তন হলো। এই হাসিতেও সেই চাঞ্চল্যতা। এবারের ছবিটা বেশ কাছ থেকে। কিশোরীর মুখের গঠন এবার সবটাই স্পষ্ট। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। নীল রঙা একখান সালওয়ার কামিজ পড়া। কামিজের হাতা কনুই পর্যন্ত বরাদ্দ। এই ছবিতে কিশোরী বেশ উদাসীন। তার দু-হাত উঠে আছে তার লম্বা বিনুনিতে। এবার তিনি নিজেই নিজের বিনুনি টেনে ধরে আছেন। এই ছবিটা বোধকরি তার আগোচরে তোলা। পাশ থেকে রাফিদ ভাইয়ার শীতল কন্ঠে ভেসে আসল,

—-” এটা ছোটমনির পনেরো বছর বয়সের ছবি নাকি। বড় মামু আর নানাভাই কোন এক অপ্রাসঙ্গিক কারনে ছোটমনিকে নাকি খুব বকা দিয়েছিলেন আর তার জন্যই ছোটমনির মুখটা এমন উদাসীন ছিলো। সারাদিন নাকি কারোর সাথে এক মিনিটের জন্যও দুষ্টুমি করেননি। মা বলে সবসময়, ছোটমনি নাকি খুব বেশিই দুষ্ট ছিলো। পুরো এলাকার মানুষ ছোটমনির নাম শুনতে দৌড়ে পালাতো। এলাকায় নাকি এমন কোনো মানুষ ছিলো না যাদের ছোটমনি জ্বালাতো না। আমরা সব ভাইবোনরা একসাথে হলে মা প্রায়ই এই মানুষটার গল্প করতো! আমি তাকে কখনো না দেখেই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি জানো। আমার বরাবর খুব আক্ষেপ ছিলো ছোট মনিকে যেন একবার দেখতে পাই। শুধু একবার হলেও হবে, আমি ছোটমনিকে দেখতে চাই… কিন্তু….”

উনি হঠাৎই কথা থামিয়ে দিলেন। আমি উনার দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকাতে উনি আমার পায়ের কাছে নেমে এলেন। আমি অবাক নয়নে উনার কার্যকলাপ দেখতে উনি আহতকন্ঠে বলে উঠলেন,

—-” হেই, আর ইউ ক্রায়িং!!”

উনার বাক্যে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। উনার কথার সত্যতা যাচাই করতে হাত তুলে গালে রাখতেই জলে হাত ভিজে উঠলো আমার। আমি আবারও অবাক হলাম। সত্যিই যে আমার চোখে জল! কিন্তু আমি তো কাঁদছিনা! একটুও কাঁদছি না তবে এই জল?

—-” আ’ইম সরি নিধি! আ’ইম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি!”

আমি দেখছি উনার অসহায়ত্ব ভরা মুখ টা। উনি আমাকে কোনো এক কারনে সরিও বলছেন কিন্তু আমি উনাকে বাঁধা দিতে পারছিনা। বলতে পারছিনা ইট’স ওকে। আমার ভেতরে এক অসহ্য য/ন্ত্র/ণা হচ্ছে। লন্ডভন্ড হচ্ছে মন। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন? ল্যাপটপের স্ক্রিনে যার মুখটা ভাসছে সেই মানুষটা আর আমার জীবনে নেই বলে? আমার মা না থাকার আক্ষেপে আমার এই অসহনীয় য/ন্ত্র/ণা?
.
.
.
.

#চলবে____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here