#প্রেয়সী 🧡(৩৯)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৭৬.
ভার্সিটির ক্যানটিনে যখন অ*জ্ঞা*ন হয়ে নীচে পড়ে গেলাম তখন মনে হচ্ছিলো ওখানকার বেশিরভাগ মানুষই আমাকে তী*ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। কেউ এগিয়ে আসছে না, অথচ দেখে দেখে মজা নিচ্ছে। তারা কে কি ভাবল জানা নেই।
যখন চোখটা বুঁজে যাচ্ছিল তখন হয়তো হৈচৈ লেগেছিলো। কেশব হয়তো ছুটে পালিয়ে ছিলো। রাহিয়ানও যে কোথা থেকে ছুটে এলো জানা হলো না। যখন চোখ মেলে সবাইকে নির্লিপ্ত চোখে দেখছিলাম, তখন হঠাৎই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল রাই। ওর পেছনেই আরফান ভাই দাঁড়িয়ে। আমি চমকে উঠলাম ওর আচরনে। ওকে দু’হাতে ধরতে ধরতে আশেপাশে নজরে এলো বাড়ির সবাইকে। চাচা-চাচিও আছেন দেখছি। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ধারন করতে পারছিনা। রাই আমোদিত গলায় বলতে লাগল,
—-” কংগ্রাচুলেশনস সোনা।”
রাইয়ের কথায় অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েও বিভ্রান্ত হলাম। আমার ডান পাশে বাড়ির ডক্টর আশফাক আলীও আছেন দেখছি। আমার দৃষ্টি সবাইকে ছাপিয়ে রাহিয়ানের পানে ছুটলো। গম্ভীর মুখে হাত ভাজ করে ডক্টরের সাথে আলাপচারিতা করছেন উনি।
আলাপচারিতার মধ্যমনি হয়তো আমিই! আমার দৃষ্টিকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে গেলেন তিনি। তাই ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালামনি আর চাচির দিকে তাকালাম। দু’জনের মুখ জুড়েই তৃপ্তির হাসি! আমার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দৃষ্টি তাদের তৃপ্তি বাড়ালো বৈ কমালো না। বউ মনি,রিম্মি আপু,ফাহিম ভাইয়া সবাই আনন্দে মিটমিট করে হাসছে। ফাহিম ভাইয়া হয়তো আমাকে একবার বুকে জড়িয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছেয় ছটফট করছে। ছটফট করছেন রাহিয়ানও কিন্তু খুশিতে নয় অজানা এক ভ*য়ে। ডক্টর প্রেসক্রিপশন তুলে রাহিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রাহিয়ান খুব সাবধানতার সহিত হাতে নিলো সেটা। ভাবলাম এবার হয়তো উনার গাম্ভীর্য মুখের পরিসমাপ্তি ঘটে হাসির রেখা ফুটে উঠবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। উনি ভুলক্রমেও আমায় দেখলেন না। ডক্টর ব্যাগ তুলে উঠ দাঁড়াতেই আরফান ভাই হাসি মুখে এগিয়ে এসে “আমাকে দিন” বলে ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিলো। ডক্টর আরফান ভাইয়ের দিকে একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের আমার দিকে তাকালেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—-” তোমার প্রেগন্যান্সির আড়াই মাস চলে! অনেকে খুব সহজেই ব্যাপারটা ধরতে পারলেও হাতে গোনা মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষেরই একটু সময় লাগে। তোমার ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। নিজের প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে হবে। তোমার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু সবার কমপ্লেন শুনলাম! বেবি কনসিভ করলে মাকে ভীষণ সচেতন হতে হয় বিশেষ করে নিজের যত্নের ব্যাপারে। যদিও বাড়ির সবাই তোমার প্রতি খুবই যত্নশীল তবুও ভ*য় তোমাকে নিয়ে। প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে কিন্তু খাবারের প্রতি অনিহা, খাবার থেকে গন্ধ লাগতেই বমি হওয়া এমন আরও কিছু সমস্যা হবে। তাতে তোমার শারীরিক কন্ডিশন একটু দুর্বল থাকবে। তাই বলে কিন্তু ভাবা যাবে না খাবার না খেলেই তো আর সমস্যা নেই! এটা ভাবলে তুমি ভুল করবে। বেবির যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় তার জন্য তোমাকে খাবার-দাবারের প্রতি আরও সিরিয়াস হতে হবে! সম্ভব তো?”
ডক্টরের কথা গুলো শুনে যেন না চাইতেও আপনাআপনি আমার হাতটা পেটের উপর উঠে এলো। উনার থেকে আমার ড্যাবড্যাব চাহনি তুলে পেটের দিকে দৃষ্টি রাখলাম। আমার ভেতরে কারোর অংশ দিন দিন বেড়ে চলেছে আর আমি টেরই পায়নি! এটা কি করে সম্ভব?
—-” অবশ্যই সম্ভব। ও নিজে নিজের যত্ন না নিলেও বা কি আমরা তো আছি। ঠিকই ওর যত্ন করব। এই ক’টা দিন আর কোথাও বের হওয়া চলবেনা। যা করবে সব আমাদের চোখের সামনে থেকে করবে। বাইরে গেলে এমনিতেই তুমি খাওয়া দাওয়া সব মাথায় তুলো। আর এই সময় এমন কিছু হলে মাও ঝুঁ*কিতে থাকবে বাচ্চাও ঝুঁ*কিতে থাকবে।”
খালামনির কথায় ভরসা পেলেন ডক্টর। মুচকি হেসে আমার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। উনার পেছন পেছন গেলেন রাহিয়ান আর আরফান ভাই। তারা বের হতেই সবাই যেন লাফিয়ে পড়ল আমার উপর। ফাহিম ভাইয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমায় ঠিক আধাঘন্টাই বুকে আগল রাখল। রিম্মি আপু,বউ মনি,রাই তারাও কিছু কম যায়না। সবার আনন্দে আমার মনটাও যেন ভরে গেলো। ইশশ, বাড়িতে কোনো বাচ্চার আগমনের বার্তায় বুঝি এতো আনন্দ হয়।
—-” আমার সংসারটা আজ পরিপূর্ণ করলি রে মা। আজ তুই আমাদের যে কতটা আনন্দ তা দিলি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”
খালামনির ছলছল করা চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে দু’ফোটা জল পড়তেই হাতের পিঠে মুছে ফেলল তৎক্ষনাৎ। আনন্দের জল মাটিতে পড়তে নেই। হাতের মুঠোয়ই থাক। আমি দুর্বল চাহনি দিয়ে ছোট্ট করে হাসলাম। সময়টা খুব আনন্দের হলেও যেন হঠাৎ মেনে নিতে পারছিনা আমি! কেশবের ভাস্যমতে রাহিয়ান প্রমান করতে ব্যর্থ হলে আমি উনার থেকে পর হয়ে যাবো। আমরা দু’জন আলাদা হয়ে গেলে আমাদের সন্তানের কি হবে? যখন সবাই জানতে পারবে আমাদের ভা*ঙ্গ*ন নিশ্চিত তখন আমাদের অনাগত বাচ্চার জন্য তাদের যে এই আনন্দ সেটা কি তখনও থাকবে? নাকি কোনো এক ঝড়ো হাওয়ায় ধুলোর সাথে মিলিয়ে যাবে তাদের এই আনন্দ, উল্লাস। তখন যে ওর কপালে জুটবে সবার অবহেলা! আজ যেখানে সবার চোখে খুশির ঝলমলে আলো সেদিনতো থাকবে কেবল ক্ষো*ভ আর হিং*স্র*তা*য়ে ঘেরা অ*ন্ধকার! সেটা আমি কি করে মেনে নিবো? কি করে মেনে নিবো আমার সন্তানের প্রতি সবার অবহেলা,অনাচার, ক্ষো*ভ আর হিং*স্র*তা?
তবে কি ওর পৃথিবীতে পদার্পণ ঘটার আগে ওর শেষ চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াটাই উত্তম হবে?পৃথিবীর এই জ*ঘ*ন্য পরিবেশে আসার আগেই ও চলে যাক বাবার কাছে। সেখানে তো মা-ও আছে। আমার বাবা-মা নিশ্চয়ই আমার সন্তানকে অবহেলা করতে পারবেনা! ও নিধির সন্তান জানলেই তো একদম আকড়ে ধরে রাখবে তারা। হ্যাঁ তবে তাই হবে। আমিও রাখব না তোকে। এই পৃথিবীতে এনে তোকে কিছুতেই অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে তোর জীবনটা আমি ন**ষ্ট করতে পারব না। যদি তুই কখনও আমার দিকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করিস,
“এতো অনিশ্চয়তা,একাকিত্বতা আর বিষন্নতার মাঝে আমাকে কেন একা ফেলে চলে গেলে?” তখন আমি কি জবাব দেবো ওকে? কোনো জবাব নেই তো আমার কাছে! আর আমার কোনো অধিকারও নেই একটা মানুষকে এভাবে ক**ষ্ট দেওয়ার। বেটার হোক তুই আসবিই না এই দুনিয়াতে। আমি এব্রেশন করে ফেলব! হ্যাঁ তাই করবো।
—-” কিরে কি ভাবছিস এতো?”
রাইয়ের হাতে ধাক্কা লাগতেই হকচকিয়ে তাকালাম আমি। সব মুখগুলো প্রশ্ন সুচক হয়ে আমাকেই দেখছে! আমার ভাবনার তাল ঘেঁটে যেতেই আমি বোবা চোখে সবার দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
খালামনি বলল,
—-” এই হয়েছে, অনেক হয়েছে মেয়েটাকে নিয়ে দলাইমলাই করা। এবার ওকে একা ছাড়তো। ও একটু রেস্ট নিক। এই আদ্রিতা?”
খালামনির ডাকে রিম্মি আপুকে পাশ কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো বউমনি। বলল,
—-” হ্যাঁ কাকিয়া বলো?”
—-” বলছি কি রে মা, ওকে একটু ফ্রেশ হতে হেল্প কর! আমি বরং ওর জন্য হাল্কা কিছু খাবার পাঠিয়ে দেই। তুই একটু ক*ষ্ট করে খাইয়ে দিস মা।”
—-” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সব করে দিচ্ছি তুমি একদম চিন্তা করো।”( মাথা নেড়ে)
—-” আ..আবার এখনি খেতে হবে? একটু পরে খাইনা প্লিজ!”
আমার বানী কারোর মোটে পছন্দ হলো না। সবাই চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। খালামনি রা*গি গলায় বলল,
—-” আবার শুরু হয়ে গেলো বাহানা। যা পাঠাবো লক্ষি মেয়ের মতো খেয়ে নিবি! বেয়ান, বেয়াই আপনারা আমার সাথে আসুন। আপনারা সেই কখন এলেন আপনাদের কিছু খেতেও দিলাম না! এই রিম্মি, ফাহিম তোরাও আয়। আমায় হাতে হাতে হেল্প করে দিবি।”
খালামনি সবাইকে নিয়ে চলে গেলো। বাকি রইলাম আমরা তিনজন। বউমনি উঠে আলমারি খুলে ড্রেস বের করে আনল। রাই আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। আমি বসতে বসতে বললাম,
—-” বউমনি তোমাদের ক*ষ্ট করতে হবেনা প্লিজ! দেখো আমি একাই পারবো সবটা করতে।”
বউমনি বুঝি গায়ে লাগালো না আমার কথা। ওয়াশরুমে গিয়ে আমার ড্রেস গুলো রেখে বের হয়ে এলো। আমার পাশে এসে বসতে বসতে বলল,
—-” কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট? সেই তখন থেকে দেখছি মুখে এক ফোঁটা হাসিও নেই!”
বউমনির কথার সুর টেনে রাই বলে উঠলো,
—-” ঠিক বলেছো বউমনি। হ্যাঁ রে নিধু? কিছু নিয়ে ভাবছিস নাকি? কি হয়েছে সোনা? বেবি আসার খবরে কি তুই খুশি নস?”
বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। কেঁপে উঠলাম আকস্মিক! অসহায় কন্ঠে বললাম,
—-” সন্তান আসার খবরে কোন মা কি কখনও অখুশি হতে পারে?”
রাই মলিন হাসল। আমার গালে হাত রেখে বলল,
—-” সরি রে! আমি কিন্তু কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি!”
—-” আচ্ছা তোরা এতো খুশি কেন বলতো?”
আমার প্রশ্নে রাই ফিক করে হেসে দিলো। বউমনির দিকে ফিরে বলল,
—-” বউমনি, শুনো মেয়ের কথা। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কোল আলো করে কেউ আসতে চলেছে। আর সেই খবরে আমরা নাকি খুশি হবো না? এও কি সম্ভব?”
বউমনিও হাসল। ওদের দু’জনের হাসি দেখে আমার গা জ্ব**লে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই হাসির পেছনেই লুকিয়ে আছে একরাশ ঘৃ*না। এক সমুদ্র অবহেলা। সবটাই আমার সন্তানের জন্য! সবটাই ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটার জন্য।
৭৭.
রাত ১০টা। বিছানায় গা লাগিয়ে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎই গা গুলিয়ে উঠল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে আরম্ভ করল। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে গেলাম ওয়াসরুমে। ভেতরে পা রাখতে না রাখতেই দুনিয়া আঁধার করে বমি শুরু হয়ে গেলো। উনি কোথায় ছিলেন জানিনা। আকস্মিক পেছনে থেকে এসে ধরলেন আমায়। দু’হাত দিয়ে মাথার এপাশ ওপাশ চেপে ধরলেন বমি থামানোর জন্য। কিন্তু বমি থামলো না। যতটুকু হওয়ার প্রয়োজন ছিলো হয়ে গিয়েছে! শরীরে আর কুলচ্ছে না যেন। বমি করেও শান্তি নেই। হাত-পা শীতল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
পাশে উনাকে আবিষ্কার করতে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু যখনই ভাবি মানুষটার সঙ্গে দু’টো কথা বলব তখনই মনে পড়ে কেশবের কথা গুলো। উনি আমার মনের বার্তা বুঝে নিলেন কি না জানিনা! আমায় দুই হাতে শক্ত করে আগলে ধরলেন। যেন বৈশাখী ঝড়ো হাওয়াতেও এই বাঁধন ছুটবে না। উনি আমার চাহনিকে এড়িয়ে গিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নিলেন আমায়। বিছানা অব্দি আসতে আসতে উনার থেকে এক মিনিটের জন্যও চোখ সরেনি আমার। যখন বিছানায় শুয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন আমিও কি ভেবে উনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। উনি কিছু বললেন না। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানলেন। পাশের টেবিলে উনার অফিসের কাগজ পত্রের দিকে ইশারা করে বললেন,
—-” আর একটু কাজ আছে!”
আমি অভিমানী সুরে বললাম,
—-” আমায় রেখে কাজ বেশি ইম্পরট্যান্ট হলো?”
—-” প্রশ্নই আসেনা এমন কিছুর। হিমাদ্র ভাইকে এই ফাইলটা আর দশ মিনিটের মধ্যে সেন্ড করতে হবে। ঐদিকে ক্লায়েন্টরা বসে আছে এই প্রজেক্টের জন্য। তাই একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম। কাজটা শেষ করতে পাঁচ মিনিটও লাগবেনা তাই ভাবলাম সেরে এসে একবারেই তোমার পাশে বসি। কিন্তু এখন আর সেটাও ইচ্ছে করছেনা। আমি ফাহিমকে বলে ভাইয়ার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভাইয়া করে নিবে।”
আমি হাত ছেড়ে দিলাম উনার। অভিমান চেপে সাফ গলায় বললাম,
—-” কাজটা কমপ্লিট করে নিন।”
উনি মানলেন না। ঘুরে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন। পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন আমায়। গালে নাক ঘষে বললেন,
—-” তুমি আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট অথচ বুঝতেই পারলেনা। ব্যাপারটা কিরকম অদ্ভুত লাগছেনা বলো?”
—-” অদ্ভুত লাগবে কেন? আজকাল বড় বড় ভ*য়ং*ক*র ব্যাপারও স্বাভাবিক ভাবে সামনে এসে দাড়াচ্ছে! এ আর এমন কি?”
—-” আর কিছুদিন পেরোতেই আমরা প্যারেন্টস্ হয়ে যাবো। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে না এই তো সেদিনই আমি প্রথম দেখলাম তোমায়। হাতে গোনা দু’দিন হলো! আর তারপর টানা দু’টো বছর পা*গ*লে*র মতো খুঁজলাম তোমায়। অতঃপর পেয়েও গেলাম। দ্যেন, কয়টা দিন লুকিয়ে ভালোবাসলাম তোমায়। আর তারপর বিয়ে। সবটা কেমন একসাথে মিলিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না?”
—-” হু।”
—-” আর আজকে বিশেষ খবর হলো সেই পুঁচকে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। আমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে সে। আর আমি তার বাচ্চার বাবা হবো।”
—-” কেশবের সাথে এমন একটা ডিল কেন করলেন?”
প্রশ্নটা আমার মতে ভীষণ ভ*য়ং*ক*র! হয়তো উনার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতক্ষণে অনেক রিয়াকশন লেনদেন হয়ে যেতো। কিন্তু উনি শান্ত। তাই আমিও নির্বিকার। উনি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলেন। উনার হাতটা আলতো করে আমার পেটের উপর রেখে বললেন,
—-” তোমার ছেলে পছন্দ নাকি মেয়ে?”
—-” বাবা খু**ন হয়েছে কেশবের হাতে অথচ আপনি আমাকে কখনো জানানোরই প্রয়োজন মনে করলেন না!”
—-” জানানোর কিছু ছিলো না! হয়তো তোমার ক**ষ্ট*টা আরও দু’গুন বেশি হতো। বাবার খু**নি*কে খুঁজে বের করার জন্য তুমি হয়রান হয়ে থাকতে, বলতে গেলে তুমি পাগলই হয়ে যেতে তাই তোমায় কিছু জানাইনি!”
—-” তো আপনার কি মনে হচ্ছে আজ আমি ভীষণ ভালো আছি? আজ আমার মোটেও ক**ষ্ট হচ্ছে না?”
—-” কেশব তোমায় কেন এসব কথা নিজের থেকে জানিয়েছে বলোতো?”
—-” জানিনা! আর জানতেও চাই না! শুধু এটুকু জানি আপনার জন্য আমার সন্তানের ভবিষ্যত অন্ধকারে ঢেকে যাবে। ওর জীবনটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ওর বর্তমান,ভবিষ্যত সবটা লন্ডভন্ড হয়ে যাবে আর এ-সব কিছু হওয়ার পেছনে একমাত্র দায়ী থাকবেন আপনি।”
—-” ভুল বুঝছো?”
—-” এতোদিন হয়তো ভুলই বুঝেছি আপনাকে! আজ হয়তো ঠিক বুঝতে পারছি! আপনি বাবার খু*নে*র কোনো প্রমান দিতে না পারলে আপনি আমায় কেশবের কাছে পাঠিয়ে দিবেন? আমার ভাবতেই ঘৃ*না হচ্ছে নিজের উপর! আজকাল আমায় নিয়ে আমার স্বামী ডিলও করে আসে। তাও এমন একজন মানুষের সাথে যে কি না আমার বাবার খু**নি!”
আমায় ছেড়ে উঠে বসলেন উনি। আমার একেকটা অপবাদ মুখ বুঝে মেনে নিলেন স্রেফ। জবাবে কিছুই বললেন না! তার মানে কি দাঁড়ায়? আমার দেয়া অপবাদ গুলো একটাও ভুল নয়! সবই ঠিক। যা ঘটেছে সবটাই ঠিক। ঘৃ*না*য় উনার মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করলো না। কান্না গুলো গলার কাছে এমন ভাবে দলা পাকাতে লাগল যে ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদি!
কেন মানুষটা আমায় এভাবে পর করে দিতে রাজি হলো! কেন হলো? তবে কি উনার জীবনে আমার আর কোনো মূল্য নেই! সবটা শেষ হয়ে গেলো? পর হয়ে গেলাম আমি? তবে কি আমাদের সন্তানও মূল্যহীন? উনার চুপ করে থাকা যে মেনে নিতে পারছিনা আমি! কান্না চেপে বসেতেই পাশে ফিরে গেলাম। দুহাতে মুখটা চেপে ধরেই গিলতে লাগলাম কান্না গুলো। কেন উনি কিছু বলছেন না? কেন জোর দিয়ে বলছেন না, নীলাদ্রিতা? কেশব যা বলেছে সবটা মিথ্যে! সবটা বানোয়াট। আমার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে আমি কিভাবে ডিল করতে পারি বলো? এই মানুষটার মাঝেই তো আমার প্রাণভোমরা থাকে। কি করে পারি তোমায় অন্যকারোর হাতে তুলে দিতে? এমন কথা তুমি ভাবলেই বা কি করে?
উনি কিছুই বলছেন না! উনার চুপ থাকাই যে বলে দিচ্ছে কেশবের একেকটা সিঙ্গেল ওয়ার্ডও সত্যি। সব সত্যি!
#চলবে____________________
[ সবাই কমেন্ট করা ছেড়ে দিয়েছে😊 কষ্ট পাইলাম 🙂]#প্রেয়সী ♥(৪০)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৭৮.
মাস দুয়েক পেরিয়ে গেলো রাহিয়ান আগের মতো বাড়িতে সময় দিতে পারেন না। সেদিনের পর থেকে উনি খুবই কম কথা বলেন আমার সাথে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বলেন। তবে আমার যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেননি উনি। অভিযোগ করার মতো কখনই কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেনা উনার বি*রু*দ্ধে। তবুও আমি মেনে নিতে পারছি না উনার চুপচাপ ভাব ভঙ্গিমা। কাজের প্রেশারে কখনও কখনও রাতে ফিরেন না উনি। রাত করে অপেক্ষা করি কিন্তু মুখ ফুটে বলিনা, আজ একটু জলদি বাসায় ফিরবেন! ছোট্ট একটা কল করে উনাকে জিঙ্গেস করা হয়না, আজ কখন ফিরছেন? আমাদের ঘরে কোনাকোনি ভাবে দুটো ক্যামেরা লাগানো হয়েছে! যাতে উনি অফিসে থেকেই আমার উপর সুন্দর ভাবে নজর রাখতে পারেন। কোনো রকম কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে যেন তৎক্ষনাৎ ছুটে আসতে পারেন। দুজন নার্সও রাখা হয়েছে সারাক্ষণ আমার শারিরীক কন্ডিশন চেক করার জন্য। কোনো রকম ত্রুটি নেই। সবটাই নিখুঁতভাবে হ্যান্ডেল করছেন উনি। কিন্তু এই সব কিছুর মাঝেও যেন সজীবতা নেই। সবটাই নিষ্প্রাণ লাগছে। সারাক্ষণ অস্থিরতা,বিষন্নতা নিয়েই পার করতে হচ্ছে প্রতিটা দিন,প্রতিটাক্ষন!
চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে আমার! মা হওয়ার সুখ আর য*ন্ত্র*ণা দুটোই বেশ ভালো ভাবে ইনজয় করছি। হাতে পায়েও বেশ পরিবর্তন। সেই রোগা পাতলা মেয়েটা ৫৪ কেজি ওজন ভে*ঙ্গে ৬০ কেজিতে পদার্পণ করেছে। গালে মাংস জমেছে। সেই স্লিম ফিটনেস বডি ভে*ঙে একটু একটু করে একজন পরিপূর্ণ মা হয়ে ওঠার গল্পটা হয়তো একটু ভিন্নই হয়। উনি বুঝি আমার এই পরিবর্তন গুলো লক্ষ করেননি। যদি করতেন তাহলে নিশ্চয়ই কিছুটা মজা আর খুনসুটি করে আমাকে রা*গা*তে*ন! আমিও বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে রা*গ*তা*ম। উনি হেসে কুটিকুটি হতেন। আর আমি? আমিও চোখ মুখ কুঁচকে গাল ফুলিয়ে থাকতাম। সেই খুনসুটি গুলো আজ আর নেই। সবটা চা*পা পড়েছে অভিমানের বড় বড় পা*হাড় গুলোর নীচে।
ঐদিকে শুনেছি কেশব বিয়ে করেছে। মেয়েটা তার অফিসের ছোটখাটো কর্মচারী! বিয়ে করে বেশ সুখেই জীবন পার করছে তারা। আমায় না পাওয়ার আক্ষেপ বুঝি ঘুচল কেশবের! রিম্মি আপু বলল, মেয়েটা অতিশয় নম্র ভদ্র। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা নেই। ছোট একটা বোন আছে। পরিবার বলতে সে আর তার ছোট বোন। ছোট বোনটা এবার মাধ্যমিক দিলো। পড়াশোনার খরচ চালাতে না পারায় অফিসের বসের কাছে এপ্লিকেশন জমা দিয়েছিলো বেতন বাড়াতে। কেশব কি ভেবে মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দু’দিনের মাথায় চুপিসারে বিয়ে করল। যেদিন কেশবের বিয়ে ছিলো সেদিন রাহিয়ানকে কাউকে একটা বলতে শুনেছিলাম, “এটা ওর একটা নতুন চাল!” এমন কিছু যে আমারও মনে হয়নি তা কিন্তু নয়! তবে আজকাল নিজেকে নিয়েই বেশ অসুবিধায় পরে গিয়েছি আমি! অন্যের কথা ভাবার আর সময় কই?
—-” শেষ বেলায় ছাদে থাকতে নেই। জ্বীন-পরির আচর লাগে।”
কথাটা বলেই হেসে পড়ল হিয়া আপু। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই হিয়ার আপুর হাস্যজ্বল মুখটা ভেসে উঠল। ঠোঁটের কোনে ক্লান্তির হাসি দিয়ে বললাম,
—-” হিয়া আপু্? কতদিন বাদে এলে!”
হিয়া আপু হাসি মুখে বলল,
—-” হুম। অনেকদিন পর! কেমন আছো কিউটি?”
—-” এই তো যেমন দেখছো। এতদিন কেন এলেনা?”
—-” আর বলো না। সে অনেক কথা! একটা জবের জন্য অনেক ট্রাই করছি গো কিন্তু কিছুতেই হচ্ছিল না! অবশেষে লাস্ট মান্থে একটা জব হয়ে গেলো। সেখানেই জয়েন করা নিয়ে অনেক ঝা*মে*লা পোহাতে হলো। অবশেষে জয়েন হতে পারলাম। বেশ ভালো জব বুঝলে। আজ ১০দিন হলো জয়েন করেছি। ফাহিমের সাথেও এতোদিন ঠিক করে দু’দন্ড কথা বলতে পারিনি! সে তো ভীষণ ফুলে আছে। তাই আজ সময় নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে এলাম। বাইরেই মিট করতাম কিন্তু তোমার কথা মনে হতেই সোজা বাড়িতে চলে এলাম।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
—-” খুব ভালো করেছো। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি তোমায় দেখে। মাঝেমধ্যে একটু আসলেও তো পারো।”
—-” এখন থেকে রোজ আসবো দেখে নিও।”
হিয়া আপুর তৃপ্তি মুলক বানিতে আমি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—-” রোজ আসতে পারবে? আর অফিসের কি করবে?”
হিয়া আপু লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
—-” বাবা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গিয়েছে। বলেছেন দু’একদিনের মধ্যেই ফাহিমের পরিবারের সাথে কথা বলবে।”
—-” সত্যিইই!”
—-” হ্যাঁ গো সত্যি। সো, বিয়েটা হয়ে গেলে আমি তো তোমাদের বাড়িতেই বেশি থাকব।”
—-” তা আর বলতে? আমি মেঝ খালামনিকে বলে তোমায় পার্মানেন্টলি এখানেই রেখে দিবো দেখে নিও। আমি বললে মেঝ খালামনিও আর না করতে পারবেনা।”
হিয়া আপুর গাল দুটো আবারও লজ্জায় লাল হলো। ছাদের মৃদু বাতাসে হিয়া আপুর স্ট্রেট চুল গুলো উড়ে এসে ওর মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে। বেচারি বিরক্ত হাতে চুল গুলো গুঁজে নিলো কানের পাশে। আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বলল,
—-” তোমার বডিগার্ডরা কই? দেখছি না যে কাউকে?”
—-” ওরা আর কতক্ষণ থাকবে বলো আমার সাথে? শুধু মাত্র উনার কড়া আদেশ বলেই আমিও আর দ্বিতীয় বুলি আওড়াতে পারিনি। কেননা পায়ে পায়ে ঘোরা লোক আমার একদম ভাল্লাগে না। আগে ভালো লাগত। সঙ্গে করে দু-তিনজন মানুষ না থাকলে নিজেকে কেমন এলিয়েন বলে মনে হতো কিন্তু বাবু পেটে আসার পর থেকে আর ভাল্লাগে না। সারাক্ষণ একা একা থাকতেই ভাল্লাগে।”
—-” এটা কি মুড সুয়িংয়ের আংশিক।”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
—-” জানি না গো। আচ্ছা আজ কি এখানে বসেই সময় পার করার ইচ্ছে নাকি? যার সঙ্গে দেখা করতে এলে সেই আসল মানুষ টা কই? তাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।”
হিয়া আপু আমার হাত ধরে বলল,
—-” সে গিয়েছে তোমার বরের অফিসে। তার নাকি কোনো এক জবরদস্ত প্ল্যান আছে। রাতে বোধহয় পিকনিকের আয়োজন হয়েছে। তাই রাহিয়ান ভাইয়াকে আনতে গেলো। আরফান ভাইয়া আর রাইও আসবে। আজ জমিয়ে আড্ডা হবে।”
রাহিয়ানের নামটা শোনার পর বাকি কথা গুলো আর বুঝতে পারলাম না। ফাহিম ভাইয়া উনাকে আনতে গিয়েছেন? উনি কি উনার এতো এতো কাজ ফেলে আসবেন? আসবেন না! আমি জানি! অকারণে আশা নিয়ে বসে কিছুই হবে না! তাতে করে অভিমান গুলো আরেকটু পাহাড় ছুঁবে। চাপা ক*ষ্ট*টা আরেকটু ছিটকে উঠে তার অস্তিত্ব জাগরন করবে। কি দরকার খামখা আশা রাখার? এই দু’মাসে তো কম আশা রাখেনি! আর কম ক*ষ্টও পায়নি। কেবল বাবুটার কথা ভেবে এসব যুক্তিহীন অনুভূতি গুলোকে নিয়ে ভেবে ক*ষ্ট পাওয়াটা বন্ধ করেছি। আশা রাখি, বাকি জীবনটাও পারব।
—–” নীচে যাবে তো? চলো?”
হিয়ার আপুর ছোঁয়ায় ঘোর কাটল আমার। আমি ওর কথা গুলো বোঝার প্রয়াস চালিয়ে বোকা গলায় প্রশ্ন করলাম,
—-” কিছু বললে?”
—-” হ্যাঁ! নীচে যাবে না? চলো যাই।”
আমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,
—-” হ্যাঁ যাবো তো। চলো?”
—-” কিছু ভাবছিলে?”
আমি কিছুক্ষণ বোবা চোখে তাকিয়ে রইলাম হিয়ার আপুর দিকে। কথার পিঠে কথা জোগাড় করতেও ক*ষ্ট হচ্ছে আমার। তাল ঘেঁটে বললাম,
—-” ভাবছি? কই না তো? কিছুই ভাবছি না। চলো নীচে চলো।”
হিয়া আপু মাথা দুলিয়ে বলল,
—-” আচ্ছা চলো।”
৭৯.
ছেলে-মেয়েদের আড্ডা মহলে বেশিক্ষণ নাক না ঘষে গুরুজনরা সবাই নীচে নেমে গেলো। রিম্মি আপুর শশুর-শাশুরি এসেছেন। কেশবরা আসেননি! বউ নিয়ে সে নাকি আলাদা সংসার করছে তাই তাকে আলাদা করে আর ইনভাইট করা হলো না। আরফান ভাই-রাই,রিম্মি আপু-আসিফ ভাইয়া,হিয়া আপু আর ফাহিম ভাইয়া সবাই পাশাপাশি বসেছেন। কেবল আলাদা আমরা দুজন। দু’দিন যাবত আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। তাই আমার জন্য ফ্লোরে বিছানো পাটিতে জায়গা হয়নি, জায়গা হয়ে হয়েছে সবার থেকে আলাদা করে একটা চার পায়াতে। শুরুতে অবশ্য উনার এমন অ*ত্যা*চা*রে রু*ষ্ট হয়েছিলাম বটে, কেন আমাকে সবার থেকে আলাদা করা হলো? পরে অবশ্য বুঝতে পারছিলাম আবহাওয়ার তেজ।
আজ বৃষ্টি হবে। হোক না, আমি না হয় না পারি কিন্তু আকাশের তো মানা নেই কাঁদতে। আজ সে না হয় আমার হয়েই একটু কেঁদে দিলো। খারাপ হবে না। ফাহিম ভাইয়ার যাওয়াতে রাহিয়ান সত্যিই এলো। আজ আশা রাখিনি বলেই হয়তো খানিক অপ্রত্যাশা আমার দুঃখ মুছলো। উনাকে দেখে আজ ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। মুখটা খুব শুঁকনো শুঁকনো লাগছে। হয়তো উনার ভেতরটা জল জল করছেন! মনের ভাবনা থেকেই ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
—-” জল খাবেন?”
উনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন উনার ফোনের স্ক্রিনে ঠেসে ছিলো। আমার কন্ঠ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন। পাশেই একবার ফাহিম ভাইয়াদের দিকে তাকালো। নাহ্, তাদের হৈ হুল্লোড় বহাল আছে। উনি ব্যতীত আমার প্রশ্ন আর কারোর কানেই যায়নি। উনি ছোট্ট করে হাসলেন। সেই পুরনো চমৎকার হাসি। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো উনার হাসি মুখটা দেখে। মনে হলো, এই তো সেই চেনা হাসিটা! এতোদিন কোথায় যেন একরাশ অভিমান নিয়ে লুকিয়ে ছিলো! আজ আবারও ফিরলো। ফিরল,ফিরল,ফিরল।
—-” কিছু খাবে? ক্ষিদে পেয়েছে তোমার?”
আমার প্রশ্নের জবাব উনি দিলেননা। পাল্টা প্রশ্ন করে আবারও চমৎকার হাসলেন। আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
—-” প্রশ্নটা আগে আমার ছিলো!”
উনি ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন,
—-” কিন্তু দায়িত্বটা তো আমার বেশি।”
—-” দায়িত্ব একা মাথায় নিয়ে তো দুনিয়া এপাশ ওপাশ করে উল্টে ফেলেছেন! এতো দায়িত্ব নিতে কে বলেছে?”
আমার কন্ঠে উনি বুঝি অভিযোগের আচ পেলেন। ছোট্ট করে হেসে জবাব দিলেন,
—-” জলটা নিজের হাতে দিবে তো?”
উনার একটু খানি প্রশ্নে আমার বুকের ভেতরটা আবারও হাহাকার করে উঠল যেন। আবার এই ছোট্ট প্রশ্নটিতেই আনন্দে ছলছল করে উঠল আমার চোখ জোড়া। ছাদ টা অন্ধকার না হলেও আলোর উল্টো দিকে মুখ করে থাকায় উনার মুখটা অন্ধকারেই ঢেকে গিয়েছে বলা যায়। সেই অন্ধকারের মাঝেও বেশ আবিষ্কার করতে পারলাম নোনাজলে চিকচিক করা উনার চোখ জোড়া। আমায় একভাবেই চেয়ে থাকতে দেখে হেসে মাথা নীচু করে নিলেন উনি। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে গেলাম উনার জন্য জল আনতে। না দেখলেও বুঝতে পারলাম উনি আঁড়চোখেই দেখছিলেন আমায়। আমি যতক্ষন না ফিরলাম উনার কাছে ততক্ষণ উনি চেয়েই রইলেন।
—-” জল!”
উনি ফোনটা পাশে রেখে গ্লাসটা হাতে নিলেন। কিছুক্ষণ জলটাকে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে বললেন,
—-” আমার মনে হচ্ছে আমার থেকেও তোমার বেশি জল তেষ্টা পেয়েছে। সো আগে তুমি খাও? তারপর আমি খাচ্ছি।”
আমি কপালের মাঝের সুক্ষ ভাজ ফেলে বললাম,
—-” আমি কিন্তু মোটেই বলিনি আমার তেষ্টা পেয়েছে।”
—-” আমিও তো বলিনি। তাহলে কেন দিলে?”
—-” কারন আপনার মুখটা শুঁকিয়ে আছে! আর আপনি মনে মনে বলছিলেন আপনার এই মুহুর্তে একটু জল চাই। আমি সেটাই শুনলাম। তাই তো দিলাম!”
উনি ভাবুক কন্ঠে বললেন,
—-” তাহলে কি তুমি মনে মনে জল তেষ্টার কথা বলোনি?”
আমি না সূচক মাথা নেড়ে বললাম,
—-” না, বলিনি।”
উনি হঠাৎ হেসে পড়লেন। আমার দিকে তাকালেন।অতঃপর আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-” তাহলে নিশ্চয়ই আমার প্রিন্সেসের খুব জল তেষ্টা পেয়েছে! আমি এই মাত্রই শুনলাম কে যেন আধোআধো গলায় বলল, পাপা আমি জল কাবো। তাই বলছিলাম কি, তুমি একটু খেয়ে ওর গলাটা ভেজাও।”
আমি তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললাম,
—-” আপনার প্রিন্সেসেরও জল তেষ্টা পায়নি। বাই দ্যা ওয়ে ও প্রিন্সেস নয়, প্রিন্স হবে। আর,আমার প্রিন্সের জল তেষ্টা পায়নি, পেয়েছে তার বাবার। সেটা আমার প্রিন্স নিজেই বলেছে।”
—-” আহ্ তুমি বুঝছো না!”
উনার বাচ্চাসুলভ কন্ঠ শুনে হেসে ফেললাম আমি। বললাম,
—-” আচ্ছা দিন খাচ্ছি। একটু খানি খাবো কিন্তু।”
উনি আনন্দিত হয়ে বললেন,
—-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ একটু খেলেই হবে।”
আমি জলটা নিয়ে এক ঢোক খেয়ে উনাকে দিয়ে দিলাম। উনি মুচকি হেসে গ্লাসটা নিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বুলালো গ্লাসটায়। আমি আঁড়চোখে দেখতেই উনি তড়িঘড়ি করে জলটা খেয় নিলেন। তবে এর মাঝেও একটা ব্যাপার ছিলো, উনার জলটা খাওয়ার ধরনে দেখে মনে হচ্ছিলো না যানি আজ কতগুলো দিন বাদে উনি তৃপ্তি করে জল খাচ্ছেন। দেখেও মনটা জুড়িয়ে গেলো।
আড্ডাতেই আরও কিছু সময় ব্যয় হলো। সবাই কিছুনা কিছু করছে! এই যেমন ফাহিম ভাই জোক্স বলছে আর আরফান ভাই গান গাচ্ছে। সেরকম ভাবেই আড্ডা এগিয়ে চলেছে। সবার পাট চুকিয়ে এবার এলো রাহিয়ানের পালা। সবাই উনাকে চেপে ধরল, কবিতা শোনানোর জন্য। আমাদের ছোট্ট লাভস্টোরিটা এখানে কম বেশি সবাই-ই জানে। আর বিশেষ করে উনার সব বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা গুলোর প্রশংসায় সবাই পঞ্চমূখ। অবশ্য এই দুই মাসে সবটাই পেছনে ফেলে এসেছেন উনি! তাই সবার অনুরোধ রাখতে পারবে না বলেই আপত্তি জানালেন! তাই বাকি সবাই উনাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে পড়ল! সবার বক্তব্য হলো, আমি বললেই নাকি উনি কবিতা বলতে রাজি হবেন। আমিও তাই সবার মন রাখতে উনায় ছোট্ট একটা অনুরোধ করেই ফেললাম। আশ্চর্যজনক ভাবে উনি কোনো রকম অমত না করেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি এঁটে আবৃত্তি করতে লাগলেন উনার বিখ্যাত স্বরচিত কবিতা,
—-” তুমি তবে রাতের আকাশে এক টুকরো চাঁদ হও
আমি তোমার পাশে জ্বলজ্বলে এক তারা হবো।
কখনো ভেসে বেড়াও বা মেঘের আড়ালে লুকাও
খুব কাছের তারাটি হয়ে আমি সঙ্গি রবো।
নয়তো তুমি ফুটন্ত এক গোলাপ হয়ে ফুটে থাকো~
আমি প্রজাপ্রতি হয়ে তোমার কাছে ছুটে আসব |
যদি তুমি অন্ধকারে বুকের ভেতর ভ*য় রাখো,
আমি জোনাকি হয়ে মিটিমিটি আলো ছড়াবো।
আমি ঝরনা হয়ে ঝাপ দিবো নীচের ঐ ভূমিতে,
যদি তুমি পাহাড় হয়ে আমায় বুকে ধারন করো |
আমি কোনো এক চর হয়ে জেগে উঠব নদীতে
যদি তুমি ঢেউ হয়ে আঁচড়ে আমার বুকে পড়ো |
আমার গভীর রাতের আঁধারে নুর হও তুমি,
শিয়াল ডাকা মধ্যরাতে ভ*য় যেন না পাই!
তোমার দুই চোখে একটিবার ডুবে যাবো আমি,
তোমায় নিয়ে কবিতা লিখে ভাবুক কবি হতে চাই |
তার চেয়ে ভালো তুমি আমার স্বপ্ন হও,
শতবার ভা*ঙ*লেও বারবার দেখতে চাই।
আশাই তো জীবন, তুমি আমার আশা হও
আমি তোমায় নিয়ে এই জীবন পাড়ি দিতে চাই |
সবচেয়ে ভালো তুমি আমার একজনমের প্রেম হও,
আমি রাত দুপুরে জনম ভর তোমার প্রেমে পড়তে চাই।”
আবৃত্তি শেষে উনি ঠোঁটের কোনের হাসিটাকে আরেকটু প্রসারিত করে আমার চোখে চোখ রাখলেন! আমারও আর এবার চোখ ফেরানোর ইচ্ছে জাগল না। মনে হচ্ছিল আম**রন এভাবেই ডুবে থাকি উনার চোখে। বাকিদের হৈ হৈ তে চমকে উঠলাম আমরা দু’জনেই। লজ্জায় পড়ে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম উনার থেকে। উনি মুচকি হেসে বাকিদের দিকে তাকালেন। বাকিরা প্রতিটা লাইন ধরে ধরে বর্ননা দিয়ে প্রশংসা করছে। আর উনি বাকিদের কথায় মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বার বার আঁড়চোখে আমায় দেখছেন। এই তো বেশ ভালো আছি। দীর্ঘ অপেক্ষার পথ অতিক্রম করে আজ অভিমানের পাহাড় গুলো উঁচু থেকে ঢালুতে পড়ে তাদের গুমুড় ভা*ঙ*লো বুঝি!
#চলবে____________________
[ কবিতাটার কেমন জানি হলো😒 ]