প্রেয়সী
১৬|
এমন প্রশ্নের কী জবাব দিব? সত্যি কি এই প্রশ্নের জবাব দিতে আমি প্রস্তুত? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তার প্রতি আমার অনুভূতি রয়েছে। যার নাম আদৌও আমি খুঁজি’নি। সে হঠাৎ এক নতুন পৃথিবী আমার সামনে খুলেছেন। যার অস্তিত্ব যে ছিলো একদমই জানতাম না। না জেনেও সেই পৃথিবী ভ্রমণ শুরু করেছি। এই ভ্রমণ আর শেষ না হোক। একদম শেষ না হোক। একটু ধীর কন্ঠে বললাম,
‘ যদি না বলি? ‘
বলেও আমি ঢোক গিললাম। থাপ্পড় না মারলেই হচ্ছে। সে ভ্রু উঁচু করলেন,
‘ আচ্ছা। দেখি না বলে দেখা। ‘
‘ অবশ্যই আমি না করতে পারবো। আমার ডিসিশন। ‘
‘ অবশ্যই। আম ওয়েটিং। ‘
সে সত্যিই অপেক্ষা করছে না শোনার জন্য? আমি চেষ্টা করলাম। কিন্তু না’টা মুখে আসছেই না। তাকে না করার ক্ষমতা কী আমার নেই? আমি আঁড়চোখে অন্যদিকে তাকালাম,
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকলে হচ্ছেনা । ‘
‘ এটা কেমন কথা। না’তো আমার মুখের উপর বলতে হবে। চোখে চোখ রেখে। কামওন ইউ ক্যান ডু ইট। ‘
গোমড়া মুখে বললাম,
‘ না শোনার জন্য এমন উতলা হলেন কেন? ‘
সে হাসলেন।
‘ কারণ তুই পারবি না। ‘
‘ এতো আত্নবিশ্বাস ভালো না। ‘
‘ ভেঙে দেখা আত্নবিশ্বাস। ‘
মাথা নিচু করে রইলাম। আমিতো সত্যিই পারবো না। সে আমার গাল টেনে ধরলেন। তারপর ধীরে আমার নিশ্চুপ ঠোঁটে তার আঙুল
ছোঁয়ালেন,
‘ জবাব নিয়ে সামনে আসবি আমার। ‘
চুল ছাড়লেন এবং কাঁপতে থাকা আমাকে রেখে চলে গেলেন।
কী ধরনের শয়তান এটা? জবাবের জন্য লাফাচ্ছে। সে কী আমাকে প্রপোজ করেছে, যে জবাব দিব। আজীব। সকলের সামনে বলেছেন বিয়ের কথা। আর আমাকে? বিয়ে করবি? এটাই তার প্রপোজ?
আমাকে পছন্দ করেন নাকি ভালবাসেন সেটাতো বলেননি। হুহ। আমিও কিচ্ছু জবাব দিবনা। যাব ও না সামনে।
বাড়িতে আজ ভিন্ন আমেজ। সকলে এদিকসেদিক ছোটাছুটি করছে৷ কেউ ঘর পরিষ্কারের কাজে, তো কেউ রান্নাঘরে। ছোট চাচী সবকিছু পরিবর্তন করছেন। চাদর, পর্দা আরও হাবিজাবি। বড় মা রান্নাঘরে। মা কাটাকুটি করছেন। রুবি আপু ঘুম থেকে উঠে রূপ চর্যায় অত্যন্ত ব্যস্ত। দীপ্ত ড্রয়িংরুমে টিভি দেখছে। আমিও সেখানে গেলাম। আলগোছে পা তুলে বসে পড়লাম। কোলে বালিশ চেপে দীপ্ত’কে হুকুম দিলাম,
‘ যাহ, আইসক্রিমের বক্স নিয়ে আয় ফ্রিজ থেকে। ‘
ও ভ্রু কুঁচকাল,
‘ আইসক্রিম ফ্রিজে? পরশু না শেষ হয়ে গেলো? ‘
আশপাশ তাকিয়ে বললাম,
‘ তন্ময় ভাই’কে দেখেছি রাত্রে আনতে। ‘
দীপ্ত দৌঁড়ে গেল। সাথে চামিচ আর বক্স আনলো৷
দুজন বেশ খাচ্ছি আর মুভি দেখছিলাম। মাহেশ বাবু’র ভারাত চলছে। আহা, যখন প্লেন থেকে নামার সিন’টা আসে। আমার মনের দরজা সবদিক দিয়ে খুলে যায়। তারপরের অ্যাকশঅন গুলোর কথা আর কী বা বলব, লা’জাবাব। একদম লা’জাবাব। আঁড়চোখে দেখলাম, চাচ্চুরা, আব্বু, রবিন ভাইয়া আর তন্ময় ভাই আসছেন।
চাচ্চু আব্বু নিজেদের রুমে চলে গেলেও, তন্ময় ভাই গেলেন না। সে অপজিট সোফায় পা তুলে বসলেন। ফোনে কি যেন টেপাচ্ছেন। অথচ, সে আসায় এখন আমার আর মাহেশ বাবুর থামাক্কা এন্ট্রি’তে মন নেই। আঁড়চোখে তাকে দেখতে ব্যস্ত। কিছুতেই পছন্দের মুভি’তে আর মন বসাতে পারলাম না। এটা কোনো কথা?
একসময় আমার আঁড়চোখে তাকানো হাতেনাতে ধরে ফেললেন সে। আমি দ্রুত টিভির দিক ফিরলাম। লজ্জায় মুখে গরম ভাব।
দীপ্ত বলল,
‘ মুভি দেখবে নাকি তন্ময় ভাইকে টিভির সামনে আনব? ‘
এবার লজ্জায় বোবা বনে গেলাম। মানইজ্জত আর রাখল না এই
ছেলে৷ তন্ময় ভাই বাঁকা হাসলেন। তারপর উঠে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ ঠাঁই বসে রইলাম। তারপর বালিশ দিয়ে দীপ্ত’কে মারলাম। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,
‘ ফাজিল। দাঁড়া আজ চাচী’কে বিচার দিব। ‘
‘ এহ। তুমি করলে দোষ নেই, আমি বললে দোষ। ‘
কী বেদ্দপ হয়েছে ছেলেটা। চোখ-মুখ অন্ধকার করে বসে রইলাম।
আর তাকাবা না এই তন্ময়ের দিক। জাহান্নামে যাক। আর তাকাবা না। একদম না।
গোসল শেষ করে বিছানায় বসলাম। আজ তন্ময় ভাইয়ের দেওয়া কামিজের মাঝে একটা পড়েছি। খুবই সুন্দর। আর আমাকে মানিয়েছেও। আয়নার সামনে কতক্ষণ দুললাম। ভাবলাম একটা ছবি তুলা যাক। নাহ। ছবি তুলে কী হবে? ধুর।
ফোন রেখে রুমের বাহিরে উঁকি দিলাম। কেউ নেই।
কিছুটা এগোলাম। হ্যাঁ, তন্ময় ভাই রুমে। কী করছে? নিশ্চয়ই গোসলে ঢুকেছে। আঁড়চোখে আশেপাশে তাকিয়ে, তার রুমে উঁকি দিলাম। ওইতো দাঁড়িয়ে। গোসল করে ফেলেছে। চুল মুছছে তাওয়ালে। তখনই পেছন থেকে কেউ আমার ঘাড়ে টোকা দিল। ভয় নিয়ে পেছনে ফিরলাম। দীপ্ত। এই বিয়াদপ ছেলে। বুকে ফুঁ দিলাম। এখনই আমার জান উড়ে যাচ্ছিলো। গলা শুঁকিয়ে আসছে।
হঠাৎ দীপ্ত ধাক্কা দিলো ভেতরের দিক। পরপরই চেঁচাতে লাগলো,
‘ অরু আপু, তুমি উঁকি দিয়ে কি দেখছিলে। ‘
দৌঁড় দেওয়ার ও রাস্তা নেই। তন্ময় ভাই এগিয়ে আসলেন। আমি আমতাআমতা করে বললাম,
‘ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলাম না। ভাইয়া আছে নাকি দেখছিলাম। আ..আসলে ফোনে প্রব্লেম দিচ্ছিলো। ‘
তন্ময় ভাই আমার দিক তাকিয়ে। কিছুক্ষণ মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেন। হয়তো বিশ্বাস করেছেন আমার কথা। বললেন,
‘ ফোন’টা নিয়ে আয়। ‘
দীপ্ত হাসছে,
‘ মিথ্যে বলছে। ‘
এই শয়তান ছেলের জন্য শান্তি নেই বাড়িতে। দ্রুত সেখান হতে চলে এলাম। এটাকে প্যাকেট করে, পানিতে চুবাতে হবে। আমাকেও ছাড়ছে না। কতবার লজ্জাকর পরিস্থিতি তে ফেলল?
কী ভাবছেন সে?
আমি আর বেরোলাম না। কী বেরোবো? ফোন তো ঠিকাছে।
আমাকে দেখলেই ফোন দেখতে চাইবেন। তখন?
ইব্রাহিম ভাইয়ের পরিবার আসলো বিকেল দিকে। মোট ছয়জন। ইব্রাহিম ভাইয়ের মা-বাবা, ছোট ভাই, মামা আর মামার মেয়ে। তার ছোট ভাই আর মামার মেয়ে আমাদের বয়সী। মিনিটে আমার সাথে মিশে গেল। ব্যবহার মারাত্মক চমৎকার। কথা বলার ভঙ্গি খুবই সুন্দর। তার ছোট ভাই’টার নাম হচ্ছে মাহিম আর মামার মেয়ের নাম রাইসা। রাইসা অনেকটা চাইল্ডিশ। কথা’তেই বোঝা যাচ্ছে। আর মাহিম খুবই ম্যাচুয়ার্ড। শান্ত কন্ঠ। আর বড্ড মিশুক।
রাইসা দীপ্ত’কে বেশ পছন্দ করলো। ঝাকড়া চুলগুলো দেখিয়ে বলল,
‘ কি কিউট দেখাচ্ছে। তাই না?’
মাহিমের জবাবা,
‘ ছেলেদের কিউট বলতে হয়না। ‘
‘ ও বাচ্চা এখনও। ‘
‘ কীসের বাচ্চা? তুই না বাচ্চা। ‘
আবার এলো। তাহলে কী সব পরিবারে কাজিনদের ঝগড়া লেগেই থাকে? কোথাও শান্তি নেই।
রাইসা, মাহিম ওদের নিয়ে এলাম উপরে। রুবি আপু ওদের দেখে হাসলেন। বিছানায় বসিয়ে সে আমার সাথে দাঁড়ালেন। রাইসা কিটকিটিয়ে হাসছে,
‘ আজ তো ইব্রাহিম ভাই গ্যায়ি কামসে। কী সুন্দর লাগছে ভাবীকে। ‘
রুবি আপু লজ্জা পেলেন। ‘ যাহ ‘ বলে সে অন্যদিকে ফিরে গেলেন। আমি হাসলাম। আসলেই এই অনুভূতি খুব সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর।
ইব্রাহিম ভাইরা গেলেন রাত দশ’টার দিক। তাদের আর আমাদের বাড়ির গুরুজনদের রিয়েকশনে বোঝা যাচ্ছে, তারা মেনেছেন। কিন্তু এখনও সঠিক জানা নেই। আমিতো ছিলাম না নিচে। যাও একবার শোনার জন্য নিচে নেমেছিলাম। তন্ময় ভাই ধমকে পাঠিয়ে দিলেন।
রুবি আপু বিছানায় বসে।
‘ হ্যাঁ নাকি না? কিছু বলেছে? ‘
আমি বললাম,
‘ না কেন বলবে? ‘
‘ আমার ভয় হচ্ছে। তন্ময় কই? ‘
‘ আমি জানি? ‘
আপু নিজেই তন্ময় ভাই’কে কল লাগালেন। তাকে বললেন উপরে আসতে। সে আসলেন খানিকক্ষণ পর। রুবি আপু অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
‘ কী কথা হলো? ‘
‘ কী হবে? ‘
‘ উফ। তন্ময়। ‘
সে হাসলেন হালকা। রুবি আপুর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন।
‘ এতো তাঁড়া চলে যাওয়ার? ‘
ব্যস। রুবি আপু মন খারাপ হয়ে গেলো। তন্ময় ভাই বললেন,
‘ কিছুদিনের মাঝে বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে। ‘
দীপ্ত তো লাফাতে শুরু করেছে।
‘ এই, বিয়ে খাবো। ‘
ওয়াও। তাহলে আমাদের বাড়ি বিয়েবাড়িতে খুব জলদি রুপান্তরিত হচ্ছে।
প্রেয়সী
১৭|
তন্ময় ভাই আজ ছয়দিন যাবত বাড়ি নেই। সেই যে গিয়েছেন আর আসার নামগন্ধও নেই লোকটার। অবশ্য কল দিয়েছেন প্রায় প্রতিদিন। তাতে কী? কল আর সম্মুখীন হওয়া কি এক হলো? একদম না। কলে তো শুধু তার ম্যানলি ভয়েস শোনা যায়। তার সেই মারাত্মক মায়াবী, হ্যান্ডসাম ফেইস তো দেখাই যায়না।
এবার ফিরলে অবশ্যই আমি আমার জবাব দিব তাকে। জবাব হবে হ্যাঁ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাসি উপহার দিয়ে বলব,
‘ হ্যাঁ , আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি। একপায়ে রাজি। যখন বলবেন তখনই বিয়ে করে ফেলব। কিন্তু তার আগে আপনাকে আমাকে প্রপোজ করতে হবে। নিজের মুখে বলতে হবে যে, অরু। আমি তোমায় ভালবাসি। আর সারাজীবন একসাথে থাকতে চাই। ‘
ব্যস। তাহলেই হবে। সকলেই তার হবু বউকে প্রপোজ করে। তাকেও করতে হবে। আলবাত করতে হবে। না করলে বিয়েও ঝুলে থাকবে। কী লোক, এখনও বলেনি নিজের মনের কথা।
বিয়ে করবি? পছন্দ করিস আমায়? এগুলো প্রপোজ? একদমই রোমাঞ্চকর না লোকটা। সে কী শারুখ খানের ফিল্ম কখনও দেখেননি? শারুখ খানের তুক্ষার রোমান্টিক ডায়ালগ গুলো কী শোনেন নি?
ধবধবে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, দু’হাত ছড়িয়ে দেবে আর আমাকে ইশারা করবে, তার বাহুতে যায়গা করে নিতে। তা না, যত্তসব চুল টানাটানি। কত চুল ছিঁড়েছে তা তো বাদ’ই দিলাম।
এখন কী আমি তাকে রোমান্স শেখাব? এতটাই
চরিত্রহীন নাকি আমি? হ্যাঁ, হবো চরিত্রহীন তার জন্য। এবার আসুক। প্রপোজ না করলে কথা নেই। ফ্রেন্ডসদের বয়ফ্রেন্ড আছে। কী সুন্দর কাপল তারা। অথচ আমার? কী আছে তাও শিয়র জানিনা।
কীভাবে বলব আমার ববয়ফ্রেন্ড আছে? সেতো তেমন কিছুই বলেনি। একদম ডিরেক্ট বিয়ে। প্রেম ছাড়া জীবনের মানে আছে? হ্যাঁ? প্রথম ভাললাগা তারপর চুটিয়ে প্রেম তারপর না বিয়ে। আর আমার সাথে কি হলো? যা’কে ভাবতাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহিল শেষে তারই প্রেমে পড়লাম। এখন তো ভালবেসে ফেলেছি। এইযে রাত্রে ঘুমাতে পারিনা। তার চেহারা হাজার বার চোখ বন্ধ করে দেখে ফেলি। কলেজের ক্লাসে মন বসে না। শুধু তাকে ভাবি। অথচ সে? আমাকে ফেলে দিব্বি ভালো আছে। থাক ভালো। এবার আয় শয়তান।
রুবি আপুর আর ইব্রাহিম ভাইয়ের ঝগড়া লেগেছে। সেটা হচ্ছে ইব্রাহিম ভাইয়ের এক্স’কে নিয়ে। আজ সারাদিন আপু না খেয়ে।
তার কাঁদাকাটি’র কথা শোনে বড় চাচ্চু ইব্রাহিম ভাইয়াকে কল
দেন। ইব্রাহিম ভাই তো সেই মাফ চেয়েছেন। লাগাতার বলেছেন,
‘ ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে চাচ্চু। ঠিক হয়ে যাবে। ‘
এদিকে রুবি আপু কথা বলতে নারাজ। একদম শক্ত আওয়াজে তার জবাব,
‘ কথা বলবো না ওর সাথে। ও যাক, ওই মেয়ে’কে বিয়ে করুক। ‘
ইব্রাহিম ভাইয়ের অবস্থা তো নাজেহাল। কতবার আমাকে কল করেছেন বলার বাহিরে। তার একটাই কথা,
‘ প্লিজ অরু। হ্যাল্প মি। কথা বলাই দাও। আই উইল ম্যানেজ। ‘
কীভাবে ম্যানেজ করবেন? রুবি আপু তো কথাই বলতে চাচ্ছেন না।
আমিতো ইব্রাহিম ভাইয়ের দোষ দেখছিনা। আপু তো জানতেন তার এক্স রয়েছে। জানার পর রিলেশনে গিয়েছেন। এখন হঠাৎ দেখা হওয়ায় ভাইয়া তার এক্সের সাথে ছবি তুলেছেন। সেই ছবি এক্স তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে ছেড়েছেন। সেটা আবার আপু দেখে ফেলেছেন। এখন আপু রেগেমেগে শেষ। ইব্রাহিম ভাইয়ের কথা হচ্ছে ‘ সে তার এক্স। অতিত। বর্তমানে তার জীবনে কোনো
যায়গা নেই। সে শুধু একটি ছবি তুলেছেন। ব্যস।
অথচ আপু মানতে নারাজ। এখন এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে পারবেন তন্ময় ভাই। কিন্তু তন্ময় ভাই খুবই বিজি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে, তাই উনি চব্বিশঘণ্টা বিজি থাকেন। পৃথিবীর মোষ্ট বিজি সেডুয়াল নিশ্চয়ই উনার৷ তারপরও কল লাগালাম। এবার রিসিভ হয়েছে।
‘ কি হয়েছে, বল। ‘
দেখ। কী অবাস্তবিক লোক। সারাটাদিন একটা কল দিল না। যাও আমি দিলাম। বলতেসে ‘ কি হয়েছে, বল। ‘ মন তো চাচ্ছিল কল’টা কেটে দি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে করে বললাম,
‘ এভাবে বলছেন, যেমন আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি। হু। আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য আমি বসে নেই। আমারও অনেক কাজ। হোমওয়ার্ক আরও কত-কী। ‘
ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ। মনে হচ্ছে গোসলঘরে ছিলেন। ঝর্না বন্ধ করার শব্দ হলো। ইশ।
‘ আচ্ছা? হোমওয়ার্ক তারপর? আর কী কাজ শুনি? ‘
‘ আপনাকে কেন বলব? কে আপনি আমার? যাকেতাকে আমি আমার সারাদিনের কাজের এক্সপ্লেইন দিব নাকি। ‘
‘ অথচ, যাকেতাকে যেচে ফোন দেওয়া হচ্ছে? ‘
যাহ। কল কেটে দিলাম। বলব না এই লোকের সাথে কথা। পরপরই মনে পড়লো আপুর কথা৷ নিশ্চয়ই কাঁদছে। ইব্রাহিম ভাইয়ের অবস্থাও ভালো না। মানইজ্জত বেঁচে দিয়ে আবার কল দিলাম। সে রিসিভ করলেন। ওপাশে মিষ্টি হাসির আওয়াজ। হু মিষ্টি না ছাই।
‘ হয়েছে কী?
‘ নিজের জন্য কল দেই নি। নির্ঘাত প্রব্লেম আছে তাই দিয়েছি। উহ, আপনাকে কল দেওয়ার জন্য, আমি সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকি না। ‘
এবার সে খুব মিষ্টি ভাবে ডাকলেন,
‘ অরু? ‘
মনে হলো, আমার এতো অভিমান নিমিষেই হারিয়ে গেল। এতএত রাগের একটুও অবশিষ্ট নেই। তার স্থির কন্ঠ,
‘ এই চার’দিন আমি অনেক ব্যস্ত ছিলাম। এইতো মাত্র রুমে এসেছি। গোসল শেষে তোকেই কল দিতে নিচ্ছিলাম। খেয়েছিস? ‘
বাচ্চাদের মতো চুপ হয়ে গেলাম। চোখ টলমল করছে। ছোট আওয়াজে জবাব দিলাম,
‘ হু। ‘
‘ লক্ষি মেয়ে। এখন বল কী হয়েছে? হোয়াই আর ইউ সো ডিস্টার্ব টুডে? ‘
আমি নিমিষেই সব বলে দিলাম। তন্ময় ভাই হাসলেন। বললেন,
‘ আচ্ছা ঠিকাছে। আমি দেখছি। রাত হয়েছে, এখনও জেগে কেন? ‘
কী বলব? আপনি আমাকে ঘুমাতে দেন কোথায়? এইতো ঘুমাতে গেলে শুধু আপনার কথা মনে পড়ে। ঘুমাতেই পারিনা। সারারাত এদিকসেদিক করি। এ কি করে ফেললেন আমার সুন্দর জীবন’টার?
‘ ঘুম আসছেনা। ‘
‘ এভাবে ফোন নিয়ে থাকলে আসবে? ‘
‘ উঁহু। ‘
‘ সেলফোন রেখে, চুপচাপ ঘুমিয়ে যাবি। ঠিকাছে? ‘
একটু কথা বললে কী হয়? এইতো মাত্র কল দিলাম। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। আর সে? এখনই রাখতে বলছে। অবশ্য সে খুবই ক্লান্ত। সারাদিন পর মাত্র ঘরে ঢুকেছেন। নিশ্চয়ই খান নি এখনও। আমি বললাম,
‘ খেয়েছেন? ‘
‘ ইচ্ছে করছেনা। ‘
‘ খেয়ে তারপর ঘুমাবেন। ‘
সে একটু চুপ থেকে জবাব দিলেন,
‘ আচ্ছা, খেয়ে তারপর ঘুমাব। ‘
আমি হাসলাম। সে খুবই সুইট। আবার শয়তান ও। সবই সে।
সকালে উঠে আরেক তাজা নিউজ। তা হচ্ছে আপু আর ভাইয়ার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। আগামী মাসের ২১ তারিখ। বাহ। মাত্র একমাস বাকি। চাচ্চুরা এখনই সকল কিছুর আলোচনা করছেন। রুবি আপুর রুমে যেতেই দেখলাম সে হেসে হেসে কথা বলছেন। পরপর জানতে পারলাম তাদের সমস্য সমাধান হয়ে গিয়েছে। তন্ময় ভাই কী এমন বললেন যে সব ঠিক হয়ে গেলো? জাদু। ছু মান্তার গান’টা গেয়েছেন নিশ্চয়ই।
কলেজ গিয়ে আরেক প্যারা। সেটা হচ্ছে সুমনা আপা। তিনি এখন আরেকদল বানিয়েছেন। আমাকে দেখলেই কানাকানি করবেন। হাসবেন আর ফুসুরফাসুর তো আছেই। ওর মেয়ে সাথী গুলোও আমাকে ভেঙচি কাটবে। মারজি মুখ ভেঙাল,
‘ তুর কাজিন’টা যেমন সুন্দর তেমনি বান্দর। ওর মতো ছেছড়া আমি আমার এই জীবনে দুটো দেখিনি। ট্রাস্ট মি। ‘
‘ হয়েছে বাদ দে। ‘
‘ বাদ দে মানে? শোন, এখনও তুর এই কাজিন, তন্ময় ভাইয়ের পিছু ছাড়েনি। জানিস সেদিন তন্ময় ভাইকে কল দিয়ে প্রপোজ করেছে? ‘
অবাকের চুরান্তে গিয়ে চেঁচালাম,
‘ কীহ? ‘
‘ হ্যাঁ। ওইযে সুমনার পাশে যে বসে, সেটা আমার ইংলিশ টিচারের মেয়ে। ওই আমাকে জানিয়েছিল। ‘
‘ তারপর? তন্ময় ভাইয়ের জবাব জানায়নি? ‘
মারজি হাসছে। কিটকিটিয়ে বলল,
‘ বলেছে নাকি, সামনে পেলে থাপড়ে দাঁত ফালাই দিবে। ‘
আমার সুন্দর তন্ময়। সবাই তারে নিয়ে টানাটানি করে। এটা কী ঠিক? এই সুমনা’কে কী করা যায়? বেশরম মেয়ে। এইবার সামনে আসুক। আমার হবু বরের দিক কু’নজর দেওয়া। আঙুল দিয়ে চোখ তুলে ফুটবল খেলব।
কলেজ থেকে ফিরবার পথে সামনে দাঁড়ালো সুমনা। আমাকে দেখে হাসছে। ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি।
‘ হয়েছে কী? ‘
‘ হয়নি। খুব জলদি হবে। ‘
হবে তুর কল্লা। তোয়াক্কা না করে চলে এলাম। নির্লজ্জ মেয়ে, কীভাবে আসে আবার আমার সাথে কথা বলতে? কোন মুখ দিয়ে কথা বলতে আসে? জাহিল।
বাড়িতে এসে দেখলাম মা’য়ের মন খারাপ। কেমন মনমরা। হঠাৎ তার আবার কী হলো? কিছু একটা হয়েছে হয়তো। নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে টেনশনে। দেখলাম বড় মা জিজ্ঞেস করছে,
‘ কী হয়েছে? ‘
মা জবাব দিচ্ছেন না। ধীরে ধীরে কাজ করছেন। তার নাগাল না পেয়ে, উপরে চলে এলাম। ড্রেস পরিবর্তন করে যাই, দেখি কি হয়েছে তার। যখন নিচে নামলাম তখন আর সে আশেপাশে নেই। নিশ্চয়ই রুমে। আমি রুমের দিক যাচ্ছি। দূরত্ব থেকেই চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে৷ বাবা চেঁচাচ্ছেন। আবার কী হলো? এবার ধীরে এগোলাম। সাইড হয়ে তাকালাম। বাবা হাত তুলেছেন মা’কে মারার জন্য। আমি দ্রুত ভেতরে ঢুকতে থেমে গেলাম বাবার কথায়,
‘ তোর পরিবার উঠেপড়ে লেগেছে আমার পরিবার বিনাশ করার জন্য। তোর ভাইয়ের মতো জালিয়াত, এই পৃথিবীতে আরেকটা
নেই। আমার একমাত্র মেয়ে। তুই তার কথা না ভেবে ভাইয়ের মেয়ের কথা ভাবিস, কেম্নে? হ্যাঁ? তোর ভাই যখন তার মাইয়ার প্রস্তাব তন্ময়ের জন্য দেয়, তোর মুখ তখন কই ছিলো? বলিস নাই কেন, তন্ময় আর অরুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তন্ময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলে, বিয়ের কথাবার্তা শুরু হবে। তুই চাস কী? তোর ভাইয়ের মেয়ে তন্ময়রে পছন্দ করে, এখন ওদের বিয়ে দেওয়ার জন্য কথা বলতাম ? শোন, আমার একটা মাত্র মাইয়া। ওরে নিয়ে কোনো কাহিনী না। এই তোর পরিবার নিয়ে যদি আরেকটা শব্দ আমি শুনি। সেদিনই তোর এ-ই বাড়িতে শেষ দিন৷ ‘
কাঁপাকাপা পা নিয়ে আমি দ্রুত লোকালাম। বাবা রাগে রুম থেকে চলে যাচ্ছে। মা বসে কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করছেন,
‘ আমি কেম্নে না করে দিমু? আমার বড় ভাই। যে আমারে দু’হাতে পালছেন। এই প্রথম অনুরোধ স্বরে কিছু বলেছেন। কীভাবে মুখের উপর না করি? কি করব আমি? ‘
রুমে ফিরে আমি চুপসে বসে রইলাম। হাত-পা কাঁপছে।
ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে। আবার ঝামেলা এসেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এই ঝামেলা এতো দ্রুত যাবেনা।
চলবে
® নাবিলা ইষ্ক
চলবে
® নাবিলা ইষ্ক