বন্ধ দরজা পর্ব ৩১

#বন্ধ_দরজা
পর্ব-৩১
লেখা-মিম
মাগরিবের আযান দিয়েছে দশ মিনিট আগে। জুতো বাহিরে রেখে ঘরে ঢুকছে সুহায়লা। মা আর সাবা ড্রইং রুমে বসে আছে। সুহায়লাকে দেখা মাত্রই তার মা মিতা জিজ্ঞেস করলেন,
-” কি রে জামাই নাকি সিরাজ ভাইয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো?”
-” হুম।”
-” ঐ বাসায় গেলো কিভাবে?”
-” ওটা নাকি ও কিনে নিয়েছে।”
-” ঐ বাড়ি ও কিনেছে কেনো? এত পুরান বাড়ি। তাছাড়া ওর তো কত বড় বাড়ি আছে। ওগুলো থাকতে এটা কেনো?”
-” দুটো কারনে কিনেছে। সিরাজ আংকেলের টাকার খুব দরকার ছিলো আর তানভীরের শখ জেগেছে আমার সাথে সে প্রেম করবে ছাদে দাঁড়িয়ে। আঠারো উনিশ বছরের ছেলেমেয়েদের মতো”
মিতার ভীষন হাসি পাচ্ছে মেয়ের কথা শুনে। কিন্তু তিনি হাসি চেপে রেখেছেন। উনি হাসলে মেয়েটা লজ্জা পেতে পারে। সাবা কিছুক্ষন চুপ থেকে এরপর জোরে হাসা শুরু করলো। ছোট মেয়ের হাসি দেখে মিতা আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। উনিও হেসে দিলেন।
-” আজব তো, এভাবে হাসছো কেনো?”
-” তোদের প্রেম দেখে।”
-” এখানে হাসার কি হলো?”
-” দুলাভাইয়ের কান্ড দেখে। এই এ্যাংরি বার্ড যে এত ভালো প্রেম করতে জানে সেটা তো উনার কথা শুনলে একদমই আন্দাজ করা যায় না। তো আর কি কি করবি তোরা?”
-” আমি জানি না। তানভীরের মতি গতি চড়কির মতো ঘুরছে। কখন কি করে, কখন কি বলে কিচ্ছু বুঝি না।”
-” শোন সুহা, তোকে আমি আগেই বলেছি তানভীর আর আগের মতো নেই। ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে ওর মাঝে। একটা সুযোগ দে ছেলেটাকে।”
-” হুম।”
-” হুম কি? দিবি কি না বল?”
-” এখনও সিদ্ধান্ত পাকাপোক্তভাবে নেইনি। ”
-” কিসের অপেক্ষা করছিস তুই যে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিস না?”
-” জানি না আম্মা । বাদ দাও এই কথা। রাতের খাবার পাঠাতে হব ওখানে। একটু বেশি করে ভাত রেঁধো।”
-” ওখানে পাঠাবো কেনো? এখানে এসে খাবে ও।”
-” আসবে না। বলেছিলাম। ওখানে খাবার পাঠাতে বলেছে।”
-” কেনো?”
-” আমি কিচ্ছু জানি না আম্মা। ওর কাজ কর্ম সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ইদানিং। আর শোনো, ডালভর্তা আর কালোজিরা ভর্তা পাঠাতে বলেছে।”
-” জামাইকে ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়াবো?”
-” ও নিজের ইচ্ছায় খেতে চাচ্ছে খেতে দাও। পরে দেখা যাবে মনমতো মেনু না হলে কিছুই খাবে না।”
কথা বলার ফাঁকেই কারেন্ট চলে গেলো। পুরো ঘর অন্ধকার। কারেন্ট যাওয়ার সাথে সাথে তানভীরের কথা মনে পড়লো সুহায়লার। বাসায় তো বোধহয় এখনও আই পি এস আনেনি। চার্জ লাইট আছে তো? আর নয়তো অন্ধকারে বসে থাকতে হবে। এসব ভাবনার মাঝেই ফোন করে বসলো তানভীর।
-” হ্যালো…..”
-” এই পুরা ঘর তো অন্ধকার। চার্জলাইটও নেই। লাইট অথবা মোম কিছু একটা নিয়ে আসো তো।”
-” আসছি।”
ফোনটা রেখে বাসায় থাকা একট্রা চার্জ লাইট টা নিয়ে বাসা থেকে বেরোচ্ছে। সাবা পিছন থেকে বললো,
-” যাচ্ছিস? যা, যা। কারেন্ট যাওয়ার উছিলায় নাহয় অন্ধকারে একটু রোমান্সটাও সেড়ে আসবি।”
-” কেনো তুই আর ইমরান ভাই কি কারেন্ট চলে গেলে এসব করিস নাকি?”
-” নাহ্ আমরা এসব করি না। আমাদের গরম করে বেশি। এজন্য কারেন্ট চলে গেলে আমরা ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলি।”
-” অামাদেরও গরম বেশি। আমরাও ডিসটেন্স মেইনটেইন করেই চলি।”
-” এখন তো হালকা ঠান্ডা পড়েছে। তাহলে এখন কি করবি?”
-” নির্লজ্জ মেয়ে…..”
সুহায়লা জানে সাবা কথা পেঁচাতেই থাকবে। তাই সে কথাটা বলে আর এক সেকেন্ড দাঁড়ায়নি। বেরিয়ে চলে গেছে। বাসার বাহিরের আর ভিতরের মেইন গেট গুলো খোলাই ছিলো । লাইট টা জ্বালিয়ে ভিতরে ঢুকছে সুহায়লা। তানভীরকে দেখা যাচ্ছে না। এ বাড়িটা দেখতে অনেকটা সুহায়লাদের মতনই। পুরো ঘর সাজানো গোছানো। ড্রইং রুমে টি টেবিলের উপর লাইটটা রেখে ভিতরের দিকে খুঁজতে যাচ্ছে সুহায়লা। হঠাৎ একটা রুমের দরজা থেকে হাতে টান পড়লো সুহায়লার। কেউ একজন এক ঝটকায় ওকে বুকে টেনে নিয়েছে। গায়ের ঘ্রানে বুঝা যাচ্ছে এটা তানভীর। তবে হুট করে টান পড়ায় খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো সে। ধীরে ধীরে তানভীরের হাত জোড়া সুহায়লার কোমড়ের দিকে এগোচ্ছে।
-” এভাবে কেউ টান দেয়? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।”
-” ভয় পেয়ে গিয়েছিলে? তাহলে সেদিনের মতো চিৎকার দিতে। আম্মাআআআ ভুউউউত। সাদিইইই ভুউউউত।। এলাকার লোকজন সব জড়ো হয়ে যেতো তোমাকে বাঁচানোর জন্য।”
তানভীর অট্টহাসিতে ফেটে যাচ্ছে।
-” খবরদার হাসবা না আমাকে নিয়ে।”
তানভীর হেসেই যাচ্ছে। সুহায়লার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে তানভীরের হাসিতে। নিেকে তানভীরের বেড়াজাল থেকে ছুটাতে চাচ্ছে সে। তানভীর হাসি থামিয়ে সুহায়লাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো
-” এমন মোচড়ামোচড়ি করছো কেনো?”
-” ছাড়ো তো?”
-” কেনো আমি গায়ে হাত দিলে কি গা চুল্কায়?”
-” হ্যাঁ চুল্কায়। সেই সাথে জ্বালা পোড়াও করে।”
-” তাহলে চলো একটু বরফ ঘষে দেই।”
-” তোমার বরফ তুমিই ঘষো।”
কথাটা বলেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তানভীরকে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সুহায়লা। ওকে ফের পিছন থেকে টেনে কাছে নিয়ে এলো তানভীর। ওকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে এলো।
ওকে পাশে বসিয়ে দুহাত ধরে রেখেছে তানভীর।
-” এত ছটফট করলে কি হয়? অন্ধকার রুম, হালকা ঠান্ডাও পড়েছে, জানালা দিয়ে তারা দেখা যাচ্ছে। রোমান্স করার জন্য পারফেক্ট একটা মোমেন্ট। কোথায় একটু আধটু আদর করবে, ঘেষাঘেষি করবে তা না করে দূরে দূরে থাকতে চাচ্ছো। আগে তো আঠার মতো লেগে থাকতে। কাজের সময় কোলে এসে জোর করে বসে থাকতে, কিছুক্ষন পরপরই চুমু খেতে এখন সেসব কোথায় গেছে? তখন তো আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছো। এখন আমি কাছে টানতে চাইলে এমন করো কেনো?”
-” সবসময় সবকিছু ভাল্লাগেনা।”
-” তাহলে কি ভালো লাগে শুনি?
-” কিছুই ভালো লাগে না। সন্ধ্যায় খেয়েছো কিছু?”
-” কোথায় খেলাম? কারেন্টই তো চলে গেলো।”
-” কিছু খাবা? বানিয়ে দিবো?”
-” নাহ অন্ধকারে কিছু বানাতে হবে না। তুমি আছো। গল্প করতে ভালো লাগছে। এখানেই থাকো।”
-” মেইন গেইট খোলা। লাগিয়ে দিয়ে আসি।”
-” কেউ আসবে না।”
-” যদি আসে?”
-” সমস্যা কি সুহা? আমি চাচ্ছি তুমি এখানে বসে থাকো। আর তুমি চাচ্ছো বারবার উঠে যেতে। কেনো? বসে থাকতে সমস্যা হচ্ছে? আমি কি তোমাকে মারধর করছি?”
তানভীর রেগে গিয়েছে। সুহায়লা চুপচাপ ওর কথা শুনছে। তানভীর সুহায়লার হাত দুটো ছেড়ে দিয়েছে।
-” আমার সাথে বসতে তো তোমার ভালো লাগে না। যাও চলে যাও। থাকতে হবে না এখানে। তোমার লাইটও নিয়ে যাও। তোমারও দরকার নেই, তোমার লাইটেরও দরকার নেই।”
বাচ্চাদের মতো জিদ দেখাচ্ছে তানভীর। হাসি পাচ্ছে সুহায়লার। এমন বাচ্চা স্বভাবের কবে থেকে হলো মানুষটা? তানভীরের গালে হাত রেখে বললো,
-” তানভীর…..”
-“………..”
-” এই তানভীর…..”
-” কথা বলবা না তুমি আমার সাথে।”
-” সত্যিই কি চলে যাবো?”
-” হ্যা যাও।”
সুহায়লা উঠে চলে গেলো। মেইন ডোরের কাছাকাছি যাওয়ার পর তানভীর এসে ওকে আবার টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসলো। রুমে এনে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তানভীর।
-” আমি বললেই কি চলে যেতে হবে? হুম?”
-” তোমার কাছে জিজ্ঞেস করেই তো গেলাম।”
-” বাহ ভালোই তো। তখন থাকতে বলেছি আমার সাথে অথচ আমার কথা শুনোনি। আর এখন চলে যেতে বলেছি সেটা ঠিকই মেনে নিলে।”
কথাটা বলে সুহায়লার চুলে নাক ডুবালো তানভীর।
-” আজকে শ্যাম্পু করেছো?”
-” হুম।”
-” নেশা ধরানো স্মেল শ্যাম্পুটার। বুঝিনা শ্যাম্পুটার স্মেলই এই টাইপের নাকি তোমার চুলে মিক্স হওয়ার পর স্মেলটা এমন নেশা ধরানো হয়ে যায়।”
-” আমি কিভাবে বলবো বলো তো? আমার কাছে তো নরমালই মনে হয়।”
-” ভালো লাগে খুব জানো।”
-” জানি। বিয়ের পর থেকেই এই একটা কাজ তুমি খুব মনোযোগ দিয়ে করো। তোমার মুখ দেখলেই বুঝা যায় তখন তোমার জগত সংসারের কোনো খেয়াল থাকে না।।”
-” হুম। এটা ঠিক বলেছো। সেই শুরু থেকে এই জিনিসটার উপর আমার কেনো যেনো খুব দুর্বলতা কাজ করে।”
সুহায়লার ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে চুমু খেলো তানভীর। কানে আস্তে করে সে বলতে লাগলো
-” এই মেয়ে….”
-” হুম?”
-” সবসময় আমার কাছে থাকতে পারো না?”
-” কাছেই তো আছি।”
-” সবসময় তো থাকতে চাও না। বুঝো না তোমাকে কাছে আগলে রাখলে আমি শান্তি পাই?”
-” কাছাকাছি থাকলে তো আকর্ষনে চেয়ে বিকর্ষন বেশি হয়।”
-” ওটা তো একটু আধটু হবেই।”
-” সেদিন যে গলা চিপে ধরেছিলে সেটা কি একটু আধটু ছিলো?”
-” মনে করো না তো সেদিনের কথাগুলো। এমনিতেই সেদিনের কথা মনে হলে খুব কষ্ট পাই। তুমি আবার নতুন করে সেসব মনে করিও না প্লিজ।”
-” তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?”
-” এটা কেমন প্রশ্ন করলে?”
-” কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি তোমার ভালোবাসা না। শুধু প্রতিদিনকার অভ্যাস মাত্র। সময় পাল্টালে অভ্যাসটাও পাল্টে যাবে।”
-” তুমি আমার অভ্যাস না। তুমি আমার বদঅভ্যাস। অভ্যাস ছাড়ানো যায়। বদঅভ্যাস না।”
-” বদলায়। নতুন অভ্যাসে পুরোনো বদঅভ্যাস কেটে যায়।”
-” নতুন অভ্যাস মানে?”
-” নতুন কেউ। প্রিয়ার মতো। তোমার স্ট্যাটাসের সাথে যায় এমন কেউ।”
-” প্রিয়ার কথাটা তোমাকে এমনি এমনি বলেছি। আর নতুন কাউকে পাবো কোথায়?”
-” তোমার মতো পুরুষদের জন্য মেয়ের অভাব হয় না।”
-” তোমার মতো মেয়েদের অভাব খুব বেশিই আছে। এ ধরনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও যে আমার সাথে তোমাকে না অন্য কাউকে মানায়। তানভীরের সাথে কাউকে মানায় না। শুধুমাত্র সুহায়লাকে ছাড়া।”
-” তুমি যে সেদিন রাতে বলেছিলে কোন মেয়ের সাথে থেকে এসেছো, সত্যিই কি…..?”
-” তুমি কি পাগল? এসব বাজে নেশা আমার নেই। আমি খারাপ হতে পারি। কিন্তু মেয়ে মানুষের নেশা ওসব কখনোই ছিলো না।”
-” তাহলে সেদিন বললে কেনো?”
-” আরে ওটা তো মজা করেছি। সিরিয়াসলি কেনো নিচ্ছো? অন্য মেয়ের কাছে গেলে কি তোমার কাছে ফিরে আসতাম?”
-” শুনেছি পার্টিতে মেয়েরা নাকি ইচ্ছে করে তোমার গা ঘেষে? তোমার কখনো ইচ্ছে হয়না ওদের কাছে যেতে?”
-” তুমি থাকতে ওদের কাছে কেনো যাবো?”
-” আমি আসার আগে?”
তানভীর হেসে দিলো সুহায়লার কথায়। ব্যাপারটা ও বেশ উপভোগ করছে। মেয়েটা তাকে জেরা করছে ঠিকই, কিন্তু জেরার আড়ালে শংকা কাজ করছে। পরনারীর প্রতি স্বামী যদি আকৃষ্ট হয়ে যায় সেই আশংকা। তবে অবশ্য সুহায়লা এই কাজটা আজ প্রথম করছেনা। এর আগেও করেছে। তবে এভাবে সরাসরি কখনো জিজ্ঞেস করেনি। বরাবরই কৌশলে জিজ্ঞেস করেছে। সুহায়লার চুল গুলো একহাত দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে তানভীর।
-” সুহা তুমি একটা পাগল। এভাবে আমাকে নিয়ে টেনশন করা বন্ধ করো।”
-” কে টেনশন করছে তোমাকে নিয়ে?”
-” তুমি।”
-” একদম না। তোমাকে নিয়ে টেনশন করার কি আছে? তোমার যদি শখ হয় অন্য কারো কাছে যাওয়ার তাহলে যাবা।”
-” হিংসা হবে না?”
-” আমার কখনো হিংসা হয় না। ”
তানভীর ভাবছে সুহায়লাকে খানিকটা বাজিয়ে দেখবে। বেশ বড় মুখ করে বলছে ও আমার হিংসা হয় না। হিংসা কতটুক হয়না সেটাই দেখতে চায় তানভীর। তবে এখন না। এখনই কিছু করলে ও বুঝে যাবে তানভীর ইচ্ছে করে ওকে জ্বালানোর জন্য এমন করছে। আর কিছুদিন যাক এরপর নাহয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
(চলবে)
.
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here