#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
২৫
আহফিন ধীরেসুস্থে রেডি হচ্ছে। নিজেকে একটু বিরতি দেওয়ার জন্য সে সিলেট যাওয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়েছে। জীবনের প্রতি একঘেয়েমি অনীহা চলে এসেছে তার। এটা তার জীবন না কি অন্য কিছু সে বুঝতে পারে না। জীবনের স্বাদ বলতে কিছু নেই এখন। চারিদিক ধূসর পূর্ণ অন্ধকার শুধু। আয়নায় তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে গায়ে কোট জড়িয়ে নিল সে।
আজকাল আহফিন কে দেখতে অন্যরকম লাগে। চেহারায় আগের সেই ভাব টা কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের একটা হাসি টেনে নিয়ে সে বাসা থেকে বের হলো। গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।
“স্যার স্টার্ট দিব?”
আহফিন মুখে কিছু বলে নি হাতের ইশারায় যেতে বলল। ড্রাইভারও চুপচাপ স্টার্ট দিল। কারণ জানে সে আহফিন কে এত এত কিছু বলার উত্তর হুম আর নাই হবে। আহফিন খুব কমই কথা বলে।
বাহিরে তাকিয়ে আছে আহফিন। শহরের অলিগলিতে আজো সে তূবা কে খুঁজে ফিরে। তূবা বিহীন তার জীবন টা অন্ধকার গোলকধাঁধা। মনের কোণায় নিভে আসা প্রদীপের মতো আশা রেখেছে তূবা কোনো এক দিন ফিরে আসবে তার জীবনের রঙ নিয়ে। কোনো এক গোধূলি তে আবারও দেখা হবে তাদের।
তূবা কে ছাড়া তার পাঁচ টা বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। এই পাঁচটা বছরে এমন একটা দিন নেই সে তূবা কে খুঁজে নি। সেদিন অফিস শেষে আহফিন হসপিটাল ঠিকি গিয়েছিল কিন্তু তূবা তুসি শিরিণ বেগম কাউকেই পান নি। হসপিটাল থেকে যখন জেনেছে তুসি মারা গিয়েছে তখন আহফিন শকড পেয়েছিল ভীষণ। চোখ দিয়ে এমনিএমনি পানি পাড়ছিল। তখনি সে তূবার বাসায় চলে যায়। গিয়ে সেখানেও তূবা কে পায়নি। উপায় না পেয়ে সে তূবার ফোনে কল করে কিন্তু ফোন তো বন্ধ। সে আশেপাশের গোরস্তানে যায়। কিন্তু কাউকেই পায় নি। এর পর থেকে অনেক জায়গায় খুঁজেও তূবার খুঁজ মিলেনি। মনে মনে তূবা কে আজ জীবনের সব টা দিয়ে চায়। এত কিছুর পরও সে ভাবে তূবা কে আর একটু সময় দেওয়া উচিৎ ছিল তার। তূবার দিক দিয়ে হয়তো তূবা ঠিক ছিল। তার হয়তো বা এত টা রাগান্বিত হওয়ার কথা ছিল না। আবার হয়তো সে ঠিক ছিল নিজের জায়গা থেকে। ওমন ভাবে রাগের মাথায় চরিত্র নিয়ে একটা মেয়ে কে না বলায় ভালো ছিল। কিন্তু সব কিছু এক দিকে রেখেও সে তূবা কে বড্ড কাছে পেতে চায়। তার শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা প্রতিটা শোণিত কনিকাও জানে সে তূবা কে কত করে চায়। কিন্তু অভিমানের পাহাড় টা? অভিমানের পাহাড় টা আজো এক ফোঁটা কমে নি তার। চুপচাপ ভিজে চোখ নিয়ে আহফিন বাহিরে তাকিয়ে আছে। হয়তো রাস্তার কোণায় কোণায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে চলছে।
—-
ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তূবা। হাতে একটা কফির মগ। দূর থেকে বহুদূরে দৃষ্টি। সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনা তার জীবনে কালো দাগ কেটে গেছে। প্রতিদিন তুসির কথা মনে পড়ে। কয়দিন পর পর সেদিনের ঘটে যাওয়া বিবৎসকর ঘটনা মনে কড়া নাড়ে তার। তুসির সেই মুখ টা ভেসে উঠতেই লোম খায়িয়ে উঠে তূবার। তুসি কে যখন তার নিজের ঘরে রেখে আসা হচ্ছিল তূবা চিৎকার করে নয় নীরবে কাঁদছিল। তুসির সাথে শিরিণ বেগমকেও উনার ঘরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। কারণ সেদিন শিরিণ বেগম হার্ট এট্যাক করেছিলেন। দেখতে দেখতে চোখ বুজে নিয়েছিলেন তিনি। তূবা কে একেবারে একা করে দিয়ে দুজনেই নিজেদের ঠিকানায় জায়গা করে নিয়েছে। জায়গা হয়নি শুধু তার। বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে আবার তুসির কাছে ফিরে যায় সে। গোরস্তান রাতে তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল বলে পাশের লেকে গিয়ে বসে একা বিড়বিড় করছিল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতের কথা আজও তার মনে আছে।
চোখ ভিজে উঠে তূবার। চোখের কোণার পানি মুছে ফেলে সে আবারও শূন্যে তাকায়। কফির মগে চুমুক দিয়ে দেখতে পায় বরফ হয়ে গেছে তা। তূবা উদাসীন হয়ে যায়। যার মাঝে সে নিজের অস্তিত্ব কে ফেলে এসেছে তাকে যে ভুলতে পারে না। ভেতরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জানে সে আহফিন নামক মানুষটা কে কতটা মিস করে। কিন্তু অভিমান নামক পাহড়ের পিছনে এখনো তূবা ঠাই মেরে বসে আছে। আহফিনের কথা আজকাল সারাক্ষণ মনে পড়ে। লোকটার মুখটা চোখ থেকে সরতেই চায় না তার। আহফিনের পুরনো স্মৃতি দুষ্টামি ভালোবাসা নিশ্বাসের স্পর্শ পাওয়া সব কিছু মনে হচ্ছে আর বুক টা ভার হয়ে আসছে। তূবার চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছে এখন।
“মাম্মাম তুমি কাঁদছো কেন?”
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে হাতে একটা পুতুল নিয়ে ছোট পরীর মতো একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। লাল আভা যুক্ত ফোলা দুটি গাল। খাড়া নাক। কি সুন্দর ডাগরডাগর চোখ। পিঠ ছাড়িয়ে পড়া লম্বা চুল। নেভি কালারের একটা ছোট ফ্রগ গায়ে দেওয়া। চুল ঝুটি করা। সামনের ছোট ছোট কাটা চুল গুলি কপালে এসে পড়ে। দেখতে পুরো আহফিনের ডুবলিকেট মনে হয়। তূবা বুঝতে পারে না এটা কি আহফিন কে সবসময় কল্পনা করার কারণে হয়েছে নাকি সারাক্ষণ তার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা তে।
তাহফিবাকে দেখে তূবা চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
“না মামুনি একদম না।”
“এই যে পানি তোমার চোখে। তুমি কাঁদছিলে মাম্মাম?”
“বললাম তো তাহু মা না।”
“….
“তুমি চলো রেডি হয়ে নাও। স্কুলে যেতে হবে না?”
“আজ আমরা বসে গল্প করি মাম্মাম?”
“ফাঁকিবাজ মেয়ে তুমি স্কুলে যাও। স্কুল থেকে এসে গল্প হবে।”
“তুমিও তো আমাকে ফাঁকি দাও। বলো কাজ আছে কাজের কারণে আসতে পারো নি বলো না এসব?”
“ওরে আমার পাকাবুড়ি রে। ব্রেকফাস্ট হয়েছে তো?”
“ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট।”
“মাই গুড গার্ল। রিমা রিমা কোথায় তুই? তাহু কে রেডি করিয়ে দে তাড়াতাড়ি। আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।”
“আসতেছি আপা।”
রিমা এসে তাহফিবা কে নিয়ে গেল। এখানে আসার পর রিমা তার সঙ্গী হয়। রিমা যখন তাকে আপা বলে ডাকে। মনে হয় তুসি ডাকছে।
তাহফিবা কে স্কুলে দিয়ে তূবা নিজের অফিসে চলে যায়। নিজের বুটিকশপে এখন অসহায় ৩০০ জনের উপরে মেয়ে কাজ করে। তার স্বপ্ন একদিন নিজের প্রতিষ্ঠান সবার মুখে উঠবে। তূবা নিজের কথার দ্বারা অনুপ্রেরণা জুগায় ভেঙ্গে পড়া মেয়ে গুলি কে। যাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো কেউ নেই তাদের সে নিজের পরিশ্রমে খেটে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়।
—-
আহফিন ফ্রেশ হয়ে ব্যালকুনিতে এলো। চারিদিকে চা বাগান। তার থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুভাস। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। এতগুলি বছরে আহফিন যেন নিশ্বাস নেওয়ার মতো একটু শক্তি পাচ্ছে। ভেতর থেকে সতেজ ভাব টা যেন ফিরে আসছে। পরিবেশের মুগ্ধতায় আহফিনের মুখ থেকে অল্প হাসি দেখা গেল।
“স্যার আপনার চা।”
মিজানের কথাতে আহফিন পিছন ফিরল। মিজান অবাক হয়ে আহফিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি হলো চা টা দিবে না দাঁড়িয়ে থাকবে?”
মিজান এবার আরো অবাক হলো।
“স্যার আপনি হাসছেন আবার এত সুন্দর করে কথাও বলছেন।”
“মিজান চা টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“ও সরি স্যার।” বলে দৌড়ে এসে চায়ের মগ টা আহফিনের দিকে এগিয়ে দিল। আহফিন মগে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মিজান বলে উঠল
“স্যার আপনাকে না আজ ২৭/২৮ বছরের যুবক লাগছে।”
“হোয়াট দ্যা ননসেন্স। আমি কি বৃদ্ধ হয়ে গেছি নাকি?”
“আরে না স্যার সেটা বলছি না। আপনি এত মন মরা হয়ে থাকেন যে আপনার চেহারা জৌলুশ খুঁজেই পাওয়া যায় না।”
“মিজান তুমি ফালতু কথা রেখে নিজের রুমে যাও তো।”
“স্যার আপনার সাথে আর একটু কথা বলি না? বেশ তো লাগছে!”
এক গাল হেসে মিজান তার দিকে তাকাতেই দেখল তীক্ষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে আহফিন। মিজান চায়ের মগ নিয়ে “আজ যতটুক বলেছে তাতেই এনাফ। বেশি বলে ফেললে মুখ দিয়ে না আগুন ঝরবে” বলে বিড়বিড় করে মিজান চলে গেল। আহফিন দরজার দিকে তাকিয়ে আবার প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিল। তূবা ছেড়ে যাওয়ার পর তার দিন গুলি সহজ যায় নি। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে। দিনের পর দিন না খেয়ে আহফিনের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ম্যানেজার তখন তার জন্যে লোক রাখে। সাথে মিজান কে ড্রাইভার বানায়। মিজান ছেলেটা তার সাথে আছে আজ চার বছর। ছেলেটা সবসময় তার সাথে কথা বলতে চায় তাকে হাসাতে চায়। মাঝে মাঝে করা মিজানের কান্ড গুলি মনে হতেই আহফিন মৃদু আঁচে হেসে উঠল।
চলবে♥
(আগের গল্প টা আমি ডিলিট করে দিয়েছি। খুব শীর্ঘ নতুন গল্প দিব ইহান ভাই কে নিয়ে। গল্প ডিলিট করার কারণ জানতে চাইবেন না। ওটা অনেক বড়। আর কিছুদিন পর এমন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি তাতে সামলে উঠতে পারব না। দোয়া করবেন সেই ঝামেলাতে গেলেও হয়তো নিয়মিত গল্প দিতে পারব☺️)