#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_২৯
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আয়না চুপচাপ ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসে আছে। ইয়াসিন ধীর পায়ে আয়নার পাশে বসলো। আয়না ইয়াসিনকে সালাম করলো। ইয়াসিন আয়নার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে পুরে নিল। শান্ত কন্ঠে বলল – এখনও ভয় পাও আমাকে?
আয়না দুই দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালো। ইয়াসিন আয়নার গাল দুটো ধরে আলতোভাবে কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিল। কেঁপে উঠলো আয়না। লজ্জায় ইয়াসিনের বুকে মুখ লুকালো।
_________________________
বাসর ঘরে নীরব দর্শকের মতো বসে আছে কাজল আর শাহরিয়ার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তার নাকি আজ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কাজল শুধু দাঁতে দাঁত চেপে শাহরিয়ারের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। শাহরিয়ার ফ্রেশ হয়ে কাজলকে শুতে বলে নিজেও চুপচাপ শুয়ে পড়ল। ৫ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে কাজল ভ্রু কুঁচকে শাহরিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শাহরিয়ার চোখ বন্ধ করে আছে, ব্যাটা কি ঘুমিয়ে পড়লো? হয়তো। নাহ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কাজল উঠে শাহরিয়ারের পে*টে*র উপরে বসে ওর গলা চেপে ধরলো।
– কি করছো? বাসর রাতে স্বামীকে মেরে বিধবা হওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?
কাজল দাঁতে দাঁত চেপে বলল – এমন নিরামীষ স্বামী রাখার চেয়ে তাই ভালো।
– আমি আবার কি করলাম?
– বাসর রাতে বউকে আদর না করে আপনি ঘুমাচ্ছেন কেন?
শাহরিয়ার কাজলের এক হাত ধরে টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো। দুষ্ট হাসি হেসে বলল – বউয়ের আমার আদর লাগবে বললেই হতো।
কাজল লজ্জায় শাহরিয়ার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
_____________________________
ধরনীর বুকে সকাল নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। আকাশের কোনে সূর্য উঁকি দিয়েছে, আর তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির কলধ্বনি। কারো গভীর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নিজের গলায় অনুভব করে পিটপিট করে চোখ খুলল নিশা। চোখ খুলে সামনের মানুষটার মুখ দর্শনে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল তার। আবসার উ*দ*ম গায়ে নিশাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কালকে রাতের কথা মনে পড়তে লজ্জাও লাগছে বেশ। আলতো হাতে ছুয়ে দিল আবসারের বক্ষ। যেখানে অজস্র খামচির আর কামড়ের দাগ, নিজের নখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল নিশা। মাথাটা একটু এগিয়ে আবসারের বুকে আলতোভাবে একটা চু*মু খেয়ে উঠে বসলো। গোসলটা সেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিল। হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পড়তেই চিৎকার করে উঠল নিশা।
নিশার চিৎকার শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসলো আবসার। পাশে তাকিয়ে দেখে বিছানায় নিশা নেই। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিশা মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে। আবসার দ্রুত গিয়ে নিশার কাছে বসলো। অস্থির হয়ে ওর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল – কি হয়েছে বউ? কাঁদছো কেন?
নিশা কেঁদেই যাচ্ছে কোনো উত্তর দিচ্ছে না। আবসার আরও অস্থির হয়ে উঠছে।
ব্যাগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল – কি হয়েছে বলবে তো? বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমার? কাল রাতের জন্য খারাপ লাগছে তোমার? স্যরি বউ, কিছু তো বলো।
আবসার নিশার মুখ থেকে হাত টেনে সরানোর চেষ্টা করছে, নিশা আরও শক্ত করে নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। নাক টেনে টেনে বলল – আমার মুখ দেখাবো না তাহলে আপনি আর আমায় ভালোবাসবেন না।
আবসার চমকালো, মুখ দেখার সাথে ভালোবাসার কি সম্পর্ক। আর এই মেয়েই বা এমন কেন করছে? নাহ এর কি হয়েছে আগে সেটা জানতে হবে। আবসার জোর করে নিশার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিল, নিশা আরও জোরে কেঁদে উঠলো। নিশার সম্পূর্ণ মুখ ছোট ছোট লাল ছোপ ছোপ দাগে ভরে গেছে। এলার্জি জনিত সমস্যা মনে হয়। আবসার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এর জন্য এই মেয়ে এত কান্নাকাটি করছে?
শান্ত কন্ঠে আবসার জিজ্ঞেস করলো – এগুলো কি করে হলো?
নাক টেনে টেনে নিশা বলল – কাল ভারী মেকআপ করেছিলাম তাই। আমি অতিরিক্ত ভারী মেকাআপ করতে পারি না ত্বকে সমস্যা হয়।
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবসারের। তরতর করে মাথায় রাগ উঠে গেল। এই মেয়ের নিজের দিকে কি কোনো খেয়াল নেই? সে কি জানতো না এভাবে মেকআপ করলে তার সমস্যা হবে তারপরও সে কেন সংয়ের মতো সেজেছিল। ধমকে উঠলো আবসার।
– কে বলেছে তোমাকে ভারী মেকআপ করতে? আমি আগেই বলেছি যেগুলোতে তোমার সমস্যা হয় সেগুলো করবে না। তারপর কেন করেছো ভারী মেকআপ?
ডুকরে কেঁদে উঠলো নিশা। নাক টেনে বলল – আপনি এখান আর আমার ভালোবাসবেন না তাই না?
নরম হলো আবসার, বুকে জড়িয়ে নিল নিশাকে। শান্ত কন্ঠে বলল – ভালোবাসা কি মুখ দেখে হয় বসন্ত কন্যা? যদি তাই হতো তবে তো ফয়সালকে ছেড়ে তোমার আমাকে ভালোবাসার কথা ছিল না। ফয়সাল আমার থেকে অনেক বেশি সুদর্শন। তুমি তাকে উপেক্ষা করে আমাকে ভালোবাসেছো। ভালোবাসা হয় মন থেকে কারো সৌন্দর্য দেখে নয়। সৌন্দর্য দেখে যেটা হয় সেটা হয় মোহ যা দুদিন পরে কেটে যায়। আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার চেহারাকে নয়, আর সারাজীবন ভালোবাসবো তাতে তোমার পুরো মুখটা যদি পুড়ে যায় তবুও। আমার ভালোবাসা এতটাও ঠুনকো নয় বসন্ত কন্যা , বিশ্বাস রাখতে পারো।
কান্না থেমে গেছে নিশার, অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবসারের দিকে। আবসার এবার আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো- আমার বউকে এই অবস্থায় কতটা রূপসী লাগছে জানো তুমি? শ্যামলা মুখ খানায় ছোট লাল লাল ছোপ ছোপ দাগগুলো অন্যরকম সৌন্দর্য বহন করছে আমার বউয়ের মুখে। আমার তো ইচ্ছে করছে বউটাকে এখনই খেয়ে ফেলি। কিন্তু খেয়ে ফেললে আবার বউ কই পাবো আমি। দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র মুরগীর বাচ্চার মতো কিউট বউ।
নিশা ফ্যাল ফ্যাল করে আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে। এজন্যই হয়তো বলে ভালোবাসা অন্ধ হয়। ভালোবাসলে তার প্রিয় মানুষটার সব কিছুতেই সৌন্দর্য খুঁজে পায়। এই যেমন আবসার পাচ্ছে নিশার গালের লাল দাগগুলো দেখে। যে তোমায় ভালোবাসবে সে তোমায় পৃথিবীর সব নিয়ম ভেঙেই ভালোবাসবে। তোমার গালে তীব্র ব্রনের দাগ যেগুলো অন্য কারো কাছে ঘৃনার কারন হলেও, সেগুলোর মধ্যেই তোমার ভালোবাসার মানুষটা সৌন্দর্য খুঁজে নিবে। আর যে তোমায় ভালোবাসবে না সে তুমি যদি বিশ্ব সুন্দরীও হও তবুও ভালোবাসবে না।
সকাল থেকে রুমের বাইরে বের হয়নি নিশা। আবিদা বেগম, রেবেকা বানু, মিষ্টি, আয়ান , আনসার সাহেব সবাই রুমে এসে ওকে দেখে গেছে। বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষ। এই মুখে নিচে সবার সামনে যেতে অসস্থি লাগছে নিশার তাই আবসারও আর জোর করেনি। ডাক্তার এসেও দেখে গেছে ,ঔষধ দিয়ে গেছে। আবসারও সারাক্ষন নিশার পাশেই বসে আছে। একের পর একজন আসছে নিশাকে দেখতে, বউয়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না সে। বউয়ের পাশে যে বসে থাকতে পারছে এই তো ঢের। সর্বশেষ আনসার সাহেব রুম থেকে বেরুতেই আবসার উঠে দ্রুত রুমের দরজাটা এটে দিল।
নিশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো – একি দরজা আটকালেন কেন?
আবসার ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো – সকাল থেকে বউ আমায় পাত্তা দিচ্ছে না, বউয়ের পাত্তা তো পেতে হবে নাকি?
নিশা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো – মানে?
আবসার নিশার পাশে বসলো , একটু সময় নিশার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ঠোঁটে দুটো নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিল। আকর্ষিক আক্রমণে হকচকিয়ে গেল নিশা, খামচে ধরলো আবসারের বাহু।
মিনিট পাঁচেক পর ছেড়ে দিয়ে বলল – তুমি বড্ড নিষ্ঠুর বউ , সকাল থেকে যে তোমার বরটা উপস করে বসে আছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তোমার।
নিশা গোল গোল চোখে আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে। আবসার যেন কাল থেকে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এমন গম্ভীর পু্রুষ যে এতটা রোমান্টিক হবে ভাবনার বাহিরে ছিল নিশার। আবসারের বুকে মাথা এলিয়ে দিল নিশা। আবসারও পরম যত্মে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল নিশাকে, চুলের মধ্যে একটা চু*মু খেয়ে বলল – ভালোবাসি বউ।
নিশা দুই হাত বাড়িয়ে আবসারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল – আমিও ভালোবাসি ক্যাপ্টেন সাহেব।
___________________________
কেটে গেল চারটা দিন। আজ নিশাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শ্বশুর বাড়ি এসেছে আবসার। আগেই আসতো কিন্তু নিশার অসুস্থতার জন্য আসতে পারেনি। এসে থেকেই নিশা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের বাড়ির মানুষের সাথে, আবসারের দিকে কোনো খেয়াল নেই তার। আশেপাশের বাসার ছেলে মেয়েরা নিশার বরকে দেখতে আসছে। সবার মধ্যে অসস্থি হলেও কিছু বলতে পারছে না আবসার। নিশার মা আবসারের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে মেয়ে জামাইর ভীষণ অসস্থি লাগছে। সে হাক ছেড়ে নিশাকে ডাকলো বললো আবসারকে নিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য।
নিশা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। এখানে এসে তো আবসারের কথা একদম ভুলেই গিয়েছিল। মানুষটা নিশ্চই ওকে খুঁজেছে, হয়তো রেগেও আছে। আবার ধমক টমক দিবে না তো, দিলে দিক তাহলে ও তার উপর দুই তিনটা ধমক দিয়ে দিবে। এখন সে ক্যাপ্টেন সাহেবের বউ ।
নিশা আবসারকে নিয়ে ওর রুমে বসিয়ে দিল। আবসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুমটা পর্যবেক্ষণ করে দেখছে। খুব সাদামাটা রুমটা। একটা খাট, একটা আলমারি, একটা পরার টেবিলে আর একটা ড্রেসিং টেবিল দিয়ে সাজানো রুমটা। নিশা কোথা থেকে একটা হাত পাখা এনে আবসারকে বাতাস করা শুরু করলো। আবসার ভ্রু কুঁচকে নিশার দিকে তাকাতেই নিশা বলল – কারেন্ট নেই। বাইরে গরম পড়েছে খুব।
আবসার মুচকি হাসি দিয়ে নিশার হাত থেকে পাখাটা নিয়ে নিল আর বলল – এর থেকে বেশি গরমে থাকার অভ্যাস আছে আমার। তোমার গরম লাগলে বলো আমি ঠান্ডা করে দিচ্ছি।
নিশা লজ্জায় মিইয়ে গেল। এই লোকটা সারাক্ষণ শুধু লজ্জা দেয়। নিশা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরলো। লোকটা কেমন অসভ্য মার্কা হাসি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩০
#লেখিকা : Smiling
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সময় বহমান, সে কারো জন্য বসে থাকে না আপন গতিতে চলে। এ কয়টা দিন স্বপ্নের মতো কেটেছিল আবসার আর নিশার কিন্তু বিদায়ের ঘন্টা যে বেজে গেছে। আবসারের ছুটি শেষ। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরবে সে। নিশা মন খারাপ করে বসে আছে। আবসারের মনটাও যে খুব ভালো তা কিন্তু নয় বউকে ছেড়ে যেতে হবে আবার কবে ছুটি পাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কিন্তু তার উপরের গম্ভীরতা দেখে ভিতরের মন খারাপটা বোঝার জো নেই।
রাত ৮ টা বেজে গেছে। নিশা সেই যে ওয়াশ রুমে ঢুকেছে বের হওয়ার আর নাম নেই। বিদায়ের সময় প্রিয়তমার মুখটা না দেখে, তার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না আবসারের । বারবার ভ্রু কুঁচকে হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আবার ওয়াশ রুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে নাহ ওয়াশ রুমের দরজা খোলার নাম নিচ্ছে না। ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে, তবে কি যাওয়ার সময় একটা বার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখটা দেখতে পারবে না সে, পারবে না নিজের বক্ষপিঞ্জরে একটা বার জড়িয়ে নিতে, পারবে না পরম ভালোবাসায় তার ললাটে একটা গভীর চুম্বন করতে? মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, হাতের ব্যাগটা নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলেই ওয়াশ রুমের দরজাটা খট করে খোলার আওয়াজ হলো। হাসি ফুটে উঠল আবসারের ঠোঁটে, অধৈর্য হয়ে ওয়াশ রুমের দরজার দিকে তাকাতেই থ হয়ে গেল আবসর। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় শীতল রক্তস্রোত বয়ে চলেছে, কেঁপে উঠছে কন্ঠনালী। গলা শুকিয়ে আসছে। বারবার মনে হচ্ছে “এই মেয়ে নির্ঘাত আমার চাকরিটা খেয়ে ছাড়বে ।”
ওয়াশ রুমের দরজায় সেই লাল রঙা রেবেকা বানুর না’ই’টিটা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশা, ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক, চুলগুলো খোলা। জানালা থেকে আসা বাইরের মৃদু বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে নিশার চুলগুলোকে। গলায় , মুখে ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুর বিন্দুর মতো পানির ফোঁটা আরও মোহনীয় করে তুলছে নিশাকে। নিশার শ’রী’রে’র অধিকাংশ ভাজই দৃশ্যমান এই পাতলা না’ই’টি’তে । ঢোক গিলল আবসার। কল লাগালো কাউকে।
– আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। হ্যা আবসার কি বলবে বলো।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালো আবসার, বলল – আসলে স্যার ছুটিতে এসেছিলাম , বিয়ে করেছি এখন ছুটি তো শেষ।
– হ্যা তা কবে ফিরছো? আর তোমার কন্ঠ এমন কাঁপছে কেন?
– ম্যালেরিয়া।
– মানে?
– আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে স্যার। আর কিছুদিন ছুটি লাগতো।
– কি ? ম্যালেরিয়া বাধালে কিভাবে তুমি?
– নারায়নগইঞ্জা মশার কামড়ে।
– নারায়ণগঞ্জের মশা আবার তোমাকে পেলে কিভাবে?
– আসলে আমার শ্বশুর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। বিয়ের পর বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। আর নারায়ণগঞ্জ কি যে মশার উপদ্রব কি বলবো স্যার। এত মশার ভীরে কখন যে ম্যালেরিয়া বাহীত মশা কুটুস করে আমাকে কামড় দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না। আর এখন আমি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত।
– আচ্ছা সমস্যা নেই তুমি আরও কিছুদিন ছুটি নেও, সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসো।
– আচ্ছা স্যার, ধন্যবাদ। এখন তাহলে রাখছি। আসসালামুয়ালাইকুম
নিশা এতক্ষন অবাক হয়ে আবসারকে দেখছিল। আবসারকে আজ নতুন ভাবে আবিষ্কার করে সে। আবসার যে এভাবে গুছিয়ে বানোয়াট কাহিনী বানাতে পারে জানা ছিল না নিশার। নিশা ঘুরে ঘুরে আবসারকে দেখছে। আবসার এক টানে নিশাকে নিজের কোলে বসিয়ে দিল, ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল – এ কি রূপ দেখাইলা বউ, আমি যে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
– আপনি এখনও এখানে কেন ক্যাপ্টেন সাহেব , আপনার ট্রেন যে মিস হয়ে যাবে।
– মশকরা করছো আমার সাথে?
– বালাই সাট আপনার সাথে মশকরা করার মতো সাহস আছে নাকি আমার, গরদান যাবে যে।
– বাহ ভালোই কথা বলতে শিখেছো, সাথে আমাকে পাগল করার দুষ্ট দুষ্ট বুদ্ধিও তৈরি করে শিখেছো।
নিশা লজ্জায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে। সত্যিই আজ বড় সাহসের কাজ করে ফেলেছে ও। তবে এই বুদ্ধি কিন্তু ওর মাথা থেকে বের হয়নি। এই বুদ্ধিদাতা হলেন মহান রেবেকা বানুর। ঐ বুড়ির মাথায় যে কিভাবে এত দুষ্ট দুষ্ট বুদ্ধি আসে কে জানে। প্রথম প্রথম কাজটা করতে একটু লজ্জা লাগলেও শেষে লাজ লজ্জা ভুলে আবসারকে আটকানোর এই পথই বেছে নিল নিশা।
বিছানায় শুইয়ে নিশার গলায় মুখ গুজলো , পরম আবেশে আবসারের চুলগুলো দুই হাতে খামচে ধরেছে নিশা। ভালোবাসার সাগরে ডুবে যাচ্ছে নিশা আর আবসার।
____________________________
দিন যায় , রাত যায়। কেটে গেল আরও একটি সপ্তাহ, এবার যে আবসারকে ফিরতে হবে। আগের বার মিথ্যা বলে ছুটি বাড়িয়েছিল। এবার যে আর তাও পারা যাবে না। কেঁদে কেটে নাক মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে নিশা। এই মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালেই আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না আবসারের। কিন্তু করার কিছু নেই, যেতে যে হবেই। আবসারের সাথে স্টেশন পর্যন্ত এসেছে সে। আবসার অনেক বার বারন করেলেও শোনেনি নিশা। অবশ্য আয়ানও এসেছে ওদের সাথে। ট্রেন ছেড়ে যখন চলে যাচ্ছিল নিশার চোখ টলমল, আবসারের মনে হচ্ছিল ওর কলিজাটা ছিঁড়ে এখানেই রেখে যাচ্ছে। ট্রেনটা একটু দূরে যেতেই ফুঁপিয়ে উঠলো নিশা। নিজেকে কোনো মতে সামলে আয়ানের সাথে বাসায় ফিরলো।
বাসায় ফিরে কতক্ষন রেবেকা বানুর রুমে, কতক্ষন আবিদা বেগমের সাথে ঘুরছে নিশা, নিজের রুমে এখনও ঢোকেনি। ঐ রুমটা যে বড্ড খালি খালি লাগে ওর কাছে। রুমটার চারদিকে আবসারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কান্না পায় খুব। আবার কবে দেখা হবে প্রিয় মানুষটার সাথে? আবার কবে তাকে জড়িয়ে নিতে পারবে নিজের সাথে? হাতের ফোনটা বেজে চলেছে নিশার সে দিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সে আনমনেই আবসারের কথা ভাবছে। কিছুক্ষণ বাদে রেবেকা বানুর কথায় হুঁশ ফিরলো নিশার।
– কি রে ছেমড়ি হুঁশ কোন দিগে তোর মোবাইল বাজে।
হকচকিয়ে উঠলো নিশা। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়েই দেখে আবসার কল করেছে। তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করতে গিয়ে দিল কলটা কেটে। চমকে উঠলো সে , যাহ বাবা কলটা রিসিভ করতে গিয়ে কেটেই দিলো। আবসার নিশ্চই খুব রাগ করবে । নিশার ভাবনার মধ্যেই মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এবার নিজেকে বেশ শান্ত রেখেই কলটা রিসিভ করলো। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে অস্থির কন্ঠে আবসার বলে উঠলো – রাগ করেছো বউ? কথা বলবে না আমার সাথে?
– আমি রাগ করিনি, কেন রাগ করবো?
– তাহলে কেন কেটে দিলে?
নিশা আমতা আমতা করে বলল – তড়িঘরি করে কল রিসিভ করতে গিয়ে কেটে গেছে।
সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো আবসার। শান্ত কন্ঠে বলল – মন খারাপ বসন্ত কন্যা?
– উঁহু
– মিথ্যে কেন বলছো? আমি স্পষ্ট দেখছি তোমার মন খারাপ।
– যখন দেখেছেনই জিজ্ঞেস করছেন কেন?
– এভাবে কথা বলছো কেন বউ?
ডুকরে কেঁদে উঠলো নিশা। নাক টেনে টেনে বলল – কথা বলবেন না আপনি। বড্ড নিষ্ঠুর আপনি ক্যাপ্টেন সাহেব। আমাকে একা রেখে চলে গেছেন।
– একা কোথায়? মা, বাবা , দাদী , আয়ান, মিষ্টি সবাই তো আছে।
– কিন্তু আপনি তো নেই আমার কাছে ক্যাপ্টেন সাহেব। আপনি যে আমার কাছ থেকে বহুদূরে চলে গেছেন। চাইলেই আপনাকে আর আমি দেখতে পারবো না। পারবো না এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবসার, এ ছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই তার। তার মনটাও যে বড্ড কাঁদছে। বুকের ভিতরটা হু হু করছে। তারও যে তার বসন্ত কন্যাকে ফেলে আসতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে।
– এভাবে কেঁদো না বউ। আমি যে শান্তি পাচ্ছি না, তোমার ঐ কান্নার শব্দ আমার বুকে তীব্র দহনের সৃষ্টি করছে। কষ্ট হচ্ছে আমার।
থেমে গেল নিশা। যাই হোক এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে পারবে না সে। তার কষ্ট হচ্ছে শুনেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে নিশার। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে বলল – এই দেখুন আমি আর কাঁদছি না। আপনি একটুও কষ্ট পাবেন না। আপনার কষ্ট যে আমার সইবে না ক্যাপ্টেন সাহেব।
হাজার কষ্টের মধ্যেও প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল আবসারের মুখে।
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩১
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সময় বয়ে চলেছে আপন গতিতে। দিন পেড়িয়েছে, রাত পেড়িয়েছে পবিত্র রমজান মাসেরও শেষের দিকে এখন। দীর্ঘ একমাস রমজানের পরে দেখা মিলে মুসলিমদের প্রিয় উৎসব ঈদের। সকল কর্মজীবীরা নিজেদের কর্মস্থান ছেড়ে পাড়ি জমায় নিজের অস্তিত্বের ঠিকানায়। সারা বছর যে যেখানেই থাকুক এই দিনটি সবাই প্রিয় মানুষদের সাথে কাটানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে, আর প্রিয় মানুষরাও অপেক্ষায় থাকে তাদের। তবে সবার ভাগ্যে এমন সুখ লেখা থাকে না, বিশেষ করে আর্মিতে যারা যুক্ত আছে। আবসারও এই ঈদে বাড়িতে আসতে পারবে না। নিশার মনটা বড্ড আনচান করছে। কতদিন হয়েছে মানুষটার দেখা মেলেনি আর এখন এমন একটা শুভ দিনেও দেখা মিলবে না। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে আবসারের কাছে। শেষে লাজ লজ্জা ভুলে বাড়ির সবাইকে বলেই ফেলল ঈদে সে আবসারের ওখানে যেতে যায়।
ঈদের আগের দিন নিশা আর কাজল দুজন মিলে রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। শাহরিয়ারও আসবে না তাই কাজলও ওর সাথেই যাচ্ছে। আনসার সাহেবও ওদের সাথে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু সারাদিন রোজা রেখে ঈদের আগের দিন সেই চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে ওদের পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসবে তাই তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে এসেছে। ট্রেনে উঠেই ফোন বন্ধ করে ফেলেছে দুই বান্ধবী ওখানে গিয়ে ওদের সারপ্রাইজ দিবে।
ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল। কিন্তু সমস্যা হয়েছে সেখানে ঢুকতে গিয়ে। নিশা আর কাজলকে গার্ডরা কিছুতেই সেখানে ঢুকতে দিবে না। তাদের এক কথা যার সাথে দেখা করতে এসেছেন তাকে কল করুন। কলও করতে পারছে না, নেটওয়ার্ক কানেকশন খুবই দূর্বল। নিশা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে অবস্থান করলেও আবসার ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে তাই তার ফোনে কল ঢুকছে না। আর গার্ডরা আবসারের নাম শুনে তো আরও ভিতরে ঢুকতে দিতে চাইছে না। পুরো ক্যান্টনমেন্টের সবাই আবসারকে জমের মতো ভয় পায়। আর তারা চাকরির বয়সে কখনও কোনো মেয়েকে আবসারের সাথে দেখা করতে আসতে দেখেনি, এই প্রথম। এই মেয়েকে যদি ভিতরে ঢুকতে দেয় আর ভিতরে গিয়ে কোনো গন্ডগোল করে তাহলে নির্ঘাত আবসার ওদের গর্দান নিবে। কাজল তো রীতিমত ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে।
এদের এই ঝামেলা দেখে একজন দৌড়ে আবসারের নিকট গেল। আবসার বসে বসে কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। চোখে মুখে গম্ভীরতা স্পষ্ট। ঢোক গিলে ব্যক্তিটি আবসারকে বলল – স্যার আপনার সাথে একজন মেয়ে দেখা করতে এসেছে।
মেয়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো আবসারের। এমনি সকাল থেকে নিশার ফোন বন্ধ থাকায় টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। তার উপর এই উটকো ঝামেলাটা আবার কে? আবসার আর চিন্তা ভাবনা না বাড়িয়ে উঠে হাঁটা ধরলো। গেটের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। চোখ দুটো বন্ধ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সামনে তাকালো হ্যা তার বসন্ত কন্যাই তো, সে ভুল দেখছে না। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল আবসারের। কতদিন পর তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখটা দেখতে পেয়েছে সে। মনের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। এতদিন পর প্রেয়শীকে দেখে নিজেকে আটকানো দায় হয়ে পড়েছে আবসারের। স্থান, কাল, পাত্র দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিশাকে। অস্থির কন্ঠে বলল – কখন এসেছো? আমাকে জানাওনি কেন? আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম। মুখটা এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে তোমার? আর তোমার ফোন বন্ধ কেন? সকাল থেকে কতবার কল করেছি জানো, টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
নিশা লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। সবাই কেমন ড্যাব ড্যাব করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত সবাই হতবম্ব, তাঁরা এই প্রথম আবসারকে এতটা অস্থির হতে দেখছে। এমন রাগচটা, গম্ভীর মানুষও যে এত বউ পাগল জানা ছিল না কারোরই।
এতক্ষনে শাহরিয়ারও চলে এসেছে। সে আর কাজল ঠোঁট টিপে হাসছে। কাজল একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল – আস্তে দুলাভাই এত প্রশ্ন একসাথে করলে বোন আমার কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবে?
হুঁশ ফিরল আবসারের, নিজের অবস্থান দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। নিশাকে ছেড়ে পাশে দাঁড়ালো। সবাইকে ডেকে হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দিল – সি ইজ মাই ওয়াইফ আর তোমাদের ভাবী।
_____________________________
ইফতারি করেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে নিশা। আবসার আগে থেকেই কোয়ার্টার নিয়ে থাকায় নিশার থাকা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কাজল আর শাহরিয়ারেরও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বিছানায় শুতেই সারা রাজ্যের ঘুম যেন নিশার চোখের উপর ভর করেছে। রোজা রেখে সারাদিন জার্নি করে বেশ ক্লান্ত সে। আবসার এসে দুইবার ডেকে গিয়েছে মেহেদী পড়ার জন্য। কিন্তু নিশার এক কথা সে এখন ঘুমাবে, কোনো মেহেদী পড়ার দরকার নেই তার।
নিশা এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। আবসার ইউটিউবের ভিডিও ডাউনলোড করে সেই ভিডিও দেখে দেখে নিশার হাতে মেহেদী দেওয়ার চেষ্টা করছে। টানা দুই ঘন্টা পর আবসার সফল। সে সফল হয়েছে তার বউয়ের হাতে মেহেদী দেওয়ায়। মেহেদীর টিউবটা পাশে রেখে নিশার হাত ধরে বসে আছে সে যাতে আবার লেপ্টে না যায়। মেহেদী শুকানোর পর খুব সাবধানে শুকনো মেহেদী হাত থেকে তুলে দিয়ে বিশ্ব জয়ের হাসি হাসলো আবসার। নিশার পাশে শুয়ে টেনে নিজের বুকের উপর উপর আনলো তাকে, কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে নিশাকে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।
__________________________
খুব ভোরে উঠে ঢুলু ঢুলু পায়ে ওয়াশ রুমে গেল নিশা। চোখ থেকে ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি কিন্তু ঈদের দিন বলে কথা আর ঘুমানো যাবে না। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতেই হাতের দিকে নজর পড়লো তার, হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। মেহেদির ডিজাইনের মধ্যে সুক্ষ্ম করে লেখা ” A + N ” । ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকে দেখে আবসার উঠে বসে আছে। নিশা আবসারের দিকে তাকিয়ে বলল – উঠে গেছেন? ফ্রেশ হয়ে আসুন তাড়াতাড়ি ফজরের নামাজের সময় চলে যাচ্ছে।
আবসার নিশার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল – আমি তো কাল রাতে কিছু করিনি বউ তাহলে সকাল সকাল উঠে গোসল করলে কেন?
নিশার ভ্রু কুঁচকে এলো, বলল – সব সময় শুধু আজে বাজে চিন্তা। আজ ঈদ ভুলে গেছেন?
আবসার নিশার হাত ধরে টেনে কোলের উপর বসিয়ে দিয়ে নিশার ভেজা চুলে মুখ গুজে দিল।
– আজ একটা জিনিস চাইবো , দিবে বউ?
– আপনি কিছু চাইবেন আর আমি দেবো না, আপনি চাইলে আমার জানটাও যে হাজির।
– মেরে ফেলতে চাইতো আমাকে?
– মানে?
– তোমার জানটা নিয়ে নিলে আমার নিজের জানাটাও যে চলে যাবে।
– বাজে কথা রেখে বলুন কি চাই আপনার?
– আল্লাহ রাস্তে তোমার এই আপনি আপনি করা রাখো, তুমি করে বলো। তোমার মুখে আপনি শুনতে শুনতে কান পচে গেছে আমার।
– আচ্ছা চেষ্টা করবো ।
– চেষ্টা না এখনই বলো।
– আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন।
– না আগে তুমি করে বলো তাঁরপর যাবো।
নিশা আমতা আমতা করে বলল – যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
আবসার মুচকি হাসি দিয়ে সশব্দে নিশার গালে একটা চু’মু দিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
___________________________
ঈদের নামাজ পড়তে গেছে। রান্নার পাঠ চুকিয়ে বসে আছে নিশা আবসার বের হওয়ার আগে বারবার বলে গেছে নিশাকে শুধু শাড়িটা পড়ে থাকতে আবসার নাকি আজ নিজের হাতে নিশাকে সাজাবে। বাড়িতে ফোন দিয়ে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় সেড়ে ফেলেছে কিন্তু আবসারের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নিবে? যেমন ভাবনা তেমন কাজ বিছানায় শুয়ে পড়েছে নিশা কিন্তু ঘুম আর হলো না। এসে পড়েছে আবসার, নীল একটা পাঞ্জাবি পড়নে , নিশার জন্যও কিনেছে একটা নীল জামদানি নিজের পাঞ্জাবির সাথেই মিলিয়ে। আবসারকে দেখেই নিশা উঠে বসলো। আবসার এগিয়ে এসে নিশার ঠোঁট চট করে একটা চু’মু বসিয়ে দিল, হকচকিয়ে উঠলো নিশা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে আবসারের দিকে। আবসার অসহায় মুখ করে বলল – তুমি তো আর দিবে না তাই আমার পাওনাটা আমিই নিয়ে নিলাম।
যাও শাড়িটা পড়ে এসো।
– আপনি রুম থেকে বের হন আমি শাড়ি পড়বো।
আবসার অবাক হয়ে বলল – তাতে আমাকে বের হতে হবে কেন?
– ওয়াশ রুমে অল্প জায়গায় শাড়ি পড়া যাবে না এখানে পড়তে হবে।
– তো?
– তো মানে?
আবসার একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল – একবার না দুইবার না হাজারবার তোমার সবকিছু দেখা আমার শেষ আর সেখানে তুমি আমার সামনে সামান্য একটা শাড়ি পড়তে লজ্জা পাচ্ছো বউ। তোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে আমার স্পর্শ আছে?
নিশা আমতা আমতা করছে। আবসার আঁটসাঁট বেঁধে খাটের উপর বসলো, বলল – শাড়িতো তোমাকে আজ আমার সামনেই পড়তে হবে, কোথাও যাচ্ছি না আমি।
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩২
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
দেখতে দেখতে কেটে গেল তিনটি মাস। নিশা এই তিন মাস আবসারের কাছেই ছিল। ছুটিতে নিশাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে আবসার , উদ্দেশ্য নিশার কলেজ থেকে কিছু কাগজ তোলা ওকে চট্টগ্রাম ট্রান্সফার করে নিবে। নিশা অনেক চেষ্টা করছে ওকে কলেজে না আনার কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবসার এসেছেই এসেছে। হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্টের রুমে বসে আছে আবসার আর নিশা। পাশে ইয়াসিনও আছে। হঠাৎ স্যার মুখ খুলে যা বললেন তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না নিশা। বলেছে না যেন ওর মাথায় বোমা ফাটিয়েছে। এসেছে ট্রান্সফার হওয়ার জন্য কাগজ নিতে সেখানে আবার এসব বলার কি দরকার? হঠাৎ স্যার বলল – তা মিস্টার আবসার তাহমিদ, আপনার ওয়াইফ তো গত ইনকোর্স পরীক্ষায় ৩ সাবজেক্টে ফেল করেছে।
আবসার গোল গোল চোখে নিশার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশা লজ্জায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে। হারয়ে বেচারা মান সম্মান, এই ভাবে মাটির সাথে মিশে গেল। ফেল করার কথাটা এই ভাবে কেন আবসারের সামনেই বলতে হবে ? নিশার অসস্থি লাগছে।
হনহন করে বাড়িতে ঢুকে গেল আবসার, তার পিছু পিছু চোরের মতো ঢুকছে নিশা। রাস্তায় একটা কথাও বলেনি নিশার সাথে, নিশাও সাহস করে কিছু বলতে পারেনি। এমনি ফেল করার মতো মহাপাপ করে ফেলেছে সে। বাড়িতে ঢুকেই আকাশ কাঁপানো এক ধমক ছাড়লো আবসার। কেঁপে উঠলো নিশা। আজ বুঝি ও শেষ। যে পরিমাণ রেগে আছে আবসার, আজ ওকে মনে হয় মেরেই ফেলবে।
– স্টপ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো আর এক পাও এগোবে না।
নিশা আর সাহস করে এগোলো না। চুপচাপ মুর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নড়াচড়া করলেই যেন প্রান যাবে তার। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলো আবিদা বেগম।
– বউমাকে ধমকাচ্ছিস কেন বাবা ও কি করেছে?
– কি করেনি বলো। তোমার আদরের বউমা পরীক্ষায় ফেল করেছে তাও এক সাবজেক্ট দুই সাবজেক্ট না তিন তিন সাবজেক্টে।
আবিদা বেগমও গোল গোল চোখে নিশার দিকে তাকিয়ে আছে। শেষে কিনা শ্বাশুড়ির সামনেও মান ইজ্জতের ফালুদা। ইস কেন যে ফেল করতে গেল। নিশা আমতা আমতা করে বলল – ফাইনাল পরীক্ষা না মা ইনকোর্স পরীক্ষা ছিল।
– এ আর এমন কি ব্যাপার ইনকোর্স পরীক্ষাই তো।
আবসার চোখ ছোট ছোট করে বলল – মা ও তিন সাবজেক্টে ফেল করেছে আর তুমি কিনা ওকে সাপোর্ট করছো?
আবিদা বেগম ভাবলেশহীন ভাবে বলল – এ আর এমন কি ব্যাপার ও তো তাও তিন সাবজেক্টে ফেল করেছে আর তোর বোন তো চার সাবজেক্ট ফেল করেছে।
– ইয়াসিন কিছু বলেনি ওকে?
– সে তোর বোনের সাথে পারে নাকি হাজার হোক তোরই তো বোন। যেমন তুই তেমন তোর বোন।
থতমত খেয়ে গেল আবসার। নিশা ঠোঁট টিপে হাসছে।
– এই তুমি হাসছো কেন? লজ্জা করেনা তোমার? পরীক্ষায় ফেল করে আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছো। এত নির্লজ্জ কেন তুমি? তোমার জায়গায় আমি হলে তো এতক্ষনে কচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দিতাম।
অমাবস্যার ঘন কালো অন্ধকার নেমে এলো নিশার মুখে। এভাবে ওকে বলতে পারলো আবসার? একটুও মায়া করলো না। কি করেছে ও যে ওকে নির্লজ্জ বলেছে, একটু ফেলই না হয় করেছে। তাও তো ওর জনই ফেল করেছে। এমন একটা স্বামী থাকতে স্বামী রেখে কি পড়াশোনায় মন বসে? সারাদিনই তো মন শুধু আবসার আবসার করে এখানে ওর দোষ কোথায়? ভীষণ অভিমান জমেছে আবসারের উপর। কথাই বলবে না তার সাথে। ওকে কিভাবে সে নির্লজ্জ বলতে পারলো?
_______________________________
রাত ১১ টা বেজে গেছে, এখনও বই নিয়ে বসে আছে নিশা। সেই সন্ধ্যায় পড়তে বসেছে এখন পর্যন্ত ওঠেনি। উঠবে না আজ আর ও। এখন থেকে ও সারাদিন রাত ২৪ ঘন্টা শুধু পড়বে। সামনের পরীক্ষায় ক্লাস টপার হয়ে দেখিয়ে দিবে। এর মধ্যে আবসার কয়েকবার এসে নিশার টেবিলের আশেপাশে ঘুরঘুর করে গেছে কিন্তু নিশা পাত্তা দেয়নি। খাবারও আজ রুমে নিয়ে এসে বই পড়তে পড়তে খেয়েছে।
রাত ১২ টা বেজে গেছে নিশার পড়ার টেবিল থেকে ওঠার কোনো নাম গন্ধ নেই। আবসার বারবার গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতি বোঝাচ্ছে কিন্তু নিশা পাত্তা দিচ্ছে না। আবসার পড়েছে মহা ঝামেলায় তার বউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। কি একটা ইনকোর্স পরীক্ষায় ফেল করার জন্য একটু বকেছে তাই বউ পাত্তা দিচ্ছে না। বউটা দিন দিন বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। এই এত বড় রাতে বউ ছাড়া থাকা সম্ভব, মোটেই না। কিন্তু বউ তো কাছেই আসছে না। আবসার উঠে গিয়ে চট করে নিশার ডান গালে একটা চু’মু খেল। না নিশার কোনো হেলদোল নেই। আবসার আবার চট করে নিশার বাম গালে একটা চু’মু খেল এবারও নিশার কোনো হেলদোল নেই শুধু মাত্র হাত দিয়ে গালটা মুছে নিল। এবার আবার নিশার নাকের ডগায় একটা কামড় বসিয়ে দিল, নাহ এবারও নিশার হেলদোল নেই শুধু একবার কটমট করে আবসারের দিকে তাকিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিল।
নাহ এভাবে আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না , আবসার দ্রুত নিশাকে কোলে তুলে নিল। নিশা দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে কোনো কথা বলছে না। আবসার নিশাকে বিছানায় শুইয়ে নিজেও তার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। নিশা আবসারের বাধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করছে কিন্তু হাজার হলেও একজন পুরুষ মানুষের শক্তি বলে কথা তার সঙ্গে কি আর পেরে ওঠা যায়।
– আমার সাথে কথা বলবে না বউ?
নিশা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে, কোনো কথা বলছে না। আবসার নিশার ঘড়ে আলতোভাবে কয়েকটা চু’মু খেল, কেঁপে উঠলো নিশা তবুও কথা বলছে না। এবার সজোরে একটা কামড় দিল নিশার ঘাড়ে। মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলো নিশা।
– কি শুরু করেছো কি ? কামড়াচ্ছো কেন?
– কি করবো বউ আমায় পাত্তা দিচ্ছে না, কথা বলছে না আমার সাথে।
– নির্লজ্জ মেয়েদের সাথে কথা বলার এত শখ কেন?
– নির্লজ্জ মেয়েদের সাথে কথা বলতেই তো মজা, এদের অল্প বললেও সম্পূর্ণ কথা বুঝে ফেলে আবার আদর করতেও সুবিধা হয়।
– একদম বাজে কথা বলবে না। দূরে থাকো আমার থেকে, একদম কাছে আসবে না।
– আসবো একশ বার আসবো কি করবে তুমি?
নিশা আবসারকে দুই হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। আবসার হেসে বলল – এমন পুঁটি মাছের শক্তি নিয়ে আমার মতো বোয়াল মাছের সাথে লাগতে?
– বোয়াল মাছ না ছাঁই বলে ভেংচি কাটলো নিশা।
আবসার নিশার নিচের ঠোঁটে একটা কামড় বসিয়ে বলল – আমি বোয়াল মাছ কিনা জানিনা না কিন্তু তুমি পুঁটি মাছ সে বিষয়ে শিওর। এখন বলো রাগ কমেছে?
– কিসের রাগ কোনো রাগ নেই আমার।
– তাহলে আদর করো আমায়।
– পারবো না।
– এর মানে রাগ কমেনি। কাছে এসো একটু আদর করে দেই বউ।
নিশা ভ্রু কুঁচকে বলল – আর কত কাছে যাবো এখন তোমার ভিতরে ঢুকে যাবো নাকি?
আবসার নিজের ডান হাত দিয়ে নিশার গলায় স্লাইড করতে করতে বলল – ইচ্ছে তো করছে তাই কিন্তু তার যে উপায় নেই বউ।
নিশার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে , না না এই মানুষের কাছে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না তাহলে রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। কিন্তু আবসারকে ঠেলে উঠিয়েও দিতে পারছে না। কি হাতির মতো শরীর।
আবসার বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলল – আর কতক্ষন রাগ করে থাকবে বউ, এবার কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে।
রাগটা কমে এলো নিশার। সে যে এই মানুষটার কষ্ট একদম সহ্য করতে পারে না। অভিমানী কন্ঠে বলল – তুমি আমাকে তখন নির্লজ্জ বললে কেন?
– বলেছি তো তোমার ভিতরে পড়াশোনার জন্য জিদ বাড়ানোর জন্য, তাই বলে তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবে?
– দেবোই তো, বলবো না কথা তোমার সাথে।
আবসার নিজের সম্পূর্ণ ভর নিশার উপর ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে কান ধরে বলল – স্যরি বউ, এই দেখো কান ধরেছি আর করবো না।
নিশা চিৎকার করে উঠল, বলল – মাফ চাইছো নাকি আমাকে মারার চেষ্টা করছে। মরে গেলাম গো, কোমড়টা গেল গো।
হকচকিয়ে উঠলো আবসার। কান ছেড়ে দ্রুত দুই হাত নিশার দুই দিকে দিয়ে ভর করে বলল – আস্তে কি শুরু করেছোকি? এত রাতে যেভাবে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছো লোকে তো অন্যকিছু মনে করবে। আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি বাঁধবে।
চুপ হয়ে গেল নিশা। মস্তিষ্ক যখন আবসারের কথার মানে জানান দিল লজ্জায় লাল হয়ে গেল নিশা। আবসার দুষ্ট হাসি হেসে বলল – এখন লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমার মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি বাধিয়ে এখন লজ্জা পাওয়া হচ্ছে।
– আপনি আসলে একটা লু’চু। সবসময় শুধু বাজে বাজে কথা।
– সে আমি জানি কিন্তু এখন কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার ভীষণ আদর আদর লাগছে। একটু আদর করে দেও না।
নিশা আবসারের বুকে ছোট্ট একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল – যাহ অসভ্য।
আবসার হো হো করে হেসে উঠলো।
____________________________
শীত নেমেছে ধরনীর বুকে। চারদিকে শীতল হাওয়া, কনকনে শীত। পথের ধারে পথচারী, গরীব মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এই শীতলতার মাঝেও দুজন ব্যক্তির হৃদয় বড় অস্থির হয়ে উঠছে। বিচ্ছেদের সুর তুলেছে তাদের হৃদয়। বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে কারো প্রিয়তমের। আবসার মিশনে যাচ্ছে দীর্ঘ এক বছরের জন্য। নিশার মনটা বড্ড ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ একটা বছর সে কিভাবে আবসারকে ছেড়ে থাকবে। আবসারও বড্ড অস্থির হয়ে উঠছে, মিশনে যাওয়াটা ক্যানসেল করার কয়েকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। ভাগ্য বুঝি এটাই চাইছে, দুজনকে ক্ষনিকের জন্য আলাদা করতে চাইছে। কিন্তু এই ক্ষনিকের সময়টাই বা কিভাবে তারা একে অপরকে ছেড়ে থাকবে। মিশনে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে কান্নাকাটি শুরু করেছে নিশা। প্রেয়শীর কান্না দেখে নিজেকে সংযত করা দায় হয়ে পড়েছে আবসারের। মনটা বড্ড কু গাইছে।
( আপনারা অনেকেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন আমার পেইজে সমস্যা হয়েছে সেই কারনে হয়তো গল্প দিতে পারবো না। আমার পেইজের সমস্যাগুলো হলো পেইজের কোনো পোস্ট পিন করতে পারি না, সবার কমেন্ট আসে না আর গ্রুপে পোস্ট করতে পারি না, এক প্রকার গ্রুপগুলো শো করে না । এছাড়া পেইজে আর তেমন কোনো সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ গল্পগুলো নিয়মিতভাবে এই পেইজেই পাবেন। এছাড়া আর কোনো সমস্যা হলে বা পেইজে লেখালেখি করতে যদি না পারি তাহলে অবশ্যই সেটা আমি আমার আইডিতে জানিয়ে দেব, তাই ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিটা দিয়ে রেখেছি। তবে আশা করছি পেইজে এমন কোনো সমস্যা হবে না, আপনারা সবাই দোয়া রাখবেন। আর পেইজে লাইক, কমেন্ট , ফলো করুন, গল্পগুলো শেয়ার করে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করুন। নতুন লেখিকা তো)
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আজ প্রায় দুই মাস আবসার বাহিরে গেছে মিশনে। আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ এটি। বাড়ি, পরিবার ছেড়ে এতটা দূরে থাকা মেঘ কতটা কষ্টকর তা একমাত্র যারা থাকে তারাই জানে। এই বিষয়ে প্রবাসী ব্যক্তিবর্গ সবসময়ই আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। আবসার এই দুই মাসেই হাঁপিয়ে উঠেছে সেখানে প্রবাসী ব্যক্তিরা বছরের পর বছর কিভাবে তার পরিবার স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে এত দূরে কাটিয়ে দেয় জানা নেই আবসারের। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় পেলেই কল লাগায় বাড়িতে বাবা, মা , ভাই , বোন, নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে এইটুকু কথায় যেন মন ভরে না তার। তবুও এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে আর যে উপায় নেই।
আফ্রিকার একটা ছোট্ট দেশ এটি। সভ্যতার নীড়ে এখনও প্রবেশ করতে পারেনি দেশটির জনসাধারণ। দেশটির অধিকাংশ মানুষই বেঁচে থাকে মাটি খেয়ে। মাটির তৈরি ঘরে কোনো রকমের যাযাবরদের মতো বাস করে এরা । তার মধ্যে মাঝে মাঝেই পাশের দেশ চালায় অতর্কিত হামলা। নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য নেই কোনো ভালো অস্ত্র। মূলত এদের রক্ষা করা এবং সভ্যতার নীড়ে নিয়ে আসার জন্যই আবসারদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আর বাংলাদেশের আর্মিরা তাদের কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে জানে।
আজ তিনদিন কথা হয়না নিশার সাথে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় সময় করে উঠতে পারেনি। অবশ্য এখানে আসার পর এমনও হয়েছে যে একটানা সাতদিনও কথা হয়নি। তাছাড়া দেশটির সব স্থানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তবে এমন একটা দেশে যে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় সেটাই তো বড় ভাগ্য। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডাটা অন করতেই পর পর তিনটি ছবি এলো নিশার আইডি থেকে। ছবি তিনটি দেখেই চমকে উঠলো আবসার। প্রেগন্যান্সি রিপোর্টের ছবি যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিশা প্রেগন্যান্ট। থম মেরে বসে আছে আবসার। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, চোখ দুটো ছলছল করছে। দেরি না করে কল লাগলো নিশাকে। কলটা ধরতেই আবেগী কন্ঠে বলল – আমি কি সত্যি দেখছি বসন্ত কন্যা, আমি সত্যিই বাবা হতে চলেছি?
নিশা বুঝতে পারছে আবসারের অবস্থা। একটু মজা নেওয়ার জন্য বলল – কে বলেছে আপনি বাবা হতে চলেছেন, আপনি তো মামা হতে চলেছেন।
– দুষ্টমী বাদ দেও বউ, সত্যি করে বলো না , আমি কি সত্যিই বাবা হতে চলেছি?
– মোটেই দুষ্টমী করছি না আমি ক্যাপ্টেন সাহেব। তুমি আমার বান্ধবীর ভাই সেই হিসেবে আমারও ভাই তাহলে হলে তো তুমি আমার বাচ্চার মামা । তুমি ফিরলে আমি আমার বাচ্চাকে তোমাকে মামা ডাকতে শিখিয়ে দেব।
ঠোঁট কামড়ে ধরলো আবসার, অস্রুসিক্ত নয়নে বলল – আমাকে তোমরা মাফ করে দিও।
নিশা অবাক হয়ে বলল – কি সব বলছো? মাফ চাইছো কেন? আমি তো দুষ্টমী করেছি তুমি কি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছো?
– মাফ করে দিও আমাকে। আমি আজ এমন একটা সময় তোমার পাশে থাকতে পারলাম না। আমি এমনই হতভাগ্য একজন স্বামী যে স্ত্রীর এই সময় তার পাশে থাকতে পারছি না, এমনি হতভাগ্য পিতা যে নিজের সন্তানের জন্মের সময়ও তার পাশে থাকতে পারবে না, তাকে সবার প্রথম কোলে নিতে পারবে না।
ছলছল করে উঠলো নিশার চোখ। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
– এভাবে বলছো কেন? তুমি সেখানে মহৎ কাজে গেছো। সেখানে হাজার মায়ের সন্তান আজ তোমার শিক্ষার শিক্ষায় আলোকিত ক্যাপ্টেন সাহেব। সেখানকার হাজার মানুষ আজ তোমাকে নিজেদের ভরসার স্থল হিসেবে পেয়েছে। আমার তোমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, উল্টো তোমাকে নিয়ে গর্ববোধ হয় আমার। দেখবে আমাদের সন্তানও তোমাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।
মৃদু হাসলো আবসার। ঠোঁটে হাসির রেশ নিয়েই বলল – একদম কেয়ারলেশের মতো চলবে না, তোমার তো আবার যেখানে সেখানে আছাড় খাওয়ার অভ্যাস আছে। ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করবে, একদম খাওয়া দাওয়ায় অনীহা করবে না। আমি কিন্তু মাকে জিজ্ঞেস করবো।
– ইসসসস বেবি আসতে না আসতেই বাবার এত কেয়ার। আমি বুঝি এখন পর হয়ে গেছি।
– এই কেয়ার গুলো বেবি এবং বেবির মা দুজনের জন্যই। কাছে নেই তো আমি চাইলেও নিজের হাতে বেবি আর বেবির মায়ের যত্ম নিতে পারবো না।
আর কথা বাড়ালো না নিশা। এত বড় একটা খুশির খবরের মধ্যে সে কিছুতেই চায় না আবসারের মনটা খারাপ হয়ে যাক। লোকটা এমনি কত দূরে , চাইলেই হয়তো নিজের খুশিটা কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারছে না। এমনি পরিবারকে ছেড়ে এত দূরে রয়েছে। এখন আবার তার সন্তান আসছে আর সে কাছে নেই।
– বউ……
– হুম
– মোবাইলটা একটু তোমার পেটের কাছে নেবে আমি আমার সন্তানকে একটু অনুভব করতে চাই।
নিশা মোবাইলটা নিজের পেটের কাছে ধরলো। আবসার পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিজের সন্তানকে অনুভব করছে। হয়তো এত দূর থেকে অনুভব করা সম্ভব না। কেউ শুনলে এটাকে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে করবে না। তবে এই মুহূর্তে আবসারের যেন এতেই তৃপ্তি। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে নিশাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে কিন্তু সেটাও সম্ভব না। তাই এভাবেই নিজের অশান্ত মনটাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
_____________________________
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহ চারদিকে। তীব্র রোদে খাঁ খাঁ করছে পুরো শহর। নিশার আট মাস চলছে। পেটটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। হাঁটতে চলতেই কষ্ট হয় খুব। হাত পা গুলোও ফোলা ফোলা। নিচতলায় শিফট করা হয়েছে তাকে। এই অবস্থায় বারবার শিড়ি বেয়ে উপরে ওঠা নিচে নামাটা ভালো হবে না । প্রেগন্যান্সির পর থেকেই তাকে নজরে নজরে রাখছে আবিদা বেগম। বাড়ির সবাই খুব খেয়াল রাখছে। আর আবসার, সে সময় পেলেই কল করে সব খবরাখবর নিচ্ছে।
সারাদিন আর শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না নিশার। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটির উদ্দেশ্য একটু বেড়িয়েছিল কিন্তু তার জন্য যে এমন একটা বিপদ ওত পেতে বসে আছে বুঝতে পারেনি। কাজের মেয়েটা ঘর মোছার সময় পানি ফেলে রেখেছে খেয়াল করেনি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পানির উপরে পা পিছলে উপুড় হয়ে পড়ে গেল নিশা। পেটে আঘাত লেগেছে তার, তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল সে। র’ক্ত ছুটে গেছে। চিৎকার শুনে আবিদা বেগম দৌড়ে এসে আঁতকে উঠলো। গরু কা’টা’র মতো র’ক্ত গড়িয়ে নামছে, আর অসহ্য ব্যথায় ছটফট করছে মেয়েটা। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। জ্ঞান হারালেন আবিদা বেগম। এমনি হার্ট দুর্বল তার , নিশার এমন অবস্থা সহ্য করতে পারেনি। ছুটে এলো মিষ্টি, এই বিপদে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে সে। একদিকে মায়ের মতো শ্বাশুড়ি অন্য দিকে বোনের মতো জা। দুজনের অবস্থা দেখেই অস্থির হয়ে উঠছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিপদের সময় বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে, মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। কোনো মতে নিজেকে সামলে আয়ানকে কল করলো। আয়ান আর আনসার সাহেব তখন অফিসে ছিলেন, বাড়িতে শুধুমাত্র এরা তিনজনই ছিল।
___________________________
( ৬ মাস পর )
সময় ও স্রোত কারো জন্য বসে থাকে না। সময় পরিবর্তনশীল। তার সাথে সাথে পরিবর্তনশীল চারপাশ, পরিবর্তনশীল মানুষ। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু বদলে গেছে। আয়না দুই মাসের প্রেগন্যান্ট, কাজল এখনও আগের মতোই আছে। রাকিব প্রেম করছে, মেয়েদের পিছু ঘুরতে ঘুরতে একজনকে পটিয়ে প্রেমিকা বানিয়ে ফেলল। নিলয় এখন কম খায়, ডায়েট করছে। তার নাকি আর মোটা জীবন ভালো না, কোনো মেয়ে পাত্তা দেয় না। ফারিয়া মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। আগের থেকে ফয়সালের সাথে সম্পর্কটা ভালো হয়েছে। ফয়সাল এখন তাকে চোখে হারায়। অবশ্য এসবই ফারিয়ার কঠিন অধ্যাবসয়ের ফল। সে হাল না ছেড়ে ফয়সালের পিছনে পড়ে ছিল। একটা সময় ফয়সালও গলেছে, ভুলতে পেরেছে নিশাকে। আর নিশার জায়গা নিয়ে নিয়েছে ফারিয়া। রিশাটাও বেশ বড় হয়েছে। মিষ্টিও প্রেগন্যান্ট। সব মিলিয়ে সবাই ভালো আছে। রেবেকা বানু বিছানায় পড়ে গেছেন। এখন আর হাঁটতে চলতে পারে না। বিছানাই তার সঙ্গী।
আজ দেশে ফিরছে আবসার। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি। কতদিন পর আজ সে বাড়িতে ফিরবে নিজের পরিবারের কাছে, নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। আর তার সন্তান? নিশ্চই সেও এখন বড় হয়ে গেছে, হাসতে পারে। আচ্ছা সে কি বসতে পারে? শুনেছে তার নাকি একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। ছবি দিয়েছিল আয়ান। ছবিতে মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিল। তবে নিশার সাথে যোগাযোগটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। কথা হয় না বললেই হয়। দুই তিনদিন পর পর আবসার কল করে তাও ফোন রিসিভ করায় আবিদা বেগমকে দিয়ে আবার কখনও মিষ্টিকে দিয়ে। আর তখনই কল করে তখনই সে হয় মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত, না হয় গোসল করে , না হয় ওয়াশ রুমে। গত ছয় মাসে নিশার সাথে কথা হয়েছে হাতে গোনা ৫ থেকে ৬ বার। এটা কেমন কথা বেবি হয়েছে বলে কি হাজবেন্ডকে ভুলে যাবে? এখন বেবিই সব। অভিমানের পাহাড় জমেছে আবসারের মনে। এবার বাড়িতে গিয়ে আচ্ছা করে বকে দিবে মেয়েটাকে। দূরে গিয়েছে কিনা মেয়েটা ওর রাগ, আর ধমককে একদম পাত্তা দিচ্ছে না। সাহস বেড়ে গেছে খুব।
সেই কখন থেকে বাড়ির বেল বাজাচ্ছে কিন্তু দরজা খুলছে না কেউ । আবসার এখন রীতিমতো বিরক্ত। আর কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। এমনি বাইরে যা গরম। অবশ্য ও যে আসবে বাড়িতে জানায়নি। ভেবেছিল সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। আচ্ছা নিশা যখন দেখবে আবসার ওর সামনে দাঁড়ানো তখন কি করবে সে? সে কি খুব খুশি হবে? আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বুকে? ভাবতেই ঠোঁট টিপে হাসলো আবসার । এখনও দরজাটা কেউ খুলে দেয়নি। আবার কলিং বেল বাজানোর জন্য হাত তুলতেই দরজা খুলে দিল মিষ্টি।
দরজার সামনে আবসারকে দেখে ভরকে গেল মিষ্টি। দেখেই মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। ভ্রু কুঁচকে এলো আবসারের , নিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো না ভয় পাওয়ার মতো তো কিছু নেই। একটা শুকনো ঢোক গিলে সরে দাঁড়ালো মিষ্টি। আবসার ভিতরে ঢুকে গেল। রান্নাঘর থেকে আবিদা বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো।
– কে এসেছে ছোট বউমা?
সামনে আবসারকে দেখেই চমকে উঠলো। এতদিন পর ছেলেকে এভাবে সামনে দেখে চোখ দুটো ভরে এলো। নিজের সাথে জড়িয়ে নিল ছেলেকে।
– কেমন আছিস বাবা? একদম রোগা হয়ে গিয়েছিস। খাওয়া-দাওয়া করিসনি ঠিক মতো?
– আয়ান আর বাবা কোথায় মা?
– ওরা অফিসে ।
সবাই সামনে থাকলেও আবসার খুঁজে যাচ্ছে অন্য একজনকে। তার চোখ দুটো যে তাকে দেখার তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে। চারদিকে চোখ বুলিয়েও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দেখা না পেয়ে আবসার জিজ্ঞেস করল – নিশা কোথায় মা?
এতক্ষন এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন আবিদা বেগম। নিশার কথা শুনে আমতা আমতা করছে আবিদা বেগম। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। মিষ্টি দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। সবার পরিস্থিতি একবার পর্যবেক্ষণ করে রুমের দিকে পা বাড়ালো আবসার। এখানে যেহেতু নেই তাহলে নিশা মেয়েকে নিয়ে তার রুমেই থাকবে।
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩৪ ( শেষ পর্ব )
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
রুমে গিয়ে আবসার দেখে নিশা একটা পুতুল নিয়ে শুয়ে আছে। কত দিন পর সে তার বসন্ত কন্যাকে দেখলো, চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কন্ঠনালী কাঁপছে। কিন্তু মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, মুখটা কেমন চুপসে গেছে। অসুস্থ নাকি মেয়েটা? কিন্তু কেউ তো তাকে বলেনি। এই দুই দিন আগেও তো ওর মায়ের সাথে কথা হলো আবসারের। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল – বসন্ত কন্যা।
চোখ খুললো নিশা, চমকে উঠলো সে। চোখ দুটো বন্ধ করে আবার খুলল। না সে ভুল দেখছে না। আবসার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর এই মানুষটা তার সামনে। কতদিন পর তার প্রিয় মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। কতশত অপেক্ষা, প্রায় দেড়টা বড় বছর। ১ বছর পরই আবসারের ফিরে আসার কথা থাকলেও বিভিন্ন ঝামেলায় ফেরা হয়েছে প্রায় দেড় বছর পর। ঝাঁপিয়ে পড়লো আবসারের বুকে, ডুকরে কেঁদে উঠলো। আবসারও নিজের সাথে জড়িয়ে নিল তার বসন্ত কন্যাকে কতদিন পর তার বসন্ত কন্যাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পেরেছে। ইচ্ছে তো করছে একদম বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে আবসার বলল – কাঁদছো কেন তুমি? কি হয়েছে এই দেখো আমি চলে এসেছি।
নিশা দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল – হ্যা তাই তো তুমি চলে এসেছো, একেবারে চলে এসেছো আমার কাছে।
বিছানা থেকে পুতুলটা কোলে তুলে নিল নিশা। আবসারের সামনে নিয়ে গিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল – দেখো আমাদের মেয়ে। কোলে নেও ওকে।
আবসার কোলে নিল না পুতুলটাকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো – কি সব আছে বাজে কথা বলছো তুমি? এই পুতুলটা আমাদের মেয়ে হতে যাবে কেন? আর আমাদের মেয়েই বা কোথায়?
তেড়ে এলো নিশা। কর্কশ কন্ঠে বলল – কি বললি আমার মেয়েকে তুই পুতুল বললি? তোর সাহস কি করে হলো আমার মেয়েকে পুতুল বলার?
নিশার কথাগুলো খুব অস্বাভাবিক লাগছে। সে তুই তোকারি করছে তাও আবসারের সাথে। যে মেয়েকে আপনি থেকে তুমিতে আনতে কাঠঘড় পোড়াতে হয়েছে সে আজ তুই তোকারি করছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবসার। নিশা যেন রনচন্ডী রূপ ধারন করেছে। রুমের সবকিছু একের পর এক ভাঙচুর করা শুরু করেছে। আবসার শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। দৌড়ে এলো আবিদা বেগম আর মিষ্টি। মিষ্টি নিশাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কোনো কাজ হচ্ছে না। আবিদা বেগম আবসারকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। আয়ান আর আনসার সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে তারা এখনও আসেনি। নিশার পাগলামো বেড়েই চলেছে। মিষ্টি দ্রুত ডাক্তারকে কল করেছিল। ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছে নিশাকে আর ওকে উত্তেজিত করতে বারন করে গেছে তাহলে হিতে বিপরীত হবে।
এতক্ষন সবটা নীরব দর্শকের মতো দেখছিল আবসার। সবটা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল সে । এতক্ষন পর মুখ খুলল আবসার। বলল – কি হয়েছে আমার নিশার?
আবিদা বেগম আমতা আমতা করছে। আবসার আবার বলল – এখনও চুপ থাকবে মা? এতক্ষন সবটা দেখে আমার বুঝতে বাকি নেই নিশার স্বাভাবিক নয়। কি হয়েছে ওর? আর কিভাবে হলো।
আবিদা বেগম বা মিষ্টি কেউ কোনো কথা বলছে না। চিৎকার করে উঠলো আবসার, বলল – অ্যানসার মি ড্যাম ইট।
কেঁপে উঠলো আবিদা বেগম আর মিষ্টি। ভয়ে কথা বলছে না তারা। সবটা শুনে কিভাবে রিয়েক্ট করবে আবসার জানা নেই। এমন সময় বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন আয়ান আর আনসার সাহেব। ঢুকতে ঢুকতে তারা আবসারের সব কথাই শুনেছে। আনসার সাহেব বললেন – তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি মাই সান।
সবটা বলা শুরু করলেন আবসার সাহেব।
– সেদিন পা পিছলে পড়ার পর নিশাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় । টানা ৪ ঘন্টা অপারেশন শেষে ডাক্তার এসে বলল – স্যরি অনেক চেষ্টার পরও আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিল বাচ্চাটা তাই বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
বাচ্চাটা খুব ফুটফুটে হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীতে আসার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। বাড়ির সবার উপরেই শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন । টানা ৪৮ ঘন্টা পর নিশার জ্ঞান ফিরেছিল। ততক্ষন পর্যন্ত তার সন্তানের লাশ রাখা সম্ভব হয়নি সবাই মিলে কবরে রেখে এসেছিল ফুটফুটে মেয়েটিকে। জ্ঞান ফেরার পর নিশা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল তার বাচ্চার জন্য। এক নার্সের মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার মৃত বাচ্চা হয়েছে। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল নিশা। কোনো ভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। শেষে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ঘুম ভেঙে একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল নিশা। কারো সাথে কোনো কথা বলছিল না। মুখ ফুটে শুধু এই টুকুই বলেছিল – আমি বাড়ি যাব।
বাড়িতে নিয়ে আসার পর নিশা নিজেকে ঘর বন্ধি করে নিল। সবাই অনেক চেষ্টা করেও তাকে রুমের বাইরে আনতে পারেনি। তবে সে যখন নিজের ইচ্ছাকৃতভাবে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তার হাতে একটা পুতুল ছিল। তার মতে এ পুতুলটাই তার মেয়ে। ঐ পুতুলটাকে পুতুল বলায় সেদিনও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। ডাক্তারকে ডাকা হলে সে বলল নিশা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে যেন কোনোভাবে উত্তেজিত করা না হয় ।সারাদিন রুমের মধ্যে থাকে নিশা আর ঐ পুতুলটার সাথে কথা বলে। আবিদা বেগম বা মিষ্টি তার রুমে খাবার নিয়ে গেলে শুধু মাত্র দুই একবার তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতো। রুমের বাইরে কখনও আসেনা সে।
সবটা শুনে হুংকার দিয়ে উঠলো আবসার।
– এত কিছু হয়ে গেল আর তোমরা আমাকে কেউ কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধে করলে না।
আনসার সাহেব আমতা আমতা করে বলল – এসব শুনলে তুই খুব চিন্তা করতি। তুই খুব দূরে ছিলি ওখান থেকে তোর আসাও সম্ভব ছিল না। তারপর এইসব শুনে যদি তোরও ওখানে বসে কোনো বিপদ হতো তাই জানাইনি।
– তাই কি? আমার স্ত্রী, আমার সন্তান এত কিছু হয়ে গেল তাদের বিষয় জানার কি আমার কোনো অধিকার নেই?
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। এত কিছু হয়ে গেল সে কিছু জানতেই পারলো না। তার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তাকে রেখে বিদায় নিল, আর স্ত্রী আজ পাগল প্রায় আর সে ক্ষুনাক্ষরেও কিছু টের পেল না। কতকিছু গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে, একা একা কতটা সহ্য করেছে নিশা ভাবতেই চোখ ভরে এলো আবসারের। নিশার রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
খাটের উপর পুতুলটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে নিশা। আবসারকে দেখেই আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। আবসার দ্রুত গিয়ে নিশাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। এবার আর নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। অবাধ্য চোখের পানিগুলো যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আবসারের স্পর্শে নিশা শান্ত হয়ে গেছে। চুপ মেরে মুখ গুজে রয়েছে আবসারের বুকে।
আবসার নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল – এমন করছো কেন বউ? তুমি কি আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না?
নিশা ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর দিল – বাসি তো। কিন্তু তুমি আমার মেয়েকে পুতুল বললে কেন? জানো তো সবাই আমার মেয়েটাকে পুতুল বলে।
– আমাদের মেয়েটা পুতুলের মতো সুন্দর দেখতে কিনা তাই সবাই পুতুল বলে।
নিশা ঠোঁট প্রসস্ত করে একটা হাসি দিয়ে বলল – সত্যি বলছো তুমি?
আবসার নিশার কপালে একটা চু’মু দিয়ে বলল – একদম সত্যি বলছি।
____________________________
( ৫ বছর পর )
পেড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। বদলেছে সবকিছু। রেবেকা বানু আর নেই। তিনি গত হয়েছেন আজ প্রায় তিন বছর। মিষ্টি আর কাজলের ফুটফুটে দুটো ছেলে হয়েছে আর আয়নার একটা মেয়ে হয়েছে। রাকিব তার সেই প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিয়েছে আর নিলয় বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে। বেচারা আর জীবন প্রেম করতে পারলো না। ফয়সাল আর ফারিয়াও বিয়ে করে নিয়েছ। আর নিশা আর আবসার, তাদের ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। মেয়ের বয়স তিন বছর। আবসারের চেষ্টা আর আল্লাহর রহমতে নিশা এখন পুরোপুরি সুস্থ।
আজও আবার সেই পহেলা বসন্ত। পুরো ঢাকা মেতে উঠেছে বসন্তের উৎসবে। রাস্তার পাশ হাতে হাত রেখে হাঁটছে তিনজন। আবসার, নিশা আর তাদের মাঝখানে দুহাতে বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে তাদের ছোট্ট মেয়ে আনিয়া । নিশা সেই প্রথম দিনের মতো আজও হলুদ শাড়ি জড়িয়েছে নিজের শরীরে, চুলগুলো খোলা। আবসার হলুদ একটা পাঞ্জাবি জড়িয়েছে আর ছোট্ট আনিয়াকেও হলুদ একটা শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে নিশা।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আবসার নিশার দিকে তাকিয়ে বলল-
“শীতের শুষ্কতাকে বিদায় দিয়ে যেমন
বসন্ত এসে নিজের রঙে রাঙিয়ে দেয় প্রাকৃতিকে।
তেমনি তুমিও আমার শুষ্ক , নির্জীব হৃদয়কে রাঙিয়েছো
তোমার রঙে
তুমি এসেছিলে কোনো এক বসন্তে,
আমার হৃদয়ে বসন্তের দোলা দিতে।
বসন্ত কন্যা
– ( কলমে : Smiling )
( সমাপ্ত )
(