#বাসন্তীগন্ধা
|০৮|
লাবিবা ওয়াহিদ
————————–
ক্লাস শেষে বের হয়ে বাহিরে গেলো মেহের এবং সোহা। সোহা কিছু সময় চুপ থাকলেও হুট করে প্রশ্ন করে বসলো,
–“আচ্ছা তোর ওই ভাই কী কখনো সন্দেহজনক আচরণ করেছে?”
মেহের থেমে গিয়ে ভ্রু কুচকে তাকায়। বলে,
–“কোন ভাই?”
–“সারিম ভাই?”
মেহেরের হঠাৎ গতকাল রাতের ঘটনা মনে পরে যায়। কিছুটা থমথমে মুখে করে বলে,
–“না!”
সোহা বেশ অবাক হয়ে বলে, “এটা কীরকম কথা?”
–“সন্দেহজনক আচরণ করা বুঝি প্রয়োজন ছিলো?”
–“অবিয়াসলি!”
মেহের সোহা দিক থেকে নজর সরিয়ে পুণরায় হাঁটতে শুরু করে। মেহের ম* গেলেও গতকালকের ঘটনা সোহার সাথে বলতে পারবে না। ভেতরের অস্থিরতা ভেতরে রাখতে-ই সাচ্ছন্দ্যবোধ করছে মেহের। মেহের স্বভাবতই চাপা স্বভাবের। সোহার সাথে প্রথমদিন যেভাবে মিশেছিলো এখন সেভাবে ঠিক মিশতে পারছে না। এর কারণ অস্থিরতাও হতে পারে। সোহা মেহেরের হৃদয় এবং মস্তিষ্কে যে ‘কাজিন লাভ’ নামক ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই ভাইরাস ক্রমশ তাঁর সর্বাঙ্গে মিশে যেতে চাইছে যা কড়াভাবে বাঁধা দিচ্ছে মেহের। সারিম এবং সাইয়ানের আদরে দুনিয়ার খবর সেরকম না পেলেও অনেক কিছুই বুঝে সে। শুধু বুঝতে পারছে না সারিমকে নিয়ে সোহার মাতামাতি।
ওরা বিভিন্ন কথা বলতে বলতে ভার্সিটি এরিয়ায় চলে আসে। আসার কারণ সোহার বড়ো বোন তাদের কলেজের সঙ্গে যুক্ত ভার্সিটিতে পড়ছে। তাকে সোহা কল করে মাঠের থেকে দূরে গাছের ছায়াতলে দাঁড়ালো। মেহের আশেপাশে তাকালে দেখতে পেলো একটা ফ্রেন্ড সার্কেল। যা ওদের থেকে অনেকটা দূরত্বে আড্ডা দিচ্ছে। সেই বন্ধুমহলে থাকা একটা ছেলের দিকে মেহেরের নজর আটকায়। ছেলেটা দেখতে সুদর্শন, চোখে একটি হলুদ সানগ্লাস ঝুলছে তাঁর। টি-শার্ট এবং জ্যাকেটটা কোমড়ে গিট দিয়ে বাঁধা। মেহেরের ছেলেটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। মস্তিষ্কে হঠাৎ খেলে গেলো এক নিষিদ্ধ বার্তা। এই ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ালে কীরকম হবে? ছেলেটাকে পারফেক্ট মনে হচ্ছে মেহেরের। অন্তত মেহেরের মাথা থেকে সারিমের ভূতটা তো নামবে।
মেহের সোহার এক হাত শক্ত করে ধরলো। সোহা চমকে তাকালো মেহেরের দিকে। মেহের ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে বললো,
–“ফোন ব্যাগে রাখ।”
–“রেখেছি। কিন্তু..”
সোহা কথা শেষ করার পূর্বেই মেহের বলে ওঠে,
–“তোর আপুর ডিপার্টমেন্ট এবং ক্লাস বল।”
–“দ্বিতীয় বর্ষ। বাংলা বিভাগ। কিন্তু কেন?”
মেহের কিছু না বলে সোহাকে নিয়ে টানতে টানতে সেই ফ্রেন্ড সার্কেলের কাছে চলে গেলো। ফ্রেন্ড সার্কেলে থাকা একটা মেয়েকে পিছু ডাকলে মেয়েটা ঘুরে তাকালো মেহেরের দিকে। মেহের আলতো স্বরে বলে,
–“আপু, দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা বিভাগের ক্লাসটা কোন ফ্লোরে বলতে পারবেন প্লিজ?”
মেয়েটা কিছু বলার আগে একটা ছেলে বলে ওঠে,
–“আরেহ। কলেজের নাকি?”
মেহের চোখ নামিয়ে বলে, “জি!”
–“কোন ক্লাস তুমি? কাকে খুঁজতে এসেছো?”
অন্য কন্ঠ শুনে মেহের মাথা তুলে তাকালো। সেই ছেলেটাই মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ-ভঙ্গি দেখে-ই বোঝা যাচ্ছে এই ছেলেটাই তাকে প্রশ্ন করেছে। মেহেরের এবার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
–“সেকেন্ড ইয়ার!”
ছেলেটা হঠাৎ ফিক করে হেসে দিলো। হাসি থামিয়ে বললো, “আরে বোকা ভয় পাচ্ছো কেন? রিল্যাক্স!”
সোহা এসবের আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। মেহের করছে টা কী? সোহা মুখও খুলতে পারছে না। ওরা নতুন মানুষ, নতুন মানুষের সামনে উলটো পালটা প্রশ্ন করা বেমানান! ছেলেটা দুই কদম এগিয়ে এলো মেহেরের দিকে। মেহের চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলো সেই ছেলের দিকে। হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠস্বরে কেউ বলে ওঠে,
–“মেয়েটাকে ভয় দেখাস না অভি। যা প্রশ্ন করেছে তাঁর উত্তর দিয়ে দিলেই তো হয়!”
অভি মুচকি হেসে বলে,
–“প্রশ্ন করার জন্যে তো অনেকেই ছিলো দোস্ত। আমাদের কাছেই আসলো কেন? খটকা লাগে না বিষয়টা? কী কিউটি? কী দরকার, আমাকে বলো!”
মেহের এবার অস্বস্তিতে পরলো। লম্বা কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে সোহার হাত ধরে বলে,
–“স্যরি আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্যে। সোহা চল!”
বলেই মেহের সোহাকে নিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো তখনই অভি পিছুডাক দিয়ে বললো,
–“এটলিস্ট নামটা তো বলে যাও। নাম না বললে কলেজ গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে!”
মেহেরের গলা শুকিয়ে গেলো। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মেহেরকে চুপ থাকতে দেখে অভি আবার বললো,
–“এইযে কিউটির পার্টনার। তুমি এটলিস্ট ওর নামটা বলো!”
সোহা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। বড়ো আপুর থেকে শুনেছে এই ধরণের ছেলে-মেয়েরা র্যাগিং না করে ছাড়ে না। বয়স কম হলে তো কথাই নেই। সোহা আমতা আমতা করে বললো, “মেহের!”
–“মেহের! নাইস নেম!”
মেহের এবার গলায় নিঃশ্বাস আটকে সোহাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়। পাকনামো করার ফল হারে হারে ভুগছে মেহের। কী দরকার ছিলো এখানে আসার? অভি হাসি-মুখেই চেয়ে আছে ওদের যাওয়ার পানে। অভির এক বন্ধু বলে ওঠে,
–“শুধু শুধু ভয় দেখালি!”
–“আই লাইক হার!” মুচকি হেসেই বললো অভি।
——————
আজ অফিসের কনফারেন্স শেষ করে রোজা ক্লান্ত। নিজের ডেস্কে বসে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। এর মাঝে তাঁর ল্যান্ডলাইনে কল আসলে রোজা তা রিসিভ করলো। সাইয়ানের কল ছিলো। রোজা বললো,
–“জি স্যার বলুন।”
–“আমার কেবিনে আসুন।”
রোজা নিজের ঘর্মাক্ত কপাল রুমাল দ্বারা মুছে নিলো। সিঁড়ি দিয়ে অতিরিক্ত ওঠা-নামার ফল। রোজা হাতের ঘড়িটা দেখতে দেখতে দ্রুত ভঙ্গিতে সাইয়ানের কেবিনে চলে গেলো।
–“মে আই কাম ইন স্যার?”
–“ইয়েস।”
রোজা ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো সাইয়ান তাঁর আরাম দায়ক চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। সাইয়ানের এ অবস্থা দেখে রোজা কিছুটা উত্তেজিত হলো। মিনমিন করে বললো,
–“আর ইয়্যু ওকে স্যার?”
সাইয়ান চোখ মেলে চেয়ে ক্লান্তিময় হাসি দিলো। অতঃপর সোজা হয়ে বসে চেয়ার ঘুরিয়ে টেবিলের সামনে আসলো। সামনের চেয়ারে হাত দেখিয়ে বলে,
–“আ’ম অলরাইট। প্লিজ!”
রোজা সপ্তর্পণে বসলো। সাইয়ান হাসি-মুখে জিজ্ঞেস করলো,
–“কী খাবেন? চা না কফি?”
–“নাথিং স্যার। থ্যাঙ্কিউ ফর আস্কিং!”
–“বারণ তো শুনবো না। এত সুন্দর প্রেজেন্টেশন দিলেন। পুরস্কার তো অবশ্যই প্রাপ্ত!”
রোজা হালকা হেসে বলে, “চা!”
সাইয়ান তখনই ল্যান্ডলাইন থেকে এক কাপ চা এবং কফির অর্ডার করলো। কথা বলা শেষে সাইয়ান বললো,
–“সত্যি, আজকের প্রোজেক্টটি খুব ইউনিক ছিলো। ইয়্যু আর সো ব্রিলিয়ান্ট।”
–“ধন্যবাদ স্যার। আপনার মতো সাপোর্টিভ বস ডিজার্ভ করে এই ধরণের প্রোজেক্ট!”
সাইয়ান হাসলো। রোজা সাইয়ানের দিকে গোল চোখে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
–“আপনি ঠিক আছেন স্যার?”
–“না থাকার কারণ?”
রোজা আলতো স্বরে বলে, “জানা নেই!”
সাইয়ান শুধু সৌজন্যমূলক হাসি দেয়। আর কিছু বলে না। রোজাও আর সাইয়ানকে প্রশ্ন করলো না। তবে কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,
–“লাঞ্চ করেছেন স্যার?”
–“নাহ! করে নিবো।”
রোজা কিছু বললো না। রোজা আজ ভালোভাবে নজর রেখেছে সাইয়ানের কেবিনের দিকে। খাবার দিয়ে গেছে এমন কাউকে রোজা দেখেনি। এর মানে কী আজও সাইয়ানের ফুপির বাসা থেকে খাবার পৌঁছায়নি। রোজা ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। ওদিকে লাঞ্চের টাইমও হয়ে গিয়েছে। চা আসার পূর্বেই রোজা সাইয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমাকে ওঠার পারমিশন দিবেন স্যার?”
–“হঠাৎ? চা তো এখনো আসেনি।”
–“আমি আবার ফিরে আসবো!”
–“ওকে। গো!”
রোজা হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে চলে গেলো। নিজের ডেস্ক থেকে লাঞ্চ বক্সটি নিয়ে সাইয়ানের কেবিনের দিকে চলে গেলো। আজ ভাগ্যিস সে মুরগির তরকারি রেঁধেছিলো।
সাইয়ান রোজার হাতে লাঞ্চ বক্স দেখে অবাক হয়ে বললো,
–“লাঞ্চ বক্স?”
রোজা ইতঃস্তত হয়ে এগিয়ে দিলো লাঞ্চ বক্সটি। আমতা আমতা করে বললো,
–“আপনার জন্যে লাঞ্চ স্যার!”
সাইয়ান অবাক হয়ে চেয়ে রইলো রোজার দিকে। নিজের লাঞ্চ সাইয়ানকে দিচ্ছে, অবাক-ই হওয়ার কথা। সাইয়ান অবাক হয়ে বলে,
–“নিজের লাঞ্চ আমাকে কেন দিচ্ছেন মিস রোজা?”
রোজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“আপনার জন্যে কাউকে খাবার আনতে দেখিনি স্যার। এছাড়াও আপনার বাইরের খাবার খেলে ফুড পয়জনিং হয়। তাই আমার লাঞ্চটা আপনাকে দিলাম। নিজেই রেঁধে এনেছি। আমার চিন্তা করবেন না, আমার বাইরের খাবারে ফুড পয়জনিং হয় না!”
শেষোক্ত বাক্যটি হেসেই বললো রোজা। রোজার এরূপ কর্মকান্ডে সাইয়ান থতমত খেয়ে যায়। মুহূর্তের মাঝে তা মুগ্ধতায় পরিণত হয়। সাইয়ান অমায়িক হেসে বলে,
–“থ্যাঙ্কিউ মিস রোজা, বাট আমাদের মিটিং চলাকালীন সময়েই আমার লাঞ্চ কেবিনে চলে এসেছে। তাই আপনার লাঞ্চ আপনার-ই থাকলো!”
রোজা কিছুটা হাসার চেষ্টা করে লাঞ্চটা ফিরিয়ে নিলো। কিছুটা লজ্জিতও হলো বটে। সাইয়ান এখন তাকে কী মনে করবে? সে একটু বেশি-ই বুঝে নিলো। রোজা গাল জোড়া লাল করে মিনমিন করে বলে,
–“স্যরি স্যার!”
সাইয়ান নিজের হাসি চেপে বলে,
–“চা টা আপনার ডেস্কেই পাঠিয়ে দিবো। চায়ের সাথে লাঞ্চটাও করে নিবেন। ওকে?”
রোজা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। রোজা চলে যেতেই সাইয়ান কিছুক্ষণ হাসলো। হাসতে হাসতে আপনমনেই বললো,
–“মেয়েটা কী পাগল? আমার এত খেয়াল রাখছে কেন?”
———————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।