বাসন্তীগন্ধা পর্ব -০৯

#বাসন্তীগন্ধা
|০৯|
লাবিবা ওয়াহিদ

–“আপুর থেকে শুনেছি ওই অভির বিষয়ে। বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সাথে আড্ডাই দিয়েছে। এছাড়া নারী কেলেঙ্কারির কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। তবে শুনেছে অভি নাকি জীবনে দুটোই প্রেম করেছে!”

–“আমাকে এসব কেন বলছিস সোহা? আমি ওই ছেলের সম্পর্কে জেনে কী করবো?”

–“সেটা তো তুই ভালো জানিস। তোর হয়তো মনে ধরেছে তাই আমি ভাবলাম ইনফরমেশন নিই। নয়তো তোর-ই বা কী প্রয়োজন ছিলো আপুর ক্লাস রুম ওদের থেকে জানার?”

–“অন্য কারণে গিয়েছিলাম ওই ছেলের কাছে। তাতে…”

মেহের সবটা বলার পূর্বেই পুরুষালি কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,
–“কোন ছেলের কাছে গিয়েছিলি?”

মেহের তৎক্ষণাৎ কল কেটে দিয়ে পাথরের মতো বসে রইলো। এই কন্ঠটা তাঁর ভীষণ পরিচিত। ভয়ে মেহেরের আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভয়ার্ত নজরে চেয়ে রইলো দরজার দিকে। সারিম ভ্রু কুচকে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরকে চুপ থাকতে দেখে সারিম রুমে প্রবেশ করলো। এগোতে এগোতে বললো,

–“ভয় পাচ্ছিস কেন? আমার প্রশ্নের জবাব দে। কার সাথে কথা বলছিলি? কোন ছেলেকে নিয়ে কথা হচ্ছে?”

মেহের আমতা আমতা করে বললো,
–“কাউকে নিয়ে কথা হচ্ছে না!”
–“তাহলে তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছে?”

মেহের দ্রুত নেতিবাচক মাথা নাড়ালো। তাও সারিমের সন্দেহ কাটলো না। সে মেহেরের কাছে এসে মেহেরের ফোনটা কেড়ে নিলো। ফোন চেক করে দেখলো মেহের এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলো! সারিম কোনো কিছু না ভেবেই সোহাকে কল দিলো। সে কন্ঠ শুনে মেয়েটার গলা শুনতে চায়। ফোন সাথে সাথেই রিসিভ হলো। এদিকে ভয়ে মেহেরের গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। মেহের মনে মনে দোয়া-দরূদ পড়ছে যাতে সোহা উলটো পালটা কিছু না বলে ফেলে। সারিম যখন মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনলো তখন কল কেটে দিলো। মেহেরের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

–“এটা তোর কোন বান্ধুবী, আমায় কালকে ওর সাথে মিট করিয়ে দিবি। আর হ্যাঁ, আমার সাথেই আগামীকাল কলেজ যাবি!”

বলেই সারিম থমথমে মুখ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আজকে সারিম আর পড়ালো না মেহেরকে। সারিম চলে যেতেই মেহের হাপ ছেড়ে বাঁচলো। কত বড়ো ভুল যে সে করেছে তা মেহের হারে হারে টের পাচ্ছে। সে কেন ভুলে গেলো, সারিম ভাই থাকতে তাঁর প্রেম করা একদম অসম্ভব। তাঁর সারিম ভাই কী অভির থেকে কম সুন্দর নাকি?

পরমুহূর্তে নিজের মাথায় চড় মা*লো মেহের। আবারও ভুলভাল ভাবনা মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে। সবই মেহেরের কাছে ধোঁয়াশা লাগছে।

মাহিম ফোনে কোনো এক মেয়ের সাথে চ্যাট করছিলো এমন সময়-ই সারিম এসে মাহিমের কান টেনে ধরলো। সব কিছু এত দ্রুত ঘটলো যে মাহিম আগা-মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। সারিম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“বোন কলেজে কী করছে না করছে সেসব দেখার জন্যে তোকে একই কলেজে ভর্তি করালাম। আর তুই বোনের দিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের কু-কীর্তি চালাতে ব্যস্ত? ইডিয়েট কোথাকার! মাহিম, যদি শুনি মেহের কোনো ছেলের প্রতি দুর্বল হয়েছে তাহলে সর্বপ্রথম আমি তোকে পিটাবো। পিটাতে পিটাতে তোরে হসপিটালে যদি না পাঠাতে পারি তাহলে আমার নামও সারিম আরজাইম নয়। মাথায় ছিদ্র করে কথাগুলো ঢুকিয়ে নিস!”

বলেই মাহিমের কান ছেড়ে দিয়ে সারিম হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে মাহিম কানের ব্যথায় কতক্ষণ এপাশ, ওপাশ করলো। পরমুহূর্তে কী ভেবে চটজলদি উঠে বসে ভাবে,
–“মেহের আবার প্রেম করছে নাকি? সর্বনাশ!”

—————-
রাতে খাবারের সময় মেহেরকে ডাকা হলো। নিচে গিয়ে বাবা বা বড়ো চাচ্চু কাউকেই দেখলো না মেহের। তাদের না পেয়ে মেহের ঢোঁক গিলে নিচে নামলো। টেবিলে সারিম, মাহিম এবং সামিরা বসে আছে। নিচে নামলে লিভিংরুমে চাচ্চু এবং বাবাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেহের। যাক, আজ ভাগ্য তাঁর অনুকূলে। মেহের সারিমের পাশে বসতে নিলে সারিম মাহিমের দিকে চেয়ে বলে,

–“তোর পাশের চেয়ারটায় তোর আহাম্মক বোনকে বসা!”

মেহের গরম চোখে সারিমের দিকে তাকালে সারিম সেই মুহূর্তে মেহেরের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের চাহনির রঙ বদল হলো। পানসে চোখে চাইলো সারিমের দিকে। সারিম কিছুই বললো না। মেহের নজর সরিয়ে মাহিমের পাশে গিয়ে বসলো। জ্যুতি অর্থাৎ মেহেরের মা ওদের খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে। মাহিম মেহেরের কানে ফিসফিস করে বললো,

–“তুই নাকি প্রেম করছিস মেহের? তা নির্বোধ ছেলেটা কে? যে তোর মতো বোকার প্রেমে পরলো?”

মেহের মাহিমের দিকে কটমট চোখে চেয়ে বললো,
–“তোকে কে বলেছে এসব আজেবাজে কথা?”

–“তোর জমজ ভাই হই আমি। তোর মাথায় কী চলে তা আমি ঠিক-ই বুঝে যাই!”

মেহের মুখ বাঁকিয়ে বললো,
–“উলটো পালটা লজিক!”

–“প্রেম করলে তোরে সারিম ভাই গুলি মা*বে মনে রাখিস!”
মাহিমের কথা শুনে এবার মেহের দমে রইলো।

সকালে সারিম-ই মেহেরকে কলেজে নিয়ে গেলো। কলেজে গিয়ে মেহের সোহার সাথে একপ্রকার বাধ্য হয়ে সারিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সারিম সোহাকে বেশকিছু প্রশ্ন করে সরে এলো।

আশেপাশের কিছু ছেলেকেও মেহেরকে চিনিয়ে দিয়ে তাঁর উপর নজর রাখতে বললো। এত-সবের মাঝে মেহের প্রেম করতেই ভুলে গেছে।

————–
রাত আটটা বাজে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠলে সাইয়ান দরজা খুলে দেখলো রোজা দাঁড়িয়ে। রোজাকে দেখে সাইয়ান হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“আরে মিস রোজা যে?”

রোজা আলতো হেসে হাতের টিফিন বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“রান্না করলাম। ভাবলাম আপনাকেও দিয়ে আসি!”

–“আরেহ। আপনি-ই খেতেন! আমার জন্যে আনার কী প্রয়োজন ছিলো?”

রোজা এবার নজর নামিয়ে অল্প অল্প স্বরে বললো,
–“ইচ্ছে করলো স্যার। আপনি চাইলেই আপনাকে আমি রান্না করে দিতে পারি। রোজ রোজ শুধু শুধু আপনার ফুপি কষ্ট করছেন!”

সাইয়ান অবাক হয়ে চাইলো রোজার দিকে। রোজার সবকিছুতে এত বেশি নজর এবং যত্ন করা সাইয়ানকে ইদানীং বেশ ভাবাচ্ছে।

প্রায় সময়-ই সাইয়ানকে এটা সেটা রান্না করে দিয়ে যায়। যা সাইয়ানের বোধগম্য হয় না। এত সেবা পাবার মতোও তো মিশেনি রোজার সাথে। তাহলে রোজা কেন তাকে নিয়ে এতটা চিন্তিত থাকে? তার যত্ন করে?

কী লাভ এই মেয়েটার এসবে? এটা কী তাঁর সরলতা নাকি তার কোনো কু-বুদ্ধি সাইয়ানের সাথে মেশার জন্যে? তবে রোজাকে সাইয়ানের মোটেও সন্দেহজনক লাগে না। মেয়েটা সত্যি-ই সরল।

সাইয়ান বেশি কিছু না ভেবে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রোজার হাত থেকে টিফিনটা নিয়ে বলে,
–“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ্ মিস রোজা!”

রোজা আলতো হাসলেও পরমুহূর্তে আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যার আমি কিছু বলতে চাই!”

সাইয়ান ভ্রু কুচকে তাকায় রোজার দিকে। জিজ্ঞাসু নজরে চেয়ে বললো, “জি, বলুন!”

রোজা আমতা আমতা করে বললো,
–“আমার দশদিনের জন্যে ছুটির প্রয়োজন!”

সাইয়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“ওহ এই ব্যাপার। তাহলে বিশ্রাম করুন। সমস্যা নেই!”

রোজা মাথা তুলে চেয়ে বলে,
–“জিজ্ঞেস করবেন না কেন নিচ্ছি?”

সাইয়ান ভ্রু কুচকে বললো, “কেন নিচ্ছেন?”

–“আমি বিয়ে হবে স্যার। আপনার দাওয়াত রইলো।”

———————
মেহের বাড়িতে ফিরতেই লিভিংরুমে দেখতে পেলো ইলিরা কে। ইলিরা হচ্ছে সারিমের সেই বান্ধুবী। ইলিরাকে দেখে মেহের ভালো করেই চিনে ফেললো। তবে ইলিরার আজকের রূপ দেখে মেহের বেশ অবাক হলো।

ইলিরা আজ শাড়ি পরে এসেছে তাদের বাসায়। অথচ মেহেরের মনে পরে না সে কোনোদিনও শাড়ি পরেছিলো কী না। ইলিরা ওড়না ছাড়া ড্রেস পরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। খুব স্টাইলিশ জামা-কাপড় পরিধান করে।

মেহেরের মনে আছে, একসময় সে ইলিরার মতো হতে চাইতো। ইলিরার ড্রেসআপ মেহেরের খুব পছন্দ ছিলো। তাই মেহের শপিং-এ গিয়ে ইলিরার মতো ড্রেস চুজ করেছিলো কিনবে বলে। কিন্তু সেই ফলাফল স্বরূপ মেহের শপিংমলের শত মানুষের সামনে চড় খেয়েছিলো সারিমের হাতে।

সেদিন লজ্জায়, রাগে মেহের টানা তিন দিন কেঁদে ভাসিয়েছে। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করেনি। সারিম একবারও চাইতেও আসেনি মেহেরকে। এত অভিমান, দুঃখ কাকে বুঝাতে চাইলো আর তার সাথে কী হলো? সেদিনের পর থেকে মেহের অভিমান করাই ছেড়ে দিয়েছে। তবে সেই তিনদিন ঘুমের মাঝে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেত সে।

অতীত ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ-ই সারিমের প্রতি আলাদা অনুভূতি তাঁর সর্বাঙ্গ জুড়ে নাড়া দিলো মেহেরের। সে বুকের বা পাশে হাত চেপে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here