বাসন্তীগন্ধা পর্ব -২২

#বাসন্তীগন্ধা
|২২|
লাবিবা ওয়াহিদ

রোজা চোখ মেলে সাইয়ানের দিকে তাকালো। সাইয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। তা দেখি মুচকি হাসলো রোজা। আবারও বলতে শুরু করলো,

–“স্পর্শ গুলো বুঝতে না পারলেও কী ধরণের স্পর্শ সেটা বুঝতাম না। কারণ এই ধরণের স্পর্শের মুখে আগে কোনোদিন পরিনি। বড়ো ভাইও ছিলো না যে ভাইদের ভালোবাসা বুঝতে পারবো। তবে এটুকু মনে হচ্ছিলো কোনো ভাই এরকম ভাবে স্পর্শ করে না। বাবা আদর করলেও অস্বস্তি হতো না৷ শুধুমাত্র রুবেলের কাছে থাকলেই অস্বস্তি হতো। সময় বাড়তে লাগলো, রুবেলের উক্ত্যক্তর তীব্রতাও দিনদিন বাড়ছিলো। শেষে একদিন কেঁদে দিয়ে বলেছিলাম আমার থেকে দূরে থাকতে। আমার তাকে একদম পছন্দ না। রুবেল তখন রাগে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দু’গালে দুই চড় দিয়েছিলো। তারপর কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

রুবেলের চড়ের কারণে সেদিন খুব জ্বর আসে আমার। রুবেল বাড়ি ফেরেনি। সেই রাগে সৎ মা সেদিন প্রথমবারের মতো আমায় অনেক বেশি মেরেছিলো। মারতে মারতে আমায় আধমরা করে ফেলেছিলো। বাবা মাঝে না আসলে হয়তো সেদিন মরেই যেতাম। দুইদিন আধমরা হয়ে রান্নাঘরেই পরে রইলাম। কেউ আমায় বিছানায় পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। সৎমা নিজের মতো কাজ আর রান্না-বান্না করে চলে যেত। আমার দিকে খেয়ালই করতো না। যেন আমি অদৃশ্য কিছু, আমাকে চোখে দেখা যায় না।

এরপর আসে সেই বীভৎস রাত। সেদিন রান্নাঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ বাজে অনুভূতি হতেই চোখ মেলে তাকালাম। দেখতে পেলাম রুবেল আমার সাথে…”

রোজা থেমে গেলো। হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলতে লাগলো,
–“রুবেলের কাছে কত আকুতি মিনুতি করেছি। কিন্তু সে আমার কোনো কথা কানে নেয়নি। ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠেছিলো সে। যখন দেখলাম কোনো কথাতে কাজ হচ্ছে না, তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য খুব কষ্টে তাক থেকে ভারী কাঁচের জগটা তুলে নেই। অতঃপর সেটা দিয়ে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে রুবেলের মাথায় আঘাত করে সরিয়ে দেই। উপরওয়ালার কী রহমত, ওইটুকুনি আমাকে হঠাৎ বড়ো বানিয়ে ফেললো। আমি চটজলদি উঠে দাঁড়ালাম। এমন ঘটনায় নিজের আহত শরীরেও কেমন প্রাণ বাঁচানোর উৎস খুঁজছিলাম। সেই সঙ্গে ভয়ও করছিলো, রুবেলকে এই আঘাত করেছি ভাবতেই ভয়ের আশঙ্কা আরও বেড়ে যাচ্ছিলো। রুবেল জ্ঞান হারিয়েছিলো আর আমি ভেবেছিলাম ম* রে গেছে। আমি দ্রুত দিক-নির্দেশনা না দেখে সদর দরজার দিকে ছুটে যায়। দরজা কোনোরকমে খুলে দারোয়ানের কাছে গিয়ে কিছু বলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন চোখ খুলি তখন নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করি। পাশে পেয়েছিলাম আমার মাকে। মা চোখে জল নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়েছিলো।

পরে জানতে পারি দারোয়ান আঙ্কেল-ই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো আর মাকে সেই খবর দিয়েছিলো। মা-ই নাকি দারোয়ানকে বলে রেখেছিল যাতে কোনো বিপদ হলে দারোয়ান তাদের জানাতে পারে। দারোয়ান আঙ্কেলও ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন, আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি নিজের চাকরীর পরোয়া না করে আমাকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। জানেন, আল্লাহ’র কাছে অনেক দোয়া করি। ওই মুহূর্তে উনি আমাকে না বাঁচালে আমি হয়তো আর বাঁচতাম না। আমাকে খুবলে খেত ওরা।”

এই মুহূর্তে এসে রোজাকে বুকে টেনে নিলো সাইয়ান। রোজার সঙ্গে সঙ্গে আবেশে চোখ বুজে এলো। কী পরম শান্তি। রোজা অনুভব করছে সাইয়ানের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে রোজা সাইয়ানের টিশার্ট খামচে ধরে বলতে লাগলো,

–“সেই ঘটনার পর মা আমাকে নিয়ে খুলনা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। এখানে আমার মামা ছিলো। অর্থাৎ আমার নানাবাড়ি। মা যেই বাড়ীতে থাকছেন ওটাই আমার নানার ভিটে৷ মামা’রা আলাদা হয়ে গিয়েছে।

আমি শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলেও মানসিক ভাবে আমি খুব-ই বিপর্যস্ত ছিলাম। আমাদের এত টাকাও ছিলো না যে আমার চিকিৎসা করাবে। মা-ও গার্মেন্টসে চাকরি করে একা হাতে সব সামাল দিয়েছে৷ তাই সবকিছু ভেতরে চাপা দিয়ে আমি পড়াশোনা করতে লাগলাম। মা সবসময় চেষ্টা করতো যেন ওই ভয়ংকর দিনটা আমার জীবন থেকে মুছে যাক। এজন্যে সবসময় স্বাভাবিক আচরণ করতো। কিন্তু শৈশবের ঘা তো এত সহজে মুছতো না। মাঝেমধ্যেই আমি অস্বাভাবিক হয়ে যেতাম। এভাবে চলতে চলতে পড়াশোনা শেষ করলাম, ছয় মাস চাকরি খোঁজার পর আপনাদের অফিসের খোঁজ পেলাম। সেখানে নিয়োগ হলাম। ধীরে ধীরে আপনার প্রেমেও পরে গেলাম।”

বলেই রোজা চুপসে গেলো। সাইয়ান এতক্ষণ শক্ত থাকলেও রোজার শেষ কথা শুনে গলে গেলো। আলতো হেসে ফেললো সে। হঠাৎ রোজাকে অবাক করে দিয়ে রোজার কপালে অধর ছোঁয়ালো। মুহূর্তে-ই রোজার সর্বাঙ্গ জুড়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। শক্ত করে খামচে ধরলো সাইয়ানের টি-শার্ট। রোজাকে এমন কাঁপতে দেখে সাইয়ান হাসলো। অতঃপর বিনাবাক্যে রোজাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরলো। রোজাকে স্বাভাবিক করতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে সাইয়ান বললো,
–“অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমাও দেখি।”

রোজা স্বস্তির সাথে চোখ বুজলো। এই বুকে ঠাই পেলে দুনিয়ার সকল দুঃখ রোজা ভুলে যেতে পারে। কেন তার মানসিক ডাক্তার বুঝলো না সাইয়ান নামক মানুষটাই তার সেরা ওষুধ?

———————
আজ রোজা এবং সাইয়ানের রিসিপশন অনুষ্ঠান। কমিউনিটি সেন্টারে নয় বরং সাইয়ানদের বাগানে-ই অনুষ্ঠানটি করা হচ্ছে। নিজের বাড়িতে নিজস্ব অনুষ্ঠানের আলাদা শান্তি আছে। তাই রোকসানাই বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে বলেছে।

আজকাল রোকসানা এবং আইয়ুঁব সাহেবের মধ্যে তর্কা-তর্কি ভাব দেখা যাচ্ছে। মা-ছেলের মধ্যে কী চলছে সেটা শুধু তারাই জানে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও দুজনের কেউ-ই আসল কথাটা বলে না। মেহের নিজেও বুঝতে পারছে না এদের মধ্যে কী চলছে?

বাড়ীভর্তি মেহমান। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মেহমান বেশিরভাগ চলে গিয়েছে। বাকিরা বাড়ীতেই গিজগিজ করছে। অনেকে বউ দেখে ঘুমোতেও চলে গেছে। আর বাগানে থেকে গেছে সাইয়ান, সারিমের কাজিন এবং বন্ধু-বান্ধব। সবগুলো মিলে প্যান্ডেলের এক কোণে ঘাসের উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। সাথে আছে তাদের নিষিদ্ধ পানীয়। যা বড়োদের থেকে লুকানো হয়েছে। এদিকে মাহিমসহ মেহের, সামিরা মিলে বাসর সাজাচ্ছে। রোকসানা-ই তাদের এই কাজ করতে বলেছে। যার ফলস্বরূপ তিন ভাই-বোন ব্যস্ত। রোজা বসেছে সামিরার ঘরে। মাহিম মুখ ভার করে ফুলের প্যাচ ধরতে ধরতে বললো,

–“কী সুন্দর ভাইয়া’রা মিলে ওটা গিলছে আর আমি কী না এখানে বাসর সাজাচ্ছি? আমাকে নিলে কী এমন হতো? বয়স তো আমার বিশ হয়েছেই!”

সামিরা মাহিমের মাথায় চাপড় মেরে বললো,
–“চাচ্চু জানতে পারলে তোকে বাড়ীতে থাকতে দিবে না। সাথে ভাইদের মাইরও ফ্রী। বাই ওয়ান গেট ওয়ান টাইপ!”

মেহের হু হা করে হেসে দিয়ে বললো,
–“আরেকটা ফ্রী জিনিস আছে। সাইয়ান ভাইয়ার রিসিপশনেও মাহিম ফ্লার্টিং করেছে। বাবা দায়িত্ব দিছে মেহমানদের দেখ-ভাল করার, আর ইনি মেয়েদের এক্সট্রা লেসন শিখিয়েছে!”

মেহেরের কথা শুনে মাহিম রেগে মেহেরের চুল টান দিয়ে বললো,
–“তোর কোনো কাজ ছিলো না? আমার পিছে পিছে ঘুরছিস কেন? আমি তোর থেকে দেড় মিনিটের বড়ো। যা ইচ্ছা করতে পারি, তোর কী?”

মেহেরও মাহিমের চুল টেনে দিয়ে বললো,
–“তুই বয়সে আমার থেকে দেড় মিনিটের বড়ো হলেও পড়াশোনার দিক দিয়ে এক বছরের বড়ো। কথা-বার্তা ভালোভাবে বলবি। নয়তো আমি মুখ খুলতে বাবা তোর পা*য় লাথ মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে!”

সামিরা বহু কষ্টে তার হাসি থামিয়ে বললো,
–“এসব চুলাচুলি বন্ধ করে দ্রুত ঘর সাজা। নয়তো দেখা যাবে জামাই সাহেব চলে আসছে আর দেখছে বউ বাসর ঘরে নেই, এখনো বাসরও সাজানো হয়নি।”

মাহিম মেহের উভয়েই দুজনকে ভেঙিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিলো। দ্রুত হাতে সব কাজ সেরে মাহিম বেরিয়ে গেলো। আর মেহের এবং সামিরা মিলে রোজাকে সাইয়ানের রুমে নিয়ে এলো। সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে যে যার ঘরে চলে গেলো। মেহের তার ঘরে যেতেই চমকে উঠলো।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
বিঃদ্রঃ চোখে ঘুম নিয়ে লিখেছি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো, থাকবো, থাকবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here