#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#উনবিংশ_পর্ব
দেখতে দেখতে বিকেল পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে। চারপাশের কালচে আঁধারের মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার তীব্র আওয়াজ দূর থেকে জানালা ভেদ করে শোনা যাচ্ছে। সিরাতও একমনে বারান্দায় বসে সেই আওয়াজ একমনে শুনে যাচ্ছে।
– ” সিরাত আপু?”
হঠাৎ করে নিশাতের কন্ঠস্বর কান অবধি পৌঁছাতেই চমকে উঠে সিরাত। ভাবনা খেয়ালের জগৎ থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে।
সিরাতের দিকে দৃষ্টি যেতেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় নিশাত। পিছন পিছন যথারীতি ফাইয়াজ ও প্রবেশ করে ভেতরে। নিশাত গিয়ে প্রথমেই সিরাতকে ঝাপটে ধরে; যেন এতদিন বড় বোনকে না দেখার বিতৃষ্ণা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সিরাত ও জড়িয়ে ধরে নিশাতকে।
– ” আপু তুই ঠিক আছিস? তোর কিছু হয়নি তো?”
বিচলিত কন্ঠে নিশাতের প্রশ্ন।
– ” হ্যাঁ আমি একদম ঠিক আছি। কিছু হয়নি আমার। হয়নি বললে ভুল হবে; মিস্টার ফাইয়াজ কিছু হতে দেন নি আমার।”
কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিমা অনুসরণ করে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে সিরাত। ফাইয়াজ বিনিময়ে শুধু মুচকি হাসি দেয়।
– ” উহুম, উহুম! সারারাত কি এভাবে গল্প করে কাটিয়ে দিলেই হবে নাকি কিছু খেতেও হবে?”
সদর দরজার সামনে ট্রে হাতে উপস্থিত হতেই বলে উঠে ফারিহা।
– ” আরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ভেতরে আয়!”
ফাইয়াজের কথামতো ভেতরে প্রবেশ করে টেবিলের উপর ট্রে রাখে ফারিহা।
– ” আচ্ছা, তোমরা না কথা বলো আমার একটা জরুরী কল এসেছে! আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি।”
বলতে বলতে ফোন হাতে রুম থেকে প্রস্থান করে ফাইয়াজ।
রাতের খাবারের আয়োজনের পর্ব চুকিয়ে তিন জন যথাক্রমে সিরাত, নিশাত আর ফারিহা মেতে ওঠে নানারকম গল্পে। হাস্যরসাত্মক গল্প করার মাঝেই ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে রিয়া। রিয়াকে এভাবে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে হাসি থামিয়ে দেয় ফারিহা আর নিশাত। দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিয়ার দিকে।
– ” রিয়া আপু তুমি এখানে? ভালোই করেছো এসে; এখানে এসে আমাদের সাথে জয়েন হও!”
– ” গল্প মাই ফুট! আমি এখানে তোমাদের সাথে কোনো ইউজলেস গল্প করতে আসি নি! আমি এখানে সিরাতকে ওয়ার্ন করতে এসেছি।”
খানিকটা রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে রিয়া। সিরাতকে ওয়ার্ন করার কথা কানে আসতেই ফারিহা, নিশাত সহ সিরাতও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে।
-” ম,ম,মানে কিসের ওয়ার্ন?”
অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে সিরাত।
– ” কি মনে করো নিজেকে? কেউ তোমার আসল চেহারা চিনবে না? আমি চিনে ফেলেছি তোমার আসল চেহারা!
আমার মুগ্ধকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার জন্য এত নাটক সাজিয়েছ তাই তো? নিজেকে মুগ্ধের সামনে অসহায় অবলা সাজিয়ে নিজের মায়ায় ফেলতে চাও যাতে করে এ সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারো; লিসেন মুগ্ধ ইজ মাইন!
ওর দিকে হাত বাড়ালেও সেটা তোমার পক্ষে ভালো হবে না সিরাত!”
রিয়ার মুখের এমন হুমকিস্বরূপ কথাবার্তা সিরাতকে অবাক না করে পারে না। রিয়ার কথায় সবার মুখেই বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।
– ” এগুলো আপনি কি বলছেন রিয়া আপু? কিসের নাটক আর কিসেরই বা মুখোশ উন্মোচন?
আর মিস্টার ফাইয়াজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনোই সম্পত্তির বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল না। আর না আমিই তার সামনে অসহায়ত্বের নাটক করেছি! তিনি তো শুধু আমার বিপদে আমাকে সাহায্য করেছেন! এখানে তাকে নিজের মায়ায় জড়ানোর সাদৃশ্য কোথায়?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সিরাত।
– ” আমার সামনে এসব নাটক করার প্রয়োজন নেই। আমি সব ভালো করে জানি! আই জাস্ট ওয়ার্ন ইউ! এর পর থেকে যেন তোমাকে মুগ্ধের আশেপাশে না দেখি! হি ইজ অনলি মাইন!
একটু পরিমাণেও যদি লাজ লজ্জা থেকে থাকে তাহলে এ বাড়ি থেকে আগামীকালই চলে যাবে তুমি।”
– ” রিয়া আপু!!
ব্যস অনেক হয়েছে। তুমি সেই কখন থেকেই সিরাত আপুকে যা তা শোনাচ্ছো, তোমার প্রবলেম কোথায়? আমার ভাই যাকে খুশি ভালোবাসবে আর এটা একান্তই তার ব্যাপার। আর তুমি খুব ভালো করেই জানো ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে না; তুমি যেগুলো সারাদিন ভাইয়ার সামনে করো সেগুলো ন্যাকামি, নাটক ছাড়া কিছুই না!”
রিয়ার প্রশ্নোত্তরে হুংকার দিয়ে বলে উঠে ফারিহা।
এদিকে চিল্লাচিল্লি করার শব্দ কর্ণপাত হতেই রুমে দ্রুত পায়ে চলে আসে ফাইয়াজ। রুমের মধ্যে রিয়াকে আর ফারিহাকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা কাটাকাটি করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় সে। আর এক পর্যায়ে সিরাতের দিকে চোখ যেতেই আতকে উঠে সে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু গুলো চিবুকে এসে জমা হয়েছে নির্লিপ্ত ভাবে। ফর্সা ত্বকে লালচে আভা স্পষ্ট।
– ” কি ব্যাপার ফারিহা; কি হয়েছে এখানে? এত চেঁচামেচি কিসের?”
ফাইয়াজের বলা কথার মাঝেই রুম থেকে গটগট করে বেরিয়ে পড়ে রিয়া। রিয়ার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থির করে ফারিহা বলে উঠে,
– ” তুই আয় আমার সাথে; তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফাইয়াজকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো ফারিহা।
এদিকে একে একে সবাই চলে যাওয়ার পর খাটের উপর ধীরে ধীরে বসে পড়ে সিরাত। চোখ মুখ লাল রঙ ধারণ করেছে অনেক আগেই।
————
পরদিন সকালে,,
ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবাই নাস্তা খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় ফাইয়াজের গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে সকলের কানে। ফাইয়াজের আওয়াজ অনুসরণ করে পাশে তাকাতেই খেয়াল করে সিরাতের হাত মুঠোয় নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে দুজন। জাফর সাহেব কপাল কুচকালেন। চোখে মুখে বিরক্তির উদ্রেক।
– ” আমি সবাইকে কিছু বলতে চাই।”
বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে ফাইয়াজ। সিরাত ভয়ে জড়সড় হয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইয়াজের হঠাৎ এমন কথার ভাবভঙ্গি যথেষ্ট পরিমাণে সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে।
– ” কি হয়েছে বাবা, কি বলবি?”
বলে উঠেন মিসেস সাবিনা ওরফে ফাইয়াজের মা।
– ” আমি সিরাতকে ভালোবাসি; আর আমি সিরাতকেই বিয়ে করব! ”
ফাইয়াজের বলা কথা শুনতে পেয়ে হালকা নড়েচড়ে উঠেন জাফর সাহেব। সিরাতও ভড়কে যায় এমন কথা শুনে।
– ” কি সব বলছো তুমি মুগ্ধ? আর ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড?
আমি রিয়ার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি; সেখানে এই মেয়ের কথা আসে কি করে? ”
গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন জাফর সাহেব।
– ” আমি ঠিকই বলছি বাবা। আমি সিরাতকে ভালোবাসি। আর যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে আমি সিরাতকেই করব বিয়ে; রিয়াকে না!”
ফাইয়াজের কথা শুনে রাগে ক্ষোভে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিয়া।
– ” হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ মুগ্ধ? তুমি এই একটা চিপ, থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য আমাকে রিফিউজ করে দিচ্ছ! আমি শুধুমাত্র তোমার জন্য ইউকে থেকে ব্যাক করেছি! আই লাভ ইউ মুগ্ধ, হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলার পরক্ষণেই নাকি কান্না জুড়ে দেয় রিয়া।
– ” কি শুরু করেছো কি মুগ্ধ?
কি যোগ্যতা আছে এই মেয়েটার এই আহমেদ বাড়ির বউ হওয়ার? ”
অত্যন্ত ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন জাফর সাহেব।
– ” বাবা!!
এই আহমেদ বাড়ির বউ হবার কোনো যোগ্যতা থাকে সেটা সিরাতের আছে! আর সবচেয়ে বড় কথা আই লাভ হার; সেখানে অন্য কাউকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।”
– ” তাহলে আমার এ বাড়িতে থাকার কী মানে? আমি থাকব না এখানে; চলে যাব আবারো ইউকে তে!”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমের দিকে পা বাড়ায় রিয়া।
– ” তবে আমার জিনিস আমি নিয়েই যাব! আর যদি না পাই তাহলে তোর মতো একটা চিপ ক্লাস মেয়েরও হতে দিব না; মুগ্ধ ইজ অনলি মাইন!
মাইন্ড ইট!”
সিরাতের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে রিয়া। অতঃপর পা বাড়ায় ঘরের দিকে।
রিয়া চলে যাওয়ার পর পরই জাফর সাহেব ও নাস্তার টেবিলে খাবার রেখেই উঠে পড়লেন।
– ” সাবিনা আমি বের হচ্ছি অফিসের জন্য!”
বলেই একটা ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়েন জাফর সাহেব। আর সেদিকেই অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফাইয়াজ। সিরাতের মনের অবস্থাও বিদ্রুপ। সামনের দিনগুলো যে খুব একটা সহজ হবে না তা বেশ ভালোই টের পাচ্ছে সে।
এক আকাশ পরিমাণ রাগ নিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে চন্দ্রিকা। সামনে বসে থাকা মাঝবয়সী মহিলা এবং পাত্রের দিকে এখন পর্যন্ত তাকিয়ে দেখে নি সে। গানের ক্লাস শেষে বাড়িতে এসে তার বিয়ের কথাবার্তা শুনতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ইয়াসিন সাহেবের কথার অমান্য করতে না পেরে এক প্রকার বাধ্য হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে চন্দ্রিকা।
– ” মাশাআল্লাহ, মেয়ে তো ভারী মিষ্টি! আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে মেয়েকে। তাহলে বিয়ের কথা সামনে বাড়াই; কি বলেন ভাইসাহেব? তাছাড়া আমার ছেলে রূপের কথাও তো রাখতে হবে!”
রূপ নামটা শুনতেই নিমিষেই সব রাগ ক্ষোভ মিইয়ে যায় চন্দ্রিকার। একরাশ বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে তাকাতেই চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অস্ফুট স্বরে শুধু উচ্চারণ করে,
– ” ড,ড্,ডক্টর রূপ!!”……………
#চলবে 🍂