#বিকেলে_ভোরের_ফুল
#পর্ব_১৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
স্পর্শ ঘুমঘুম চোখে ফুলের দিকে তাকালো। কাল বৃষ্টি হওয়াতে ঘুমটা বেশ জমেছিল। স্পর্শ ইশারায় ফুলকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে?? ফুল ভয়ে ভয়ে বলল,
–“বাইরে কারা যেন এসেছে!!”
স্পর্শ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–“কি??”
–“হুম!”
–“তুমি এখানে দাঁড়াও আমি দেখতেছি।”
বলেই স্পর্শ বাইরে চলে গেল। ফুল জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতেছে। স্পর্শ লোকগুলোর সাথে কি যেন বলাবলি করছে দূরে থাকার কারণে ফুল কিছুই শুনতে পারছে না। স্পর্শ লোকগুলোর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে এলো। লোকগুলো বোট থেকে বড়বড় প্যাকেট নিয়ে স্পর্শর পিছু পিছু আসতেছে। ফুল ভয়ে জড়সড় হয়ে ঘরের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো। প্রথমে স্পর্শ ঘরে আসলো তারপর লোকগুলো এক এক করে এসে সব প্যাকেটগুলো রাখলো সাথে বড়বড় পানির বোতল ও এনেছে। সবকিছু রেখে লোকগুলো চলে গেল। স্পর্শও ওদের পিছু পিছু সমুদ্রের তীর পর্যন্ত গেল। ফুল বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রইল। লোকগুলো বোট নিয়ে চলে যেতেই স্পর্শ ফুলের কাছে ফিরে আসলো। ফুল জিজ্ঞেস করল,
–“এরা কারা??”
–“কেন চিনতে পারোনি??”
–“না।”
–“ওঁরা আমাদের খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে এসেছিল।”
–“ওহহ”
স্পর্শ ঘরের ভেতর চলে যায়। ফুল বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো লোকগুলো এতকিছু দিয়ে গেল, তারমানে এখানে আরও অনেকদিন থাকতে হবে। তখনই স্পর্শ বাইরে এলো ফুল স্পর্শের দিকে ঘুরে বলল,
–“আমরা এখান থেকে যাচ্ছি কবে??”
–“কেন?? তোমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না??”
–“প্রথমে ভালো লাগলেও এখন লাগছে না। প্লিজ এবার তো আমাকে বাড়িতে যেতে দিন।”
স্পর্শ মনে মনে বলল,”কখনোই না ফুল তোকে এত তাড়াতাড়ি আমার থেকে দূরে সরতে দেব না। এতদিন পর তোকে পেয়েছি।”
কিন্তু মুখে বলল,
–“যতদিন না পর্যন্ত আমার প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে ততদিন তুমি আমার সাথেই থাকবে।”
–“আমার বাবার সাথে আপনার শত্রুতা কিসের একটু বলবেন??”
স্পর্শ ফুলের হাতে ব্রাশ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“অনেকদিন তো ব্রাশ করো না। এখন ব্রাশ করে নাও, নাহলে দাঁত পোকায় খেয়ে ফেলবে আর তুমি ভালো ভালো খাবার খেতে পারবে না যেগুলো একটু আগে আমার লোকেরা দিয়ে গেছে।”
বলেই স্পর্শ সমুদ্রের দিকে হাঁটা ধরল। ফুল কয়েকমিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি বলে গেল ছেলেটা??এক মুহূর্তের জন্য ফুলের স্পর্শর কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় ফুল ব্রাশ করতেই চাইতো না। ওর মা জোর করে ব্রাশ করাতো। ফুলকে খেপানোর জন্য স্পর্শ বলতো,”ফুল ব্রাশ না করলে দাঁত পোকায় খেয়ে ফেলবে আর তুই কিছু খেতে পারবি না। সব মজার মজার খাবার আমি একাই খেয়ে নেব।” বিনিময়ে ফুল স্পর্শকে ভেংচি কাটত। এভাবেই চলতো দুজনের খুনসুটি। ফুল বিড়বিড় করে বলল,
–“কেন জানি এই কিডন্যাপারের সাথে সেই মানুষটার অনেক মিল।এটা কিভাবে সম্ভব??”
ফুল আবার স্পর্শর পিছু পিছু দৌড় দিল। স্পর্শকে ডেকে বলল,
–“এই যে শুনুন আমি বাড়ি যাব। এখানে আমার একদম ভালো লাগছে না।”
স্পর্শ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
–“তো যাওনা??কে বারণ করেছে??”
–“কিভাবে যাব?? এখানে তো কোন বোট নেই??”
–“তাহলে সাঁতরে যাও।”
–“আমি সাঁতার জানি না আর তাছাড়া এতো বড় সমুদ্র কেউ সাঁতরে পাড়ি দিতে পারে নাকি??”
–“এতোই যখন জানো তাহলে অযথা বকবক করছো কেন??”
–“উফফ আপনি বড্ড অসহ্য।”
স্পর্শ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতেছে। ফুল স্পর্শের থেকে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতেছে। খুব বিরক্তি নিয়েই ফুল ব্রাশ করতেছে। স্পর্শ মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পর ফুলও ফিরে যায়। গিয়ে দেখলো স্পর্শ পা ভাঁজ করে বসে মাংসভাত খাচ্ছে। ফুল তাড়াতাড়ি ব্রাশ রেখে বলল,
–“এসব কি??”
–“কেন দেখতে পাচ্ছো না??”
–“হ্যা পাচ্ছি তো কিন্তু এসব ওনারা দিয়ে গেছে??”
–“তোমার সাথে কথা বলার সময় আমার নেই। যদি খেতে ইচ্ছে হয় তাহলে খাও না হলে চুপচাপ থাকো।”
ফুল আর কথা বলল না। চুপচাপ খেতে বসে গেল। আজ অনেকদিন পর ভাত খাচ্ছে। মোরগের কাবাব কলা ঘাসপাতা খেতে খেতে পেটে খিল ধরে গেছে ওর। খাওয়া শেষে ফুল ব্যাগ থেকে এক এক করে সব কিছু খুলে দেখতেছে। সবই ফাস্টফুড। ফুল নাক কুঁচকে বলল,
–“একি সবই তো ফাস্টফুড।”
স্পর্শ খেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল। ফুলের কথা শুনে উঠে বসে বলল,
–“তো তুমি কি ভেবেছিলে??ডালভাত??”
–“সেটা হলে তো ভালোই হতো।”
–“মাথায় কি তোমার একটুও বুদ্ধি নেই। এটা একটা দ্বীপ তোমার বাড়ি নয়। এখানে ফ্রিজ নেই কারেন্ট নেই যে খাবার ভালো থাকবে। আর ভাত,হুহ সেতো একদিন পরই পচে যাবে। তুমি কি পঁচা বাসি ভাত খাবে??”
ফুল মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো। স্পর্শ আবার শুয়ে পড়লো। ফুল নিজের মাথায় নিজেই হাত দিয়ে চাপড় মেরে বলল,
–“ছিঃ ফুল এটুকু বুদ্ধি নেই তোর মাথায়?? সত্যি তো ভাত তো একদিনের বেশি সময় থাকে না,পচে যায়। ধুর ধুর ধুর!!!”
🍁🍁🍁
বাইরে কড়া রোদ উঠেছে ফুল ঘরে বসে বসে নিজের ওড়নায় নিজেই গিট্টু দিচ্ছে আবার খুলছে। স্পর্শ ওকে ঘর থেকে বের হতে বারণ করেছে। তাই ফুল চুপচাপ বসে আছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে ফুল একইভাবে বসে আছে। কিন্তু এখন আর সহ্য হচ্ছে না তাই ফুল বেরিয়ে পড়লো। সমুদ্রের তীর বরাবর হাঁটছে ফুল। ঢেউগুলো ফুলের পায়ের তলা দিয়ে খেলা করছে ফুল সেটা উপভোগ করছে। হঠাৎ করেই ফুল দূরে স্পর্শকে দেখতে পেল। স্পর্শ কি যেন করতেছে। ভালো করে দেখার জন্য ফুল স্পর্শর সামনে গেল। স্পর্শ বাঁশ কেটে ভেলা তৈরি করতেছে। টিশার্ট টা খুলে কোমড়ে বেঁধে নিয়েছে। গায়ে অবশ্য একটা গেঞ্জি আছে। প্যান্টের পায়ের দিকের খানিকটা অংশ ফোল্ড করা। ফুল কে দেখেই স্পর্শ বলে উঠলো,
–“তুমি এখানে কেন?? তোমাকে না এখানে আসতে বারণ করেছিলাম।”
–“আমার বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না তাই এলাম। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন??”
–“ভেলা বানাচ্ছি।”
–“কেন??ওয়েট ওয়েট, তার মানে আমরা ভেলায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দেব। ওয়াও, আমার তো খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আপনি ভেলা কেন বানালেন?? আপনার লোকদের তো বোট আছে। শুধু শুধু কষ্ট করলেন। কিন্তু আমরা যদি ভেলায় চড়ে যাই, মাঝপথে গিয়ে যদি বড় কোন নীলতিমি এসে আমাদের ভেলাটা উল্টে দেয় তখন কি হবে?? আমি তো সাঁতার জানি না!!”
স্পর্শ এতক্ষণ ফুলের কথাগুলো শুনছিল। স্পর্শ ভেবে পাচ্ছে না একটা মেয়ে একদমে এতকথা বলে কিভাবে??স্পর্শ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–“তোমার বকর বকর করা শেষ হয়েছে?? তাহলে আমি আমার কাজে মন দেই।”
বলেই স্পর্শ আবার কাজে লেগে পড়লো। ফুল মুখটা গোমড়া করে বলল,
–“আমি কোথায় বকর বকর করলাম?? সত্যি কথাই তো বলছি। আপনি সবসময়,,,,,,,”
ফুল আর কিছু বলার আগেই স্পর্শ বলে উঠলো,
–“শাট আপ ফুল তুই আগের থেকে আরো বেশি বকবক করিস।”
ফুল সন্দিহান চোখে স্পর্শর দিকে তাকিয়ে বলল,
–“কি বললেন আপনি?? আমি আগের থেকে বেশি কথা বলি। আপনি কি করে জানলেন যে আমি আগে বেশি কথা বলতাম?? আপনি কি আমাকে আগে থেকে চিনতেন??”
স্পর্শ এবার আমতা আমতা করতে লাগলো। কি বলবে এবার ও। স্পর্শ একটু কেশে বলল,
–“আগে মানে তোমাকে যখন কিডন্যাপ করে এনেছিলাম তখন তুমি একটু কম কথা বলতে আর এখন একটু বেশি কথা বলো।”
–“কিন্তু মাঝেমধ্যে আপনি আমাকে তুই করে বলেন আবার তুমি বলেন এটার মানে কি??”
–“ও ও ওই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়।”
–“ওহহহ।”
–“তুমি যাও এখান থেকে আমি ভেলা বানাব।”
–“না আমি ভেলা বানানো দেখব।”
স্পর্শ আর কিছু বলল না ভেলা বানাতে মন দিলো। ফুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্পর্শর ভেলা বানানো দেখলো। স্পর্শ ভেলাটা সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে তার উপর উঠে দাঁড়ালো তারপর ফুলকে বলল,
–“ফুল চলো।”
–“কোথায়??”
–“তোমাকে ভেলায় চড়াই।”
–“না আমি সাঁতার জানি না পড়ে গেলে??”
–“আরে আমি তো আছি।”
–“আপনাকে দিয়ে আমার বিশ্বাস নেই। যদি ফেলে দেন পানিতে।”
–“মারার হলে তোমাকে আগেই মেরে ফেলতাম। বুঝেছো?? এখন তাড়াতাড়ি ওঠো নাহলে এই ভেলায় ভেসেই আমি এখন চলে যাব আর তুমি রবিনসনের মতো এখানে থেকে যাবে।”
ফুল ঘাবড়ে গেল। এই লোকটা যা বলে তাই করতে পারে তাই ফুল তাড়াতাড়ি স্পর্শের হাত ধরে ভেলায় উঠে দাঁড়ালো।খুব ভয় লাগছে ফুলের, ও স্পর্শকে ঝাপটে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শ মুচকি হেসে বাঁশের তৈরি বৈঠা দিয়ে বাইতে লাগলো। ফুলকে ভয় পাওয়ানোর জন্য স্পর্শ পা দিয়ে ভেলাটা দোলাতে লাগলো। ফুল ভয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল স্পর্শকে।
–“আপনি ইচ্ছা করে এরকম করছেন তাই না?? আমাকে ভয় দেখাতে এরকম করছেন??”
–“তুমি যেটা মনে কর। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে।”
কথায় কথায় অনেকটা গভীর পানিতে চলে এসেছে ওরা। স্পর্শ ফুলকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ফুল পিছনে ঘুরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই শিহরিত হয়ে উঠল ফুল। ওদের থেকে করেক মিটার দূরে ডলফিনের দল লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। এটা যেন প্রকৃতির এক অসম্ভব সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য দেখার জন্য অনেক মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। ফুল হা হয়ে চেয়ে আছে। কিন্তু এখন ওর মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। ও স্পর্শকে বলল,
–“তাড়াতাড়ি ফিরে চলুন এরা এখন আমাদের ভেলা উল্টিয়ে দেবে।”
–“আরে না। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো।”
–“না না না আপনি ফিরে চলুন তাড়াতাড়ি।”
–“ওকে ওকে। তুমি বসো এখানে। আমাকে এভাবে ধরে রাখলে আমি ভেলা কন্ট্রোল করতে পারব না।”
ফুল ভয়ে ভয়ে বসে পড়লো। স্পর্শ আপন মনে ভেলা চালাতে লাগলো। তখনই মাথার উপর দিয়ে শো করে একটা হেলিকপ্টার চলে গেল। ফুল উপরের দিকে তাকিয়ে হেলিকপ্টারের চলে যাওয়া দেখলো। কিছুক্ষণ বাদেই ওরা সেই দ্বীপে পৌঁছে গেছে। ফুল ভেলা থেকে নেমেই এক দৌড়ে চলে গেল। স্পর্শ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“আজব মেয়ে, এত সুন্দর দৃশ্য দেখালাম কোথায় একটা থ্যাঙ্কস জানাবে তা না করে উল্টো দৌড়ে চলে গেল। কবে তুই আমাকে বুঝবি ফুল??কবে আমাকে চিনতে পারবি?? অবশ্য চিনেই বা কি হবে??তোর আর আমার মাঝে যে শত্রুতার দেওয়াল তৈরি হয়েছে। এই দেওয়াল কখনোই ভাঙবে না। আমি কিভাবে তোকে কাছে পাব ফুল?? জানিনা এর শেষে কি আছে??”
রাতে তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় আসার সম্ভাবনা ও আছে। স্পর্শ খড়ের গাদা সরিয়ে মাটির উপর কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। ফুলের খুব শীত করতেছে। তাই সে আগুনের পাশে এসে বসল। হাত পা আগুনের উপর ধরে গরম করতেছে। ওড়নাটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে রেখেছে। স্পর্শ ফুলের দিকে তাকাতেই,,,,,,,,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,