#বুনোভাই
#পর্ব_২১
#লেখনিতে_তিথি_মজুমদার
ছয় বছর পর,,,,,,
আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের গ্যালভাস্টন শহরে গত দুই বছর ধরে মৃদুল আর মৃণালিনী রয়েছে।মৃণালের ডাক্তারি পড়া শেষ হওয়ার পর মৃদুল নিজের সাথেই তাকে নিয়ে আসে টেক্সাসে।এখানের গ্যালভাস্টনের একটা মেডিকেল কলেজেই মৃণাল তার ডাক্তারি প্র্যাক্টিস করছে।বেস্ট হার্ট সার্জন হিসেবে বেশ নাম ডাকও করেছে মৃণাল।আর মৃদুল সেও তার কর্ম জীবন নিয়ে অনেকটা সফলতা অর্জন করেছে।একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করার পাশাপাশি গ্যালভাস্টনের মতন শহরে নিজের একটা পাঁচতারা রেস্টুরেন্টের ব্যাবসাও আছে এখন।সব মিলিয়ে অর্থ,বৈভবের কোনো অভাব নেই তাদের,আর ভালোবাসা সেতো সময়ের সাথে সাথে যেনো আরো কয়েকশো গুন করে প্রতিদিন বাড়ছে।আজও তাদের দুজনের ভালোবাসার খুনসুটি গুলো দেখলে ভাববে ওরা হয়তো নিউলি ম্যারিড কাপল বাস্তবত কিন্তু তা নয় দীর্ঘ ছয় বছর নয় মাস বিবাহিত জীবন তারা পার করেছে।নানারকম চরাই উতরাই পার করে ওরা দুজন দুজনকে পেয়েছে।তাই হয়তো ওদের ভালোবাসা এখনো মলিন হয়নি।
অতীত,(বাংলাদেশ)
সেদিনের পরের সময় গুলো যেনো খুব দ্রুতই চলে গিয়েছিলো। মৃদুল-মৃণালীনি পরদিন সকালেই বাড়িতে ফিরে আসে।
বাড়িতে ফিরে আসতেই তার মা মোবাশ্বেরা আহমেদ অনেকটাই চমকে যায় তার সাথে মৃনালকে দেখে।তিনি কোনো প্রশ্ন করার আগেই মৃদুল তার বাবা-মাকে তাদের সম্পর্কের কথা জানায়।
এতে তার বাবা রাজি হলেও অনেকটাই ক্ষিপ্ত হয়ে যান মোবাশ্বেরা আহমেদ।তার মতে তিনি এমন কোনো মেয়েকে নিজের একমাত্র ছেলের বউ করবেন না,যার মা জন্মের সময়ই মারা গিয়েছে,যার বাবাও পর্যন্ত তাকে ত্যাগ করেছে,এমন অপয়া, অলক্ষুণে মেয়েকে তিনি কোনো মতেই ঘরের বউ করবেন না।
তিনি মনে মনে বিপাশাকেই নিজের ছেলের যোগ্য প্রাত্রী হিসেবে পছন্দ করেন।তাই বিয়ে যদি করতে হয় তবে বিপাশাকেই করতে হবে।
এমনকি তিনি এ নিয়ে প্রায় দুদিন নাওয়া খাওয়াও বন্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু তাতেও তিনি সফল হননি।নিজের জেদ আর স্নেহের মধ্যে তিনি স্নেহকেই বাছাই করে নিয়েছিলেন সেদিন।কারন পরিবারের অন্যরা বিশেষ করে রুপা তাকে অনেক করে বুঝিয়েছে যে তিনি যদি এখন সহসাই এই বিয়েটা না দেয় তাহলে মৃদুলকে তার চিরজীবনের মতন হারাতে হবে।কারণ মৃদুল প্রাপ্তবয়স্ক, চাইলেই নিজের একটা চাকরী যোগার করে মৃণালকে নিয়ে আলাদা সংসার পাততে পারে সে। আর মৃণালও এখন ডাক্তারি পড়ছে।ভবিষ্যতে তাদের আর কোনো কিছু নিয়েই চিন্তা নেই তাহলে মোবাশ্বেরা কেনো শুধু শুধু খারাপ হবে আর খারাপ হয়েও তো কোনো লাভ নেই কারণ মৃদুল যখন যা বলে তখন তাই করে।অবশেষে মোবাশ্বেরা বেগব কনবেন্স হয়েছিলো রুপার কথায়।তাইতো সেদিন সন্ধ্যায় মৃদুল-মৃণালীনির বিয়ে অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে হয়ে গিয়েছিল। এই অল্প সময়েই গ্রাম থেকে জমিরা বিবি,পলি ও তার বাবাও এসে উপস্থিত হয় এই বিয়েতে।পলিতো আগেই তপেশের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে অনেক খুশি হয়েছিল। কিন্তু মনে মনে একটু ভয়ও হচ্ছিল তার জেঠীমার জন্য। যাক সব বাঁধা বিপত্তির অবসান করে সেদিন পরিবারের সবার উপস্থিতি তে বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিলো।
জমিরা বিবিতো অনেক খুশি হয়েছিলেন সেদিন, অবশেষে তার নাতনীর বিয়েটা তিনি দেখে যেতে পেরেছেন তাও আবার তারই নাতির সাথে।
মৃদুল-মৃণালীনির বিয়ের পর পলির বাবা পলি আর তপেশের সম্পর্কের কথাটাও সবাইকে জানায়।পারিবারিক সিদ্ধান্তে তপেশ আর পলির বিয়েও আগামী মাসে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো মৃদুল এ বিয়েতে থাকতে পারবে না কারন তিনদিন পরেই তার ফ্লাইট ছিলো।
”
”
”
বর্তমান, (টেক্সাস)
গ্যালভাস্টনের হসপিটালের চেম্বারে বসে আছে মৃণাল। একটু আগেই সে হসপিটালে এসেছে।এতোদিন একটা মেডিকেল কনফারেন্স এর জন্য সে টেক্সাসের বাহিরে ছিলো।
”
”
অন্যদিকে বাহিরে প্রায় হুলুস্থুল কান্ড। এক বাংলাদেশি ছেলের মায়ের হার্ট ব্লক হয়ে গেছে।খুবই জটিলতা রয়েছে তার হার্টে যার জন্য ডাক্তাররাও রিস্ক নিতে চাইছে না।এদিকে ছেলেটা ডাক্তারদের উপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়বে এমন অবস্থা। হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ডরা অনেক কষ্টে তাকে সামলাচ্ছে।
এদিকে বাহিরে এতো চেচামেচি শুনে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে মৃণাল।সে আসতেই একজন নার্স তাকে সম্পূর্ণ ঘটনাটা খুলে বলল।তারপর মৃণাল ওই যুবক ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-মি.কাইন্ডলি আমি কী একবার আপনার মায়ের রিপোর্ট গুলো দেখতে পারি!
পরিস্কার কন্ঠে কথা গুলো শুনে একবার মৃণালের দিকে চোখ তুলে তাকালো ছেলেটি।তারপর কিছুটা বিরক্তিত হয়ে বলল,
-আপনাকে কেনো দেখাবো কে আপনি?
মৃণাল কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একজন নার্স বলে উঠলো,
-মি.চৌধুরী ওনি হচ্ছেন আমাদের হসপিটালের বেস্ট হার্ট সার্জন মিসেস এহমেদ। ওনি এতোদিন দেশের বাহিরে ছিলেন তাই আপনার মায়ের কেইসটা ড.গিভসন দেখছিলেন।
বেস্ট হার্ট সার্জন কথাটি শুনে চকিতেই চমকে গেলো ছেলেটি।তার অশ্রুসিক্ত চোখ যেনো হঠাৎই একটা আশার আলো দেখতে পেলো। সে দ্রুত মৃণালকে অনুরোধের সুরে বলল,
-মিসেস আহমেদ প্লিজ আপনি কিছু একটা করুন।পৃথিবীতে আমার মামু আর মা ছাড়া কেউই নেই।আমার মায়ের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার বেঁচে থাকাটাও মৃত্যু সমতুল্য হবে।প্লিজ মিসেস আহমেদ!
-ডোন্ট ওরি মি.চৌধুরী। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো বাকিটা আল্লাহর হাতে।
বলেই ছেলেটির হাত থেকে তার মায়ের সবগুলো রিপোর্ট নিয়ে নিজের ক্যাবিনে চলে যায় মৃণাল।যাওয়ার আগে সে ছেলেটিকে বলে যায় যে সে আগে সবগুলো রিপোর্ট দেখবে তারপর অপারেশন করবে কী না করবে তার সিদ্ধান্ত জানাবে।
”
”
মৈনাখ খুব হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে আসলো।সে রিসিপশনে আসতেই রিসিপশনিস্ট দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
-মি.চৌধুরী আপনি এখানে?
মৈনাখ অনেকটা উত্তেজনার সাথে বলল,
-আমার বোন এই হসপিটালে এডমিটেড।কাইন্ডলি একটু খোঁজ নিয়ে বলুন তো ওনি কোন কেবিনে আছে।
-অবশ্যই। আপনার বোনের নামটা প্লিজ বলুন মি.চৌধুরী। আর কোন সমস্যা নিয়ে উনি এডমিটেড সেটা বললে আরও সুবিধা হবে।
-মুনিরা চৌধুরী। হার্টের প্রবলেম নিয়ে এডমিট হয়েছে। গত দু’দিন আগে। আমি দেশের বাহিরে ছিলাম তাই আসতে পারনি।আজই এখানে ল্যান্ড করলাম আর সরাসরি এখানো চলে এলাম।
-ওও অনিশ চৌধুরীর মা তাইতো স্যার।
-হ্যাঁ হ্যাঁ কি অবস্থা এখন ওর।
-স্যার ওনার অবস্থা অনেকটাই সিরিয়াস ছিলো।অপারেট করাটা খুবই দরকার ছিলো।কিন্তুু করোনা মহামারীর কারনে আমাদের হসপিটালের বেশিরভাগ ডক্টর ই এখন বিভিন্ন ক্যাম্পে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।যার জন্য ওনাকে আমরা অপারেট করতে ভয় পাচ্ছিলাম।
-কি বলছেন এখন ওর কি অবস্থা।
পুরো কথা শুনেই চিন্তিত স্বরে বলল মৈনাখ।
-না না স্যার আগে পুরো কথাটা শুনুন।গতকাল সকালেই আমাদের এখানে অন্যতম একজন বেস্ট হার্ট সার্জন জয়েন করেছেন।ওনিও দেশের বাহিরে ছিলেন।কালই এখানে এসেছে।ওনি মিসেস চৌধুরীর সব রিপোর্ট দেখে অপারেশন এর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।কিছুক্ষণ আগেই ওটি শুরু হয়েছে স্যার।
-ওটি রুমটা কোনদিকে। আমি এক্ষুনি সেখানে যেতে চাই।
-মি.চৌধুরী আপনি আমার সাথে চলুন।আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।
”
”
”
ওটির বাহিরে পায়চারি করছে অনিশ।মনে মনে সে খুবই ভিত তার মায়ের জন্য। অপারেশনটা যেনো সাকসেসফুল হয় সে বারবার সেই দোয়াই করছে।
দূর থেকে অনিশকে দেখে একটু দ্রুতই তার কাছে হেঁটে এলো মৈনাখ।
-অনিশ,
-মামু তুমি।তুমি কখন এলে।
পিছন ফিরে বলল অনিশ।
-এইতো কিছুক্ষণ আগে।কি অবস্থা মুনিরার।আর ওকে কে অপারেট করছে।
-মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই মামু।আর মায়ের অপারেশন মিসেস আহমেদ বলে কোনো ডাক্তার করছেন।
-ওওওওও
———————————————————
-পলিথিন তোমার পেটটা তো পুরা বেলুনের মতন গোল হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
চোখ কটমট করে তপুর দিকে তাকালো পলি।
এদিকে পলিকে পাত্তা না দিয়ে তপু আবার বলল,
-আচ্ছা পলি বেবি তোমার পেটে কয়টা বাবু আছে।না মানে দিনকে দিন যেভাবে তোমার পেট ফুলছে আমার তো মনে হয় তুমি একবারেই একটা ফুটবল ম্যাচের টিম জন্ম দিয়ে দিবে।
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো তপেশ।
এদিকে পলি তার স্বভাব মতন তার আব্বু কে ডাকা শুরু করলো।
তখনই অনেকটা ভরকে গিয়ে খাট থেকে পড়ে গেলো তপু।
তপেশের পড়ে যাওয়া দেখে আব্বুকে ডাকা বাদ দিয়ে পলি এবার নিজেই হাহাহা করে হেসে উঠলো।
-তোমার এখনো বাবাকে ডাকার স্বভাব টা গেলো না পলি।
নিজের কোমর ঘষতে ঘষতে বলল তপু।
হাসতে হাসতে পলি বলল,
-তোমারও তো আগের মতন হুটহাট ধপাস করে পড়ে যাওয়ার অভ্যাসটা গেলো না।
পলির কথা শোনার পর দু’জনই দুজনের দিকে তাকিয়ে এবার এক সাথে হেসে উঠলো।
এভাবেই হাসি,কান্না, মান-অভিমান, খুনসুটি নিয়ে সংসার করছে পলি -তপু।
আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা পলি।এই প্রেগনেন্সি নিয়েই সারাদিন দুজনের মাঝে চলে নানা রকম ভালোবাসার খুনসুটি। পাঁচ বছরের সংসার জীবন অতিক্রম করে ফেলেছে দুজন তারউপর এখন নিজেরাও বাবা-মা হবে কিন্তু স্বভাবে এখনো নিজেরাই যেনো বাচ্চাদের হার মানায়।
———————————————————-
দুই ঘন্টা পর, (ওটির বাহিরে)
-মি.চৌধুরী অপারেশন ইজ নাও সাকসেসফুল। ঘন্টা দেড়েক পর আপনার মাকে কেবিনে শিফট করা হবে চাইলে তখন আপনি তার সাথে দেখা করতে পারেন।
-সত্যি বলছেন মিসেস.আহমেদ। আমার মায়ের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে!
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার ঋণ আমি কোনো দিনও শোধ করতে পারবো না।
-ইটস ওকে মি.চৌধুরী। আমি জানি একজন সন্তানের জীবনে তার মা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
-তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো মা।আজ তোমার জন্যই আমার অনিশটা এতিম হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলো।
মৈনাখের গলার স্বর শুনে অনেকটা চমকে যায় মৃণাল।চকিত সে পিছন ফিরে তাকায় তার দিকে। মূহুর্তেই যেনো তার পুরো পৃথিবীটা থমকে গেলো।অস্পষ্ট স্বরে সে শুধু একবার বাবা বলে ডেকে উঠলো মৈনাখ কে।
-কিছু বললে মা!
মৈনাখের মুখে মা ডাক শুনে বুকের ভিতর যেনো একটা হাহাকার ভর্তি অনুভূতি ছেঁয়ে গেলো মৃণালের মনে।তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো”বাবা, বাবা ও বাবা।তুমি আমায় চিনতে পারছোনা! আমি যে তোমার মেয়ে,মৃণালিনী। ”
কিন্তু ভাগ্য তার এতটাই অপ্রসন্ন যে সে তার বাবাকে বাবা বলে ডাকার অনুমতি টুকুও পায়নি কোনোদিন। আজ কতগুলো বছরপর সে তার বাবাকে সামনাসামনি দেখছে,লোকটার লম্বা, তবে গায়ের রং হালকা ময়লা,চোখে মুখে পড়েছে বয়সের ছাপ,তবুও তার মধ্যে যেনো আঠারো বছর আগেকার সেই মাঝবয়সী বাবাকেই দেখতে পাচ্ছে মৃণালের।তার এখন খুব ইচ্ছে করছে তার বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে, বুকের মধ্যে জমানো এতোদিনকার সকল কষ্টগুলোকে উপড়ে ফেলে দিতে।কিন্তু সে পারছেনা সেসব করতে কারণ সে যে হতভাগিনী, নিরুপায়!
-কি হলো মা তুমি হঠাৎ চুপ করে গেলে যে!
অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে সংবরণ করে মৃণাল বলল,
-তেমন কিছু নয়,আসলে আমি ভাবছিলাম এ পৃথিবীতে এমন অনেক হতভাগ্য সন্তান আছে যাদের বাবা-মা বেঁচে থাকতেও অনাতের মতন জীবন কাটাতে হয়।
বলেই সে দ্রুত গতিতে ওটির সামনে থেকে চলে গেলো।
এদিকে মৃণালের শেষ কথাটা যেনো অনেকটাই নাড়া দিয়ে গেলো মৈনাখকে।সেও তো একজন বাবা।তারওতো একটা সন্তান আছে,যার মুখটা পর্যন্ত সে কোনোদিন দেখতে চায়নি।তাহলে সে কি নিজের ভালোবাসায় এতটাই আচ্ছন্ন ছিলো যে নিজের পিত্রৃত্বের দায়িত্ব কে সে অবহেলা করেছে, নিয়ে নিজের উরসজাত সন্তানকে বন্ছিত করেছে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে!
নাহ্ নাহ্ সে আর ভাবতে পারছে না।তার স্নায়ুতে প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে, নিজের চুলের মুঠি মুষ্টি বদ্ধ করে সে বসে গেলো মেঝেতে। হঠাৎ করে মামার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো অনিশ।প্রবল বেগে দৌঁড়ে এসে সে ঝাপটে ধরলো মৈনাখকে।
—————————————————–
জ্ঞান ফেরার পর মুনিরা প্রথমেই অনিশকে দেখতে চাইলো।নার্স অনিশকে খবর দিতেই সে হন্তদন্ত হয়ে মায়ের কেবিনে ঢুকলো।
-মা,তুমি ঠিক আছো তো।
উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল অনিশ,
-হ্যাঁ বাবু আমি ঠিক আছি।তোর মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো রে,খুব কেঁদেছিলি বুঝি মায়ের জন্য।
জড়ানো কন্ঠে বলে মুনিরা।
-তুমি আর মামু ছাড়া কে আছে আমার এ পৃথিবীতে বল মা।আর তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলোতো।
-দূর পাগল ছেলে।এখন তো আমি ঠিক আছি তবুও কেনো কাঁদছিস।
-জানো মা আমি না খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আজ যদি ডক্টর মৃণালিনী না থাকতো তাহলে হয়তো আমি আর তোমাকে দেখতেই পেতাম না।ওনি একদম ফেরেশতার মতন এসে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মা।
অনিশের মুখে মৃণালিনী নামটা শুনে হঠাৎই চমকে যায় মুনিরা।মৃণালিনী এই নামটাকে খুব ভালো করে চিনে সে।কে এই মৃণালিনী কে?
-ডক্টর মৃণালিনী তার পুরো নাম কী রে বাবু?
অনেকটা নিস্তেজ গলায় প্রশ্নটা করলো মুনিরা।
-ড.নুসাইবা তাবাসসুম মৃণালিনী। সার নেম আহমেদ। এখানে ওনাকে সবাই মিসেস আহমেদ বলেই ডাকে।বুঝলে মা ড.মৃণালিনী যেমন ভালো ডাক্তার তেমনি ভালো মানুষ। কি অমায়িক তার ব্যবহার।এত বড় একজন ডাক্তার তবুও তার কোন অহংকার নেই।
অনিশ এক নাগারে কথা গুলো বলেই যাচ্ছে। কিন্তুু মুনিরার সেই দিকে কোনো খেয়ালই নেই।তার সমস্ত মনোযোগ চলে গেছে মৃণালিনী নামটার মধ্যে। তখনই অনিশ বলে উঠলো,
-ওহ্ তোমাকে উত্তেজনায় একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি। মামু আজ সকালে টেক্সাসে ফিরেছে।হসপিটালেও এসেছিলো।তোমার ওটি শেষ হওয়ার পর মামু হঠাৎই একটু অসুস্থ বোধ করছিলো তাই আমি মামুকে গাড়ি করে বাংলো তে পাঠিয়ে দিয়েছি।
মৈনাখে অসুস্থতার কথা শুনে চকিত তাকালো মুনিরা অনিশের দিকে।
-কি হয়েছে তোর মামুর হঠাৎ।
-জানি না মা।তবে,,,,,, আর তারপরই মামু কেমন একটা জানি করতে লাগলো।
ওটির বাহিরে মৈনাখ আর মৃণালিনীর কথোপকথন এর কথাটা বলল অনিশ।
এতোক্ষণ মুনিরা যে বিষটা সন্দেহ করেছিলো এখন তাই ঠিক হয়েছে।তাহলে এই মৃণালিনী। মৈনাখের মনে এতোগুলো বছর ধরে মুনিরা একটু একটু করে বিষ ঢুকিয়েছিলো।নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সে কি না করেছিলো।তার কটুক্তির জন্যই ওই মেয়েটার বাবা থাকতেও সে এতিমের মতন জীবন কাটিয়েছে। আর আজ কিনা সেই মেয়েই অপারেশন করে তাকে নতিন জীবন দান করেছে।আত্মগ্লানিতে নিজের দোহ,মন,স্নায়ু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছে মুনিরার।ক্ষণে ক্ষনে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে তা।মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে আজ তার মনে হচ্ছে এতোগুলা বছর সে যা করেছে তাকে পাপ বলে।নিজের সন্তানের সুখ কিনতে গিয়ে সে অন্য আরেকটি সন্তানকে তার হক থেকে বঞ্চিত করেছে।তাই হয়তো সৃষ্টি কর্তা তাকে এমন একটা রোগ দিয়েছে যার নিরাময় করতে সে বঞ্চিত মেয়েটার সাহায্যই তাকে নিতে হয়েছে। তার জীবনের এতো পাপ এতো গ্লানি সে মুছবে কি করে তাই ভাবছে সে।যে করেই হোক সে মৃণালিনী কে তার প্রাপ্য টা ফিরিয়ে দিবেই।এতে যদি সে সবার কাছে খারাপও প্রমাণিত হয় তবুও তার শান্তি অন্তত নিজেকে নিজে তো সান্ত্বনা দিতে পারবে এই বলে যে সে তার পাপ মোচনের চেষ্টা একবার হলেও করেছে।
—————————————————
কয়েক বছর পর,
-নানু ভাই এমন ভাবে দৌড়াতে নেই পড়ে যাবে তো।
-তুমি আমাকে ধরতে পারবে না পারবে না।
বলেই পুল সাইডে দৌড়াচ্ছে মিশু।
-আরে নানু ভাই আমি কি তোমার সঙ্গে পারি বলো আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি।আগের মতন তো আর পায়ে সেই জোর নেই।
হাপাতো হাপাতে বলে মৈনাখ।
কে শুনে কার কথা মিশু তো মিশুই। সে নিজের গতিতেই পুরো বাংলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
-মিশু নানুভাই এখানে এসো এই ফল গুলো খেয়ে নাও।
-আমি ফল খাব না, আমি এখন দৌড়াবো।
-দেখ মুনিরা ছেলেটা কি বিচ্ছু হয়েছে।আমাকে মানে এই মৈনাখ চৌধুরীকে ওর পিছনে দৌড় করে ছাড়িয়েছ।
-কি আর করবে বলো ভাইয়া,হাসতে হাসতে বলল মুনিরা।তবে আমি ওকে এখনি শান্ত করতে পারি।জাস্ট দুমিনিটের ব্যাপার এটা আমার কাছে।
-তাই বটে।দেখি দিলাম তোকে দুমিনিট করে দেখা তো মিশুকে শান্ত ছেলে।
তখনই মুনিরা তার সবসময়ই কার ট্রিকস টা ব্যাবহার করলো।
-মিশু তোমার মামনি কিন্তু আর কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে ঢুকবে।তখন কিন্তু আমি বলে দিবো তুমি আমার কোনো কথাই শোনো নি।তারপর বুঝবে মজা।
ব্যাস আর কি লাগে মিশুকে থামাতে।মায়ের আসার কথা শুনতেই দৌড়ে এসে ফলের প্লেট হাতে নিয়ে বসে পড়লো চেয়ারে।
-মিশু তো ভালো ছেলে তাই না মনি।মিশু তো তোমার সব কথা শুনে তাই না।এই যে দেখো মিশুর ফল খেতে একদম ভালো লাগে না। কিন্তু মনি বলেছে বলেই তো মিশু ফল খাচ্ছে। তাই না মনি।
মুখ কাচুমাচু করে বলল মিশু।
-হুম মিশু তো ভালো ছেলে তাইতো মায়ের নাম নিলেই সব কাজ করে ফেলে।
বলেই মৈনাখ মুনিরা হাসতে থাকে।
কয়েকবছর আগেও মৈনাখ এমন ছিলো না।সেদিন যখন মৃণালিনীর মুখে মৈনাখের কথা মৃদুল শুনেছিলো সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো বাবা মেয়েকে এক করার জন্য। অবশেষে তার চেষ্টা সফলও হয়েছিল এতে অবশ্য মুনিরা আর অনিশেরও অনেকটা অবদান ছিলো।মুনিরা নিজের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেছিলো মৈনাখের কাছে,তখনই মৈনাখ ছুটে যেতে চেয়েছিলো মৃণালিনীর কাছে কিন্তু কোন মুখে তিনি তার মেয়ের সামনে দাঁড়াবেন তা ভেবেই ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও তিনি নির্বাক হয়ে ছিলেন।পরে যখন মৃদুল এসে তাকে বুঝিয়েছিলো মৃণালিনী আজও তার বাবকে ফিরে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতিটি দিন গুনে,বাবার বুকে মাথা রেখে নিজের সুখ দুঃখের গল্প করতে চায় তখন আর মৈনাখ চুপ থাকতে পারেন নি।এক শীতের সকালে মৃদুলের বাংলো চলে আসেন তিনি।মৃণালিনী কে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন সেদিন তিনি,কেঁদেছিল মৃণালিনীও।এরপর থেকে মৈনাখ নিজের ব্যাবসার পুরো দায়িত্ব মৃদুল আর অনিশকে বুঝিয়ে দেন,আর মৃণালের অবসর সময়ের গল্প সঙ্গী হন তিনি।মুনিরা ক্ষমা চেয়েছিলো হাত জোড় করে মৃণালের কাছে।মায়ের বয়সী ফুফুকেও সেদিন ক্ষমা করে দিয়েছিলো মৃণাল।এরপর থেকেই মৈনাখ,মুনিরদ,অনিশ, মৃনালিনীদের সঙ্গেই থাকে।সব কিছু ঠিক হয়ে য়াওয়ার পরই মিশুর অস্তিত্বের জানান পায় সবাই।বাংলাদেশে মোবাশ্বেরা এ খবর জানার পর
তো সেই খুশি।অবশেষে তার ছেলের ঘরে একটা সন্তান আসবে সেই আনন্দে তিনি কি না করছেন।মিশুর জন্মের কয়েকমাস আগেই তিনি আর মঈনুল আহমেদ চলে আসেন টেক্সাসে।এভাবেই তিনি সুখে দুঃখে কেঁটে গিয়েছে কয়েকটি বছর।আজ দেখতে দেখতে মৃণাল দেশের নাম করা একজন হার্ট সার্জন হয়ে উঠেছে,মৃদুলের নিজের ব্যাবাসতেও পেয়েছে অনেক অনেক সাফল্য, মৈনাখ এখন তার বৃদ্ধ বয়সটা কাটাচ্ছে নিজের নাতির সঙ্গে হেসে খেলে,মোবাশ্বেরার মনে এখন আর মৃণালিনীকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই,বরং এ মানুষটিই তার প্রেগ্ন্যাসির সময় তাকে নিজের মায়ের মতন সামলিয়েছে।মুনিরাও এখন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য আজও সে আত্মগ্লানিতে ভুগে। রুপার মন অবশেষে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জয় করেছিলো হিমাদ্র।এখন তারও সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছে ইংল্যান্ডে।মৃন্ময়ী আজও আগের মতন উদাসীন, তবুও অনুজের তার প্রতি এতোটুকু ভালোবাসা কমেনি। সে সত্যিই ভালোবাসে মৃন্ময়ী কে সে তার যেমনই রুপ হোক না কেনো।পলি আর তপেশের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।সে এখন ক্লাস টু তে পড়ে।এখন পলি আবার দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট। বিপাশাও বিয়ে করেছে তার ভালোবাসার মানুষ টাকে।
”
”
সবাই যার যার জীবনে এগিয়ে গিয়েছে অনেকটুকু।শুধু এগোতে পারেনি বিশান,আর সিমি।মৃণালিনী কে যে বিশান কখন এতোটা ভালোবেসে ফেলেছিলো তা সে নিজেই বুঝতে পারেনি।তাইতো আজ মৃণালিনীর শূন্যতায় সে বদ্ধ পাগল।সে নিজের মনকে অনেক বুঝিয়েছিলো।কিন্তু তার বেহায়া মন বুঝতে চায়নি মৃণালিনী অন্য কারোও হতে পারে,সে অন্য কাওকে ভালোবাসতে পারে।তাইতো একাকি এক বদ্ধ ঘরে দিনের পর দিন সে আঁটকে রেখেছিলো পাছে মৃণালিনী যেনো কষ্ট না পায় এই ভেবে যে তার জন্য কেউ একজন কষ্টে আছে।নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে রাখতে রাখতে আজ সে পাগলা গারদের সেরা পাগল।এখানে সবাই ওকে পাগল প্রেমিক বলেই চিনে।আজও বিশানকে কোনো মেয়ে ভাইয়া বলে ডাকলে সে ক্ষেপে যার মৃণালিনীর সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনের মতন।সে ভাবে ওই মেয়েগুলো হয়তো তার মৃণালিনী। একদিন যে মৃণালিনী নাম শুনে বিশান রাবিন্দ্রনাথের মৃণালিনীর জরবন দূঃখের সাথে মিলিয়েছিলো আজ সে বিশানই মৃণালিনীর শোকে পাগল প্রেমিক হয়েছে। ।
“.
”
অন্যদিকে কোনো একদিন বিশান সুস্থ হয়ে ফিরবে সিমির কাছে সে আশায় আজও বসে আছে সিমি।সিমি ভাবে যদি তার ভালোবাসা সত্যি হয় তবে বিশান ফিরবে,অবশ্যই ফিরবে তার কাছে।তাকে যে ফিরতেই হবে। যেদিন বিশান সিমির ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারবে সেদিন আর সে মরীচিকার পিছনে ছুটবেনা,বরং সে ফিরে আসবে তার কাছে।
একতরফা ভালোবাসার যন্ত্রণায় দগ্ধ বিশান দগ্ধ সিমি।
পুনশ্চ ;বুনোভাই নামক মানুষটা না থাকলে হয়তো আমি আমি হতাম না।এই মৃণালিনী হয়তো হারিয়ে যেতো কোনো এক অজানায় থাকলেও হয়ত আজকের মতন আত্মতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকতাম না।এই বুনোভাই নামক মানুষটার জন্যই আজ আমি মৃণালিনী হতে পেরেছি।
—————————সমাপ্ত———————-