বুনোভাই,পর্ব:১৬+১৭

#বুনোভাই
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_তিথি_মজুমদার

১৬

অনেক চেষ্টা করেও মৃণাল সেই মুখোশধারী অজ্ঞাত ব্যাক্তিটিকে দেখতে পেলো না।তবে সে এতোক্ষণে এটা বুঝে গিয়েছে যে, সে যদি এদের সাথে সমঝোতা না করে তবে কখনও আর সে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেনা।এদিকে রাতও অনেক বেড়েছে।প্রথমে অতটা ভয় না পেলেও এখন তার মনে প্রচন্ড ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে।সে বুঝতে পারছে না কে হঠাৎ তাকে তুলে আনল,আর কেনোই বা সে তাকে বিয়ে করতে চাইছে।এখনও পর্যন্ত এদের কেউ ওর সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি,উল্টো মৃণাল যে ধরনের গাড়ামী করছে এরা যদি খারাপ কেউ হত তাহলে এতোক্ষণে ওকে আস্ত রাখতো না। তাই মৃণাল এতোটুকু নিশ্চিত যে এরা অন্তত ওর কোনো শারীরিক ক্ষতি করবে না।কিন্তু কে এই বস! কেনো সে তাকে এমন ভাবে বিয়ে করতে চায়।এসব ভাবতেই হঠাৎ মৃণালের মাথায় বিশানের নামটা এলো।তখনই তার মস্তিষ্ক সতর্ক হয়ে গেলো।কারণ তার এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেদিন যখন বিশান তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো তখন সে কী কী বলেছিলো।তাহলে এমন নয়ত যে বিশান সেই আঘাতটা নিতে পারেনি যার জেরে সে আজ তাকে এভাবে তুলে এনে বিয়ে করতে চাইছে।কিন্তু এ যে অসম্ভব কারণ সে তো এই এক জীবনে কেবল একজনকেই ভালোবাসেছে আর তার নামও সেদিন সে বিশানকে বলেছিলো।যদিও তখন মৃণাল জানতো না তারই ভালোবাসার মানুষটির সাথে বিশানের আদরের ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।যদি সে তা জানতো তাহলে সে কখনই তার ভালোবাসার মানুষটির নাম বিশানকে বলতো না।তবে কেনো আজ এমনটা করবে সে,প্রতিশোধ নিচ্ছে তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য।
কি করবে এখন সে, কিছুই বুঝছে না মৃণাল।এরই মাঝে তনু নামের মেয়েটি তাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে তবে এটাকে বিয়ের সাজ বলা চলে না।এই সাজ দেখে মৃণালের মনে হচ্ছে তাকে যেনো কোনো পার্টির জন্য সাজানো হয়েছে।সাদা রঙের গাউনের সাথে হালকা মেকাপে সাজানো হয়েছে তাকে।তবে এই সাদাময় সাজের মধ্যে মৃণালের চেহারায় সবচেয়ে বেশি যেটা ফুঁটেছে তা হলো চোখের নিচে গাড় কালো কাজল।হয়ত পুরো সাজটায় সাদার পরিমাণ বেশি থাকায় চোখের কোণের ক্ষুদ্র কালো রঙরা বেশি স্পষ্ট দেখাচ্ছে তার কাছে।নিজেকেই নিজের কাছে আজ অন্য রকম সুন্দর লাগছে তার।
সে কয়েকবার তনুকে প্রশ্ন করেছে এ ভাবে সাজানো নিয়ে,কিন্তু সে কেবল একটা উওর ই পেয়েছে,তা হলো-“আমি এসবের কিছুই জানি না,আমাকে যা যা করতে বলা হয়েছে আমি কেবল সেটুকুই জানি।”
বারবার একই উওর পেয়ে মৃণাল হাল ছেড়ে দিলো।



-কিরে মৃণালিনীকে কী সাজানো হয়েছে।

-জ্বি বস।আপনার কথামতই সব হচ্ছে।

-শালা এতো বস বস করতেছিস কেন,এখন কী মৃণাল আশেপাশে আছে!

-না বস,তবে দেয়ালেরও কান আছে।

-তাও ঠিক।তবে আজ তোরা আমাকে যেভাবে সাহায্য করলি তার জন্য আমি সত্যিই তোদের কাছে অনেক ঋণী।

-দূর শালা পাগল কোথাকার। আমরা আমরাই তো।এইখানে আবার কিসের ঋণ আর কিসের ধন্যবাদ দেওয়া শুরু করলি তুই।

-যাই বলিস দোস্ত তোরা না থাকলে আমি একা এসব কিছুই করতে পারতাম না।জীবনে যদি কোনোদিন তোর কোনো সাহায্যে আমি লাগতে পারি বলে তোর মনে হয় তাহলে তুই শুধু আমাকে একবার স্বরন করবি আমি বান্দা হাজির হয়ে যাবো দোস্ত।

-তা নাহয় দেখা যাবে পরে।এখন যেটার জন্য এতোকিছু করলাম সেটা শুরু করবি কখন।

-এইতো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু করবো।এখনো আরও পনেরো মিনিট সময় আছে হাতে।

-ওকে বস।
বলেই দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো।

—————————————————
একরাস বিরক্তি আর অস্বস্তি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মৃণাল।মনে মনে সে খুবই উদগ্রীব হয়ে আছে সেই অজ্ঞাত বসকে দেখার জন্য। কারন তনু যখন তাকে ঘর থেকে বের করে আনছিলো তখন সে তাকে বলেছে যে বাহিরেই মৃণাল তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।তাতে মৃণাল উচ্ছাসিত হলেও যখন তার চোখে একটা কালো কাপড় বেঁধে দেয়া হলো তাতেই তার যত অস্বস্তি আর বিরক্তির শুরু হলো।কিন্তু এই
অজ্ঞাত বস ব্যাক্তিটির সম্মুখীন হওয়ার এই একটি উপায়ই আছে।তাই সে চুপচাপ তনুর হাতে হাত রেখে সে বিনা বাক্য ব্যায়ে হেঁটে চলছে।হাঁটার মাঝেই সে বুঝতে পারলো তাকে ছাঁদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে তার এখন নতুন করে ভয়ের উদ্রেক হচ্ছে, আচ্ছা তাকে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে ছাঁদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দোওয়ার প্ল্যান করছে না তো এরা!হায় আল্লাহ তাহলে এটাই ছিলো ওই বেটা বসের মনে।এখন আমার কি হবে এখন শেষ কালে কিনা আমাকে এভাবে মরতে হবে,আমার স্বপ্নগুলো আর পূরণ হবে না,বাবার মুখোমুখি কী কখনোই দাঁড়াতে পারবো না,নিজের ভালোবাসার মানুষটির মুখও কী মৃত্যুর আগে দেখতে পাবো না এসব নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মৃণালের মাথায়।সিঁড়ির একেকটা ধাপ পার হচ্ছে আর তার মনে হচ্ছে সামনেই তার মৃত্যু ফাঁদ তৈরি হয়ে আছে যার থেকে বাঁচার কোনো উপায় তার জানা নেই।

কিছুক্ষণ পর,

হঠাৎ করেই তনু একটা সমতল জায়গায় এসে স্থির হলো আর মৃণালের হাতটিও ছেড়ে দিলো।মৃণালের হাত ছেড়ে দিতেই তার মনের ভিতরকার ভয় আরও তীব্র হলো।তাহলে কী সে যা ভেবেছে তাই হতে যাচ্ছে এখন।সব কিছু এভাবেই তাহলে শেষ হয়ে গেলো ভাবতেই তার গলায় কান্নার দলা পাকিয়ো গেলো।সে মনে মনে কালেমা আর বিভিন্ন দোয়া দূরুদ পরে বুকে ফুঁ দিয়ে মনে মনে মৃত্যুর জন্য যখন তৈরি হচ্ছিল তখনই পিছন থেকে কেউ একজন আলতো করে তার চোখের বাঁধন খুলে দিলো।চোখের বাঁধন খুলে দিতেই তার গলায় দলা পাকানো কান্না গুলো যেনো মূহুর্তেই চোখের পানি হয়ে গড়াতে লাগলো।এ সে কী দেখেছে,তাহলে শেষ পর্যন্ত এ মানুষটাই কিনা তার সাথে এমন একটা কাজ করলো,সে তো এ পৃথিবীতে এই মানুষটাকে অনেক বিশ্বাস করতো আর সেই মানুষটাই তার সাথে এমন করলো,কী করে করতে পারলো সে এমন কাজ ভাবতে তার বুক চিড়ে কান্না আসছে!

চলবে,,,,,,,,

#বুনোভাই
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_তিথি_মজুমদার

১৭

চোখের বাঁধন খুলতেই মৃণাল দেখতে পেলো তার সামনে বিশান হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে আছে। মূহুর্তেই তার পুরো পৃথিবী যেনো থমকে গেলো।তাহলে কী বিশান এখন তার প্রত্যাখ্যানের জবাব দিবে বলেই তাকে এখানে এনেছে! ভাবতেই তার ভিতরের কান্নার দলেরা বের হয়ে আসলো।
এদিকে মৃণালকে কাঁদতে দেখে অনেকটা চমকে গেলো বিশান।সে দ্রুত মৃণালের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-মৃণালিনী তুমি কাঁদছ কেনো?
বিশানের এমন কথা শুনে মৃণালের রাগ চড়ে যায়।

-আপনি সব জেনেশুনে কীভাবে এমনটা করতে পারলেন আমার সাথে শান!
আবার এখন জিজ্ঞেস করছেন আমি কাঁদছি কোনো, আপনি জানেন না আমি কেনো কাঁদছি? আপনি,,,,,,,

-আরে মৃণালিনী তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে আগে আমার কথাটাতো শুনবে,

-কি শুনবো আমি হ্যাঁ, আপনার সব কথা শুনার পর তো সেদিন আমি আমার উওর টা দিয়েই দিয়েছিলাম তারপরও আপনি এটা কোনো করলেন শান,,
কাতর কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলছে মৃণাল।

-কিন্তু তুমি,,,
পুরো কথাটা বলার আগেই মৃণাল বলল,

-আর কোনো কিন্তু নয়,আমি আর আপনার কোনো কথা শুনতে চাইনা শান।আপনাকে কী আমি সেদিন বুঝাতে পারিনি যে,আমি আপনাকে কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবো না।ইনফেক্ট এ জীবনে আমার পক্ষে বুনোভাইকে ছাড়া আর অন্য কোনো পুরুষকে ভালোবাসা সম্ভব নয়,আমি আপনাকে এ কথাটা বলতে বলতে আজ ক্লান্ত হয়ে গেছি শান।
কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছে মৃণাল।তার মাঝেই সে ছাঁদে বসে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো,

-এ জীবনে আমি শুধু বুনোভাইর হতে চাই,আমি যে তাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি,কিন্তু আফসোস সে কখনো আমার এই ভালোবাসা বুঝতেই পারবেন না,বা হয়ত বুঝেও না বুঝার অভিনয় করে যায় প্রতিদিন। কিন্তু আমি কেবল তাকেই ভালোবাসি, গভীর ভাবে ভালোবাসি।আমার বুনোভাইকে ভালোবাসি।

কথাগুলো বারবার আওড়াতে লাগলো মৃণাল।তখনই কোনো একজোড়া পুরুষালী হাত তাকে বুকে আঁকড়ে ধরলো।আর বলল,

-এতোটা ভালোবাসিস তুই আমাকে।কবে থেকে এতোটা ভালোবাসতে শিখেছিস তুই পিচ্চি। কখনো আমাকে বুঝতে পর্যন্ত দিস নি আমায়।
আকষ্মিক পুরো ঘটনাটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো মৃণালের। তারপর সে মৃদূলের বুকে মাথা রেখেই জবাব দিলো,

-যবে থেকে নারী-পুরুষের মাঝে ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি তবে থেকেই আপনাকেই শুধু ভালোবেসে গেছি।শুধু আপনাকে।

-তাহলে বলিস নি কেনো কোনদিন।

-কারণ আমি যে মেয়ে,আর মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফুটাতে নেই বুনোভাই।

-পাগলী একটা
বলেই মুচকি হাসলো মৃদূল।
তখন পাশ থেকে বিশান গলা খ্যাকারি দিয়ে বলল,

-আপনাদের ভালোবাসার মান অভিমান কী আজ মিটবে?

বিশানের কথা শুনে মৃণাল মৃদুলের বুক থেকে উঠতে নিলে মৃদুল তাকে বাঁধা দিয়ে বিশানকে মৃদূ রাগ দেখিয়ে বলে,

-দূর শালা কাবাব মে হাড্ডি হতে আসছিস কেন? দেখতেছিস না পিচ্চির সাথে প্রেম করতেছি।যা এখান থেকে!!!!

-ওকে বস।
বলেই হাসতে হাসতে ছাঁদ থেকে বিশান চলে গেলো।
এদিকে বিশান চলে যেতেই মৃণাল মৃদূলের বুক থেকে মাথা তুলে কথা বলতে নিলেই মৃদূল তার ঠোঁট আঙুল দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,

-হুশ্ এখন এই সময়টা শুধু তোর আর আমার।এখানে অন্য কোনো প্রসঙ্গে কথা বলা মানা।
বলেই মৃনালের দিকে আরও গভীর ভাবে তাকালো মৃদূল।মৃদূলের চাহনি দেখে লজ্জা পেলো মৃণাল সে দ্রুতই নিজের চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো।তখনই মৃদূল ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

-তোর ওই চোখের জল যখন কান্না হয়ে ঝরে পড়ে তখন তাকে কী বলে জানিস?
মৃদূলের কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় মৃণাল।মৃদূল আবার বলে,

-তখন তাকে অশ্রু বলে।আর সে অশ্রু সবার প্রথম যাকে স্পর্শ করে সে হলো তোর চোখের ওই গাড় কাজল। মৃণালের চোখের নিচের লেপ্টানো কাজল ছুঁয়ে বলে কথাটি।
-আর তোর সেই চোখের কাজল ছাড়াও তোর অশ্রুসিক্ত চোখ অন্য আরেকজন কেও স্পর্শ করে তা কি তুই জানিস।

মৃদূলের এই কথায় তার চোখের দিকে তাকায় মৃণাল।

-সেই অশ্রু মুছার সাথে সাথে চোখে পড়া কাজলও কিন্তুু মুছে যায়।

-তাহলে নাহয় আজ থেকে আমিই তোর চোখের কাজল হবো,যে কাজল কখনো মুছে যাবে না বরং সবসময়ই তোর চোখের জ্যোতি বর্ধন করবে।

-ক্ষিদে যেমন বুঝে নেয় খাদ্যের অধিকার।
তুমিও তেমন আমায় ভালোবেসো বারবার।

-এ দেহে প্রান থাকবে যতকাল, এ বুকে তোর থাকবে অধিকার, আমায় আপন করে নিজের মনের ঘরে শুধু জায়গা দে একবার।

বলেই মৃণালের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো মৃদূল।

-নিলাম অধিকার, দিলাম অধিকার। আজ থেকে আমি শুধুই তোমার বুনোভাই।
কথাটি বলতেই মৃণালকে আবার জাপটে ধরে বুকের মাঝে নিয়ে নিলো মৃদূল।তারপর আবার মৃণালের মুখ তুলে তার কপালে একটা ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়া একে দিলো।মৃদূলের ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে পরম আবেশে তার বুকে লজ্জায় মুখ লুকালো মৃণাল।
মুদূল তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

-আমার লজ্জাবতী মৃণালিনী!

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here