বেদনার রঙ নীল পর্ব -০৪

#বেদনার_রঙ_নীল
পঞ্চম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

বাড়িতে ঢুকেই প্রণয় ধাক্কা খেল মিউজিক প্লেয়ারের সাথে। ঠিক দরজার সামনে পুরনো এই মিউজিক প্লেয়ারটা রাখা। প্রণয় পা ডলতে ডলতে আরও ভেতরে আসতেই তার চোখ জুড়িয়ে গেল। ড্রয়িংরুমের সোফাগুলো উল্টে-পাল্টে পড়ে আছে। প্রণয়ের সাধের ল্যাপটপটাও দুই খন্ড। এই দৃশ্য দেখে প্রণয়ের হৃদয়টাও দুই খন্ড হয়ে যেতে চাইল। সে আফসোস ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মেঝেতে ধপ করে বসল। তখনি তার জিন্স ভিজে গেল। কারণ লালচে, আঠালো পদার্থ লেগে আছে টাইলসে। র/ক্ত নয়, এগুলো হচ্ছে টমেটো সস। একটুর জন্য সসের বোতলের কাঁচ চামড়ায় গেঁথে যায়নি। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

সে খুব ক্লান্ত ছিল। রান্নাঘরে ঢুকল পানি খেতে। সেখানকার অবস্থা আরও নাজেহাল। চারদিকে আটা-ময়দা, ডিম,মশলা ছড়িয়ে আছে। প্রণয় বাথরুমে পা ধুঁতে গেলেই পিছলে পড়ল। সাবান পানি ছড়িয়ে বিদঘুটে অবস্থা এখানে৷ শুধু কি তাই?এলইডি টিভির সামনের কাঁচ ভাঙা। থ্রিডি গ্লাস গুলো মেঝেতে পড়ে আছে। একটা পুরোপুরি ভেঙে গেছে আর বাকি তিনটা হয়তো ভাঙতে ভাঙতে কোনোমতে বেঁচে গেছে। বেঁচে যে গেছে সেটাই বিস্ময়ের। প্রণয় নিশ্চিত হলো মিষ্টি আপু আর ছোটমা কালরাতে একবারও বাড়ি আসেনি।

প্রণয়ের মেজাজটা আগেই খারাপ ছিল। আর এখন চরম খারাপ হয়ে গেল। কোথায় ভেবেছিল সারারাতের ক্লান্তি মুছতে এখন একটু শান্তিতে ঘুমাবে! কিন্তু এমন আস্তো একটা বাদর বাসায় থাকলে শান্তির আশা করাও পাপ।

প্রণয় রাগ নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে যেতে লাগল। তাদের বাড়িটা বেশ বড়। এই বড় বাড়ির মাত্র এক অংশ দেখেছে সে। বাকি তিন অংশের কি অবস্থা আল্লাহ জানেন। হঠাৎ এক টুকরো কাঁচ তার পায়ে বিঁধে গেল। পা থেকে খুব সাবধানে কাঁচটা খুলে নিয়ে আবার হাঁটতে লাগল সে। এবার খুব রাগ হচ্ছে। ওই ত্যাদরকে সামনে পেলে যে সে কি করবে! একবার তাকে ইচ্ছেমতো প্যাঁদানি না দিলে শান্ত হবে না প্রণয়ের মন। মাত্র একরাত কেউ বাড়িতে ছিল না তাতেই ঘরের এই হাল করেছে শান। ছোটমাও যে তার জন্যই হসপিটালে গেছে সেইটাও আন্দাজ করতে পারল প্রণয়। এমন বাদর ঘরে থাকলে পরিবারের সবাইকেই একবার না একবার হসপিটালে যেতে হবে।

আক্রমণাত্মক গতিতে শানের ঘরে যেতে নিয়েও থামল প্রণয়। শান এই সময় নিজের ঘরে কিছুতেই থাকবে না। প্রণয়ের ঘরে হামলা করাই তার প্রধান কাজগুলোর একটি। পুরো বাড়ি খালি পেয়ে সে নিশ্চয়ই এই কাজটা খুব আরামে করছে। কথাটা ভেবেই প্রণয় তার নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল।

তার ঘরের লক খোলা। যাওয়ার আগে ঘরটা লক করে গিয়েছিল সেটা মনে আছে প্রণয়ের। আর ঘরের চাবিও তার পকেটেই। কিন্তু ওই ইবলিশের বড়ভাই চাবি ছাড়াই লক খুলতে ওস্তাদ। প্রণয়ের শরীর রাগে কাঁপছে রীতিমতো। আল্লাহ মালুম কি অবস্থা করেছে তার ঘরটার!

প্রণয় পর্দা সরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকতেই চোখ গেল কম্পিউটারের স্ক্রিনে। পিসি অন করা। তবে কোনো ক্ষতি হয়নি। এই ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে নিতেই দেখল কিবোর্ডটা উল্টে পড়ে আছে মেঝেতে। মাথাটা অসম্ভব গরম হয়ে গেল এবার। আচ্ছা, শান পিসির পাসওয়ার্ড কোথায় পেল? এতোক্ষণে নিশ্চয়ই সব ফোল্ডার ঘেঁটে ফেলেছে, সর্বনাশ! প্রণয়ের আগুন গরম চোখ দু’টো আশেপাশে শানকে খুঁজছে। হঠাৎ উপরের দিকে নজর পড়তেই দেখল বাদর টা আলমারির উপর বসে মনের সুখে পা দোলাচ্ছে৷ তার চোখ দু’টো বোঁজা। হাতে একটা উকুলেলে। যেটা সে বাজানোর চেষ্টা করছে। ওই উকুলেলেটাও প্রণয়ের আলমারি থেকে নিয়েছে সে।

প্রণয় বিশাল গর্জন করে শানের নামটা উচ্চারণ করল। শানের হাত থেমে গেল। পা নাড়ানো বন্ধ হলো। চোখটা আলতো করে খুলে সে হঠাৎ লাফিয়ে বিছানায় নামল। তার হাতের উকুলেলেটা ছিটকে প্রণয়ের ঠিক কপালে এসে বারি খেল। প্রণয় ব্যথায় কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে প্রায় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল। কটমট করে বলল,” আজকে শান তুই শেষ!”
.

.

বিছানায় বসে হাঁটুতে মাথা রেখে কি যেন ভাবছে তুলি। তার লম্বা চুল গঁড়িয়ে পানি পড়ে অর্ধেক বিছানা ভিজে গেছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে অন্যমনস্ক হয়ে শুধু একটা কথাই চিন্তা করছে। ছেলেটাকে আবার কোথায় পাবে?

রাইফা বিরক্ত হয়ে তোয়ালে দিয়ে তুলির চুল মুছে দিতে লাগল।

” একটা বিষয় নিয়ে কতক্ষণ চিন্তা করবি তুলি? কি অবস্থা করেছিস নিজের খেয়াল আছে? জামাটা পুরো ভিজে গেছে। ওঠ, চেঞ্জ কর আবার। তারপর ব্রেকফাস্ট করতে যাব। ”

তুলি মাথা তুলে বলল,” আমার খুব আফসোস লাগছে রাফু৷ ইশ, যদি ফোন নাম্বারটা অন্তত রেখে দিতাম…”

রাইফা মৃদুভাবে ধমক দিয়ে বলল,” ওই ছেলের ফোন নাম্বার তুই কেন রাখবি? তুই মেয়ে না? মেয়েরা কখনও ফোন নাম্বার রাখে না। কই, ওই ছেলে তো তোর ফোন নাম্বার চাইল না!”

” আমার কাছে তো ফোনই ছিল না। এজন্যই হয়তো চায়নি।”

” শোন, এতো ভাবার কিছু নেই। তার যদি তোকে প্রয়োজন হয় তাহলে সে নিজেই খুঁজে বের করবে।বাড়ির ঠিকানা তো সে জানেই। ”

তুলি সরাসরি রাইফার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” আর যদি তার আমাকে প্রয়োজন না হয়?”

” তাহলে তোরও তাকে প্রয়োজন হওয়া উচিৎ না।”

তুলির মনটা ভার হয়ে গেল। সত্যিই কি উচিৎ না? রাইফা আর তুলি একসাথে ডাইনিংটেবিলে খেতে বসল। অনেকগুলো আইটেম। স্যান্ডওইচ, কফি, সসেজ,ডিম সিদ্ধ, পেস্ট্রি আবার আইসক্রিমও। ব্রেকফাস্টেই এতো আয়োজন দেখে অবাক হলো তুলি।এতো খাবার সে খেয়ে শেষ করতে পারবে কি-না জানেনা। রাইফা শুধু তার প্লেটে দিয়েই যাচ্ছে। তুলির খেতে নিয়ে হঠাৎ মনে হলো, এইভাবে আর কয়দিন?কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগল তার। মামার কাছে তো ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার নিজস্ব থাকার কোনো জায়গাও নেই। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর না হয় হোস্টেলে চলে যাবে। কিন্তু এই কয়েক মাস তো তাকে বান্ধবীর বাড়িতেই বসে খেতে হবে। তুলি এসব চিন্তা করতে করতে কফিতে চুমুক দিল। তারপর একটু নরম সুরে বলল,” আচ্ছা, রাইফা..”

রাইফা স্যান্ডউইচ মুখে নিয়ে বলল,” কি?”

” আমার এইভাবে থাকতে ভালো লাগবে না।”

” কিভাবে থাকতে?”

তুলি ইতস্তত করে বলল,” আমাকে একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে পারবি? ভালো কিছু টিউশনি হলেও চলবে। ”

রাইফা চোখ বড় বড় করে বলল,” চাকরি দেওয়ার আগে তোকে আমি থাপ্পড় দিবো৷ সামনে এডমিশনের কত প্যারা জানিস? পড়াশুনা করেই কুল পাবি না আর উনি এসেছেন চাকরি খুঁজতে। আগে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হো। ক্যারিয়ার সেট কর। তারপর চাকরি-বাকরি এমনিই আসবে।”

তুলি মাথা নিচু করে বলল,” তাহলে এতোদিন কি আমি তোর ঘাড়ের উপর বসে খাবো? বাড়িতেও তো আর ফিরতে পারবো না।”

রাইফা কিছু বলছে না। তুলি আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখল সে মুখের খাবারটা দ্রুত চিবানোর চেষ্টা করছে। অর্থাৎ মুখটা খালি হলেই তুলিকে বিশাল একটা ঝারি শুনতে হবে। তুলি অবশ্য ঝারি শোনার জন্য প্রস্তুত।

রাইফা পানিটা খেয়ে নিয়েই বলল,” ঘাড়ের উপর বসে কই খাচ্ছিস?? তুই তো টেবিলে বসে খাচ্ছিস। আর দরকার পরলে ঘাড়ের উপর বসেও খেতে পারিস। কোনো সমস্যা নেই। আমার সবকিছুই তোর। ঘাড়ও তোর। তেমনি আমি নিজেও তোর। আর কোনোদিন এসব কথা বললে ঠাটিয়ে চড় খাবি। এখনও ফ্রেন্ডকে আপন ভাবতে পারলি না। সেলফিশ কোথাকার!”

তুলি হেসে উঠে বলল,” এখানে সেলফিশ হওয়ার মতো কি বললাম?”

” চাকরি নিয়ে আমাকে একা ছেড়ে চলে যেতে চাইছিস। অথচ আমি কত স্বপ্ন দেখেছি তুই আমি দিন-রাত একসঙ্গে পড়াশুনা করে এডমিশন টেস্ট দিবো।”

তুলি হালকা হাসলো। এই মেয়েটা কেনো যে তাকে এতো ভালোবাসে!

” রাফু, তবুও কিছু একটা ব্যবস্থা করে দে না! আমার নিজেরও তো কিছু হাত খরচ লাগবে।”

রাইফা একটু ভেবে বলল,” এখন টিউশনি বা চাকরি করা তোর জন্য ঠিক নয়। তবে একটা চাইলেই করতে পারিস। ভালো ইনকাম হবে। কিন্তু কাজটা রিস্কি।”

” রিস্কি মানে?কেমন কাজ?”

” আমার এই মাত্রই মনে পড়লো। একটা বাচ্চা ছেলে আছে। আমাদের এলাকারই। নাম হল শান। আবরার শাদীদ শান। ছেলেটা ক্লাস সিক্সে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়ামের। সমস্যা হচ্ছে ছেলেটাকে কোনো টিচারই কন্ট্রোল কর‍তে পারে না। খুবই বাদর৷ খুউব! এক সপ্তাহের বেশি কোনো টিউটর টেকেনি। ওর মা তো হন্যি হয়ে টিউটর খুঁজছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এডভারটাইজও দিয়েছে। তুই যদি একবার ছেলেটাকে বাঘে আনতে পারিস তাহলে শুধু টাকা আর টাকা! ওরা কিন্তু অনেক বড়লোক।”

রাইফা হাতে তুরি বাজালো। তুলি উৎফুল্ল হতে নিয়েও হতে পারল না। কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। রাইফা বলল,” কি ভাবছিস? অফারটা নিবি?”

তুলি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,” আমি ভাবছি..যে ছেলের এক সপ্তাহের বেশি টিউটর টেকে না সে কত ডেঞ্জারাস হতে পারে?”

রাইফা এবার উচ্চশব্দে হাসতে লাগল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here