বেদনার রঙ নীল পর্ব -০৯

#বেদনার_রঙ_নীল
নবম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

একটা অচেনা মেয়ে এসে এইভাবে শার্ট টেনে ধরে রাখলে যতটা অস্বস্তিবোধ হওয়ার কথা প্রণয়ের তার চেয়েও বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। মেয়েটা কে? সে জানেও না। অথচ কি নির্লিপ্তে তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে! প্রণয় তাকে যত সরাতে চাইল তুলি যেন তত নিজেকে গুটিয়ে কাছে আসতে লাগল। অন্ধকার বাড়িতে এই মেয়েটা কি করছে এই প্রশ্নের উত্তরটা জানা দরকার সবার আগে। প্রণয় নিজের শার্ট ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,” আজব! কে আপনি? দেখি, ছাড়ুন।”

তুলি আকুতি ভরা টলমলে কণ্ঠে বলল,”অন্ধকারে আমি খুব ভয় পাই।”

” ঠিকাছে। আমি আলো জ্বালার চেষ্টা করছি। তার আগে আপনি আমাকে ছাড়বেন তো, নাকি?”

তুলি থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। মিনমিনিয়ে বলল,” ছাড়তে বলবেন না প্লিজ। মাঁকড়সাটা এখানেই কোথাও আছে।”

তুলি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রণয়ের শার্ট খামচে ধরেছে। প্রণয় ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,” মহাবিপদ তো! মাঁকড়সা কোত্থেকে আসবে? বাড়িতে কোনো মাঁকড়সা নেই।”

” আছে।”

” আমি বলছি, নেই।”

” কিন্তু আমি বলছি আছে!”

প্রণয় একটুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ ধমক দিল,” আপনি কি আমার থেকে বেশি জানেন? আমার বাড়িতে আমি তো কখনও মাঁকড়সা দেখলাম না!”

তুলি জবান দিল না এবার। প্রণয় কঠিন হয়ে বলল,” দেখুন আমার শার্ট যদি ছিঁড়ে তাহলে আমিই আপনার উপর মাঁকড়সা ছেড়ে দিবো।”

তুলি এই কথা শুনেই কেঁপে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে প্রণয়কে ছেড়ে একটু দূরত্বে দাঁড়ালো৷ প্রণয় হাঁফ ছেড়ে কুচকে যাওয়া শার্ট ঠিক করতে করতে বলল,” এবার বলুন, কি সমস্যা? আপনার পরিচয়?”

” আমি আবরার শাদীদের নতুন টিচার।”

প্রণয়ের এবার মনে পড়ল, আজ তো শানের টিচার আসার কথা ছিল! নানা ঝামেলায় ব্যাপারটা মাথাতেই ছিল না। তবে এখন বাকিটা প্রণয় নিজেই বুঝতে পারল। অন্ধকারেই সে তুলিকে আপাদমস্তক দেখল। লম্বা চুলের রোগা-পাতলা একটি অবয়ব। সে হেসে সামান্য উপহাস করে বলল,” ওহ, আপনিই তাহলে সুপার গার্ল? এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম ঘটনা!”

তুলি কিছু বলল না। সে আশেপাশে তাকাচ্ছে। প্রণয় প্রশ্ন করল,” শান পালিয়েছে, না?”

তুলি মাথা নাড়ল। প্রণয় বাঁকা হেসে বলল,” এইরকম পাখির আত্মা নিয়ে শানকে পড়াতে এসেছেন? আপনি তো প্রথমদিনই একদম কুপোকাত। কিন্তু এইটা তো সবে ট্রেইলার ছিল, ম্যাডাম। ফুল পিকচার এখনও বাকি। কি করবেন?”

তুলি আহত কণ্ঠে বলল,” আমি কিছুই করতে চাই না। শুধু এখান থেকে বের হতে চাই। উপরে শানের ঘরে আমার ব্যাগ আছে। সেটা নিয়ে আমি চলে যাবো।”

” একদিনেই হার মেনে যাচ্ছেন? মিষ্টি আপু যে কি দেখে নিয়েছিল আপনাকে…”

শেষ বাক্য প্রণয় বলল বিড়বিড় করে। তুলি কটমট করে তাকাল। অন্ধকারে অবশ্য তা বোঝা গেল না। প্রণয় ঠান্ডা গলায় বলল,” আপনি বসুন এখানে। আমি দেখছি কি করা যায়।”

” আমি বসবো না। আপনি যা করার দ্রুত করেন।”

” সার্কিট অফ করা হয়েছে। বাড়ির পেছনদিকে যেতে হবে।”

” আমাকে অন্ধকারে একা রেখে যাবেন?”

প্রণয়ের খুব হাসি পেল। নিজেকে ধাতস্থ রেখে বলল,” তাহলে চলুন আপনিও।”

বাড়ির পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে প্রণয় সার্কিটের সমস্যা ঠিক করার চেষ্টায় আছে। তুলি তার থেকে অনেকটাই দূরে দাঁড়ানো। হঠাৎ সে বলল,” একবার আমার দিকে তাকান তো। আপনি প্রণয় আহসান না?”

প্রণয় অবাক হয়ে তাকাল৷ ফ্ল্যাশ লাইট তুলির দিকে বাড়িয়ে ধরল। তারপর সবিস্ময়ে আওড়াল,” তুলনা সরকার?”

তুলি সবেগে মাথা নাড়ল৷ এবার দু’জনের ঠোঁটেই হাসি ফুটল। অকারণেই তারা কিছুক্ষণ হেসে নিল। তারপর তুলি বলল,” চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু এইরকম হবে আমি কখনও চিন্তাই করিনি। কি নাটকীয় ব্যাপার তাই না?”

প্রণয় রসিকতা করে বলল,” আমি চিন্তা করেছিলাম। আপনি ছাড়া এইভাবে চিৎকার করার ক্ষমতা কারো নেই। এইটা কিন্তু আপনার উজ্জ্বল প্রতিভা। সামলে রাখবেন।”

তুলি খুব রাগার চেষ্টা করল। কিন্তু অগত্যাই তার হাসি পেয়ে গেল। চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠল। আশেপাশে খুব বাতাস। দূর-দূরান্তেও কোনো আলোর রেখা নেই। বিশাল বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। আচ্ছা, পৃথিবীটা যদি হঠাৎ করে এমন আঁধার রাজ্যে ডুবে যেতো চিরকালের মতো তাহলে কি হতো? মানুষ কি বেঁচে থাকতে পারতো? একাকী দাঁড়িয়ে এইসব অদ্ভুত বিষয়ে চিন্তাই করতে লাগল তুলি। এই মুহূর্তে তার ভয়টা সাহসে রূপান্তর হয়েছে।

প্রণয় তাকে ডেকে বলল,” শুনুন, একটু আমাকে সাহায্য করলেও তো পারেন। মোবাইলটা এসে ধরুন। তাহলে আমার কাজে সুবিধা হয়।”

তুলি কাছে এগিয়ে এলো। পাশেই একটা স্টোর-রুম। দরজাটাও হাঁট করে খোলা। দশ মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা। তুলি হঠাৎ খেয়াল করল তার পা বেয়ে কিছু একটা উঠার চেষ্টা করছে। শরীর টা শিরশির করে উঠল। কি এমন জিনিস? মাঁকড়সার কথা মনে হতেই সে চিৎকার দিয়ে উঠল। তার চিৎকার শুনে প্রণয়ের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল অনায়াসে। যখন সে চিৎকারটা দিয়েছে তখন সে প্রণয়ের একদম কাছে। এতো তীক্ষ্ণ আওয়াজে কেউ চেঁচাতে পারে? প্রণয়ের মনে হচ্ছে তার কানের পর্দায় গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। পাঁচ সেকেন্ড পর তুলির চিৎকার থামল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রণয় মোবাইল খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় পড়েছে কে জানে? তুলি কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার সেই স্পর্শটা অনুভব করল। এবার তার মনে হলো সত্যিই মাঁকড়সা! আবার চেঁচিয়ে উঠে প্রণয়ের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।প্রণয় তাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল অনেকটা। আচমকা কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে তারা দু’জনেই ঢুকে পড়ল স্টোর-রুমের ভেতরে। প্রণয় চিৎ হয়ে একদম মেঝেতে শুয়ে পড়ল। কিন্তু তুলি উঠে গেল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কি হয়ে গেল কেউই যেন কিছু বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ তারা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ খুব তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হলো। দু’জনেই ঘুরে দেখল প্রবল বাতাসের ধাক্কায় স্টোর-রুমের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রণয় এক লাফে উঠে শব্দ করল,” ওহ, শিট!”

তুলি বলল,” কি হয়েছে?”

” দেখছেন না, দরজা লক হয়ে গেছে।”

” এবার?”

” এবার কি আর? আরও চিল্লান!”

” আমার চিল্লানোর জন্যই কি এমন হয়েছে নাকি? দরজা তো বাতাসে আটকে গেল।”

” মেয়ে মানুষের কাজই তর্ক করা।”

” আপনি যদি মেয়ে মানুষ কথাটা আরেকবার উচ্চারণ করেছেন তাহলে আমি কিন্তু…”

“কি করবেন?”

” চিৎকার করবো।”

” না, প্লিজ।” প্রণয় হাতজোড় করল।

তুলি শান্ত হলো। একটু পর প্রণয় ভ্রু কুচকে বলল,” আমার মোবাইল আর আপনি দু’টোই কি বিকর্ষিত জিনিস? যখনই আপনি সাথে থাকেন তখনি ফোনটা হারিয়ে যায়।”

তুলি চোখ বড় করে বলল,” এটা কি আপনার সেই দেড়লাখের ফোন? কিভাবে পেলেন?”

” আজমীরের কাছে ছিল। সে রেখে দিয়েছিল। ”

” ও আচ্ছা। আর গাড়ির কি অবস্থা?”

” গ্যারেজে আছে। কন্সট্রাকশন চলছে।”

” ওকে। অন্তত কন্ট্রাকশনের টাকাটা আমি দিতে চাই।”

” অবশ্যই দিতে পারেন। মাত্র পাঁচ-ছয়লাখেরই ব্যাপার।”

তুলি লজ্জিত হয়ে বলল,” থাক, মাফ চাই। যখন আমার অনেক টাকা হবে তখন দিবো।”

প্রণয় হাসতে লাগল। আবদ্ধ অন্ধকারে খুব শীঘ্রই তাদের গরম লাগা শুরু হলো৷ প্রণয় শার্টের বোতাম অর্ধেক খুলে ফেলল। তুলি নিজের চুল খোপায় বাঁধল। প্রণয় পায়চারী করতে করতে বলল,” এখনও কি কেউ বাড়িতে আসেনি? আমরা কতক্ষণ আটকে থাকবো?”

তুলি সরল কণ্ঠে জানতে চাইল,” কেউ না এলে কি আমরা এখান থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারব না?”

” কেউ না এলে কিভাবে বের হবো মিস তুলি? দরজাই তো খোলা যাচ্ছে না!”

তুলি বিরক্ত হয়ে বলল,” এই কথা আপনি আগে বলবেন না?”

” আগে বললে কি দরজা খুলে যেতো?”

” উফ!”

” এখন উফ করে কি হবে? সব তো আপনার জন্যই হলো। কি দরকার ছিল তেলাপোকা দেখে ওইভাবে হুড়োহুড়ি করার? ”

” আমি তেলাপোকা দেখিনি। শুধু মনে হয়েছে যে কিছু একটা আমার পা বেয়ে উঠছে।”

” ও। শুধু মনে হওয়াতেই এই অবস্থা? সত্যি হলে কি করতেন?”

” দেখুন, মজা নিবেন না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই অন্ধকার ঘরে কিভাবে বসে থাকব আমি? কতক্ষণ থাকব ?হে আল্লাহ!”

মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসল তুলি। খুব অস্থির লাগা শুরু হলো তার। সে আশঙ্কা নিয়ে বলল,” যদি টিকটিকি বের হয়? আপনি কখনও নীল মাঁকড়সা দেখেছেন? ”

” নীল রঙের মাঁকড়সা হয় না।”

” হয়। আমি কিন্তু দেখেছি। এত্তোবড় মাঁকড়সাকে পানির গ্লাসে সাতার কাটতে দেখলে কি করবেন আপনি?”

” পানিটা ফেলে দিবো!”

” আর মাঁকড়সা?”

” উঠিয়ে খেয়ে নিবো।”

” ছিঃ, ওয়াক! আপনি বিয়ার গ্রিলসের চেয়েও ভয়ংকর।”

প্রণয় চাপা স্বরে হাসছিল।তুলি দেয়ালে মাথা ঠেঁকিয়ে স্বগতোক্তি করল,” ও আল্লাহ, আমি তো পাগল হয়ে যাব। আমার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে আমি এখনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। প্রণয়, প্লিজ কিছু একটা করুন না। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে আমি মরেই যাব..”

প্রণয় ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠে বলে উঠল,” আগে আপনি চুপ করুন, আমাকে চিন্তা করতে দিন!”

তুলি কিছুক্ষণের জন্য চুপ হলো। প্রণয়ের মনে হয় এক কেজি তুলা কানের ভিতর ঢুকিয়ে রাখতেও তার এতো খারাপ লাগবে না যতটা তুলির চিকন গলার অনবরত বকবক শুনতে লাগবে। শব্দ দূষণ করেই যাচ্ছে মেয়েটা। তুলি আবার কথা বলল,” কোনো আইডিয়া পেয়েছেন? আমরা কি বের হতে পারবো?”

” না।”

তুলি হতাশ হয়ে তাকাল। হঠাৎ তার হাত পড়ে গেল একটা স্ট্যান্ডের উপর। সেখানে ছিল পুরনো যান্ত্রিক ফ্যান। সুইচ টিপলেই ঘোরে। প্রবল বাতাস হয়৷ তুলি অন্ধকার হাতড়েই সুইচ টিপল অকারণে। এবার বাতাসে স্টোর-রুমের ধুলোকণা উড়ে তাদের নাকে-মুখে ঢুকে যেতে লাগল। তুলি ছিটকে সরে এলো। প্রণয় চোখে হাত দিয়ে বলল,” কি করলেন এটা? বন্ধ করুন!”

” কিভাবে বন্ধ করব?”

” চালালেন কিভাবে?”

” বুঝতে পারছি না।”

” উফ!”

প্রণয় নিজেই গেল বন্ধ করতে। বাতাসে তুলির টকটকে লাল ওরনাটা গিয়ে পড়ল প্রণয়ের মুখের উপর। তুলি জোরে চেঁচিয়ে বলল,” আমার ওরনা…”

প্রণয় রেগে বলল,” আছে, উড়ে যায়নি। দিচ্ছি তো। ধৈর্য্য ধরুন। কথায় কথায় এতো চেঁচাবেন না। আপনার কণ্ঠ খুব ইরিটেটিং।”

তুলি আহত হলো। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল,” মানে আপনি বলতে চান আমার কণ্ঠ খারাপ? এই কণ্ঠ নিয়ে আমি কত ভালো গান গাইতে পারি সেটা কি আপনি জানেন?”

প্রণয় অত্যন্ত রূঢ়ভাবে বলল,” না, প্লিজ। জানতেও চাই না। এখন আবার গান শুরু করবেন না যেন। একবার উদ্ধার না হতেই আরেক বিপদে পড়তে চাই না।”

” আপনি আমার গানকে বিপদ বলছেন?”

প্রণয় জবাবে শুধু বলল,” হু বলছি।”

ঠিক সেই মুহূর্তে আলো জ্বলে উঠল চারিদিকে। আবদ্ধ স্টোররুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে সরু আলোর রেখা পড়ল তাদের মাঝখানে। দু’জনেই এবার দু’জনার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তুলি চোখ কটমট করে তাকাল। প্রণয় ওরনাটা তুলির হাতে দিল। তুলি একটু অস্বস্তি নিয়ে ওরনা গায়ে জড়াল।

প্রণয় জানালার কাছে গেল। কারেন্ট চলে এসেছে মানে শানও বাড়ি ফিরে এসেছে। জানালার গ্রিল ধরে উঁকি মেরে শানকে খুঁজছিল প্রণয়। মূল দরজার সামনে বড় গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। মানে ছোটমা আর মিষ্টিও চলে এসেছে। শান তার সাইকেলটা দরজার বাহিরে রেখে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। প্রণয় শানকে উচ্চশব্দে ডাক দিল,” ওই গ্রীনলাইট!”

প্রণয়ের গলার আওয়াজ শুনে আশেপাশে তাকাল শান। শব্দ কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারল না। কারণ সে ভাবতেও পারল না যে প্রণয় স্টোর-রুমের ভেতর থেকে তাকে ডাকবে।
প্রণয় আবার ডাকল,” এইযে এইদিকে, স্টোর রুমের জানালায় দ্যাখ।”

শান এতোক্ষণে প্রণয়কে দেখতে পেল। খানিকটা অবাক হয়ে জানালার কাছে এসেই কৌতুহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল, ” তুই এইখানে কেনো ভাইয়া?”

প্রণয় ঠান্ডা গলায় হুমকি দিল,” আগে দরজাটা খোল, তারপর বোঝাচ্ছি তোকে।”

” এই দরজা আমি কিভাবে খুলবো? আর এইটার ভিতরেই বা ঢুকলি কেন তুই? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

” কাবাডি খেলতে খেলতে ঢুকেছিলাম। এবার দরজা খোল।”

” কাবাডি? কার সাথে?”

প্রণয় গরম চোখে তাকিয়ে আছে। শান নরম সুরে বলল,” কিন্তু আমি কিভাবে দরজা খুলবো?”

“আমার রুমের লক করা দরজা খুলে ফেলতে পারিস। এইটা কি তোর মতো বিচ্ছুর কাছে কোনো ব্যপার?”

শান কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো। তারপর হুট করে বলল,” সেফটি পিন হবে?”

প্রণয় ভাবুক স্বরে উচ্চারণ করল,” সেফটি পিন!” তারপর সে তুলির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,”সেফটি পিন হবে?”

প্রণয়ের কথায় শানও জানালার ভেতর উঁকি মেরে তুলিকে দেখল। উল্টোদিকে ঘুরে বসে আছে তুলি। প্রণয়ের কথার উত্তর দিতে সে নারাজ।

শান বলল,” ওহ মাই গড! শী ইজ হেয়ার? আপু তোর সাথে এইখানে কি করছে ভাইয়া? কাবাডি!”

প্রণয় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” হ্যাঁ। আমার সাথে কাবাডি খেলছে। তোর কোনো সমস্যা?”

শান চোখমুখ কুচকে বলল,”কিন্তু কাবাডিই কেন?”

তুলি মাথা থেকে ববি পিনটা খুলে জানালার দিকে দিয়ে বলল,” এইটা দিয়ে চলবে, শান?”

শান হাসি মুখে বলল,” পারফেক্ট!”

দুই সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। প্রণয় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে শানকে উদ্দেশ্য করে বলল,” গ্রীনলাইট, তোর ম্যাম কে বল উঠে আসতে। বলা তো যায়না! অন্ধকারে কোথ থেকে তেলাপোকা, টিকটিকি বেরিয়ে আসবে! তারপর দেখা যাবে চিকন গলায় চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। এমনিতেই ছোটমার লো প্রেশার। এই চিৎকার শুনলে তো ছোটমা নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে। ”

শান বলল,” আপু,ভাইয়া আপনাকে উঠে আসতে বলছে। নাহলে…”
তুলি বলল,” তোমার ভাইয়াকে বলে দাও আমার চিৎকার যদি তার এতোই অসহ্য লাগে তাহলে যেন এখন থেকে সবসময় কানে তুলা গুঁজে রাখে।”

” ভাইয়া, তোকে বলছে কানে তুলা গুঁজে রাখতে।”

” এখন তুলো কোথায় পাই বলতো? ওর কাছে আছে নাকি? নিজের বিদঘুটে আওয়াজের জন্য কি সে মানুষকে তুলো সাপ্লাই দিয়ে বেড়ায়? এক্সকিউজ মি, আমার চিৎকার না খুব সাংঘাতিক! অকারণে চিৎকার করতে আমার ভালো লাগে। তাই সেফটির জন্য সবাই তুলো সাথে রাখুন।”

শান খুব জোরে হেসে বলল,”আপু আপনার কাছে কি তুলা আছে?”

তুলি চোখমুখ শক্ত করে বলল,” আমার চিৎকার শুনে এর আগে কেউ কখনও বিরক্ত হয়নি। আর মানুষের বিপদে কানে তুলো গুঁজে রাখা কোনো বাহাদুরির কাজ না। তাই আমার কাছে তুলো নেই।”

” ওকে। ভাইয়া, আপু বলছে…..উফফ আমি বুঝতে পারছি না কথাগুলো আমি বার-বার রিপিট কেনো করছি? তোরা কি একজন-আরেকজনের কথা শুনতে পাচ্ছিস না?”

প্রণয় সটান করে শানের গালে একটা রামচড় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। গালে হাত রেখে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল শান। তাকে মারার জন্য হাজারটা কারণ থাকলেও নির্দিষ্টভাবে কোন কারণটার জন্য প্রণয় তাকে চড় মারল, সেটাই বুঝতে পারছে না সে। প্রণয় বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তুলিও উঠে লাল ওরনাটা গলায় জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার সময় আবার শানের দিকে তাকিয়ে বলে গেল,” বেশ হয়েছে মেরেছে! বাজে ছেলে একটা!”

শান এখনও গালে হাত রেখেই দাঁড়িয়ে আছে। ঝগড়া করছিল তারা দু’জন। কিন্তু রাগ ঝারা হলো শানের উপর। সো স্যাড! তবে এই দুইজন ঠিক কোন কারণে এইরকম ফুলে পাম্প হয়ে আছে? জানতে পারলে ভালো হতো। মিষ্টি দূর থেকে শানকে ডাকল। শান ছুটে গেল।
” কি হয়েছে ভাই? মুখটা এমন বানিয়ে রেখেছিস কেন?”

শান ঠোঁট উল্টে বলল,” আমি একটা ইকুয়েশন নিয়ে চিন্তা করছি।”

মিষ্টি চোখ গোল করে বলল,” ইকুয়েশন? মানে ম্যাথস? ও বাবা!”

শান বিড়বিড় করে বলল,” রেডলাইট আর মিস কিউটিপাইয়ের ব্যাপার-স্যাপার বোঝার চেষ্টা করছি। ইটস টু কমপ্লিকেটেড ইকুয়েশন।”

” ভাই আর মিস কিউটিপাই? কিন্তু মিস কিউটিপাই আবার কে?”

“তুলি আপু।”

” তুলির নাম মিস কিউটিপাই হলো কবে থেকে? ”

” আজকে থেকেই। এই নাম আমি রেখেছি। শী ইজ সাচ আ ইনোসেন্ট গার্ল!”

মিষ্টি আগ্রহপূর্ণ গলায় বলল,” আচ্ছা তাই? তোর তুলিকে ইনোসেন্ট কেন মনে হলো?”

শান পকেট থেকে আর্টিফিসিয়াল মাঁকড়সাটা বের করে মিষ্টির মুখের সামনে ধরে বলল,” এইটা দেখে সে ভয় পায়। একদম কিডসের মতো।”

মিষ্টি ছোটখাট একটা চিৎকার দিয়ে উঠল,”এইটা কি জিনিস শান? এইটা দেখলে তো যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।”

” ইয়াহ রাইট, বাট সে একটু বেশিই ভয় পায়। আই থিংক, শী হেজ এরাখনোফোবিয়া।”

” এরাখনোফোবিয়া আবার কি?”

” যারা মাঁকড়সা খুব ভয় পায় তাদের রোগের নাম এরাখনোফোবিয়া। মিস কিউটিপাইয়ের আছে সেই রোগ। আমি ড্যাম শিউর।”

” প্রথমদিনই টিচারের উইক পয়েন্ট বের করে ফেলেছিস? এসব তোর দ্বারাই সম্ভব ফাজিল!”

মিষ্টি শানকে একটা গাট্টা মারতে যাচ্ছিল। এর আগেই শান দ্রুত মাঁকড়সা পকেটে ভরতে ভরতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here