#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব৫
পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।বাম হাতে কপাল চেপে ধরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আকাশের দিকে অনুভব করছে কিছু একটা হতে যাচ্ছে।বিদ্যুৎ চমকে চারপাশে খন্ড খন্ড আলো দিচ্ছে।মেঘের তুমুল শব্দে বুক কাপছে তার।এই নির্জন রাস্তায় মেঘের শব্দে বেশ ভয়ে চিন্তায় পরেছে জেরিন।বিচে এসে ফিরবে ফিরবে করে এত দূর চলে আসা একাই।সন্ধ্যায় সমুদ্রের ঢেউ দেখে বেশ মুগ্ধ হচ্ছিল জেরিন।যখন মস্তিষ্ক জানান দিলো, রিসোর্টে ফেরা দরকার তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘড়িয়ে রাত।বেশি অবাক তখন হয়েছে যখন রাস্তায় এসে অনুভব করে একটা গাড়িও নেই।এখন রিসোর্টে ফিরবে কিভাবে সে?চিন্তায় কপালে হাত দিলো জেরিন।ফোনের শব্দে একটু চমকে উঠে।কাপা কাপা ব্যস্ত আছে ব্যাগ থেকে ফোন বেড় স্ক্রিণে তাকালো। শাওনের ফোন পেয়ে দ্রুত রিসিভ করে কানে দিলো,
—-“কিরে দোস্ত, কি করছিস?”
জেরিন একরাশ চিন্তা নিয়ে বলে,
—-“রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। ”
শাওন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
—-“তোকে রিসোর্ট থেকে বেড় করে দিয়েছে নাকি?রাস্তায় কি করছিস এই রাতে?”
জেরিন হতাশ গলায় বলে,
—-“রিসোর্ট থেকে অনেকটা দূরে একটা সুন্দর বিচে এসেছিলাম রে।কখন যে সময় চলে যেয়ে রাত হলো বুঝতে পারিনি।কিন্তু রাস্তায় এসে একটা গাড়ি দূর মানুষ ও দেখছি না।”
শাওন তাৎক্ষনিক অস্থির হয়ে বলে,
—-“ওহ সিট!মামা এখানে তো কিছুই পাবি না এখন।বখাটে ছেলে গুলো তো রাতেই বেড় হয়।তুই যে কি করলি না!দেখ,আশেপাশে কোনো গাড়ি দেখিস কিনা।”
চারপাশে প্রচুর বাতাস শুরু হয়েছে।বিশাল বিশাল গাছ গুলো শব্দ করে দুলছে। গায়ের ওড়না ও ভেসে যাচ্ছে হাওয়াতে।অনেকটা সময় অপেক্ষা করেও কিছু দেখতে পেলো না।শাওন ভ্রু কুঁচকে বলে,
—-“কিরে কিছু পেলি?”
জেরিন বিরক্ত হয়ে বলে,
—-“একটা গাড়িও নেই ভাই।আর…”
কথার মাঝেই বন্ধ হয়ে গেলো ফোন।কয়েক বার হ্যালো বলেও শব্দ পেলো না ওপাশের।চোখের সামনে ফোন এনে বন্ধ হিসেবে আবিষ্কার করল জেরিন।রাগে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।রিসোর্টে না গেলে কি হবে আজ?রাস্তার ওপাশে দু-একটা বখাটে ছেলে কয়েক বার তাকিয়ে হাসলো।ভয়ে জেনো প্রাণ যায় যায় জেরিনের।
.
.
.
.
চলন্ত গাড়ি মাঝ হঠাৎ থেমে গেলো।স্পর্শ কপালে ভাজ ফেলে ড্রাইভারের দিকে তাকাল।পিএ সাদ ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
—-“গাড়ি থেমে গেলো কেনো?”
ড্রাইভার বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
—-“জানি না স্যার।আমি দেখছি কি হয়েছে।”
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে গেলো।অনেকটা সময় হওয়ার পর স্পর্শ গম্ভীর মুখে বলে,
—-“কি সমস্যা মুকবুল?”
ড্রাইভার বেশ ভয়ে ভয়ে নিচুস্বরে বলে,
—-“স্যার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না।মনে হচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে।এখন ঠিক করাতে হলে অনেক সময় লেগে যাবে।”
স্পর্শ কিছুটা উঁচু গলায় বলে,
—-“মানে কি মুকবুল?তুমি আগে সব দেখে রাখনি কেনো?এখন কিভাবে যাবো আমি?”
স্পর্শ গাড়ি থেকে নেমে আসে।পিএ সাদ নিচুস্বরে বলে,
—-“স্যার সামনেই একটা স্টান আছে। সেখানে গেলে গাড়ি পাওয়া যাবে।আপনি বরং স্টানের দিক যেতে পারেন।আমি গাড়ি সারিয়ে সকালের আগেই চলে আসবো।”
স্পর্শ গাল ফুলিয়ে নিশ্বাস ফেলল।গাড়ি থেকে কোট হাতে নিয়ে হাটা ধরলো।আকাশের অবস্থা বেশ ভালো না।ঝড় হবে হয়তো রাতে।মেঘের গর্জনে স্পর্শ হেটে চলেছে।”স্টান” নামক কোনো স্থান খুজে পেলো না স্পর্শ।বিরক্ত নিয়ে ফোনে সাদকে কল দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু বৃথা গেলো চেষ্টা।কানে ভেসে এলো সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন।এদিক ওদিক তাকিয়ে সারি সারি নারকেল গাছের ফাকে ফাকে রাতের সমুদ্র খুজে পেলো।ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে সমুদ্রের দিকে চোখ স্তির রাখলো। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেলো স্পর্শ। সমুদ্র থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে চোখ ঝলঝল করে উঠে।চোখে বিস্ময় নিয়ে ভালো করে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখলো।স্পর্শ বিস্মিত গলায় বলে,
—-“আরে আপনি এখানে?”
জেরিন চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ফেলল।দম নিয়ে কাপা কাপা কন্ঠে বলে,
—-“থাংক গড! আপনি চলে এলেন এখানে। আমি খুব ভয় পেয়েছি।”
স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে তাকাল।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বুঝতে পারল পিছনে থাকা কয়েকটা বখাটে ছেলে দাঁড়ানো। স্পর্শ জেরিনের এই অস্থিরতা কমাতে এক হাতে জড়িয়ে ধরে।ধির কন্ঠে বলে,
—-“আমি এসে গেছি ম্যাডাম।কিন্তু আপনি কি করছেন এই রাতে?পালাচ্ছেন নাকি আবার?”
জেরিন নিজেকে ছাড়িয়ে একটু স্তির হয়ে বলে,
—-“পালাবো কেনো?বিচে ঘুরতে এসে ছিলাম।জায়গাটা খুব সুন্দর তাই যাবো যাবো বলে রাত হয়ে গেলো।রাস্তায় এসে কিছু খুজে পেলাম না।”
স্পর্শ হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“তাই বলে এতো দূরে? আপনি জানেন এখান থেকে রিসোর্ট ২ ঘন্টার দুরত্ব? মিটিং শেষ করে মাঝ পথে এসে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলো।সেই কখন থেকে হাটলাম তবুও গাড়ি পেলাম না।”
জেরিন চিন্তিত হয়ে বলে,
—-“তাহলে এখন কি করবো?রিসোর্ট ফিরবো কিভাবে?”
স্পর্শ হাত ঘড়িতে সময় দেখলো ৯ঃ০০টা বাজে।এদিক ওদিক তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
—-“একটু হেটে দেখি চলুন।”
জেরিন কিছুক্ষণ স্পর্শের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।ক্লান্ত তবে স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।ভরসা করা যায় বলে মনে হলো।মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।স্পর্ধা মৃদু হেসে হাত সামনে বাড়িয়ে চলতে ইশারা করল।১০মিনিট চলার পর শুরু হলো তুমুল ঝড়।বাতাসের বেগ বাড়তে লাগে।গাছ পালা জেনো ভেঙে যাবে আজ।মেঘের শব্দ জেনো বিশাল আকাড় ধারণ করছে।ভয়ে বার বার কান চেপে ধরছে জেরিন।স্পর্শ কিছুটা কানের কাছে ঝুকে বলে,
—-“এখানে গাড়ি খুজে পাওয়া যাবে না। খুজে পেলেও বাতাসের কারণে নির্ঘাত উল্টে যাবো।”
জেরিন অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো।কথার মাঝেই ঝুম বৃষ্টির আগমন হলো।মুহূর্তেই আধভেজা হয়ে গেলো দুজন।স্পর্শ হাতে থাকা কোট দুজনের মাথায় ধরে জেরিনের হাত ধরে ছুটতে থাকে।আকস্মিক কাজে জেরিন কিছুট অপ্রস্তুত হয়ে স্পর্শের উপর চোখ দিলো।ছুটতে ছুটতে শিতল কন্ঠে বলে,
—-“মিস এখানে গাড়ি খুজতে হবে না।আপাতত আশ্রয় দরকার।”
জেরিন ঠিক শুনলো কিনা স্পর্শ জানে না।অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো জেরিন।গাছের ফাকে রাস্তার পাশেই জ্বলতে দেখা গেলো একটা ছোট্ট ধাবার মতো হোটেল। হাত ধরে সেদিকেই গেলো দুজন।জেরিন স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আলতো কন্ঠে বলে,
—-“এখানে এলাম কেনো আমরা?”
স্পর্শ আস্তে করে বলে,
—-“বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে।যদিও জানি না আমাদের থাকতে দিবে কিনা।আপনি চুপ করে থাকবেন কেমন?”
জেরিন উত্তর দিলো না।স্পর্শ দরজায় কয়েক বার শব্দ করল।কিছু সময় পর একজন বয়ষ্ক মুরুব্বি লোক দরজা খুলে দিলো।সাথে মাঝারি বয়সের একটা ছেলে।দুজনকে দেখে ভদ্র লোক প্রশ্ন করল,
—-“কি চাই?কে তোমরা?”
স্পর্শ শান্ত ভাবে বলে,
—-“জ্বি আমাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। বাইরে প্রচুর ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।কোনো গাড়িও খুজে পেলাম না।”
লোকটার পাশে থাকা ছেলেটা ভদ্রভাবে বলে,
—-“বাবা এই রাতে গাড়িও পাবে না। ”
জেরিন চিন্তিত চোখে স্পর্শের দিকে তাকাল।স্পর্শ বেশ অনুরোধ করে বলে,
—-“এই রাতে মেয়ে নিয়ে রিসোর্টে ফিরে যাওয়া সম্ভব না।আমি একা হলে সমস্যা ছিল না।রাতটা যদি থাকতে দিবেন? ”
ভদ্রলোক বেশ কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকাল।দরজায় বড় করে লেখা “হাজি মাওলানা “তা দেখে একবার স্পর্শ বলে,
—-“মাওলানা সাহেব রাতটা কি থাকা যাবে?”
মাওলানা সাহেব শক্ত গলায় বলে,
—-“মেয়েটা কে হয় তোমার?রাতের বেলায় মেয়ে ছেলে কি করছো?”
মাওলানা সাহেবের কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয় জেরিন।স্পর্শ অতি নম্রভাবে বলে,
—-“জ্বি আমরা স্বামি-স্ত্রী।আমাদের মাস খানেক হলো বিয়ে হয়েছে।ঘুরতে এসেই বিপাকে পরলাম।”
স্পর্শের কথায় শরীর শিউরে উঠলো জেরিনের।বুকটা ধুকপুক করে উঠে।মাওলানা সাহেব সন্দেহী গলায় বলে,
—-“কাবিন নামা বা প্রমাণ আছে?কিভাবে প্রমাণ ছাড়া যুবক যুবতি বাড়িতে রাখি?”
স্পর্শ এবার মুশকিলে পরে যায়।জেরিনের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
—-“আমরা স্বামি -স্ত্রী সত্যি।”
মাওলানা সাহেবের ছেলে কানে কানে কি জেনো বলল তাকে।মাওলানা সাহেব মাথা দুলিয়ে বলে,
—-“ভিতরে এসো।সিহাব বিয়ের কাগজ -কলম নিয়ে আয় তো।”
ভদ্রলোকের কথায় পা থেমে গেলো দুজনের।কিন্তু তত সময় বসার ঘরে পা ফেলে দিয়েছে দুজন।সিহাব দরজাটা শব্দ করে লাগিয়ে দিলো।বুকটা জেনো অস্থিরতায় বেকুল হয়ে যায় দুজনের।মাওলানা সাহেব দুজনকে বসতে বলেন।ধির পায়ে দুজন সোফায় বসে। সিহাব কাগজ পত্র এনে দিলো বাবাকে।মাওলানা সাহেব চোখে চশমা দিয়ে স্পর্শ কে প্রশ্ন করল,
—-“বাবা মায়ের নাম বলো? ”
স্পর্শ অপ্রস্তুত হয়ে বলে দিলো সব।জেরিন কেও জিজ্ঞেস করা হলে সেও ভয়ে ভয়ে বলে।জেরিন ভিতু কন্ঠে বলে,
—-“এগুলো জেনে কি করবেন আপনি?”
সিহাব পাশে থেকে সচ্ছল গলায় বলে,
—-“আপনাদের আবার বিয়ে দিচ্ছে বাবা।উনি বিয়ে পরায় আর আমি উকিল। আপানাদের রেজেস্ট্রি পেপার রেডি করছি আমি।”
স্পর্শ দ্রুত বলে,
—-“এসবের কি দরকার? আবার বিয়ে কেনো করতে হবে?”
মাওলানা সাহেব অতি শক্ত গলায় বলে,
—-“স্বামি -স্ত্রী হলে বিয়ে করতে সমস্যা কি?১হাজার ১০১ টাকা দেনমহরে তোমাদের বিয়ে হচ্ছে।”
বাধ্য করে স্পর্শ কবুল বলে।জেরিন চুপ মেরে বসে রইলো।স্পর্শ কে বিয়ে করছে ভাবতেই অস্থির হচ্ছে মন।জীবনে কত জটিলতা এখনো রয়েছে তার।স্পর্শ অতি ধনি ঘরের ছেলে হয়ে মধ্যবিত্ত মেয়েকে এভাবে বিয়ে করবে?জেরিনের ভাবনাকে ঝেরেউঁচু গলায় কবুল বলতে বলে।ছলছল চোখে জেরিন কবুল বলতে বাধ্য হলো।
__________________________
জীবনে মাত্র একটা ঘন্টায় বিয়ে হয়ে যাবে কল্পনা করেনি দুজন।চুপ করে বসে আছে একটি পরিপাটি রুমে।অন্ধকার রুমে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় স্পর্শের ক্লান্ত মুখ দেখতে পাচ্ছে জেরিন।অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেলো।জোর করে মাওলানা সাহেবদের সাথে রাতে খেতেও বসেছিল।স্পর্শ খেলেও জেরিন খেতে পারেনি।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল স্পর্শের দিকে।ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে স্পর্শ মৃদু কন্ঠে বলে,
—-“রাত হয়েছে আপনি বরং শুয়ে পরুন।”
জেরিন এই প্রথমবারের মতো বলে,
—-“আপনি শুবেন না?”
স্পর্শ উঠে দাঁড়ায়।গায়ের ব্লেজার খুলে শার্ট এর দুটো বোতাম খুলে হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে।আমি নিজের ব্যবস্থা করে নিবো।”
জেরিন চুপ করে স্পর্শকে দেখলো।ছেলেটা খুবই সুন্দর এবং মায়াবী।জেরিন নিচুস্বরে বলে,
—-“আপনি অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে।এখানে সোফা বা অন্য কিছু নেই।ফ্লোরে শোয়ার মতো জায়গা ও নেই। বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।আমার একা অন্ধকারে ঘুমাতে ভয় হয়।আপনি চাইলে পাশেই ঘুমাতে পারেন।”
স্পর্শ কয়েক সেকেন্ড স্তির ভাবে তাকিয়ে একটু মজা করেই বলে,
—-“এত দূর একা চলে এলেন। রিসোর্টে এত বড় রুমে একা কিভাবে ছিলেন?”
—-“সব লাইট অন করে।”
মাথা নিচু করে বলে জেরিন।স্পর্শ ঠোঁট টিপে হাসল।শান্ত গলায় বলে,
—-“ঠিক আছে আপনি শুয়ে পরুন।আমি দেখি সাদকে ফোনে পাওয়া যায় কিনা।”
জেরিন সম্মতি দিলো।চুপটি মেয়ে ওড়না কাথার মতো করে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরে।অনেক বার চেষ্টা করেও সাদকে পেলো না ফোনে।হয়তো ঝড়ের কারণে নেটওয়ার্ক লাগছে না।স্পর্শ ফোনটা রেখে দিলো।বিছানায় তাকিয়ে দেখলো জেরিন চোখ বন্ধ করে আছে।মেঘের তুমুল শব্দে কেপে কেপে উঠছে।স্পর্শ বুঝে নিলো জেরিন ভয় পাচ্ছে।কয়েক মিনিট মন দিয়ে চেয়ে রইলো জেরিনের দিকে।মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দর এবং মায়াবি।চোখ গুলো বেশ মায়াভরা।কথা গুলো ও সিমিত সাজানো অল্প বাক্য।স্পর্শ আনমনে হাসল কিছুটা।ধির পায়ে জেরিনের পাশে এসে শুয়ে পরলো। সোজা হয়ে শুয়ে আছে স্পর্শ। কপালের উপর আড়া-আড়ি দিয়ে হাত রাখা।চোখটা বন্ধ করে আছে সে।খুব শব্দ করে মেঘ ডাকতেই বুকের উপর ভাড়ি কিছু অনুভব হলো।কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকাল।স্পর্শের বুকে মুখ লুকিয়ে বাম হাতে শক্ত করে খামচে আছে শার্ট।বেখেয়ালি ডান হাতে স্পর্শ কাধ থেকে চুল। সরিয়ে জড়িয়ে ধরে জেরিন কে।বোতাম খোলায় কিছুটা উন্মুক্ত লোমহীন বুকে জেরিনের নিশ্বাস পরছে।হাত কাপছে স্পর্শের।আবারো মেঘের শব্দ হলো।আগের চেয়েও বেশি শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে জেরিন।স্পর্শ শুধু দুহাতে আগলে ধরে জেরিনকে।
মাঝ রাতে চোখটা খুলে তাকাল জেরিন।অনেক বছর পর জেনো শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল সে।চোখে সামনে স্পর্শকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে চুপ করে রইলো।ভালো করে খেয়াল করলো স্পর্শ দুহাতে আগলে আছে জেরিনকে।জেরিন একটু নড়তেই স্পর্শ পিটপিট করে চোখ মেলে দেখলো।অদ্ভুত ভাবে হেসে চোখ বন্ধ করে ভালো করে জেরিনকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আদো আদো কন্ঠে বলে,
—-“ঘুমান আপনি একদম ভয় পাবেন না।আমি আছি আপনার কাছে।”
জেরিন কিছু বলল না।চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পরে পানি।নিশ্চুপে অনুভব করল এই বুকেই সে শান্তিতে ঘুমিয়েছে।এখানে সে শান্তি অনুভব করছে।চুপটি করে চোখ বন্ধ করে নিলো জেরিন।
.
.
.
.
বৃষ্টির পর প্রকৃতি একদম ঝকঝকে রুপ নিলো।সব পরিষ্কার হয়ে গাছ পালা আরো শতেজ লাগছে।সকালের মৃদু রৌদের আলোয় চোখে পরতেই পাশ ফিরলো স্পর্শ।চোখ কুঁচকে মেলে তাকাল।বিছানায় জেরিন নেই। চট করে উঠে বসলো স্পর্শ। রুমের কোথাও সে নেই।বিছানায় একটা চিরকুট রাখা শুধু।স্পর্শ সেটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে এলো।খুলে সকালের আলোয় পড়তে লাগে সেই চিরকুট।
‘ঘুমন্ত আপনাকে জেগে তুলতে ইচ্ছে করেনি।গতকাল রাত যা হয়েছে আপনাকে মনে করাতে চাই না।আমার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে আপনার বউ হতে পারে না।জীবনে অনেক জটিলতা সমাধান করতে হবে আমায়।সেখানে আপনার মতো সচ্ছল যুবকের জীবন নষ্ট করতে চাই না।আমি চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন!’
স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।কিছু সময় বাইরে চেয়ে ফিরার জন্য প্রস্তুত হলো।কোট গায়ে জড়াতে যেয়ে চোখ পরলো বিছানায় থাকা জেরিনের হাল্কা আকাশি রঙা ওড়না এবং গলায় থাকা চেইনের উপর।স্পর্শ মৃদু হেসে সযত্নে তা তুলে নিলো।এটাই না হয় স্মৃতি হিসেবে থাকবে বিয়ের।
#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব৬
উদাসীন মনে রিসোর্টের পুল সাইডে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।এক রাতের মাঝে সব কেমন হয়ে গেলো।এটা ভুলে যেতেই হবে। জেরিন যখন এলোমেলো চিন্তায় ব্যস্ত, ঠিক তখন বন্ধুরা চমকে দিতে উত্তেজিত। বার্থডে কেক হাতে সবাই চারপাশে ঘিরে হৈহৈ করে বলল,
—-“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…!হ্যাপি বার্থডে জরিনা!”
জেরিন বিস্ময় নিয়ে সবার দিকে তাকাল।সাদিয়া জড়িয়ে ধরে জন্মদিনে শুভেচ্ছা দিলো।জেরিন এখনো বিস্মিত হয়ে আছে।আশ্চর্য গলায় বলে,
—-“শাওন তোরা এখানে?মানে, সত্যি তোরা?আমি ভুল দেখছি না তো?”
শাওন এক হাতে জড়িয়ে ধরে জেরিন কে।এক গাল হাসি দিয়ে বলে,
—-“এখন কি মনে হচ্ছে?”
সাকিব বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে,
—-“বান্ধুবী তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে সেই ঢাকা থেকে কক্সবাজার এলাম।”
নিলয় কেক সামনে ধরে উৎসাহিত হয়ে বলে,
—-“আজকে জরিনা আপার জন্মদিন।”
জেরিন কান টেনে বলে,
—-“তুই আবার জরিনা বলছিস?আমার নাম জেরিন জাহান। ”
নিলয় হেসে দিলো।রাফি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো।সবাই এক সাথে জড়ো হয়ে কেক কাটলো।বন্ধুদের সাথে নিজের ১৮তম জন্মদিন পালন করে জেরিন মহা খুশি আজ।কেক মাখা-মাখিতে মেতে উঠে সবাই।হাসা হাসি করার পর রাফি বেশ উত্তেজিত হয়ে একটা প্রস্তাব দিলো,
—-“তোরা কি সমুদ্রের পাড়ে যাবি?আজকের এই দিনটা স্বরণীয় করে রাখি। ”
শাওন সায় দিয়ে বলে,
—-“চল মামা!”
সবাই ফ্রেশ হতে পা বাড়ালো। রিসেপশন এসে জেরিন বলে,
—-“আমি চাবি নিয়ে আসছি দোস্ত।”
জেরিন রিসেপশন এ হাল্কা হেসে বলে,
—-“রুমের চাবিটা মি.জয়?”
জয় হেসে চাবিটা দিলো।জেরিন ফিরে যেতে পা দিলে জয় একটু ব্যস্ত হয়ে বলে,
—-“ম্যাডাম আপনার একটা গিফট আছে।”
জেরিন জয়ের দিকে ফিরে তাকাল।একটু অবাক হয়ে বলে,
—-“কিসের গিফট? ”
জয় একটা রেপিং করা প্যাকেট এগিয়ে দিলো।জেরিন বিস্ময় নিয়ে তাকালে জয় মৃদু হেসে বলে,
—-“স্যার এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।”
জেরিনের কপালে এবার বিস্ময়ের আরো ছাপ পরে,
—-“কোন স্যার? ”
—-“আপনার সামনের রুমটাই।মি.মেহরাব দু-ঘন্টা আগেই ঢাকা ফিরেছেন।আর এটা আপনার জন্য রেখে গেছেন।”
জেরিন হাল্কা হাসার চেষ্টা করল।গিফটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখছে।প্যাকেটের উপর সুন্দর করে লেখা “হ্যাপি বার্থডে জেরি”।বন্ধুরা জেরিনের চুপ করে থাকা দেখে কাছে এগিয়ে এলো।দুপাশ থেকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করল,
—-“কি হয়েছে তোর?”
শাওনের কথায় উত্তর দিলো না জেরিন।হাল্কা হেসে সবাইকে রুমে নিয়ে গেলো।গিফট না খুলেই লাগেজে রেখে দিলো জেরিন।বন্ধুদের মাঝে খুললেই নান প্রশ্ন শুনতে হবে।ফ্রেশ হয়ে সবাই বিচে চলে যায়।
আজ বিচে মানুষ খুবই কম।ছয়জন বন্ধু নিশ্চুপে উপভোগ করছে সমুদ্রের ঢেউ।আনন্দ-উচ্ছ্বাস করে সবাই এখন ক্লান্ত।বালিতে বসে আছে সবাই।এতো গল্প আর আনন্দের মাঝেও কিছু একটা ভাবাচ্ছে জেরিন কে।রাফি বার দু-এক জিজ্ঞেস করেছিল, ‘জেরিন ঠিক আছিস?’বরাবরের মতো হেসে না জানায়।
.
.
.
.
বিশাল বড় রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।হাতে স্পর্শের দেওয়া গিফট। সেই কখন থেকে দেখেই যাচ্ছে কিন্তু খুলছে না।আচ্ছা?কি আছে এর মাঝে?জেরিন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে খুলল প্যাকেট।প্রথম দফায় কিছু ছবি পেলো।ভালো করে দেখে বুঝলো সেদিনের প্রগ্রামের ছবি।সাথে কালো দামি একটা শাড়ি।ছোট একটা চিরকুট ও আছে।জেরিন কাপা কাপা হাতে চিরকুট হাতে তুলে বার কয়েক পড়ল।
“সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করাই উপর ওয়ালার কাজ।পবিত্র একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া এবং তার দায়িত্ব নেওয়া হয়তো আমাদের কাজ।আপনার অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করবো না।শুধু একটা কথা, কখনো নিজেকে অসহায় মনে করলে যদি আমাকে খুব প্রয়োজন মনে হয় আপনার , শুধু উপর ওয়ালাকে বলবেন। আমি চলে আসবো!”
জেরিন চিরকুট হাতে আশাবাদী হয়ে বলে,
—-“সত্যি কী আসবে সে?”
_______________________
ডিনারে সবাই বসে আছে উত্তেজনা নিয়ে।সাকিবের উত্তেজনা সে গান ধরবে।রাফির উত্তেজনা কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে এখানে।সাদিয়ার উত্তেজনা মেকাপ কতটা সুন্দর হয়েছে।নিলয় তো কি কই খাবে এ’নিয়েই বেহুশ।শাওন গানের সুর দিচ্ছে।জেরিন ওদের কান্ড দেখছে আর হাসছে।আড্ডা গান হৈচৈ করে সবাই এবার সিরিয়াস হলো।খাবার খেয়ে মনোযোগী হলো জেরিনের উপর।সাকিব বেশ হতাশ হয়ে বলে,
—-“এখন আমরা কী করবো?”
সাদিয়া বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,
—-“তুই পালিয়েছিস ভালো কথা। কিন্তু একটা বয়ফ্রেন্ড ও নেই?এখানে এসে তো করতে পারতি?”
জেরিন বেখেয়ালি কন্ঠে বলে,
—-“বয়ফ্রেন্ড তো দূর রে,আমার তো হ্যাসবেন্ড জুটে গেছে।”
সবাই ঠিক বুঝতে না পেরে একই সুরে বলে,
—-“কীইইইইইই?”
জেরিন চমকে গেলো।তাৎক্ষনিক গলা ঝেরে বলে,
—-“আমার কপালে বয়ফ্রেন্ড নেই।সবই বেস্ট ফ্রেন্ড। ”
রাফি টেবিলের উপর ঝুকে জেরিনের মাথায় চাটি মেরে বলে,
—-“এইসব খুবই বাজে কথা।তোর মতো মেয়ে এখনো সিংগেল!”
—-“আরে দোস্ত, ওরে যেদিন একটা ছেলে প্রপোজ করে সেই দিন আর সবাইকে রাখি পরায় দে।”
সাকিবের কথায় জেরিন মৃদু প্রতিবাদ করে বলে,
—-“তাহলে এই খাইসট্টা ছেলে গুলোকে জান বলবো?”
শাওন ওদের মাঝ পথে থামিয়ে সিরিয়াস গলায় বলে,
—-“এইসব বাদ দে!যা বলছি একটু মন দিয়ে শুনবি সবাই।জেরিন কে আরো কিছুদিন এখানেই রাখবো।চাইলে এখানে জব ও করতে পারে সে।ধর কয়েক মাস থেকে যদি ফ্যামিলি একটু জেরিনের কদর বুঝে।”
নিলয় সায় দিয়ে বলে,
—-“একদম জোস কিন্তু, আন্টি খুলে বের করলে?”
জেরিন শক্ত গলায় বলে,
—-“গাইস..! আমি এখন এডাল্ট হয়েছি।আমার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।”
সাদিয়া বেশ উত্তেজনা নিয়ে বলে,
—-“আমার একটা কাজিন আছে কক্সবাজার। আমরা চাইলে ও আমাদের জেরিন কে জবের ব্যবস্থা করে দিবে।”
রাফি হাত মিলিয়ে বলে,
—-“তাহলে তো হয়েই গেলো দোস্ত।”
বন্ধুরা খুশি মনে জড়িয়ে ধরে জেরিন কে।কি হয়েছে আর কি হবে কেউ জানে না।হাসানের থেকে দূরে থাকাটাই যে এখন কাজ ওদের।এই বাল্যবিবাহ থেকে আদৌ কি মুক্তি পাবে?
চলবে….
চলবে…