ভালবাসার প্রহর পর্ব ৭+৮

#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব৭

নতুন বছরের নতুন আহবান।শীতের শেষের দিকে কুয়াশায় ঘেরা সকাল।গুলশানের বিলাস বহুল বিশাল চার তলা বাড়ির নিজস্ব বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শ। হাতে তার কফির মগ।দৃষ্টি কুয়াশায় আড়াল হওয়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঠাক দম্পতির উপর।প্রিয়তমার গায়ে একটি যুবক পরম যত্নে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।স্পর্শ আনমনে একটু হাসলো।মাঝে মাঝে প্রায় স্পর্শ হাসে একা নিরবে।অদ্ভুত ভাবে কক্সবাজারে সাকসেস হওয়া প্রজেক্টের কথা হলেই স্পর্শ একা একা চিন্তায় ডুবে থাকে।রাস্তায় কোনো রোমাঞ্চকর ঘটনা দেখলেই মনে পড়ে যায়, তার ও রোমাঞ্চকর গল্প আছে এক রাতের।ঝড়, বৃষ্টি উঠা রাতের। জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ গল্প।তার ও একটা দাম্পত্য জীবন আছে। এক বৃষ্টি ভেজা রাতের।একটা বউ আছে, মেঘের গর্জনে ভয় পাওয়া বউ।স্পর্শ হেসে রুমে পা বাড়াল।কয়েক মিনিটের মাঝেই হামলে পড়া দুটো উচ্ছ্বাসিত প্রাণ।দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে বন্ধু এবং বন্ধুর ছোট ভাই নিরব।স্পর্শ বিছানায় বসে কিছু ফাইল চেক করছিল।হঠাৎ হামলা হওয়াতে ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকালো।বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বন্ধু প্রলয় বিছানায় বসে বলে,

—-“বন্ধু তোকে আমার সাথে যেতে হবে।”

স্পর্শ কোনো বনিতা ছাড়াই বলে,

—-“নিশ্চয়ই বলবি নিরবের বিয়ে।”

প্রলয় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

—-“আসলেই এমন কিছু।”

নিরব দাত বের করে হাসি দিয়ে বলে,

—-“ভাইয়া, বিয়ে ফাইনাল এখন শুধু একটু প্রাইভেট কথা বলবো ওর সাথে।”

স্পর্শ হাতের ফাইল গুলো ঠিক করে সাইড টেবিলের উপর রাখলো।নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসে স্পর্শ শান্ত ভাবে বলে,

—-“এ’জীবনে কতগুলো বিয়ে করবি তুই?মানলাম সম্পর্কে তুই প্রলয়ের মামাতো ভাই কিন্তু আমাদের ছোট ভাই।তোর বয়স সবে ২৪ হয়েছে।”

নিরব এবার প্রলয়ের দিকে ক্ষোভ নিয়ে চেয়ে বলে,

—-“এই নিয়ে ভাইয়া আমার ১০৩ নাম্বার বিয়ের দাওয়াত দিলো তোমায়।আসলে এই ২৬ বছরেও সে প্রেমিকার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেনি।তাই আমাকেই পাত্র বানিয়ে তোমাকে কনভেন্স করতে আসে।”

প্রলয় নিরবের মুখ চেপে ধরে।স্পর্শকে কিছু বলার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই স্পর্শ শান্ত ভাবে বলে,

—-“এটাই শেষ বার। হিমুকে বলো,সাথে বন্ধু বা আত্মীয় কাও কে আনতে।আমি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি।আর প্রলয়?এভাবে নিরবকে এতো বিয়ে দিস না ভাই।বেচারা তাহলে আসল বিয়েই করতে পারবে না।”

কথাটা বলে স্পর্শ আলমারি থেকে ড্রেস বেড় করতে গেলো।কথার পিঠে নিরব মজার ছলে বলে,

—-“তা ভাইয়া, তুমি কবে করছ বিয়ে?শুভ ভাইয়া তো বেশ বড় সারপ্রাইজ দিলো ৬/৭ মাস আগে।বিয়ের দিন খন ঠিক করে অবাক করে দেয়।এখন তো তোমার পালা।”

স্পর্শ শার্ট হাতে থেমে যায়।চোখের সামনে ভেসে আসে সেই রাতের কথা।কাজের চাপ শেষ হতেই প্রায় সেই গল্প মনে পড়ে তার।কারো সাথে শেয়ার ও করা হয়নি সেই গল্প।প্রলয় স্পর্শের থেমে যাওয়া দেখে নিরবকে মৃদু ঝারি দিলো,

—-“চুপ কর তুই! স্পর্শের জন্য একটা ইউনিক বিয়ের গল্প লিখতে হবে।সব কাজই ওর ইউনিক। ”

স্পর্শ কিছু না বলে রেডি হতে চলে গেলো।নিরব সাথে সাথে প্রলয়ের গলা চেপে রাগি গলায় বলে,

—-“তুমি নিজে তো বিয়ের প্রস্তাব দিতেই পারো না, মাঝে আমার ১০৩ বার বিয়ে করালে।একবার ভাবো যদি এই কথা রুমের বাইরে যায় কী হবে?”

প্রলয় নিজেকে ছাড়িয়ে অনুরোধ করে বলে,

—-“ভাই এটাই শেষ রে।স্পর্শ এই প্রথম রাজি হয়েছে যেতে।”

.

.

.

.
পিংক কালারের লেদার জ্যাকেট গায়ে ৬তলা রেস্টুরেন্টে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।চারপাশে সবুজ গাছ আর ইন্টোডিওর অসাধারণ ডিজাইন।কাচের রেলিঙ দ্বারা এই ছোট খোলা বেলকোনি।পাশে থাকা সজ্জিত কাচের টেবিলে দুহাত রেখে বান্ধুবী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।জেরিন বার দু-এক পিছনে ফিরে হাল্কা হেসে বলে,

—-“কিরে এভাবে কী দেখছিস?”

—-“তোকে কী সুন্দর লাগছে জেরু।এই সাদা লং গাউনের সাথে সেই মানিয়েছে জ্যাকেট। সাথে তোর খোলা চুল রে।আমি যদি ছেলে হতাম না এখনি বিয়ে করে নিতাম।”

জেরিন নিঃশব্দে হেসে বলে,

—-“হিমু স্কুল লাইফ থেকে একই কথা বলছিস।আমাকে বিয়ে করতে হবে না, তুই সেই অপ্রস্তুত ছেলেটা কেই বিয়ে কর।আজ যদি সে বনিতা করেছে তাহলে এখান থেকে ফেলে দিবো।”

হিমু শব্দ করে হেসে দিলো।জেরিন ধানমন্ডির লেকে বসে থাকা দম্পতিদের উদ্দেশ্য করে বলে,

—-“দেখ,এরা কত মন দিয়ে প্রেম করছে। কিন্তু দুদিন পর যে এভাবেই বসে থাকবে তার কী কোনো গ্যারান্টি আছে?সেখানে আমরা এসেছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলতে।”

হিমু মৃদু তাড়া দিয়ে বলে,

—-“দোস্ত চলে এসেছে ও।”

জেরিন ডান দিকের দরজায় চোখ দিতেই দুজন যুবক দেখলো।হিমুর বয়ফ্রেন্ড কে সে চিনে। কিন্তু সাথে থাকা মাস্ক পরিহিত যুবকটা কে দেখে কিছুটা অবাক হলো।জেরিন হিমুর পাশে চেয়ার টেনে বসতেই মাস্ক পরিহিত যুবকটির দৃষ্টি স্তির হয়ে গেলো তার উপর।হিমু মৃদু উত্তেজনা নিয়ে বলে,

—-“দোস্ত ও প্রলয়। প্রলয় আমার বেস্টু জেরিন।”

প্রলয় স্মিত হেসে বলে,

—-“নাইস টু মিট ইউ ম্যাডাম।ওই হলো আমার বন্ধু স্পর্শ মেহরাব।”

নামটা শুনেই জেরিনের হাত থেকে সুন্দর মাথার টুপিটা ফ্লোরে পরে যায়।”মেহরাব” নামটা তার খুবই চেনা।আগে পরে কিছু না শুনলেও সেই রাতে মেহরাব নামটা ঠিকই কানে এসেছিল।জেরিন অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

—-“আসসালামু আলাইকুম। ”

স্পর্শ প্রলয়ের সাথে চেয়ার টেনে বসে।জেরিন দ্রুত ফ্লোর থেকে টুপি তুলে নিলো।কিছু সময় চুপ থেকে আলাপ বাড়ালো জেরিন।ধির কন্ঠে বলে,

—-“প্রলয় ভাইয়া অনেক দিন হলো এই গল্পের।হিমুর বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব ঘুর ঘুর করছে।আপনার কী ইচ্ছে আছে বিয়ে করার?”

প্রলয় স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বলে,

—-“আমার সব কথা স্পর্শের সাথে বলতে পারো।”

জেরিন এবার মৃদু বুক কাপা নিয়ে স্পর্শ কে বলে,

—-“দেখুন সবার কপালে ভালবাসা আসে না।আপনার বন্ধু কী আমার বান্ধুবী কে বিয়ে করতে রাজি?”

স্পর্শ কয়েক সেকেন্ড নিরব তাকিয়ে বলে,

—-“রাজি মিস!আমরা বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চাই।”

জেরিন হাসার চেষ্টা করে বলে,

—-“আপনার কন্ঠ আমি আগেও শুনেছি মনে হচ্ছে।আচ্ছা,প্রলয় ভাইয়া আপনার বাড়িতে আপনার বন্ধু বিয়ের প্রস্তাব দিবে।আমি হিমুর বাড়িতে পরিচিত কারো মাঝে আপনার নামে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি।”

হিমু খুশিতে জেরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,

—-“আই লাভ ইউ ইয়ার।”

প্রলয় অনেক ধন্যবাদ জানায়।জেরিন হেসে বিদায় নিয়ে বলে,

—-“তাহলে তোরা কথা বল আমি যাই।বাড়ি না ফিরলে এখন ঠিক রাত হয়ে যাবে।আর আমি রোজ রোজ ঝামেলা নিতে পারছি না। বায় দোস্ত।”

হিমু হাল্কা হেসে বিদায় দিলো।জেরিন যাওয়ার আগে বার কয়েক স্পর্শের দিকে তাকায়।মানুষটা যে অতি সুদর্শন তা মাস্ক পরায় থাকলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে জেরিন।জেরিন বেড়িয়ে যেতেই মুখ থেকে মাস্ক খুলে স্পর্শ। খুব সিরিয়াস মুখে প্রশ্ন করল,

—-“কিসের ঝামেলা উনার?”

হিমু কিছুটা বিষণ্ণ গলায় বলে,

—-“৬/৭ মাস আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় ও।প্রায় ১ মাস পর ফিরে আসে বাড়িতে।সবাই স্বাভাবিক হলেও ওর মা হয়নি।যেই বিয়ের জন্য পালিয়েছে সেটা নিয়ে এখনো পরে আছে।রোজ রোজ বকা ঝকা আর কটু কথা শুনছে।”

স্পর্শ চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলে,

—-“আলহামদুলিল্লাহ! এখনো একাই আছে তাহলে।”

________________________

শীতের বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।সাথেই দাঁড়িয়ে আছে শাওন।মুখে তার বিস্তার বিস্ময় এবং অবিশ্বাস। জেরিন গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে দূর আকাশে।গায়ের চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিলো সে।শাওন এক হাতে কপাল চেপে ধরে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে,

—-“আমি বিশ্বাস করি না তুই এটা করেছিস?”

জেরিন অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,

—-“এটাই সত্যি বন্ধু।”

শাওন ছাদের রেলিঙে হাত রেখে বিস্ময় নিয়ে বলে,

—-“তুই কক্সবাজারে সেদিন বিয়ে করলি!মানে ৬/৭ মাস হয়ে গেলো আর তুই এখন আমাকে বলছিস তুই বিয়ে করেছিস?”

জেরিন চুপ করে রইলো।কিছু সময় চুপ থেকে ব্যস্ত গলায় বলে,

—-“আমি তো জানতামই না এমন কিছু হবে।আমরা সেদিনের পর মুখোমুখি হইনি।সকালে তোদের সাথে জন্মদিন সেলিব্রেট করলাম।উনার দেওয়ার গিফট পেয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম।আজও যত্ন করে রেখেছি।আমি আসার আগে সেদিন চিরকুটে বলেও দিয়েছি তার জীবন নষ্ট করতে চাই না।আমি তো ভুলেও যেতে চেষ্টা করেছি সেই রাত।কিন্তু একা হলেই হঠাৎ হঠাৎ মানুষটাকে মনে পড়ে।আমি শান্তিতে আর ঘুমাতেই পারিনি সেরাতের পর।”

শাওন কয়েক মিনিট সময় নিয়ে শান্ত গলায় বলে,

—-“এটা তো জানলাম সে অতি সুদর্শনা যুবক।নাম কী?কোথায় থাকে সে?প্লিজ, তোর হ্যাসবেন্ড হয় সে।যদি বলিস জানিস না এই ছাদ থেকে ফেলে দিবো।”

জেরিন অসহায় চোখে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে,

—-“সত্যি জানি না দোস্ত।”

শাওন বিস্মিত কন্ঠে বলে,

—-“একটা মানুষ তোর কতটা কাছের হয়ে গেছে।তুই একটা রাত তার সাথে ছিলি আর নাম জানিস না?কোথায় থাকে তাও জানিস না?”

জেরিন আস্তে করে বলে,

—-“সেই অবস্থায় কীভাবে কবুল বলেছি আমিই জানি।তবে আগে পরে শুনিনি জাস্ট মেহরাব শুনেছি।”

শাওন হাত জোর করে বলে,

—-“মাপ চাই বন্ধু!তোর মতো বউ খুজেও পাওয়া যাবে না।কক্সবাজারে বিয়ে করে ম্যাডাম এখন বলছে।আচ্ছা?তোরা তো ধার্মিক এবং আইনত বিবাহিত।”

.

.

.

.

বসার ঘরে নাজমুন বেগম স্বামী এবং ভাই-ভাই বৌনিয়ে সবাইকে জড়ো করেছে।সন্ধায় দমদমে পরিবেশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে শাওন এবং জেরিন।নাজমুন বেগমের চোখে চোর ধরেছে এমন আহবান।সবাই অবাক চোখে জেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে।নাজমুন বেগম শক্ত গলায় বলেন,

—-“ছেলেটা কে?”

জেরিন এবং শাওন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এক সাথেই বলে,

—-“কোন ছেলেটা?”
#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব৮

পরিবেশটা এবার থমথমে রইলো না।বেশ গরম মনে হচ্ছে।জসীম সাহেব মেয়ের কাছ থেকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে।লতিফ সাহেব বেশ উত্তেজনা তৈরি করছেন।নাজমুন বেগম এবার কিছুটা উচ্চস্বরে বলেন,

—-“কোন ছেলেটা মানে কি?তোমরা ভালো করেই জানো আমি কার কথা বলছি।”

জেরিনের মনে একটাই কথা নড়ে উঠলো,

—-“যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।”

শাওন জেরিনের চুপ মেরে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।লতিফ সাহেব তেতে উঠে বলেন,

—-“কোন ছেলে কিছুই জানিস না?তলে তলে এতো কিছু,এত দূর করে এখন এমন ভাব করছিস জেনো কিছুই জানিস না?”

জেরিন ঢোগ গিলে অস্পষ্ট ভাবে বলে,

—-“ক্লিয়ার ভাবে বললে ভালো হতো।”

শাওন ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় করে বলে,

—-“শালি আগে নিজের কথা ক্লিয়ার কর।”

জেরিন অসহায় চোখে শাওনের দিকে একবার তাকালো।নাজমুন বেগম শক্ত গলায় বলেন,

—-“এক কথা বার বার বলবো না আমি।কি ভেবেছো তোমরা, আমি কিছুই জানবো না?আমি সব শুনেছি তোমাদের কথা।কক্সবাজার তাই না?”

নাজমুন বেগমের কথায় তাৎক্ষণিক বুকের উপর ভাজ করে রাখা দুহাত শাওনের পরে গেলো।জেরিন এবং শাওন দুজনের উপর চাহনি নিক্ষেপ করল। যাতে ভয় আতঙ্ক স্পষ্ট। জসীম সাহেব এবার অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলেন,

—-তোর কাছ থেকে আমি এমনটা আশা করিনি জেরিন।তুই শেষে কি না আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিলি!তুই আগে ও বলতে পারতি পছন্দের কথা।”

লতিফ সাহেবের স্ত্রী সেলিনা সবাই সামলানোর চেষ্টা করে বলেন,

—-“যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমাদের ছেলে এবং তার পরিবার সম্পর্ক জানা দরকার।বিস্তারিত সব না জেনে কিছু করা ঠিক হবে না।আমাদের তো ছেলে দেখতে হবে।”

লতিফ সাহেব ফোঁড়ন কেটে বলেন,

—-“আমার হাসান রে পছন্দ না,ওরে পছন্দ না।এখন সবই পছন্দ। আল্লাহ জানে কোন রিকশা ওয়ালা বিয়ে করছে।”

জেরিন এবার দ্রুত উঁচু গলায় বলে,

—-” হাসান উনার পিএ এর ও যোগ্যতা রাখে না।সে কোনো রিকশা ওয়ালা লতিফ সাহেব।”

শাওন সহ সবাই বেশ অবাক।জেরিন নিজেও অবাক এক রাতের স্বামীর জন্য সে উঁচু গলায় কথা বলছে?লতিফ সাহেব তেড়ে বলেন,

—-“কোন দেশের প্রেসিডেন্ট সেই ছেলে? তোর গলার জোর ও দেখি খুব বাড়ছে। কে সেই ফকিরনির পোলা?”

জেরিন এবার রাগে নিজের হাত মুঠী বদ্ধ করে নিলো।শাওন পাশ থেকে জেরিনের কাধে হাত রেখে আস্তে করে বলে,

—-“দোস্ত ওনারা পুরোটা জানে না।থাংক গড! আন্টি শুধু শেষের বিয়ে হয়েছেই শুনেছে।আমরা এখনো সামলাতে পারবো না।”

জেরিন ফ্লোরে দৃষ্টি স্তির করল।জসীম সাহেব বেশ কঠিন গলায় বলেন,

—-“দেখ তুই বিয়ে করলি কিন্তু আমরা জানি না।প্রায় ৬/৭ মাস হওয়ার পর আমাদের জানতে হচ্ছে কেনো?”

জেরিন কি বলবে বুঝতে পারছে না।শাওন দ্রুত কিছু একটা ভেবে বলে,

—-“আসলে আংকেল বিষটা আমরা ও জানতাম না।মানে জেরিন আমাদের বন্ধু মহলে জানায় নি।কক্সবাজার থেকে আসার পর আমরা জানতে পারি।আপনাদের আর কিছু দিন পরই জানাতো।”

নাজমুন বেগম বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন,

—-“কোন দিন জানাতো?হয়তো একদিন এসে বলতো মা আমি প্রেগন্যান্ট। ”

জেরিন চোখ বন্ধ করে কয়েক ফোটা পানি ফেলে দিলো ফ্লোরে।শাওন সেদিকে তাকিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে বলে,

—-“আন্টি এমনটা জেরিন বলতো না। আর বললেও সেটা বৈধ হতো। দুলাভাই একটা সঠিক সময় খুজছিল জানানোর জন্য।সামনেই হিমুর বিয়ে হচ্ছে।হিমুর বিয়ের পর পর দুলভাই দেখা করতে আসবে।”

জেরিন বিস্ময় চোখে শাওনের দিকে তাকালো। হিমুর বিয়ের পর পাবে কোথায় স্পর্শ কে?জসীম সাহেব শক্ত ভাবে বলেন,

—-“দেখো যা হওয়ার হয়েছে।হিমুর বিয়ের পর সেই ছেলের সাথে আমরা দেখা করবো।তোমরা তাকে বলে দিও রেডি থাকতে।এ বিষয় আর কথা হবে না।হিমুর বিয়ের পরই সব কথা হবে।”

লতিফ সাহেব মাঝে ভ্রু উঁচিয়ে বলেন,

—-“হিমুর বিয়ে কবে?”

শাওন শান্ত কন্ঠে বলে,

—-“সাত দিন পর।”

নাজমুন বেগম কঠিন গলায় বলেন,

—-“সাত পরই কথা হবে। ”

.

.

.

.

ছাদে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে শাওন এবং জেরিন।জেরিন এদিক ওদিক পায়চারি করে যাচ্ছে।মাথায় রাজ্যের চিন্তা নেমেছে।শাওনের উপর প্রচুর বিরক্ত লাগছে এখন।শাওন ডান হাতের নখ কামড়ে ভিতু করে জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,

—-“এমন ব্যস্ত হচ্ছিস কেনো?”

জেরিন চিন্তা এবং বিরক্ত নিয়ে বলে,

—-“কি করলি এটা তুই?”

শাওন বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলে,

—-“আমি আবার কি করলাম?”

জেরিন পায়চারি থামিয়ে শাওনের সামনে দাঁড়ায়।রাগ নিয়ে বলে,

—-“সাত দিন পর কোথায় পাবো সেই উনা কে?উনি তো আমার জন্য সেই রুমে বসে আছে কক্সবাজার তাই না?”

শাওন গলা ঝেরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বলে,

—-“আমি তোর ভালোর জন্যই বলেছি।লতিফ সাহেব হাসান কে একটু আগে কল দিয়েছে দেখলাম।”

জেরিন চিন্তিত হয়ে হতাশ গলায় বলে,

—-“দোস্ত আমি আর পারছি না নিতে।হাসান যদি মি.মেহরাব কে খুজে বেড় করে তখন,তখন আমি কি করবো?”

শাওন সাহস দিয়ে বলে,

—-“এতো হতাশ হচ্ছিস কেনো?তুই না বললি সে সব জানে তোর বিষয়?হাসান তাহলে কি করবে হ্যা?আর চাপ নিচ্ছিস কেনো?আমি তখন বলেছিলাম না কেউ আসবে? আসলো তো নাকি?এখন যখন বলেছি তো নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সারিয়ে দিবে।চিন্তা করিস না বন্ধু।নাহলে আমরা অন্য কাউ কে ভারা করে আনবো কিন্তু তোর কিছু হতে দিবো না।চল আমরা খোজ নেই সেই রিসোর্টে উনি আর এসেছে কিনা।”

সারা রাত খোজ করেও জানতে পারেনি কিছুই।রিসোর্ট থেকে সুন্দর করে একটাই কথা বলেছে “মেহরাব নামে অনেকেই আছে কিন্তু ফুল নেইম বললে দেখতে পারি।”হাজার নাম বলেছে কিন্তু একটাও ধরতে পারেনি সে।এভাবে কি সম্ভব খুজে বেড় করা?

__________________________

পারিবারিক ভাবেই আজ হিমু এবং প্রলয়ের বিয়ে।ঘরোয়া ভাবে আকদ করবে আজ।মাস দু-এক পর বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে।সকাল সকাল হিমুদের বাসায় চলে আসে জেরিন।হাল্কা আকাশি রঙা সিল্কের শাড়ি গায়ে।যার মাঝে সোনালি সুতোর ফুল আকা।খোঁপা করা চুলে বেলি ফুলের মালা।হাতে দু একটা চুড়ি।হিমুর মা রেহানা ইসলামের হাতে হাতে ফল, মিষ্টি সাজিয়ে দিচ্ছে জেরিন।একটু পরই চলে আসবে সবাই।ড্রয়িংরুমে মিষ্টির প্লেট সাজিয়ে রাখছে সে।রেহানা ইসলাম রান্না ঘর থেকে বাইরে আসেন।জেরিনের কাধে আলতো হাত রেখে বলেন,

—-“মা তুমি এবার হিমুকে সাজিয়ে দাও।এদিকে আমার বোন এবং ননদ আছে ওরা দেখে নিবে।”

জেরিন সম্মতি দিয়ে রুমে গেলো।হিমু প্রেমালাপ করতে ব্যস্ত এখনো।বিছানায় বসে লজ্জিত মুখে মধুর আলাপ করছে।জেরিন ধির পায়ে বিছানার কাছে এসে কোমরে দুহাত রেখে চোখ বড় করে বলে,

—-“ছি ছি ছি!একটু পর বিয়ে আর তুই প্রেম করছিস?”

হিমু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

—-“তুই কি বলছিস জেরিন?কখন এলি তুই?”

জেরিন ফুস করে নিশ্বাস ফেলে হিমুর ফোনটা এক প্রকার কেড়ে নিলো।কানে দিয়ে এক দমে বলে,

—-“দেখুন ভাইয়া একটু পর তো বিয়ে করছেন। দ্রুত ফোন রেখে চলে আসুন তো।আর আমার জন্য মুদ্রা নিয়ে আসুন।আপনার প্রিয়তমা কে সাজাতে হবে।”

ওপাশ থেকে শব্দ করে হেসে প্রলয় বলে,

—-“আচ্ছা শালিকা।”

জেরিন হেসে ফোন কেটে দিলো।হিমুর দিকে তাকিয়ে বলে,

—-“দ্রুত আসুন আপনাকে বউ সাজাবো।”

হিমু মৃদু হেসে বলে,

—-“দোস্ত তোকেই তো নতুন বউ লাগছে।আমি ভাবছি তোকেই না ওরা নিয়ে যায়।”

জেরিনের বুক ধুক করে উঠে।মৃদু উত্তেজনা নিয়ে বলে,

—-“কি যে বলছিস তুই!চুপ করে বস না আমি সাজাবো। ”

হিমু হেসে হাত জোর করে বলে,

—-“মাপ কর বোন।আচ্ছা, শাওন কখন আসবে?”

জেরিন হিমুর চুল বেধে দিতে দিতে বলে,

—-“চলে আসবে রে।”

.

.

.

.
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে প্রলয় এবং স্পর্শ। আশে পাশে কাজিন এবং মুরুব্বি ভোর পুর।পরিবেশটা বেশ উত্তেজিত এবং ঘম ঘমে।স্পর্শ বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।এ’সে এসে দুষ্টুমি করছে।কিন্তু স্পর্শের চোখ সেই একজন কে খুজে যাচ্ছে।একরাতে পাওয়া সেই একজন কে।প্রলয়ের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায় স্পর্শ। প্রলয় কিভাবে হাসছে বসে বসে।রেহানা ইসলাম আত্মীয়দের মাঝে উঁচু গলায় বলেন,

—-“জেরিন মা, একটু এদিকে আয়।”

স্পর্শ দ্রুত রেহান ইসলামের চারপাশে চোখ দিলেন।মনে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।প্রলয় তা দেখে নিচুস্বরে প্রশ্ন করে,

—-“তুই ঠিক আছিস? ”

স্পর্শ হাসার চেষ্টা করে বলে,

—-“হ্যা আছি।”

কয়েক মিনিটের মাঝে স্পর্শের উত্তেজনা আরো বেড়ে গেলো।বিরক্তি সব হারিয়ে গেলো এক যুবতি কে দেখে।শাড়ি পরিহিতা যুবতি মেয়ে শরবতের ট্রে হাতে এদিকেই এগিয়ে এলো।একে একে সবাই কে শরবতের গ্লাস দিয়ে প্রলয়দের কাছে আসতেই পা থমকে গেলো।চোখে মুখে বিস্ময়। হাতটা মৃদু কাপছে তার।কাপা কাপা হাতে প্রলয় কে শরবত দিয়ে পাশে থাকা মানুষটার দিকে স্তির হয়ে তাকালো।প্রলয় কিছুটা মজা করেই বলে,

—-“কি শালিকা? আমার বন্ধুকে দেখে ফিট খেলে নাকি?কিরে স্পর্শ কিছু তো বল?”

জেরিন বিস্মিত মুখে বলে,

—-“স্পর্শ মেহরাব?”

“স্পর্শ মেহরাব” নামটা কানে আসতেই শাওন পাশ থেকে তাকালো।আত্মীয়দের কথার মাঝে জেরিনের চোখে মুখে বিস্ময় এবং নাম শুনেই দ্রুত ছুটে এলো।স্পর্শ শরবতের গ্লাস হাতে জেরিনের মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে আলতো স্বরে বলে,

—-“জেরিন জাহান।”

জেরিনের ঠিক এই মুহূর্তে কি বলা বা করা উচিত জানা নেই।পাশে থাকা শাওন মুখে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলে,

—-“দুলাভাই? ”

জেরিন বিস্ময় নিয়ে শাওনের দিকে একবার তাকিয়ে স্পর্শের দিকে তাকালো।মৃদু হাত কাপা নিয়ে ট্রে হাতে হিমুর রুমে চলে গেলো।শাওন দ্রুত পিছু রুমে গেলো।জেরিনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।কপালে হাত চেপে চিন্তিত হয়ে শাওন কে বলে,

—-“দোস্ত স্পর্শ মেহরাব।আমার…”

—-“স্বামী তাই তো?”

শাওনের কথায় জেরিন অসহায় চোখে তাকালো।শাওন উত্তেজিত হয়ে বলে,

—-“দোস্ত আমি তো জতিস হয়ে যাবো।দেখ আমার এ কথাও সত্যি হয়ে গেলো।তবে, দুলাভাই জাস্ট সেই রে।আমি তো মুগ্ধ দোস্ত।তুই জানিস উনি কত নাম করা বিসনেস ম্যান?জানবি বা কি করে তুই?এই সব খবর রাখিস নাকি?”

জেরিন আর শাওনের কথায় হিমু বিছানা থেকে উঠে আসে।লাল বেনারসি পরিহিতা বউ সাজে হিমুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।এই সজ্জিত মুখেই আনন্দ নিয়ে বলে,

—-“দোস্ত স্পর্শ ভাইয়া তোর সেই কক্সবাজার? ”

জেরিন এদিক ওদিক তাকিয়ে হিমুর মুখ চেপে বলে,

—-“আস্তে বোন আস্তে বল।মানুষটা শুনলে কি মনে করবে?”

শাওন মুখ চেপে হেসে বলে,

—-“দোস্ত আসার আগে দেখলাম একটা মেয়ে তাকে বিরক্ত করছে।”

জেরিন বিরক্ত নিয়ে বলে,

—-“মেয়েরা বিরক্ত করছে?কিন্তু সে তো এমন না। আমার খুব বিরক্ত লাগছে শাওন।”

চলবে..

পর্ব৯
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/382500820138363/
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here