ভালোবাসার রং কালো পর্ব ৬+৭

#ভালোবাসার_রঙ_কালো 🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব- ৬-৭
——————————————–

.
#পর্ব -৬
.
জনশূন্য একটি প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে তিতাস নদীর শান্ত জলরাশি; আর পিছনে কাঁচা ইটের ভাটা। আকাশের বুকে মুচকি হেসে রুটির মতো গোল আর ফোলা চাঁদটা ঝুলে আছে। রাতের কয়টা বাজে জানি না। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে ওঠলাম! কালো আর রূপালি পাড়ের একটি শাড়ি পরে আছি আমি! রাতের বেলা এই জনশূন্য প্রান্তরে আমি একা; ভাবতেই ভয়ে পুরো শরীরে কাটা দিয়ে উঠল আমার। এখানে কীভাবে এসেছি আমি? কে নিয়ে এসেছে আমায়? আমার চারপাশে দূর দূর পর্যন্ত কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না! নদীর ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হু হু করে বাতাস বইছে। পরনের শাড়ি ভেদ করে শীতল হাওয়া আমার পুরো শরীরটাকে গ্রাস করে ফেলছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় শাড়ির আঁচলটাকে আরও ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিলাম। দূর থেকে শেয়ালের পালের করুন কান্নার সুর ভেসে আসছে। এই সময় এরা দল বেঁধে শিকার করতে বের হয়। আর নদীর পাড়ই এদের স্থায়ী ঘাঁটি। ভয়ে উৎকণ্ঠায় আমি চঞ্চল চোখে চতুর্দিকে কেউ আছে কি না খুঁজতে লাগলাম। এদিকে শেয়ালের ডাকগুলো আমার আরও নিকটবর্তী হচ্ছে। ভয়ে আমার হাত পা বরফের মতো জমে যাচ্ছে। আমার মন বারবার বলে চলেছে, এক্ষুণি এখান থেকে পালা আরজু। সামনের দিকে পা বাড়া। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি একপা’ও সামনের দিকে বাড়াতে পারলাম না। স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। যেন কেউ আমার পা দুটো পেরেক দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে তাই আমি নড়তে পারছি না! হঠাৎ দেখি একটি শেয়াল আমার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। মনে হয় এটা দলছাড়া হয়ে শিকারের আশায় এদিকটাই জলদি এসে পরেছে। রাতের আঁধারে চাঁদের আলোয় ওটার সবুজ চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। ধীরে ধীরে শেয়ালটা যখন আমার একেবারে কাছে চলে এসেছে; তখনি আচমকা পিছন থেকে কেউ এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে নদীর পাড় ধরে ছুটতে শুরু করে। বেশিকিছু না ভেবে আমিও সেই হাতের মুঠোয় আমার হাত সঁপে দিয়ে দৌড়াতে থাকি। কে আমার হাত ধরে রেখেছে? কার সাথে ছুটে যাচ্ছি কিছুই জানি না। কিন্তু সেই হাতের মুঠোয় নিজেকে ভীষন নিরাপদ অনুভব করছি। অনেক্ষণ ছুটার পরে একটি বড় কুঁড়ি গাছের নিচে এসে থেমে দুজনেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকি। কিসের টানে কুঁড়ি গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি এখান থেকে চাঁদটাকে আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বড় রুপোর থালার মতো মনে হচ্ছে চাঁদটাকে। সবকিছু ভুলে চাঁদ সুন্দরীর রূপের চাঁদনীতে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছি আমি। কিছুটা দূরে নদীর ঢেউয়ের কলকল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই রাত,মাধবী ঘেরা আকাশের বুকে মরিচ বাতির মতো জ্বলজ্বল করা লক্ষ তারার ভীড়ে রুপসী সাদা চাঁদ। আর সামনে তিতাস নদীর বিরঙ্গনা স্রোতস্বীনির ফোস ফোস করা কুলকুল ঢেউয়ের শব্দ সবকিছু মিলিয়ে এক অন্য জগতে পোঁছে দিয়েছে আমাকে; যে জগতে দেহের কোনো চিহ্নও পড়ে না! এই জগতে কেবল গন্তব্যহীন পথিকের মতো অগণিত ফেরারি হৃদয়েরা বসবাস করে। হুট করেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আমার হাতটাকে ধরে রাখা সেই হাতের দিকে তাকালাম। কালো আর রূপালির মিশেলে পাঞ্জাবী পরা কালো বলিষ্ঠ একটি হাত আমার হাতটাকে শক্ত করে মুঠোয় ধরে রেখেছে। পূর্ণিমায রাত হওয়ায় সবকিছু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। হাতটাকে অনুসরণ করে উপরের দিকে তাকাতেই একটা হেঁচকা টানে সেই হাতের মালিক আমাকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। আচমকা এমন করাতে ভয়ে আমি তার বুকের দুই পাশের পাঞ্জাবী আঁকড়ে ধরলাম। আমাদের দুই জনের নিঃশ্বাসের শব্দ চারপাশের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। যার বুকের মাঝে আমি মাথা গুজে রয়েছি সে যে একজন সুপুরুষ সেটা তাকে ভালো করে না দেখেও আমি বেশ বুঝতে পারছি। লোকটা উচ্চতায় আমার থেকে কয়েক ইঞ্চি লম্বা। তার সুঠাম দেহ, সুউচ্চ কাঁধ আমার মনে হেয়ালি তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। নিজের অজান্তেই আমার দুই হাতে তার পিঠে আঁকড়ে ধরলাম। তার বুকে মাথা রেখে তার হৃদ স্পন্দন শুনতে লাগলাম। অদ্ভূত একটা সুখের অনুভূতি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কত কাল ধরে এই বুকে মাথা রেখে তার হৃদ স্পন্দন শুনেছি আমি! মনে হচ্ছে আমি তাকে চিনি; সে আমার অনেক পরিচিত আর খুব কাছের কেউ! তার শক্ত বাহু ডোরে নিজেকে সঁপে দিয়ে সুখের আবেশে দুই চোখ বুঝে এমনি অচেনা সুখের অনুভূতিতে যখন মজে আছি, তখনি একটি পুরুষালী কণ্ঠ ভালোবাসা মাখানো নরম আর আদুরে সুরে বলতে লাগল,
“তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দে আমার বুকের ভেতরে ভালোবাসারা জেগে উঠছে আরজু! তোমার দু’চোখের পাতায় ঘুম হয়ে মিশে যেতে ইচ্ছ করছে। তোমার কোমল হৃদয়ে আমার নামের ঝড় তোলার বড় সাধ জাগছে। জগতে কার ভালোবাসার রঙ কেমন হয় তা আমি জানি না; কিন্তু এটা জানি, তোমার আর আমার “ভালোবাসার রঙ কালো”!
.
ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যেতেই বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে অদ্ভূত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি। মুচকি হেসে সেই স্বপ্নের কথা ভাবতে লাগলাম। রাতের আঁধারে জনশূন্য তিতাস নদীর পাড়ে একলা একটি কুঁড়ি গাছের নিচে রূপালি পাঞ্জাবী পরা আমার খুব পরিচিত এক সুদশর্ন পুরুষের বুকে মাথা রেখে তার হৃদ স্পন্দন শুনছিলাম আমি। সে আমাকে তার হৃদয়ের গহিনের ভালোবাসার ইচ্ছেগুলো বলছিল। ভীষণ মিষ্টি ছিল স্বপ্নটা। ইশ! কেন যে ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্নটার কথা ভাবতেই আফসোস হতে লাগল আমার। এখন যদি ঘুম না ভাঙতো তবে হয়তো আরও অনেক্ষণ সেই স্বপ্নটা দেখতে পারতাম। কিন্তু তাহলে তো আমার ফজরের নামায কাযা হয়ে যেত। ভালোই হয়েছে আমার ঘুম ভেঙে গেছে৷ কারণ ঘুম আর অলীক স্বপ্ন থেকে নামায উত্তম। তবে স্বপ্নে কেন জানি আমার বারবার মনে হচ্ছিলো সেই লোকটা মিহির ভাই ছিল! মিহির ভাই ভেবেই আমি তার বুকে মাথা রেখে তাকে জরিয়ে ধরেছিলাম। ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি? এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেছি যে স্বপ্নে কাকে না কাকে মিহির ভাই মনে করে জরিয়ে ধরেছি! আর মিহির ভাইকে ভেবে এত খুশি হওয়ারই বা কি ছিল! কেন জানি হুট করেই আমার ভীষণ লজ্জা লাগল। যেন মিহির ভাইকে স্বপ্নে না, বাস্তবেই জরিয়ে ধরেছি আমি!
.
সকাল থেকেই মিহির ভাইকে এক নজর দেখার জন্য মনটা আনচান করছে। গত সাতদিন তাকে একটা বারের জন্যও দেখেনি। আমার কি হয়েছে, কেন এমন করছি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এতটুকু অনুভব করতে পারছি আমার মন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। যে আমি মিহির ভাইকে সহ্যই করতে পারতাম না৷ সেই আমি এখন তাকে এক ঝলক দেখার আশায় অস্থির হয়ে পড়েছি। গত সাতদিন আগে তার তার সাথে হয়েছিল আমার। সেদিন যখন আমি ওয়ালেট রেখে মিহির ভাইয়ের রুম থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম; তখনি কোথায় থেকে যেন জাদু দিয়ে তিনি রুমের ভেতরে এসে হাজির হয়ে আচমকা আমার পিছন থেকে রাশভারী কণ্ঠস্বরে বলে ওঠেন,
” যা একবার দিয়ে দেই সেটা আর ফেরত নেই না আমি। আর যদি কেউ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তাকে এর উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়!
আমি কিছু না বলে পিছনে ফিরে ভীরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছাই রঙা একটা ফুলহাতা শার্ট পরে একহাতের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছিলেন মিহির ভাই। মাথা ভর্তি এলোমেলো ঝাকড়া চুলের কয়েকটি এসে তার কপালে পড়ে ছিল। আর সব সময়ের মতোই তার শার্টের বুকের উপরের তিনটি বোতাম খোলা ছিল। এবং অতীতের মতোই তার কালো পুরুষ্ট বুকের অনেকটা দেখা যাচ্ছিল। আমি ভীতু হরিণীর মতো তার দিকে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু তিনি আমার সেই চাহনিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাগে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। চরমভাবে অপমানিত হয়ে যখন আমি সেখান থেকে চলে আসতে গেলাম, তখনি আবার দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকাতেই মিহির ভাই তার ওয়ালেটটা আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুনরায় দরজা লাগিয়ে দেন। দ্বিতীয় বারের মতো অপমানিত হয়ে আমি ফ্লোর থেকে তার ওয়ালেটটা কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে আমার রুমে চলে আসি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন মিহির ভাইয়ের প্রতি আমার একটুও রাগ হয়নি। বরং এর পরিবর্তে তার জন্য আমার মায়া হতে থাকে। লোকটা নিজ থেকে যেচে আমার সাহায্য করতে এসেছিল। আর আমি কি না তার বাড়িতে থেকেই তার সাথে বিরোধিতা করছিলাম! সেই মূহুর্তে থেকে আমি না চাইতেও মিহির ভাইকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। এবং সেই এখন ভাবনা এতটাই গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে যে, কাল রাতের স্বপ্নেও আমি তাকেই ভেবেছি। মিহির ভাই বরাবরই আত্ন-অহংকারী মানুষ। তার একরোখা ভাবটা সেই ছোট থাকতেই দেখেছি। ভাড়া বাসায় না উঠে আংকেল তাদের সবাইকে নিয়ে কেন আমাদের বাড়িতে থাকতে উঠেছিলেন, সেটা নিয়ে খুব রেগে ছিলেন তিনি আংকেলের প্রতি। এমনকি আমাদের বাড়িতে আসার পর প্রথম চার পাঁচ মাস কারোর সাথেই কথা বলেননি। শুধু তার ছোট ভাই বোনের সাথে কথা বলতেন আর তাদের সাথেই খেলতেন। পাঁচ মাস পর আন্টির ঘ্যান ঘ্যানানিতে অতিষ্ট হয়ে মাঝে মাঝে আমাদের সাথেও কথা বলতেন৷ কিন্তু সেই কথাও হতো খুবই সীমিত। তবে আম্মার সাথে খুব ভাব ছিল তার। আর এই নিয়ে আন্টি নাখোশ ছিল তার প্রতি। কেন মিহির ভাই আন্টি থাকা সত্ত্বেও আম্মার সাথে সবকিছু বলতো এই নিয়ে তিনি অনেক কথা শোনাতেন তাকে। তিন বছর পরে তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার আগে মিহির ভাই নাকি ইসরাত আপুকে বলেছিল আমাদের সবাইকে নিয়ে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে। ইসরাত আপু আর তার বয়স প্রায় কাছাকাছি বলে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং এখনো আছে।
” এত মনোযোগ দিয়ে কার কথা ভাবছো আরজুপু?
নিধির কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মুচকি হেসে মজা করে বললাম,
” কালো মানুষের আবার কেউ থাকে নাকি।
” থাকে থাকে, দরকার শুধু একটু মনের দৃষ্টির।
” মানে?
” আহারে বেচারি। কেন তুমি কি আশেপাশের কিছুই দেখতে পাওনা নাকি? কেউ যে সেদিন তোমাকে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে দিলো না!
নিধির ইশারা বুঝতে পেরে খালি মুখেই ভিষম খেয়ে কাশতে শুরু করলাম। নিধি আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” আহা আরজুপু, তোমার এখনি কেন কাশি উঠতে গেল বোলোতো? তোমাকে কাশতে দেখে যার অস্থির হয়ে উঠার কথা সে তো বাড়িতে নেই। তাই আমি বলি কি, তুমি বরং তোমার এই অসময়ের কাশিকে একটু সামলিয়ে রাখো। তারপর সময় সুযোগ বুঝে কাশতে শুরু করবে। তখন আমার জায়গায় অন্য কেউ কাশি থামানোর জন্য তোমার মাথা আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিবে।
আমি হতবাক হয়ে নিধির কথা শুনছি। ওর সাথে আমার কখনো এমন সুসম্পর্ক ছিল না যার অধিকারে ও আমাকে এমন উদ্ভট কথা বলতে পারে!
.
#পর্ব-৭
.
বাড়ি ভর্তি মেহমান। রিধির শ্বশুরবাড়ির অনেক আত্নীয়কেই বিয়ে পরবর্তী দাওয়াত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন দেশের বাইরে থাকায় আসতে পারেনি। তাই যারা বাকি ছিলেন তারা আজকে এসেছে। বলা বাহুল্য মিহির ভাইও আজ বাড়িতে আছে৷ বাইরে কোথাও যাননি। আব্বা নোমান আর আম্মাকে সাথে নিয়ে তাঁর এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে গেছেন। আমাকেও তাদের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই যাইনি। কি দরকার এত মানুষের ভীড়ে গিয়ে নিজের গায়ের কালো রঙের গুণকীর্তন শোনার। আমার রুম থেকে ড্রইংরুমের অনেকটাই দেখা যায়। আমি রুমে বসেই সেদিকে তাকিয়ে আছি। নিধি আর নাহিদ রিধির বরের সাথে দুষ্টুমি করছে। তাদের পাশেই রিধির শ্বাশুড়ি আর তার কিছু আত্নীয়া আন্টি আর রিধির সাথে গল্প করছে। রিধির পরণে লাল জামদানি শাড়ি। ওর গায়ের ফর্সা রঙের মাঝে লাল রঙটা ফুটে ওঠেছে। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর। ওর বরটাও দেখতে সুন্দর। ওদের দুজনকে একসাথে দেখলে মনে হবে সুন্দরে সুন্দরে কাটাকাটি হয়ে গেছে। ওরা দুইজনেই ফর্সা হওয়াতে যদি কাটাকাটি হয়ে যায়, তবে কী আমার আর মিহির ভাইয়ের দুই জনেরই গায়ের রঙ কালো হওয়ার জন্য আমাদের মাঝেও কাটাকাটি হয়ে যাবে! পাগলের মতো এসব কী ভাবছিস আরজু? তোর কি মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে, নাকি আরও খানিকটা বাকি আছে? মনে মনে নিজেকে কড়া শাসন করলাম। এর মাঝেই মিহির ভাই আর আংকেল এসে সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিলেন। তাদের সাথে রিধির শ্বশুরও আছেন। মিহির ভাইকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। রুপালী আর কালো মিশেলে একটি পাঞ্জাবী পরে আছেন তিনি। ঠিক যেন আমার দেখা সেই স্বপ্নের মতো! হাতে দামী ঘড়ি পরে আছেন। সব সময়ের মতো আজ তার বুকের উপরের পাঞ্জাবীর বোতামগুলো খোলা নেয়। বরং খুব সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে সেজেছেন তিনি। পাঞ্জাবীতে তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে! আচ্ছা, সব সময় কী তাকে এতো সুন্দর লাগতো না কি এখন হঠাৎ করে তাকে আমার চোখে এত সুন্দর লাগছে সেটা বুঝতে পারছি না। আগেও তো কতবারই তাকে পাঞ্জাবী পরা দেখেছি৷ কই তখন তো আমার চোখে তাকে এত সুন্দর লাগেনি? বরং তাকে দেখলে বিরক্ত হতাম। তাহলে এখন কেন তাকে এত সুন্দর লাগছে আমার চোখে? নাকি এর আগে আমি তাকে কখনো এত মনোযোগ দিয়ে দেখেনি? আড্ডার মাঝখানে মিহির ভাই আংকেলকে কি যেন বলে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। তার যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ছোট একটি তিন চার বছরের বাচ্চা মেয়ে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠল। ওর চিৎকারে সবাই যে খুব বিরক্ত হচ্ছে সেটা তাদের মুখভঙ্গি দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বাচ্চাটার মা আসেনি নাকি সাথে? ওকে কেউ থামাতে পারছে না কেন? মিনিট দশেক পরেও বাচ্চাটি আগের মতো কেঁদে চলেছে। বাচ্চাটা দেখতে ঠিক আমার মতো কালো। তাই হয়তো ওর জন্য আমার মায়াটাও একটু বেশি হচ্ছে। অনেক্ষণ উসখুস করার পর আমি ড্রইংরুমে গিয়ে রিধিকে বাচ্চাটার মা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, এটা ওর বড় ননদের একমাত্র মেয়ে। ওর মায়ের অফিসে জরুরি কাজ থাকায় ওদের সাথে আসতে পারেনি। এটা শুনে আমি ওকে বাচ্চাটার কান্না থামানোর কথা বলতেই ও মেয়েটাকে আমার কোলে দিয়ে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল,
” ওর নামও কিন্তু আরজু!
আমি অবাক হয়ে ছোট আরজুকে কোলে নিয়ে লিফটে উঠে বোতাম চাপলাম।
ছোট আরজুকে নিয়ে ছাদে আসতেই মিহির ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম। আরজুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে খানিকটা সামনে এগিয়ে যেতেই দেখি, তিনি মোটা দেখতে একটি ছেলেকে কি যেন বোঝাচ্ছিলেন। আমি আরজুকে নিয়ে তার আরও কাছাকাছি যেতেই শুনি তিনি ছেলেটিকে বলছেন,
” শোনো হিশাম, তুমি মোটা বলে সবাই তোমাকে ঘৃণা করে এটা কিন্তু তোমার ভুল ধারণা। আসলে সবাই তোমাকে তাদের সমপর্যায়ের ভাবতে পারে না বলেই তোমাকে কটুকথা বলে। কারণ তুমি তাদের চাইতে আলাদা। তারা সবাই দেখতে একইরকম। আর তুমি সবার থেকে আলাদা। শোনো, ডিজনি আছে না? যারা বাচ্চাদের জন্য ছবি বানায়? সেই ডিজনি ১৯৪১ সালে একটা অ্যানিমেশন ছবি বানিয়েছিল৷ ছবিটার নাম হচ্ছে ডাম্বু (Dumbo)। এই ছবিটার নতুন ভার্সনও আবার রিলিজ হয়েছে এই বছরে। সেই ছবিতে নীল চোখের একটি ছোট্ট হাতির বাচ্চাকে দেখানো হয়েছে। সেই বাচ্চা হাতিটির নামই ছিল ডাম্বু। এবং সেই ডাম্বুর দুটি কান ছিল সাধারন হাতিদের চেয়ে অনেক বড়। আর এই জন্য ডাম্বুর মা ছাড়া অন্য সব হাতিরা সবাই ওকে নিয়ে হাসি তামাশা করতো। ডাম্বুর মা আর অন্য হাতিরা সার্কাসে থাকতো। সেখানেই একটি ঘটনার দ্বারা ডাম্বুর একটি ছোট ইঁদুরের সাথে দেখা হয়। এবং সেই ইঁদুরের মাধ্যমেই ডাম্বু জানতে পারে ওর কান দুটি অন্যদের মতো সাধারণ কান ছিল না। সেই কান দুটির বিশেষ গুণ হচ্ছে ঐ কান দুটি দিয়ে পাখির ডানার মতো উড়া যায়! সেই থেকে নীল চোখের সেই ছোট্ট হাতি ডাম্বু ওর পাখির ডানার মতো কান দুটির সাহায্যে উড়ে বেড়াতো!
মিহির ভাইয়ের মুখে হিশাম নাম শুনেই ছেলেটিকে চিনতে পেরেছি। ও চার তালার ডাক্তার সাহেবের ছোট ছেলে। তার বৃদ্ধ কালের সন্তান। হিশাম হা করে মিহির ভাইয়ের কথাগুলো শুনছে।
মিহির ভাই বলতে থাকেন,
” ডাম্বুর মতো তুমিও হলে স্পেশাল। অন্যদের চাইতে তুমি দেখতে ব্যতিক্রম। তাই সবাই তোমাকে তাদের সাথে মেনে নিতে পারে না। তবে তুমি এখন থেকে ফ্যাট খাবার কম করে খাবে। তাহলে তুমি আরও অসাধারণ হয়ে যাবে।
তার কথা শুনে ছোট আরজুও কান্না বন্ধ করে চুপ করে আছে। আমি ওকে নিয়ে লিফটে উঠতেই ও জোরে চিল্লানো বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কিন্তু এখন ওর ফোঁপানোও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আরজুকে কোলে নিয়েই মিহির ভাইয়ের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তখনো হিশামকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন।
” আমিও তো দেখতে অন্যদের চাইতে আলাদা। আমার গায়ের রঙ কয়লার মতো কুচকুচে কালো। তাহলে কী আমিও স্পেশাল?
আমার কথা শুনে মিহির ভাই আর হিশাম দুজনেই পিছনে ফিরে তাকালো। আমি আরজুকে কোল থেকে নামিয়ে হিশামের পাশে বসিয়ে দিলাম। তারপর মিহির ভাইকে তার ফোনটা দিতে বললাম। তিনি চোখমুখ কুঁকচে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকে তাড়া দিয়ে বললাম,
” কি হলো দিন।
মিহির ভাই পাঞ্জাবীর পকেট তার ফোনটা বের করে দিলেন।
” ফোনের লকটাও খোলে দিবেন।
তিনি ফোনের লক খুলে দিলে আমি ফোনটা নিয়ে ইউটিউবে ডিজনির ডাম্বু সিনেমাটা সার্চ দিয়ে প্লে করে সেটা হিশাম আর আরজুকে দেখতে দিয়ে মিহির ভাইকে ডালিয়া গাছের কাছে আসতে বলে চলে আসলাম। আমার পিছু পিছু তিনিও আসলেন। এই ডালিয়া গাছটার এইখানেই সেই রাতে প্রথম বার মিহির ভাই আমার অনেকটা কাছে এসেছিলেন। সেই সময়ের কথা ভাবতেই আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠল।
” এখানে ডেকেছ কেন আমাকে?
মিহির ভাই চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মুখের হাসি ধরে রেখেই উত্তর দিলাম,
” আপনাকে একটা বিষয় মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।
” কী?
আমি হুট করে তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। ঠিক যেমন সেই রাতে তিনি আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি এমন কিছু করবো এটা তিনি কল্পনায়ও ভাবেননি হয়তো। তিনি প্রায় লাফিয়ে আমার থেকে দূরে সরে গেলেন। আমিও সেই রাতে মিহির ভাইয়ের মতোই পুনরায় তার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তিনি আতংকিত গলায় প্রশ্ন করলেন,
” এসব কী করছো আরজু?
” আপনাকে অনুকরণ করছি।
” মানে!
” সেই রাতে আপনিও শিলাকে দিয়ে আমাকে ছাদে ডেকে এনে এই ডালিয়া গাছে নিচে এইখানে ঠিক এমনভাবেই আমার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভুলে গেছেন?
” নাহ ভুলেনি।
” এটা না ভুললেও অন্যকিছু আপনি ঠিকই ভুলে গেছেন।
মিহির ভাই জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
” কী?
” শাস্তি! আপনার আমাকে শাস্তি দেওয়ার কথা ছিল। সেটা আপনি ভুলে গেছেন।
আমার মুখে কথা জড়িয়ে আসছে। কারণ মিহির ভাই আবার তার বুকের পাঞ্জাবীর বোতাম খুলে রেখেছেন। যার দরুন তার বুকের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। ড্রইংরুমে তো তার পাঞ্জাবীর বোতাম গুলো লাগানোই দেখেছিলাম। ও এই জন্যই বুঝি তিনি সেখান থেকে উঠে ছাদে চলে এসেছেন। তার শার্ট/পাঞ্জাবীর সব বোতাম লাগিয়ে রাখলে হয়তো কষ্ট হয় কিংবা এটাই তার অভ্যাস!
” জীবনে এই প্রথমবার আমি চেয়েও কাউকে শাস্তি দিতে পারছি না।
মিহির ভাইয়ের কথায় আমার চিন্তার ঘোর কাটলো। তিনি অনেকটা অসহায়ের মতো করে কথাটা বললেন।
” কাকে চেয়েও শাস্তি দিতে পারছেন না?
মিহির ভাই হতাশার সুরে বললেন,
” তোমাকে!
তার জবাব শুনে আমার সেই স্বপ্নের মতো সুখ সুখ অনুভূতি হতে লাগল। তিনি চেয়েও আমার উপরে রাগ করতে পারছেন না। আর তাই এটা নিয়ে তিনি বিরক্ত হয়ে আছেন।
মিহির ভাই আমার চোখে চোখ রেখে রাগী সুরে বললেন,
” আমি অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে কোনো শাস্তি দিতে পারছি না। তুমিই প্রথম যে আমাকে অপমান করার পরও এখনো কোনো শাস্তি পাওনি।
আমিও মাথা উচু করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
” কে বলেছে আপনি আমাকে কোনো শাস্তি দেননি? আপনি যে ভাবনার চাইতেও অনেক বড় শাস্তি দিয়েছেন আমাকে!
” আমি তোমাকে কখন শাস্তি দিলাম?
” এই যে গত সাত দিন আমাকে আপনার মুখও দেখাননি৷ এটা যে আমার জন্য কতবড় শাস্তি ছিল, সেটা আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না।
মিহির ভাই অবিশ্বাস্য চোখে আমাকে দেখছেন। আমি তার থেকে দৃষ্টি লুকিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,
” সেদিন আপনি কেন নিধিকে আমাকে টাকা দিতে দেননি সেটা আমি তখন বুঝতে পারিনি। এবং পরে যখন আমার প্রতি অধিকার দেখিয়ে আপনার ওয়ালেট দিয়ে এসে ছিলেন; এবং আমার কাছে সব সময় ওয়ালেট রেখে আপনার উপর অধিকার জমাতে ইশারা করেছিলেন সেটাও বুঝতে পারিনি। কিন্তু,
মিহির ভাই চাতক পাখির মতো একবুক আশা নিয়ে আমার কথাগুলো শুনছিলেন। হঠাৎ আমাকে কথার মাঝে থেমে যেতে দেখে তার সহ্য হলো না। উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
” কিন্তু?
আমি লজ্জা মাখা কণ্ঠে আস্তে করে বললাম,
” আমি আপনাকে আমার স্বপ্নে দেখেছি। তারপর নিধিও আমাকে পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে।
আমার কথা শুনে মিহির ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তারই ছোট বোন তার মনের গোপন অনুভূতি তার অজান্তেই আমার আগে জেনে গেছে। সেটা শুনে মনে হয় হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” নিধি কি বুঝিয়েছে তোমায়?
” আমি যে বয়সে ওর থেকে বড় হয়েও কতটা অবুঝ সেটাই বুঝিয়েছে।
মিহির ভাই আমার দিকে হালকা ঝুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি বুঝেছো তুমি?
আমি দুই পা পিছিয়ে গিয়ে লজ্জায় দুইহাতে আমার মুখ ডেকে নিলাম।
” আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মুখ ডাকছো কেন আরজু?
মিহির ভাই আলতো করে আমার মুখের উপর থেকে হাত দুটো সরিয়ে দিয়ে বললেন,
” আমার দিকে তাকাও। এতক্ষণ তো অনেক সাহস দেখাচ্ছিলে? আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলে। এখন কি হলো তোমার?
আমি তখনো মাথা নিচু করে আছি।
মিহির ভাই আমার থুতনি ধরে মুখ উপরে তুলে আমার মুখের উপরে সামান্য ঝুকে আসলে আমি আবার আমার চোখ বন্ধ করে নেই।
মিহির ভাই আমার কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে ভালোবাসো আরজু?
আমি চোখ বন্ধ রেখেই লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেললাম,
” বাসি!
.
#চলবে ….
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here