#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক — #মাহমুদ
পর্ব — ৪
,
রূপা ড্রইংরুমে চুপটি মেরে বসে আছে। ফারজানা বেগম কিছুক্ষণ আগে তাকে এখানে বসতে বলেছিলেন। সেই সুবাধেই রূপা এখানে বসে আছে ফারজানা বেগমের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর ফারজানা বেগম গয়নার বক্স নিয়ে ড্রইংরুমে আসলেন। রূপা উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,
– ‘আরে মা বস বস। কষ্ট করে এত দাঁড়ানোর দরকার নেই।’
বলেই তিনি রূপাকে বসিয়ে সেও তার পাশে গিয়ে বসলেন।
– ‘মা এগুলো কী?’
মা হাসিমুখে বললেন,
– ‘তোর জন্য কিছু গয়নাগাটি এনেছি। এজন্য তোকে ডাকা!’
– ‘আরে মা না না। এসব আমার লাগবে না।’
– ‘লাগবে না কেন? তোকে তো বিয়ের পর থেকে কিছুই দেয়া হয়নি। সেই যে বিয়ের সময় একটা গলার নেকলেস, একটা বালা, আর একটা কানের দুল দিয়েছিলাম। তারপর তো আর কিছুই দেয়া হয়নি। অবশ্য তখন এর থেকে বেশি কিছু দেয়ার সামর্থ্যও ছিলো না আমাদের। কিন্তু এখন যখন সময় হয়েছে অবশ্যই তোর ভরণপোষণে কমতি রাখবো না।’
– ‘মা আমি এগুলো নিতে পারবো না। আপনি এই গয়নাগুলো যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিন।'(লেখক মাহমুদ)
– ‘এটা কোনো কথা হলো? আমাকে কি একটু মা ভাবতে পারিস না? তোর মা যদি এগুলো দিতো তাহলে কি তুই না করতিস?’
– ‘মা এমনভাবে বলছেন কেন? আমার আপন মা বলতে আপনিই আছেন। এমনভাবে আর কখনো বলবেন না।’
– ‘আচ্ছা বলবো না। তবে একটা শর্ত আছে! শর্তটা হলো তোকে এই গয়না গুলো নিতে হবে। কী? নিবি তো?’
মাথা নাড়িয়ে রূপা বললো,
– ‘জি মা।’
– ‘এই তো আমার লক্ষি মেয়েটি।’
রূপা মুচকি হাসলো। বললো,
– ‘জানেন মা? ছোটবেলা থেকে কখনো মায়ের ভালোবাসা পায়নি। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম কিছু বুঝতাম না তখন মা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা তখন খুব ভেঙে পড়ি। তবে আমার থেকে আমার বাবাই বেশি ভেঙে পড়েছিলেন। ছোট থেকেই তাকে দেখে এসেছি কখনো কোনো কিছুতে তিনি ভেঙে পড়তেন না। কিন্তু যেদিন বাবা মায়ের এক্সিডেন্টের কথা শুনেছিলেন সেদিন উনি খুব ভেঙে পড়েন। হসপিটাল থেকে জানানো হলো মা মারা গেছেন। সেদিনের পর থেকেই আমাদের সবকিছু উলাটপালাট হয়ে গেল। বাবা কয়েক মাস পর বিয়ে করলেন। হয়তো উনি ভেবেছিলেন বিয়ে করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমরাওল আবারও মায়ের ভালোবাসা পাবো। কিন্তু সেটা আর হলো না। মা হয়ে উঠলো সৎ মা। সবসময় আমাকে আর বোনকে মারধর করতেন। কখনো নিজের মেয়ে ভেবে আমাদেরকে বুকে টেনে নেননি। জানেন মা? তখন নিজেকে বড্ড অসহায় লাগত। ভাবতাম আমরা কি কখনোই মায়ের ভালবাসা পাবো না?’
বলতে বলতেই রূপার চোখ দিয়ে পানি চলে এল। ফারজানা বেগম রূপাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– ‘কাঁদিস না মা! কে বলেছে তোকে যে তুই মায়ের ভালোবাসা পাবি না? আমি কী তোর মা নয়? আমি তোকে আর নিলুকে কী কম বেশি ভালোবাসি? তোরা দুজনই আমার সন্তান। দুজনকে কখনো আমি ভেদাভেদ করে দেখিনি। তোরা দুজনই আমার কাছে একই রকম। আর আজ তোর সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে! কথাটা বলা অতি জরুরী। কথাটা হলো তোর ছোট বোন নিপা আজ থেকে আমার মেয়ে। আর আজ থেকে ও আমাদের সাথেই থাকবে। তুই, ধ্রুব, নিলু তো আমার সন্তান ছিলিই, আজ থেকে নিপাও আমার সন্তান। কখনো ওকে কোনো কিছুতে কমতি রাখবো না। সেটা ভরণপোষণ হোক কিংবা ভালোবাসা! সবকিছুই ও সমান সমান পাবে। এবার তুই বল নিপাকে এখানে আনলে তোর কী কোনো সমস্যা হবে?'(লেখক মাহমুদ)
রূপা কিছু বলছে না। ছলছলে চোখে সে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। সত্যিই কী পৃথিবীতে এত ভালো মনের মানুষ পাওয়া যায়?
– ‘কী বলিস? তোর কী কোনো আপত্তি কিংবা সমস্যা আছে?’
– ‘মা, মাগো! আপনি এত ভালো কেন মা? কিভাবে একটা মানুষ এতটা ভালো হতে পারে?’
মা হাসলেন। রূপা আবারও বললো,
– ‘মা জানেন? আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আপনার মত একটা মা পাবো। খুব ভালোবাসি আপনাকে! খুব ভালোবাসি।’
ফারজানা বেগম ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– ‘আমিও যে তোদেরকে বড্ড ভালোবাসি রে পাগলী। আর কখনো যেন বলবি না, তোদের মা নেই।’
– ‘বলবো না।’
– ‘দেখেছো মেয়েটার কান্ড? এই পাগলী কাঁদছিস কেন? এমনভাবে কেউ কাঁদে নাকি? আমি আছি তো তোর সাথে।’
– ‘হু….’
ফারজানা বেগম রূপার চোখমুখ মুছে দিলেন। রূপার ডান হাত ধরতে গিয়ে দেখতে পেলেন বেশ কিছু জায়গা জুড়ে হাতটি পুড়ে গেছে। তিনি বেশ আতংকিত হয়ে বললেন,
– ‘তোর হাতে কি হয়েছে? এমন অবস্থা কিভাবে হলো? সেদিনও হাত পুড়ল আর আজও পুড়েছে! কিভাবে হলো এমনটা?’
রূপা সাথে সাথে আচল দিয়ে হাত ঢেকে ফেলল। মা বললেন,
– ‘লুকিয়ে কী লাভ? সেই সেই তো আমি দেখেই ফেলেছি। এখন বল কীভাবে পুড়লো? হাত তো দেখে মনে হচ্ছে আজ পুড়ে নিই। তাইলে কবে পুড়লো?’
রূপা আমতাআমতা করে বললো,
– ‘কাল মা।’
– ‘কিভাবে পুড়েছে?’
– ‘আসলে মা, আমি যখন কাল মাছ ভেজে বাটিতে তুলছিলাম তখন হঠাৎ হাত ফসকে গরম মাছ আমার হাতে পড়েছিল। ও কিছু হয়নি মা। ওই সামান্য পুড়েছে।’
কথাগুলো বলতে বলতেই ধ্রুব ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো। মা ওকে ডেকে বললেন,
– ‘দেখেছিস তোর বউয়ের কান্ড? হাত পুড়িয়ে বলে কিনা কিছুই হয়নি? তুই তো অত্যন্ত ওর হাতে মলম লাগিয়ে দিতে পারতিস। তাহলে আর ঘা টা বেশি বাড়তো না।’
ধ্রুব একথা শুনে হাত থেকে ব্যাগটা চেলে ফেলে দিলো। দ্রুত রূপার পাশে বসে তার হাতটি ধরতে ধরতে বললো,
– ‘ওহ মাই গড!! কীভাবে পুড়িয়েছো? রান্নার সময় কী একটুও খেয়াল থাকে না তোমার? অবশ্য খেয়াল থাকবে কীভাবে? সারাদিন তো শুধু কাজ আর কাজ! এত কাজ করতে বলে কে তোমার? কাল থেকে ভাবছি একটা কাজের লোক রাখবো।’
মা সম্মতি জানালেন। বললেন,
– ‘ঠিক বলেছিস। একটা কাজের লোক রাখতেই হবে। ও আমার মেয়ের মতন। যেখানে নিলু রাধে না সেখানে ও রাধবে কেন? ওকে তো আর আমি ছেলের বউ এর চোখে দেখিনা। সবসময় মেয়ের চোখেই দেখি। আর সন্তানের কষ্ট কোনো মা’ই সহ্য করতে পারে না। বেশ কদিন ধরে দেখছি মেয়েটা কষ্ট করেই যাচ্ছে। কখনো তো এই রান্না করে তো কখনো ওই রান্না করে। বুঝি না রান্নাবান্নাতে কী এমন পেয়েছে? যাজ্ঞে সেসব কথা। তুই কালই কাজের মেয়ে ঠিক করবি।’
– ‘হুম।’
– ‘এখন হুম হুম না করে ওর হাতে মলম লাগিয়ে দে তো।’
– ‘হু… আর মা একটু মলমটা এনে দাও তো।’
– ‘আচ্ছা এনে দিচ্ছি।'(লেখক মাহমুদ)
ফারজানা বেগম চলে যেতেই রূপার হাত শক্ত করে ধরলো ধ্রুব। হাত এতটা শক্ত করে ধরেছে যে রূপার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে রূপার হেচকি উঠে গেল। ধ্রুব আরো শক্ত করে হাত ধরে বললো,
– ‘খুব বার বেড়েছিস না?’
– ‘আহ! লাগছে!’
ধ্রুব রূপার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
– ‘লাগছে না? আমার মায়ের সামনে এত নাটক করিস কেন? কী পেয়েছিস কী আমার মাকে? হ্যা? কী ভেবেছিস? আমার মাকে বশে নিলে তুই আমার হাত থেকে বেঁচে যাবি? হা হা হা! কখনোই না। তোকে তো আমি….’
কথাগুলো বলতে বলতেই ধ্রুব বুঝলো মা ড্রইংরুমে প্রবেশ করেছেন। ধ্রুব কথা ঘুরিয়ে বললো,
– ‘দেখো রূপা, কাল থেকে একদমই রান্নাঘরে পা রাখবে না। আর আমি তোমার কোনো কথা শুনছি না। কাল কাজের লোক রাখবো ব্যস রাখবো।’
মা সায় দিয়ে বললেন,
– ‘ধ্রুব একদম ঠিক বলেছে। কাল থেকে তোর রান্নাঘরে যাওয়া অফ।’
রূপা কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইলো। মা বললেন,
– ‘ধ্রুব বাবা, তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।’
– ‘হ্যা মা বলো।’
– ‘তোর যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে কী আমি রূপার ছোট বোন নিপাকে এই বাড়িতে আনতে পারি?’
– ‘কেন নয়? অবশ্যই আনতে পারো। এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে?’
– ‘হুম। কিন্তু এই আনা সেই আনা নয়।’
– ‘মানে?’
– ‘আমি ভাবছি নিপা সারাজীবন এই বাড়িতেই আমাদের সাথে থাকবে। তুই কী বলিস?’
ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ ছিলো। এরপর বললো,
– ‘অবশ্যই থাকতে পারে। ও তো আমার ছোট বোন নিলুর মতন’ই। ও এবার থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। তুমি যদি বলো আমি আজই ওকে নিয়ে আসবো।’
– ‘আরে না না। আজ না। কাল ধীরে সুস্থে গিয়ে আনবো। যেহেতু ওর মা বাবা আছে। অবশ্যই তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই আনতে হবে। তাই আমি ভেবে রেখেছি রূপা আর আমি গিয়ে ওকে আনবো।'(লেখক মাহমুদ)
– ‘তুমি যা ভালো বোঝো তাই কর। আর রূপা আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে আসো তো। খুব টায়ার্ড লাগছে।’
– ‘জি।’
ধ্রুব চলে গেল। রূপা ফারজানা বেগমের থেকে সম্মতি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো। এরপর এক গ্লাস পানি নিয়ে সে পা বাড়ালো তার ঘরের দিকে।
চলবে,,,,,,,,,,,
লেখকের অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ