ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ২৫

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ২৫

ইভান আর তামান্না টেবিলের দুপাশে দুইজন বসে আছে.. গল্প করার চিন্তাভাবনা হয়তো তাদের মাথায় আপাতত নেয়.. একজন অন্যজনের চোখে ডুবে থাকাটাই যেন তাদের এখনকার মূল উদ্দেশ্য..
ইভান গালে হাত দিয়ে একপলকে তামান্নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে.. আর তামান্না লাজুক হাসি মুখে ঝুলিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে… ইভানের চোখের দিকে তাকালেই যেন তার শরীরে বিদুৎ খেলে যায়!! এ যেন এক অদ্ভুত অনূভূতি!! অন্য রকম শিহরনজাগানো!!

হঠাৎ কোথা থেকে এসে ইফতি তাদের মাঝখানে একটা চেয়ারে ধুপ করে বসে পড়লো.. আর ব্রু কুঁচকে দুজনের দিকে তাকালো.. তারপর সব খাবারগুলো একাই খেতে শুরু করে দিলো!!!
তামান্না অবাক হয়ে তাকালো সেদিকে আর ইভান ব্রু কুঁচকে ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল– কাবাবের মধ্যে এতো বড় হাড্ডিটা কি হওয়া কি খুব জরুরি ছিল??
ইফতি পিজ্জার স্লাইডের আরও একটা বাইট নিয়ে বলল– খাবারের সদ্ব্যবহার করছি.. খাবার চেয়ে থাকার জিনিস না.. আয়েশ করে বসে গরম গরম খাবারটা মুখের ভিতর পুরে দেওয়ায় তৃপ্তি!!! এইবলে একটা ফিসফিংগার মুখে পুরে দিল সে.. আর ফলসরুপ সসে তার ঠোট মাখামাখি….

— খাবারটা তো কেউ নিয়ে খেয়ে নিচ্ছে না.. খাটাশের মতো খাওয়ার মানে টা কি???
ইফতি হঠাৎ এমন কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো.. তারসামনে ইফ্ফাত বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে.. ইফতি সেদিকে তাকিয়ে ডকডক করে এক গ্লাস জিরাজল খেয়ে নিল তাও আবার স্ট্র ছাড়াই.. ইফ্ফাত সেদিকে নাক সিটকে তাকিয়ে বলল– তোমার সাথে ব্রেকআপ করবো আমি তাও আবার বিনা নোটিশে…
ইফতি ধরফরিয়ে দাড়িয়ে তাড়াতাড়ি টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে বলল– জান,, আমি আবার কি করলাম??
ইফ্ফাত — এমন খাচ্চরের মতো খাদক ছেলেকে নিজের পাশে মানায় না ভেবে এই সিদ্ধান্ত.. এইবলে সে ইফতির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সবেগে প্রস্হান করলো.. আর ইফতী হাবলার মতো সেইখানেই বসে পড়লো..
তখন ইভান হেসে বলল– খুব ভালো.. মানুষকে জ্বালানোর শাস্তি..
ইফতি ইভানের মাথায় স্বজোরে টুকা দিয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে প্রস্হান করলো…আর তা দেখে তামান্না জোরে হাসতে লাগলো.. অন্যদিকে ইভান মোহিত হয়ে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো… সে আনমনে ভাবলো— এমন মুক্তোঝরানো হাসি শুধু এই মেয়েই হাসতে পারে…

আজকে রাতেই স্টুডেন্টসদের নিয়ে টিচাররা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে… তাই তাদের ট্রিপের লাস্ট পর্ব. “”” লেকে ঘুরা ও আদিবাসীদের গ্রাম “” এই নামের ট্রিপটি সকালেই আরম্ভ করবেন তারা যাতে তাড়াতাড়ি বেক করতে পারে তারা….

রোদেলা লং টপসের ওপর একটা জ্যাকেট পড়ে নিল সাথে জিন্স.. চুলগুলো পানিটেইল করে বেধে নিল সে.. কয়েকটা প্রজাপতি আর ঝুমকো আছে এমন চুড়ি হাতে পড়ে রুনুঝুনু শব্দ করে হালকা ঘুরে দেখলো কেমন দেখাচ্ছে তাকে… রেডি হয়ে পিছনে ফিরতেই দেখলো তামান্না হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।। রোদেলা ব্রু কুঁচকে বলল– কি সমস্যা?? আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি গিলছিস?? মুখ থেকে কি মধু ঝড়ে পড়ছে??

তামান্না নিজের চোখের নিচে হাত দিয়ে খানিকটা কাজল রোদেলার কানের নিচে লাগিয়ে বলল– কোন জলকুমারের নজর যাতে না পড়ে তোর ওপর…
রোদেলা কনফিউস্ট হাসি হেসে বলল– শুধু জলকুমার ই কেন?? স্থলকুমার ও তো হতে পারে…
তামান্না হেসে রোদেলার কাধে হাত দিয়ে বলল– আরে স্থলকুমাররা তাকালে তো আমার জিজু হাসনাত ভাই একেকটাকে পিটিয়ে উগান্ডায় পাঠিয়ে দিবে… রোদেলা শব্দ করে হেসে দিল…তারপর দুইজনই বেরিয়ে গেল বাইরের উদ্দেশে ..

হাসনাত বোটের সামনে দাড়িয়ে সবাইকে নিয়ে অপেক্ষা করছে.. রোদেলাকে দুচোখ ভরে দেখার নেশাটা যেন তার মনে মধ্যে বারবার চাঙ্গা দিয়ে ওঠছে.. মেয়েটা যে কোথায় থেকে গেল কে জানে— সে অস্হির হয়ে বলল… ইফ্ফাত আর ইফতী দূর থেকে তার অবস্হা দেখে হেসে অস্হির..
হঠাৎ হাসনাত ওপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল.. খাড়া ঢালু বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে রোদেলা. রোদেলাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে আজ।। পুরো একটা ডলের মতো লাগছে ওকে.. আপনাআপনি হাসনাতের মুখ হা হয়ে গেল… রোদেলা সেদিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দিল!! হাসনাতের হঠাৎ মনে হলো বুকের বা পাশটা চিনচিনিয়ে ব্যাথা করছে তার.. আর তার এই ব্যাথার অসুধ রোদেলার কাছে ছাড়া হয়তো আর কারো কাছেই নেয়..রোদেলা গুটিগুটি পায়ে আস্তে আস্তে নদীর কাছে গিয়ে দাড়ালো যেখানে সবাই দাড়িয়ে আছে.. সে আড়চোখে হাসনাতের দিকে তাকালো.. হুয়াট ফরমাল সার্ট আর ব্লেক জিনস পড়েছে সে… চুলগুলো স্পাইক করানো আর এতে তার এইজটা আরো কম লাগছে!!! মাহিয়া হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাসনাতের পাশে দাঁড়িয়ে বলল– স্যার আমাকে নৌকায় তুলে দিবেন??
হাসনাত চোখ বড় বড় করে রোদেলার দিকে তাকালো… আর মনে মনে বিরবিরিয়ে বলল– এই মেয়েটা আমাকে মাইর খাওয়াবে.. নির্ঘাত খাওয়াবে.. কোথায় আমি একটু শখ করছি আমার জানের থেকে ভালোবাসি শুনব.. আর এই মেয়ের কান্ড দেখে না জানি আমার ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে দেয় সে…
হাসনাত পরপর কয়েকবার ঢুক গিলে বলল– মাহিয়া তুমি অন্য স্টুডেন্সদের সাথে যাও..আর আমার লেইট হবে আরো একটু কিছু কাজ আছে. মাহিয়া মুখ ছোট করে ঐখান থেকে প্রস্হান করলো…
হাসনাতের মুখের অবস্হা দেখে রোদেলার মুখে অটোমেটিক হাসি চলে এলো সে মুচকি হেসে বোটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।।।
হাসনাত একলাফে বোটে ওঠে দাঁড়ালো.. তারপর রোদেলার দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল.. রোদেলা হাতটা বাড়িয়ে দিতেই দুষ্টুহাসি দিয়ে হাসনাত জোরে টান দিল ওকে!!..আর রোদেলা হুমড়ি খেয়ে পড়লো সোজা হাসনাতের বুকের ওপর!! সে ভয়ে হাসনাতের শার্টের কিছু অংশ আঁকড়ে ধরলো!! রোদেলার এই অবস্হা দেখে হাসনাত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দুষ্টু হাসি হাসলো ..

রোদেলা চোখ মুদে মনভরে হাসনাতের মিষ্টি স্মেলটা নিজের গায়ে মাখালো.. এতো নেশা কেন তোমার মাঝে হাসনাত ভাই—-রোদেলা আনমনে ভাবলো.. রোদেলা ইচ্ছে সে একবার অ্যালকোহল টেস্ট করে দেখবে.. তার যে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কার মাঝে নেশা সবচেয়ে বেশি.. হাসনাত ভাইয়ের মাঝে নাকি অ্যালকোহলের মাঝে!!!

বোটটা হেলেধুলে চলতে শুরু করলো.. চারিদিকে মিষ্টি বাতাসের সো সো শব্দ…আর পানির সাথে বোটের সংঘর্ষের কলকল শব্দ!! সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা মাতালকরা…মৃদু বাতাস তাদেরকে ছোয়ে দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে বারবার. রোদেলা আড়চোখে কিছুখন পরপর হাসনাতকে দেখছে.. তার ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মনের কথাটা হাসনাতকে বলে দেয় সে.. এই দুরত্ব যে সত্যি অনেকটা কষ্টদায়ক…
অন্যদিকে হাসনাত তার মায়াপরীকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে.. কিছুখন পরপর পানি নিয়ে খেলছে সে.. যেন কোন বাচ্চা মেয়ে.. তার সেই খিলখিলিয়ে হাসি যেন মনের মাঝে মৃদু ঝংকার তুলে..

লেকের মাঝখানে একটা বিশাল গাছ!! কোন কান্ড ছাড়া!! রোদেলার হঠাৎ মনে হলো এই গাছগুলোতে হয়তো ভূতের বসবাস.. সে আস্তে আস্তে হাসনাতের দিকে চেপে বসলো…

হাসনাত রোদেলার মনের ভাব খুব ভালোভাবে বুঝছে..কিন্তু রোদেলার সাথে দুষ্টুমি করার লোভটাও যে অনেকটা মারাত্মক!! নাক মুখ ফোলিয়ে যখন রোদেলা হাসনাতের দিকে তাকাই হাসনাতের তখন তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে যা সে কোনভাবেই মিস করতে চায় না…

সে রোদেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল– হেই মেয়ে,, তোমাকে আমার বড্ড ভালো লেগেছে.. চলো আমার রাজ্যে.. আমি এই গাছের গুড়ির নিচে থাকি.. তোমাকে রানী বানিয়ে রাখবো…

রোদেলা ভয়ে… ও মা গো.. বলে চেচিয়ে ওঠলো.. সবাই অবাক হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইলো আর হাসনাত খিলখিলিয়ে হেসে দিল…

রোদেলা চোখ রাঙ্গিয়ে হাসনাতের দিকে তাকালো.. এইটা কোন দেশীয় অসভ্যতামী.. আর হাসনাত তার তাকানোর স্টাইল দেখে তার দিকে তাকিয়েই চোখ টিপ মেরে দিল.. রোদেলার রাগে পুরো শরীর জ্বলছে.. এ ছেলে কোন কালে ঠিক হবে না।। রোদেলার খুবকরে জানা…রোদেলার এখন হাসনাতকে শিটপাটাই তুলে হলুদের মতো বাড়ি দিয়ে দিয়ে পিশতে ইচ্ছে হচ্ছে . .. সে বিরবিরিয়ে বলল– তোমাকে ভালোবাসি বলবো না আমি কখনো..তুমি বলবে আমাকে…. যদি না বলো কখনো পাবে না আমায়….এইসব ভাবতে ভাবতে মুখ গোমড়াকরে বোটের ভেতর দিয়ে হেটে গিয়ে তামান্নার পাশে বসে পড়লো… তামান্নাটাও ফোনে বিজি.. রোদেলার এবার প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো.. তার ইচ্ছে করছে এই দুইটা কে বড়শিতে গেঁথে লেকের পানিতে নিক্ষেপ করতে..যখন পানিতে ডুবে ডুবে জল খাবে.. আর মাছের কামড় খাবে সব ইতরামি বেড়িয়ে যাবে দুইটার…

লেকের ভ্রমন শেষে রোদেলা নিজেই লাফ দিয়ে বোট থেকে নেমে এলো.. হাসনাতের বিষয়টা মনের মাঝে বড্ড খচখচ করছে…. সে রোদেলার সাথে কথা বলতে তার পিছন পিছন দৌড় লাগালো.. রোদেলাকে দেখতেই তার সামনে দাড়িয়ে গেল সে..তারপর বলল– আমি তো তোর সাথে সবসময় মজা করি.. আজ কেন এতো রাগ করলি??
রোদেলা ব্রু কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে বলল– কিউট কোন মেয়েকে হনুমানের মতো দেখতে কেউ যদি ওল্টাপাল্টা কথা বলে মেয়েটা ছেলেটার সাথে আর কথা ও বলতে চায় না..
হাসনাত মুচকি হেসে রোদেলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল– কোন কিউট মেয়েকে যদি রাগলে আরো কিউট লাগে আর শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হয় তখনই হনুমানের মতো ছেলেটা তাকে আরো বেশি বেশি রাগায়….
এইবলে হাসনাত মুচকি হেসে তার সামনে থেকে চলে গেল.. আর রোদেলা বেকুবের মতো সেখানেই দাড়িয়ে রইলো… তার মাথাটা অতিরিক্ত হ্যাং হয়ে গেল হঠাৎ।। হাসনাত আসলেই কি বুঝিয়ে গেল তাকে এইটাই ভাবতে লাগলো সে…..

পুরো গ্রামটা ঘোরে বেড়াতেই তাদের যাওয়ার সময় হয়ে এলো.. সবাই যে যার মতো বাসে ওঠে বসলো..
তামান্নার মনটা প্রচন্ড খারাপ..সাথে ইভানেরও.. হয়তো অনেককথা বলার আছে তার.. কিন্তু তামান্নার চেহারার দিকে তাকিয়েই যেন সব কথা গলায় আটকে যাচ্ছে ইভানের… তামান্না তাকে বিদায় জানিয়ে গুটিগুটি পায়ে গাড়ির দিকে যাওয়া আরম্ভ করলো আর ইভান পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার যাবার পানে…
হঠাৎ তামান্না কি মনে করে পিছনে ফিরে তাকালো আর ইভান কনফিউস্ট নজরে তার দিকে তাকিয়ে রইলো… আচমকা তামান্না দৌড়ে ইভানের বুকের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো.. হঠাৎ এই চমকে ইভান অবাক হয়ে গেল তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক!! এ যেন খুব প্রিয় মানুষটিকে আরো কাছের করে পাওয়ার আনন্দ!! সে ফিসফিসিয়ে বলল– খুব তাড়াতাড়ি এই বুকটি জুড়ে শুধু তুমিই ঘুমোবে…
ইভানের এই কথাই তামান্নার মাঝে কম্পন সৃষ্টি করলো.।। মুহুর্তেই লাল হয়ে গেল তার গালদুটি!! এক ঝটকায় ইভানকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গাড়িতে ওঠে গেল সে.. আর ইভান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিল….

রোদেলার খুব ইচ্ছে ছিল হাসনাতের পাশে বসাতে.. কিন্তু তামান্নাটা যেন আজ তার সাথেই বসার জন্য গো ধরেছে.. রোদেলা মনে মনে বলল– আমার লাভ স্টোরীতে এতোরকমের হাড্ডি আছে যতগুলো হাড্ডি একটাবক্স কাবাবেও থাকে না…
এইসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুৃমিয়ে পড়ল.. আর তামান্না মুচকি হেসে ভাবলো — বি রেডি ফর ইউর বুক কাঁপানো সারপ্রাইজ!!!!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here