ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ৩৬ এবং শেষ

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ৩৬
অন্তিমপর্ব

হাসনাতের রুমের দরজা খোলা হতেই সে বেরিয়ে এলো… হাসনাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শামীমের দিকে.. শামীমের এতোটা রাগ এর আগে কখনো দেখে নি হাসনাত… সে ধীরপায়ে শামীমের সামনে এসে দাড়ালো … মাথা নিচু করে বলল– আন্কেল আপনি আমাকে খুব ভালো করে চিনেন.. আমি রোদেলার সাথে দুষ্টুমি করি সত্যি কিন্তু রোদেলার কোন ক্ষতি চায় না…আর…
শামীম হাত উচিয়ে থামিয়ে দিল হাসনাতকে তারপর ভারী কন্ঠে বলল– দেখ হাসনাত.. তুমি আর রোদেলা পরস্পরের জন্য তৈরি হও নি.. তোমাদের ভবিষ্যতে আলাদা হতে হতো..তার চেয়ে বরং এখনই আলাদা হয়ে যাও তোমরা…
হাসনাত স্তব্ধ হয়ে তাকালো শামীমের দিকে.। এই শামীম যেন তার কাছে বড্ড অচেনা!! সে নিশ্চুপে বেরিয়ে গেল…

রোদেলা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে… জিবনে সবচেয়ে বেশি যাকে ভালোবেসেছে সে তাকে হারানোর যন্ত্রনাটা সে সহ্য করতে পারবে না।।। এতোটা অসহায় নিজেকে কখনো মনে করেনি সে… রোদেলা কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়লো…

আচমকা ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠলো রোদেলা.. খুব বাজে স্বপ্ন দেখে ঘুৃম ভেঙ্গেছে তার!! সকাল ঘুম থেকে উঠে নামাজটা পড়ে নিল সে.. হঠাৎ তার মনে পড়লো তাদের আকদ হয়েছে.. তারা স্বামী স্ত্রী!!! তাহলে বিয়ে কিভাবে ভাঙ্গবে এরা।।। সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো.. চারদিকের সব সাজসজ্জ খুলে নেওয়া হয়েছে.. পুরো ঘরটাকে কেন যেন বিধবা মনে হচ্ছে রোদেলার কাছে।।

সে তার বাবা মা কে খুজতে খুঁজতে কিচেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো…
শামীম সাহেব আয়েশ করে চা খাচ্ছে আর মিতা তার সাথে কি বিষয়ে কথা বলে খিলখিলিয়ে হেসে দিচ্ছেন.. রোদেলার বড্ড রাগ হলো তার বাবা মার ওপর.. কোথায় তাদের জোয়ান মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না হাত পা বিছিয়ে কাঁদবে তা,না নিজেদের মজা নিয়ে ব্যাস্ত…
রোদেলা ধুপ করে তাদের সামনে বসলো কিন্তু তাদের মিষ্টি হাসি আর কথা যেন শেষ ই হচ্ছে না..
নিজেদের মাঝে মজে আছেন তারা!!!
রোদেলা ধুপ করে কয়েকটা প্লেট মাটিতে ফেলে দিল.. তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল…

হাসনাত নিজের ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছে.. স্কিনে রোদেলার হাসিখুশি মাখা মুখের একটা ছবি.. ছবিটা পাচ বছর পুরোনো।। কিন্তু ছবিটার রেশ যেন হাসনাতের চোখে এখনো লেগে আছে…
ইশার হলুদের দিন সিড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় রোদেলাকে দেখে সে!! সে প্রানখুলে হাসছিল ইফ্ফাতের সাথে!!! ভালোবেসে ফেলেছিল সেইদিনের সেই হাসিটাকে !! তাইতো ছবি করে রেখেছে সেই স্মৃতিটুকুকে!!

টুপ করে কয়েকফোটা পানি ফোনের স্কিনের ওপর পড়লো.. হাসনাতের আজ বড্ড কষ্ট হচ্ছে! আসলেই জিবনের প্রিয় জিনিসগুলো সবসময় হেফাজত করতে হয়.. নয়তো সেই জিনিস গুলো একসময় জিবন থেকে হারিয়ে যায়… আর খুব করে চেয়েও সেই সকল জিনিস হয়তো আর পাওয়া যায় না!!!

ইফতি ইফ্ফাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে.. অনুশোচনার আগুনে জ্বলছে সে.. কোন না কোন ভাবে সে ইফ্ফাতকে কষ্ট দিয়েছে!! ইফ্ফাততের হাতগুলো নিজের মুটোয় শক্ত করে পুরে বলল– ইফ্ফাত জিবনটা অনেক ছোট আর সেই ছোট জিবনের প্রতিটি মুহুর্ত তোমার সাথে কাটাতে চায় আমি… খুব করে চায় তোমাকে.. নিজের চেয়েও বেশি.. এতোটা বেশি তোমাকে হয়তো বলে বোঝানো সম্ভব নয়.. আমাকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না??
ইফ্ফাত ফুফিয়ে কেঁদে ইফতির বুকের ওপর গিয়ে পড়লো.. ইফতি নিজের হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল.. আজ যেন সে সম্পূর্ণ।। মনে মনে মহান আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে দিল সে…
/
/
চারিদিকে মানুষের কিচিমিচি শব্দ.. এন মোহাম্মদ কনভেনশন হল যেনো রঙের মেলা চলছে…

হুম.. আজ হাসনাত রোদেলার বিয়ে!!! শামীম রোদেলা আর হাসনাতকে কিছু শিক্ষা দেওয়ার জন্য মুলত এমনটা করেছেন.. সে খুব করে জানে এরা একে অপরকে ছাড়া অসহায়.. কিন্তু এই জিনিসটা তাদের ও বোঝাতে তার এই নাটক..
অবশ্য এর জন্য হিমেল তাকে নাটকবাজ অনেক বার বলে ফেলেছে.. আর রোদেলা হাসনাতের বিয়েটাও খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পাদন হয়েছে.. হাসনাতের হাতে রোদেলার হাত দিতেই রোদেলা লাজুক চোখে নিচের দিকে তাকালো।। আর হাসনাত তার সেই লাজুক মুখটির দিকে তাকিয়ে আরো কয়েকবার প্রেমে পড়তে লাগলো!!!!
/

সানিয়া ইশানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে. ছেলেটা কেন যেন কাঁপছে.. সানিয়া শেষে ইশানের খুব কাছে দাড়িয়ে বলল– আমি তোমাকে ভালোবাসি…
ইশানের কান মুহুর্তেই লাল হয়ে গেল.. সে আমতাআমতা করে বলল– আসলে,, আমি নিজে…
সানিয়া পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল– ওকে। সমস্যা নেই.. আমি ভালোবাসি বলেতো আপনার ও বাসতে হবে এমন তো কথা নেই.. ভাল থাকবেন.. আমি অন্যকাউকে বিয়ে করে নিব…
ইশানের বুকের মাঝে ধক করে ওঠলো.. সে সানিয়ার হাত ধরে টেনে নিজের খুব কাছে এনে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল– তুমি শুধু আমার.. আর বিয়ে কখনো করলে আমাকেই করবা.. বুঝতে পেরেছো? নাকি আরো বোঝাবো??
সানিয়া বোকার মতো মাথা দোলাতে লাগলো.. ইশান দুষ্টু হাসি টেনে পকেটে হাত গুঁজে ওখান থেকে বেরিয়ে গেল… সানিয়া ওখানে দাঁড়িয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো..

মেহেদী সবটা দেখে জোরে নিশ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল..সবার জিবনে ভালোবাসা আছে শুধু তার জিবন ছাড়া.. এইসব ভাবতে ভাবতে সে সামনে পা বাড়ালো.. হঠাৎ মাহিয়া কোথা থেকে এসে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে লাজুক চোখে বলল– শুধু কি অন্যের প্রেম দেখবেন.. নাকি নিজেও করবেন.. মেহেদী প্রথমে না বুঝে ব্রু কুঁচকে তাকালো.. পরক্ষনে বোঝে চোখ বড় বড় করে মাহিয়ার দিকে তাকালো.. মাহিয়া ফিক করে হেসে দৌড়ে পালালো.. আর মেহেদী নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে হেসে দিল।।

রোদেলা হাসনাতের বাসায় এসে পৌছালো.. এখন এইটাই তার শশুরবাড়ি.. নিজেকে অনেকটা পরিবর্তন করবে এমন শপথ নিয়ে চারিদিকে চোখ বোলাল সে…
পুরো ঘরটা মেহমানে ভর্তি.. হাসনাত আচমকা রোদেলাকে কোলে তু্লে নিল.. রোদেলা ভয়ে হাসনাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো!! হাসনাত মুচকি হেসে হাটা শুরু করলো.. সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে… হঠাৎ ইফতি আমাতা আমাতা করে বলল– ভাই,, ছবি তুলবো আপনাদের সাথে…
হাসনাত পিছনের দিকে না তাকিয়ে বলল– আমার বৌ টায়ার্ড.. রেস্ট নিক.. কালকে তুলিও…
রোদেলার লজ্জায় অবস্হা খারাপ.. ছেলেটা তার ইমেজের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে. সবাই কি ভাবছে তাকে। সে বিরবিরিয়ে বলল– আমাকে প্লিজ নামান…আমি ঠিক আছি..
হাসনাত ডোন্টকেয়ার ভাব নিয়ে বলল– সেইটা আমি বুঝবো।। আগে রুমে চল..
মায়া জানে তার ছেলে একবার যা বলে তা ই করে… সে পরিবেশটা ঠান্ডা করতে বলল– আসলে,, রোদেলা অসুস্থ তাই..
.এইবলে হতাশাজনক দৃষ্টিতে ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো!!

রোদেলা নেমে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে রুমে প্রবেশ করলো.. হাসনাত রুমে ডুকে দরজাটা লাগিয়ে রোদেলাকে নামিয়ে দিলো। তরপর ব্রু কুঁচকে বলল– বাইন মাছের মতো করস কেন??
রোদেলা মুখ ভেঙ্চিয়ে বলল– কারন আমি বাইন মাছ তাই..

হঠাৎ হাসনাত লাইট জ্বালাতেই রোদেলা অবাক চোখে সামনে তাকালো. রোদেলার সেই কাটা শাড়িটা যেইটা হাসনাত কেটেছিল সেই শাড়িটা আর ফুল দিয়ে তাদের খাট সাজিয়েছে হাসনাত.. রোদেলা অবাক হয়ে হাসনাতের দিকে তাকালো.. হাসনাত মুচকি হেসে বলল– আসলে ঐ শাড়িতে এতোটা বেশি সুন্দর লাগতো তোকে যা আমি সহ্য করতে পারতাম না.. তাই কেটে ফেলেছিলাম…
রোদেলা ধিমি পায়ে সামনে এগিয়ে গেল… ফেইরি লাইট দিয়ে দেয়াল সাজিয়েছে এর মাঝখানে অসংখ্য রোদেলার ছবি… রোদেলার চুড়ি, পায়েল.. এমন কি রোদেলা তাকে খাইয়ে দেওয়া সেই প্লেট!!! রোদেলার হাতে ধোয়া সেই কাপড়গুলো.। আরো অসংখ্য স্মৃতি!!!

রোদেলা চরম অবাক হয়ে হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলল– এইসব কখন করলেন??
হাসনাত মুচকি হেসে রোদেলাকে বিছানার ওপর বসিয়ে দিল… তারপর তার হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে পুরে বলল — ক্লাস এইটের জে এস সি.. পরিক্ষা দিয়ে তুই নানুবাড়ি গিয়েছিলি যখন তখন প্রথম তোর প্রতি অন্যরকম ফিল শুরু হয় আমার মনে.. দিন দিন সেই অনুভূতি বাড়তে থাকে.. এতোটা যে নিজেকে কন্ট্রোল করতেই পারতাম না.. তাইতো তোর থেকে নিজেকে আলাদা রাখতাম.. খুব ভালোবাসি তোকে আমি..
দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে থামলো হাসনাত.. রোদেলা জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে. তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না হাসনাত এইসব বলছে… হাসনাতের মুখ থেকে এই শব্দ শুনতে তার মন কতোটা ব্যাকুল ছিল সেটা শুধু সেই জানে…
হাসনাত আচমকা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে বলল– তোকে ভালোবাসি সেইটা তোকে কখনো হয়নি বলা.. কারন যতোটা ভালোবাসলে একটা মানুষকে বলা যায়,, তুলনা করা যায় এতো কম তো ভালোবাসিনি তোকে.. নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি তোকে… এতোটা যে আমার শ্বাসটা তোর মাঝে আটকে আছে…
রোদেলা আর কিছু বলতে দিল না হাসনাতকে.. হাসনাতের ঠোটে নিজের ঠোটটা ডুবিয়ে দিল… ভালোবাসায় সিক্ত হতে লাগলো তারা…
না বলা ভালোবাসাটা ব্যক্ত হয়ে গেল তাদের.. সেই ভালোবাসা যা তাদের মনকে সিক্ত করেছে আরো দশ বছর আগে!!”!”

সমাপ্ত

কেমন লাগলো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here