ভীন দেশের গল্প পর্ব ২

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_২
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

খুব আড়ম্বর করেই মহুয়া আর মাজহাবের বিয়েটা হয়ে গেল। লাবণী চেয়ে চেয়ে দেখলোই শুধু। মুখ ফুঁটে বুক ভাঙার কথা কাউকে বলতে পারল না। সন্ধ্যের পর একে একে সব আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব,মাজহাবের অফিসের কলিগ- সকলেই বিদায় নিলে লাবণী রান্নাঘরে বিছানা করতে লাগল। রুবা মিষ্টির প্যাকেট নেওয়ার জন্য রান্নাঘরে এসে লাবণীর প্রস্তুতি দেখে বলল,

-কয়টা বাজে? এখনই বিছানা গোছাচ্ছিস কেন?

লাবণী নিচু গলায় বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দেয়,

-আমার শরীরটা ভালো নাই ভাবী। মাথাটা কেমন যেন করছে।

মুখ ফসকে কিছু কড়া কথা বেরোতে গিয়েও বেরোলো না। সেগুলো গিলে নিয়ে লাবণীকে আগাগোড়া পরখ করল রুবা। হুট করেই গলার স্বর পাল্টে বলল,

-ঠিক আছে। কিন্তু এখানে বিছানা করেছিস কেন? পেছনের বারান্দায় চৌকি পেতেছে তনয় তোর জন্য। ওখানে গিয়ে শো। রান্নাঘরে বারবার আসবো যাবো,তোর ঘুমের ডিস্টার্ব হবে না?

লাবণী চুপচাপ বিছানা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। তনয় কিছু কিছু কথা শুনতে পেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। দরজায় দাঁড়িয়েই লাবণীর চলে যাওয়া দেখে বলল,

-বাবাহ! ম্যাডামের হঠাৎ দরদ জেগেছে দেখি..

রুবা কানে তুলল না। মিষ্টির প্যাকেট ফ্রিজ থেকে বের করে কিছু পিস একটা প্লেটে নিয়ে বাকি গুলো পুনরায় ফ্রিজে রেখে দিলো। প্লেটটা নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তনয় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে দাঁত গুলো কেলিয়ে বলল,

-ম্যাডামের তেজ বেড়ে গেল হঠাৎ করে। ব্যাপার কী ম্যাডাম? আপনার দল ভারী হয়েছে,এই কারণে বুঝি?

রুবা কাঠ গলায় বলল,

-তনয়, তুমি কিন্তু লিমিট ক্রস করছো বার বার। আমাকে রাগীও না। আমি তোমাকে বলেছি না,আমাদের সম্পর্ক টা রাতের আঁধারের মতোই অন্ধকার।

-তুমি চাইলে আমাদের সম্পর্ক টা দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হতে পারে রুবা। বড় ভাইয়া মা’রা গেছে সাড়ে পাঁচ বছর হয়ে গেল। তোমার বাবা-মা তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে তুমি যাওনি। মায়ের দেখভাল করার বাহানা দিয়ে থেকে গেছো। কিন্তু আমি জানি, এর পেছনে তোমার কী উদ্দেশ্য ছিল। আজ তোমার বাবা-মা নেই, আমার মা-ও নেই। বড় বিধবা ভাবী যদি দেবরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নতুন করে এতে দোষের কী আছে? এরকম তো অহরহ হচ্ছে রুবা। তুমি কেন মানতে চাইছো না?

-কারণ আমার একমাত্র লক্ষ্য ব্লাড স্টোন। যে করেই হোক, যে ভাবেই হোক, আমি এটা চাই! আর এর জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন আমি তাই করব তনয়। তোমার প্রতি এক্সট্রা কোনোকিছু ভেবে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই।

রুবার গলায় তেজ। চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি। আঁখিদুটি চকচক করে উঠে আবেগ ঘন হয়ে। তনয় কথার পিঠে কথা বলার মতো যুতসই কিছু খুঁজে পায় না। মাজহাবের আগেও আরও একটি ভাই ছিল তার। যার নাম ছিল ফুয়াদ। ফুয়াদের সঙ্গে রুবার বিয়ে হয়েছিল প্রায় সাত বছর আগে। তারপর একদিন ফুয়াদ অদ্ভুত জ্বরে কাতর হয়ে মা’রা গেল। রুবা তখনও যুবতী। তার বাবা-মা তাকে অন্যত্র বিবাহ দিতে চাইলে সে রাজী হয়নি। নানান বাহানায় থেকে গেল এখানেই। আস্তে আস্তে তনয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তার। তনয় একদিন জানতে পারল, সে যা নিয়ে রিসার্চ করেছে, যা যা সে জানে, তার চাইতেও বেশি জ্ঞান রুবার রয়েছে সেই বিষয়ে। এবং শুধু তাই নয়, ‘ব্লাড স্টোন’ নিজের হাতের মুঠোয় করার জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে উঠেছে রুবা। যদি এর জন্য কাউকে খু’ন করা প্রয়োজন হয়, তবে তাও করবে সে৷ তনয়ের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়,ফুয়াদ ভাইকেও কী রুবা-ই মে’রে ফেলল?

তনয়কে ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে দেখে নিজেকে ধাতস্থ করে রুবা। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভূত দেখার ন্যায় চমকে উঠে সে। লাবণী দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্নবোধক চোখে। রুবা ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট করে চাইলো। পারছে না চোখের আগুন দিয়ে তনয়কে ভস্ম করে দিতে। এই ছেলের জন্য বারবার ‘ব্লাড স্টোন’ এর ব্যাপারে কথা বলতে হয় তার। আর যখন এই প্রসঙ্গ আসে তখন দিকবিদিক ভুলে যায় সে। ‘ব্লাড স্টোন’ কব্জা করার নেশায় পাগল রুবা। ভয় হচ্ছে,লাবণী কী শুনে ফেলল কিছু?

-ত…তুই এখানে কেন? মানে ঘুমাসনি এখনো?

রুবার গলা কাঁপছে, হাতের তালু ঘামছে। তনয় ততক্ষণে রুবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে নিজেও আশংকিত। রুবাকে নিয়ে নয়, লাবণীকে নিয়ে। যদি লাবণী সত্যি সত্যি কিছু শুনে ফেলে তবে যে ওর দিনও ফুরিয়ে যাবে!

লাবণী হতভম্ব গলায় বলল,

-পানি খেতে আসছি ভাবী। আপনি এভাবে কাঁপছেন কেন? ভাবী, আপনি ঠিক আছেন তো?

নাসিকাপথ ভেস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। তনয়, রুবা- দু’জনে দু’জনের দিকে অল্প একটু চাইলো। স্বাভাবিক গলায় রুবা বলল,

-ও, আচ্ছা। না,কিছু না। আমারও শরীরটা খারাপ লাগছে রে। যাই..

চোখ ইশারায় তনয়কে নিজের ঘরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রুবা জায়গা ছাড়ে। ঠোঁট গোল করে বাশির আওয়াজ তুলে তনয়ও চলল পিছু পিছু। লাবণী ওদের দু’জনের যাওয়ার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। তার কানে বাজছে দুটি শব্দ, ‘ব্লাড স্টোন’

কী এই ‘ব্লাড স্টোন’? কেন এটি নিজের করার জন্য রুবা পাগল হয়ে উঠেছে? এটি কোথায় আছে,এর কাজই বা কী? প্রশ্নে প্রশ্নে মস্তিষ্ক ভারী হয়ে উঠলেও উত্তর মেলে না একটিও। দ্বিধাদ্বন্দ্ব মন নিয়েই এক গ্লাস পানি খেয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় লাবণী।

-বলেছিলাম, বলেছিলাম তোমাকে যখন তখন এই প্রসঙ্গ তুলবে না। আমার এতদিনের সাধনা যদি তোমার কারণে নষ্ট হয় তাহলে আমি তোমাকে খু’ন করে ফেলবো তনয়। এমনকি মহুয়াও তোমাকে ছাড়বে না।

দাঁতে দাঁত পিষে তনয়ের উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছোঁড়ে রুবা। তার হাত দুটি তনয়ের কলার চেপে ধরেছে। নিজেকে রুবার থেকে ছাড়ানোর বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা নেই তনয়ের মধ্যে। বরং তাকে দেখে খুশি খুশি লাগছে। আরেকটু কাছে ঘেঁষে রুবার কোমর জড়িয়ে ধরল তনয়। রুবা চোখ পাঁকায়। ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠল,

-তোমার সাহস দেখে দিন দিন অবাক হচ্ছি তনয়। তুমি কী জানো না, আমি চাইলে এই মুহূর্তে তোমার ঘাড়টা মটকে দিতে পারি?

তনয় বাঁকা হেসে জবাব দেয়,

-আর তুমিও কী জানো না, আমি চাইলে তোমার সত্যতা সবার সামনে তুলে ধরতে পারি? যদিও এই যুগে এসে কেউ তোমার সত্যতা বিশ্বাস করতে চাইবে না। এর জন্যেও আমার কাছে প্রুফ আছে। তোমার সেই ভিডিও…মনে পড়ে রুবা?

একটা চিড়বিড়ানি রাগ রুবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ক্রমেই চোখের মণির পরিবর্তন তনয়ের হাসির মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। আচানক রুবাকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরে তার কাঁধে নিজের থুতনি রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,

-এই ভুলটা একদম করতে যেও না। ভুলে যেও না, ব্লাড স্টোন জাহির করার জন্য তোমার যেমন প্রয়োজন আছে,আমারও আছে। আরও খোলাশা করে বললে…

-কোনো প্রয়োজন নেই খোলাশা করার। আমি সবই জানি।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে রুবা। এই এক জায়গাতেই সে আঁটকে আছে। ‘ব্লাড স্টোন’ পাওয়ার জন্য এমন একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হবে যেখানে তনয়ের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। একবার শুধু সেই প্রয়োজনীয়তাটুকু পরিপূর্ণ হোক, তারপর একে একদম দেখে নেবে- মনে মনে ভাবে রুবা। চোখের রঙ স্বাভাবিক হয় তার। তনয়ের বাহুবন্ধনে ধীরে ধীরে সিক্ত হতে শুরু করে সে।

-আচ্ছা,একটা কথা বলো তো। লাবণীর উপর তোমার হঠাৎ দরদ বেড়ে গেল কেন?

-এই কারণেই তোমাকে গরু বলি আমি। সামান্য বিষয়টাও মাথায় ঢোকে না তোমার। লাবণীই যে আমাদের তুরুপের তাস তনয়, ভুলে গেলে এ কথা? ব্লাড স্টোনের কাছাকাছি পৌঁছোতে হলে আমাদের ম্যাক্সকে হাতের মুঠোয় আনতে হবে। আর ম্যাক্সকে হাত করার জন্য প্রথম চালটিই চালবো লাবণীকে দিয়ে।

রুবার চোখ জোড়া ফের চিকচিক করে উঠে। তনয় মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয়। রুবার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে সে আর দুটো দেখেনি! মানুষের মাথা চলে যে স্পিডে, তার চাইতেও তিনগুণ বেশি স্পিডে চলে রুবার মাথা। কেননা রুবা একজন…
নাহ, এই রহস্য খোলাশা করার আসল সময় এখনো আসেনি যে!

দরদর করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে লাবণীর। এক ফোঁটা ঘুম নেই, তবুও ঘুমের ভান করে শুয়ে রয়েছে সে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মাজহাবের সাথে কাটানো বিশেষ বিশেষ কিছু মুহূর্ত। মাজহাব যখন তার কাছে আসতো, তাকে টেনে নিয়ে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতো, যখন যখন লাবণীর অধরে নিজের ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করাতো- সেইসব মুহূর্ত গুলিই লাবণীর জন্য বিশেষ। বোকা মেয়ে! ভালোবাসার আসল সংজ্ঞা কী এগুলোই? লাবণী জানে না।

মশার উপদ্রব ভীষণ। শুয়ে থাকা দায়। কামড়ে কামড়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে। অগত্যা লাবণীকে উঠে বসতে হয়। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল। বারান্দার দরজা আঁটকানো নয়,ভিড়িয়ে রাখা। লাবণী চট করে গায়ে ওড়না টেনে নিলো। আলগা পায়ে উঠে দরজা মেলতেই মাজহাবের অস্বস্তি ভরা মুখখানা ভেসে উঠে।

-ইয়ে..লাবণী.. মহুয়াকে একটু শাড়ি পরিয়ে দিবি? একটা নতুন শাড়ি এনেছিলাম ওর জন্য। কিন্তু ও পরতে পারে না। ভাবীর কাছে গেছিলাম। সে বোধহয় ঘুমুচ্ছে। তুই যদি…

কথার পিঠেই কথা বলে লাবণী,

-আমি আসছি।

(চলবে)
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here