ভীন দেশের গল্প পর্ব ১

আজ লাবণীর স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে। সেই উপলক্ষে অনেক বড় আয়োজন করা হয়েছে। এতবড় আয়োজন লাবণীর বিয়ের সময়েও করা হয়নি। যে স্বামী বছরেও একটা কাপড় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না নিজ স্ত্রী কে, সেই স্বামী খুশিতে গদগদ হয়ে লাবণীকে দুটি কাপড় কিনে দিয়েছে। একটা গতকাল গায়ে হলুদে পরেছে সে। অপরটি পরে আজ দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মুখে। লাবণীকে এই বাড়িতে নিয়ে আসা হয় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে। তার শ্বাশুড়ি আলেয়া খাতুন গণ্ডগ্রাম থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন ওকে। কিন্তু মাজহাবের কু দৃষ্টি পড়ায় এবং লাবণী মেয়ে হিসেবে, একজন বউ হিসেবে আদর্শ হওয়ায় আলেয়া খাতুন অতটুকু মেয়েকেই তুলে দিয়েছিলেন নিজের ছেলের হাতে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাজহাব মানা না করলেও তার মৃ’ত্যুর পর সবকিছু পাল্টাতেও সময় লাগেনি। বলা ভালো, শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই নয়, তার নামে রেখে যাওয়া একটা বড় সম্পত্তির জন্যেই মাজহাব কোনোপ্রকার দ্বিমত করেনি। আলেয়া খাতুনের বাধ্য থেকে সে নিজে একজন আদর্শবান ছেলে এটাই বুঝিয়েছে প্রথম থেকে। তাই তো মৃ’ত্যুর আগে বড় ছেলের নামেই অর্ধেকের চাইতেও বেশি জমিজমা এবং সম্পত্তি লিখে রেখে যান আলেয়া খাতুন।

লাবণীর বর্তমান বয়স ২১। মাজহাবের সাথে তার বিবাহের বয়স পাঁচ বছর! ছোট লাবণী যেদিন মাজহাবকে তিন কবুলের মাধ্যমে আপন করে নিয়েছিল, সেদিন থেকেই তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বুঝে গিয়েছিল, তার দায়িত্ব অনেক বড়! স্বামীর সোহাগ এবং ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগা লাবণী কোনটা শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার টানে কাছে আসা এবং কোনটা সত্যিকারের ভালোবাসা তা এতদিনে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছে। মাজহাব কখনোই তাকে ভালোবাসেনি। এক বিছানায় দু’জন ছেলে-মেয়ে থাকলে কাছে আসতে হয় বলেই কাছে এসেছিল। ভালোবাসার সঙ্গে কাছে আসার সম্পর্ক টা খুবই নগন্য! যা বোকা লাবণীর বুঝতে এতকাল পার হয়ে গেছে!

মাজহাব আজ ভীষণ খুশি। এই আধুনিক যুগে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে একজন আধুনিক মেয়েরই প্রয়োজন হয়। শুদ্ধ ভাষাটা রপ্ত করতে পারলেও গায়ের ওড়না ফেলে বোল্ড আকর্ষণে আকর্ষিত করতে হয় কী করে তা লাবণী কখনোই রপ্ত করতে পারেনি এবং পারবেও না। সুতরাং এখন হাত বদল করা উচিত! মাঝে মাঝে খাবারেও তো পরিবর্তন আনতে হয় নাকি?

-লাবণী…এই লাবণী..

লাবণীর ধ্যান ভাঙে। সে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল মঞ্চে বউ সাজে বসে থাকা মহুয়ার দিকে। বড় ভাবী রুবার চিৎকারে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। সে পড়িমরি করে ছুটলো রুবার দিকে।

রুবা কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে তীব্র বিতৃষ্ণা। কপালে ভাঁজের সৃষ্টি। ঠোঁট টা শুকিয়ে আছে। লাবণী কাছে আসতেই সে হুংকার ছেড়ে বলল,

-একটা থা’প্পড় দিয়ে দাঁত গুলো নাড়িয়ে দিবো। তোকে কী সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম আমি? আর একটু পর কাজী আসবে। নতুন বউয়ের পেটে কিছুই পড়েনি। সেইদিকেও কী আমাকে ছুটতে হবে? আমি এখনো রেডি হতে পারলাম না… উফ লাবণী, যা না..আমি একা আর কত..

লাবণী নিচু গলায় বলল,
-যাচ্ছি।

তারপর সরে এলো।

একটা প্লেটে অল্প একটু পোলাও আর কয়েক পিস গরুর গোশত নিয়ে যে ঘরে এতদিন নিজে থাকতো সেই ঘরের ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে আসলো। মহুয়া জাকজমকপূর্ণ ভাবে বসে রয়েছে। তার পাশের চেয়ারে মাজহাব। একের পর এক ক্লিক পড়ছে। ছবি তোলার ধুম উঠেছে যেন। লাবণী গুটিগুটি পায়ে মহুয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। উপস্থিত সবাই তার দিকে তাকাল এমনভাবে যেন এই পরিবেশে সে বড্ড বেমানান। মাজহাব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে লাবণীর দিকে তাকালে লাবণী মিনমিন করে বলল,

-উনি কিছুই খাননি। তাই..

-নিয়ে যাও।

দ্রুত জবাব দেয় মাজহাব। তারপর ফিসফিসিয়ে মহুয়ার কানের কাছে কিছু একটা বলল,লাবণী শুনতে পেল না। কথা শেষে মহুয়া উপস্থিত সকলের দিকে অল্প একটু হাসি ছুঁড়ে দিয়ে লাবণীর সঙ্গে উঠে এলো।

-তো তুমিই আমার সতীন?

মহুয়া প্রশ্ন করে। এর জবাবে কী বলা প্রয়োজন লাবণী বুঝতে পারে না। বলা ভালো, সে অনেকটাই লজ্জিত এবং বিব্রতবোধ করল। অথচ এখানে লজ্জা পাওয়ার কথা মহুয়ার, যে বিবাহিত জানা সত্ত্বেও মাজহাবের গলায় ঝুলে পড়তে চলেছে!
লাবণী অল্প একটু মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ প্রকাশ করে। মহুয়া বিছানার উপর বসে চারিদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।

-এটা তোমাদের বেডরুম ছিল,তাই না? আর এখন থেকে আমাদের বেডরুম হবে। তাই না বলো?

লাবণী নিভে যাওয়া গলায় জবাব দেয়,

-হুঁ।

-তোমার কী মন খারাপ লাবণী? আই থিংক মাজহাব আমাকে বিয়ে করছে এটার কারণে তুমি খুব আপসেট হয়ে আছো। ডোন্ট বি আপসেট। আমি সতীন হিসেবে এতোটাও খারাপ হবো না লাবণী! এন্ড তোমার যদি কোনো প্রেমিক থেকে তবে তুমিও তাকে বিয়ে করতে পারো। এমনিতেও তোমাকে ক’দিন পরেই মাজহাব তালাক দিয়ে দিবে।

চমকে উঠে লাবণী। মাজহাব যে অনেকদিন যাবতই আরেকটি বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল, তা জানা থাকলেও তাকে তালাক দিয়ে দিবে এমনটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সে। সবার আগে মাথায় একটি প্রশ্নই বারি খায়, যদি মাজহাব তাকে ছেড়ে দেয় তবে কোথায় যাবে সে? তার যে এই পৃথিবীতে যাওয়ার মতো কোনো জায়গায়ই নেই!

লাবণীর মুখে হঠাৎ করেই বিষন্নতার চাদর নামলো। মহুয়ার নজর এড়ালো না। সে নিঃশব্দে হেসে বলল,

-ভয় নেই। তালাক দিলেও এই বাসায়ই থাকতে পারবে তুমি। আমি ওকে বলব। এমনিতেও আমার কাজটাজ করার জন্য একজন লোকের প্রয়োজন। আর যেহেতু এই সংসারে তুমি অনেক বছর যাবত আছো,সো তুমিই সবচেয়ে ভালো বুঝবে এবং আগলে রাখতে পারবে।

লাবণীর দু’চোখ ভরে আসে। যে সংসার তার নিজের ছিল এতদিন তা আজ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে সেখানেই গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত হতে হবে! ভাগ্য বুঝি এতোটাই বিরূপ? লাবণীর তরফ থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়ে মহুয়া ভ্রু কুঁচকে পুনরায় বলল,

-কী হলো? কোনো কথা বলছো না কেন? ওহ, ভাব দেখাচ্ছো? হা হা হা..! তোমার মতো মানুষের ভাব মানায়, বলো তো!

বুকে লাগে প্রতিটি কথা। তবুও লাবণীর ঠোঁট খোলে না। সে যেন পণ করেছে জীবনেও আর একটি শব্দ উচ্চারণ করবে না। মহুয়ার সামনে খাবারের প্লেটটা রেখে লাবণী দায়সারাভাবে বলল,

-খেয়ে নিন।

মহুয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করে।

-তোমার কী চোখ নেই? দেখছো না আমি সেজেগুজে আছি। এই অবস্থায় নিজে হাত দিয়ে কীভাবে খাবো?

বাঁকা ঠোঁটে হাসে মহুয়া। লাবণীর একদম ভালো লাগছে না। বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। এতক্ষণ কোনোরকম অনুভূতি না হলেও এখন খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে। মাজহাবের কলার চেপে ধরে বলতে, ‘আপনি শুধু আমার…শুধুই আমার। আপনি আর কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না। কাউকে না..’
কিন্তু আফসোস, এগুলো কখনোই সম্ভব নয়।
লাবণী বলল,

-উনাকে ডেকে দিচ্ছি। উনি খাইয়ে দিবেন।

বলেই এক সেকেন্ডে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। মহুয়া শব্দ করে হেসে উঠে। লাবণীকে আচ্ছারকম জ্বালানো গেছে ভেবে মনটা শান্তিতে ভরে উঠল তার। অপরদিকে বেরিয়েই দেয়ালে পিঠ ঠেকায় লাবণী। দূর থেকে পুরোনো বেডরুমটা চোখ ভরে দেখে নেয়। এরপর আর কখনো এই রুমের ওই বিছানায় মাজহাবের পাশে ঘুমানো হবে না হয়তো। হয়তো আর কখনোই একজন স্ত্রীর অধিকার নিয়ে এই ঘরে ঢোকাও হবে না। সবকিছু আজকের পর থেকে চলে যাবে অন্য আরেকজনের দখলে। রাতের পর রাত স্বামীর সোহাগে সিক্ত হবে সে। আর লাবণী? সে আগেও এই বাড়ির কাজের লোক ছিল এবং এরপরও কাজের লোক হয়েই থাকবে। আচ্ছা,ভাগ্য কী তবে একেই বলে?

রুবার চোখেমুখে আচ্ছারকম বিরক্তি। শাড়ি সামলানোই কষ্টকর তার জন্য, সেখানে শাড়ি নিজে নিজে পরা কোনো যুদ্ধের চেয়ে কম না। রুবার রাগ লাগছে লাবণীর উপরে। মেয়েটা কোথায় গিয়ে ম’রেছে কে জানে। কতক্ষণ খুঁজেও পাওয়া যায়নি তাকে। তাই একা হাতেই শাড়ি পরতে হচ্ছে এখন। লাবণী আবার শাড়ি পরতে জানে খুব সুন্দর ভাবে। রুবা বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে আয়নার দিকে তাকাতেই খানিকটা চমকে উঠে। তনয় দাঁড়িয়ে!

রুবা দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

-তুমি এখানে কেন?

তনয় এগিয়ে আসে। ঠোঁটে হাসে। আসার পথে দরজাটা পা দিয়ে ঠেকে ভিড়িয়ে দিলো। রুবা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। এক আঙুল তুলে বাঁধা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল,

-একদম না। খবরদার!! যেকোনো মুহূর্তে তোমার ভাই চলে আসবে। পরে তুমিও ম’রবে,আমিও ম’রব।

তনয় কোনো কথা শুনলো না। চোখ মিটমিট করে চোরা ভাবে হাসল। রুবার কোমর খপ করে ধরে তাকে টেনে নিলো নিজের বাহুডোরে। উন্মুক্ত পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-আমি থাকতে তুমি কষ্ট করতে যাবে কেন সোনা? আই এম হেয়ার, না! আসো, শাড়ি পরিয়ে দেই।

রুবা বিদ্যুৎ বেগে সরে দাঁড়ায়। স্পষ্ট কণ্ঠে প্রতিবাদ করে উঠে,

-তনয়, লিমিট ক্রস করো না। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক টা রাতের আঁধারের মতোই অন্ধকার। যা অন্ধকারে রাখলেই ভালো। দিনের আলোয় এনে নিজের বিপদ ডেকো না।

-ওকে ম্যাডাম, সরে যাচ্ছি! হ্যাপি?

বলে তনয় সরে দাঁড়াল। তার ঠোঁটের হাসিতে বিদ্রুপ খেলা করছে। রুবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। তারপর এলোমেলো শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক করতে লাগল মনোযোগের সহিত। তনয় আয়নার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। রুবা বলল,

-সামনে থেকে সরো। আয়না দেখব।

তনয় সরে দাঁড়িয়ে বলল,

-তুমি কিন্তু আমাকে কিছুই খোলাসা করোনি এখনো রুবা। কেন এই দ্বিতীয় বিয়ে, কেনই বা মহুয়াই আসছে ভাইয়ের ওয়াইফ হিসেবে? আর তুমি কী শিউর, মহুয়া পারবে?

রুবা তাকায়। তার সমস্ত মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। দরজার বাইরে কেউ আছে কীনা তা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করে দেখল। তনয়ের কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল,

-তোমাকে কতবার বলেছি যেখানে সেখানে এসব ব্যাপারে কথা না বলতে? তুমি কী চাও, আমাদের সত্যতা সবাই জেনে যাক?

-না,তা চাইবো কেন! কিন্তু তুমিও তো আমার থেকে কথা লুকিয়ে যাচ্ছো। মহুয়া আর তোমার ভেতরে কী কথা হয়েছে,তা কী আমাকে বলেছো? বলো!

-বলিনি কারণ সময় আসেনি। সময় আসলে তোমার প্রশ্নের সব জবাব পেয়ে যাবে। শুধু এইটুকু বলি, নিশ্চিন্ত থাকো। ম্যাক্সের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় মহুয়াই জানে। মানতে হবে, আমাদের মাথা যতটুকু, তার চাইতেও বেশি বুদ্ধি ওর মাথায়। হবে না-ই বা কেন, ও তো কোনো সাধারণ মানুষ নয়।

রুবার ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি। তনয়ও নিশ্চিন্ত হলো।

-একবার ম্যাক্স কে নিজেদের হাতের মুঠোয় আনতে পারলেই আমরা যেটা চাচ্ছি, সেটা পেয়ে যাবো। তখন আমাদের চাইতে ধনী এবং শক্তিশালী আর কেউ থাকবে বলে মনে হয় না!

তনয় বলল। রুবা কথার মাঝে বলে উঠল,

-এতোটাও সহজ ভেবো না। ম্যাক্স ওদের জগতের একমাত্র রাজকুমার। তাকে হাত করা কী এতোই সহজ? মোটেও না! তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্যর, আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির। কত সময় লাগবে জানি না। তবে ম্যাক্সকে আমাদের হাতের মুঠোয় আনতেই হবে। যেকোনো ভাবেই হোক।

-জানি। তো তোমাদের প্ল্যানের প্রথম ধাপ কী?

রুবা মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে বলে,

-সময় হোক, জানতে পারবে।

(চলবে)
#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_১
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

(এই গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এখানে বাস্তবের সাথে কোনোপ্রকার মিল খুঁজতে আসবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here