ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -০৪+৫+৬

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)

০৪,,,

আহান রিয়াকে টেনে সামনে দাঁড় করালো। কাজটায় আহানের উত্তেজনার পাশাপাশি রিয়ার প্রতি যত্নের অভাব পড়েনি৷ এমন না যে আহান রেগে গিয়ে করেছে। রিয়া তখনও কাঁদছে। আহান কম্পিত এবং ব্যস্ত কন্ঠে বললো,

-আঙ্কেল তোমার বিয়ে ঠিক করেছেন মানে? একরাতে ঠিক করা সম্ভব?

রিয়া নাক টেনে বললো,

-আব্বু কিছুদিন ধরে বলছে। আমি পাত্তা দেইনি। বলেছিলাম, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ে করবো। গতকাল আব্বু তোমার বাইকের পেছনে আমাকে দেখার পরই…

রিয়া কথা শেষ করার আগে আবারও কেঁদে দিলো, যার দরুন ও কথা বলতে পারছিলো না। রিপা উঠে গিয়ে ওকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো। রিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।
রিপা, সে টিনএজ বিধবা। গ্রামে তার, কিশোরী বয়সেই একজন বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের সাড়ে আট মাসের মাথায় বুড়ো লোকটা মারা যান। ওনি গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন, যার প্রথম স্ত্রী খুব কম বয়সে মারা গিয়েছেন আর এলাকায় চেয়ারম্যানের দাপটও ছিলো বেশ। তিনি বেশ সম্পদশালীও ছিলেন। রিপার নিম্নবিত্ত পরিবার, চেয়ারম্যানের থেকে বিয়ের প্রস্তাবটা পাওয়ার পর একদমই দেরি করেনি। রিপার মতামতের তোয়াক্কা না করেই ওকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পারিবারিক চাপ আর একটা সাজানো ভবিষ্যতের লোভে পড়ে রিপাও প্রথমে না করলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব একটা ভালো কাজ করেছিলেন। বউকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় কচি স্ত্রী রিপা, তাকে চেয়ারম্যান তার প্রাপ্য সম্পদটুকু লিখে দিয়েছিলেন বাসররাতেই। বউয়ের মুখ দেখার উপহার হিসাবে। চেয়ারম্যান সাহেব নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন তিনি বেশিদিন হয়তো বাঁচবেন না। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর স্ত্রীকে যাতে প্রথম পক্ষের ছেলে-বৌমা ঘরছাড়া না করে বা তাকে বঞ্চিত না করে বা কোনোপ্রকার অবহেলা না করে, তাই এই পদক্ষেপ।

চেয়ারম্যান সাহেবের মৃত্যুর পর রিপা নিজেও কিছুদিন শোকার্ত ছিলো। এরপর সে সিদ্ধান্ত নেয়, জীবনটাকে নতুন করে সাজাবে। দ্বিতীয় সুযোগ তৈরি করে নেবে বা সে সুযোগ আসলে লুফে নেবে। সে আবারও পড়াশোনা শুরু করে দেয়। বর্তমানে হোস্টেলে থাকে। নিজের নামে যথেষ্ট সম্পদ থাকায় এখনো তার তিনছেলে, অর্থাৎ চেয়ারম্যান সাহেবের প্রথম পক্ষের তিন ছেলে এবং তাদের বউ, ছেলেদের মধ্যে সবার ছোটটিই রিপার থেকে আট বছরের বড় এবং নববিবাহিত, তারা খুব তোয়াক্কা করে তাকে। ছেলে বউয়েরা সুস্বাদু রান্না করে তাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই পাঠায়। ছেলেগুলোও ছুটিতে রিপা বাড়ি ফিরলে মা, মা করে বাড়ি মাথায় করে। সবই চেয়ারম্যান সাহেবের দেওয়া বাসররাতের উপহারের যাদু। এখনো প্রত্যন্ত গ্রামটায় গেলে বোঝা যায়, রিপা তার রাণীত্ব একেবারে হারিয়ে ফেলেনি। গ্রামে সে একজন শ্রদ্ধাভাজন নারী। সেখানে শিক্ষার প্রসারে রিপার ভূমিকা তারা অস্বীকার করতে পারে না।
রিপা ওদের ভেতর বয়সে আসলে বড়। এরপরও একই ইয়ারে ওরা। মাঝখানে পড়াশোনায় গ্যাপ পড়ায় এমনটা ঘটেছে।

রিয়া আবারও নিজের কান্না থামিয়ে বললো,

-আব্বু আজকে থেকেই আমার ভার্সিটিতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন অফিসে গিয়েছে বলে বের হতে পেরেছি। আহান কিছু করো। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।

রিপা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাকিরাও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের ঘিরে ধরে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছে। আহানের আচরণ বদলে গিয়েছে। ওর চোখে মুখে উদভ্রান্তভাব স্পষ্ট এই মূহুর্তে। আহান হঠাৎ করে রিয়ার বাহু ধরে নিজেকে শান্ত করে বললো,

-রিয়া, আমার দিকে তাকাও।

রিয়া না তাকিয়ে কেঁদে চলেছে। আহান এবার প্রায় ধমকের সূরে বললো,

-তাকাতে বলেছিনা আমি?

অনিকেত রেগে গিয়ে বললো,

-ওর উপর নিজের রাগ ঝাড়ছিস কেন তুই? ওর কথা তো ভাববি।

আহান জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ওর বুকের ওঠানামা শরীরে সেঁটে থাকা শার্টের উপর থেকে বোঝা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে চোখ মেলে বললো,

-আমাদের মাঝে ঢুকিস না তোরা।

ওর কথায় এবার প্রত্যেকের ভেতরই প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। ওদের প্রেমে সবরকম সহায়তা ওরাই করে এসেছে আর আজ আহান ওদেরই ঢুকতে নিষেধ করছে!
বিষয়টা গন্ডগোলের দিকে যাওয়ার আগেই তিলো বলে উঠলো,

-ওদের অন্তত কিছু সময় একা ছেড়ে দে।

আহান একবার তিলোর দিকে তাকিয়ে রিয়ার হাত ধরে ওদের ঘিরে ধরা জটলা থেকে খানিক এগিয়ে দাঁড়ালো। মীরা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

-কি যে হবে ওদের? আঙ্কেল নিশ্চয়ই বেকারের হাতে মেয়ে দেবে না। শুধু আঙ্কেল কেন? আমার বাবাও তো দেবে না। এই হলো সমবয়সীদের সাথে প্রেম করার জ্বালা। আমি তো বাবা…।

মীরার কথা শেষ হওয়ার আগেই মীরা লক্ষ্য করলো কয়েক জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মীরাও যে প্রেম করে, এটা আরেকটু হলেই ও স্বীকার করে ফেলছিলো। মীরা নিজের কথার লাগাম টেনে ঠোঁটজোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিয়ে বললো,

-আমাদের আগে ওদের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। ওদের সমস্যাটা বেশি গভীর আর সমাধানটা এই মূহুর্তে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

অনি সহমতের সুরে বললো,

-Exactly, আমি এটাই বলতে চাচ্ছিলাম।

-হ গাধী। এটুকু অন্তত বুদ্ধি হয়েছে যে, তুই ধরতে পারছিস কোন কথাটা যুক্তিসংগত।
তৌকির বললো।

ওর কথায় অনি মুখ ভেঙচিয়ে চোখজোড়া আহান আর রিয়ার উপর আবদ্ধ করলো।

-দেখো রিয়া, কেঁদো না। আজকেই আমার আব্বু – আম্মু যাবে তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।

কন্ঠে উদ্বিগ্নতা ঢেলে আহান বললো।
রিয়া চোখ একবার মুছে নাক টেনে বললো,

-তোমার মনে হয়, আমার আব্বু মেনে নেবে তোমাকে? আহান, তুমি বেকার। আব্বু কখনোই মেনে নেবে না।

-তাহলে কি করতে পারি আমি? রিয়া, কেঁদো না প্লিজ।

-পালিয়ে বিয়ে করি চলো।
রিয়ার কন্ঠে উৎফুল্লতা।

-হোয়াট? পালিয়ে বিয়ে করবো? আমরা?

রিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
আহান ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

-মাথা খারাপ তোমার? ওনারা মেনে না নিলে আমরা যাবো কোথায়? তোমার বাবা তো তোমার সাথে সব সম্পর্ক নষ্ট করে দেবে। তাছাড়া আমি তোমায় খাওয়াবো কি?

রিয়া এবার মাটিয়ে বসে পড়ে কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

-আমাকে ভালোবাসো না তুমি। কখনো ভালোবাসোনি। আমার বিয়ে হয়ে যাক, সেটাই তো তুমি চাও। তাই না? তোমার বাবা-মা কি মেনে নেবে না আমাকে? আমার আব্বুর মানা না মানায় কি আসে যায়?

আহান হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-প্লিজ রিয়া, বোঝার চেষ্টা করো। আমি…

রিয়া এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,

-বাপ তো আমার। আমি যদি পালাতে পারি তো তোর সমস্যা কি? লাগবে না তোকে আমার। আমি যাচ্ছি। তোর সাথে ব্রেকাপ। একদম আমার রাগ ভাঙাতে আসবি না।

বলতে বলতে রিয়া উঠে দাঁড়ালো। চলে যেতে যেতে বললো,

-দেখিস, তোর থেকে ভালো ছেলে বিয়ে করে দেখাবো আমি। তুই থাক তোর ইগো নিয়ে। তোর ইগোকে বিয়ে করিস বাড়ি গিয়ে।

আহান হতাশ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। প্রতিসপ্তাহের রেগুলার ব্রেকাপের সময় বলা কথাগুলো রিয়া এখনো বলে যাচ্ছে। দুএক ঘন্টা পরই রিয়া আবার ওকে ম্যাসেজ করতে শুরু করে। আজ কি হবে, তা আহান জানে না। তবে আজকের পরিণতি ভালো হবে না, এটুকু ও বুঝতে পারছে। আহানই বা কি করবে? রিয়াকে বিয়ে করে খাওয়াবে কি? নিজে কিছু করে না। বাবা সরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, যিনি রিটায়ার্ড করেছেন। বহু কষ্টে শখের ভেতর একটা বাইক পূরণ হয়েছে। তাও কেবল ওর শখ পূরণে না, পারিবারিক কাজেও লাগে। যেমন, বাজার করতে রিক্সা বা অটোতে না গিয়ে ওর বাবা ওর বাইকটাই ব্যবহার করেন। ছোট বোনটাকে স্কুল, টিউশনে ড্রপ করে দেওয়াসহ ইত্যাদি কাজে। পেনশন যা পায় ওর বাবা, তা দিয়ে সংসারটা কোনোমতে চলার পাশাপাশি বোনের লেখাপড়া আংশিক চলে। আহান এরপর তিন চারটা টিউশন করায়। এভাবে টানাটানিতে চলছে। এরমধ্যে রিয়াকে বিয়ে করে ওকে সুখী করবে কি করে? রিয়ার বাবা যথেষ্ট অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি। প্রাইভেট একটা কোম্পানির ম্যানেজার। মোটা স্যালারি পান। সেভাবেই জীবন চালান। রিয়াও বিলাসিতা পছন্দ করে। আহান কিছু না করলে, সংসারে তো রোজ ঝামেলা হবে।

রিয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আহানের চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠলো। হয়তো এটাই তাদের সমাপ্তি! আহান ডাকলোনা একবারও রিয়াকে। সেই কলেজ থেকে তারা প্রেম করে আসছে। ভাবতে পারেনি, হঠাৎ করেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে।

রিয়া চলে যেতে গেলে, ফিরোজ ওকে কয়েকবার ডাকলো। রিয়া তবুও দাঁড়ালো না। ভার্সিটি গেট থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা ধরে বাড়ির পথ ধরলো। চোখে থেকে তার পানির ধারা থামছেই না। রিয়া চেষ্টা করেও থামাতে পারছেনা। ভেতরটা মনে হচ্ছে, দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কেউ শরীরের কোনো একটা অঙ্গ টেনে ছিড়ে ফেলছে যেন। যেটা প্রতিরোধ করতে সে সম্পূর্ণ নিরুপায়।

ওরা বন্ধুরা আহানের কাছে এগিয়ে এলো। একেকজনের একেক অভিমত। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে তো কেউ দুষছে। গালাগালি করছে তো, কেউ তাকে থামতে বলছে। ওদের কথাবার্তার মাঝেই গম্ভীর ভারী কন্ঠে কেউ তিলোর নাম ধরে ডাকলো। তিলোসহ প্রত্যেকের দৃষ্টি এখন শব্দ উৎসের দিকে। তিলো অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলো অরিক ওকে ডেকেছে দেখে। ওরা যদি জেনে যায়, অরিক ওর ভাই? বিরক্তিকর। বাড়ির লোকজন ওর গায়ের রং নিয়ে বলে, সেটা ওর বন্ধুরা জানে। এখন অরিক কি সাক্ষ্য প্রমাণ সবকিছু বাস্তবে ওদের সামনে উপস্থাপন করবে?
তিলো ভদ্র কন্ঠে বললো,

-ইয়েস প্রফেসর?

অরিক কর্কশ সুরে বললো,

-তোমরা ক্লাস টাইমে এখানে কেন? ভার্সিটিতে কেবল আড্ডা দিতে আসো নাকি?

ওরা প্রত্যেকেই এবার ঘাবড়ে গিয়েছে। আহানের ব্যাপারটার জন্য তো অরিকের উপস্থিতির কারণ ওরা কেউ আন্দাজ করারই ফুরসত পায়নি। এখন ভয় করছে। এই প্রফেসরের দাপট তো প্রথমদিনই দেখে নিয়েছে তারা। যেসব সিনিয়রদের বিরুদ্ধে বাকি সব প্রফেসর মুখ বন্ধ করে থাকতো, সেখানে অরিক প্রথমদিনই ওদের বিরুদ্ধে শুধু বলেইনি। ওদের পানিশমেন্ট দিয়ে শান্ত হয়েছে। ওরা কেউই কিছু বলছে না। ওদের চুপ করে থাকতে দেখে অরিক গর্জে উঠলো।

-তোমরা যে কেবল আড্ডা দিতে ভার্সিটিতে আসো, এগুলো তো নিশ্চয়ই তোমাদের প্যারেন্টস জানেননা। ওনারা তো ভাবেন, তাদের সন্তানেরা কতো ভালো পড়াশোনা করে যে, রোজ ভার্সিটিতে যায়। পরীক্ষার খাতায় কি লিখবে তোমরা ক্লাস না করলে? তাদের ঠকাচ্ছো……
ইত্যাদি ইত্যাদি, অরিক বলেই গেলো। হুমকি দিলো ওদের প্যারেন্টস ডেকে সব বলে দেবে। প্রিন্সিপালের কাছে যাবে। তিলোর অবাক লাগছে, ওরা বড় হয়েছে। আর অরিক কিনা ওদের হাইস্কুলের মতো হুমকি ধামকি দিচ্ছে। একগাদা লেকচার দেওয়ার পর অরিক সরাসরি তিলোর দিকে আঙ্গুল তুলে বললো,

-আর এই মেয়েটা। এই মেয়ে, নিজের তো শ্রী ওই। না পড়লে করবে কি জীবনে? এখনই ক্লাসে যাও তিলো। আর একদিনও ক্লাস টাইমে তোমাকে বাইরে দেখলে সোজা তোমার বাবার কাছে নালিশ করে দেবো। রিমেম্বার।

অরিক কথাগুলো বলে চলে গেলো সেখান থেকে। তিলো বরাবরের মতোই বিরবির করলো,
-নালিশ করে যতো বালিশ পাবে, তাই দিয়ে বালিশের দোকান দিও। ভার্সিটিতে তোমাকে এলাউ কোন বলদ করলো, সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। তোমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য এখানে পড়াতে পারছো। আবার বড় বড় কথা!

অনি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকালো। অরিক ওর নাম জানলো কি করে, আর ওকেই নির্দিষ্ট করে এতো বেশি কিছু বললো কেন, এসবই অনির মস্তিষ্কে আঘাত করছে। তিলো তাহলে অরিককে চেনে। ভাবতেই অনির মন নেচে উঠলো যেন। তিলোর থেকেই সব জানতে হবে ওকে। বিশেষ করে প্রফেসর সিঙ্গেল কিনা? তবে এখনই তিলোকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ ওর হলোনা। অরিকের দাবড়ে ওরা ক্লাসে ফিরলো।

#চলবে

**এই কয়েকদিন গল্প দিতে না পারায় দুঃখিত। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে দিতে পারিনি।

ভুলত্রুটি আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)

০৫,,

-অকর্মা কোথাকার! সামান্য একটা পিয়াজু ভাজতে পারিস না! সংসারে গিয়ে করবি কি তুই? রোজ নালিশ আসবে তো আমার বাড়িতে। তিল, আমি কিন্তু আগে থেকে বলে রাখছি, তোর সংসারের ঝামেলা আমার সংসারে এনে ফেলবি না একদম। এতো বড় হয়ে গিয়েছিস, এটুকুও পারিস না! সর এখান থেকে, দেখ আমি কিভাবে করি।

নাসিরা পারভীন তিলোর কাজে বিরক্ত হয়ে কথাগুলো তিক্ত কন্ঠে বললেন। সন্ধ্যাকালীন হালকা নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকতেই তিলোর আক্রমণের মুখোমুখি হলেন তিনি। মাঝে মাঝেই তিলোর এমন রান্নাবান্নার আগ্রহ জাগে। বিশেষ করে ও যখন মনে করে, ওর আসলে শেখা উচিত এই কাজগুলো। তিলোর রান্নাঘরে প্রবেশকে নাসিরা পারভীন আসলে ভয় পান। কাজ তো ঠিকমতো করবেই না বরং এক কাজ করতে হাজারটা ভুল করে ওনার কাজ বাড়াবে।
তিলো সরুচোখে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুমি কি প্রথমবার এর থেকে ভালো করে ভাজতে পেরেছো? আমি নিশ্চিত পারোনি। শিখতে তো দেবা? নাকি?

নাসিরা পারভীন ওর হাত থেকে খুন্তিটা কেড়ে নিয়ে ঠিক করে ভাজতে ভাজতে বললেন,

-তোর মতো বয়সে আমি তুলির মা হয়ে গিয়েছি। আর রান্নাবান্না! দেখ কিভাবে করতে হয়।

-উফঃ আম্মা। তুমি অকালপক্ব ছিলে বলে কি আমাকেও হতে হবে? আর এখন তো তুমি পারবেই। তোমার সংসারের বয়সের থেকে আমার বয়স কম। ছোট মানুষ আমি। না শেখালে শিখবো কি করে?

কথাগুলো বলে তিলো আবারও ওনার হাত থেকে খুন্তি নিয়ে নিজের কেরামতি দেখাতে গেলো। আর তাতে পিয়াজু গুলোর সমস্ত পেঁয়াজ দলাগুলো থেকে ছাড়িয়ে সারা তেলে ছড়িয়ে একেবারে যা-তা অবস্থা!

তিলো কাজটা করে জিহ্বা কামড়ে ধরলো। আড়চোখে একবার নাসিরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে ছোট করে ‘সরি’ বলে ধীরগতিতে পেছনে ফিরলো আর নাসিরা পারভীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিলো সেখান থেকে গায়েব। নাসিরা পারভীন রাগে গজগজ করতে করতে একা একাই বকবক করলেন কিছুসময়। সেটা ছিলো তিলোকে কয়েকটা ঝাড়ি দেওয়া। তারপর নিজেই কাজে লেগে পড়লেন তিনি।

তিলো একছুটে তুলির ঘরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। তুলি ওকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,

-আবার কি আকাজ করে আসলি?

-কোনো আকাজ না। শুধু শিখতে গিয়েছিলাম। আর তুই তো জানিসই আম্মা সামনে থাকলে যা হয়।

-আম্মা সামনে থাকলে কিছু হয়না। আকাজ তুই করিস। চা বানাতে গুঁড়া দুধের জায়গায় বেসন কে দেয়? পেঁয়াজ বাটা রসুন বাটা গুলিয়ে ফেলে কে?

তিলো একপ্রকার বিরক্ত হয়ে তুলির পাশে বসে বললো,

-বাদ দে সেসব। আম্মা এমনিতে রেগে আছেন।

তুলিও আর এ নিয়ে কোনো কথা তুললো না। তুষার এসে ওদের পাশে বসলো। তুষার কথা বলা শুরু করার আগেই তুলি ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ওকে ইশারায় চুপ করতে বললো। ইশান ঘুমাচ্ছে। তুলি ওর দুপাশে বালিশ দিয়ে ছোট মশারীটা দিয়ে ঢেকে দিলো ওকে। রুম ছেড়ে দিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসলো। ততক্ষণে নাসিরা পারভীন স্ন্যাক্স নিয়ে চলে এসেছেন। তিলো নিতে গেলেই ওনি তিলোর হাতে ছোট করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলেন,

-নিজে যা বানিয়েছো তাই খাবি।

তিলো করুণ চোখে একবার ওনার দিকে তাকালো। ওনি সেই খাবারগুলোর সাথেই আনা একটা পিরিচে রাখা ছাড়া ছাড়া পেঁয়াজ ভাজি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-দুদিন এমন শিক্ষা দিলে তুই পথে আসবি বাছাধন। আমি তোকে বারবার নিষেধ করেছি তিল, আমার কাজের সময় বিরক্ত না করতে। এখন তুি এগুলো পাবি না।

-আম্মা প্লিজ। আর বিরক্ত করবোনা। আজকের মতো দাও প্লিজ।

নাসিরা পারভীন কড়া চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে পিরিচটা ইশারা করে বললেন,

-এই পিরিচের সবটা তুই খাবি।

তিলো একবার তুলি আর তুষারের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওরা মিটিমিটি হাসছে। তিলো হুট করেই সোফা ছেড়ে উঠে ধপাধপ্ পা ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো। ও চলে যেতেই শুনতে পেলো সেখানে হাসির রোল পড়ে গিয়েছে। তিলোর রাগ হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। ও জানে কিছুক্ষণ পর নাসিরা পারভীন ওর জন্য ভালো খাবারটাই এনে দেবেন। প্রথমে ও অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে। তারপর খেয়ে নেবে। কিন্তু এখন রাগ করে মায়ের সাথে ঝগড়া করলে আর সেটা হবে না। তাই তিলো বসে অপেক্ষা করলো নাসিরা পারভীনের আসার। প্রায় এক ঘন্টা পর ঘটলোও তাই।

পরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার পর থেকেই অনি তিলোকে একেবারে ছেঁকে ধরেছে। তার দাবি অরিকের সাথে ওর একটা কিছু করে দিক তিলো। তিলোর ভাষায় লাইন বা ইটিসপিটিস। তিলো যতোবারই এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে, অনি ততবারই বেশি করে ওকে ধরছে।

-বুন্ডি একবার একটা উপায় করে দে। দেখ, তোর কাছে আর কখনো কিচ্ছু চাইবো না। তোকে প্রমিজ করছি, এবার থেকে সব পরীক্ষায় তোকে সবকিছু দেখাবো। সব নোট আমি নিজে যোগাড় করে দেবো।

অনুরোধের সুরে অনি বারবার তিলোকে বলে যাচ্ছে। ভার্সিটি শেষে তিলো লাইব্রেরিতে এসে বসেছিলো। সেখানেই অনি হাজির। আজকে সম্পূর্ণ সময়টা তিলো ওর থেকে দূরে দূরে থাকতে চেয়েছে। রিয়া আর আহান দুজনের কেউই ক্লাসে না আসায় আজকে সবাই সে আলোচনাতেই ব্যস্ত ছিলো। আর এদিকে অনি ওর পেছনে ফাউ এর মতো লেগে পড়েছে। তিলো এতক্ষণ ওর কথার কোনো উত্তর না দিলেও এবার আর না দিয়ে পারলোনা।

-তুই দেখাবি পরীক্ষায় আমাকে? ও তাই?
চোখ মুখ শক্ত করে তিলো বললো,
-আর তোর তা দেখে ফেইল করি বসে।

অনি অস্থির ভঙ্গিতে বললো,

-এই না না। না দোস্ত। এবার থেকে আর ফেইল হবে না। পড়বো আমি। খুব পড়বো তোকে পাশ করাতে।

তিলো ওর কথায় হাসবে না কাঁদবে নাকি নির্বিকার হয়ে থাকবে, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। এই মেয়ে পড়াশোনা করবে ওকে পাশ করাতে, নিজে পাশ করতে নয়! তিলো কর্কশ কন্ঠে বললো,

-ফাজিল মহিলা! নিজে পাশ করার কোনো ইচ্ছা নেই না? শোন অরিক ভাইয়ার কিন্তু এমন ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট একদম পছন্দ না।

-ওহ ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস! ফাইনালি স্বীকার করলি প্রফেসর তোর ভাই।

প্রায় লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে অনি কথাটা বললো। পুরো লাইব্রেরির সকলের দৃষ্টি এখন ওর দিকে। অনি নিজের কাজের জন্য লজ্জাবোধ করলো ঠিকই তবে সেই অনুভূতির প্রভাব ওর উপর থাকলো না একদমই। চোখ খিঁচে বন্ধ করে টুপ করে চেয়ারটায় পুনরায় বসে চোখ মেলে সকলের উদ্দেশ্য হাত দুটো উপরে তুলে সারেন্ডার্ডের ভঙ্গিতে বললো, ‘মাই ব্যাড।’

তিলো চমকে উঠেছিলো অনির এহেন কাজে। এবার ও ক্ষমা চেয়ে নিতেই তিলো বললো,

-তুই তাহলে এতক্ষণ আন্দাজে ঢিল মারছিলি?

অনি মুখে হাসি নিয়ে মাথা নেড়ে ওর কথার সম্মতি দিলো।

-ছিঃ তোর লজ্জা করে না? ওনি না তোর প্রফেসর?

-লজ্জা কেন করবে? আমি যখন বিয়ে করবো তখন যদি জামাইয়ের পেশা শিক্ষকতা হয়, তাহলে কি আমি বিয়ে করবো না। না যে, ছেলে টিচার, মানে সে বিরাট সম্মানিত। তাকে বিয়ে করা যাবে না। কারণ আমি ছাত্রী। তাহলে তো প্রত্যেক টিচারের উচিত জীবনে কোনোদিন কোনো স্কুল, কলেজে যায়নি এমন মেয়ে বিয়ে করা। তাহলে তার কোনো টিচার থাকবে না আর টিচারের স্টুডেন্ট সে হবে না। এখন যদি টিচারটা গোল পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে তার বউয়েরই টিচার হয় বা সে যদি চাকরিটা তার বউ পড়া ভার্সিটিতেই পায়, তবে ছেড়ে দেবে চাকরিটা? কোনো টিচার কি কোনোদিনও প্রেম করে না? দুটো সম্পর্ক আলাদা। মিলিয়ে ফেলিস না। তাছাড়া প্রফেসর অরিক আমাদের ডিপার্টমেন্টের না।

তিলো চুপচাপ ওর যুক্তিগুলো শুনে বললো,

-পারবোনা আমি। তোর শখ হলে নিজে যা। জানিসই তো ওরা কেউ আমার কোনো কথা শোনে না। তাছাড়া দুদিন পর আরেক ছেলে দেখে ভাইয়াকে ভুলে যাবি তুই। চিনি তো আমি তোকে।

অনি তিলোর একহাত নিজের দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,

-দেখ দোস্ত, না শুনুক। একটুখানি আমাকে সাহায্য কর। বিশ্বাস কর, এটা আমার শেষ ক্রাশ। আর কাউকে দেখে আমি আর কখনো ক্রাশ খাবো না। প্রয়োজন ছেলে দেখলেই চোখ বন্ধ করে ফেলবো। প্রফেসর তোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। না হলে, কালকে যেচে অতো কথা বলতে আসতেন না। কোনো প্রফেসর, ছাত্রীর রূপ নিয়ে বলতে পারে? তুই বোন বলেই তো বলেছেন৷ প্লিজ তিল। কিছু কর।

তিলো টেবিলের উপর মেলে রাখা বইটা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘আনবিলিভেবল’। বলেই ওখান থেকে উঠে গেলো। অনিও ওর সাথে সাথে উঠে ওর পেছনে পেছনে ওকে অনুরোধ করতে করতে গেলো।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)

০৬,,

তিলো ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে দেখতে পায়, আনিস সাহেব ইশানকে কোলে নিয়ে ওর কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তুষার বিভিন্ন ভঙ্গিমা করে সার্কাসের ক্লাউনের মতো হাত পা নাড়িয়ে ওকে দেখাচ্ছে, যাতে ওর কান্না থেমে যায়। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। বাচ্চাটা গলা ছেড়ে সর্বোচ্চ যতোটা বড় করা যায় গাল ততটা বড় করে চিৎকার করে কাঁদছে। মাঝে মাঝে কাঁশছে। আবারও কাঁদছে। তিলোর অবাক লাগে, ও তো একটা মানবশিশু। কিভাবে এতো চিৎকার করে কাঁদতে পারে! গলা চিড়ে কি মনে হয় না, এখন থামা উচিত?

তিলোর মনে প্রশ্ন জাগছে, নাসিরা পারভীন এবং তুলি কোথায়? আনিস সাহেব ফিডারটার মুখ খুলে ইশানের মুখে দিলো। ইশানের কান্নার দরুন ও বিষম খেলো। আনিস সাহেব ওর পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে মুখ থেকে আহ্লাদ মেশানো কিছু শব্দ উচ্চারণ করছেন। তিলোর দেখে বেশ হাসিও পাচ্ছে। ছেলেরা বাচ্চা সামলাতে কিভাবে নাকের জলে চোখের জলে এক হয়, সেটা আজকে স্ব চোখে দেখে তিলো এক ধরনের আনন্দ অনুভব করতে পারছে মনে মনে। তিলো ঠোঁট টিপে হেসে ড্রইং রুমে ঢুকতে ঢুকতে ওদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-আম্মা কই?

তুষার ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,

-আম্মা আর তুলি আপু মার্কেটে গিয়েছে।

কথাটা শুনে তিলোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ওকে রেখে তারা মার্কেটে গিয়েছে! তিলো উত্তেজিত হয়ে বললো,

-কি! আমাকে বাদ দিয়ে কিভাবে মার্কেটে যেতে পারে তারা! একবার বললোও না যে যাবে।

তিলোর কান্না পাচ্ছে। আনিস সাহেব তিলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-ছোট মা দেখ না, এই ছেলেকে সামলাবো কি করে আমি? তুই একটু কিছু কর। ওর কি লাগবে, তাতো বুঝতে পারছি না।

তিলো ভগ্ন কন্ঠে বললো,

-আমি জানবো কি করে? বাচ্চাকাচ্চা সামলিয়েছি কোনোদিন। যার বাচ্চা, তাকে ফোন করো গিয়ে।

কথাটা বলেই তিলো নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। ওরা বুঝতে পারছে তিলোর রাগের কারণ। তিলো এইসমস্ত মার্কেটিং, সাজগোজ, অনুষ্ঠানাদির বিষয়ে একটু বেশিই আগ্রহী। একটু না। বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহী। ফাহাদের বিয়েতে তার যাওয়া হয়নি বলে ক্ষেপে যেতো। কিন্তু সেখানে নিজের ভালোর একটা বিষয় ছিলো বলে, সে শান্ত আছে।

তিলো রুমে ঢুকে রাগে গজগজ করছে। ওরা ওকে ফেলে চলে গেলো! ভাবতেই রাগ হচ্ছে। এর ভেতর ইশানের কান্না কানে যেতে বিরক্ত হলেও ওর মায়াও হচ্ছে। বাচ্চাটার কান্না সহ্য করা দ্বায়। তিলো রুম থেকে বেরিয়ে আনিস সাহেবের কোল থেকে ওকে নিজের কোলে নিলো। ওকে ভালো করে পরখ করে ওর ডায়াপার পরিবর্তন করে দিলো, তারপর ফিডার খেতে দিলো। বাচ্চাটা ক্লান্ত ছিলো। ওর কোলে ঘুমিয়েই পড়লো।
ইশান ঘুমিয়ে যেতেই আনিস সাহেব আর তুষার যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে এমন ভঙ্গিমায় বসলো যেন, সারাদিনে কনস্ট্রাকশন লেবারের কাজ করে এসেছে। আনিস সাহেব খুশি হয়ে বললেন,

-বাঁচালি মা আমাদের। বাচ্চা সামলানো আসলেই কঠিন। একটা মেয়ে কি করে এতোটা পারে!

তিলো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-যার বাচ্চা, তার বোধ নেই? এভাবে ফেলে যায় কেউ?

-রাগ করিস না। তোকে আমি মার্কেটে নিয়ে যাবো। তোর যা পছন্দ কিনে নিস।

-লাগবে না আব্বু। আমি আর কখনো মার্কেটে যাবো না।

তিলোর গাল ফুলিয়ে বলা অভিমানের কথা শুনে আনিস সাহেবের হাসি পাচ্ছে। তিনি নিজেকে সামলে নিলেন তারপরও। এখন হাসা ঠিক হবে না তিলোর সামনে।

কিছু সময়ের নিস্তব্ধতার পর আনিস সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনই তিলো আঙুল ঠোঁটে দিয়ে ইশারা করলো থেমে যেতে। তিলো ইশানকে কোলে নিয়ে তুলির ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসে ওদের সামনে বসলো। কর্কশ কন্ঠে তিলো তুষারকে বললো,

-তা তোর মা আর বোনের মহৎ উদ্দেশ্যটা কি শুনি?

-ওই তো কাল…।

তুষার কথাটা শেষ করার আগেই আনিস সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-ইশানের কি কি প্রয়োজন যেন বললো। চলে আসবে তাড়াতাড়ি।

তিলো ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

-আসুক আর না আসুক, তাতে আমার কি? তারা যখন আমার কথা ভাবে না, তখন আমি ভাববো কেন?

তুষার ফোঁড়ন কেটে বললো,

-ঠিকই তো। তুই কেন ভাববি?

তিলো অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোকে জিজ্ঞাসা করিনি আমি। সো, মুখ বন্ধ রাখ।

তুষার আর কোনো কথা বললো না। তিলো ওখান থেকে নিজের রুমে চলে আসলো।

ওরা ফিরে আসলে তিলো দেখতেও বের হয়নি কার জন্য কি আনা হয়েছে। রাতে খেতে বসেও কথা বলেনি ওদের সাথে। ওরাও কেউ সেদিকে পাত্তা দেয়নি। সাধারণত এমন হয়না। এবার হওয়ায় তিলো অবাক হওয়ার পাশাপাশি, ওর অভিমানটাও বাড়লো। ও একবার ভেবেছিলো নিজে বলবে। পরে আর বলেনি।

পরদিন শুক্রবার হওয়ায় তিলো ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। ব্রাশটা গালে নিয়ে সারা বাড়ি চক্কর দিতে গিয়ে তিলোর চক্ষু চড়কগাছ। আজকে বাড়িতে সে বিশাল আয়োজন। ওর মা, কাজের মহিলা আর তুলির মাঝে বিরাট ব্যস্ততা। তিলো দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতেই ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাতে একটা বাটি নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘সর, সর সামনে থেকে। পুড়ে মরবি তো।’

তিলো কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো সরে দাঁড়িয়ে তুলিকে জিজ্ঞাসা করলো,

-এতো আয়োজন কিসের আপু? কেউ আসবে?

তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বললো,

-আসবে তো। তুই একটু ইশানকে দেখ না বোন। আমার হাতে অনেক কাজ।

তিলো গালের থুথু ডাইনিং এর বেসিনে ফেলে মুখ ধুয়ে নিয়ে বললো,

-কারা আসবে?

ওর প্রশ্নটা হয়তো কারো কানে ঢুকলো না। ঢুকলেও কেউ পাত্তা দিলো না। ও এবার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলো। নাসিরা পারভীন এবার নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,

-সবাই আসবে। তোমার ফাহাদ ভাইয়া নতুন বিয়ে করেছে। তাদের তো একবার অন্তত দাওয়াত করে খাওয়াতে হয়, নাকি?

ফাহাদের নাম শুনে তিলো থমকে গেলো। আজকে সে আসবে! নতুন বউ নিয়ে আসবে! তিলো কম্পিত কণ্ঠে বললো,

-নতুন বউ আসবে?

নাসিরা পারভীন এবারও আগের মতো স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

-নতুন বউ কি তিল? ভাবি বলো। তোমার থেকে কলি একবছরের বড়।

কথাটা বলে ওনি পোলাওতে ঘি ঢাললেন। তিলোর হঠাৎ করেই খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ফাহাদের বউয়ের নাম তাহলে কলি। তিলো এইমাত্র জানতে পারলো। এই কয়েকদিন ভুলে ছিলো। আজ আবারও ওদের আসা লাগছে! তিলোর মনে হচ্ছে, কেন ওর মা আগে বললো না, তাহলে ও নানাবাড়ি চলে যেতো অন্তত। ফাহাদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস ওর নেই।

তিলো ওখানে আর দাঁড়ালো না। সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ওদের ওর দিকে খেয়াল করার সময় হাতে নেই। বুক ফেটে কান্না আসছে তিলোর আবারও আজ। হঠাৎ মনে পড়ায় কষ্টটা বেশি হচ্ছে। কলি ফাহাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, ওর পাশে বসে তিলোর বাড়িতেই ডাইনিং এ বসবে, ভাবতেই ভেতরটা মুচড়ে উঠছে তিলোর।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here