ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -০২+৩

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়া (ছদ্মনাম)

০২..

তিলো বোনের সংসারের অশান্তির কথা জানলেও ভাবতে পারেনি বিষয়টা এতোটা জটিল যে, ইমন তুলিকে তালাক দেওয়া পর্যন্ত গড়াবে। তিলো নিজের অবাক হওয়ায় পর্যায় থেকে নেমে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

-ভাইয়া তোকে তালাক দেবে কেন আপু? কী হয়েছে তোদের ভেতর? ইশানের তো জ্বর। এভাবে কেন বের করে দিলেন?

তুলি ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই একবার নাক টেনে বললো,
-ও বিশ্বাস করে না রে বোন। ও বিশ্বাস করে না ইশান ওর ছেলে।

কথাটা শোনামাত্র তিলো দ্বিতীয়বারের মতো ধাক্কা খেলো। এটা কি ধরনের কথা? দুটো বছর সংসার করার পর তাদের মাঝে নতুন কেউ এসেছে। তাকে নিয়েই অবিশ্বাস! তিলো এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো,
-এসব কি বলছিস আপু। এটা সম্ভব নাকি?

-আমি জানি না। কিচ্ছু জানি না। ও কোথা থেকে জেনেছে আমার কারো সাথে সম্পর্ক আছে। এখন ইশানকে নিয়েই ওর মনে দ্বিধা চলছে।

তুলি কান্নার দরুন কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে বলছে। তিলো যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তিলোকে তো কেউ বন্ধু ছাড়া আরেকটু গভীরভাবে পছন্দই করে না। কিন্তু তুলিকে করতো। এলাকায় ওর মতো সুন্দরী, কেবল হাতে গোনা দুএকজনই আছে। এরপরও বিয়ের আগে পর্যন্ত তুলি কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি৷ ওর কথাই ছিলো, ওর সমস্ত ভালোবাসা সবটুকু ও ওর বরের জন্য সঞ্চয় করে রাখছে। বিয়ের পর সবটা তাকে দেবে। তুলি স্বেচ্ছায় পছন্দ করে ইমনকে বিয়ে করেছে। ইমনও পছন্দ করেছে ওকে। আর সেই মেয়ের নামে এতোদিন পর চরিত্র নিয়ে কথা তোলা হচ্ছে! তুলি কাঁদছে, এতে তিলো অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশান কেঁদে ওঠায় তুলি নিজের কান্না থামিয়ে ওকে শান্ত করতে লেগে পড়লো। তিলো সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তুলিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। ইশানের জন্মের কিছু মাস আগে থেকেই তো তিলো ওদের অশান্তির কথা শুনেছিলো। ইশান জন্মের সময়ও তুলি এবাড়িতে আসেনি। সে কি ভয় পেতো? যদি ইমন ওকে ফিরিয়ে না নেয়? তাতে লাভ কি হলো? সেই তো ইমন ওকে ত্যাগ করলো। কয়েকমাসে কি হাল হয়েছে চেহারার! গলার দুপাশের কলারবোন দুটো পাখির ডানার মতো মেলে আছে যেন। কখনোই তিলো এর আগে ওকে এতোটা শুকিয়ে যেতে দেখেনি। ছেলেটার এখনো আতুর কাটেনি। কিভাবে পারলো ইমন এটা করতে? ইশশ, ইশান তো দেখতেও ইমনের মতো। বিশেষ করে ওর ঠোঁটের দিকটা। এরপরও ইমন সন্দেহ করে!
দুটো বছরেও সংসারে ‘বিশ্বাস’ নামক বস্তুটা থিতু হতে পারেনি। তুলি নিজেকে সামলে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে নিজের জন্য এবাড়িতে বরাদ্দকৃত ঘরটায় চলে গেলো। ইমন ওকে এক কাপড়ে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ঘর ছাড়া করেছে। আজব! ইমনের মা আর ভাই-ভাবিও কিছু বললো না?

তিলো শরীর মুছে শুকনো কাপড় পড়ে ফোনটা হাতে নিলো। মা বাবাকে অন্তত জানানো দরকার তুলির আগমনের কথা। তুলি আর ইমনেরও ফাহাদের বিয়ের দাওয়াত ছিলো। কিন্তু ওরা যায়নি। সকলেই জানতো যাবেনা। তবুও ফর্মালিটি রক্ষা করতে দাওয়াত দেওয়া।

তিলো ফোনটা হাতে নিয়ে হতাশ হলো। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। সারারাত ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনে চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে। তিলো চিন্তা করছে, ওর থেকেও বড় সমস্যা, বড় কষ্ট পৃথিবীতে উপস্থিত। আর সেটা ওর ঘরেই। ফাহাদ তো ওকে ছেড়ে কেবল বিয়ে করছে আর এদিকে ওর বোনটার পরিপূর্ণ সংসারটা মিথ্যা অপবাদে ভেঙে যাচ্ছে। এটা ওর কষ্টের থেকেও বড় কোনো কষ্ট।

তিলো ফোনটা চার্জে দিয়ে দেখলো বিদ্যুৎ নেই। না থাকারই কথা। এই দুর্যোগে বিদ্যুৎ থাকার সম্ভাবনাই কম থাকে। এখনো বাইরে অন্ধকার হয়ে আসেনি আর আবহাওয়া ঠান্ডা বিধায় বৈদ্যুতিক কোনোকিছু ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি। তাই বুঝতেও পারেনি এতক্ষণ। ওর মা বাবার সাথে যোগাযোগের উপায় বাড়িতে কেবল এই একটাই। তুলি বোধহয় ফোন সাথে করে আনেনি। আনলে হাতে দেখতে পেতো।

তিলো তুলির রুমে গিয়ে দেখলো, তুলি ইশানকে ঘুম পাড়িয়ে ওর শরীরে ধীরে ধীরে হাত দিয়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে আর নিঃশব্দে কাঁদছে। তিলো ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-তুই তো বোধহয় খেয়ে আসিসনি। খেতে আয়।

তুলি দূর্বল ভঙ্গিতে বললো,

-ইচ্ছা করছে না রে তিল।

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে মাঠে নামলো। তুলিকে খাওয়ানোটা এখন ওর বিরাট দ্বায়িত্ব। তিলোর জোরাজুরিতে তুলি অবশেষে খাবার টেবিলে আসে। তিলো রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে রান্না করা খাবার বের করে গ্যাসস্টোভে গরম করে নিয়ে আসে। তিলো নিজেও খায়নি দুপুরে। খেতে খেতে তুলি বললো,

-রান্না কে করেছে?

-আম্মু করে রেখে গিয়েছে।

-রাতে থেকেছে কে তোর সাথে?

-শাহানা আন্টি। এখন যাবো ওনাকে বলতে, আজকে আসা লাগবে না।

-ওই খিটমিটে মহিলা? তুই থাকতে দিয়েছিস?

-কি করবো? আম্মু বলে গিয়েছেন ওনাকে। তুই তো জানিস না, কি জোরে যে নাক ডাকেন! আমি পাশের রুমে শুয়ে তাই কানে বালিশ চাপা দিই। শাহানা আন্টির মেয়ে, শারমিন আপু বলেছে আমাকে, ওনার পাশে ঘুমালে ওনি মাঝরাতে কোল বালিশ বানিয়ে জড়িয়ে ঘুমান। আমি শুইনি তার পাশে এটা শুনে।

তুলি তিলোর কথা প্রত্যুত্তর করলো শুধু ‘ওহ’ বলে। অন্য সময় হলে দুজনে বসে আরো পঁচাতো মহিলাকে। কিন্তু এখন তুলির সেদিকে কোনো আগ্রহই নেই। তিলোও বিষয়টা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলো।

খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে তিলো জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। বাইরে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। তিলো ছাতা হাতে পাজামা হাঁটু অবধি টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো শাহানা আন্টির বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখান থেকে মোড়টা ঘুরলেই তাদের বাড়িটা। তিনতলা পুরানো বাড়ির দোতলায় তারা থাকেন। বাড়ির নিচতলা আর তিনতলা ভাড়া দেওয়া। এলাকায় তিনি খুবই জনপ্রিয়। ছেলেটা বিদেশে থাকে বউ নিয়ে আর মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে চট্টগ্রামে। স্বামী এখনো নিজের ছোট ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহিলার সংসারে দ্বায়িত্ব খুবই কম। ছেলে আর স্বামীর পয়সায় রান্না করার লোক, ঘর পরিষ্কারের লোক আছে। তাই পরোপকারী হিসাবে তাকে এলাকায় এমন কোনো মহিলা নেই, যে চেনে না। এবাড়ি ওবাড়ি করে সারাদিনই আড্ডা দিয়ে বেড়ায় নিজের বয়সী, বা বড় ছোট মহিলাদের সাথে। অবসরের দারুণ বন্ধু তিনি। তার সাথে মানুষের যেকোনো উপকার, নিজের সাধ্যের মধ্যে থাকলে করেন। শুধু পরের প্রজন্ম তাকে কিছুটা অপছন্দ করে, কারণ তিনি ন্যায্য কিছু কথা তাদের মায়েদের শিখিয়ে দিয়ে যান। ছেলেমেয়ের খেয়াল রাখা, মোবাইল ফোনে আসক্ত না হয়ে পড়া, ওদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা, এসবই ওনি শেখান তাদের মায়েদের। এবাড়ির গল্প ওবাড়ি। ওবাড়ির গল্প সেবাড়িতে বলে বলে সচেতনতা সৃষ্টি করেন। আর তার প্রয়োগ ঘটে বাচ্চাগুলোর উপর। কিছু কিছু মেয়ের সাথে তাকে ঝগড়ায় লেগে পড়তেও দেখা যায় মাঝে মাঝে। ওনার মেয়ের বয়সী ছেলেমেয়েগুলোকে ওনি প্রথম দর্শন থেকেই ‘তুই’ সম্বোধন করেন। এটা ওনার একটা বিশেষ গুণ। অথবা হয়তো দোষ।

তিলো শাহানা আন্টির ঘরের বেল বাজাতেই ওনি দরজা খুলে দেন। আজকে বাইরে বৃষ্টি হওয়ায় ওনি বের হতে পারেননি। আবার উপর তলায় ব্যাচেলর ছেলেরা থাকে। আর নিচতলায় একটা এনজিও বিধায় ওনার গল্প করার সঙ্গী বাড়িতেই নেই।
শাহানা আন্টি তিলোকে দেখে পান খাওয়া লালচে দাঁতগুলো বের করে একটা হাসি দিয়ে বললেন,

-কিরে ছেমড়ি? ভয় পাইতাছিস নাকি একা একা?

তিলো জোরপূর্বক হেসে বললো,

-না আন্টি। আসলে আপু এসেছে। তোমার আসার লাগবে না আজকে রাতে।

-কি বলিস? এই ঝড়ের মইধ্যে মাইয়াডা আসলো কেমনে?

-সে আরেক কথা। তোমার ফোনটা দাও তো আম্মুর সাথে কথা বলবো।

শাহানা আন্টি মাথা নেড়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,

-বাইরে খাঁড়ায় আছিস ক্যান? ঘরে আয়।

তিলো ছাতাটা বাইরে রেখে ঘরে ঢুকলো। শাহানা আন্টি নিজের আইফোনের লেটেস্ট মডেলটা এনে তিলোর হাতে দিলেন। তার সাথে বরাবরের মতো সুযোগ ছাড়লো না একথা বলতে যে, ফোনটা তার ছেলে তাকে পাঠিয়েছে। মহিলা প্রযুক্তি বেশ পছন্দ করেন। তার আবার এসবে বেজায় আগ্রহ। তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও বেশ এক্টিভ দেখা যায়। নতুন মডেল বের হলেই ছেলের কাছে তার আবদার, সেটা পাঠাতে হবে। পাড়া চড়িয়ে বেড়ানোর সময়ও ফোনটা হাতে থাকবে, যদিও তার ঘাড়ে বেশ বড়ো সড়ো একটা ব্যাগ প্রায় বলতে গেলে ফাঁকাই থাকে।

তিলো ওর মাকে ফোন করলো। দুবার বাজার পর তৃতীয়বারে নাসিরা পারভীন ফোন তুললেন। ফোনটা তুলেই তিনি বললেন,

-কি শাহানাপা, কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?

তিলো খুক করে একটু কেশে বললো,

-আম্মা, আমি তিল। তুলি আপু এসেছে বাড়িতে। ইশানের খুব জ্বর।

তিলো পুরোটা বলতে চাচ্ছে না শাহানা আন্টির সামনে। ঘরের কথা এই বিবিসি নিউজের প্রধান সাংবাদিকের সামনে বলা মানে সাথে সাথে টেলিকাস্ট হয়ে যাবে। ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটবে এলাকায়৷ তিলো চিন্তা করছে, তিলো বের হয়ে যেতেই ওনি ওনার পরিচিত ভাবিদের ফোন করে করে বলবেন, জানেন ভাবি মোড়ের দুটো বাড়ি পরে উত্তর দিকে যে একতলা ছোট বাগান বাড়িডা আছে না? ওইহানে যে নাসিরা আপা থাকে, তার বড় মাইয়াডারে তো ওর বর ছাইড়া দিছে। কবে কিডা, কি করছে ও। এখনকার ছাওয়াল মাইয়ারা যে কি, তা কওন যায় না। এগোতো পান থেইক্কা চুন খসলেই সংসার শ্যাষ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথাগুলো তিলো কল্পনা করে নিজেই অবাক হলো। শাহানা আন্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো, তিনি ড্যাবড্যাবে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন।
নাসিরা পারভীন বললেন,

-এই বর্ষায় তোমার বোন কেন এসেছে? ইমন দিয়ে গিয়েছে?

আজব! যেই তুলি ফাঁপরে পড়লো, সেই সে শুধু তিলোর বোন হয়ে গেলো!

-না।
মৃদুস্বরে জবাব দিলো তিলো।

-তিল শোনো, আজকে ঝড় কিন্তু সারাদেশেই হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই উপকূলীয় বিপদসংকেত সম্পর্কে খবর দেখেছো আজকে। আজকে তোমার ভাইয়ার বিয়েটা হয়নি। পরিস্থিতি ভালো থাকলে কালকে হবে। অথবা পরশুদিন।

-তোমরা কি ভাইয়ার বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসবে না?

-অদ্ভুত তো! ফাহাদের বিয়ে হোক বা না হোক, এই ঝড়বৃষ্টিতে কিভাবে রওনা দেবো আমরা? তুমি ইমনকে বলো তোমার বোনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যদি তোমার খুব অসুবিধা হয়।

তিলো বুঝতে পারছে, তুলির সংসারে অশান্তিটা নাসিরা পারভীনেরও পছন্দ না। তিনি সবসময়ই তুলিকে মানিয়ে চলতে বলেন। তুলি পারেনি বলে, তিনি নারাজ ওর উপর।
তিলো একবার ভাবলো তুলির ডিভোর্সের কথাটা বলবে। তুলির ডিভোর্স এতোদিন হবে হবে ভাব ছিলো। কিন্তু আজকে তুলি সাইন করে বেরিয়ে এসেছে। এটা তার জানা প্রয়োজন।

-আম্মা, আপুর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।
তিলো চাপাস্বরে বললো

ওপাশ থেকে তেমন কোনো কথা আসলোনা। হয়তো ওপাশের ব্যক্তিটি ধাক্কাটা সামলাতে সময় নিচ্ছেন। ঝড়ের সময় উপকূলীয় ঢেউয়ের ধাক্কার ন্যায় শক্তিশালী কোনো আঘাত এটা। নাসিরা পারভীন নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

-ফোন রাখো তিল। ইশানের খেয়াল রাখো।
বলেই তিনি কল কেটে দিলেন। তিলো কান থেকে ফোন নামিয়ে শাহানা আন্টির কৌতুহলী দৃষ্টির তলায় পিষ্ট হয়ে গেলো যেন। ফোনটা ওনার হাতে দিতেই ওনি জিজ্ঞাসা করলেন,

-তুলির কি হইছে রে?

তিলো তড়িৎ বেগে উত্তর দিলো,
-তেমন কিছু না। ইশান একটু অসুস্থ।

-তা পোলায় অসুস্থ হলে এই সময়ে কিডা বাপের বাড়িতে আসে?

-আরে আন্টি। ইশান তো এখানে আসার পর অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। আমি আসছি, ওদিকে আপু আবার ছেলেটাকে একা সামলাতে পারছে কিনা কে জানে?

তিলো দ্রুত ওনার ঘর থেকে বের হয়ে যায় ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। ভাবসাবে তার মহাব্যস্ততা! শাহানা আন্টি দুএকবার ডাকলো ওকে। ও সময় নেই বলে চিৎকার করে চলে গেলো।

সন্ধ্যা নামতেই তিলো চার্জারের লাইট জ্বালিয়ে নিয়ে এসে তুলির সাথে গল্প করছে। জেনারেটরটা বিগত প্রায় একবছর আগে নষ্ট হয়ে আছে। সরকারের উন্নয়ন পদক্ষেপে দুর্যোগ ছাড়া বিদ্যুৎ খুব কম সময়ের জন্যই যায়। তাই আর সেটা সারানোর গরজ অনুভব করেননা আনিস সাহেব(তিলোর বাবা)।

তিলো চাচ্ছে ওর বোনের মনটা হালকা হোক। তিলো তার নতুন ভার্সিটি জীবনের সুন্দর মূহুর্তগুলো তুলির সাথে শেয়ার করছে। যদিও ঘটনা সংক্ষিপ্ত। তিলো আরও রং চড়িয়ে দীর্ঘ করছে। আর খারাপ অভিজ্ঞতা তো এড়িয়েই চলছে। তুলির কখনো ভার্সিটি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ইন্টার পাশ করে এডমিশনের আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কথা ছিলো বিয়ের পর পড়াবে। কিন্তু সংসারের দ্বায়িত্ব কাঁধে পড়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তুলি মাঝে মাঝে মৃদু হাসছে। তিলো লক্ষ্য করলো, ওর এখন ফাহাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে না। তুলির মুখে হাসি দেখে তার দ্বিগুণ আনন্দ হচ্ছে।

রাত বাড়তেই তিলো নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কেবল ঘুম এসেছে। রুমের দরজা খোলা। তখনই তুলি ওকে টেনে উঠিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,

-তিল আমার বাবুটা কেমন যেন করছে। কিছু একটা কর বোন।

তিলো কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লো। কি করবে ও? জীবনে কোনোদিনও বাচ্চাকাচ্চা কি সামলিয়েছে? তুষারটাও তো ওর থেকে মাত্র তিনবছরের ছোট। নাসিরা পারভীনই ছেলেকে সামলিয়েছেন। তিলো বিছানা ছেড়ে নেমে তুলির ঘরে গেলো। দেখতে পেলো, বাচ্চাটার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে মাঝে মাঝে কাঁদছে গলা ছেড়ে দিয়ে। বুক ওঠানামা করছে খুব বেশি। গোঙানি ধরনের শব্দ আসছে ওর মুখ থেকে। বুকের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। তিলো নিজেও বুঝতে পারছে না ও কি করবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছাতাটা মাথায় দিয়ে একছুটে চলে গেলো শাহানা আন্টির কাছে। এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গিয়ে কলিং বেল বাজালো। প্রথমবার খুললো না। তিলো এবার অনবরত বাজাচ্ছে।
এবার ভেতর থেকে বিরক্তপূর্ণ একটা কন্ঠ জিজ্ঞাসা করে উঠলো,
-কে? কে রে এতো রাতে?

কন্ঠটা শাহানা আন্টির স্বামীর। তিলো তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দিলো,
-আমি আঙ্কেল। আমি তিলো।

-ওহ। তা দাঁড়াও, খুলছি দরজা।
ভেতর থেকে বললো কন্ঠটা। এরপর খুট করে একটা শব্দ হয়ে দরজা খুলে গেলো। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত লুঙ্গি এবং স্যান্ডো গেঞ্জি পরা লোকটা বললো,

-এতোরাতে এখানে কেন মা?

তিলো হাঁপানি ছেড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

-আন্টিকে ডাকুন না। ইশানের অবস্থা ভালো না।

-অ। তুমি দাঁড়াও। আমি ডাকছি।

আঙ্কেল ভেতরে গিয়ে শাহানা আন্টিকে ডেকে দিলেন। সম্ভবত কারণও বলেছেন। তিনি সালোয়ার কামিজের ওড়নাটা মাথায় চড়াতে চড়াতে বেরিয়ে এসে বললেন,

-মাইয়ের কইলজে দেহো। এই রাতবিরেতে চলপ আইছে। এই ছেমড়ি, তোর ফোন দিতে কি হইছিলো?

-আন্টি আমাকে পরে বকবেন। আগে তো চলেন। ফোনে চার্জ নেই। থাকলে আম্মাকে আপনার ফোন থেকে ফোন করা লাগতো না।

শাহানা আন্টি কথা বাড়ালেন না। তিলোর সাথে ওর বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন।

তিলোদের বাড়িতে পৌঁছে তিনি ইশানকে কোলে তুলে নেন। একা একা কিছু গালি দিলেন আবহাওয়া আর নিজের এলাকাটাকে। এখান থেকে হসপিটাল বেশ দূর। তারসাথে বিশেষ করে আবহাওয়া। ডাক্তার ডাকলেও আসবে কিনা সন্দেহ। ওনার স্বগতোক্তি করে যাওয়া গালিগুলো থেকে রেহাই পেলো না, তিলোর মা বাবা, ইমন এবং তুলিও।

শাহানা আন্টি তেল গরম করে ইশানের বুকে ঘষে দিলেন। সাথে আরো কিছু করলেন। ইশান অবশেষে ঘুমিয়ে পড়তে সক্ষম হলো।
ওনি সারারাত ইশানকে নিজের পায়ের উপর ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন।

পরদিন সকালে ওনি বাড়ি ফিরলেন। সেদিন আবহাওয়া কিছুটা ভালো। তুলি তিলো আর ইশান, সারাদিনই বাড়িতে। বিকালে তিলোর বন্ধুরা আসলো ওদের বাড়িতে। বিদ্যুৎ তখনও আসেনি। তিলোর ফোন বন্ধ আর ওরা জানে তিলো একা বাড়িতে, তাই চিন্তা হচ্ছিলো ওদের।
সেদিন সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক হলো। অবিবেচকের মতো ফোনের চার্জ সব শেষ করে ফেলা এবং কখনোই পাওয়ার ব্যাংক না কেনার পক্ষপাতী থাকাতে নিজের সামান্য অনুশোচনা হলো তিলোর। তিলোর মা যাওয়ার আগে অনেকটা রান্না করে রেখে গিয়েছেন। যদি ওনার আসতে আরো দুচারদিন দেরি হয়, সেই আশঙ্কায়। তিলো মোটামুটি রান্না পারলেও ভারী খাবার রান্নায় একদমই অপটু। তবে তুলি পারে।

পরদিন রাতে তিলোর বাবা মা আর ভাই ফিরে আসলো। ওদের মাঝে কথাগুলো তিলোর ভালো লাগলো না বিধায় ও চলে গেলো সেখান থেকে নিজের ঘরে। ঘরে বসেই ওদের চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাচ্ছে ও। তুলি গলা ছেড়ে দিয়ে কাঁদছে। মাঝে মাঝে জড়ানো কন্ঠে চিৎকার করে কিছু বলছে। তিলো তাতে নাক গলালো না।

পরদিন সকালে ভার্সিটি গেট থেকে ঢুকে খানিক দূর হেঁটে গিয়ে নিজের বন্ধুদের ছোট জটলাটা চোখে পড়লো। হাসি মুখে সেদিকে এগিয়ে যেতে নিতেই কারো গম্ভীর কন্ঠ কানে আসলো ওর।

-এই যে মিস দাঁড়কাক। সিনিয়রদের দেখে যে সম্মান দিতে হয়। সালাম দিয়ে ভার্সিটিতে ঢুকতে হয়। এটুকু ম্যানার্স কি আগের কলেজে শেখানো হয়নি?

তিলো পেছনে ফিরে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললো। ভার্সিটির জীবনটায় ওর আনন্দটাই মাটি করে দেয় সিনিয়রদের এই দল। শুধু ওর না সব পিচ্চিগুলোর, মানে জুনিয়রদের।

#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়া (ছদ্মনাম)

০৩..

তিলো পেছনে ফিরে সিনিয়রদের দলটাকে দেখে ঘাবড়ে গেলো। আজ কি ওরও ছাড় নেই? এই কয়েকদিন তো লুকিয়ে চুরিয়ে বেঁচে গিয়েছে। এই বিষয়টায় ওর মাঝে একটা হেজিটেশন কাজ করে। ও সবসময়ই ঝামেলামুক্ত থাকতে পছন্দ করে। তা সে ঘরে হোক বা বাইরে। যদি ঝামেলা আর কারো ঘাড়ের উপর থেকে চালানো যায় তো ও সেটাই করে। এখনো নিজেকে ছোট মনে করে, যার বড়দের আলোচনার মাঝে থাকতে নেই। তাই তো তুলির বিষয়ে ও একদমই নাক গলাচ্ছে না।

তিলোর গায়ের বর্ণ কালো। তাই বলে তাকে দাঁড়কাক উপমা দেওয়ার কি আছে? ও মানুষ। ওরও আত্মসম্মান আছে। ছোটবেলায় বেশ লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে ও, যখন আসলে বন্ধুরা কিছু বুঝতো না। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ওর পাশে কেউ বসতে চাইতো না। টিচারদের থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না পেলেও ওর ক্লাসমেইটগুলো সেসময় ভীষণ পাঁজী ছিলো। ও যদি সামনের বেঞ্চেও বসতো, ওরা কেউই বসতো না। ওকে বরাবরই একা থাকতে হতো। কালো বলে ওর স্পর্শও কেউ পছন্দ করতোনা। (আমার ভাইয়ের কিন্ডারগার্টেনেই আমি এমন একটা ঘটনা বাস্তবে ঘটতে দেখেছি।) ধীরে ধীরে বড় হতে হতে যখন আশেপাশের মানুষগুলো ওকে মানিয়ে নিতে শুরু করলো, তখন থেকে ও কিছু বন্ধু জুটিয়ে নিতে সক্ষম হলো। এখন তো ভার্সিটিতে বেশ কিছু বন্ধু ওর আছে।

সিনিয়রদের দলটা ওর বেশ কাছে এগিয়ে এলো। তাদের মধ্যে একটা মেয়ে বললো,
-তো মিস কাকতাড়ুয়া, এতোদিন কোথায় ছিলেন আপনি? আমরা তো আপনাকে খুঁজেই পাইনি। অবশ্য পাবোই বা কি করে? আপনাকে তো আসলে দেখাই যায়না। অন্ধকার শুধু না দিনের আলোতেও তো আপনাকে দেখা যায়না।

মেয়েটা বলেই হেসে দিলো। তার সাথে আরো কয়েকজন তাল মিলিয়ে হাসলো। তিলো এমন কথা ওর দাদী আর চাচীর মুখে শুনেছে। চাচা চাচী থাকেন রাজশাহীতে। চাচার সরকারি চাকরির ট্রান্সফার এখন সেখানে। দাদীও তাদের সাথেই থাকে। কথাগুলো আগেও শুনে থাকলে নতুন করে এখন অন্য কারো মুখে সবার সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে তিলো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার পাশাপাশি ওর বেশ লজ্জাও লাগছে। তিলো হাত মুঠ করে আসমানী রঙের থ্রিপিছটার একটা মাথা খামচে ধরে রেখেছে। চোখজোড়া মাটিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছে, আল্লাহ যেন ওর বন্ধুগুলো অন্তত ওকে এখানে দেখতে পায় আর কিছু একটা উপায় বের করে এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে।

-তাহলে মিস আপনি এতোদিন লুকিয়ে থাকায় আপনার শাস্তি সুদে আসলে বাড়লো। আপনি এক কাজ করুন …

মেয়েটা কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা ছেলে বললো,

-তুমি কেবল একটা গান শোনাও।

তিলো চকিতে মাথা উঁচু করে তাকালো সামনে। কন্ঠের অধিকারীকে দেখে তিলো একটা ছোটখাটো ধাক্কা খেলো। তিলোর সাথে সাথে বাকিরাও তাকালো সেদিকে। এটা একটা পুরুষের কন্ঠ। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ মূর্তিটি তিলোর পরিচিত। অরিক। অরিক আহসান। তিলোর চাচাতো ভাই। তিলো জানতো সে পড়াশোনা শেষ করে একটা ভার্সিটিতে প্রফেসর পদে নিয়োগ দেবে। ওর বাবার মুখে অন্তত সেদিন দুপুরে খাবার টেবিলে বসে এটুকুই শুনেছিলো। ও ভাবেনি এখানেই অরিকের সাথে ওর দেখা হতে পারে। ও তো আত্মীয় স্বজন কারো সাথে কথাই বলেনা প্রায়। সবার থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে ও। প্রায় প্রত্যেকেরই কি রাজকীয় রং গায়ের! বেশি চাপা হলে, উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু তিলোর মতো এতো চাপা রঙের কেউ নেই। বাড়িতে বাবা-মা, ভাই আর বোনের মধ্যে এটা নিয়ে একদমই কথা ওঠেনা এখনো পর্যন্ত বলে ও সেখানে মুখর। তবে তিলো জানে, এসুখ বেশি দিন আর স্থায়ী হবে না। মা ইতিমধ্যে ওর বিয়ের কথা বলতে শুরু করেছে। ওকে যখন পাত্রপক্ষ একের পর এক রিজেক্ট করবে, তখন ওকে বাড়িতেও শুনতে হবে গায়ের বর্ণ নিয়ে।

অরিক মৃদু হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-একটা গান শোনাও আর চলে যাও। গুণের ভেতর তো এই একটাই আছে তোমার। তাই না?

অরিকের কথায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট। আরে বাহ্! চমৎকার। তিলোর তো কোনো ধারণাই ছিলো না অরিকের ওর গানের প্রতি আগ্রহ থাকতে পারে। কিন্তু না। একে আগ্রহ বলা যায়না। এটা অতি ছোট্ট সহানুভূতি, যা হয়তো যেকারো প্রাপ্য এমন একটা পরিস্থিতিতে একজন দ্বায়িত্বশীল প্রফেসরের পক্ষ থেকে। আর তাছাড়া অরিক শুধু ওর কৌতুকই করেছে।
সিনিয়রদের দলটা এবার অরিকের উপরই তেতে উঠলো। ওরা হয়তো এখনো ওকে চেনে না। একটা ছেলে তো ক্রুদ্ধ চেহারা নিয়ে ওর কলার চেপে ধরলো।
-শালা, ভার্সিটিতে পা রাখতে না রাখতে নিজেকে কি মনে করিস? চিনিস আমাদের? আমাদের কাজের মাঝে নাক গলাতে আসছিস! নাকই থাকবে না।

ছেলেটা অরিকের নাক বরাবর ঘুষি দিতে নিতেই অরিক ওর হাত ধরে ফেলে। ছেলেটার চোখে রাগ আরো স্পষ্ট হলো। তবে তা প্রকাশের আগেই ওর পাশে দাঁড়ানো আরেকটা ছেলে ওকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে কানে কানে কিছু ফিসফিস করলো। ছেলেটা যেমন আচমকা অরিকের কলার ধরেছিলো, তেমনি আচমকাই ছেড়ে দিলো। তিলো বুঝতে পারলো, সে নিশ্চয়ই অরিকের পরিচয় তাকে বলেছে। ইতিমধ্যে আশেপাশে উপস্থিত অধিকাংশের নজরই এদিকে। তিলোর বন্ধু গ্রুপ এগিয়ে এসেছে।

বেপরোয়া ছেলেটা মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বললো,
-সরি প্রফেসর।

ব্যাস! এর বেশি কিছু বললো না। হয়তো তার ইগোতে লাগছে। তিলোর কোনোপ্রকার অনুভূতি নেই। ও জানে অরিক রগচটা ধরনের। এখনো কিভাবে শান্ত হয়ে আছে, এটা তিলোকে সামান্য ভাবাচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনা যে আরো এগিয়ে যাবে, এবিষয়ে তিলো নিশ্চিত।

অরিক ছেলেটার কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে একবার তিলোর দিকে তাকিয়ে আশেপাশে জমে যাওয়া ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলো। অরিকের যাওয়ার দিকে অনেকেই তাকিয়ে আছে। অরিক প্রশাসনিক ভবনে ঢুকলো। অরিকের গন্তব্য সকলের কাছেই স্পষ্ট। সে প্রিন্সিপালের কাছে গিয়েছে।

তিলো বেপরোয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সে একেবারে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে যে নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছে, সেই বোধ তার হচ্ছে। এখন শুধু কবরে ওর শরীরটার ডেলিভারি বাকি। তার চোখে মুখে আফসোস প্রকাশ পেলেও সে ছিলো নির্বিকার।

ধীরে ধীরে সেখানকার জটলা পাতলা হয়ে যে যার অবস্থানে ফিরে গেলো।

তিলো ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। আশেপাশে অনবরত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে ওর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তিলো হাতের কলমটা একবার আঙুলের ফাঁকাগুলোর মধ্যে থেকে গলিয়ে নিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, যেন ক্লাসে প্রফেসরের উপস্থিতি তার জন্য কোনো বিষয়ই না। বিপত্তিটা তখনই ঘটলো। চকচকে টাক মাথার প্রফেসর ওর দিকেই তখন চোখ ফেলে গর্জে উঠলেন। ফলস্বরূপ, ক্লাস থেকে আউট।

তিলো বেরিয়ে যাওয়ায় ওর বন্ধুরাও একে একে বেরিয়ে গেলো। ভার্সিটি মাঠে একটা গাছের তলায় গোল হয়ে বসে তারা আড্ডার প্রস্তুতি নিলো। তিলো তখনও উদাস।
অনি সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বললো,
-এই তিল। তুই কি এখনো ছ্যাঁকা খেয়ে এভাবেই পড়ে থাকবি? আরে দোস্ত, জীবনে কতো ফাহাদ আসবে যাবে। একজনের জন্য নিজের সময়টা নষ্ট করার কোনো মানে হয়? আমি তো আজও গেলাম।

তিলো ভ্রু কুঁচকে বললো,
-আজও গেলি মানে?

প্রত্যুত্তরে অনি কেবল মুচকি হাসলো। তৌকির ফোঁড়ন কেটে বললো,
-জনগণস তোরা বুঝোস নাই? আমাদের কথায় কথায় ক্রাশ খাওয়া কুইন আজও খাইছে৷

অনির দিকে তাকিয়ে তৌকির আবারও বললো,
-আজ তো ভার্সিটি নতুন একজনই আসছে।

তিলো বিষয়টা বুঝতে পেরে একেবারেই চুপ হয়ে গেলো। এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই। অরিক ওর কাজিন জানতে পারলে, ওর সাথে অরিকের যে আসলে কথাই হয়না বিশ্বাস করলেও ওর পেছনেই হয়তো হাত ধুয়ে লেগে পড়বে।
আজকে আহান ভার্সিটিতে আসেনি। সেই সাথে রিয়াও। দুজনের মাঝে প্রেমের একটা সম্পর্ক আছে, সেটা ওরা সবাই জানে। ওরা মাঝে মাঝেই ক্লাস না করে ঘুরে বেড়ায়। অনিকেত গিটার হাতে নিয়ে সুর তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত। মিরা ফোনে কার সাথে যেন চ্যাট করছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। রিপা অনির সাথে গল্প করে যাচ্ছে আর ফিরোজ গিয়েছে সবার জন্য চা কিনে আনতে। মোটামুটি এই কয়েকজনই আছে তিলোদের ফ্রেন্ড সার্কেলে।

উদাস দৃষ্টিতে তিলো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমার পরিবারের মতো পরিবারে কুৎসিত হয়ে জন্মানোটা একপ্রকার আশির্বাদ।

ঝড় হয়েছে দুতিনদিন হলো। এখন আবারও আকাশে কালো মেঘ জমেছে। প্রকৃতিতে এখন কোনো নিয়মই সুস্থিতি নেই। অনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
-কেন রে?

-আপুটা সুন্দরী হওয়ায় আগে আগে বিয়ে হয়ে গেলো। আর আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। রূপ নেই। তাই এদিক থেকে স্ট্রং হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। আপুর ভাগ্যটা দেখ, ইমন ভাইয়া একবারও এই কয়েকদিনে ফোন করে নিজের অসুস্থ ছেলেটার খোঁজও নিলো না।

-তোর দুলাভাই একটা খবিশ, হারা*, জানো**।
মিরা তেতে উঠে বললো।

অনিকেত ওদের ভেতরকার কথা শুনে বললো,
-এই তোরা থাম। এখন কিন্তু ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার পুরো মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে পরিবেশ ভারী করলে। তিল একটা গান ধর।

-হ্যাঁ রে তিল। আজকে একটা গান গা।

তিলো প্রথমে না চাইলেও ওদের জোরাজোরিতে রাজি হয়ে গেলো। ততক্ষণে ফিরোজও ফিরে এসেছে। অনিকেত গিটার বাজাচ্ছে আর তিলো গান গাচ্ছে, এরপর ওরাও একসাথে গলা মেলালো,

আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার

ঝড়ের জল-তরঙ্গে নাচবে নটি রঙ্গে
ভয় আছে পথ হারাবার (×২)

গল্প করার এই তো দিন
মেঘ কালো হোক মন রঙিন (×২)

সময় দিয়ে হৃদয়টাকে বাঁধবো নাকো আর
…………………………………………….

তিলো বাড়ি ফিরে দেখতে পায়, নাসিরা পারভীন তুলিকে খুব যত্ন করে দুপুরের খাবার খাওয়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে মমতা মাখা গলায়, হা হুতাশের শব্দ করছেন। সাথে ইমনকে মনপ্রাণ খুলে গালাগাল করছেন।
‘আহারে, সোনাটা আমার কতোটা শুকিয়ে গিয়েছে। ওই শয়তানটা তোর কি হাল করেছে! আমাদেরই ভুল তোকে ওমন একটা হারা* হাতে তুলে দেওয়া। ……
ইত্যাদি, ইত্যাদি।

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। আসলেই মানবমস্তি্স্ক বড়ই অদ্ভুত! ঘটনা কিছুটা এমন, যেমন-
ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় আশাতীত ফলাফল করতে না পারায় বাড়িতে বকাবকি করা হয়েছে। এরপর সে দুএকদিন জেদ করে না খেয়ে, নিজের গাফিলতির জন্য অনুতপ্ত হয়ে এবং ভবিষ্যতে আরো সতর্ক থাকার প্রত্যাশা দেওয়ায় বাবা মা যেমন এই দুএকদিনের আদরের অভাব পূরণ করতে একটু বেশি আহ্লাদী হয়ে পড়েন, কিছুটা তেমন হয়েছে তুলির ক্ষেত্রে আচরণটা। এরপর সেই সন্তানের পূনরায় গাফিলতিতে মাঝে মাঝেই এই কথা তুলে বকাঝকা বা খোঁটা দেওয়া হয়, তিলো নিশ্চিত তুলির ক্ষেত্রেও তেমনি ঘটবে।

তিলো নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। নাসিরা পারভীন ওকে খেতে দিতে দিতে বললেন,
-তিল, তোমার বোন আবারও পড়াশোনা শুরু করবে। ইশানকে আমি সামলে নেবো। তোমার কলেজেই ওর এডমিশনের জন্য আবেদন করি। তুমি কি বলো?

তিলো যেন এই কথারই প্রত্যাশায় ছিলো। হাসি মুখে বললো,
-আমার মতামত নেওয়ার কি আছে। বাবাকে ব্যবস্থা করতে বলো। ওহ, অরিক ভাইয়া কিন্তু আমাদের ভার্সিটিতেই জয়েন করেছে। তুমি তাকেও বলতে পারো।

-অরিক তোমার ভার্সিটিতে?

-তেমনই তো বললাম।

নাসিরা পারভীন আর কথা বাড়ালেন না। তিলোকে খাবার গুছিয়ে দিয়ে তুলির রুমে চলে আসলেন। তুষার কোচিং এ থাকে এইসময়। আর আনিস সাহেব অফিসে থাকেন।

পরদিন কলেজে এসে সেই সিনিয়র দলটাকে ওরা আর দেখতে পেলোনা। কলেজ চলাকালীন সময়েই খবর ভেসে বেড়াচ্ছে, ওই বেপরোয়া ছেলেটাকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে আর বাকিদের কয়েকদিনের জন্য কলেজে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। সাথে কিছু জরিমানাও হয়েছে। এতে অনেকেই খুশি হয়েছে।

রিয়া আজকেও প্রথম থেকে ক্লাস করেনি। ওরা আজও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সেই গাছের তলায় বসেছে। তিলো মাঝে মাঝে ভাবে, ভার্সিটিতে ওরা কেন আসে? ক্লাস বাদ দিয়ে আড্ডাই যেন বেশি চলে। পড়াশোনার যে কি হবে! একেকজনের থেকে নোট ধার করেই ওদের চলে। মাঝে মাঝে ওদের ভেতর একেকজন ক্লাস করে সবাইকে পরে বুঝিয়ে দেয়। বন্ধুত্ব এতো সুন্দর কেন? তিলো শুধুই ভাবে।
ওদের আড্ডার মাঝেই রিয়া উপস্থিত হয়ে আচমকা আহানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। সবার সামনে এটা ও আশা করেনি। রিয়া ফুপিয়ে কেঁদে দিয়ে বললো,
-আহান, আব্বু আমাদের ব্যাপারে সব জেনে গিয়েছে। আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।

রিয়ার কথায় আহান চমকে উঠলো। আর বাকিরাও বেশ অবাক হয়ে গেলো।

#চলবে

**আগামী দুদিন গল্প দিতে পারবোনা। এজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here