ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -৪২+৪৩ ও শেষ

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৪২,,

রিয়া আত্মহত্যা করেছে, কথাটা তিলোর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। রাতেও ওর সাথে কথা হলো। আর এখন সে নেই! দ্বিতীয়বারের জন্য হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ও। অরিক ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরে পাশে এসে দাঁড়ালো। ও চায়নি তিলোকে বলা হোক। কিন্তু সকলেই নিরুপায়। অফিসার ওর সাথেই এবিষয়ে কথা বলতে এসেছে। তিলো দুপা পিছিয়ে গেলো কথাটা ওর বোধগম্য হতেই। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। অফিসার আরো যেটা বললো, সেটা শুনে তিলোর বোধ হলো তার হাড়গুলো ভস্ম হয়ে যাচ্ছে আর একটা হাড়ের কাঠামোহীন চামড়ার দেহটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ও পড়ে যেতে নিতেই অরিক ওকে নিজে হাতে ধরে পুতুলের ন্যায় দাঁড় করিয়ে দিলো। অরিক মাঝে মাঝে চিন্তা করে, তিলো এতোটা আবেগপ্রবণ! বন্ধুদের কথা শুনে ওর এমন অবস্থা হয়, তাহলে আপন কারো বিয়োগব্যথা সহ্য করবে কি করে?
অফিসার আরো বলেছিলেন, রিয়া প্রায় তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। গতকালই ওর রিপোর্ট এসেছিলো। অফিসার এসেছেন শুধু তিলোকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে। এটা স্পষ্ট আত্মহত্যা, যার সাক্ষী রিয়ার বাবা-মা উভয়েই। তবে এরপরও পুলিশের কাজ তদন্ত করে অপঘাতে মৃত্যুর একটা পরিপূর্ণ নথি তৈরি করা। এটা ফর্মালিটি। যার কারণে তাদের তদন্তের স্বার্থে তিলোর সাথে কথা বলতেই হবে।
তিলো একটা ঘোরের মাঝে ছিলো। এরপরও আধো আধো যতটুকু পেরেছে উত্তর দিয়েছে। আবার ওর অবস্থা দেখে আর ওর উত্তরের ধরণে অফিসারও খুব বেশি প্রশ্ন করেননি। ওনারা তাড়াতাড়িই বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছেন। অরিককে বলে গিয়েছেন, তিলো স্বাভাবিক হলে ওকে একবার থানায় নিয়ে যেতে।

ওনারা চলে যেতেই তিলো কান্নায় ভেঙে পড়লো আগেরবারের ন্যায়। ওর খেয়াল নেই আসলে ও এখন কোথায় আছে। অরিকের টিশার্ট খামচে ধরে ওর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। আকবর সাহেব আর অভ্র আগেই চলে গিয়েছে এখান থেকে। ফাহমিদা বেগম একবার ওর দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

সাইদুর এহসান খুব চেষ্টা করছেন রিয়ার যাতে পোস্ট মর্টেম না হয়। নিজের মেয়েটাকে আর কষ্ট দিতে চাননা ওনি। থেতলিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া শরীরটাকে আর কাটাছেঁড়া করতে দিতে চাননা। মুখের একটা পাশ পাবলো পিকাসোর অঙ্কিত ছবির ন্যায় হয়ে আছে। সরকারি হসপিটালে ওনাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হলো রিয়ার পোস্ট মর্টেম বন্ধ করে লাশটা বাড়িতে নিয়ে আসতে।
রাফিদা এহসান শেষরাতে মেয়েটাকে নিজের চোখের সামনে পড়ে যেতে দেখার পর থেকেই একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। নড়াচড়াও বন্ধ করে দিয়েছেন যেন। হয়তো পারলে শ্বাস নেওয়াটাও বন্ধ করে দিতেন হয়তো। আফসোস হচ্ছে, কেন তিনি একটু সতর্ক ছিলেননা যখন আগেও একবার তাঁর মেয়ে একই কাজ করতে গিয়েছিলো। আহানের মৃত্যুর পর রিয়া এবাড়িতে আসার পর থেকেই ওনি রিয়ার সাথে সাথেই থাকতেন। রিয়ার ধীরে ধীরে মানসিক অবনতি ঘটছিলো, সেটা সকলেই বুঝতে পারছিলো যারা ওর আশেপাশে থাকতো সবসময়। রাতে ওর পাশেই ঘুমাতেন রাফিদা এহসান। গতরাতেও ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে ওনি রিয়াকে নিজের পাশে দেখতে না পেয়ে রুমের দরজা খোলা দেখতে পান। রুম থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখে দ্রুত সাইদুর এহসানকে ডাকেন। দুজনে মিলে এরপর খোঁজাখুঁজি শুরু করে ছাদে গিয়ে একদম ছাদের ইটের রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। কি অবস্থা মেয়েটার! কয়েক মাস আগের রিয়া আর এখনের রিয়ার মাঝে আকাশপাতাল পার্থক্য। আগের মতো যৌবনের জৌলুশ সে কবেই হারিয়ে গিয়েছে চেহারা থেকে। ফ্যাকাসে চেহারার একটা অর্ধমৃত লাশের মতো তার উপস্থিতি ছিলো। এখন তো সেটাও নেই।

রিয়া তিলোর সাথে কথা বলেছিলো এখানে দাঁড়িয়েই। ফোনটা কাটার পর কয়েকবার মনে হয়েছে ওর বেঁচে থাকা উচিত ওর ভেতর বড় হতে থাকা আহানের শেষ স্মৃতির জন্য অন্তত। পরক্ষণে আবার মনে হয়েছে, এটা ওকে ঠকানো হবে। রিয়া দুচোখের পাতা ফেলে চোখে জমে থাকা পানি গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়তে দিলো। উদরে হাত মেলে রেখে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানের উদ্দেশ্যে তার শেষ বার্তা প্রেরণ করলো স্নেহভেজা মমতায় সিক্ত কন্ঠে,
-আ’ম সরি সোনা। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। আর তোমার বাবাকেও। তোমার তো অনেক দ্বায়িত্ব ছিলো আমাদের জীবনে আসা নিয়ে। তুমি পারতে তোমাকে যেমন আমরা তোমার বাবা মাকে উপহার দিতাম সেভাবে আমাদের ফেলে দেওয়া উপহারগুলো কুড়িয়ে দিতে। কিন্তু দেখো, তোমার আসার আগেই তোমার দ্বায়িত্ব শেষ। এখন সবাই আমাদের মেনে নিয়েছে কিন্তু তোমার বাবাই নেই। আ’ম সরি। আমি কখনো তোমাকে তোমার বাবাকে এনে দিতে পারবোনা তুমি চাইলেই। তোমাকে আমি তোমার ভালো একটা মা এনে দিতে পারবোনা তুমি চাইলেই। সমাজ তোমাকে অনেক কথা শোনাবে। জানো তো, তোমার মা খুব স্বার্থপর। খুব বেশি। তোমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আর তোমাকেও ছেড়ে কি করে থাকবে? তার থেকে চলো, আমরা তিনজন একসাথে থাকবো। সেটা সবচেয়ে ভালো হবে। আমরা সবসময় একসাথে থাকবো। সবসময়। কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। উই উইল বি টুগ্যাদার ফর ইটার্নিটি। তোর স্বার্থপর মাকে ক্ষমা করে দিস। আমার পক্ষে শ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আমি আর পারছিনা।

রিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো কথাগুলো বলতে বলতে। আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে ভোরটা দেখার অপেক্ষায় ছিলো। জীবনের শেষ ভোর। কিন্তু সেটা আর তার ভাগ্যে জুটলো না। রাফিদা এহসান এবং সাইদুর এহসান ছাদে এসে ওকে রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, রাফিদা এহসান চিৎকার করে ওঠেন। সাইদুর এহসানের এই মূহুর্তে একটা বোকা মহিলাকে বিয়ে করার জন্য আফসোস হচ্ছে। সারাজীবন ভেবেছিলেন ঘরের বউ বোকা হলে স্বামীদের সংসারের আয়ত্ত নিজের হাতে রাখতে সুবিধা হয়। কিন্তু ওনার চিৎকারে রিয়ার সতর্ক হয়ে যাওয়ায় সাইদুর এহসানকে খুব দ্রুত মেয়েকে এই ভুল করা থেকে ফিরিয়ে আনতে ভাবতে হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওঠার সময় রিয়াকে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছিলেন পেছন থেকে ওকে টেনে নামাতে পারবেন। তবে সেটা আর এখন সম্ভব না। সাইদুর এহসান ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিয়াকে নেমে আসতে বললেন। রিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে সেটা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। রাফিদা এহসান কেঁদে দিয়ে ওকে নামতে বললেন। কাজ হলোনা। সাইদুর এহসান এগিয়ে আসতে গেলেই রিয়া ওনাকে সাবধান করলো যাতে এগিয়ে না আসে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে একটা ছোটখাটো নাটক উপস্থাপন হলো সেখানে, যেখানে অভিনেতা অভিনেত্রী বিনা দর্শক আর কেউ ছিলোনা। অবশেষে রিয়া সামনে পা বাড়াতে যেতেই সাইদুর এহসান চিৎকার করে বলে ওঠেন,
-আর একটুও নড়লে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে।

রিয়া মৃদু হেসে বললো,
-বোকা বাবা! আমি থাকলে তো দেখবো। ক্ষমা করে দিও তোমার এই স্বার্থপর মেয়েটাকে।

কথাটা শেষ করতে করতেই রিয়া সামনে পা বাড়িয়ে দিলো। সেখানে মাটি প্রায় আরো একশো ফুট নিচে। স্বাভাবিকভাবেই সে মাটিতে পড়েছে। সাইদুর এহসান রিয়ার নাম ধরে চিৎকার করে এগিয়ে এসে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালেন। রিয়ার নিথর দেহের নিচে থেকে মাটিতে রক্তের ধারা বয়ে চলেছে। রাফিদা এহসান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এরপর। আর যখন জ্ঞান ফেরে তখন থেকেই একদম নির্বাক একটা মূর্তি হয়ে বসে আছেন। চোখের মণিটা পর্যন্ত নড়ছে না যেন।
রিয়ার খবর পেয়ে ওর বড়ভাই রিয়াজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। একমাত্র ছোটবোনকে হারিয়ে তার অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। বাবার সাথে থেকে ক্লান্তি দূরে ঠেলে রিয়ার দাফন কাজে লেগে পড়েছে।
তিলো কয়েকবার অরিকের কাছে আবদার করেছে ওকে রিয়াদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। অরিক শোনেনি। ও একা আসতে চাইলেও বাঁধা দিয়েছে। তিলোর মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো নেই। এরপরের ঘটনাগুলো ওর প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা কতোটুকু সে সম্পর্কে অরিকের বেশ ভালোই ধারণা হয়ে গিয়েছে।

রিয়ার মৃত্যু পরবর্তী দিনগুলো আবারও অনেকটা কঠিন হয়ে উঠেছিলো। তবে এবার অরিক নিজ দ্বায়িত্বে খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। অদ্ভুতভাবে ফাহমিদা বেগম অরিকের ফ্ল্যাটে ওদের সাথেই কয়েকমাস যাবৎ থেকেছেন আর তিলোকে সঙ্গ দিয়েছেন। বিষয়টায় অরিক অবাক হলেও তিলোর অবাক হওয়ার ক্ষমতা ছিলোনা। এটা ছিলো ওদের জন্য একটা চমকপ্রদ ব্যাপার। ফাহমিদা বেগমের সাথে তিলোর সম্পর্ক খুব ভালো না হলেও যথেষ্ট স্বাভাবিক। মেনে নিতে হয়েছে বলে মেনেছেন থেকে একটু উন্নত হয়েছে।

সময় চিরবহমান। পাশাপাশি মানিয়ে নেওয়ার একজন ভালো প্রশিক্ষকও বটে। কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। খারাপ দিনগুলোও। আবার ভালো দিনগুলোও একইসাথে। এই ভালো খারাপের মিশেলেই আমাদের জীবনটা। খারাপ সময়টুকু আসে বলেই ভালো সময়ের মর্যাদা আছে।
তুলি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি নিজের ছেলেরও খেয়াল রাখছে। কাজটা কঠিন বলে নাসীরা পারভীন ইশানের খেয়াল রাখেন অধিকাংশ সময়। আনিস সাহেব তুলিকে বলেছেন, আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যেমনটা তিলোকে বলতেন যদিনা হালিম সাহেব তিলোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির না হতেন। তুষারের এসএসসির রেজাল্ট সন্তোষজনক। সে এখন কলেজে উঠেছে।

মীরার পরিবার, তার গোপন প্রেমিক সম্পর্কে এখন জানে। ছেলেটা আসলে বিদেশে থাকে বিধায় মীরা নিরবে নিভৃতে প্রেম চালিয়ে যেতে পেরেছে। দেখা করার ঝামেলায় পড়ে কারো হাতে কখনো ধরা পড়ে যায়নি। ছেলেটা ফিনল্যান্ডে পড়াশোনা করছে। পরিবার ভালো দেখে মীরার বাবা-মা বাঁধা দেয়নি। মেয়ে খারাপ, বখে যাওয়া কোনো ছেলে পছন্দ করেনি। মীরার বাবা ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছেন। তার পরিবারের সাথেও কথা বলেছেন। তাদেরও মীরাকে পছন্দ হওয়ায় ছেলেটার শেষ পরীক্ষাটার অপেক্ষায় আছে তারা। পরীক্ষা শেষে দেশে ফিরলেই খুব তাড়াতাড়িই তাদের চারহাত এক করে দেবে।

রিতার অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেলো। ভালো একজন ব্যবসায়ীর সাথে রিতার ছেলেরা এবং নাতিনাতনিরা খুব ধুমধামের সাথে তার বিয়ে দিয়েছে। গ্রামে বিয়ের আয়োজনে প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলো। অরিক আর তিলোও গিয়েছিলো সেই অজপাড়াগাঁ গ্রামটিতে। কিন্তু সেখানে নবাবি হালে ছিলো শহর থেকে যাওয়া প্রত্যেক অতিথি। রিতার বন্ধু হিসাবে আলাদা আপ্যায়নের দাবিদার ছিলো তারা।

অনিকেত অস্ট্রেলিয়ায় এক শ্বেত সুন্দরীর সাথে প্রায়ই ছবি তুলে ফিডে দেয়। ওর বন্ধুদের লাইকের পাশাপাশি কমেন্টে ওকে ওরা জ্বালিয়ে খায়। অনিকেত ওদের প্রশ্নের উত্তরও দেয়। মাঝে মাঝেই ফ্রেন্ডলিস্টটা চেক করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখনো আহান আর রিয়ার যৌথভাবে পরিচালনা করা আইডিটা রয়েছে। আইডিটা কেউ ডিঅ্যাক্টিভেট করেনি৷ শুধু সেই আইডিটা দিয়ে এখন কিছু পোস্ট হয়না। কোনো ট্যাগ হয়না। কোনো রিঅ্যাক্ট পড়ে না। কোনো কমেন্ট আসে না। কেউ আলাদা করে নক করেও রাতে জ্বালায়না। ওদের দুজনের কাপল পিক আপলোড দিয়ে প্রেমময় কোনো ক্যাপশন থাকে না। রাত দুইটা তিনটার সময় তারা ব্রিজের হলুদ বাতির নিচে মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে কোনো ছবিই তো আসলে তোলে না। কোথাও ঘুরতে গিয়ে ভিডিও করে না। খাওয়ার ভিডিও পোস্ট করে ওদের লালা গ্রান্ডও ক্ষেপিয়ে তোলে না। মাঝে মাঝেই অনেকে ওদের পুরানো পোস্টগুলো বারবার দেখে। ওদের হাসিখুশি জুটিটা ওদের সকলের মনেই একবার হলেও উচ্চারণ করতে বাধ্য করেছিলো, ‘পার্ফেক্ট কাপল’, পাশাপাশি একটা আকাঙ্ক্ষা নিজেদের জীবনেও সেরকম একজনকে পাওয়ার, যেমনটা তিলোর মরুভূমি হৃদয়ে একবার মনে হয়েছিলো ওদের বিয়েরদিন ওদের দেখে। সবই এখন স্মৃতি।

ফিরোজ পড়াশোনাটাই মন দিয়ে করছে। তাকে তার বাবার একমাত্র ছেলে হিসাবে ব্যবসাটা সামলাতে হবে। খুব বড় দ্বায়িত্ব তার। ব্যবসাটা ওর দাদুর ছিলো। ফুফুর অংশটুকু সে ভাগ করে নিয়ে বেঁচে দিতে চাইলে ওর বাবাই সেটুকু কিনে নিয়েছেন। পুরোটা সামলাতে নিজেকেও যোগ্য প্রমাণ করার একটা তাগিদ সে অনুভব করছে। পাশাপাশি কেউ একজন তার জীবনে এসেও আসছে না। মেয়েটাকে সে ডাক্তারের চেম্বারে দেখেছিলো নিজের যখন জ্বর এসেছিলো তখন৷ এরপর খোঁজ নিয়েও খুঁজে পায়নি৷ তবে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।

তৌকির রয়েছে নিজের মতো। সারাদিন মেয়েদের সাথে ফ্লাট করেই দিন কাটছে। কিন্তু পাকাপোক্তভাবে কারো প্রতি ওর মন টিকছে না। একজনকে একদিন একটা দশ টাকার নেতিয়ে পড়া গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করে তো দুদিন কথা বলে তাকে আর ভালো লাগে না। সবার মাঝেই কোনো না কোনো বিষয় তৌকিরের অপছন্দের। বিশেষ করে ও যাদেরকে প্রপোজ করে, তাদের দুদিন পর ন্যাকা কথাগুলো। ফিরোজ ওকে বলেছে, ভালো মেয়ে দেখে প্রপোজ করতে৷ ও তো করেও সেই ধরনের মেয়েদের সাথে যারা আহ্লাদে গদগদ হয়ে পড়ে। আসলে সেরকম না করলেও তো ওর নেতিয়ে পড়া ফুলগুলোতে কারাই বা রাজি হবে?

তিলো আর অরিকের মাঝে একদিন ভীষণ ঝগড়া লেগেছে। তিলো তো থাকবেই না অরিকের সাথে আর। নাসীরা পারভীন তিলোর পক্ষ নিয়ে অরিককে ইচ্ছামতো ঝেড়ে গিয়েছেন। নিজের রাগ সবটা ঝেড়ে গিয়েছেন। তিলো হঠাৎই রেজা সাহেবের কথা তুললো। সেটা তুলে নিজেও বুঝতে পারলো, আসলে ও গতানুগতিক একটা চাল চেলেছে ঝগড়ার সময়, যেটা নিয়ে লড়লে নিশ্চিত হার। অরিক হেসে দিয়ে জানালো যে, শামীম রেজা সাহেব একজন ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছেন। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই সুখী সুখী বাচ্চাদের জন্ম হতে চলেছে তাদের সংসারে।

অনি তিলোর সাথে একদমই সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিলো অরিকের সাথে ওর বিয়ের আগেই। তবে কিছুদিন আগে ফোন করে কান্নাকাটি জুড়ে বসলো। সে বুঝতে পেরেছে, আসলে অরিক ওর সাময়িক মোহ ছিলো। বুঝতে পারার কারণ হলো ওর বর্তমানে নতুন করে কারো প্রেমে বুদ হয়ে ওঠা। তিলোকে তার ছবিও পাঠিয়েছে। তিলোর কেন যেন, ছেলেটাকে একদম পছন্দ হয়নি। তিলো ওকে সেটা বললে ও বলেছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি তিলো? তিলো হতাশ হয়ে ওকে আর কিছু বললো না। মেয়েটা উল্টো বোঝে কেন সব? অনি ছেলেটা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেও না। কিন্তু সে প্রেমে মাতাল। তিলোর ভয় হচ্ছে, আবারও অন্তরের মতো না ও কোনো ভুল করে বসে।

সানজিদ এবং রোৎশীর মাঝেমধ্যেই কথা হয়। রোৎশী প্রায়ই এখন অরিকের বাড়িতে বেড়াতে আসে। রোৎশীর মা, মেয়ের হঠাৎই অন্তর্মূখী স্বভাব ত্যাগ করে বহির্মূখী হয়ে ওঠার রহস্য আন্দাজ করতে পারলেও নিশ্চিত হতে পারছেন না। আগে রোৎশীকে টেনে নিয়েও বাড়ির বাইরে বের করা কষ্টকর ছিলো। এখন প্রায়ই সে অরিকের ফ্ল্যাটেই ঘুরতে আসে। রাকিব একদিন সরাসরি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো। রোৎশী নিজেকে বাঁচিয়ে বলেছে, তিলোর সাথে সময় কাটাতে ওর খুব ভালো লাগে বিধায় আসে এখানে।

#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৪৩,,

বেশ কিছুদিন যাবৎ অরিক নিজে তদারকি করে তিলোকে পড়িয়েছে। চেষ্টা করেছে কোনোভাবে ওকে স্কলারশিপ পাওয়ানোর জন্য। তিলো পড়েছে ঠিকই। কিন্তু এই নিয়ে অরিকের উপর বেজায় অখুশি। একদিকে এই ভার্সিটিতে পড়ো আরেকদিকে স্কলারশিপের জন্য পড়ো।
প্রায় নয়মাস পর অরিক ওকে নিয়ে ইউএসএ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। অরিক সেখানে ইউনিভার্সিটি অব পেন্সিলভেনিয়াতে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। যাওয়ার আগে এখানকার সেই ভাড়া ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দেবে। বলে দিয়েছে বাড়ির মালিককে। সানজিদের বেশ খারাপ লেগেছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

ওদের যাওয়ার আগেরদিন অরিকের কাজিনেরা একসাথে আবারও সানজিদদের বাড়ির ছাদে আড্ডা বসিয়েছে। তিলোর যেতে মন চাইছে না। আবার অরিককে একাও সে ছাড়তে নারাজ। অগত্যা সে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ওদের অগোচরেই রোৎশী আলাদা গিয়ে ছাদের আলোর বাইরের সীমানায় দাঁড়িয়েছে। সানজিদও ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করলো কিছুক্ষণ পর।

-আপনার কি মন খারাপ?

রোৎশী পেছনে দাঁড়িয়ে সানজিদ মৃদুস্বরে বললো। রোৎশী একবার ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। সানজিদ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলো। রোৎশী ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-তা জেনে আপনার কোনো কাজ আছে?

সানজিদ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-না আসলে। কিন্তু ওখান থেকে কিছু না বলেই চলে আসলেন যে।

-আপনি কেন আসলেন?

-এমনিই।

রোৎশী কোনো প্রত্যুত্তর না দেওয়ায় আবারও দুজনের মাঝে নিরবতা স্হান করে নিলো। রোৎশী চাইছে সানজিদ কিছু বলুক। বিশেষ করে কোনো কথা বলুক ওর সাথে। ওর বহু প্রতীক্ষিত কথাগুলো আজ ওকে বলুক। এতোগুলো দিনেও কি ওর প্রতি একবিন্দু মায়া জন্মেনি তার? আজকের পর এই বাড়িতেও তো আসার কোনো অযুহাত ওর থাকবে না। অযুহাত দেখিয়ে অন্তত দেখা করা যেতো। এরপর আর কি বলবে? হঠাৎ করে চাইলেই পারবে না। সানজিদ কিছু বলতে চেয়েও কোথাও বাঁধা পাচ্ছে। সোহা এখনও ওর সাথে জড়িয়ে আছে। চাইলেও হুট করে আর কাউকে কিছু বলা যায় না।
পাশাপাশি দাঁড়ানো দুজন। কিন্তু এরপরও নিজেদের মধ্যে যেন অনেক বেশি দূরত্ব। নিজেদের জড়তা আর সংকোচবোধ দুজনের চারপাশেই দেওয়াল তুলে রেখেছে। একজন অপরজনের থেকে যেন বহুদূরে।

সংকোচ ভেঙে সানজিদ বললো,
-তিল ভাবি আর আপনি একই বয়সী না?

-হুম।

সানজিদ নিজের মাঝে আটকে রাখা কথাগুলোকে কোনোমতে সাজিয়ে নিয়ে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলো,
-তা বিয়ে শাদির কোনো পরিকল্পনা নেই? না মানে, ভাবির তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। আপনার নেই?

রোৎশী একবার সানজিদের দিকে তাকালো। সানজিদ সে দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। রোৎশী নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
-ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়না কখনো আমাকে।

সানজিদ হয়তো মনে মনে হাসতে সক্ষম হয়েছে। তবে সেটা সামনে একদমই প্রকাশ করলোনা। কেবল প্রশ্ন জুড়লো কথার পিঠে,
-কেন?

রোৎশী তাচ্ছিল্যভরে হেসে বললো,
-এই স্থুলকায় জলহস্তির মতো দেহ দেখে। তারা তো তাদের বাড়িতে বউ নিতে চায়। হাতি নয়।

সানজিদ এবার আর নিজের হাসিটা দমিয়ে রাখলো না। গালের সামনে হাত দিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। অন্ধকারে দেখা না গেলেও রোৎশী বেশ ভালোই বুঝতে পারছে সেটা। ও বিরক্ত হয়ে উল্টো ঘুরে বড় বড় পা ফেলে ফিরে গেলো ওদের আসরে।

পরদিন যাওয়ার সময় তিলো বেশ কেঁদেছে। বিশেষ করে নাসীরা পারভীন ওর সামনে আসতেই ও অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নাসীরা পারভীন অরিকের সাথে রাগ করে কথা বলেননি। অরিক ওদের আবেগ দেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। বিয়ের সময় একবার দেখেছে, আজ আবার দেখলো। ফাহমিদা বেগমও কেঁদেছেন। অরিক হতাশ চোখে কেবল ওদের কাজ দেখেছে।

ওরা চলে যাওয়ার পর যে যার বাড়িতে ফিরে চললো দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। রোৎশীর মনটা একটু বেশিই খারাপ। ওর সাথে রাকিব এসেছিলো। এখন রাকিবের সাথে বাসে করে ফেরত যাচ্ছে নিজেদের ছোট্ট শহরে।

রেস্টরন্ট এ সামনাসামনি বসে আছে সোহা এবং সানজিদ। সানজিদ ওকে জরুরি কথা আছে বলে দেখা করতে বলেছিলো। এখানে পৌঁছানোর পর থেকে চুপচাপ বসে আছে সানজিদ। সোহা নিজে কথা বলেও ওর মুখ থেকে কথা বের করতে পারছে না। শেষে সোহা বিরক্ত হয়ে উঠতে নিতেই সানজিদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-সোহা, আমার কথাটা তো শুনবে।

সোহা সানজিদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-সেটা তো তখন থেকে আমিও জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি। তুমি কোনো কথা বলছো আদৌও?

-আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি। একটু সময় দাও।

সোহা ধপ করে চেয়ারটায় বসে বললো,
-আর কতক্ষণ? অনন্তকাল এখানে বসে থাকতে পারবোনা আমি।

সানজিদ একবার চোখ বুজে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললো,
-আসলে সোহা…আসলে…

সোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-আসলে কী?

-আসলে আমার মনে হয়, আমাদের এখানে থেমে যাওয়া উচিত। মানে, সম্পর্কটা আমি আর এগিয়ে নিতে চাচ্ছি না। আমাদের অনেক কিছু মেলে না। দেখো, আমার মা নেই। তোমার মা আছে। তোমার বাবা সরকারি চাকরি করে। আমার বাবা ব্যবসা করে। তুমি ফর্সা। আমি শ্যামলা। তুমি …

সানজিদ আর কিছু বলার আগে সোহা অতিষ্ঠ হয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-ওয়েএএট। কি বলছো এসব তুমি?

সানজিদ একবার সোহার দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে বললো,
-আসলে এতো অমিল নিয়ে তো আর সংসার করা যায়না। তাই এখন থেকে তুমি তোমার মতো, আমি আমার মতো।

সোহা টেবিলের উপর জোরে নিজের হাতের তালু দিয়ে শব্দ করে বললো,
-তুমি আমার সাথে মজা করছো? লিসেন সানজিদ, এতোক্ষণ চুপ করে থেকে, আমাকে বসিয়ে রেখে মেজাজটা এমনিতে গরম করে দিয়েছো। এখন এইসমস্ত ফালতু অযুহাত টেনে আনছো!

-সোজা কথায়, ব্রেক আপ।

-মানেহ? দুবছর প্রেম করে, এখন কোথায় বিয়ে করবো আমরা। আর তুমি বলছো ব্রেক আপ!! একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাও আমাকে যে, কেন তুমি সম্পর্কটা নষ্ট করতে চাইছো? আমি কি যত্নশীল নই এই সম্পর্কের প্রতি বা তোমার প্রতি? সহানুভূতিশীল? সুবিবেচক? তোমাকে ফালতু কথা বলে বিরক্ত করি? আমি দেখতে খারাপ? আমি কি ঘরের কাজ পারি না? আমি কি পড়াশোনা জানি না? আমার কি অতিরিক্ত চাহিদা? আমি কি তোমাকে প্রতারণা করেছি? আমার বাবার কি যথেষ্ট নেই? সানজিদ, কোনটা আমাকে বলো? কি কারণে তুমি আমাদের ভেতরকার সবকিছু হঠাৎ করে অস্বীকার করছো? বলো আমাকে। আমার ভেতর কিসের কমতি আছে?

সানজিদ আরেকবার সোহার দিকে তাকালো। আসলে সোহার কোনোকিছুরই কমতি নেই। সে প্রেমিকা হিসাবে তেমনই যেমনটা একজন পুরুষ চেয়ে থাকে। কোনো অল্প বয়স্ক ছেলে নয়। বরং একজন বিবেকবান, সুবিবেচক পুরুষ যেমনটা চায়। সোহার কোনো অতিরিক্ত চাহিদা বা ন্যাকামি নেই। সে পড়াশোনায় ভালো। ঘরকন্না ভালোই শিখেছে। দেখতেও একটা গতানুগতিক মেয়ের থেকে সুন্দরী। তার ভেতর যেসকল গুণাবলী রয়েছে, সেটা একটা সংসার টিকিয়ে রাখতেও যথেষ্ট। কিন্তু তারপরও। সোহার প্রতি সানজিদ এতোদিন যেটা অনুভব করতো, সেটার নাম সানজিদ এখন দিতে পারে। এটা কেবলই আকর্ষণ। সেই বেপরোয়া শব্দটার অনুভূতি সে আসলে অনুভব করেনি কখনো যেটা রোৎশীর প্রতি সে করেছে। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা স্থূল দেহের মেয়েটার মুখ বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যেমনভাবে কখনো সোহাকে সে অনুভব করেনি। কোনোপ্রকার সতর্কতামূলক সংকেত সে পায়নি রোৎশীকে মনের কুঠুরিতে জায়গা করে দিতে। আপনাআপনি মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি মিস্ত্রি হয়ে গড়ে নিয়েছে নিজের ইমারত সানজিদের মনে। সানজিদ কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও ছিলো তার এবং রোৎশীর মধ্যেকার নিগূঢ়তম সম্পর্কটা সম্পর্কে একদমই অসচেতন এবং অবিবেচক। শুধু অনুভব করেছে কোনো এক স্পর্শরৈখিক উপায়ে তার সাথে সে জুড়ে গিয়েছে। রোৎশীর বিদায়টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখার সময় যখন তার বুকের ভেতর হঠাৎই কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা ভর করছিলো, হঠাৎই মনে হচ্ছিলো ফাঁকা ফাঁকা তার চারপাশ, হঠাৎই অসহায় লাগছিলো নিজেকে, হঠাৎই বুকের ভেতরটা বারবার মুচড়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তার কাছে তার এবং মেয়েটির সম্পর্কটা প্রোজ্জ্বলতা লাভ করতে শুরু করেছিলো তখনই।
সোহার প্রতি তার ছিলো দূর্দমনীয় একটা আকর্ষণ, যেটা একসময় কেটে যাওয়ার ছিলো।

সানজিদ নিজের ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে সোহার চোখে চোখ রেখে ওর মেহেদী রাঙা হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে কাতর কন্ঠে বললো,
-তোমার ভেতর কোনো কমতি নেই সোহা। আর তাই তুমি আমার থেকে আরো ভালো ছেলে তোমার জীবনে প্রত্যাশা করো। কমতি আমার আছে। আমার মাঝে তোমার জন্য ভালোবাসার কমতি রয়েছে। তোমাকে আমি পরিপূর্ণ করতে পারবোনা। এখন যদি আমাদের সম্পর্কটা টিকেও থাকে, সেটা হবে কেবলই একটা বোঝা। অনেকটা গলায় বেঁধে থাকা কিছু, যেটা ফেলে দেওয়াও যায়না আবার গিলে ফেলাও যায়না। পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে। আমি আশা করি, তুমি নিশ্চয়ই এমন কাউকে জীবনে পাবে যে সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসবে আর ভালো রাখবে। ভালো থেকো।

সোহার অনাড়ম্বর সাধারণ সুন্দর চেহারাটা ইতিমধ্যে বিষাদের কালো মেঘে ছেঁয়ে গিয়েছে। যেন কোনো শিল্পী সুন্দর মুখশ্রীর ছবি আঁকতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছে।
সোহার অভ্যাস নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি রাখা। সবসময়ই তার হাতজোড়া রাঙিয়ে দখল করে থাকে মেহেদী। মেয়েটা আঁকেও ভীষণ সুন্দর। সোহার মুখের দিকে তাকিয়ে সানজিদের খারাপ লাগছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কারো মন সে এভাবে ভেঙে দিলো! কিন্তু তাছাড়া করার কিছু নেই। সোহার সাথে এরপরও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা ওর প্রতারণা করা হবে। সানজিদ ওর অঙ্কনে পরিপূর্ণ হাত জোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে শুরু করলো সামনে। পেছনে তাকালো না। ওর পক্ষে সম্ভব না পেছনে তাকিয়ে সোহাকে আরেকবার দেখা। সোহা কেঁদে দিয়ে ভগ্ন কন্ঠে পেছন থেকে বলে চলেছে,
-আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি সানজিদ। তোমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে। আমাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করলে না? কেন ঠকালে আমাকে?

সানজিদ দাঁড়ায়নি আর। সোহা মাটিতে ধপ করে বসে নিজের হাতজোড়া বুকে ধরে কেঁদে চলেছে।

আজ ঘোর অমানিশা। আকাশটা পুরো কয়লার ন্যায় কালো। চাঁদের নূন্যতম ফালি কেটেও লাগানো হয়নি। সোহার ভেতরকার অন্ধকারটুকুকেই উৎসর্গ করতে হয়তো আকাশটাও প্রকৃতির উপর রাগ করে চাঁদটা ঢেকে ফেলেছে।
সানজিদ সন্ধ্যায় রেস্টরন্ট থেকে বেরিয়ে পার্কিং এরিয়ায় এসে নিজের মোটরসাইকেলটার উপর বসে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। ‘রোদ’ নামে সেভ করা নম্বরটায় ছোট্ট একটা টেক্সট লিখে সেন্ড করে দিলো।
‘তুমি কি আমার সকালবেলা হাঁটতে যাওয়ার সঙ্গী হবে?’

সানজিদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো উত্তরের। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। সানজিদ তৎক্ষনাৎ হিসাব কষে নিলো, কতক্ষণ হয়েছে রোৎশীর ভ্রমণ করা বাসটা ছেড়েছে। বেশিক্ষণ হয়নি। সানজিদ তখনই রওনা দিলো সেই বাসটার নাগাল পাওয়ার উদ্দেশ্যে।

রোৎশী হাতে থাকা ফোনটার কম্পনে প্রথমে কোনো আগ্রহবোধ না করলেও কয়েক মূহুর্তের চিন্তায় সে নিজের ভেতর তীব্র সুপ্ত অদমনীয় কৌতুহল বোধ করলো। ফোনের স্ক্রিন আনলক করে সানজিদের পাঠানো টেক্সটটা পড়ার আগের প্রেরকের নামটা দেখেই শরীরের মাঝে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো তার। সে চাপা উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু সে নিজের সর্বোচ্চ ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে দমিয়ে রেখে দিলো। ব্যস্ত ভঙ্গিমায় সে টেক্সটটা পড়তেই পারছে না ঠিকমতো। তার কেবল মনে হচ্ছে, যাই লেখা থাকুক, টেক্সটটা তার পাঠানো। যেকোনো কথা শুনতে বা জানতে সে প্রস্তুত। প্রথমবার অরিকের বাসায় এসেই সে সানজিদের ফোন নম্বরটা সেভ করে রেখেছিলো। কিন্তু কখনো ডায়াল করা হয়নি আর না সেই নম্বর থেকে কখনো ডায়াল করা হয়েছে। প্রথমবার টেক্সটায় সে পুলকিত।
রোৎশী কম্পিত হস্তে ম্যাসেজটা খুললো। লাইনটা পড়ে একবারে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। পাশে তাকিয়ে রাকিবকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু তার মাথায়ও আসলোনা, ম্যাসেজটার কোনো উত্তর কেউ প্রত্যাশা করতে পারে। সে নিজের ঘোর কাটিয়েই বের হতে ব্যর্থ। বোকা একটা ধারণা, যে সে এমনিতেই বুঝতে পারবে, রোৎশীর মস্তিষ্কে নাড়া দিলো। সে আর উত্তর দিলো না টেক্সটটার।

সানজিদ অনেক খুঁজে অবশেষে সেই বাসটার সন্ধান পেয়েছে। দুপাশেই খোঁজ করে একটা সীটের জানালার পাশে চোখ বুজে সীটে হেলান দিয়ে রোৎশীকে শুয়ে থাকতে দেখে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো। সে নিজেও জানে না কেন সে এটা করলো। কিন্তু করে ফেললো। তাকে এখন তার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করছে। সে নিজেকে নয়।
সানজিদ মোটরসাইকেলটা বাসটার ওভারটেক করে সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো বাসটাকে।

হঠাৎ বাসটা থেমে গিয়ে জড়তার দরুন যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় অনেকেরই ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তাদের মধ্যে রোৎশী এবং রাকিবও রয়েছে। বাসের কন্ডাকটর নেমে এসে বেশ চড়া গলায় বললো,
-এটা লোকাল বাস না। এভাবে হুটহাট করে থামানো যায়না, জানেন না?
আরো বেশ কিছু কথা।
সানজিদ সেসবে পাত্তা না দিয়ে বাসটার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-আমার জিনিস যে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি থামাবো না তা? অদ্ভুত মানুষ!

সানজিদ বাসে উঠে রোৎশীর সীটের দিকে এগিয়ে চললো।
রোৎশীর ওর উপর চোখ পড়তেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো যেন। সে খুব ভালো করেই সানজিদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে। বা সে যেটা ধারণা করছে, সেটা না হয়ে থাকলেও রাকিব এখানে উপস্থিত আর সে খুব ভালো করেই সানজিদকে চেনে। রোৎশী নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে স্থাপন করলো নিজের দৃষ্টি। যেন সেই হরিণের মতো, যাকে বাঘে তাড়া করায় সে গাছের আড়ালে নিজের মুখ লুকিয়ে মনে করে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই বোকা হরিণ এটা বোঝে না যে, তার সম্পূর্ণ শরীর দৃশ্যমান। সে বাঘকে দেখতে পাচ্ছে না মানে যে বাঘও তাকে দেখতে পাচ্ছে না, সেটা নয়।
রোৎশীর মনে হচ্ছে, নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সে যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতো বা হুট করে কোনো স্থানে টেলিপোর্ট হয়ে এই বাস থেকে হারিয়ে যেতে পারতো!

সানজিদ ওর সীটের সামনে এসে দাঁড়ালে রাকিব বলে উঠলো,
-তুমি হঠাৎ এখানে! কোথাও যাবে?

সানজিদ রোৎশীর দিকে একপলক তাকালো। তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
-হ্যাঁ। আমার শ্বশুরবাড়ি যাবো।

রাকিব ওর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে কিছু বলার আগেই সানজিদ বললো,
-রোদ, আমার টেক্সটের জবাব দিলে না কেন?

‘রোদ’ নামটা, পাশাপাশি টেক্সটটার মতোই ‘তুমি’ সম্বোধন শুনে রোৎশী কেঁপে উঠলো। আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছে একবার সানজিদের দিকে তাকাতে। কিন্তু রাকিবের কথা চিন্তা করে তাকালো না।
সানজিদ আবারও বললো,
-রোদ, আমি তোমাকে বলছি।

রোৎশী এবার ওর দিকে তাকিয়ে অবাক ভঙ্গিমায় নিজের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
-আ…আ…আমাকে? কিন্তু এখানে রোদ কে?

সানজিদ চোখ বুজে মাথা নাড়িয়ে আবারও চোখ মেলে বললো,
-হ্যাঁ, তোমাকে। আমি তোমাকে টেক্সট করেছিলাম যার জবাব পাইনি।

রোৎশীর এখন নিজেকেই মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে। জবাবটা দিলে কি হতো ওর? অন্তত সানজিদ এখানে আসতো না। রোৎশী তো ভাবতেই পারেনি, সানজিদ এতোটা বেপরোয়া। সানজিদ নামের শান্ত শিষ্ট ভদ্র একটা ছেলেকেই ও কেবল চিনতো।

রাকিব হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে সানজিদের শার্টের কলার ধরে বললো,
-তোর সাহস তো কম না, আমার সামনে আমার বোনকে তোর টেক্সটের কথা বলিস!

আর কিছু বলার আগে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। বাস ভর্তি লোকজন। এখানে কোনো দর্শনীয় দৃশ্যের উপস্থাপন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। রোৎশী উঠে দাঁড়িয়ে রাকিবকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে।

সানজিদ নিজের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-সাহস আছে বলেই সবার সামনে এসে বললাম। আমার মাঝে কোনো খাদ নেই ওর প্রতি আমার অনুভূতিতে। থাকলে বা আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে তো লুকিয়ে রাখতে বলতাম ওকে আমার ব্যাপারটা৷ ও না বললেও আমি এসে তো বললাম। নয় কি?

রাকিব ওর কথায় কিছুটা শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু নিজের রাগ এখনো যায়নি৷
সানজিদ নিজের কদম ফুলের মতো চুলগুলোর মাঝে হাত চালিয়ে ঘামটুকু মুছে নিয়ে বললো,
-আজ আপনাকে বললাম। কাল আমার বাবা যাবে আপনার বাড়িতে। সোজাসুজি রাজি থাকলে ভালো। না হলে…

রাকিব সানজিদের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললো,
-না হলে কি? কি করবি তুই?

বাসের কিছু যাত্রী এবং কন্ডাকটর ওদের ঝামেলার মাঝে চলে এসেছে। সানজিদ দুই হাত তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বললো,
-আমরা পালাবো। আমি জানি রোৎশীও আমাকে ভালোবাসে। আমি বললে ও নিশ্চয়ই আমাকে সঙ্গ দেবে।

-দেবো না আমরা ওকে তোর সাথে বিয়ে।

রোৎশীর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে রাকিব জিজ্ঞাসা করলো,
-ও যা বললো সত্যি?

রোৎশী মাথা নামিয়ে ফেললো ভয়ে। রাকিব দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলো ধমকের সাথে। রোৎশী সামান্য কেঁপে উঠলেও মুখ থেকে হ্যাঁ বোধক উত্তর বেরিয়ে এলো। রাকিব আরো রেগে কিছু বলার আগে সানজিদ বললো,
-আমার কি খারাপ, একটু বলবেন। আপনার বোনের জন্য কি আমি যোগ্য নই?

-না।

সানজিদেরও এবার বেশ রাগ হলো। ও বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
-বেশ। আপনার মুটি বোনকে কোথায় বিয়ে দেন আমিও দেখবো।

রাকিব আরো তেতে উঠে বললো,
-ওই তুই আমার বোনকে মুটি বললি কেন? তোর সাহস কি করে হলো ওকে মোটা বলার? ওই দাঁড়া তুই। দাঁড়া বলছি।

রাকিব এগিয়ে যেতে নিলে বাসের যাত্রীরা বাঁধা দিলো। এমনিতেই এতোক্ষণ ওদের ঝামেলা দেখে তারা অতিষ্ঠ। আর ঝগড়া বাড়ালে ওদেরই বাস থেকে নেমে যেতে বললো।
রাকিব অগত্যা নিজের রাগে কাঁপতে থাকা শরীরটা ধপ করে ফেলে দিলো বাসের সীটে। রোৎশীর সাথে আর একটা কথাও বললো না সারা রাস্তা। রোৎশী চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বাকি রাস্তা চলতে থাকলো। রাকিব মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে সানজিদকে গালি দিচ্ছে, বিশেষ করে রোৎশীকে মোটা বলার জন্য। আর রোৎশীকে বলেছে, বাড়ি ফিরে ওকে দেখে নেবে।

#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

অন্তিম পর্ব,,

অরিকের সাথে তিলোর আজকে ঝগড়া হওয়ার মূল কারণ ঘর পরিষ্কার। এখানকার গ্রাণী ফ্ল্যাটটা সপ্তাহের ছুটির দিন কথা ছিলো দুজনের একসাথে পরিষ্কার করার। কিন্তু এতো বেলা হয়ে গেলো অরিক ঘুম থেকেই উঠছে না। আজকে গরমটাও একটু বেশি। তিলো নিজের জন্য বরাদ্দ কাজগুলো করে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। অরিক সবে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে করতে চারপাশ দেখে তিলোকে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কাজের দু’একটা বলতেই তিলো তেড়ে আসলো ওর দিকে। তারউপর পাশের ফ্ল্যাটের ভারিক্কি চেহারার বুড়োটার মিষ্টি নাদুসনুদুস বউটা এসে আজকে ওদের নিজেদের বিবাহবার্ষিকীর দাওয়াত দিয়ে গিয়েছে। এই চারবছরে ওদের মাঝে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর বিবাহবার্ষিকীতে ওনারা দাওয়াত দেন। তিলোর অবশ্য মহিলাটাকে ভালো লাগলেও ওনার স্বামীকে একদম ভালো লাগে না। একটা খিটখিটে মেজাজের বুড়ো। মাঝে মাঝে তিলোর মনে হয়, অরিক বুড়ো বয়সে এমন হয়ে গেলে ও কিভাবে অরিকের সাথে থাকবে?তিলো মাঝে মাঝে গালিও দেয় ওই বুড়োটাকে। কোনোদিনও একটু হাসিমুখে কথা বলেনি সে। কিন্তু তার বউটা! সে তো তিলোর সাথে দেখা হলেই, ভাল্লুকের মতো থাবাযুক্ত হাত বাড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিলোর এই বিষয়টা খুবই ভালো লাগে।

অরিক তিলোর দাবড় খেয়ে নিজের ভাগের কাজ দ্রুত শেষ করে তিলোর পাশে বসলো। তিলো সোফার ব্যাকরেস্টে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বললো,
-আমি ঘৃণা করি, এই উষ্ণ ময়লা এলোমেলো খড়খড়ে দিনগুলো। অরিক, আমি তোমাকে আবারও বলছি আমার পরীক্ষা শেষে দেশে ফিরে যাবো। আমার আর ভালো লাগছে না এখানে।

অরিক তিলোর এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। তার পড়াশোনা আপাতত শেষ। সে এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করছে। রিসার্চ করার সুযোগও তার রয়েছে। তার আয় রোজগারও অনেক ভালো এখানে। অরিক ফিরে যেতে চায়না। আবার তিলো এখানে থাকতে চায়না। আবার ফাহমিদা বেগমও তিলোর পেছনে লেগেছেন অরিককে ফিরিয়ে আনার জন্য বোঝানোর দ্বায়িত্ব দিয়ে। তিলোর সাথে প্রায়ই এটা নিয়ে মান অভিমান লেগে থাকে।
এই মূহুর্তে অরিক বেশ ক্লান্ত। ওর সাথে ঝগড়া করার জন্য যথেষ্ট ভালো মেজাজ ওর নেই। অরিক চুপ করে তিলোর কথাগুলো কেবল শুনলো।

তুলি নিজের গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। পাশাপাশি ইশানকেও একটা স্কুলে ভর্তি করেছে। রোজ স্কুলে দিয়ে আসার দ্বায়িত্ব আনিস সাহেবের। আনিস সাহেবের চাকরিরও আর বেশিদিন বাকি নেই। সারাজীবন খাটাখাটুনি শেষে অফুরন্ত অনাগত ছুটি নিতে ওনার আসলে মন চাইছে না। ওনি কাজের মানুষ। কিভাবে থাকবেন বয়সের ভারে যখন চাকরিটার মেয়াদ পুরে যাবে। সেই চিন্তাতেই তিনি প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন তুলি ওনাকে ইশানের দ্বায়িত্ব দেওয়ায় তিনি খুশি মনেই সে দ্বায়িত্ব নিয়েছেন। সারারাস্তা ইশানের এটা ওটা জিজ্ঞাসা করা নিয়ে ওনি একদমই বিরক্ত হননা। ছেলেটা খুব বেশি বকবক করে। তার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর না দিলে সে বলে ওঠে, ওরে আল্লাহর রাসূল, এরা তো আমার সাথে কথাই বলে না দেখি। গাট্টা গাট্টা ফর্সা হাতদুটো নাড়িয়ে নাড়িয়ে যখন কথা বলে তখন দেখতে অনেক সুন্দর লাগে।

দুদিন হলো আনিস সাহেব শহরের বাইরে গিয়েছেন। তুলিই এখন ইশানকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া করছে। তুষার পড়াশোনা করে রাজশাহীতে। ওখানেই হোস্টেলে থাকে।
তুলির মনে হচ্ছে কেউ ওকে লক্ষ্য করে। কিন্তু কোনো প্রমাণ সে আসলে পায়নি।
নাসীরা পারভীন এদিকে আনিস সাহেবকে তুলির দ্বিতীয় বিয়ের জন্য বলে রেখেছেন। কিন্তু আনিস সাহেবের সেদিকে তেমন একটা গরজ নেই। মেয়ে যেমন আছে, থাক না। ওর ইচ্ছা হলে নিজে এসেই বলবে।

রোৎশীর পরিবার সেদিন সানজিদকে মেনে নিয়েছে। আসলে সানজিদ রোৎশীর জন্য একটু বেশিই ভালো সম্বন্ধ। বিশেষ করে রোৎশীর কোনো সম্বন্ধই টিকছে না যখন ওর স্থুলতার দরুন। সেটা রাকিব বোঝেনি৷ সে এখনও সানজিদের উপর চটে আছে। কিন্তু তাতে তার পরিবারের কিছু যায় আসে না। ওরা বলেছিলো রোৎশীর পড়াশোনা শেষ হলে ওদের বিয়ে দেবে। রোৎশীর শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। তাই বিয়ের আয়োজন চলছে। আজকে সানজিদ আর রোৎশী শপিং মলে এসেছিলো। আর এখানে সানজিদ একটা আশাতীত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ভীষণ খুশি হয়েছে। সে সোহাকে দেখেছে। সেদিনের পর থেকে আর সোহার সাথে তার যোগাযোগ ছিলোনা। আজকে সোহার কোলে একটা দুবছরের বাচ্চা মেয়েকে দেখে সানজিদ এগিয়ে গিয়েছিলো ওর সাথে কথা বলতে। সোহা বেশ হাসি মুখেই কথা বলেছে। তার স্বামী, সৃজনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সানজিদকে বন্ধু বলে। সোহার পর রোৎশীকে নিজের জীবনে পাওয়ার আগে সানজিদের আর কারো প্রতি কোনো আকর্ষণের সৃষ্টি হয়নি। হয়তো রোৎশীর সাথে দেখা না হলে সোহার প্রতি আকর্ষণটুকুকেই ওর প্রেম মনে হতো বরাবরের জন্য।

শপিং মল থেকে বেরিয়ে সানজিদের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে ওকে জাপ্টে ধরেছে রোৎশী। সানজিদ মৃদু হেসে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলো। রোৎশীকে নিয়ে কোলাহলে পরিপূর্ণ শহরটা ছেড়ে একটু দূরে যাওয়ার জন্য সানজিদ মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে গতিসীমা অতিক্রম করলো। রোৎশী আরো শক্ত করে ওকে আঁকড়ে ধরলো। ওর এই গতিটা বেশ ভালো লাগছে। রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি হচ্ছে নিজের ভেতর। রোৎশী গুনগুনিয়ে নিজের মোটা গলায় গান ধরলো,

Baby, take my hand
I want you to be my husband
Cuz you’re my iron man
And I love you 3000

সানজিদ ভ্রু কুঁচকে বললো এই পর্যায়ে,
-Only 3 thousands?

রোৎশী গান থামিয়ে দিয়ে বললো,
-উঁহু। 3 trillions.

-Only?

-Ok then. A galaxy.

-Only?

-আর কি?

-But I love you whole multiverse.

রোৎশী সানজিদের পিঠে একটা চাপড় বসিয়ে বললো,
-ফাজলামি করার আর জায়গা পাওনা, তাই না? ফাজিল লোক!

সানজিদ মোটরসাইকেলটা একটু ঘুরিয়ে বেসামাল হওয়ার ভঙ্গিমা করতেই রোৎশী মৃদু চিৎকার করে চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে সানজিদের শার্টটা খামচে ধরলো। সানজিদ জোরে হেসে দিয়ে বললো,
-আরেকবার মারবে তো এখনই অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে। খেয়াল তো রাখো, কোথায় আছি।

রোৎশী ওকে মুখে আর কিছু বললো না ঠিকই। কিন্তু বিড়বিড় করে ওকে বলে চলেছে। সানজিদের কথায় ওর বিড়বিড় করা থেমে যায়।
-যেবছর অভেঞ্জার্স এর ওই মুভিটায় আয়রন ম্যান বলে ‘আই লাভ ইউ থ্রি থাউসেন্ডস’ সেটা বলার কারণ ছিলো, মার্ভেলস এর কোনোকিছুর তিন হাজার পূরণ হয়েছিল। আমার মনে নেই সঠিক, আসলে কিসের তিন হাজার পূরণ হয়েছিল।

রোৎশী ওর কথার প্রত্যুত্তর করলো না। ও সানজিদের পিঠে নিজের মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে চোখ বুজে ফেললো।

আজ বিকালে তুলির অফিসের ক্যাফেতে কেউ একজন ওর সাথে দেখা করতে চায় বলে পাঠিয়েছে। তুলি ভ্রুযুগলকে আপনাআপনি কুঁচকে সেদিকে পা বাড়ালো। মানুষে ভর্তি ক্যাফেটায় একটা কোণার টেবিলে কাউকে পেছনে ফিরে বসে থাকতে দেখে তুলি ধীর পদক্ষেপে সেদিকে এগিয়ে গেলো। লোকটার সামনে গিয়ে তার মুখ দেখে তুলি চমকে উঠলো। প্রায় পাঁচবছর পর সেই মানুষটাকে আবারও দেখছে ও। তুলি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে আসতে নেবে, ইমন কাতর কন্ঠে ওকে অনুরোধ করলো একটুখানি ওর সাথে কথা বলার জন্য। তুলি আশেপাশে একবার তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বসলো ওর সামনে। কেন যেন ওরও ইমনের কথা শুনতে ইচ্ছা করছে। ইমনের চেহারা একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সারা মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তুলি আন্দাজ করতে পারছে, ইমন ভালো নেই।
কিছুক্ষণ ওদের ভেতর নিরবতায় কেটে যাওয়ার পর তুলি বিরক্ত হয়ে উঠলো। ইমন চোখ নিচের দিকে আবদ্ধ রেখে বললো,
-কেমন আছো?

তুলির রাগ এখন পাহাড়সম। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-এই ফালতু কথা শুনতে এখানে এসেছেন? সরি, আমার হাতে সময় নেই আপনার জন্য।

ইমন অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনি? এতোটা পর হয়ে গিয়েছি?

-একদম ন্যাকামি করবেন না আমার সাথে। কেন এসেছেন এখানে? জানতে চান, আমি কেমন আছি? খুব ভালো আছি। আমার ছেলেকে নিয়ে আমি অনেক বেশি ভালো আছি। আপনিও নিশ্চয়ই সুখে আছেন। এখন আসুন।

বলে তুলি উঠতে নিতেই ইমন বললো,
-আমার কাছে ফিরবে?

তুলি থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়েও গলার স্বর নামিয়ে বললো,
-লজ্জা করেনা এখন এসব কথা বলতে? কেন? আপনার বউ আবার ভেগেছে নাকি?

ইমন নাক শিটকে বললো,
-কি অবস্থা তোমার ভাষার!

-আপনার জন্য এর থেকে ভালো ভাষা মুখ থেকে বের হয়না। খবরদার, আর আমাদের জীবনে আসবেন না।

-তুমি ইশানকে তবে আমায় দিয়ে দাও।

তুলি এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। লোকটা পেয়েছে কি হঠাৎ করে? তুলি কিছু বলার আগে বললো,
-ইতির কখনো সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তুলি তাচ্ছিল্য ভরে হেসে বললো,
-তো আমি কি করতে পারি? সেটা আপনাদের স্বামী স্ত্রী’র বিষয়। এতে আমাকে কেন জড়াচ্ছেন?

-তুমি চাইলে ফিরতে পারো আমার জীবনে। নাহলে ইশানকে দাও। আমার ছেলেকে ফেরত দাও।

তুলি নিজের ডানহাতটা এবার ইমনের গালে বসিয়ে দিলো সশব্দে। পুরো ক্যাফের প্রত্যেকের নজর এখন এদিকে। তুলি চিৎকার করে বললো,
-হারা**। তোর এখনও লজ্জা হয়নি? যে ছেলেকে স্বীকৃতিই দিতে চাসনি এখন নিজের সংসারের প্রয়োজনে আমার থেকে আমার ছেলে কেড়ে নিতে এসেছিস! নির্লজ্জ! আমার আর আমার ছেলের মাঝে একদম ঢোকার চেষ্টা করবি না। আমার ছেলের দিকে হাত বাড়ালেও তোর হাত কেটে ফেলতে আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না। কথাটা মনে রাখিস। তোর বাচ্চা হয়না, তুই তোর সংসার নিয়ে জাহান্নামে যা। আমাকে বিরক্ত করতে এসেছিস কেন?

তুলি কথাগুলো বলে হাঁপাচ্ছে। আশেপাশে সকলেই তুলিকে চেনে। কিন্তু ইমনকে চেনে না। তুলিকে উত্তেজিত হতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই সকলের কৌতুহল বেড়ে গেলো। ওরা তুলিকেই সাপোর্ট করতে এগিয়ে এলো।
ইমন রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
-আমি আইনের সাহায্য নেবো আমার ছেলেকে ফিরে পেতে।

তুলি ওর কলার টেনে বললো,
-যা না যা। যেখানে খুশি যা। আমার ছেলে জানে ওর বাপ মরে গিয়েছে। ওকে আমার থেকে আলাদা করার ক্ষমতা তোর কোনো আইনের নেই। তোর যতো ক্ষমতা আছে কাজে খাটিয়ে দেখ। আমি বলছি, তুই হারবি। একদম হেরে যাবি। বের হ এখান থেকে। তোর মুখ আমি দেখবো না।

ইমন কিছু বলার আগে এখানকার বাকি স্টাফদের আক্রোশের স্বীকার হয়ে ওকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতেই হলো। তুলি চেয়ারে বসে পড়লো। ওকে অনেকেই সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এসেছে। ও ওর এখানকার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মৃত্তিকার উদর জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো। মৃত্তিকা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সকলকে যার যার কাজে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো।

আরো দুতিনদিন পর তুলি অফিসে এসেই নিজের ডেস্কে একটা গোলাপি রঙের খামে মোড়ানো চিরকুট পেলো। সাথে এক তোড়া লাল গোলাপ। তুলি আন্দাজ করতে পারে কাজটা কার। কিন্তু তবুও নিশ্চিত হতে পারে না। তুলির চিকন ওষ্ঠজোড়া আপনাআপনি খানিকটা উপরে উঠে গেলো। কয়েকমাস হয়েছে এখানে চাকরিটা ও করছে। এখানকার এমডি’র আচরণটাই একটু ভিন্নরকম ওর প্রতি। তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যানের ছেলে। চিরকুটটা খুলে দেখলো ও।

‘আপনার রোজকার ক্লান্তিভরা মায়াবী মুখটার প্রেমে পড়েছি নিজের অজান্তেই। বিগত কয়েকদিন ছোট্ট ছেলেটার হাত আঁকড়ে ধরে রাস্তা পার হওয়ারত একটা মেয়ের মুখ কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। আমি এতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে পারি না। আমি স্পষ্টবাদী। আবার খুব রোম্যান্টিকও নই যে কয়েক পাতা প্রেমের কবিতা লিখতে পারি। গত পরশু একটা লোককে দেখলাম ঝামেলা করতে আপনার সাথে। তাই আর হেয়ালি করছি না। আমার অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছা।

ইতি,
খুঁজে নিন তাকে।’

তুলি চিরকুটটা পড়ে বেশ লজ্জা পেলো। ক্লাস নাইনে থাকতে একটা চিরকুট পেয়েছিলো ও। কিন্তু তখন ভয়ে আর উত্তেজনায় খুলে পড়া হয়নি। তবে শেষ বাক্যে তুলি বেশ বিরক্ত। খুঁজে নিন মানে কি? ও কি সকলকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করবে নাকি যে, আপনি কি আমাকে চিরকুট পাঠিয়েছেন? তবে তুলি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছে, কে তাকে এটা পাঠালো?

আবিরকে তো আনিস সাহেব অনেক আগেই পুলিশে দিয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে সে এই শহর ছেড়েছে লজ্জায়।

অনিকেত সেই শ্বেত সুন্দরীকে বিয়ে করে নিয়েছে। এখন অস্ট্রেলিয়াতেই স্থানীভাবে বসবাস করছে।

ফিরোজও সেই মেয়েকে খুঁজে পেয়েছে। ছোট্ট একটা গ্রামের মেয়ে সে। তাতে ফিরোজের কি? সে তো মেয়েটার মায়ায় পড়েছিলো। তাড়াতাড়ি সে তাকে বিয়ে করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তৌকিরের বিয়েটা হয়েছে ওর বাবা মায়ের পছন্দ করা একটা মেয়ের সাথে। কোথাও মন না টিকলেও এই মেয়েকে মেনে নিয়ে সংসার করতে করতে এখন তাকে সাংসারিক ভালোবাসা খুব টানে। সুস্থ একটা মেয়ের জনক সে এখন।

রিতা গ্রাজুয়েশন শেষ করেও পড়াশোনা করে চলেছে। ইতিমধ্যে একটা ছেলে সন্তানের মা হয়েছে, যে কিনা ওর নাতি নাতনির থেকে ছোট।

মীরার জন্য অনেকেই আফসোস করে। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো ও। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করার সময়ই ছেলেটা ফিনল্যান্ড থেকে ফিরে এসেছিলো। বিয়ের সময় কথাদ দিয়েছিলো ওকে পড়াশোনা শেষ করতে দেবে। কিন্তু সংসারের চাপে মীরাকে তৃতীয় বর্ষেই পড়াশোনার ইতি টানতে হয়েছে। এখন সে যমজ ছেলেমেয়ের মা।

আহান আর রিয়া স্মৃতি হয়েই সবার মাঝে বেঁচে আছে। ওদের মাঝে মাঝে কেউ স্মরণ করে তো করে না। কিন্তু প্রায়ই অনেকের অনেক সময় ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাগুলো ওদের মনে করিয়ে দেয়।

অনিমা পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে ওর শেষ ক্রাশের সাথে। এরপর ওর সাথে ওর বাবা মায়ের আর কোনো যোগাযোগ নেই।
অনিমা ঠকে গিয়েছে। খুব বাজেভাবে ঠকে গিয়েছে। ছেলেটার আসলে কোনো পরিচয়ই নেই। নেশাখোর, জুয়ারি একটা ছেলে সে।
অনিমা একদিন আদ্রিয়ান সাহেবকে ফোন করেছিলো। কিন্তু তিনি ওর মুখে ‘আব্বু’ ডাক শুনে ফোনটা কেটে দিয়েছেন বুক ভরা কষ্টের দরুন।
অনিমা আর যোগাযোগ করতে পারেনি ওনাদের সাথে।

অভ্রকে বিয়ের জন্য বারবার ফাহমিদা বেগম তাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু অভ্রের কোনো হেলদোল নেই। ফাহমিদা বেগম তো রাগ করে ওকে বলেছেন, সন্ন্যাসী হয়ে যেতে। অভ্র তাই হতে চেয়েছে। ফাহমিদা বেগম রাগ করে থাকলেও ঘটক লাগিয়ে মেয়ে খুঁজে চলেছেন ছেলের বিয়ের জন্য। ওনি প্রয়োজনে বস্তায় ভরে অভ্রকে বিয়ে দেবেন। ওনার একজন মামাকে সত্যিই বস্তায় ভরে বিয়ে দেওয়া লেগেছিলো। সেই মামা কোনোমতে বিয়ে করতে চাইতেন না৷ অবশেষে বিয়ে ঠিক হলে ওনাকে জানানো হয়নি। বিয়েরদিন সকালে জানতে পেরে পালিয়ে গেলেন। এরপর ফাহমিদা বেগমের নানা ছেলেকে লোকজন যোগাড় করে বস্তায় ভরে বিয়ে দিতে নিয়ে গেলেন। ফাহমিদা বেগমও তেমনি ষড়যন্ত্র এঁটে চলেছেন নিজের ছেলেকে নিয়ে।

তিলোর পরীক্ষা শেষে সে আর থাকবে না ইউএস এ। অরিক ভার্সিটি থেকে একটা কাজে ফ্লোরিডায় এসেছিলো। তিলোকেও সাথে এনেছে। আশেপাশে সবচেয়ে কাছে ক্লিয়ার ওয়াটার সি বিচে এসে বসেছে সে এবং তিলো। প্রায় দুদিন হলো এখানে এসেছে ওরা৷ তিলোর সাথে আবারও ঝগড়া হয়েছে। অরিক শেষবারের মতো ওকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলো যাতে ওরা এখানে থেকে যেতে পারে। তিলো মানতে নারাজ। অরিক চুপ করে বসে আছে। তিলো তার পাশে মুখ ভার করে বসে আছে। অরিক দুবার ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছে। তিলো মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। অরিক অবশেষে কোনো উপায় না পেয়ে খুব বাজে একটা বুদ্ধি বের করলো। ও এখানে রোদ পোহাতে থাকা স্বল্প বসনা পরিহিত মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে তিলোর দিকে তাকাচ্ছে। ও চাচ্ছে, তিলো ওর কাজটা প্রত্যক্ষ করুক।

কিছুক্ষণ যাবৎ অরিকের উপস্থিতি টের না পেয়ে তিলো পাশে তাকিয়ে দেখে অরিক ড্যাবডেবে চোখে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তিলোর এবার বেশ রাগ হলো। এই শ্বেত উলঙ্গ ভাল্লুকগুলোর কবল থেকে রক্ষা করতেই তো তিলো এতো কষ্ট করে ওর সাথে এই দেশে পড়ে আছে। এখানে সব কাজ তিলোর নিজে করতে হয়। এটাই সবচেয়ে বড় কষ্ট ওর। এখন ওর সামনেই অরিক নিজের দুঃসাহস দেখাচ্ছে!! তিলো দাঁত কিড়মিড় করে অরিকের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
-She’s hot. Right?

অরিক ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
-Yeah.

তিলো নিজের মৃদু হেসে বললো,
-I think she is one of the reasons why hell is so hot!

অরিক হুট করেই নিজের দৃষ্টি সংযত করে তিলোর দিকে অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকালো। তিলো হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে হাঁটা ধরলো দপাদপ পা ফেলে। অরিক নিজের ভুল বুঝতে পেরে বুঝলো তিলো আরো রেগে গিয়েছে। ও নিজেও তিলোর পেছন পেছন যেতে আরম্ভ করলো।

অবশেষে অরিক হেরে গিয়ে দেশে ফিরতেই হলো। এতোবছর পর দেশে ফিরে তিলো তো বেজায় খুশি। ওদের ফিরে পেয়ে ওদের পরিবারও খুশি। অরিক এরপরও তিলোকে আরও পড়তে বলেছে। তিলো নিজেও সম্মতি প্রদান করেছে।

অরিক এখানেই একটা ভার্সিটিতে পড়ানোর দ্বায়িত্বে রয়েছে। পাশাপাশি এখানেই রিসার্চ করছে। এখন তারা ‘মায়ানীড়’ এ থাকে।

তিলো একরাতে অরিকের পাশে শুয়ে হঠাৎই বললো,
-অরিক, আমরা অনেকদিন ঝগড়া করি না। তাই না?

অরিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। সত্যিই তো। আগে ওর সাথে নিয়মিত ঝগড়া বাঁধতো দেশে ফেরা নিয়ে। ফিরে আসার পর আর ঝগড়া করার প্রয়োজন পড়েনি।
তিলো ফট করে ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো,
-চলো আমরা ঝগড়া করি।

অরিক মৃদুস্বরে বললো,
-কি নিয়ে ঝগড়া করবে তুমি বাবাজানা?

তিলো কিছু সময় চিন্তা করলো। তারপর ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো,
-আমার অগোচরে তুমি কোনো ধলা ইঁদুরের সাথে কথা বলোনি তো ওই দেশে থাকতে?

অরিক বিরক্ত হয়ে বললো,
-তোমার মাথায় এগুলো ছাড়া কিছু ঘোরে না?

তিলো উঠে বসে কর্কশ গলায় বললো,
-এড়িয়ে যাচ্ছো কেন তুমি? তাহলে সত্যিই তোমার কেউ ছিলো। তাই না? আমি জানতাম। আমি জানতাম, তুমি এমনই। আমার মতো কালোকে তো আর ভালো লাগবে না তোমার ওখানে অতো সাদা সাদা মানুষ দেখে। দেখেছো, আমি চিনতে পারি মানুষকে। তুমি তো……

তিলো আরোও অনেক কিছু বলে চলেছে। অরিক উল্টো ঘুরে কানে বালিশ চাপা দিলো। তিলো ওর বলিশ কেড়ে নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলো। বেঁধে গেলো ঝগড়া, তিলোর মনের প্রত্যাশা পূরণে।

সময় খুব দ্রুত চলে যায়। বর্তমানে তো আরোও দ্রুত যাচ্ছে। একবছরের হিসাবে কয়েক সেকেন্ড কমেও যাচ্ছে পুরো বছর থেকে। সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় অনেক কিছু। মানিয়ে নেওয়া, বদলে দেওয়ার একটা কারণ। আবার সম্পর্কগুলোও এগিয়ে চলে। ভেঙে যায়। স্থির হয়ে থাকে এক জায়গায়।
তিলো এবং অরিক ইউএস থেকে ফিরেছে প্রায় দুমাস হতে চললো। ফাহমিদা বেগমের সাথে তিলোর সম্পর্কে স্বাভাবিক শ্বাশুড়ি বউমার মতোই। মেয়ে হতে পারলোনা তিলো তাঁর। তবে এখন নিজের ষড়যন্ত্রের পার্টনার হিসাবে তিনি তিলোকে নিজের দলে ভিড়িয়েছেন। অভ্রর জন্য মেয়ে খোঁজার দ্বায়িত্ব এখন তিলোর উপরও বর্তিয়েছে।

তিলোর শরীরটা কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছিলো না বিধায় ও ফাহমিদা বেগমকে সাথে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। সামনেই ওর আর অরিকের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। তিলোকে কিছু টেস্ট দেওয়ায় ও সেগুলো করেই এসেছে। এমনকি রিপোর্টটাও ওর হাতে এসে পৌঁছেছে। বাড়ির সকলেই জানে সুখবরটা। কেবল অরিক জানে না। তিলো ঠিক করেছে, ওদের বিবাহবার্ষিকীতে একবারে ওকে সারপ্রাইজ দেবে।

প্রতিরাতের মতো আজও সৃজন জেগে আছে সোহা আর ওদের মেয়ে দাহিয়ার ঘুমের অপেক্ষায়। ওরা ঘুমিয়ে পড়তেই সৃজন দাহিয়াকে ওদের মাঝখান থেকে উঠিয়ে বিছানার একপাশে শুইয়ে দিলো পাশে বালিশ দিয়ে। মেয়েটা জেদ ধরে থাকে দুজনের মাঝখানে ঘুমাবে বলে। সৃজন দাহিয়ার কপালে ছোট্ট একটা চুম্বন করে ফিসফিসিয়ে বললো,
-সরি মামনী। তোমার মা শুধু আমার।

দাহিয়াকে একপাশে রেখে মাঝখানে সৃজন শুয়ে সোহাকে নিজের বুকে চেপে ধরলো। বিয়ের পর থেকে এটাই ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বুকের মাঝে সোহাকে নিয়ে ওর শরীরের ঘ্রাণ না পেলে সৃজনের ঘুম আসে না। সোহা জেগেই থাকে প্রতিরাতে। শুধু ঘুমের অভিনয় করে। সৃজনের বাচ্চামিতে ও ঠোঁট টিপে হাসে। সত্যিই ওর কপালে একটু বেশিই সুখ ছিলো। সৃজন ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে যতোটা ও সানজিদকে বাসতো তার থেকে হাজার গুণে বেশি। কেউ ঠকালেও অবশেষে সুখটা ঠিকই প্রকৃতির নিয়মে চলে আসে জীবনে।
সোহা নিজেও ঘুমের মাঝে নড়ে ওঠার বুঝ বুঝিয়ে সৃজনকে আঁকড়ে ধরে বরাবরই। মেয়ের সাথে সৃজনের এই হিংসাত্মক মনোভাবটা সোহা বেশ উপভোগ করে। সে বিশ্বাস করে, সে ভাগ্যবতী।

ইমন সত্যিই আইনের আশ্রয় নিয়েছিলো। কিন্তু সে হেরে গিয়েছে। তুলির মাতৃত্বের সামনে ইমনের দাবি টেকেনি।

পরিশিষ্ট :
বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে অরিক তিলোকে নিয়ে একটা রেস্টরন্ট এ ব্যক্তিগত একটা ছোট কক্ষ বুক করেছে। তিলোকে সে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো। তিলো হেসে দিয়ে বললো,
-এটা তো মেয়েরা করে থাকে। জানো তো, পৃথিবীতে বিক্রি হওয়া মোমের ৯৬ শতাংশ মেয়েরা কিনে থাকে।

অরিক মুখ গোমড়া করে বললো,
-তুমি করলে না। তাই আমি করলাম।

তিলো মুচকি হেসে অরিকের খুব কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,
-অরিক ইয়েসয়ি, আমাদেরও সময় এসেছে, আমাদের পৃথিবীতে নতুন কাউকে স্বাগতম জানানোর।।।

কথাটা অরিকের বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। বুঝতে পেরেই সে তিলোর মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। অস্ফুট স্বরে তিলোকে সে কিছু বললো, যেটা তিলো শুনতে পেলো ঠিকই। তিলোত্তমার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো অরিকের কথায়। আজ তার মনে অবচেতন ভয়টা নেই পরিশেষে পথ হারিয়ে ফেলে নিজেকে হারিয়ে ফেলার।

–সমাপ্ত–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here