ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -৩০+৩১+৩২+৩৩

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩০,,

তিলো অনিমার বাড়ির দরজায় বেল বাজিয়ে দাঁড়ায়নি। আয়াশ যতক্ষণে দরজা খুলেছে, ততক্ষণে তিলো ওখানে ছিলোনা। আয়াশ আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে দরজা আটকানোর আগে নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটার দিকে চোখ পড়তেই ওর ভ্রু যুগল আপনাআপনি কাছাকাছি চলে আসে। ও ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে চিনতে একদমই অসুবিধা হয়না এটা কিসের ব্যাগ।
আয়াশ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অনি এই মূহুর্তে বাড়িতে নেই যে ওকে এগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আয়াশ নিজের কৌতুহল মেটাতে পারে।

রাতে অনিমা তিলকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলো। কিন্তু তিলো সেগুলো রিসিভ করেনি।

পরদিন ভার্সিটিতে গিয়েও তিলো অনির সাথে কোনো কথা বলেনি। অনিমা কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তিলোর ওকে এড়িয়ে যাওয়ায় ও নিজের অবস্থান বুঝে নিয়েছে। একবার ক্লাসের মাঝে হাত টেনে ধরে আদুরে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
-এই তিল, কথা বলছিস না কেন? রাগ করেছিস? দেখ, পরশু কেবল আমার মনের কথাগুলো তোকে বলেছিলাম। তোকেই তো সব বলি। এতে রাগ করছিস কেন?

তিলো অনির সে কথারও কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। ও এই বিষয়টাকেও এতোটা হালকাভাবে নিচ্ছে, ভেবেই তিলোর শরীর রাগে রি রি করে উঠলো।
অনি আরো কিছু বলতো। তবে তিলোর থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে বললো না।

কিছুক্ষণ পর যখন ওরা মাঠে এসে বসেছে তখন অনি আবারও বললো,
-আজকে আব্বু অরিক স্যারের বাবার সাথে দেখা করতে যাবে।

কথাটা তিলোর কানে গেলেও তিলো কিছু বললো না। আবার ওদের ভেতরকার মনোমালিন্যতা ওদের বাকি বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। জিজ্ঞাসা করেও সদুত্তর পায়নি তারা৷ তবে অনির শেষ কথাটা রিয়ার শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো অনির দিকে। সে অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলো,
-তোর বাবা স্যারের বাবার কাছে যাবেন কেন?

অনি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
-বিয়ের কথা বলতে।

এবার প্রত্যেকেই ওর দিকে তাকালো। তিলো কিছু না বলে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। তৌকির আর আহান ওকে পেছন থেকে ডাকলো। কিন্তু তিলো থামলো না। ওর কান্না পাচ্ছে। ইতিমধ্যে চোখজোড়া ভরে উঠেছে পানিতে। আপন মানুষগুলোই ওর বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে কেন? তিলো ভেবেও উত্তর পায়না। তুলি নিজের চরিত্র দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, বিশ্বাস করতে নেই সবাইকে। আজকে আবার অনিও। ও কি বুঝেও না বোঝার ভান করে বসে আছে। তিলো এটাও জানে না। ও আর পরবর্তী ক্লাসগুলো করবে না। বেরিয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে।

অনির কথা শুনে সকলেই অবাক হয়েছে। রিপা অবাক কন্ঠেই বললো,
-তিলের সাথে তো বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। তাহলে তুই মাঝখান থেকে উদয় হলি কেন?

অনি হাত দুটো পিছনে নিয়ে শরীরের ভর পেছনে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললো,
-তিলো তো পরিবারের ঠিক করে দেওয়া বলে রাজি হয়েছে। তাহলে এই বিয়ে ভেঙে গেলে সমস্যা কোথায়?

মীরা অনির মাথায় চাটি মেরে বললো,
-তাতে কি? ঠিক তো হয়েছে। একটা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া কতো বড় অন্যায় তোর ধারণা আছে! পাগল নাকি তুই!

অনি কিছু বলার আগে রিয়া বললো,
-দেখ অনি, পাগলামি করিস না। আমি বুঝতে পারছি না, আঙ্কেল কি করে সায় দিচ্ছেন এতে? তিলো কষ্ট পেয়েছে, বুঝতে পারছিস না? ও মন থেকে এই বিয়ে করতে চায়।

অনি মুখ থেকে ‘চঁ’ জাতীয় শব্দ করে বললো,
-ওরও বোঝা উচিত, কারো অনুভূতিকে দাম দিতে হয়। আরেহ্, তোরা বুঝিস না কেন, ও কেবল পারিবারিকভাবে বিয়ে করতে রাজি। আমি ভালোবাসি তাকে। রিয়া, তুই কেন আহানের সাথে পালিয়ে গেলি তোর বাবা তোর জন্য ভালো একটা ছেলে ঠিক করার পরও?

ওদের মধ্যে বিতর্ক চলতেই থাকলো যতক্ষণ না ওরা নিজেদের শব্দভাণ্ডার শূন্য করে নিজেদের ক্লান্ত করে তুলেছে। তবে সে বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিজয়ী কে, কেউই নিশ্চিত নয়। তারা নিজেদের অবস্থানে নিজেদের যুক্তিসমেত যথেষ্ট পাকাপোক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে।

তিলোকে ওর বন্ধুরাও ফোন করেছে। কিন্তু সে তাদের ফোনও রিসিভ করেনি।
বিকালে ছাদে গিয়ে তিলো তুলিকে আগে থেকেই সেখানে ইশানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ঠিক দাঁড়িয়ে নয়। ইশানকে কোলে নিয়ে সে ওর সাথে আহ্লাদী সুরে কথা বলছে আর বিভিন্ন জিনিস চেনানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
তিলো এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলো তুলি বলছে,
-আমার আব্বুটা দেখো, এটা হলো একটা গাছ। এটা কাঁঠাল গাছ। পাতার রং দেখো। এটা সবুজ। দেখো, ওটা একটা কাক।

তিলো হেসে দিলো তুলির বাচ্চামিতে ভরপুর কথাগুলো শুনে। ইশান এখনো কত ছোট! তাই ওর সাথে এভাবে কথা বলে চলেছে তুলি! আবার কিছুক্ষণ পরপর তুলি ওর পেটে মুখ গুঁজে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আর তাতে ইশান দাঁতহীন গালটা চওড়া করে শব্দ করে হেসে কুটিকুটি। ধবধবে ফর্সা নাদুসনুদুস বাচ্চাটাকে দেখলেই তিলোর ইচ্ছা করে চটকে খেয়ে ফেলবে। নিজেকে রাক্ষুসী মনে হয় তখন।
আসলে মানুষ অতিরিক্ত সুন্দর কিছু সহ্য করতে পারে না। সুন্দর কিছু দেখলে আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন এবং সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার দুটির অস্বাভাবিক ক্ষরণের ফলে সেই বস্তুটাকে মানুষ ধ্বংস করতে চায়। এর প্রভাব সিরিয়াল কিলারদের মাঝে মাত্রাতিরিক্ত থাকলেও প্রতিটা মানুষের মাঝেই থাকে। যে কারণে সুন্দর ফুল ফুটতে দেখলে আমরা ছিঁড়ে ফেলি। গোলগাল বাচ্চাদের জোরে গাল টিপে ধরি। একে ‘Cute Aggression’ বা ‘Playful Aggression’ বলে। ডোপামিন আসলে বিভৎস রকমের একটা নিউরোট্রান্সমিটার (আমার মতে)। ডোপামিন, নরপাইফিন এবং এড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণের ফলে ক্রাশ বা ভালোবাসার মানুষটা কাছে আসলে হৃৎস্পন্দনের হার আপনাআপনি বৃদ্ধি পায়। অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
ভালোবাসার মানুষটার পাশে ঘুমালে আমাদের ডিপ্রেশন হ্রাস পায়। এই ডোপামিন এবং সেরোটোনিন ক্ষরিত হয়, যা আমাদের মন ভালো রাখে। আবার ডোপামিন, মেলাটোনিন হরমোনে রূপান্তরিত হয়, যা আমাদের ঘুমের সাইকেলে প্রভাব বিস্তার করে। আমরা দ্রুত এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি।

তিলো মনুষ্য প্রজাতির উর্ধ্বে নয়। ইশানকে দেখলেই ওকে আদর করতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে এটা এতো বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় যে, ইশান অবশেষে কেঁদে দেয়। ওর গাল হাত পা লাল হয়ে যায়। নাসীরা পারভীন এর আগে দুবার তিলোকে বকেছেন এই নিয়ে। তাতে তিলোর কি? ও ইশানকে হাতের কাছে পেলে নিজেকে সামলাতে পারে না। নিজের গালটাও আপনাআপনি আদুরে ভাব প্রকাশ করে।

তিলো তুলির কোল থেকে ইশানকে নিয়ে ওর গালটা টিপে ধরে জোরে একটা চুমু বসিয়ে দিলো। ইশান হাত নাড়িয়ে নিজের আনন্দ প্রকাশ করতে তিলোর মুখ খামচে ধরলো। তিলো তাতে বিরক্ত না হয়ে আরো বেশি করে ওকে আদর করতে ব্যস্ত। তুলি কেবল ওদের দেখছে আর মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছে।

কিছুসময় নিজের আবেগ নিয়ে খেলা শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিলো তুলিকে জিজ্ঞাসা করলো,
-তোর কাহিনি আমাকে বল তো।

তুলি ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কোন কাহিনি?

-তোর নতুন প্রেমের কাহিনি। যার জন্য এখন এই পিচ্চি বাপ ছাড়া।

তুলির মুখটা সাথে সাথেই ঘনকালো মেঘে গোমড়া হয়ে গেলো। তিলো আবারও বললো,
-কি রে বল।

-রাতে আমার রুমে আসিস বলবো। এখন আম্মা বা কেউ শুনে নিলে বিষয়টা বিশ্রী হয়ে যাবে। ইশানকে দে। ওর খাওয়ার সময় হয়েছে।

তিলো কিছু না বলে ইশানকে তুলির কোলে দিয়ে দিলো। তুলি ওকে কোলে নিয়ে নিচে চলে এলো। তিলোও কিছু সময় কাটিয়ে নিচে এলো।

সন্ধ্যায় তিলো কেবল পড়তে বসার পরই ওকে তৌকির ফোন করে জানালো আহান অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। এখন সিটি হসপিটালে আছে। অবস্থা ভালো না। সংবাদটায় তিলো ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলো। আনিস সাহেব সবে বাড়ি ফিরেছেন। তিলো কাউকে কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজনবোধ করলোনা। আনিস সাহেবকে কেবল বললো ওর সাথে যেতে। আনিস সাহেব সারাদিনের ক্লান্তিতে ইচ্ছা না থাকলেও ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩১,,

এদিকের ঝুল বারান্দাটা থেকে পাশের বারান্দাসমেত ঘরটাকে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে কোনোকিছুর উদযাপন চলছে সেখানে। আসলে চলছিল। এতক্ষণে থেমে গিয়েছে। জানালার গ্রীলের সাথে বাঁধা বেলুনগুলো একে অন্যের সাথে বারি খাচ্ছে এলোমেলোভাবে উত্তাল বাতাসে। সেগুলো নীল, লাল, সবুজ, গোলাপি, সাদা, বেগুনি, কমলাসহ রঙবেরঙের, নরম এবং খানিকটা কুঁচকে গিয়েছে। ঘর্ষণে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে হয়তো। ফলে একে অন্যের সাথে লেপ্টে আছে তো দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তিলো জানতে পেরেছে সেখানে দশবছরের একটা ক্যান্সার আক্রান্ত ছেলে ভর্তি আছে। কিছু চিকিৎসার জন্য তাকে কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। আজ, ওহ! এখন গতকাল হয়ে গিয়েছে কারণ রাত বাজে দেড়টা, তার জন্মদিন ছিলো। তারই ছোটখাটো উদযাপন করা হয়েছে এখানে। বারান্দার মেঝেতে এখনো সোনালী ফয়েলে মোড়ানো কেকের নিচের কার্ডবোর্ডটা পড়ে আছে। অন্ধকারে দেখা না গেলেও তিলো জানে, পিঁপড়াদের একটা বিশাল দল এখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজেদের তুলনায় আকারে বড় কেকের গুঁড়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আহ! এটা তাদের অধিকার। কালো কালো পিঁপড়া, খয়েরী খয়েরী কেকের গুঁড়া।

দরজার সাথে লেগে থাকা ছোট্ট গোল কাঁচের জানালা দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে থাকা নিরাবরণ বিছানাটি এবং বিছানার উপরের উদ্ভুত দেহটি, যেটি সাদা বর্ণের অসংখ্য ছিদ্রবিশিষ্ট বিশেষ কাপড়ে মস্তকসহ সর্বাঙ্গ আবৃত হয়ে আছে এবং মুখে পরিহিত বিশেষ যন্ত্র আর আশেপাশে দানবাকৃতির যন্ত্রসমেত দৃশ্যমান হয়ে রয়েছে, একজোড়া অশ্রুসজল চোখ ছিলো তার উপর নিবদ্ধ। সে অনিরুদ্ধ দর্শনে চেয়ে আছে।
আহানের শারীরিক অবস্থা একদমই স্থিতিশীল নয়। কাউকে আইসিইউতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রিয়া সেই কখন থেকে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে ওকে। বারবার চোখে পানি জমে ঝাপসা হয়ে আসছে তার দৃষ্টি। পরক্ষণে সেটা মুছে ফেলে পলক ফেলে নিজের দৃষ্টি পরিষ্কার করে নিচ্ছে। এখানে ওদের বন্ধুরা সকলে রয়েছে। আহানের বাবা-মা আর বোনও এসেছে। অবাক করা বিষয় হলো, রিয়ার বাবা-মাও এসেছে। তারা সমব্যথী এই মূহুর্তে। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে যখন জানালেন, তিনি দুঃখিত এবং মাত্র কিছুক্ষণই রয়েছে এখন আহানের হাতে। আহানের মায়ের হৃদয়বিদারক চিৎকারে পরিবেশটা মূহুর্তেই অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো।

আজ সন্ধ্যার কিছু আগে আহান একটা টিউশনি করে বেরিয়েছিলো। বাইকটা নিয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই পেছন থেকে একটা মালবাহী একটা ট্রাক ধাক্কা দেয় তার বাইকটাকে। আহান ছিটকে গিয়ে সামনে পড়ে। ট্রাকটা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার আগেই আহানকে আরেকবার আঘাত করে। এখানে কেউ কাউকে দোষারোপ করার না থাকলেও আহানের বাবার মাঝে অনুতাপ বোধটা কেউ খেয়াল করতে না চাইতেও সকলের সামনেই বারবার উপস্থাপিত হচ্ছে। রিয়ার চেহারায়ও মাত্র কয়েক ঘন্টার দুশ্চিন্তা এবং দুঃখটা খুব বেশিই দৃশ্যমান। আহানের মা ইতিমধ্যে দুবার জ্ঞান হারিয়েছেন। এখন নিজেই পাশের কেবিনে ভর্তি হয়েছেন।

তিলো ডাক্তারের মুখে তাদের দুঃখিত হওয়ার খবরটা শোনার পর থেকেই এই পাঁচতলার শেষ মাথার বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে দুপাশে, দুই কেবিনের আরো দুটো ছোট ছোট বারান্দা আছে। তিলোর হাতের ডানপাশের বারান্দাটা যে কেবিনের, সেই কেবিনের ছেলেটির জন্মদিন ছিলো। বাচ্চাটি হয়তো ঘুমে অচেতন, যার জন্মদিন সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। বারবার তিলোর ভেতরটা মুচড়ে উঠছে। ও কারো মৃত্যু নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবতে পারে না। ভয়ংকর রকমের একটা অনুভূতি ওকে গ্রাস করে ফেলে, বিশেষ করে কম বয়সী কারো মৃত্যুতে। তিলো এজন্য প্রকৃতির এই মৃত্যু নামক নিয়মটার উপর ভীষণ নারাজ। ওর মনে হয়, কম বয়সী কারো মৃত্যু আসলে তার পূর্ণ অধিকার কেড়ে নেওয়া। জীবন তো সে একটাই পাবে। তবে কেউ কেন বেশি সময় এই সুন্দর পৃথিবীতে থাকতে পারবে আর কেউ কম সময়? এটা কি ধরনের বৈষম্য! তার কি এমন দোষ যে তার থেকে বেঁচে থাকার অধিকার বা ধীরে ধীরে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা কেড়ে নেওয়া হবে!

তিলোর মনে হয়, এমনকি ওর বিশ্বাস, আহানের হাতে বেশি সময় নেই। তিলো জীবনে এই প্রথমবার নিজের বিশ্বাস সঠিক হওয়ার অসফলতা কামনা করছে। সে হয়তো এবার ব্যর্থ হতেই বেশি খুশি হবে।

তিলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধ শহরটাকে স্থির নয়নে দেখে চলেছে। এই মূহুর্তে নিজেকে দার্শনিক মনে হচ্ছে তার। সে পর্যবেক্ষণ করছে শহরটাকে। আনিস সাহেব চলে গিয়েছেন। তিলো নিজেই ওনাকে জোর করে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিলো এখানে চুপিচুপি এসেছে, কারণ সে একা থাকতে চায়। ওদের কথাগুলো কানে যতোই যাচ্ছে, ওদের হাহুতাশ, ততই তিলোর নিজের মাঝে বুকের বোঝাটা ভারী হচ্ছে।

বাতিলকৃত পুরাতন নক্ষত্রপুঞ্জ, পতন ঘটেছে যাদের আসমান থেকে, পুনরায় সজ্জিত হয়েছে পৃথিবীতে নকশায় নকশায় আর রাস্তায় রাস্তায় আর টাওয়ারে টাওয়ারে আর বাড়িগুলোতে। হানা দিয়েছে সেখানে পোকারা। তারা আকৃষ্ট হয়েছে রঙবেরঙের বাতিতে।

হাসপাতাল, অদ্ভুত একটা জায়গা! কারো জীবনের সূচনা এখানে হয় তো কারো জীবনের সমাপ্তি। একটা জীবনে এমন অনেকের যাতায়াতই চোখে পড়ে। আচ্ছা, যে চলে যায়, তার অনুভূতি কেমন? কেমন লাগে, এই মায়াবী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে? কেমন লাগে সব ছেড়ে যেতে যদি সে মূহুর্তে সে সবকিছু অনুভব করতে পারে? হিংসা হয় কি যারা বেঁচে থাকে তখনও তাদের প্রতি? তিলো ছোটবেলায় হিংসা করতো ওর ছোটদের। ওর ধারণা ছিলো কেবল বৃদ্ধ হয়েই মানুষ একই সময়ে মারা যায়। তিলো যখন মারা যাবে তখনও ওর ছোটরা বেঁচে থাকবে!! খুবই হিংসাত্মক একটা বিষয়!
এখন বোঝে, সেগুলো কেবলই বোকামি। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় এটা করতো কেননা তখনও বাস্তবতা না চিনে ও বাবা মায়ের তৈরি সুরক্ষা বলয়ের ভেতর অবস্থিত নরম গদিতে রাজকন্যার মতো শুয়ে থাকতো। বাবা-মা যেন, আলাদীনের জিনি। তবে তার থেকে ভালো। আলাদীনের জিনিটা কেবল তিনটা ইচ্ছাই পূরণ করতে পারে। কিন্তু এই দুটো জিনি সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। জীবনটা কতো সহজ ছিলো!!

স্ট্রীটলাইটের উপরে সাদার উপর ফোঁটা ফোঁটা দাগে চিত্রিত পেঁচার বাচ্চাটা কুর্নিশে নিচু হয়েই আবার উঠে পড়লো একজন জাপানিজ ব্যবসায়ীর মতো অতি শিষ্ট আর অনবদ্য ঢঙে। তিলো একদৃষ্টিতে সেটার দিকে চেয়ে আছে। অনেকক্ষণ হয়েছে সে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের কিছু হিসাব কষে নিয়েছে ইতিমধ্যে। ভালোবাসাগুলো কি অসমাপ্ত থেকে যায়? শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘ভালোবাসা হলো অসংখ্য দীর্ঘশ্বাসের সমন্বয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা’। তবে তিলোর দার্শনিক মন আজ বলছে, ‘সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কখনো না কখনো অনির্ণেয় পরিমাণ নোনা পানিতে ডুবতে থাকা হাবুডুবু খেতে থাকা বাঁচার আকুতি নিয়ে ডুবন্ত অবস্থায় মুখ বাড়িয়ে শ্বাস নেওয়ার আকুলতা প্রকাশক মূমুর্ষু জীব।’
শেক্সপিয়ার আরো বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের ভালোবাসার পথ কখনো মসৃণ হয়না।’ ইহা একটি সত্য কথা বলে তিলো বিশ্বাস করে। আরো মনে করে, সে পথের শেষে খাদটাও সবসময় দৃশ্যমান থাকে না। পা পিছলে যেতে সময়ও লাগে না।

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে, পেঁচার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তার ভঙ্গিমাটি ফেরত দিয়ে তাকে বললো, ‘ওইয়াসুমিনাসাই (শুভ রাত্রি)।’

পরক্ষণেই মনে হলো, এটা ঠিক না৷ আসলে ও আর কখনো এখানে আসবে না। আর না ও আশা করে এই পেঁচাটির সাথে ওর আবার দেখা হবে। হয়তো এটাই শেষ বিদায়। তিলো নিজেকে সংশোধন করে বললো, ‘সাইয়োনারা (বিদায়)।’ যেটা ছিলো বাংলা এবং ইংরেজি বহির্ভুত আর কোনো ভাষা, আসলে জাপানিজ সম্ভাষণ যতোটুকু ও জানতো।

তিলো ফিরে এলো ভেতরে। পরিবেশটা থমথমে। একেকজন একেকরকম হতাশাপূর্ণ ভঙ্গিতে বসে আছে সেখানে। তিলো নিজে গিয়েও ওদের মাঝে বসলো। কিছুক্ষণ পরই সেখানে অরিকের আগমন ঘটলো। সে আহানকে দেখতে আসার পাশাপাশি তিলোর দ্বায়িত্বে এসেছে। অনি এখানে থাকলেও এই পরিবেশে কোনো দর্শনীয় দৃশ্যের উপস্থাপন ওর মাথায়ও আসছে না। সে একবার আড়চোখে অরিককে দেখে নিজের দৃষ্টি সংযত করে ফেললো।

রাত আড়াইটা থেকে আহানের অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করে। এদিকে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে। তিলো মূর্তির ন্যায় বসে আছে। তার চোখের সামনে এই প্রথম কারো মৃত্যু হতে চলেছে। এর আগে সে মৃত্যু পরবর্তী মৃতদেহ দেখেছে। কিন্তু মৃত্যুর মূহুর্তে উপস্থিত ছিলোনা। অরিক ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও সে রাজি হয়নি৷

রাত তিনটার দিকে আহান তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। মাল্টিপ্যারা মনিটরে তার ইসিজির হৃৎস্পন্দনের বন্ধুর সারিটা সোজা হয়ে গেলো। ক্ষীণ তীক্ষ্ণ আওয়াজটা এখন যেন বুক ছিদ্র করে দেওয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক। অক্সিজেনের বুদবুদ আর নেই। তার বুকটা আর ওঠানামা করছে না। মৃত্যুর কিছু মূহুর্ত আগে থেকে তার ডানহাতটা রিয়ার দুই হাতের মাঝে স্যান্ডউইচের মতো ধরা ছিলো।
আহানের মৃত্যু সংবাদটা বদ্ধ ঘরটা থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো প্লেগের ন্যায় দ্রুত। তিলোর কানে যখন সংবাদটা পৌছালো তিলো তখন পাশে একটা কাঁধ পেয়েছে যেখানে সে আশ্রয় পেতে পারে। যে জায়গাটার আশা সে করেছিলো আহান আর রিয়ার বিয়েরদিন তাদের জুটিটা দেখে। তিলো ভাবতেও পারেনি, যতদিনে সে সেটা খুঁজে পাবে, ততদিনে ওদের ভেতরকার ভাঙন দেখতে হবে। তিলো খবরটা নিতে পারছিলো না, পড়ে যেতে নিতেই অরিক ওকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরলো। তিলো ঘুরে দাঁড়ালো। অশ্রুসিক্ত নয়নে অরিকের মুখের দিকে একবার তাকালো। এরপর ওর প্রশস্ত বুকে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। শব্দটা অরিকের বুকেই আবদ্ধ থেকে গিয়েছে। অরিকও এবার তিলোকে শক্ত করে নিজের বুকে মিশিয়ে নিলো। এতোটা কাছে এই প্রথমবার তারা। কিন্তু সেই অনুভূতি অনুভব করার কোনো তাড়া তাদের ভেতর নেই।

রিয়া একদম চুপ করে বসে আছে আহানের ক্ষতবিক্ষত স্থির মুখটার দিকে তাকিয়ে। ওর শরীরের যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটা কেটে ফেলা হয়েছে। তার মস্তিষ্ক এবং হৃদয়। অনুভূতিহীন একটা পুতুল যেন সে।
আহানের মা এখনো জানেন না যে, তাঁর ছেলে ইতিমধ্যে পরলোকগমন করেছে। রিয়ার বাবা-মাও আজ ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। ওদের বন্ধুরা কারো চোখই শুকনো নেই। অনিকেত নিজের অজান্তেই রেগে সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আর বাকিদের অবস্থাও একই।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩২,,

“চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিধানের সাথে সাধারণ অভিধানের একটা অমিল হলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিধানে ‘নিশ্চিত’ শব্দটার কোনো স্থান এখনো নেই। কোনো চিকিৎসক বলতে পারে না যে, তার রুগী নিশ্চিত সেই সময়ই মারা যাবে বা বেঁচে থাকবে। তারা ধারণা দিতে পারেন যে, এই কয়েকমাস বাঁচবেন। তবে সুনির্দিষ্ট দিনটা কোনোদিনই বলতে পারেন না। যখন একজন রুগী মারা যাবে বলে তারা বুঝতে পারেন, তারা সরাসরি বলেন না যে মারা যাবেন। তারা বলেন, তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ওনার যা মন চায় খাওয়ান। দুটো গল্প বলি, সত্য ঘটনা একদম।

একজন হার্টের রুগী একদম শেষ মূহুর্তে চিকিৎসা করাতে গিয়েছেন। চিকিৎসক ওনার রিপোর্ট দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওনি মাত্র কয়েকমাসই বাঁচবেন। কোনো চিকিৎসা নেই ওনাকে সুস্থ করার। ওনি তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। রুগী সেটা বুঝতে পেরে হতাশ হলেও ওনি আরেকজন চিকিৎসককে দেখানোর কথা চিন্তা করলেন। দুদিন পর গেলেন আরেকজন চিকিৎসকের কাছে। সেই চিকিৎসকও ওনার রিপোর্ট দেখে মুখ গোমড়া করে ফেললেন, তবে রুগীর অগোচরে। এরপর রুগীর দিকে চওড়া হাসি নিয়ে তাকিয়ে প্রফুল্ল কন্ঠে ওনার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ‘আরেহ্, আপনার তো কিচ্ছু হয়নি। আপনি এখনো পাঁচ বছর বাঁচবেন। এটুকু অসুখে কারো কিছু হয় নাকি?’

রুগী সেটা বিশ্বাস করেই খুশি ছিলো। এবং অদ্ভুত বিষয় হলো, ওনি ঠিক পাঁচ বছরই বেঁচে ছিলেন তারপর। রুগীর আত্মীয় স্বজনরা বলতে লাগলো, ডাক্তার বোধহয় দশবছর বললে ওনি দশবছরই বাঁচতেন।”

কথাগুলো অরিক বলছিলো তিলোকে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে। দুমাস হয়ে গিয়েছে আহান চলে গিয়েছে। তিলো নিজের বিয়েটা স্থগিত করে রেখেছে। মানসিকভাবে নিজেও দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। অপূর্ণতার একটা ভয় জেঁকে বসেছে ওর মাঝে।

তিলোর বন্ধুমহলও হঠাৎই ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে আহানকে হারিয়ে। আসলে তারা আহানের সাথে সাথে রিয়াকেও হারিয়ে ফেলেছে। রিয়াকে আহানের মৃত্যুর পর থেকে আর ভার্সিটিতে দেখা যায়নি। এখন সে নিজের বাবা-মায়ের সাথে থাকে। একবার আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিয়েও সফল হয়নি। ঘর থেকে একদমই বের হয়না। কারো সাথে সে কোনো যোগাযোগও রাখেনি৷ ওর বাড়িতে গেলেও ও কারো সাথে দেখা করে না। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে ফেলেছে। আহানের মায়ের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। এখন সেই এলাকায় গিয়ে ওদের কথা জিজ্ঞাসা করলেই শোনা যায়, ওই যে পোলাডার মরণের পর মাথা খারাপ হইয়া গেছে যে মহিলাডার।

প্রাণোচ্ছলতা হারিয়ে ফেলেছে তারা। অরিকও তিলোকে সময় দিয়েছে নিজেকে সামলে ওঠার জন্য। অনিকেত ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছে। ফলে ওরা আরো গুমিয়ে উঠেছে।

অনি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করেনি। আহানের মৃত্যুতে ও নিজেও শোকাহত। তবে অরিকের বাড়িতে সেদিন ওর বাবার যাওয়ার পর থেকে ফাহমিদা বেগম অরিককে উত্ত্যক্ত করে চলেছেন। অরিক ওনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে আকবর সাহেবের পরামর্শে। কিন্তু এখন সেটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। যতোই হোক, ফাহমিদা বেগম অরিকের মা। অরিক তাকে যথেষ্ট সম্মানও করে। তিলো যত দেরি করছে, পরিস্থিতি অরিকের জন্য জটিল হয়ে পড়ছে।

তিলোর বন্ধুমহলের সকলে সে রাতের স্মৃতি চাইলেই ভুলতে পারবে না। সারাজীবন এটা বিড়ালের লেজে বাঁধা টিনের কৌটার মতো ঝনঝন শব্দে (উপমা স্বরূপ) পিছু করে বেড়াবে।

অরিক এই দুমাসে সরাসরি একবারও ওকে বিয়ের কথা বলেনি। তবে অরিকের প্রতিবাক্যেই পরোক্ষভাবে সেটা প্রকাশ পেয়েছে।
তিলো ওর কথাগুলোতে বিরক্ত কখনোই হতোনা। ও নিজেও বুঝতে পারতো, ঝামেলাটা আসলে ও বাঁধিয়েছে এবং একটা সম্পর্ক স্থায়ীভাবে স্থাপন করাটা আসলে অধিক সুরক্ষিত একটা ব্যাপার। তবুও তিলোর নিরবতা অরিকের জন্য ছিলো বিরক্তির কারণ।

তিলোকে চুপ করে থাকতে দেখে অরিক আবারও বললো,
-তিল, ঠিক আছো তুমি?

-হুম।

কথাগুলো বলতে নিজের ওষ্ঠজোড়া ফাঁকাও করে না তিলো। বর্তমানে তিলো একটু বেশিই চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গিয়েছে। ধাক্কাটা সামলে উঠলেও গভীর একটা ক্ষত রেখে গিয়েছে। যেমনটা হয়ে থাকে পোড়া দাগগুলো। ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে যায়।

-তুমি কি কিছু বলবে? (অরিক)

-গল্পটা আসলে আমার ভালো লাগেনি। (তিলো)

-এটা গল্প ছিলোনা। সত্যি ছিলো।

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-আমার একটা ক্ষুদ্র ধারণা তোমায় দেই? সে আসলে ডিসকাউন্ট অফার পেয়েছে।

অরিক থমকে গেলো ওর কথা শুনে। তিলোর এই হাইপোথিসিস সে আগেও শুনেছে। আহান যেভাবে আঘাত পেয়েছিলো, তাতে আসলে অনেকের ধারণা ওর স্পট ডেড হওয়ার কথা। এরপরও যতোটা সময় ও বেঁচে ছিলো, সেটা ছিলো ওর জন্য ডিসকাউন্ট। যেমনটা আমরা পেয়ে থাকি বড় বড় শপিংমলে বা কোনো পণ্য কিনে আরেকটা ফ্রী পেয়ে। এটা অনেকটা এমন যে, একটা পণ্য সে কিনলো। সে জানতো পণ্যটার দাম এতো হতে পারে। কিন্তু সে বিশ বা ত্রিশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পাওয়ায় তার নির্ধারিত টাকা থেকে কিছু টাকা বেঁচে গেলো। সেই টাকাটা সে বাড়ি ফিরে টিনের বাক্সে জমিয়ে রাখলো বা অন্য কিছু কিনতে পারলো। এভাবে সে জীবন থেকে ছেঁকে ছেঁকে কিছু সময় সঞ্চয় করে রেখেছে, যেটা ও ডিসকাউন্ট পেয়েছে। যেন সেই গানটার মতো, ‘If I could save time in a bottle’.
তিলোর এই অদ্ভুত ধারণায় অরিক তাজ্জব বনে গিয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। তার হায়াৎ যতোটুকু ততটুকুই তো সে বাঁচবে। কিন্তু তিলো নিজের ধারণাটা মজা করতে বানিয়েছিলো, তাও এতো গুরুতর একটা সময়ে এটাই অরিকের কাছে অদ্ভুত লেগেছে।

অরিক কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
-তিলো, আমার মা।

অরিকের আর কিছু বলতে হয়নি। কারণ অরিক জানে যে তিলো জানে যে অরিক জানে যে তিলো জানে।
হয়তো তিলোর আচরণ এতোক্ষণ অতিরিক্ত ছিলো। তিলো আশা করেছিলো, অরিক আরো আগেই ওকে হঠাৎই বলে উঠবে, ‘যেটা তোমার দরকার আসলে, আমি বলতে দুঃখিত হচ্ছি, সেটা হচ্ছে দুটো শক্ত চড়।’ কিন্তু অরিক সেটা বলেনি। সে ধৈর্য্য ধরে ছিলো। তিলোর আচরণ ওর পরিবারের কাছেই বিরক্তিকর ছিলো। অরিক অধিকারপ্রবণ নয় বরং খুব বেশি সহযোগিতাপূর্ণ। অরিক জীবনসঙ্গী হিসাবে যথেষ্ট অপেক্ষা অধিক। সে যত্নশীল এবং অনুগত সম্পর্কটার প্রতি। তিলোত্তমার মতামতকে সমর্থন করার পাশাপাশি তাকে গুরুত্ব দেয়। আহানের মৃত্যুটার প্রভাব ওর উপর যতোটা না পরেছে ও আরো বেশি ভেবে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলো।

আজ অরিকের কন্ঠের আকুলতা একটু বেশিই। তিলো ভেবেছে কিছুদিন ধরে। জীবন আসলে থেমে থাকে না। ওকে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে তিলো দুফোঁটা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,
-আর দেরি করার প্রয়োজন নেই অরিক। আমরা এগিয়ে যেতে পারি।

তিলোর বাক্যদুটো ছিলো একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত। অরিক যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কিন্তু এরপরও দ্বিতীয়বার ও জিজ্ঞাসা করলো না। ওকে বিরক্ত করতে চায়না নিজের কথা দিয়ে। তিলোর মেজাজটাও এখন নিয়ন্ত্রণে থাকে খুব কমই। প্রতিটা মানুষই নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে নিয়েছে। সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে চলেছে। অরিক উৎফুল্ল কন্ঠে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন কেটে দেওয়ার আগে তিলো আবারও বললো,
-দয়া করে খুব সাদামাটাভাবে এটা হোক। আমি কোনো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান চাই না।

অরিক ওকে আশ্বস্ত করলো যে, সে নিজেও চায়না। তিলো বললো,
-তোমার জন্য আনন্দময় রাত্রি কামনা করছি।

অরিক মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর করলো,
-তোমার জন্য তার কয়েক গুন।

এরপর একে অপরকে বিদায় জানিয়ে ফোন কেটে দিলো তিলো। কতো সময় আমরা কতো ভাবে কাটিয়ে দেই। কিন্তু তাদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে এমন কিছু মূহুর্ত যেগুলো ওলটপালট করে দিতে পারে পুরো জীবনের ছন্দ। ছন্দময় গতিটা রুদ্ধ করে দিতে পারে। একটা মানুষের জীবন। কিন্তু ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে বহু জীবনের উপর তার প্রভাব পড়তে পারে। কতোটুকু সময় ছিলো সেটা যখন আহান আঘাতটা পেয়েছিলো। এক মিনিট? নাকি তারও কম? কিন্তু নাড়িয়ে দিয়েছে ভীতগুলো। মানসিকভাবে আঘাত করেছে, তিলোর মতো অতি আবেগি ব্যক্তিগুলোকে। মানুষকে বাঁচতেও সমাজে থাকতে হয়। কিন্তু গাছের মতো যে শিকড় এতোটা গভীরে গিয়ে নিজের বেখেয়ালিপনার মাশুল গুনতে হয় সেই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া প্রতিটা মানুষকে। সেই গাছ থেকে প্রাপ্ত ফলগুলোর আশায় থাকা মানুষগুলোকে। অদ্ভুতভাবে পরিবেশ বদলে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে মাত্র কিছু মূহুর্তের। গুমোট পরিবেশটায় শ্বাস নিতেও ভয় হয়। হয়তো নিশ্বাসের বাতাসে তাসের ঘরের ন্যায় চারপাশ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।

জোসনার ছদ্মবেশ নেওয়া নিয়ন কর্কশ আলোকধারা জানালার গ্রীলের ফাঁক গলে বয়ে এসে তিলোর শরীরে পড়ছে। তিলো শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যতোটুকু দৃষ্টিসীমার মাঝে পড়ে ততটুকু আকাশ। তিলো চিন্তাও করতে পারে না, রিয়ার পরিস্থিতি। ও ঠিক সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কাছের মানুষগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকাটাও একটা কাঁচের পাত্র হাতে নিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তায় হিল জুতায় খটখট শব্দ তুলে হাঁটার মতো। সংবেদনশীল প্রতিটা স্পর্শ। যত্নশীলতা না শিখে কখনোই সেই সম্পর্কে জড়ানো উচিত নয়। সম্পর্কটার পাশাপাশি মানুষটার চারপাশেও গড়ে তুলতে হয় সুরক্ষা দূর্গ। সেটা তার দ্বারাই উদিত হবে সগর্বে। তার সাথে তার পরিখা, কামানের প্রকোষ্ঠ, মাটির তলায় লুকানো বন্দীশালা, সেই দূর্গের অনাবশ্যক অলংকৃত ঘরগুলো। মানুষটাকে কেবল অর্জন করলেই হয়না। তাকে ধরে রাখার কৌশল জানতে হয়।

‘হেথায় শ্বাস নাও খুব ধীরে, কারণ ভঙ্গিরতায় পূর্ণ সব।’
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৩,,

আজ শুক্রবার। সকাল থেকেই আশাকুঞ্জ-এ মোটামুটি ব্যস্ত একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দুপুরে অরিকের পরিবার থেকে হাতেগোনা কয়েকজনই আসবে। বাদ পড়ে যাওয়া অতিথিদের মধ্যে রয়েছে ফাহমিদা বেগম। আকবর সাহেব সরাসরি ওনাকে আসতে নিষেধ করেছেন। সাথে সাথে ফাহমিদা বেগমের বাপের বাড়ির লোকজনকেও ওনি নিমন্ত্রণ করেননি। অরিকের নানাবাড়ির দিক থেকে নানা এবং একজন মামাই আসবেন। তিলোর নানাবাড়ির দিকের প্রায় সকলেই রয়েছে। নানা, নানী, দুই মামা তাদের স্ত্রী সন্তান নিয়ে আর খালা ওনার পরিবার নিয়ে আছে। তিলো নিজের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছে। তারা সকলে পরিবার নিয়ে আসলেও অনি আসেনি৷ তবে অনির মা আর আয়াশ এসেছে।
অনিমার মা বেশ লজ্জিত সেদিন অরিকের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া নিয়ে। অনি তাদের বলেনি তখনও যে ইতিমধ্যে অরিকের সাথে তিলোর বিয়ে ঠিক হয়ে ছিলো। অনি কেবল গিয়ে ওর বাবাকে বলেছিলো যে, ওর কাউকে ভালো লাগে আর ও তাকে বিয়ে করতে চায়। অনির বাবাও ছেলের পরিচয় পেয়ে যখন দেখলেন যে, এবার আর অনি ভুল কোনো মানুষকে বেছে নেয়নি তখন তিনি মেয়ের খুশির জন্য কোনোকিছু চিন্তা না করেই চলে গিয়েছিলেন সেদিন। সে বিষয়ে পরবর্তীতে তাঁকে কেউ আর লজ্জা দেয়নি। অনুষ্ঠানটা একদমই সাদামাটাভাবে হলেও সেটার নূন্যতম প্রাণ ছিলোনা। সকলের মাঝেই এক অদ্ভুত ধরনের বিষন্নতায় ছেঁয়ে ছিলো। হয়তো বিষন্নতা একধরনের ছোঁয়াচে রোগ। তিলো এবং ওর বন্ধুমহলের বিষন্নতাই মুখ্য কারণ ছিলো এসবের পেছনে।

তিলো বেশি সাজেনি। একসময় কল্পনা করতো নিজের বিয়েতে সে কতোটা সাজবে, কিভাবে সাজবে, কতোদিন ধরে অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু সেসবের আসলে কিছুই হয়নি। অরিক পছন্দ করে ওকে যে শাড়িটা কিনে দিয়েছে, তিলো সেটাই পড়েছে। বিয়েরদিন হিসাবে তার অবস্থাটা বলা যায় ‘হতশ্রী’, যে শব্দটা ব্যবহার করা যাবে তাকে বর্ণনার জন্য। তার চোখের দিকে তাকালে যার মুখোমুখি পড়তে হয় তা হলো ‘শূন্যতা’। তিলোর মাঝে একটা অবচেতন ভয় আছে, ভালোবাসার পূর্ণতা এবং তাকে ধরে রাখার বিষয়ে। সে নিজের ভেতরে ভয়টা ধারণ করেই এই বিয়েতে এগিয়ে চলেছে।

ইমন এসেছিলো। কিন্তু তুলির সাথে একদমই কথা বলেনি। ব্যাপারটা তুলিকে নতুন করে আরেকবার আঘাত করলো। তিলোকে নিজের বোকামির কথা বললেও তিলো কেবল তাকে বলেছে, সুন্দরীরা আসলে বোকা হয়। তুলি প্রচলিত এসব কথার উর্ধ্বে নয় একেবারে। তুলি সুন্দরী। বিধায় সে যথেষ্ট বোকা। যেসকল সুন্দরী রূপের সাথে বুদ্ধিমত্তাও পায়, তারা আসলে বিশেষ কেউ হয়ে থাকে। বিউটি উইথ ব্রেইন। তুলি তেমন নয়৷ সে তুষারের ভাষ্যমতে ‘গর্ধব’ মস্তিষ্কের অধিকারী। তিলো ওকে আনিস সাহেবকে সবটা খুলে বলতে বলেছে। এতে আনিস সাহেব রেগে গেলেও কোনো উপায় বের করতে পারবেন। ওই যে, আলাদীনের চেরাগের জিনি। হুকুমের অপেক্ষা। এরপর যেভাবেই হোক, সকল সমস্যা দূর হয়ে যায়। বাবা-মা এভাবে বলে না যে, ‘হুকুম করুন মালিক’। বরং তারা আদুরে স্বরে কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞাসা করতে থাকে, ‘কিছু খাবি? মন খারাপ? কেন খারাপ? আমাকে বল। কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো? ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আরো মধুর কন্ঠে। বলার ভঙ্গিমায় আনুগত্য থাকে না বরং সেটা অপেক্ষা অনেক বেশি কিছু থাকে। থাকে স্নেহ এবং মমতা, যাকে বলা যেতে পারে জীবনে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ কিছু।

তুলির আসলে তাঁকে জানানো প্রয়োজন। এভাবে কতোদিন থাকবে? এখন তো তিলোর ভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছে। ক্লাস করে। আনিস সাহেব যদিও বলেছেন, তিলোর বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে ওকে নিয়ে নতুন কিছু ভাববেন। তুলি চাইলে পড়াশোনা শেষ করতে পারে। এরপর কোনো কাজে ভিড়তে পারে। আবার চাইলে আরেকবার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার পরিকল্পনা করতে পারে। এটা এখন সম্পূর্ণ তুলির ইচ্ছাধীন।
তবে তুলির সবেতে ভয়। ভীষণ ভয়।

আশাকুঞ্জের ছাদে এবং সামনের ছোট বাগানটায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আতিথেয়তায় কোনোপ্রকার ত্রুটি আনিস সাহেব রাখেননি। নাসীরা পারভীন খানিকটা অসন্তোষ হলেও সেটা প্রকাশ করেননি। নিজেকে বুঝিয়েছেন, নিজের মেয়ে যেখানে ভালো থাকবে, সেখানে ওনার অসন্তুষ্টিতে কিই বা যায় আসে?

সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান শেষে বিকালের বিদায়বেলায় তিলো নিজের আপনজনদের জন্য কেঁদেছে ঠিকই। তবে হয়তো সে ক্লান্ত এই কয়েকদিনের জীবনধারার সাথে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে নিজের আবেগের সাথে। কারণ ইতিমধ্যেই সে নিজের আবেগগুলোর সাথে স্বঘোষিত যুদ্ধে কয়েকবার পরাজিত হয়ে মারা গিয়েছে। এখন সে অপেক্ষায় রয়েছে নিজের মৃত্যু অপেক্ষা গুরুতর কোনো নাটকের অপেক্ষায়।

তার বিদায় প্রক্রিয়াটা একদমই যেন তার ঘোরের মাঝে ছিলো। সে আসলে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে সত্যিই সে তার জন্মস্থান, তার শৈশব কাটানো বাড়িটা, তার আপনজনদের ছেড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিলো, আশেপাশের পৃথিবী ঘুরছে। সে স্বপ্ন দেখছে না হলে অন্য জগতে রয়েছে। পুরো প্রকল্পের বাস্তবায়নটা হয়তো খুবই দ্রুত ঘটেছে বা হয়তো খুব ধীরে। তিলো ঠাহর করতে পারলোনা কোনটা। ছবিটা ছিলো একদম পরিষ্কার আর শব্দগুলো ঠিকঠাকই ছিলো। তুষার ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে তিলো অনুভব করলো সে আসলে বিরক্ত হয়েছে। কেন? তা ওর জানা নেই। হয়তো ওকে ওর বিদায়টা বুঝিয়ে দেওয়াটা ও মেনে নিতে পারছিলো না। পুরো পরিস্থিতিতে মনে হয়েছে সে কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় মানুষগুলোকে সে আসলে মজা দিচ্ছে। যেটা সে চায়না। পুরো চিত্রনাট্য একদম ঠিক থাকলেও, কোথায় জানি একটা দূরত্ব ছিলো। কিছু একটা ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারা যাচ্ছিলো না। অনেক পেছনে অনুভূতিরা হামাগুড়ি দিয়ে আসতে লাগলো।

তিলোর গন্তব্য ছিলো অরিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটা পর্যন্ত। তাকে সাদরে গ্রহণ করতে উপস্থিত ছিলো অরিকের খালা (ফাহমিদা বেগমের স্থান দখল করে) এবং মামীরা। তিলো তাদের কানাঘুঁষাও শুনতে পেলো। তবে কেউই ওকে সরাসরি আক্রমণ করলোনা। কারণ তারা সেটা করার ক্ষমতা রাখেনা। তিলো অরিকের ছোট্ট মামাতো বোনটার মুখে ওকে ‘নিগ্রো’ বলতে শুনলো, যাকে কিনা দ্রুত তার মা কোলে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এবং পরবর্তীতে তিনি ছিলেন লজ্জায় মর্মাহত, সকলের দিকে ফিরলেন একটা সাহসী হাসি নিয়ে এবং তার কোলে থাকা পরিবারের সবচেয়ে নতুনতম সদস্যটিকে নিয়ে বললেন,
‘আমাদের অরিকের বউ তো দেখি অতি শান্তশিষ্ট।’

তিলোর কোনো অনুভূতি কাজ করলোনা তার সম্পূর্ণ কাজটার প্রতি। তার কোনো ক্ষোভ ছিলোনা বাচ্চাটার প্রতি আর না শিশুটির প্রাপ্ত শিক্ষাটার প্রতি। অতি সাধারণভাবেই তাকে ঘরে তোলা হলো। অরিকের অন্যান্য টিনএজ, প্রাপ্ত বয়স্ক কাজিনরা হয়তো আরো কিছুক্ষণ তাদের বিরক্ত করতো। কিন্তু এখানেও হয়তো অরিকের নিষেধাজ্ঞা ছিলো।
তিলোর এখন নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। সে যতোটা ব্যথিত, তার থেকে অনেক বেশিই সকলের সামনে প্রকাশ করেছে। যেহেতু অরিক ওর প্রতিটা বিষয়েই সংবেদনশীল। তাই সেই অতিরঞ্জিত বিষয়টাকেও একইরকম গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। ফলাফল, এখন হয়তো অনেকের অনেকদিনের পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেওয়া। তারা হয়তো অরিকের বিয়েটা নিয়ে কিছু না কিছু ভেবে রেখেছিলো। সেসবই অধরা থেকে গেলো।

বাসরঘরটাও সাদামাটাভাবেই সাজানো হয়েছে। তবে সেটা তিলোত্তমার পছন্দের হলুদ গোলাপে। তিলোর জানে না এই সময় একটা মেয়ের আসলে অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত। তবে সে একদমই অনুভূতিশূন্য ছিলো তা নয়। সে অনুভব করছে ঠিক না। সে গবেষণা করছে। চিন্তা করছে। অরিক ওর পরিচিত বিধায় একধরনের অনুভূতি হচ্ছে। যখন একটা মেয়ে তার নবস্বামীকে একদমই চেনে না তখন তার আরেক ধরনের অনুভূতি হয়। যখন কেউ কয়েকবছর প্রেম করে বিয়ে করে তখন তার আরেক ধরনের অনুভূতি হয়। তিলো নিজেকে সেই প্রতিটা অবস্থানে কল্পনা করে মনে মনে দুটো ব্যক্তি সেজে কথা বলছে, কারণ তার হাতে আর কোনো কাজ নেই কল্পনা ব্যতীত। সবচেয়ে মজা পেয়েছে একদম অপরিচিত কারো বউ হিসাবে নিজেকে কল্পনা করে। সে জানে না তার স্বামী কেমন? সে কি রাগী নাকি শান্ত হবে? তার সিদ্ধান্তের গুরুত্ব দেবে? কি রোমাঞ্চকর!!

তিলো সেই রোমাঞ্চ অনুভব করে পুলকিত। অরিক হয়তো অপরিচিত হলে বেশি ভালো হতো।

ওর ভাবনার মাঝেই অরিকের সেই কক্ষে আগমনে তিলোর ভাবনার ঘুড়িটা ভোকাট্টা হলো। এতক্ষণ একধরনের অনুভূতি হলেও অরিকের আগমনে পুরো পরিস্থিতি যেন পাল্টে গেলো। দরজাটা বন্ধ করার শব্দে তিলো মৃদু কেঁপে উঠলো। এতক্ষণ একরকম ভাবলেও তিলো এখন বুঝতে পারছে, সেগুলো নিতান্তই অমূলক ছিলো। তিলো অনুভব করলো, ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের উপরে অরিকের পরোক্ষ হস্তক্ষেপ রয়েছে। অরিকের প্রতি পদক্ষেপে তিলোর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। গভীরভাবে সে নিশ্বাস ফেলছে। তিলো উঠে দাঁড়িয়ে অরিককে সালাম দিলো। অরিক গম্ভীর কন্ঠে তার উত্তর দিয়ে এমন একটা অপ্রত্যাশিত আবদার করলো যেটা তিলোর জন্য একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। অরিক ওকে ছাদে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। তিলো নিজের ঘোর কাটিয়ে সম্মতি দিতেই রুমের বিছানার তলা এবং কাবার্টের নিচে থেকে তিনটা ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এসে প্রায় চিৎকার করে নিজেদের ব্যর্থতা প্রকাশ করে বললো,
-ভাই এটা কি হলো? সব ভেস্তে দিলি!

অরিক যুবতী মেয়েটার (যে আলমারি থেকে বেরিয়েছে) কান টেনে দিয়ে বললো,
-তোরা যে আমার বাসর ভেস্তে দিতিস, তার বেলায়?

মেয়েটা কান ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
-লাগছে তো। ছাড়। কিছুই তো করতে দিলি না। বাজে লোক একটা! এতেও সমস্যা। না হলে তোদের প্রেম করা দেখতাম রাত জেগে।

অরিক তখনও ছাড়েনি ওর কান। এবার আরেকটা ছেলে (যে খাটের তলা থেকে বেরিয়েছে) মেয়েটার কান ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-ভালো হয়ে যাও মাসুদ। ভালো হতে টাকা লাগে না।

অরিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কথাটা আমার তোদের বলা উচিত। বোকারদল কোথাকার!
তিলোর হাত ধরে বললো,
-চলো তিল। এই চিরিয়াখানার জীবগুলো দেখে শান্তি নেই। তোমাকে মিরপুর চিরিয়াখানায় নিয়ে যাবো।

তিলো এতক্ষণ ওদের কাহিনি দেখে মুখ টিপে হাসছিলো। আফসোস হচ্ছে, তুষারটা ওর ছোট। নাহলে ও নিজেও এই কাজটা করতো। ইতিমধ্যে তিলো ঠিক করে ফেলেছে অভ্রের বাসরে সে এমন কিছু করবেই করবে। অরিক ওর হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে পেছন থেকে আরেকটা ছেলে (সেও আলমারি থেকে বেরিয়েছে) বলে উঠলো,
-এখন তো ভাবিকে পেয়ে আমাদের চিনিসই না। যাও, যাও। সময় আমাদেরও আসবে।

অরিক ওদের দিকে না ফিরেই বললো,
-সে সময়গুলোও এখনের মতো দুঃসময় হয়ে যাবে। টা টা।

তিলো পুরো বিষয়টা বেশ উপভোগ করেছে। আসলে সে এইধরনের মজাগুলো আগে কখনো করেনি। প্রথমবার এমনটা হওয়ায় ও আনন্দই পেয়েছে।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here