#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৩
ভাগ্য জায়িনের সহায় হলো। মীরার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার আগেই জায়িনের ফোন বেজে উঠল। ফোনের ওইটুকু আলো দিয়েই জায়িন ড্রয়িংরুমটা দেখে নিল। মীরাকে নিয়েই এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নিল। আবির বোনের চিন্তায় অস্থির করে জায়িনের কল করছে। জায়িন কল তুললো। আবিরের উত্তেজিত কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
“জায়িন মীরা তোদের ওখানেই তো? ওকে বৃষ্টিতে একা বেরুতে দিছসনি তো?”
জায়িন শান্ত গলায় জবাব দিল,
“মীরা আমার কাছেই আছে। ওর কিছু হয়নি।”
“থ্যাংক গড! বাহিরে যে পরিমাণ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা এটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম মীরা হয়তো রাস্তায় কোথাও আটকা পড়েছে। রাত হলেও ওকে আসতে দিস না। ঝড় কমলে আমি এসে নিয়ে যাব। ওকে একটু দেখিস ভাই। বাজ পড়লে মীরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।”
“হুম।”
আবির কল কেটে দেওয়ার পরও মীরা জায়িনকে ছাড়ছে না। সে আগের মতোই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জায়িনকে ধরে রেখেছে। মীরার দ্রুত চলা একেকটা শ্বাস-প্রশ্বাস জায়িনের বুকে বাড়ি খাচ্ছে। মাথাটা একটু নিচু করতেই মীরার চুল থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো। নিশ্চয় শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। বুকের বাঁ পাশে ঠিক যেখানটায় হৃদয়ের অবস্থান, জায়িনের শার্টের ওই অংশ মীরার হাতের মুঠোর ভেতর দলা পাকানো। মেয়েটা কি তার ভেতরের উথালপাতাল অনুভূতির আন্দোলন টের পাচ্ছে? জায়িনের হাসফাস লাগছে। বাইরে তীব্র বাতাস গাছগাছালি উড়িয়ে নিয়ে গেলেও জায়িন এই ঘরের ভেতর পর্যাপ্ত বাতাস পাচ্ছে না। জায়িন চোখ বন্ধ করে নিয়ে গভীর ভাবে দম টানলো। বাইরের ঝড়ের সাথে তার নিজের ভেতরও একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড় প্রকৃতির ঝড়ের থেকেও ভয়ংকর রুপ ধারণ করার আগে কিছু করতে হবে। জায়িন নরম গলায় মীরাকে ডাকল।
“মীরা! মীরা, একবার চোখ খুলে দেখো। ভয়ের কিছু নেই। মীরা!”
না। মীরা নিজেও ঘোরের মধ্যে আছে। এভাবে কাজ হবে না ভেবে জায়িন শক্ত হাতে মীরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে হুঁশে আনতে চাইল।
“মীরা, আলো এসেছে। এখন আর ভয় পেতে হবে না। মীরা!”
জায়িনের কঠিন গলায় ধমক খেয়ে মীরার হুঁশ ফিরেছে। সে নিজের করা কাণ্ডের কথা মনে করে ভয়, লজ্জা, অস্বস্তিতে জায়িনের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারল না। লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে বেচারি। জায়িন ওর বাহু ছেড়ে দিল। এবং মীরাকে কিছুই না বলে কোথাও চলে গেল। জায়িন যেতেই মীরা ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। এটা কী করেছে সে? তাকে দিয়ে এটা কী হয়ে গেল! জায়িন ভাই তাকে কী ভাবছে? মীরা কেন বুঝলো না। নিশ্চয় জায়িন ভাই তাকে বাজে ভাবছে। লজ্জায়, নিজের উপর ঘৃণায় মীরার চোখে পানি এসে গেছে। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেলল। সে তো জানে, ইচ্ছে করে এটা করেনি সে। ভুল করে হয়ে গেছে। কিন্তু জায়িন ভাই কি বুঝবে?
পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতে মীরা ভয় পেয়ে ছিটকে সরে যেতে নিল। কিন্তু ততক্ষণে সে বাধা পেলো। মীরা বিস্ফোরিত চোখে জায়িনকে দেখতে লাগল। জায়িন একহাতে তার পা ধরে আরেক হাতে বরফ ঘষে দিচ্ছে। মীরা ভুলেই গিয়েছিল তার পায়ে গরম চা পড়েছে। ব্যথাটাও এতক্ষণ ছিল না। কিন্তু জায়িন ভাই ভুলেননি! তিনি মীরার পায়ে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছে। অস্বস্তিতে মীরা ছটফট করতে লাগলে জায়িন কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে ধমক দেওয়া গলায় বলল,
“সমস্যা কি? চিংড়ি মাছের মতো এরকম ছিট পারছো কেন?”
মীরা গলা দিয়ে কোন শব্দই বের করতে পারল না। অনেক চেষ্টার পর চিউচিউ করে বলল,
“আপনি আমার পা ধরছেন…
ওকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে জায়িন রাগী চোখে দেখল। ব্যস। মীরা এতেই আবারও কথা হারিয়ে ফেলল। বরফ লাগানো শেষ হলে জায়িন মীরাকে বসিয়ে রেখে রুম থেকে মলম নিয়ে এলো। এবার মীরার পায়ে লাগাতে নিলে মীরা পা সরিয়ে নিয়ে অসহায় মুখে বলল,
” আপনি আমার পা ধরছেন। আমার পাপ হবে। আপনি দিন। আমি নিজে লাগিয়ে নিতে পারব।”
জায়িন মীরার কথায় কানই দিলো না। উল্টো নিজেই মলম লাগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করল,
“পাপ হবে কেন?”
“আপনি আমার বড় না!”
“পাপ হবে না। আর হলেও, তুমিও আমার পা ধরে পাপ কাটাকাটি করে নিও।”
জায়িন ভাইকে সে সবসময় বদমেজাজি, গোমড়ামুখো বলে আসত। কিন্তু এই গোমড়ামুখো লোকটার ভেতরেই যে আরেকটা কত ভালো মানুষ লুকিয়ে আছে তা এতদিন দেখতে পারেনি। আজকের জন্য মীরা সত্যিই জায়িন ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল,
“ধন্যবাদ।”
“কেন?”
“বরফ ও মলম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“শুধু একটা ধন্যবাদে কাজ হবে?”
মীরা এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেও এই কথা শুনে চকিতে লোকটার দিকে তাকাল। জায়িন মীরার দিকেই তাকিয়ে ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি রেখে বলল,
“আরও তো অনেককিছু করেছি। চা বানিয়ে খাইয়েছি। অন্ধকারে ভয় পাওয়া থেকে বাঁচিয়েছি। ওসবের জন্য ধন্যবাদ দিবে না?”
এই লোকের কথা শুনে মীরা হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। সুযোগের ব্যবহার করে তাকে এভাবে খোঁচা মারছে! এমনিতেই তো সে নিজের কাজে লজ্জিত। এখন কি তা মনে করিয়ে দিয়ে আরও লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? আচ্ছা অধিক লজ্জায় কি মানুষ মারা যেতে পারে? তাহলে নির্ঘাত পৃথিবীতে আজই তার শেষ দিন। এত লজ্জা নিয়ে কিছুতেই সে বাঁচতে পারবে না।
…
মীরা অর্ধভেজা শরীরে আবিরের পেছনে বাড়ি ঢুকতেই বড়মার ক্রোধের সামনে পড়তে হলো। মীরা জানে এটা বড়মার রাগ না। তার জন্য বড়মার অস্থিরতা, চিন্তা। বাইরে এখনও সমান তালে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। জায়িন ভাইদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেট পর্যন্ত আসতে আসতেই ভিজে গেছে। গাড়িতে বসে পুরো পথ আবির ভাই বকাঝকা করেছে। এখন বাড়ি ফিরে বড়মা!
“কাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি তুই? কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলি?”
মীরা মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইল। বড়মা উত্তর না পেয়ে আরও রেগে যাচ্ছে।
“আজকে পড়া দেখাচ্ছিলি? সারাবছর যে মেয়েকে ঠেলে ধাক্কিয়ে প্রাইভেটে পাঠানো যায় না সে মেয়ে আজ ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে পড়তে চলে গেল!”
ছোট চাচীও আজ মীরার বিপক্ষে বলছে।
“কেন গিয়েছে জানেন না ভাবী? বাড়িতে থাকলে কি বৃষ্টি হলে ভিজতে দিতাম? ইচ্ছে করে এমন দিন দেখেও প্রাইভেটে গেছে যেন রাস্তায় বৃষ্টি শুরু হলে ভিজে আসতে পারে।”
ভেজা কাপড়ে মীরার শীত লাগছে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ধমক খেলো। মীরা ঠোঁট উলটে আবিরের দিকে দেখলো। যতই হোক আবিরকে তো বোনকে বাঁচানোর জন্য কিছু বলতেই হবে।
“মামী ওর বিচার তো এখনও কিছুই হয়নি। সব বিচার বাকি আছে। আগে ওকে রুমে গিয়ে কাপড় পালটে আসতে দাও। তারপর লম্বা সময় নিয়ে বিচার বসবে।”
দু’জনই দেখল সত্যিই মীরা ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে আরও ধমক দিল।
“এখন ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জ্বর বাধাতে? জ্বর এলেও তো আমাদেরকেই ভোগাবি। রুমে গেলি না এখনও!”
মীরা চ্যাল চ্যালিয়ে রুমে চলে গেল। যাক বাবা, আবির ভাই এযাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। মীরা চেঞ্জ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এতক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলেও প্রকৃতিতে এখনও রেশ লেগে আছে। ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছে ভীষণ। মীরা অন্যমনস্ক হয়ে মাথা মুছতে মুছতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও এমনিই তাকিয়ে থাকা। মাথা মুছতে মুছতে মীরা মনে করছে আজ কী কী হয়ে গেল। জায়িন ভাইও তাকে মাথা মোছার জন্য এরকম একটা তোয়ালে দিয়েছিল। বিকেলের পর থেকে যা যা ঘটে গেছে তা মীরার কল্পনার বাইরে ছিল। সে যদি জানত মুবিন ভাই বাড়িতে নেই তাহলে কি জীবনে ওখানে যেত? আর গিয়েছিল ঠিক আছে। জায়িন ভাইদের একটা ছাতা থাকলে কি এসব কিছু হতো? না সে ওখানে থাকত, না ওই ঘটনা গুলো ঘটতো। ছাতা ছাড়া চলে এলেও বাড়িতে এসে বকাও খেতে হতো না।
“সব দোষ আপনার জায়িন ভাই। আপনি আবির ভাইয়ার কথা শুনে আমাকে জোর করে আটকে রেখেছেন।”
কনকনে ঠান্ডা বাতাসে মীরার শীত লেগে যাচ্ছে। সে ব্যালকনি থেকে রুমে ফিরে এলো। এখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। কোথায় কোন তার টার ছিড়ে গেল না তো? বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেলে আজ রাতে আর কারেন্ট আসবে বলে মনে হয় না। ঘরের জানালা খোলা ছিল। পর্দাগুলো বাসাতে উড়ছে। মীরা সব জানালা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা মাথায় পড়েছিল বলেই মনে হচ্ছে সর্দি লেগে গেছে। অলরেডি কয়েকবার হাঁচিও দিয়ে ফেলেছে। আজকের ঠান্ডা আবহাওয়া দেখেই মীরা কম্বল নামিয়েছে। এখন তার কিছু করার নেই। নিচে গেলেই বকা খাবে। তাই মীরা বিছানা উঠে পড়ল,
“চল ভাই মীরা, খিচুড়ি খাওয়ার ওয়েদারে তোর কপালে আছে বকা। তাই বকা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে মীরা শুয়ে পড়ল। কয়েকবার এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমঘুম ভাব এসে গেল। পুরোপুরি ঘুম চলে আসার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
চলবে..#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৪
মীরা প্রচণ্ড বেগে দৌড়াচ্ছে। সে যত জোরেই দৌড়াতে চাচ্ছে ততই যেন পিছিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক জায়গায় থেমে আছে। একটুও এগোতে পারছে না। তার পেছনে কুচকুচে কালো কয়েকটি কুকুর তাড়া করেছে। মীরা কুকুরের হাত থেকে বাঁচতেই জানপ্রাণ দিয়ে ছুটছে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। পা মাটির সাথে আঠার মতো লেগে আছে। কুকুর গুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। মীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু গলা দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না। মীরা সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চাচ্ছে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। কুকুর গুলো মীরাকে কাটতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বাজ পড়ছে। বৃষ্টি শুরু হলে মুহূর্তেই মীরার চারপাশে পানি জমে গেল। মীরার হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। কুকুর গুলো ভিজে চুপচুপে হয়েও তাকে কামড়াতে চাচ্ছে। গলা দিয়ে শব্দ না বের হলেও মীরা চিৎকার করে গলা ভেঙে ফেলেছে। মীরার মনে হচ্ছে আজই তার শেষ দিন। কুকুর গুলো তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। মীরার এই ভাবনার মাঝেই জায়িন ভাই এসে হাজির হলো। কুকুর তাড়ানোর জন্য জায়িন ভাইয়ের হাতে কফির মগ! জায়িন ভাই হিরোর মতো মীরার সামনে এসে বলল,
“আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই, জানপাখি!”
বলেই জায়িন ভাই কুকুর গুলো দিকে হাতে থাকা মগটা ছুড়ে মারলো। কুকুর গুলো ভয় পেয়ে ঘেউঘেউ করতে করতে পালিয়ে গেল। মীরা জায়িন ভাইকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল,
“তুমি এসেছ কলিজা? আমি জানতাম তুমি আসবে।”
ঠিক তখনই ঠাস করে ওদের উপর বজ্রপাত হলো। মীরা লাফিয়ে উঠে বসলো। এই শীতল আবহাওয়ায়ও ঘামছে বেচারি। আতঙ্কিত চোখে আশেপাশে দেখতে লাগল। নিজের ঘরে আছে বুঝতে পেরে ফোঁস করে দম ফেলল।
“আল্লাহ! মাবুদ, এটা কী দেখেছি আমি? কী দেখালে তুমি আমাকে?”
দরজা জানালা বন্ধ বলেই রুমে বাতাস আসছে না। বৃষ্টি থেমেছে মনে হয়। মীরা কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছলো। কয়টা বাজে এখন? রুম অন্ধকার থাকায় ঘড়িতে সময় দেখতে পারল না। ফোন খুঁজে বের করে সময় দেখল। মাত্র আটটা বাজে। এই সন্ধ্যা রাতে ঘুমিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখল!
“আল্লাহ। এখন থেকে আমি দিনের বেলা শোয়ার আগেও আয়াতুল কুরসি, তিনকুল পড়ে বুকে ফু দিয়ে শোব। ঠা’ডা পড়ে মরে গেছি! তাও জায়িন ভাইকে নিয়ে! নাউজুবিল্লাহ, স্বপ্নে উনাকে আমি… উনি আমার হিরো ক্যারেক্টারে ছিল? আস্তাগফিরুল্লাহ।”
সন্ধ্যাবেলা ঘুমিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখার জন্য মীরার নিজের গালেই ঠাসঠুস চড় দিতে ইচ্ছে করছে। আসলে সব দোষ জায়িন ভাইয়ের। আজকের ওই ঘটনা ধরেই এই স্বপ্নটা এসেছে।
“জায়িন ভাই আপনি আমার স্বপ্নে এসেও জ্বালাতে শুরু করে দিয়েছেন! ছাতা ছিল না, আপনি আমাকে ভিজেই চলে আসতে দিতেন। বন্ধুর কথা শুনতে গিয়ে কী ঘটালেন দেখেন তো।”
বাইরে থেকে দরজা ধাক্কিয়ে কেউ ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। মীরা বিরক্ত হয়ে তাকাল। এই বাড়িতে কোন প্রাইভেসি নেই? ভালো মতো স্বপ্নের শোকটাও কাটিয়ে উঠতে পারল না। তার আগেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। তনি আপুর কি খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই?
“কিরে সাড়াশব্দ দিচ্ছিস না কেন? মরে টরে গেলি নাকি? মীরা! এই খবিশ, দরজা খোল।”
মীরা বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দিলে তনি মীরাকে ঠেলে ভেতরে চলে এলো। পুরো ঘর অন্ধকার দেখে বলল,
“দরজা জানালা লাগিয়ে ঘর অন্ধকার করে ধ্যান করছিলি নাকি? কার আত্মাকে ডাকছিলি?”
“নিজের আত্মাই দেহ ত্যাগ করতে করতে বেঁচেছে, অন্যের আত্মা ডেকে এনে নুন মরিচ দিয়ে আচার দেব?”
“দিলে দিতেও পারিস। তোর সাথে তো কোন ভরসা নেই। হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা হয়েছে।”
খিচুড়ি, ইলিশ ভাজার কথা শুনেই মীরার জিভে পানি এসে গেল।
….
মুবিন ভাইয়ের উপর মীরা ভীষণ রাগ করেছে। আজকের পর থেকে সে আর মুবিন ভাইকে সাহায্য করবে না। একা একাই এবার মাহিমার মন জয় করুক। দেখুক কত ধানে কত চাল। নানির বাড়ি যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে যেতে পারলো না? তাহলে তো মীরা ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে কষ্ট করে এতদূর যায় না। মুবিন ভাইয়ের মেসেজ দেখেও মীরা দেখছে না।
“আপনি গুরুতর একটা অপরাধের কাজ করেছেন মুবিন ভাই। জিরাফ ভাইটাকে বাড়িতে রেখে নিজে চলে গেছেন। উনাকেও কেন সাথে নিয়ে গেলেন না!”
অনেকগুলো মেসেজ জমা হলেও মীরা সিন করছে না। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে এখন ঘুমও আসছে না। সময় কাটাতে মীরা ইভার কাছে চলে গেল। প্রতিদিন রাতেই ওরা লুডু খেলে। মীরা ইভান ভাইয়ের ঘরের সামনে এসেও ভাবল, এখন এগারোটা বাজে। এসময় কাউকে বিরক্ত করা কি ঠিক? মীরা আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। মুবিন ভাই কি কানা? দেখতে পারছে না কয়টা বাজে এখন। এসময় মেসেজ দিচ্ছে। মীরা রিপ্লাই করল,
“মুবিন ভাই প্রথমত আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। দ্বিতীয়ত, কয়টা বাজে দেখেছেন?”
“সরি মীরা। এত রাতে মেসেজ দেওয়ার জন্য দুঃখিত। কিন্তু তুমি আমার সাথে কথা বলবে না কেন?”
“কারণ কাজটাই আপনি এমন করেছেন। আপনার জন্য আমার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন আসছে। ঘুমোতে যেতে ভয় করছে।”
“মানে! আমি কী করেছি মীরা?”
“আপনিই তো সব করেছেন।”
“আমি সব করেছি মানে কী? খুলে বলবে একটু?”
মীরা কিছুই মুবিন ভাইকে খুলে বলতে পারল না। পায়ে গরম চা পড়েছিল। সে জায়গা এখন ফোস্কা পড়ে গেছে। পায়ের ছোট আঙুলটা সোফায় ঠুসা খেয়েছিল। সেটাও ব্যথা করছে। মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সর্দি লেগেছে। টিস্যু হাতে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। হাঁচি শুরু হলে একসাথে দশ বারোটা। ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা নতুন করে না-ই বললো। এসব কার জন্য হয়েছে? মুবিন ভাই বাড়িতে নেই এই কথাটা তাকে জানালে এসব কিছুই হতো না।
“আমি ঠিক করেছি, আমি আর আপনাকে সাহায্য করব না। এতদিনে যতটুকু করেছি ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে সেটাও ফিরিয়ে নিতাম।”
…
জায়িন তার মা’র সাথে ফোনে কথা বলছে। সুমনা ছেলেকে একা বাড়ি রেখে গিয়ে থাকতে চাচ্ছিল না। তবুও চাচা চাচীর জোড়াজুড়িতে থাকতে হলো। সুমনারা দুই বোন। কোন ভাই নেই। বাবা মা-ও বেঁচে নেই। এখন বাপের বাড়ি বলতে এক চাচা আছে তাকে দেখতেই মাঝে মাঝে আসে। চাচা তাদের নিজের মেয়ের থেকে কম দেখে না। আজ অনেকদিন পর দুই বোন এলে যেতে দিলো না।
“রাতে খেয়েছিস কিছু?”
জায়িন যদি এখন মা’কে বলে সে রাতে খায়নি তাহলেই মা’র প্রেসার বেড়ে যাবে। মিথ্যা না বলে সে কোনরকমে কথা কাটিয়ে নিতে চাইল,
“আজ বিকেল থেকে প্রচুর ঝড়তুফান হয়েছে। রাস্তাঘাটে পানি জমে গেছে। রাতে না ফিরে ভালোই করেছ।”
“সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু তুই আমার কথা কাটাচ্ছিয় কেন? খাসনি কিছু?”
“দুই মগ কফি খাওয়ার পর আর খিদে হয়নি।”
“তুই খিদে হয়নি বললেই আমি বিশ্বাস করে নিব! সকালে রান্না করে ফ্রিজে রেখে এসেছি। এক্ষুনি ফ্রিজ থেকে ভাত তরকারি বের করে গরম করে খাবি। ওসব খেতে না পারলে আমি লাইনে থাকতে থাকতেই তুই রান্না করে খাবি।”
“মা এক রাত না খেলে কিছু হবে না। তুমি তো কাল চলেই আসবে।”
“কিছু হবে না কিছু হবে না বলেই তো শরীরের এই হাল করেছিস। নিজে রান্না করতে পারলি না। বাইরে থেকে কিছু আনিয়ে খেয়ে নিতি।”
“ওদিকে আবহাওয়া ভালো দেখে বুঝতে পারছ না এদিকে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে গেছে। খাবারের অর্ডার দিলেও মনে হয় না ডেলিভারি ম্যান আজ খাবার পৌঁছে দিয়ে যেতে পারতো।”
“আজ মীরা এসেছিল?”
মা হুট করে সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসঙ্গে চলে গেল। জায়িন সন্ধ্যা থেকে মীরাকে নিয়েই ভেবে কাটিয়েছে। এই মেয়ের ভাবনা তার মস্তিষ্কে জোঁকের মতো এঁটে বসেছে। আজকাল অনুভূতি গুলো বড্ড অবাধ্য হচ্ছে। মন লাগামছাড়া হতে চাচ্ছে। এখন আর অনেকদিন পর এক পলকের একটু দেখায় মন ভরছে না। এখন পুরোটা সময় মীরাকে দেখতে ইচ্ছে করে। যখন তখন নানান আজুহাতে ওর কপালে পড়া অবাধ্য চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মীরার সাথে মনের সব অব্যক্ত কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে করে। তার এত এত অনুচিত ইচ্ছে, এদিকে জায়িন জানেই না মীরা তার জন্য কী ফিল করে। মীরার মনেও তাকে নিয়ে আদোও কোন অনুভূতি আছে কি-না। জায়িন কল কেটে অলস ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়লো। এইতো আরও চার/পাঁচ ঘন্টা আগে মীরা ঠিক এই জায়গাটায় বসে ছিল।
জায়িন মীরার পায়ে মলম লাগিয়ে দেওয়ার পর দু’জনেরই আর কোন কাজ ছিল না। গুমোট বাঁধা অদৃশ্য এক অস্বস্তিতে নিজেরাও কথা বলতে পারছিল না। ওদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই। আবির ভাই তাকে কখন নিতে আসবে? মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে সোফায় বসে আবিরের আসার অপেক্ষা করে করে এক একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
জায়িন কিছুটা দূরে বসে মীরাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে ঘুমাতে দেখছিল। সেই ঘুমন্ত মুখটার মায়া জায়িন এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কত স্নিগ্ধ! কত পবিত্র সেই মুখখানা। বাজ পড়ার শব্দ হলে ঘুমের মধ্যেই মীরা ভয় পাচ্ছিল। জায়িন লক্ষ করেছে মীরা যতবার বজ্রপাতের শব্দে ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়েছে ততবারই ওর ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপেছে। জায়িন নিজের মনের সাথেই লড়াই করে পেরে উঠছে না। অনিশ্চয়তা, সংকোচ, দ্বিধা তাকে মীরার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেও দিচ্ছে না।
“অজান্তে তোমাকে আমি চেয়েছি। যখন বুঝেছি, তখন আর ফিরে আসার উপায় ছিল না। দেখলাম, ততদিনে সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তোমার মায়ার পুরোপুরি আটকা পড়েছি।”
চলবে…#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৫
মাহিমা কলেজে যাওয়ার আগে মীরাকে নিতে এসেছে। গতরাতের ঝড়তুফানের পর আজ সকাল সকাল উঠে কলেজে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। এই লেখাপড়া জীবনের অর্ধেক শান্তি, আরাম, ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আজকে আবার দজ্জাল ম্যাম ক্লাস টেস্ট নিবে। না গেলে কালকে সবার সামনে অপমান করবে। মহিমা এখানে এসে দেখে মীরা জ্বর বাঁধিয়ে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। মাহিমা মীরার পাশে ধপ করে বসে পড়ে ঠোঁট উলটে বলল,
“ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়েছিস না? আমি জানি। ক্লাস টেস্ট দেওয়ার ভয়ে তোর এই জ্বর।”
মীরা কম্বল গলা পর্যন্ত টেনে বসে যাওয়া গলায় চিউচিউ করে বলল,
“তুমি গা গরম হওয়ার আগেই ও বাবা গো, ও মা গো বলে নাটক করো দেখে সবাই কি তোমার মতো নাটক করে মনে হয়? হারামি, হাঁচি দিতে দিতে আমি মরে যাচ্ছি।”
মাহিমা অবহেলাভরে মীরার কপালে হাত রেখে বলল,
“বিলাইয়ের জ্বর। তেমন কিছু না। উঠে রেডি হ। আমি একা কলেজে যেতে পারব না।”
“না গেলে না যাবি। আমার জ্বর এক সপ্তাহ থাকবে। ঔষধ তো দূর, ডাক্তার গুলিয়ে খাওয়ালেও সারবে না।”
ডাক্তারের কথা উঠতে মনে পড়লো, জায়িন ভাইকে নিয়ে ভোর রাতেও একটা স্বপ্ন দেখেছে। এই লোক এক রাতে দুইবার তার স্বপ্নে হানা দিয়েছে। মীরা কারো কাছে শুনেছিল। সঠিক জানে না তাই মাহিমার কাছে জিজ্ঞেস করে শিওর হতে চাইল।
“ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় এই কথাটা কতটুকু সত্য রে মাহি?”
“কেন? তুই আবার ভোরে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস? মুবিন ভাইকে নিয়ে?”
“মুবিন ভাইকে নিয়ে তুই স্বপ্ন দেখ। আমি কেন অন্য বেডির বয়..
রেগে গিয়ে কথাটা বলতে গিয়েও মীরা বলল না। দুনিয়ায় যদি গাধার থেকেও নির্বোধ, বোকা কোন প্রাণী থাকে সেটা এই মাহি। এতদিনেও বুঝতে পারছে না মুবিন ভাই কাকে পছন্দ করে। মীরা ইশারা ইঙ্গিতে কতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এই হাদার বাচ্চা মুবিন ভাইকে দুলাভাই বানাতে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে।
…
গতরাতের ঝড়বৃষ্টির পর আজ কলেজে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়েরাই এসেছে। যারা এসেছে সেসব ব্রিলিয়ান্টদের মধ্যে মাহিমাও একজন। ছুটির পর একা বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। ভালো লাগছে না। মীরা সাথে থাকলে বকবক করতে করতে পথ ফুরিয়ে যায়। মাহিমা কিছুদূর এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুবিন মাহিমাকে দেখে এগিয়ে আসছে। গতরাতে মীরার মেসেজ পড়ে পুরো রাত বেচারা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। টেনশনে অস্থির হয়ে রাতটা কোনরকমে পার করে সকালেই রওনা দিয়েছে। মীরা কেন তাকে সাহায্য করবে না? সাহায্য ফিরিয়ে নিবে মানে কি? মীরা কি মাহিমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে! এই মেয়ের সাথে বিশ্বাস নেই। মাহিমা মুবিনকে আসতে দেখে বিড়বিড় করে বলল,
” আপনার পাখি তো আজ আসেনি মুবিন ভাই। আপনাকে আজ নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে।”
মুবিন মাহিমার কাছাকাছি চলে এলে মাহিমা ঠোঁটে হাসি টানলো। মাহিমাকে হাসতে দেখে মুবিন স্বস্তি পেলো। যাক মীরা উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি।
“মুবিন ভাই, কেমন আছেন?”
“ভালো।” মাহিমাকে পাল্টা, ‘তুমি কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করতে মুবিনের লজ্জা লাগল। তাই বলল, তোমাদের খবর কী?”
“আমার খবর ফার্স্ট ক্লাস। কিন্তু আপনার ছাত্রী জ্বরে পড়েছে।”
“ওহ।”
মাহিমা মুবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না। মীরার জ্বর শুনেও মুবিন ভাইয়ের চেহারায় তেমন কোন উদ্বেগ বা অস্থিরতা প্রকাশ পেলো না। পছন্দের মানুষের গা গরম হলে নিজে প্যারাসিটামল খাওয়া পাবলিক মনে হয় মুবিন ভাই না।
“কাল আপনার কাছে পড়তে গিয়েই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে।”
“আমি তো কাল বাড়িতে ছিলাম না।”
“আপনি বাড়ি নেই এই কথা মীরা জানতো না?”
“মনে হয় না। ওকে বলার সুযোগ হয়নি।”
মাহিমার সন্দেহ এবার গাঢ় হচ্ছে। মুবিন ব্যাটা কি সত্যি সত্যি মীরাকে পছন্দ করে? পছন্দ না করলে শুধু শুধু টাইম পাস করার ছেলে তো মুবিন ভাই না। মাহিমা কিছু বলছে না। কিন্তু মুবিন কথা চালিয়ে নিতে চাচ্ছে। কী বললে আলাপ দীর্ঘ করা যায় ভাবছে মুবিন।
“তোমাদের পরীক্ষা কবে হবে?”
“শুনেছিলাম দুই মাস পর।”
“কেমন প্রিপ্রারেশন নিচ্ছ?”
মাহিমা তীক্ষ্ণ চোখে মুবিনকে দেখছে। তার এখন মনে হচ্ছে মুবিন ভাই মীরাকে পছন্দ করে না। করলেও প্রেম ভালোবাসা টাইপ না। কারণ উনি আসার পর থেকে মীরার সম্পর্কে কোন কথাই জিজ্ঞেস করেনি। মীরার জ্বর শুনেও ওর জন্য টেনশন না দেখি পরীক্ষা নিয়ে আজাইরা পেঁচাল পারছে। ওরা কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিল। মুবিন রাস্তার পাশে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। মাহিমা রাস্তায়। এই রোডে খুব বেশি গাড়ি বাস চলাচল করে না। তবে পেছন থেকে হঠাৎ করে মোটরবাইক এলে মুবিন মাহিমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকে রাস্তা থেকে নামিয়ে নিয়েছিল। বাইকটা একটুর জন্য মাহিমার গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। মুবিন ঠিক সময়ে মাহিমাকে টেনে না নিলে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যেত। মুবিন উত্তেজিত গলায় মাহিমাকে জিজ্ঞেস করছে,
“কোথাও লাগেনি তো? ব্যথা পেয়েছ?”
এতক্ষণে বাইকটা অনেকদূর চলে গেছে। মুবিন ওদিকে তাকিয়ে চাপা ক্রোধে বলল,
“আজকাল ছেলেগুলো বাইক নিয়ে রাস্তায় নামলে ভুলে যায় ওরা পাবলিক প্লেসে বাইল চালাচ্ছে। তোমার কোথাও লেগেছে? তুমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটো।”
মাহিমা হতবাক হয়ে মুবিনকে দেখছে। মানুষটার চোখে তার জন্য স্পষ্ট উদ্বেগ, চিন্তা, কেয়ার দেখতে পারছে। মুবিন ভাই মীরার জন্য তার সাথে এত ভালো আচরণ করছে না। মাহিমা এবার বুঝতে পারছে। তবে এটা বুঝতে পেরেই সে লজ্জা, অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেল। মুবিন ভাই মীরাকে না তাকে পছন্দ করে। এটা জানলে মীরা কতটা কষ্ট পাবে ভেবেই মাহিমার বুক কেঁপে উঠল। মাহিমা জীবনে কোনদিন এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যাতে মীরা সামান্যতম কষ্ট পায়। তাই সে মুবিনকে এড়ানোর জন্য জোরে পা চালালো। হঠাৎ কী হলো মুবিন বুঝতে পারল না। কথা বলতে বলতে মাহিমা এমন স্বাভাবিক ভাবে ছুটছে কেন? সে কি ভুল কিছু করে ফেলেছে? মাহিমা পেছন ফিরে মুবিনকে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না।
“আপনি কাজটা ঠিক করেননি মুবিন ভাই। মীরা আপনাকে পছন্দ করে। আপনি কেন আমাকে পছন্দ করতে গেলেন?”
…
মাহিমার হঠাৎ এরকম চলে যাওয়ার মুবিন কিছুই বুঝতে পারছে না। এ নিয়ে বেচারা সারাটা দিন মনমরা হয়ে থেকেছে। ভালোবাসা জিনিসটা তো কঠিন কেন? তার বন্ধুরা একসাথে দুই তিনটা গার্লফ্রেন্ড চালাতে পারতো। সে একটাও বানাতে পারছে না। ভালোবাসা শুধু কি তার জন্যই কঠিন? আগে জানলে ভালোবাসা নামক এই ফাঁদে জীবনেও পা দিতো না। কিন্তু এখন তো দিয়ে ফেলেছে। ফিরে আসার কি কোন পথ আছে? হয়তো আছে। কিন্তু মুবিন ফিরে আসতে চায় না। এই অনুভূতিটা ভীষণ সুন্দর।
বিকেলে মুবিন মায়ের সাথে বসে টিভি দেখছে। টিভি দেখছেও বলা যায় না। মা সিরিয়াল দেখছে। সে শুধু শুধু বসে আছে। মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করলেও মা’র মনোযোগ এখন ইন্ডিয়ান সিরিয়াল থেকে সরছে না।
জায়িন ঘুম থেকে উঠে এলোমেলো চুলে মা ভাইয়ের কাছে এসে বসলো। মুবিন ভাইকে দেখলো। ট্রাউজারের এক পা উপরে উঠে আছে। চোখে মুখে এখনও ঘুম জড়ানো। ফোলা ফোলা চেহারায় ভাইয়াকে সুন্দর লাগছে। মুবিন ভাবল, তার ভাইটাই ভালো। যখন খুশি তখন ঘুমানো এক বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে। বাড়িতে এলে সারাদিনই ঘুমায়। মুবিন বুঝে না, দিনের বেলা এত ঘুমানোর পর ভাইয়া রাতের বেলা কী করে? আর ঘুম থেকে উঠেও ভাইয়ার মেজাজ এত ভালো থাকে কীভাবে? মুবিন দিনের বেলা ঘুমালে তার সাথে যে সমস্যা গুলো হয়। তার মধ্যে এক নম্বর, ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারে না দিন না রাত। বিকেলে উঠলেও মনে হয় রাত হয়ে গেছে। বা একটা রাত পুরো ঘুমিয়ে সকালে উঠেছে। দুই নম্বর সমস্যা, মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকে৷ কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেউ কথা বললেও কলিজা কাঁপানো ধমক দিতে ইচ্ছে করে। তাই মুবিন দিনের বেলা ঘুমানোই বাদ দিয়েছে।
“কী দেখছিস?”
জায়িনের কথায় মুবিন লজ্জা পেলো। সে এতক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল বুঝতে পেরে দু’পাশে মাথা নাড়ল। জায়িন একনজর মা’র দিকে তাকিয়ে নিজেই উঠে কিচেনের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরই দুইটা মগ হাতে নিয়ে ফিরল। ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে বাঁ হাতে ধরা মগটা মুবিনের দিকে এগিয়ে দিল। মুবিন মগটা নিলে জায়িন আরাম করে নিজের মগে ঠোঁট ছোঁয়াল।
“মা কফি খাবে?”
“না। তুই খাবি? করে দিব?”
জায়িন হাসলো। বলল,
“না থাক। তোমার ডিস্টার্ব হবে।”
মুবিন ভাইয়ের দিকে ফিরে গলা নিচু করে বলল,
“দেখলে ভাইয়া, মা পুরোপুরি সিরিয়ালে আসক্ত হয়ে গেছে।”
“বাবা ফিরলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“বাবা কবে ফিরবে জানো?”
“বলেছিল তো এই সপ্তাহে আসবে।”
“হিসেব করলে দেখা যাবে, বারো মাস থেকে বাবা কিন্তু আমাদের সাথে তিন মাসও ভালো ভাবে থাকে না।”
“তুই চাস বাবা বারো মাসই বাড়িতে থাকুক?”
প্রশ্নটা করে জায়িন কফিতে চুমুক দিয়েছে। মুবিন এই প্রশ্নটার উত্তর দিলে মিথ্যা বলতে হবে। সত্যটা ভাইয়ার কাছে বলা যাবে না। বাড়িতে সে আর মা একা একা থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন বাবা বাড়ি এলে তার স্বাধীনতা বিগ্ন হয়। মনে মনে চায়, বাবা কবে যাবে। ভাইয়া বাড়ি এলে ভালো লাগে। কারণ ভাইয়া তো তাকে বাবার মতো শাসন করে না। জায়িন ভাইকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো।
মুবিন রুমে গিয়ে বাইকের চাবি নিয়ে এলো। বেরুবার আগে মা’কে বলল,
“আম্মু আমি একটু বেরুচ্ছি।”
সুমনা ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এখন কোথায় যাচ্ছিস? মীরা পড়তে আসবে না?”
“আজ মনে হয় আসবে না। মীরার জ্বর।”
“সে কি! জ্বর কীভাবে বাঁধাল? এই সিজনের জ্বর তো ভালো না। ইভাকে কল করে জান তো অনেক জ্বর নাকি।”
মীরার জ্বর এসেছে শুনে জায়িন পিঠ সোজা করে বলল। নিশ্চয় বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়ায় এই জ্বর এসেছে। মীরা এসময় পড়তে আসে ভেবেই জায়িন ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। যাতে মীরার সাথে দেখা হয়। গতরাতের পর মীরাকে দেখার যে তীব্র ইচ্ছাটা দমন করে রেখেছিল তা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেয়েটা তাকে এত জ্বালায় কেন?
চলবে…
বিঃদ্রঃ গল্প একদিন পরপর দেওয়া হয়। প্রতিদিন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এইটুকু অপেক্ষা করতে না পারলে পুরোটা শেষ হলে একেবারে পড়বেন।💜