মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব – ৪৫+৪৬+৪৭

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪৫

মীরার দিন কাটছে কঠিন বিরহে। জীবনের প্রথম তার কাউকে ভালো লেগেছে। এখন জানতে পেরেছে ওই লোকের আগে থেকেই গার্লফ্রেন্ড আছে। আহা ভালো ভাবে প্রেমেও পড়তে পারল না। তার আগেই গরম গরম ছ্যাঁকা খেয়ে ফিরে এলো। ওদিকে মুবিন ভাই আর কইতরির রঙিন লাভ স্টোরি দেখে দেখে মীরা আরও ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। তার ডিপ্রেশনকে আরও এক পাল্লা বাড়িয়ে দিতে সাকিব মীরাকে প্রপোজ করে বসলো। মীরা দুঃখে বাঁচে না। যাকে সে পছন্দ করে, সে তাকে পাত্তা দেয় না। আর সে যাকে পাত্তা না দেয়, সে আবার তাকে প্রপোজ করে। মীরা সাকিবকে সোজা কথায় ফিরিয়ে দিল।

” একজনকে পছন্দ করে গরম গরম ছ্যাঁকা খেয়েছি সাকিব। তুমি এসব নাটক করে আমার জ্বালা বাড়িয়ো না। যে তোমাকে পছন্দ করে এমন একটা মেয়ে খুঁজে বিয়ে করে ফেলো, যাও।”

মীরা কাউকে পছন্দ করে ছ্যাকা খেয়েছে! কই মাহিমা তো জানতো না। সাকিব বিদায় হলে মাহিমা বিলাপ পাড়তে শুরু করে দিল।

“তোর পিছু নিয়ে তোর জন্মের পনেরো দিন পরেই আমিও দুনিয়ায় চলে এলাম। ছোট থেকে একসাথে বড় হলাম। এক কাপড় পরলাম। এক থালায় খেলাম। একই স্কুল, একই কলেজ। এমনকি এক বাড়িতেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম। এত মিল আমাদের। এতো মোহাব্বত। এখন কি-না শুনতে হচ্ছে তুই কাউকে পছন্দ করতি আর সেটা আমি জানতাম না! এই দুঃখ আমি কাকে দেখাব? আমি মরে গেলেও তো আমার এই দুঃখ মিটবে না।”

মীরা বিরক্তিতে নাক ফুলিয়ে মাহিমার দিকে তাকাল। এই মেয়ে এত নাটক করতে পারে! একে তো স্টার জলসায় ডুকিয়ে দেওয়া উচিত।

“ওভার অ্যাক্টিং করিস না তো। এটা এমন বড়োও কোন ব্যাপার না।”

“বড়ো ব্যাপার না! কী বলছিস কি তুই? কাকে পছন্দ তোর? ছ্যাঁকা খেয়েছিস কীভাবে? আমাকে বল।”

“বলার কিছু নেই। যেখানে কিছু শুরুই হয়নি সেখানে তোকে কী বলবো আমি?”

“শুরু কেন হয়নি?”

“ব্যাটার গার্লফ্রেন্ড আছে।”

“তাতে কি? ওরকম গার্লফ্রেন্ড তো কতই থাকে। আবার ব্রেকআপও হয়। এটা কোন বড়ো কথা না। বয়ফ্রেন্ড তো আর জামাই না। বয়ফ্রেন্ডকে যে মেয়ে জামাই ভাবে সে আস্ত একটা গাধা।”

“তাহলে এই লিস্টে তোর নামও উঠবে।”

“তুই আমার কথা বাদ দে তো। এটা আমাকে নিয়ে ভাববার সময় না। তুই বল কাকে পছন্দ করিস তুই? থাক গার্লফ্রেন্ড। আমরা ব্রেকআপ করিয়ে নিব। তুই শুধু বলে তো দেখ একবার। কেমন প্ল্যান বানাই।”

মীরার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে কারো পথের কাটা হতে চায় না। না কারো ব্রেকআপের কারণ হতে চায়। দুটা মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে। তাদের মাঝে কেন আসবে সে? ওরা অনেক আগে থেকেই নিজেদের চেনে। মীরাই বরং আসতে দেরি করে ফেলল।
মীরার সিরিয়াস টাইপ মন খারাপ হতে দেখে মাহিমা মজা করা বন্ধ করে দিল।

“এই মীরা তুই কি সত্যি সত্যিই কারো জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? কী হয়েছে আমাকে বল না। আমার থেকে তো কোনকিছু লোকাস না তুই।”

“আমি চাইনি মাহি। কিন্তু জানি না কীভাবে যেন মানুষটাকে অপছন্দ করা থেকে ধীরে ধীরে পছন্দ করতে শুরু করেছি। উনাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। এখন যদি জানতে পারি উনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন এতে কি আমার কিছু করার আছে? আমি নিজের অনুভূতির সাথে লড়াই করে যাচ্ছি। তবুও উনাকে ভুলতে পারছি না। উনি অন্য কারো এটা ভাবলেই আমার ভীষণ কষ্ট হয়। উনি কেন আমার হলো না?”

“হুম। কিন্তু উনিটাকে কে?”

“সেটা তোকে বলতে পারব না।”

“কেন?”

“উনার কথা আমি কাউকেই বলতে পারব না। শুনলে তোরা আমাকে বাজে ভাববি।”

“কী আশ্চর্য! বাজে কেন ভাববো? পছন্দ হতেই পারে। কাকে পছন্দ হয়েছে তোর?”

“এখন তো বলাই যাবে না। কারণ উনার গার্লফ্রেন্ড আছে। আমার অনুভূতি জানিয়ে উনাকে বিব্রত করতে চাই না।”

“কী মুশকিল! চেয়ে না পেলে কেড়ে আদায় করা ধর্মে বিশ্বাসী মীরা কীসব আবেগী কথা বলছে। তুই আমি তো সারাজীবন পছন্দের জিনিস যেকোনো মূল্যে আদায় করে ছেড়েছি। দরকার পড়লে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।”

“সেটা জামাকাপড় বা কসমেটিক হলে এবারও আমি জোর করেই নিয়ে নিতাম। কিন্তু মানুষের মন কীভাবে জোর করে নিব?”

আহারে, মীরাটার জন্য কষ্টে মাহিমার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। বেচারীর জীবনের প্রথম ভালো লাগা। সেটা আবার অন্য কোন শাঁকচুন্নির দখলে।

মীরাদের কলেজের আয়েশা ম্যামের বেবি হয়েছে। এই ম্যাম মীরা মাহিমা দু’জনকেই ভীষণ পছন্দ করে। ওরাও করে। তাই আজ ছুটির দিনে ম্যামের বাসায় উনাকে দেখতে গিয়েছিল। ফিরে আসার সময় রাস্তা থেকে দশ টাকার বাদাম কিনে খেতে খেতে আসছে। মাহিমা বলছে,

“বাবুটা কী সুন্দর না রে মীরা! ইশ, কেমন তুলোর মতো তুলতুলে।”

“ম্যামও তো সুন্দর। তাই বাবুও সুন্দর হয়েছে।”

“ম্যামের বরটা কিন্তু কালো।”

মীরা এখন এই কিছুটা সময়ের জন্য জায়িনকে ভুলে আছে। নইলে বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ জায়িনকে নিয়েই ভাবে। রিকশা না নিয়ে দু’জন পায়ে হাঁটছিল। কিছু দূর আসার পর আবিরকে দেখতে পেল। মাহিমা ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে।

“এই ওটা আমার ভাই না রে?”

“কই?”

মীরা দেখতে না পেয়ে আশেপাশে খুঁজছে। মাহিমা সামনে দেখিয়ে বলল,

“ওইদিকে দেখ।”

“হ্যাঁ। আবির ভাইয়াই তো।”

“ভাইয়া এখানে কি করছে বল তো!”

“ট্রাকে জিনিস তুলছে মনে হচ্ছে। কিন্তু আবির ভাইয়া ট্রাকে জিনিস তুলে কোথায় যাচ্ছে? আর এসব আসবাবপত্রই বা কার?”

“চল তো গিয়ে দেখি।”

আবিরের কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই মীরা অন্য একজনকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। দূর থেকে জায়িনকে দেখা যায়নি। কিন্তু জায়িন ট্রাকের আড়ালে অপর পাশে ছিল। মানুষটাকে দেখেই মীরার মন খারাপ হয়ে গেল। যাকে ভুলে থাকতে মীরা মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে যাচ্ছে না। সে নিজেই পথেঘাটে মীরাকে দেখা দিচ্ছে। কেন রে ব্যাটা? তুই তো বাড়ি থাকিস না। তাহলে এবার এতদিন কেন আছিস? মীরাকে জ্বালাতে!
মীরা চাচ্ছিল এখান থেকেই চলে যেতে। কিন্তু মাহিমা কি এখানে কী হচ্ছে তা না জেনে যাওয়ার পাত্রী?

“ভাইয়া, কী করছো তোমরা এখানে?”

আবির বোনদের দেখে বলল,

“তোরা কোত্থেকে এলি?”

“ম্যামের বাবু দেখতে গিয়েছিলাম।”

“ওহ।”

ট্রাকে জিনিস তুলে এখন বাঁধা হচ্ছে। জায়িন রশি ধরা হাতে মীরার দিকে তাকাল। এই মেয়ে তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এত রাগ বাবাহ! সেদিনের পর থেকে তাদের বাড়িতেও আসছে না। এই বোকা মেয়ে কি জানে জায়িন শুধু তাকেই ভালোবাসে। মীরা আড়চোখে ঠিকই জায়িনকে দেখছে। জায়িনকেও তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখ বাঁকাল।
মাহিমা এখনও জানতে পারেনি ভাইয়া এখানে কী করছে।

“এখানে কী করছো ভাইয়া?”

“আল্লাহ চোখ দেয়নি? দেখতে পারছিস না কী করছি?”

“দেখতে তো পারছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না। কেউ কোথাও যাচ্ছে নাকি?’

মাহিমা কথা বলতে বলতেই জান্নাত গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো। জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। এই মেয়েটাকে দেখেই মীরার রাগ, জেদ, খারাপ লাগা তিন রকমের অনুভূতি একসাথে কাজ করতে লাগল। ওহ তাহলে এই ব্যাপার! বন্ধুকে নিয়ে গার্লফ্রেন্ডকে হেল্প করা হচ্ছে! তা শাঁকচুন্নিটা কোথায় যাচ্ছে? জান্নাতের এই প্রয়োজনের সময়ে দুই বন্ধুকে কাছে পেয়ে সে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবে ভেবে পাচ্ছে না। তাই বারবার বলেই যাচ্ছে।

” তোমরা না থাকলে আমার যে কী হতো? কীভাবে কী ম্যানেজ করতাম আল্লাহ জানেন।”

আবির হাতের কাজ সেরে হাত থেকে ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে জান্নাতের সামনে এসে দাঁড়াল। সে স্কুল টাইমের মতো এখনও জান্নাতকে খেপানোর জন্য বলল,

“ওহহো জানু, আমি কি তোমার পর? তুমি কিন্তু এভাবে বলে আমাদের পর করে দিচ্ছ। আরে আমরা আমরাই তো।”

সেসময় আবিরের জানু ডাকা নিয়ে মেয়েটার আপত্তি থাকলেও অনেকগুলো বছর পরেও আবিরের মুখে এই ডাক শুনে মেয়েটা হেসে ফেলল।

“তুমি একটুও চেঞ্জ হওনি। ঠিক আগের মতোই আছো। জায়িনও একটুও পালটায়নি।”

মীরা মনে মনে ভেংচি কেটে বলল,

“এহহ ন্যাকা। পালটায়নি এখন তুই তোর ভালোবাসা দিয়ে পাল্টে দে শাঁকচুন্নি।”

জান্নাত এখানে মীরা মাহিমাকে দেখে খুশি হয়ে বলল,

“যাক ভালোই হলো। যাবার আগে তোমাদের দেখে যেতে পারলাম।”

জান্নাতের বাবা মা-ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। উনারাও আবির জায়িনের প্রতি কৃতজ্ঞ।

“তোমাদের যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বাবা। তোমরা আমার মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়েছ। নইলে ও একা কীভাবে যে কী করত।”

জায়িন বয়স্ক লোকটার কথা শুনে মৃদু হেসে বলল,

“ধন্যবাদ দিতে হবে না আঙ্কেল। ও আমাদের বন্ধু।”

জায়িনকে হাসতে দেখে মীরা মনে মনে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। শ্বশুরের সামনে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসা হচ্ছে! আহা বন্ধু কেন? গার্লফ্রেন্ড বলতে লজ্জা লাগছে?
মীরা এতক্ষণ লক্ষ করেনি মহিলার কোলে একটা বাবু। জান্নাত মায়ের থেকে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল,

“মামাদের গুড বাই বলে দাও তো আম্মু।”

চলবে…#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪৬

“মামাহ!”

মাহিমার চোয়াল ঝুলে গেছে। তারা আরও এই মেয়েটাকে জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ভাবছিল। কিন্তু মেয়েটা তো এক আন্ডা দেওয়া মুরগী।
আবির জান্নাতের দিকে এগিয়ে এসে মুখ কালো করে বিরহের সুরে বলল,

“হতে চেয়েছিলাম বাবা। তুমি বানিয়ে দিলে মামা। সেদিন আমার প্রপোজ এক্সেপ্ট করলে তোমার মেয়ের বাবা আমি থাকতাম। কিন্তু তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে জানু।”

ক্লাস নাইনে থাকতে আবির জান্নাতকে প্রপোজ করেছিল। জান্নাত শুধু আবিরকে ফিরিয়েই দেয়নি হ্যাডস্যারের কাছে বিচারও দিয়েছিল। আহা স্যার বেচারাকে বেত দিয়ে পেছনে মেরেছিল। ওসব দিন এখন রঙিন স্বপ্ন বলে মনে হয়। জান্নাত চোখ পাকিয়ে তাকিয়েও হেসে ফেলল।

“তুমি আর মানুষ হলে না।”

বাবুটা জায়িনের কোলে আসতে চাচ্ছে। জায়িন ওকে কোলে নিয়ে জান্নাতকে বলল,

“কোন সমস্যা হলে আমাদের জানিও। আমরা তো এখানে আছিই।”

“আর সমস্যা কী? তোমরা তো আমার সব সমস্যাই দূর করে দিয়েছ। বাবা মা’কে নিয়ে যাচ্ছি। এখানে উনাদের দেখার কেউ ছিল না।”

মীরা এতক্ষণ বোকার মতো ওদের কথা শুনছিল। এদের কথাবার্তা বুঝতে পেরে মীরা হতভম্ব। এই মেয়েটা জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড না! এই মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে। একটা বাবুও আছে। এত বড়ো সত্যটা জেনে খুশিতে মীরার ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। এই মেয়েকে জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ভেবে মীরা কী কষ্টই না পাচ্ছিল।
যাবার আগে জান্নাত মীরা, মাহিমার থেকেও বিদায় নিল। গাড়ি ছেড়ে দিলে আবির বলল,

“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাড়ি চলে যা।”

মীরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আশেপাশের সবকিছু ভুলে গেল। আবিরের কোন কথাই তার কানে ঢুকলো না। সে তো ড্যাবড্যাব করে জায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। জায়িনও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মীরার চোখের আড়ালে হাসল।

বাড়ি এসে মীরা সবার আগে ইভাকে পেল। বাঁধ ভাঙা খুশিতে বেচারি ইভাকে ধরে ঘুরতে লাগল। ওর হঠাৎ এমন আচরণে ইভা চমকাল।

“আরে আরে হয়েছে কী? মীরা, এই মাথা ঘোরাচ্ছে তো।”

মীরা হাসতে হাসতে বলল,

“মাথা ঘোরাক। বমি হোক। তুমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাও। তবুও আমি থামবো না।”

“কী আশ্চর্য! কেন?”

“কারণ আজ আমি ভীষণ খুশি। খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।”

“এত খুশির কারণ কী? আমাকেও বলো। আমিও খুশি হই।’

” বলা যাবে না গো ভাবী। বলা যাবে না। শুধু জেনে রাখো আজ আমি অনেক বেশি খুশি।”

ওরা এরকম চরকির মতো ঘুরছে দেখে বড়মা এসে অবাক হওয়া গলায় বলল,

“কী করছিস তোরা এসব? এভাবে ঘুরছিস কেন?”

ইভা আর পারছে না। তার সত্যিই মাথা ঘোরাচ্ছে। মীরা ইভাকে ছেড়ে দিলে ইভা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে সোফা ধরে বসে পড়ল। কিন্তু মীরা থামছে না। সে বড়মাকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে হাত নাচাতে নাচাতে বলল,

“আজকে আমার ভীষণ খুশি লাগছে বড় মা। খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। গান গাইতে ইচ্ছে করছে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।”

“পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এত খুশি কেন লাগছে?”

ইভা বসে হাঁপাতে হাঁপাতে মীরাকে দেখছে। এই মেয়ে কি পাগল হয়ে গেছে? হঠাৎ ইভার মনে পড়ল মীরার এত খুশির কারণ ওই ছেলেটা না তো? যাকে মীরা পছন্দ করত। ওই ছেলের কি ব্রেকআপ হয়ে গেছে? তাই মীরা এত খুশি হচ্ছে!
মীরা ঘুরতে ঘুরতে তিড়িংতিড়িং করে নাচছে। রুশমি বোনকে এরকম করতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে আতঙ্কে মা’কে জড়িয়ে ধরেছে। বড়মা মীরাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।

“এই পাগলের বংশ থাম। চাচা, জেঠা, ভাইবোন সব কয়টা পাগল। এতগুলো পাগলের পাল্লায় পড়ে আমরাও না জানি কবে পাগল হয়ে যাই।”

বড়মার ধমক খেয়ে মীরা চুপ করে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল, খুশির চোটে সে কি একটু বেশিই পাগলামি করে ফেলেছে? কিন্তু পাগলামি না করেও বা যাবে কোথায়? ওটা তো জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড না। এখন তো তার পথ ক্লিয়ার।

পরের দিন মীরা অধৈর্য হয়ে সময় গুনেছে কখন বিকেল হবে। কখন সে মুবিন ভাইদের বাড়ি যাবে। আজকে যেন ঘড়ির কাটা দেরিতে চলছে। চারটা বাজতেই চাইছে না।
মীরা যতটা খুশি হয়ে এখানে আসছিল। আসার পর জায়িনকে চলে যেতে দেখে ঠিক ততটাই মন খারাপ হলো। এতদিন তার বিরহকাল চলছিল তখন লোকটা বাড়িতেই ছিল। আজ মীরা সারাটা দিন মানুষটাকে একবার দেখার জন্য কী পরিমাণ ছটফট করেছে তা শুধু সে-ই জানে। এখন এসে দেখছে জায়িন ভাই চলে যাচ্ছে। জায়িন যাবার আগে মীরাকে দেখতে পাবে আশা করেনি। সে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,

“যাই মীরা।”

মীরার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, আপনি আজ যাবেন না জায়িন ভাই। আপনাকে আমার অনেক কথা বলার আছে। আপনার ডাক্তারি পড়াও এতটা জরুরি না আমার কথাটা যতটা জরুরি। আপনি আমার কথাটা একবার শুনে যান প্লিজ। কিন্তু মীরা কিছুই বলতে পারলো না। তার চোখের সামনে দিয়েই জায়িন চলে গেল।
এবার বাড়ি এসে ছেলেটা অনেকদিন থেকেছে। তাই বিদায় দিতে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই সুমনার বড় ছেলের প্রতি একটু বেশিই টান। ছোট ছেলে মুখ ফোটে সব বলে ফেলতে পারে। বড় ছেলেটা তা পারে না। সুমনাও মন খারাপ করে মীরাকে নিয়ে বাসায় চলে এলো। ভাইয়া চলে গেলে মুবিনের বাড়িতে আর ভালো লাগে না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে সব। তাই আজ তার পড়ানোর ইচ্ছে নেই। সুমনা মীরার সাথে বসে কথা বলছে।

“ছেলেটা এবার অনেকদিন থেকে গেছে। তাই প্রতি বারের থেকে বেশি মন খারাপ করছে। কত বললাম বাড়ি থেকে এতটা দূরে গিয়ে পড়তে হবে না। কিন্তু ওর বাবার ইচ্ছা ছেলেকে ডাক্তার বানাবে। বাপের কথার আগে তো ছেলে কারো কথা শুনবে না। চারটা বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে দূরে পড়ে আছে। দুইটাই তো ছেলে আমার। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে বল।”

জায়িনের রুমের দিকে তাকিয়ে মীরার মনে হলো সত্যিই বাড়িটা আজ ফাঁকা লাগছে। মীরা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে দেখে তনি জিজ্ঞেস করল,

“এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে! পড়িস নি?”

“না।”

“কেন?”

মীরা উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে গেল। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমোতে গিয়েও মীরার ঘুম আসছে না। বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করছে।

“দূর! কী ম*রারে বাবা। আগেই ভালো ছিল। শোবার সাথে সাথে ঘুম এসে যেত। প্রেমে পড়লে যে এত জ্বালা কে জানত? তার উপর একটা জিরাফের প্রেমে পড়েছি। ব্যাটার মনে আমাকে নিয়ে কোন অনুভূতি নেই। এদিকে আমি উনাকে নিয়ে অনুভূতির সাগরে ডুবে যাচ্ছি।”

মীরা ফোন হাতে নিল। ফেসবুকে লগইন করে জায়িনকে মেসেজ দিবে। মেসেজ দিতে গিয়ে ভাবল, কী মেসেজ করবে? রাত এগারোটা বাজে। এত রাতে কেন মেসেজ দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে কী বলবে? তাছাড়া মুবিন ভাইকে যখন তখন যা খুশি তাই বলা যায়। জায়িনের সাথে তো তার এত খাতির নেই। মীরা ফোন রেখে আবার শুয়ে পড়ল।

“জায়িন ভাই ছোট্ট এই মেয়েটার মন নিয়ে এভাবে খেলছেন আপনি! আমি তো কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। আপনার কি সত্যিই গার্লফ্রেন্ড আছে? আর না থাকলেও আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন না। আমি বোকা আপনাকে পছন্দ করে বসে আছি।”

মুবিনকে দেখে মীরার আফসোস হয়। মনে মনে ভাবে,

“আপনার ভাইটা কী সুন্দর আমাকে ঘটক ধরে কইতরিকে পটিয়ে নিল। আপনি বড়ো হয়েও কিছু করতে পারলেন না। হাহ্, আপনি পারেননি তো কী হয়েছে? আমাকে তো পারতেই হবে।”

মীরার মাথায় একটা প্ল্যান এলো। সে খাতা কলম রেখে বলল,

“মুবিন ভাই একটা প্রশ্ন আছে।”

“কী প্রশ্ন? বলে ফেলো।”

“আপনি বিয়ে কবে করবেন?”

হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে মুবিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এটা কেমন প্রশ্ন!

“কেন? ”

“কেন কি? আপনি বিয়ে করবেন না? কইতরির বিয়েতে আমি কত মজা করব ভেবে রেখেছি।”

মুবিন এখনই বিয়ের কথা ভাবতেই পারে না। বাবাকে তো বিয়ের কথা বলাই যাবে না। তার উপর ভাইয়া বিয়ে না করলে সে কীভাবে করবে। বড় ভাইকে রেখে সে কি আগে বিয়ে করে ফেলতে পারবে!

“ভাইয়া লাইন ক্লিয়ার করে না দিলে আমি কীভাবে…

মীরা নড়েচড়ে বসল। এইতো মুবিন ভাই লাইনে আসছে।

” আপনার ভাইয়ের জন্য আপনি আটকে থাকবেন?”

“বড়ো ভাইকে রেখে আমি… তাছাড়া এখনও আমার পড়াশোনা শেষ হয়নি। ঠিকঠাক একটা জব জোটাতে না পারলে বিয়ের কথা ভাবা যায় না।”

“জব তো আপনি পেয়েই যাবেন। জব নিয়ে কোন চিন্তা নেই। আসল চিন্তা তো আপনার ভাইকে নিয়ে। যতদিন উনার কোন গতি না হবে ততদিন আপনার বিয়েও হবে না।”

“বড়ো ভাই আগে বিয়ে করবে এটাই তো নিয়ম।”

“তাহলে তো আমার আর এই জীবনে আপনার বিয়ে খাওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার ভাই কবে বিয়ে করবে?”

“আরে হবে হবে। একটু ধৈর্য না ধরলে কীভাবে হবে? ভাইয়ার পড়াশোনা শেষের দিকে। এইতো কয়দিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। দুই তিন বছরের মধ্যে ধরে বেঁধে জোর করে বিয়ে করিয়ে ফেলব, তাহলেই হবে।”

মীরা মনে মনে হিসেব করল, দুই তিন বছরে সে ভার্সিটিতে উঠে যাবে। তখন নিশ্চয় বাবা বিয়ে দিতে রাজি হবে। বিয়ের কথা ভাবার আগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে।

” জোর করলে উনি মানবেন? উনার কি কোন গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড আছে?”

“শিওর জানি না। তবে আমার যা মনে হয়, ভাইয়ার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।”

“কেন, কেন? এমন কেন মনে হয়?”

“হয়তো থাকতেও পারে। কিন্তু ভাইয়া যা ঘরকুনো স্বভাবের! কারো সাথে তো কথাই বলে না।’

” তা ঠিক।”

“আমাদের যারা আত্মীয় আছে তাদের কয়জনকে ভাইয়া চেনে? হাতে গুনে কয়েকজন ছাড়া আর কাউকেই চিনবে না। এমন ছেলের গার্লফ্রেন্ড হলেও খুব বেশিদিন টিকবে না।”

মীরা এটাই শুনতে চাচ্ছিল। ছলেবলে কৌশলে মুবিন ভাইয়ের থেকে জেনে নিল জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না। জান্নাতকে জায়িন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ভেবে একবার যে ছ্যাকাটা খেয়েছে! সেই ছ্যাকা আর খাবে না।#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪৭

মীরা যতবারই জায়িনকে মেসেজ দেওয়ার জন্য ফোন হাতে নিয়েছে, ঠিক ততবারই কোনো না কোন বাধা পেয়ে ফিরে এসেছে। প্রথম বার রিমু কল করে কতক্ষণ ধরে বকবক করলো। রিমুর সাথে কথা বলা শেষ করে মেসেঞ্জারে ঢুকলে তনি মাহাকে নিয়ে ঘরে এলো। মীরা তনিকে দেখে ফোন রেখে দিল। তনি মাহাকে মীরার কাছে গছিয়ে দিয়ে বলল,

“সারাদিন কী করিস হ্যাঁ? বোনটাকে তো একটু কোলেপিঠে করে মানুষ করতে পারিস।”

“তুমিও তো ওর বোন। তুমি মানুষ করো।”

“করছিই তো। কিন্তু আমি একা দায়িত্ব পালন করলে তো হবে না। তোকেও বোন হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে।”

তনি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে মীরার দেরি করিয়ে দিচ্ছে। সে মাহাকে কোলে নিয়ে তনিকে বিদায় করতে বলল,

“তনি আপু, আজ বিকালে না আবির ভাইয়াকে একটা মেয়ের সাথে দেখেছি। খুব হেসে হেসে কথা বলছিল। আমার মনে হয় মেয়েটা ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড।”

মীরা জানত এই কথাতেই কাজ হবে। তনি আবিরের কথাটা শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে নিজের ফোন আনতে রুমে চলে গেল। তনি চলে গেলে মীরা বড়ো করে শ্বাস ফেলল। একটা মেসেজ করতে গিয়ে কত বাধা! মাহাকে কোলে নিয়েই মীরা ফোন হাতে নিল। এতক্ষণ তো মেসেজ করার জন্য যুদ্ধ করেছে রীতিমতো। কিন্তু এখন কী মেসেজ করবে?

“কী বলে কথা শুরু করব? সালাম দিব? সালামই দিই। আহ মাহা, দুষ্টুমি করিস না বোন। তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলতে গেলে অনেক ভেবেচিন্তে বলতে হয়।”

মাহা দুষ্টুটা এখন যা দেখে সবকিছু ধরে মুখে দিতে চায়। দুনিয়ার সবই যেন তার খাওয়ার জিনিস। এখন সে মীরার ফোন ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মীরা বেচারি মাহাকে কোলে নিয়ে ঠিকঠাক টাইপ করতে পারছে না।

“মাহা মারব কিন্তু। তুই চাস না জায়িন ভাই তোর দুলাভাই হোক?”

মাহা মুখে তা-তা জাতীয় কোন একধরনের শব্দ করে মীরার ফোনে থাবা মেরে বসল। মীরা বকা দিলে সে আরও উৎসাহ পাচ্ছে। মাহা ফোনটা ধরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। মীরা রাগী গলায় বলছে,

“মাহার বাচ্চা এমন পিটানি দিব তোকে। তখন বুঝবি তোর বোনের কত রাগ।”

হঠাৎ মীরার চোখ ফোনের স্ক্রিনে পড়লে মীরা আকাশ পাতাল এক করে বিকট চিৎকার দিল। বেচারির চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মাহার সাথে হাতাহাতি করার সময় কখন চাপ লেগে জায়িন ভাইয়ের কাছে কয়েকটা ইমোজি চলে গেছে। ইমোজি গুলো একটা পার্পল হার্ট, আরেকটা কান্না করার। আর সবার শেষেরটা চুমুর। মীরা চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে।

“আল্লাহ! ও গড, এটা কী হলো? জায়িন ভাই দেখে ফেললে আমি কোথায় যাব? রিমুভ, জায়িন ভাই দেখার আগেই রিমুভ করতে হবে।”

মীরা মাহার উপর রাগ দেখাতে পারছে না। এত ছোট বাচ্চা তার রাগ বুঝবেও না। মাহাকে পাশে বেডে বসিয়ে মীরা তাড়াহুড়ো করে ইমোজি কয়টা রিমুভ করার আগেই জায়িন সিন করে ফেলল। মীরা ফের একবার চিৎকার করে উঠল। ওর চিৎকারে মাহা ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। মীরা ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফ্লোরে পা বাড়ি দিচ্ছে।

“না না না। অন্য সময় মেসেজ দিলে তো সিন করতে দুই তিনদিন লাগে। আজ কেন সাথে সাথেই সিন করলেন জায়িন ভাই? এত লজ্জা আমি কই রাখব? এই মুখ কোথায় লুকাবো? ইমোজি গুলো আমি দিইনি মাহা দিয়েছে। এই সত্যটা বললেও তো এখন আপনার কাছে অজুহাতই মনে হবে।”

পরপর দু’বার মীরার চিৎকার আর মাহার কান্না শুনে সবাই হন্তদন্ত হয়ে মীরার ঘরে এসে উপস্থিত হলো। ভয়ে সকলের কলিজা কাঁপছে। অজানা আশঙ্কায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। বড়মা, ছোট চাচী, তনি, ইভা ঘরে এসে দেখল দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গলা মিলিয়ে কাঁদছে। ছোট চাচী দু’জনকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলতে লাগল,

“কী হয়েছে মা? চিৎকার কেন দিয়েছিলি? এই মীরা, বল না মা। কাঁদছিস কেন?”

মীরা অশ্রুসিক্ত চোখে ফ্যালফ্যাল করে সবাইকে দেখল। তার কান্নার কারণ কীভাবে বলবে সে? বড়মার হাত-পা কাঁপছে। তিনি ঠিকঠাক কথাও বলতে পারছেন না।

“কী হয়েছে বল মা।”

তনি নিজেও এতটাই ভয় পেয়ে গেছে। সে বোধবুদ্ধি হারিয়ে বাবা, চাচাকে কল করতে চলে গেল। ইভাই একমাত্র মাথা ঠান্ডা রাখতে পারল। সে মীরার কাছে এসে কোমল গলায় জানতে চাইল,

“চিৎকার করেছ কেন মীরা? কোন কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলে?”

মীরার মাথায় এবার একটা বুদ্ধি এলো। আসল কথা মরে গেলেও কাউকে বলা যাবে না। কিন্তু কোন একটা অজুহাত তো দিতে হবে। তাই সে বলল,

“তে-তেলাপোকা! এ-একটা তেলাপোকা, উ-উড়ে এসে আমার গায়ে…

এটুকু শুনে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। ওরা ভাবছিল কী না কী হয়ে গেছে। এই সামান্য কারণে পুরো বাড়ির মানুষকে হয়রান করার জন্য কেউ মীরাকে বকতেও পারল না। কারণ ছোটবেলা থেকেই এই মেয়ের সাপ, তেলাপোকা, কুকুরে ভীষণ ভয়। এই তিনটা জিনিস সামনে দেখলে মীরা মরে যাবে নাকি জ্ঞান হারাবে খেয়ালে থাকে না। বড়মা নিজের কাঁপা কাঁপি কিছুটা কমিয়ে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

” থাক রে মা কাদিস না। ভয় পেয়েছিস না! কালই তোর বড় আব্বুকে বলব। বাড়িতে একটা তেলাপোকাও রাখব না। আমার সোনা মেয়েকে ভয় দেখানো, না! সব ক’টাকে মে’রে ভূত বানিয়ে ফেলব।”

ছোট চাচী মাহাকে কোলে নিয়ে শান্ত করতে করতে মীরার ভয়ও দূর করার চেষ্টা করছে।

“পাগলি মেয়ে! তেলাপোকা দেখে এত ভয় পেতে হয়! তুই কি এখনও ছোট? তেলাপোকা তোর কী করবে? তুই বরং আরেকদিন এলে তেলাপোকার ঘাড় মটকে দিবি।”

সবাই তার জন্য কতো চিন্তা করে! তার একটু ভয় পাওয়া নিয়েই সবাই কত অস্থির হয়ে পড়েছে। অন্য সময় মীরা ছোটখাটো মিথ্যা বলে। কিন্তু এখন এভাবে বড়মা, ছোট চাচীকে মিথ্যা বলে মীরা মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছে।
মীরাকে শান্ত করে সবাই চলে গেলে মীরা রেগেমেগে ফেসবুক একাউন্টই ডিএক্টিভেট করে দিল। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি। যত ঝামেলা এই মেসেজের জন্যই তো।

“না। ঝামেলা মেসেজের জন্য না। ঝামেলা আপনার জন্য জায়িন ভাই। আপনি আমার জীবনের পুরো রুটিনটাই এলোমেলো করে দিয়েছেন। নিজে তো বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে পড়াশোনা করে উলটিয়ে দিচ্ছেন। এদিকে আমার কী অবস্থা হচ্ছে একবার ভাবছেনও না। আপনার জন্য সবাইকে মিথ্যা বলতে হলো। আপনি মানুষটা একটুও ভালো না।”

….

বাবা বাড়ি আসায় মুবিনের স্বাধীনতায় কিছুটা বিগ্ন ঘটেছে। সে এখন চাইলেও আগের মতো যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারছে না। কোথাও যাওয়ার হলেও বাবার কাছে বলে যেতে হচ্ছে। রোজ সন্ধ্যায় মুবিনকে বেরুতেই হয়। বাবা আসার পর সন্ধ্যায় বেরোনোটা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। আজও মুবিন বাড়ি থেকে বেরুবার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু বাবা বাড়িতেই আছে। তারপরও সে নিঃশব্দে বেরিয়ে যেতে চাইলে জামান হোসেন ছেলেকে ডেকে উঠলেন।

“কোথায় যাচ্ছিস?”

বাবার ডাক শুনেই মুবিন দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঠোঁট কামড়ে ফিরে তাকাল। আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করল।

“কোথাও না আব্বু।”

“তিন চার দিন ধরে লক্ষ করছি রোজ সন্ধায় তুই বেরিয়ে যাস। বাড়ি ফিরিস ন’টার পরে।”

মুবিন মনে মনে বলল,

“এই রে! এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। আব্বু ঠিকই খেয়াল করেছে।”

“তুই কোথায় যাচ্ছিস, কী করছিস তোর মা-ও জানে না।”

মুবিন ভাবছে আজ রক্ষে নেই। তার হিটলার বাপ আজ সত্যিটা জেনেই ছাড়বে।

“রোজ এই সময় কোথায় যাস?”

“কোথাও না আব্বু।”

ছেলের মুখ ছেলেই জামান হোসেন বুঝতে পারলেন মুবিন মিথ্যা বলছে। তবুও তিনি বিষয়টা নিয়ে আর ঘাঁটালেন না।

“ঠিক আছে। রুমে যা।”

মুবিন আজকের মতো বেঁচে গিয়ে রুমে ফিরতেই তার ফোন বাজলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল,

“কোথায় তুই মুবিন? প্রতিদিন তোর লেট হয়। এরকম করলে দলটা কীভাবে আগাবে? তুই কি সিরিয়াস? নাকি টাইম পাস করছিস? দেখ ভাই, আমাদের সবার স্বপ্ন জড়িত দলটার সাথে। তাই হেলায় ফেলায় নিস না।”

“তোদের একার স্বপ্ন? আমার কোন স্বপ্ন নেই?”

“তাহলে আসছিস না কেন?”

“বেরুতেই যাচ্ছিলাম। আব্বু আটকে নিল।”

“বাপকে এত ভয় পেয়ে এতদূর এগিয়েছিস কেন? একদিন না একদিন তো ফ্যামিলি জানতে পারবেই। সেদিন ওরা তোকে সাপোর্ট না করলে তুই কি দল ছেড়ে দিবি?”

মুবিন গম্ভীর মুখে দৃঢ় গলায় বলল,

“কোনদিন না। আমি আমার স্বপ্ন কারোর জন্যই ছাড়ব না।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here