‘এই যে নবাবজাদী!গোয়ালঘর কে ঝাট দেবে শুনি?দুদিন পর যে আমার পোলাডার বিয়া, ঘর বাড়ি লেপা লাগতোনা?গতরডা খাডাও একটু।এমনে ঢিলামি কইরা আর কত দিন পার করবা?আমার পোলাডারে তো খাইছো,বাড়ির থেকেও বিদায় হও না।আবার কামের বেলার এত ফাকিবাজি ক্যা রে?’
শ্বাশুড়ির কথায় তরকারিতে কষা মাছের পিস গুলো দিয়ে মাথা তুলে তাকায় মহুয়া।শীতের এই সকালে ফজর নামাজ পরে উঠে পুরো বাড়ি উঠোন,বাইর আঙিনা ঝাড়ু দিয়ে থালাবাসন ধুয়ে রান্না চড়িয়েছে সে।বাড়িতে হালখাতার আয়োজন চলছে, সেই মানুষদের রান্না সহ রান্না করতে গিয়ে একটু দেরি হলো কি হলো না আর এভাবে কথা শুনতে হলো তার।বাড়িতে তো কাজের লোকও আছে কই তার ভুল করার আগে তো সেই কাজের লোক সব কাজেই সাহায্য করছে।কেন কেনো করতে দেয়না।ভেবে পেলোনা মহুয়া।মানছে তার ভুল আছে, তাই বলে এভাবে কথা বলবে।অথচ এই শ্বাশুড়ি মহুয়াকে আদরে মাথায় রাখতো।অষ্টাদশী মহুয়ার কান্নাভরা আহত দৃষ্টির চাহনী উপেক্ষা করলেন মহুয়ার শ্বাশুড়ি নাজমা বেগম।তার মনে পুত্র হারানোর শোকটাই বিদ্যমান।তারমতে মহুয়া যদি তার ছেলেকে নিয়ে আক্ষেপ না রাখতো তো তার ছেলে আজ তার কাছে থাকতো।কিন্তু মহুয়ার জন্য তার ছেলে বাড়ি ছেড়েছে,সে বেচে আছে না মরে গেছে সেটাও জানে না বাড়ির কেউ তবুও সব দোষ মহুয়ার। মহুয়া পরের মেয়ে তাতে তার কি যায় আসে।এই মেয়েকে উনি বলেই ছিলেন চলে যেতে বাপের।যায়নি কেনো!এই দোষটা সম্পূর্ণ মহুয়ার এটাই মনে করেন তিনি।মহুয়া যদি তার ছেলের সাথে মানিয়ে থাকতো তাহলে তার ছেলে এভাবে অকালে মরতোনা।এসব ভেবেই নাজমা বেগম আর একবার মহুয়াকে তাগাদা দিয়ে সরে গেলেন রান্নাঘর থেকে।উঠোনের গেট পেরিয়ে নাজমা বেগম ধানের মাড়াই কাজ চলছে সেদিকে গেলেন তিনি।ধান মাড়াইয়ের মেশিনে ধান বাড়ানো হচ্ছে কামলা নিয়ে সেদিকটায় দেখতে গেলেন তিনি।রান্নাঘরের দরজা দিয়ে এটুকুই দেখলো মহুয়া।
মহুয়া দুফোটা চোখের পানি মুছে আবারও তরকারির দিকে মনোযোগ দেয়।সকালটা শুরু হলো তার যন্ত্রণা দিয়ে পুরো দিনটাই যাবে এখন যন্ত্রণা ভরপুর।রান্নাঘরের দরজার ফাক দিয়ে অদূরে মহুয়া তার দাদাশ্বশুর আজমল শিকদারকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে চুলায় কাঠখড়ি লাগিয়ে দিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।বাড়ির উত্তরদিকের কোণায় তিনটে চুলা বানানো হয়ছে মাটি খুড়ে ইট দিয়ে।সেখানে তিনটা চুলায় তিনটা বড় কড়াইয়ে জিলাপি,পুড়ি আর নিমকি ভাজা হচ্ছে।বাড়িতে মহুয়ার শ্বশুড় মশাইয়ের সারের দোকানের হালখাতা হচ্ছে।অগ্রহায়ণ মাসের শীতের শুরুতে নতুন ধান কেটে ঘরে তোলা হলে প্রতিবছরই তার শ্বশুরের দোকানের হালখাতা হয়।গায়ের মানুষরা বাড়িতে এসেই হালখাতা করে যাবে।আর অন্য গায়ের মানুষরা দোকানে এসে হালখাতা করবে।বাড়ি থেকে সদাইপাতি নিয়ে গিয়ে দোকানে দিয়ে আসলেন আজমল শিকদার।সেই ভোর পাচটা থেকে বানানো হচ্ছিলো এসব।যতটুকু বানানো হয়েছিলো সেগুলোয় দিয়ে আসলেন তিনি। আজমল শিকদার মহুয়াকে দেখে মুখখানা রাশভারি গোছের করে থমথমে গলায় বলে উঠেন,
‘রান্নাবারির কাম কাইজ সারছো নাতবউ?একটু পর যে হালখাতার আয়োজন শুরু হইবো,হুশ আছে সেদিকে?বেলা বাজে সারে আটটা মনে হয়।এতক্ষণে শুরু হওন লাগতো!’
‘দাদা হালাইগোড় (আমাদের গ্রামের ভাষায় যারা নিমকি জিলাপি বানায় তাদের হালাইগোর বলা হয়)গো সব রান্দোনবারি হইয়া গেছে।আপনে ওগো আইতে কন।খাইয়া ওরা আবার সদাইপাতি বানাতে বসবেনি।’
মহুয়া পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে কথাটা বলে আজমল শিকদারকে। আজমল শিকদার পানি টুকু পান করে গ্লাস এগিয়ে দিয়ে চলে যায়। মহুয়া ঠোট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে।এর আগের বছরেরও তো হালখাতা হয়ছিলো কিন্তু এত বিষাদে ভরপুর না।মহুয়ার দাদাশ্বশুর কত হাসিঠাট্টা করেছে।অথচ এখন কথাই বলতে চান না তিনি।মাথা থেকে এাব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মহুয়া রান্নাঘরে পা বাড়ায়।অনেক কাজ পরে আছে তার।ভাত তরকারি গামলাভর্তি করে বেরে রান্নাঘরের সাথে রাখা খাবার টেবিলে সব রেখে দিয়ে মাছের তরকারিটা নামায় সে।অন্য বাটিতে তরকারি বেরে পাটি বিছিয়ে দেয় উঠোনে টিনের বেড়া ঘেষে ঝাঁটার ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দিয়ে পাটিটা বিছিয়ে দিয়ে ডাক দেয় বাড়ির কাজের লোক সহিদাকে।সে এসে আজমল শিকদারকে ডেকে নিয়ে হালাইগোরদের সহ খাওয়াতে শুরু করে।মহুয়া ওদের সামনে যায়না।গোয়ালঘরে গিয়ে গোবর ফালানোর ঝুড়িতে কোদাল দিয়ে গোবর তুলে ঝাড়ু দিয়ে বের হয়।শ্বাশুড়িকে সবাইকে খাওয়াতে দেখে সহিদাকে হাক ডেকে গোবর ফালানোর জায়গায় ফালাতে বলে।আজকে আপাতত ঘর ছয়টা লেপবে বলে মনস্থির করে মহুয়া।ঘরের দেয়া-পিড়ি পাকা হলেও মেঝেগুলো মাটির।হালখাতা হয়ে গেলে কাল উঠোন আর বাহিরের আঙিনা লেপে দিবে গোবর দিয়ে।এসব ভেবেই বারান্দার পাশে রাখা লেপার মাটির ঢিবি থেকে মাটি নিয়ে কাঠের লাঠি নিয়ে মাটি বারাতে থাকে মহুয়া।মাটি ভিজিয়ে রেখে খেতে বসবে সে।তারপর লেপতে ধরবে।মাঝে মাঝে বাপের বাড়িই যেতে ইচ্ছে করে মহুয়ার কিন্তু তার বাবার কাছে তার এক পেটের ভাত যোগার করাই কষ্টকর বলেই মাটি কামড়ে পরে আছে সে।নয়তো কবেই চলে যেতো সে।আর কেউ না জানুক সে তো জানে তার স্বামী মরে নাই।সবার সামনে মরণের নাটক করে তারে সবার কাছে খারাপ বানিয়ে চলে গেছে সে আপন গন্তব্যে। মরলে তো লাশ পাওয়া যাইতো। কই তাতো পাওয়া যায়নি।মাটি বাড়াতে বাড়াতে এসব ভাবছিলো মহুয়া।পরে কারোর ডাকে মাথা তুলে তাকায়।তার দাদী-শাশুড়ি মনিরা বেগম দাড়ায় আছে তার পানে চেয়ে।মহুয়া মুচকি হাসে তাকে দেখে।এই একটা মানুষ পুরো বাড়িতে ভালোবাসে তাকে।মহুয়াকে হাসতে দেখে তিনি বলে উঠেন,
‘কি লো নাতবউ!ভাত খাবি চল।সকাল থে মেলা কাম করছোস। ভাত খাইয়া আবার করিস।’
‘তুমি যাও দাদী,আমি হাত ধুইয়া আইতাছি।’
মহুয়ার আবারও মুচকি হেসে উত্তর দেয়।মনিরা বেগম মাথা দুলিয়ে চলে যায়।মহুয়া হাত ধুয়ে একটা কথা মাথায় আসতেই ছুট লাগায় রান্নাঘরে।আরমানের জন্য তার সকাল সকাল কফি করা হয়নি।চুলায় পাতিলে গরম পানি বসিয়ে দিয়ে দাদীশ্বাশুড়ি আর শ্বাশুড়িকে খেতে শুরু করতে বলে।যত যাই হোক সবাই একসাথে খায় ওরা।মহুয়া পারতোনা কফি বানাতে,কিন্তু তার শহর ফেরত দেবর শিখিয়েছে কফি বানানো।ঘুম থেকে উঠার সময় হয়ে গেছে আরমানের।শহরে ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে শহরেই চাকরি করে সে।ছুটিতে বাড়িতে এসেছে আর তাতেই বাবা মা ধরে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিতে বউ ঠিক করে ফেলছে গতকাল।আংটিও পড়িয়ে আসছে সময় কম বলে বিয়েটা তাড়াতাড়ি করাবে।ঘুম থেকে উঠে কফি না পেলে আরমানের চিল্লানিতে বাড়ি মাথায় উঠবে।কফি না পেলে তার মাথা ব্যাথা করে।এই ভেবে খাওয়া রেখে কফি বানিয়ে নেয় মহুয়া।আরমানের আনা কফির মগে কফি ঢেলে নিয়ে ছুট লাগায় উত্তর-পূর্ব দুয়ার করে তোলা ছয়টা রুমে সবথেকে কোণার রুমটায়।বাড়িটার অবস্থানই যে এমন পূর্বদিকে তিনটা রুম তারসাথে লাগিয়ে দক্ষিণ পাশে তিনটা রুম করা।সাথে লম্বা বারান্দা। উত্তরে একপাশে কলপাড় দুটো আর এক সাইডে গোয়ালঘর বানানো।সাথেই গোড়ারপার করা,ছয়টা গরুর খড়-পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করা।আর দক্ষিণের ঘরের সাথে রান্নাঘর করা,পাশেই খাবার জায়গা করা।সামনে একটু খানি উঠোন তাতে গেট দেয়া।গেট পেরিয়ে বাইরে বড় উঠোন সেখানে সব আবাদ-ফসলের কাজ করা হচ্ছে।এই এত বড় বাড়ির বউ একটা সাধারণ বর্গাচাষীর মেয়ে হয়ে কিভাবে হলো মহুয়া।আরমানের দরজার সামনে দাড়িয়ে টোকা দিয়ে দাড়িয়ে পুরো বাড়িতে নজর বুলিয়ে এসব ভাবছিলো মহুয়া।আরফাজ দরজা খুলতে হাসিমুখে কফির মগ এগিয়ে দেয় সে।আরফাজ ভাবীর হাত থেকে কফি নিয়ে রুমে ঢুকে যায়।মহুয়ার জন্য আজ তার বড় ভাই আরফাজউধাও।আইনত মহুয়া এখনও আরফাজের ওয়াইফ।সেজন্য তাকে কেউ বাড়ি থেকে বের করতে পারেনা।এই কারণেই আরমানও মহুয়াকে ইগনোর করে চলে।দুদিন পর এই আরমানের বিয়ে।দেখতেই তো বাচ্চা বাচ্চা লাগে।তার আবার বিয়ে এখনই,ভাবতেই মহুয়ার হাসি পেলো।হাসি আটকে মহুয়া গিয়ে খেতে বসে যায় শ্বাশুড়ির সাথে।
💖💖💖
নিজের রুমের জানালার সাথে মাথা হেলিয়ে দিয়ে হাতে পড়ানো সোনার আংটিটার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে জান্নাত।কি একটা তিক্ত স্মৃতি আংটিটা তার।আসলো দেখলো পছন্দ করে হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো আর সে অন্য কারোর হবু বউ হয়ে গেলো। ভাবতেই কান্নার দমকটা আরও বাড়ছে জান্নাতের।সেই সময় জান্নাতের বড় বোন তোর্ষা এলো সেখানে।ছোটো বোনটাকে কাদতে দেখে এগিয়ে যায় বোনের দিকে।কাছে গিয়ে থুতুনিতে আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে জান্নাতের চোখ মুখ ফোলা দেখে তার বুকের মধ্যে ছ্যাত করে উঠে।তার আদরের বোন যার গায়ে একটা আচর লাগতে দেননি তিনি সে কাদছে।ব্যাপারটা ব্যাপক কষ্ট দিচ্ছে তোর্ষা কে। জান্নাত বড় বোনকে দেখে কান্নার দমক আরও বাড়িয়ে দেয়।জান্নাত বোনকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বোনকে।তোর্ষা বোনকে আদুরে গলায় জিগাসা করে,
‘আমার পিচ্চি জানটা কাদছে কেনো?সে কি এই বিয়েতে খুশি নয়?’
বোনের আদুরে স্বরের কথা শুনে জান্নাত আরও জোড়ে কেদে দেয় হেঁচকি তুলে। তারপর ভাঙা গলায় উত্তর দেয়,
‘বড়পু আমি বিয়ে করতে চাইনা প্লিজ। আমি অন্তত এই অনার্সটা শেষ করতে চাই।তুই বাবাকে বুঝা না প্লিজ যেন বিয়েটা ভেঙে দেয়।সবে তো অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠলাম বল। আর একটা বছর।এখনই বিয়ে করা সম্ভব! ‘
বোনের কথায় তোর্ষা দুকদম পিছিয়ে যায় বোনকে ছেড়ে।সেও তো একদিন তার মায়ের কাছে এভাবে বিয়ে ভাঙতে বলেছিলো।কিন্তু তার বাবা যে রাগী আর একগুঁয়ে মানুষ নিজের সম্মানের খাতিরে মেয়েকে ঘরবন্দী করতেও দুবার ভাববেন না।তোর্ষা কাপা গলায় বলে উঠে,
‘জান বোন আমার তোর কি কোথাও সম্পর্ক আছে?না থাকে তো বিয়েতে সমস্যা কোথায়।পুরো গ্রাম জানে তোকে আংটি পড়িয়ে গেছে দু গ্রামের পরের শিকদার পরিবার।এখন বিয়ে ভাঙার কথা বলছিস।বাবার মুখের উপর কথা শুনাবে গ্রামবাসী।এমনিতে গ্রামের জমিদার হওয়ার ফলে কম শত্রু নেই বাবার।মানুষ হাসবে তো বাবার উপর।’
বোনের মুখে সম্পর্কের কথা শুনে ঘাম ছুটে যায় জান্নাতের।মনের পাতায় ভেসে উঠে একজনের মুখ।হাতপা কাপতে থাকে জান্নাতের।তোর্ষা বোনের এই অবস্থা দেখে এগিয়ে আসতেই জান্নাত সেন্স হারিয়ে মেঝেতে এলিয়ে পরে।তোর্ষা তা দেখে বাড়ির সবাইকে চিৎকার করে ডেকে উঠে।
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ২
#Tasfiya _Nur
বিকেলে বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে আছে জান্নাত।পিঠ ছাড়িয়ে কোমড় ছুইছুই করা চুলগুলো বিকেলে শনশনে বাতাসে উড়াউড়ি করছে।তোর্ষা দুকাপ আদা মধু দিয়ে চা করে এনে বোনের পাশে দাড়ালো।জান্নাত বোনকে দেখে মুচকি হাসে।তোর্ষা চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় বোনের দিকে।জান্নাত কাপটা নিয়ে ছাদের রেলিং ঘেষে দাড়ায়।পুরোনো শ্যামলা পড়া জমিদার বাড়িটায় কেমন একটা গুমোট ভাব।তোর্ষা বোনের পাশে দাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিগাসা করে,
‘খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিস না কি?সকালে সেন্সলেস হয়ে গেলি।ডাক্তার কাকা চেকআপ করে বললো অতিরিক্ত চিন্তা,প্রেশার লো, শরীর বড্ড দূর্বল তোর বোন।কিসের এত চিন্তা তোর?ভাইয়া যে সবার সাথে রাগারাগি করলো আমরা এতগুলা মানুষ হয়ে তোর খেয়াল রাখতে কেনো পারিনা এজন্য। ‘
‘আপুই! আমি কি খুব বাজে রে?আমায় ভালোবাসা যায়না কি?’
জান্নাতের কথায় তার দিকে চকিতে তাকায় তোর্ষা।সে আর জান্নাত তো মাত্র তিনবছরের ছোটো বড়, সেই হিসেবে তাদের দুবোনের মাঝে বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক হওয়া উচিত।এতদিন যাবত হয়েও এসেছে তাই।তবে কি দুইবোনের মাঝে দূরত্ব এসেছে।ভেবে পেলোনা তোর্ষা।জান্নাতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসে,
‘ভালোবেসেছিস কাউকে?এসব বাজে কথা মাথায় আসে কি করে যে তুই বাজে মানুষ!’
‘বেসেছি তো আপু খুব করে বেসেছি।যেখানে পিরুষ মানুষ বেহায়া হয়ে মেয়েদের পিছনে ছুটে সেখানে আমি তার জন্য পাগল হয়েছি।কিন্তু সে বরাবরই এড়িয়ে গেছে। তাইতো সেমিস্টার এক্সাম শেষ হতেউ তার চক্ষুর অগোচরে এসেছি।কিন্তু এসেই তো সর্বনাশ হলো তবে।অন্য কারো ঘরের ঘরণী হবো।সুন্দর না বল!’
কথাটা বলেই জান্নাত চায়ের কাপটা তোর্ষার হাতে দিয়ে কাধে পড়ে থাকা ওরনাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিচে নেমে যায় তোর্ষাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।তোর্ষা অবাক চোখে বোনের পানে তাকিয়ে থাকে।তার ছোটো বোনটা বড় হয়ে গেছে ভালোবাসে কাউকে।ঢাকা শহরে বড় ভার্সিটিতে পড়বে বলে জিদ করে তিনটা বছর হলো ঢাকায় হোস্টেলে থাকছে জান্নাত।সেখানে গিয়েই কষ্টের উৎপত্তি ঘটিয়ে কষ্ট পাচ্ছে সে, অথচ তিন ভাইবোনের মাঝে জান্নাত ছোটো হওয়ার দরুণ আদরে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে ওকে।যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। হয় তাদের বাবা ইয়াকুব তালুকদার আবদার মিটিয়েছে নয়তো তার অনুপস্থিতিতে আবদার মিটিয়েছে তাদের বড় ভাই সুজন তালুকদার।সে আর তাদের মা আহিদা বেগম দাড়িয়ে জান্নাতের খুশি দেখেছে। আর সেই বোন আজ কষ্ট পাচ্ছে।ভাবতে পারছেনা তোর্ষা।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।জান্নাতের থেকে সব জানতে হবে তার।এই ভেবে সেও হনহনিয়ে চিলেকোঠার ঘর পেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।
আগামী পরশু মেয়েটার গায়ে হলুদ আর এভাবে যদি হতাশায় অসুস্থ হয়ে পরে তাহলে কি হবে!চিন্তাটা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে তোর্ষা কে। রান্নাঘরে চায়ের কাপটা রেখে চলে যায় তাদের দাদী নুর জাহান বেগমের রুমে।তোর্ষা জানে জান্নাত এই সময়টায় দাদীর রুমে গিয়ে দাদীর হাতে বানানো জলপাইয়ের আচারটা খায় আর দাদীর সাথে গল্প করে।যতই যা হোক জান্নাতের এই কাজে হেরফের হয়না কখনো।
🌺🌺🌺
‘কই গো আছোনি মহুর মা?বলি এক গেলাস পানি দাও দেহি।বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।’
দুচালা ঘরের বারান্দায় বসে মহুয়ার মা যায়েদা বেগমকে হাক পেরে কথাটা বলে মহুয়ার বাবা রাংগা মিয়া।তার ডাকে কলপার থেকে মাটির কলসিতে পানি ভরে নিয়ে আসেন যায়েদা বেগম।কলসি থেকে গ্লাসে করে পানি নিয়ে এগিয়ে দেয় তার স্বামীর দিকে।রাংগা মিয়া স্ত্রীর হাত হতে পানি নিয়ে ঢকঢক করে একটানে পানি টুকু পান করে শেষ করে।যায়েূা বেগম স্বামীর পাশে মাটির বারান্দায় পিড়ি টেনে বসেন।রাংগা মিয়া স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন,
‘তা যায়েদা বেডাডা কই আমার?ওরে দেখবার পাই না ক্যা রে?’
‘শিহাব খেলবার গেছে গায়ের মাঠে।ওরে কখন ঘরে পাবা তুমি!গাও ধোয়া আর দু-মুঠো খাওয়া ছাড়া ওরে পাওন যায় নাকি!’
স্ত্রীর কথায় হতাশ হন রাংগা মিয়া।ছেলেটাকে পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চান তিনি,কিন্তু তার ছেলে তো কথা শুনার মানুষ না।এত কষ্ট করে রোজগার করে অভাবে দিন পার করেও ছেলের লেখাপড়ার খরচে খামতি রাখেন না তিনি।হতাশার শ্বাস ছেড়ে স্ত্রীকে বলে উঠেন,
‘খাওনের কিছু আছে?থাকলে দেও খাইতে।খাইয়া একটু হাটে যাই। আজ কামলা খাইটা তিনশডা টেকা পাইছি।বাজার-সদাই কইরা আনি।’
যায়েদা বেগম স্বামীর কথায় বারান্দার এক পাশে কুটুরি করে খাওয়ার জায়গায় যে ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখান থেকে ভাত তরকারি বেরে এনে স্বামীর সামনে দেন খেতে।রাংগা মিয়া হাত ধুয়ে ভাত তরকারি মাখিয়ে খেতে শুরু করেন।যায়েদা বেগম স্বামীর খাওয়ার মাঝে বলে উঠেন,
‘দুইডা দিন পর আরমান বাবার বিয়া।বিয়াই সাহেবের বাজান আইছিলো দাওয়াত করতে দুপুর পরে।বলি কি আমাগো কি যাওন উচিত হইবো?’
যায়েদা বেগমের কথা শুনে খাওয়ার মাঝেই থেমে যান রাংগা মিয়া।চোখের সামনে মেয়ের মুখটা ভেসে উঠে।রাংগা মিয়ার ভিটেমাটি আর পাচ শতক জায়গা ছাড়া কিছু নেই।তিন শতক বিক্রি করে মেয়ের সুখের জন্য মেয়ের পড়াশুনা বাদ করিয়ে বিয়ে দেন।বাকি দুইশতক আর ভিটেমাটি টুকু ছেলের জন্য রেখেছেন।অথচ সেই মেয়েই জামাইয়ের সাথে ঝামেলা করে আজ কষ্টে আছে।কি এমন ক্ষতি হতো জামাই বাবাকে মেনে নিলে।ভাবতেই দুচোখ অশ্রুসিকত হয়ে উঠলো রাংগা মিয়ার।স্বামীর থমথমে মুখ দেখে শীতের এই দিনেও রীতিমতো ঘাম ঝড়ছে যায়েদা বেগমের।রাংগা মিয়া কিছু বলছেনা স্বামীর গায়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে আবারও বলে উঠেন,
‘কি হলো তোমার?কিছু তো কও!’
স্ত্রীর ধাক্কায় মেয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে ভাতে আবার গ্রাস দিয়ে বলে উঠেন,
‘আজমল শিকদার বাড়ি বয়ে এসে কয়ে গেছে না যাইয়া উপায় নাই।কিন্তু মিলিয়ে নিও এবার তোমার ঐ বদমাশ মেয়েকে আমি বাড়ি আনবো।গায়ের মানুষের কাছে কথায় টিকে থাকন যায়না।এতগুলা দিন পার হয়ে গেছে তবুও সবার মুখে এককথা, “তোমার মেয়ে মহুয়ার জন্য শিকদার বাড়ির বড় ছেলে গলায় কলসি বেধে নদীতে ডুবে মরছে।” আর সহ্য করা যায়না মহুর মা।কই আরফাজ বাবার লাশ তো পাওয়া যায়নি।পাওয়া গেলে তোমার মেয়ে জেলে থাকতো এদ্দিনে বুঝছো তুমি।পুলিশরে যে বেয়াই সাহেব অভিযোগ দায়ের করছিলো শুধু প্রমাণের অভাবে বাইচা গেছে তোমার মাইয়া।জানিনা কপালে কি আছে ওর।জামাই বাবা নাই তাই ঐ বাইত্তে পইড়া থাকার মানে হয়না।যাইয়া নিয়া আসমু।মেয়েরে বুঝাইয়ো তুমি।এতদিন মেলা জিদ সহ্য করছি আর না।’
খেতে খেতে কথাটা বলে শেষ করতে করতে খাওয়াও শেষ করেন মহুয়ার বাবা।যায়েদা বেগম নিজেও স্বামীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হাত ধুয়ে উঠে মহুয়ার মাকে বলেন বাজারে ব্যাগটা দিতে।যায়েদা বেগম ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে থালা-গ্লাস কলপারে নিয়ে ধুতে লাগেন।
🦋🦋🦋
সন্ধ্যাবেলায়,,,
সারাবাড়িতে বাতির সুইচ টিপে সন্ধ্যার আলো দেয় মহুয়া।সবে গোসল সেরে বেরুলো সে।বাড়িঘর ঝাড়া-লেপায় সময় লেগে গেছে সারাটাদিন।সন্ধ্যার নাস্তা বানানো হয়নি।এজন্য চুলে পেচানো গামছাটা খুলে বারান্দায় বাধা রশিতে মেলে দিয়ে রান্নাঘরে যায়।রান্নাঘরে গিয়ে শ্বাশুড়িকে উপস্থিত দেখে অবাক হয় সে।এই সময় তার শ্বাশুড়ির ঘরে বসে পায়ে বাতের তেল মালিশ করার কথা।অথচ তিনি চায়ের পানি গরম করতেছেন চুলায়।মহুয়াকে দেখেও তিনি নিরব।মহুয়াই আগ বারিয়ে জিগাসা করে,
‘আম্মা আপনে এখানে কি করেন?আপনি ঘরে যান আমি সব তৈয়ার করে দিতাছি।’
‘আমার সংসার,আমি সেখানে কি করি মানে?কি কইতে চাও বউ আমি কিছু করতে পারমু না।তুমি একাই আসছো পন্ডিত। সব পারো!’
নাজমা বেগম খোচা মেরে কথাটা বলে মহুয়াকে।শ্বাশুড়ির কথায় মনঃক্ষুণ্ন হয় মহুয়ার।সে তো ভালো বুঝেই শ্বাশুড়িকে বললো করে দিবে।কিন্তু তিনি উল্টোটা বুঝলেন।মহুয়া শ্বাশুড়ির পাশে বসে তরকারি কাটতে শুরু করে।রাত আটটায় সবাই খেতে বসে,রান্নাঘরে আসার আগে দেখে এসেছে ছয়টা বেজে গেছে। সময় মাত্র দুই ঘন্টা এর মাঝেই সব রান্না সেরে ফেলতে হবে মহুয়ার।কাজের লোক সহিদা চারটা বাজতেই চলে যায়। তাই সব কাজ এক হাতেই সারতে হবে মহুয়ার।কিন্তু সারাদিনের খাটনিতে শরীর যেন চলছেনা তার।নাজমা বেগম আড়চোখে মহুয়াকে দেখে নিলেন।তারপর থমথমে গলায় মহুয়াকে বলেন,
‘হয়ছে এত কষ্ট করা লাগবেনা। একপদের তরকারি রান্দো সাথে ভর্তা কিছু কইরো।একগাদা তরকারি রান্দার দরকার নাই জনে জনের।আমি সবডিরে চা-বিস্কিট দিয়ে আসি, তুমি ভাতের চাউল ধুইয়া দাও।আমি আইসা জমশলা বাইটা দিমুনে।’
শ্বাশুড়ির কথায় মনটা আনন্দে ভরে উঠে মহুয়ার।এগারোটা মাস পর নাজমা বেগম তার সাথে ভালো করে কথা বললো।চোখের কোণে পানি আসে মহুয়ার।ঝাপসা চোখ মুছে পাতিলে ড্রাম থেকে চাউল নিয়ে ধুয়ে নেয়।বেগুন আছে তরকারির ডালায় ওগুলোয় সিদ্ধ করে ভর্তা করবে,সাথে সুরমা মাছ দিয়ে আলু-ফুলকপি দিয়ে চচ্চড়ি করে নিবে বলে সেই অনুযায়ী তরকারি কাটে মহুয়া।তার শ্বশুরের খুব পছন্দ এগুলো।সাতটায় দোকান থেকে ফিরবেন মহুয়ার শ্বশুর আরিফুল শিকদার।আরমান তো এসব খায়না তার জন্য মুরগী গোস্তের তরকারি করে নিবে মহুয়া।এসব ভাবতে ভাবতে তরকারি গুলো তাড়াতাড়ি কেটে নেয় মহুয়া।
সময় গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। রাত দশটা বাজে বাড়ির সব কাজ সেরে শুয়ে পড়েছে মহুয়া।বালিশের পাশে রাখা বাটন ফোনটা ভো ভো করে বেজে চলছে।ভাইব্রেট মুডে থাকার ফলে কাপছে ফোনটা।মহুয়া কম্বলের তলা হতে হাত বের করে ফোনটা হাতে নেয়।নাম্বারটা দেখে পিলে চমকে উঠে মহুয়ার।”এই লোকটা কেনো ফোন দেয় আমাকে।যত নষ্টের গোড়া এই মানুষটা।” কথাটা আনমনে বলে কলটা কেটে দেয় সে।একটুপর নাম্বারটা থেকে মেসেজ আসে।তাতে লিখা আছে,
“পালাচ্ছো আমার থেকে।ওকে পালাও,আমিও আসছি কাল তোমার বাড়ি।সামনে আরমান শিকদারের বিয়ে তো।দেখি কেমনে খেদায় দাও আমারে।দেখা হচ্ছে কাল সকালে।আল্লাহ হাফেজ।”
ক্লাস টেন অব্দি পড়ার খাতিরে মোবাইলের মেসেজটা পড়তে পারে মহুয়া। মেসেজটা পড়ে নাম্বারটা ব্লক মেরে দিয়ে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে বিরবির করে বলে উঠে,
‘কোথায় আপনি আরফাজ।আপনিহীন এই আমি,আজ খুবই নিঃস্ব আর কমদামী।আপনার কথা ফলে যাচ্ছে আরফাজ।প্লিজ ফিরে আসুন না আপনি। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। আমার কষ্ট হয় আরফাজ খুব কষ্ট হয়।’
কথাটা বলে অশ্রু বিসর্জনে ব্যস্ত হয়ে যায় মহুয়া।
চলবে?
মন মহনায় শুন্যতা পর্ব ১+২
তাসফিয়া