মন ময়ূরী পর্ব -০৬

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

৬.

খেয়ার পরিবারের সাথে এবার যোগ দিলো ফায়েজের পরিবার৷ ক্লাবের সেই কক্ষে কেউবা বসে আছে কেউবা দাঁড়িয়ে আছে মুখ গম্ভীর করে। সকলের মধ্যেমনি হয়ে বসে আছে আমাদের খেয়া।

ফায়েজের পরিবার এখানে আসার মূল কারণ হচ্ছে ফায়েজের বাবা মাহমুদ চৌধুরী। কারণ,ফায়েজের পাশাপাশি তিনি জানেন খেয়া তাদের দু’জনকে সরাসরি এই বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করেছিল যার মূল কারণ ফায়েজের কর্মজীবন। সেখানে হুট করে খেয়ার বাবার আংটিবদলের এনাউন্সমেন্ট, ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে লাগছে ফায়েজের বাবার কাছে!

-খেয়া, তুমি কি সত্যি ফায়েজকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছো?

মাহমুদ চৌধুরীর এমন প্রশ্নে খেয়া কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলো। কিন্তু,বিচলিত হলে তো চলবে না তাই খেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাহমুদ চৌধুরীকে সব সত্য ঘটনা জানাবে। উনারা হয়তো জানবে খেয়া আর তার পরিবার খুশিমনে এই বিয়ের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে কিন্তু খেয়ার পরিবার তো জানে এই বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তাদের জীবনে ঠিক কতটা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে?

-আসলে,চাচা বাবা আমাদের কিছু না জানিয়ে সবার সামনে এনাউন্সমেন্ট করেছে। খেয়া ফায়েজের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।

মাহমুদ চৌধুরী অবাক হয়ে খেয়ার বাবা কবিরের দিকে তাকালেন। কবির খাঁন মাহমুদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন। ফায়েজের মা এবং বাবা দু’জনে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ফায়েজের মা খেয়াকে বলেন,

-এখন, কি করবে খেয়া? তোমার জন্মদিনের পার্টিতে যতগুলো মিডিয়ার লোক উপস্থিত ছিল এখন তোমার আর ফায়েজের বিয়ের এনাউন্সমেন্টে আরও মিডিয়ার লোক উপস্থিত হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। সামাজিক মাধ্যমে তোমাদের দু’জনের বিয়ের খবর কি পরিমানে শেয়ার হচ্ছে তুমি ভাবতেও পারবে না। একটু ভুলের জন্য এখন কতগুলো মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হবে তুমি জানো, খেয়া?

-আমি সব জানি চাচি, তাই বলছি আপনারা প্লিজ দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আপনাদের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি ।

খেয়ার কথায় কিছুটা দুশ্চিন্তার ছাপ কম দেখালো ফায়েজের বাবা-মায়ের মুখে।খেয়ার মা নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, উনার সেই ছোট মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেলো? আজ যে উনার সামনে আছে সে তো তার বাবার সম্মান বাঁচাতে গিয়ে,তার বাবাকে যাতে কেউ মিথ্যাবাদি উপাধি দিতে না পারে সেজন্য জনম ভর নিজের অপছন্দের মানুষের সাথে দিন পার করবে!সেই দুষ্ট খেয়ার সাথে এই পরিণত খেয়ার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।

ফায়েজের বাবা-মা চলে গেলেন তবে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন তারাতারি চলে যেতে। কারণ, উনাদের কথা প্রায়ই উপস্থিত মেহমানেরা জিজ্ঞেস করছে৷

উনারা চলে যাবার পর খেয়ার মা এসে খেয়ার হাত ধরে কিছু জিজ্ঞেস করবেন তার আগেই খেয়া তার মায়ের হাত ধরে বলে,

-মা, আমি জানি তুমি কি বলবে।অথচ, ফায়েজ চৌধুরীকে তোমরা সবাই পছন্দ করেছিলে আমার জন্য। আমার পছন্দ হয়নি বিধায় তোমরা এখন আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো।সেদিন, যদি আমি ফায়েজকে পছন্দ করতাম তবে কি এত দুশ্চিন্তা করতে,মা? তাই বলছি তোমার একটি মাত্র মেয়ের জীবনের কতবড়ো দিন আজ! তুমি কই হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলবে তা না করে এখানে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছো এটা ঠিক না বুঝলে। এখন যাও বাবার কাছে বাবার তোমাকে খুব প্রয়োজন। আমি তো জানি আমার বাবা নিজেকে ঠিক এই মূহুর্তে কতটা অসহায়বোধ করছেন!

খেয়ার মা নিজের চোখের পানি মুছে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন রুমের বাইরে।খেয়ার দাদিকে কিছুক্ষণ আগল বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে খেয়ার বাবা৷ বয়স্ক মানুষ এত দুশ্চিন্তার মাঝে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না।

ক্লাবের এই ঘরটায় এখন কেউ নেই। পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে আছে পুরো ঘর জুড়ে।খেয়া নিজেকে সবার সামনে এতসময় ধরে ঠিক যতটা শক্ত রেখেছিল এখন আর নিজেকে একা পেয়ে আর পারেনি। দুচোখে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

মিনিট দশেক এইভাবে অতিক্রম হবার পর খেয়া তার চোখের পানি মুছে মোবাইল হাতে নিয়ে কারো কাছে কল করলো। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই খেয়া বলে,

-দশ নাম্বার রুমে চলে আসুন।

কল কেটে দেয়ার পর খেয়া ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো। খেয়া, আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ভের দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে। বেসিনের কল ছেড়ে দুহাতে পানি ভরে ঝাপটে দিলো নিজের চোখেমুখে।আরও দু-তিনবার পানি ঝাপটে দেয়ার পর চোখের জ্বালা কিছুটা কমতে খেয়া কল বন্ধ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো।

রুমে আসার পর ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে মুখের পানি মুছে নিলো খেয়া।

এরইমাঝে, দরজায় নক পড়লো খেয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো, ফায়েজ এসেছে সাথে আরও একজনকে দেখা যাচ্ছে।কিন্তু, ফায়েজের পাশে দাঁড়ানো লোকটাকে খেয়া কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। খেয়াকে দেখামাত্র ফায়েজের পাশে দাঁড়ানো লোকটা সালাম দিয়ে বলে,

-ভাবি, আমি জব্বার উদ্দিন। আমাদের ফায়েজ স্যারের একমাত্র এসিস্ট্যান্ট।আমাদের আসতে খুব বেশি দেরি গেলো ভাবি। আসলে,হুট করে আপনার বাবা এনগেজমেন্টের এনাউন্সমেন্ট করলেন ঠিক আছে কিন্তু স্যার আপনার হাতের অনামিকা আঙুলে কি পড়াবে? এই দুশ্চিন্তায় স্যারের মাথাব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি স্যারকে বগলদাবা করে বড়ো জুয়েলারী শপ থেকে আপনার জন্য হিরার আংটি কেনার জন্য গিয়েছিলাম।সেখান থেকে ফিরে আসতে আমাদের এত দেরি হয়েছে।আপনি আবার স্যারের সাথে রাগ দেখাবেন না ভাবি। তিনি অতন্ত ভালো মানুষ, তাই না স্যার?

খেয়া হাসিমুখে জব্বারের সব কথা শুনার পর ফায়েজের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনি প্লিজ একা আসবেন আমার সাথে নাকি আপনি জব্বার উদ্দিনকে সাথে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছেন?

-না, আমি একাই আসবো। জব্বার?

-জি স্যার।

-তুমি চলে যাও।

-না, স্যার। আপনি যেখানে আমি সেখানে। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো

খেয়া দরজা ছেড়ে রুমের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালো ফায়েজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের ভিতরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।দরজার আটকানোর সাথে সাথে জব্বার এগিয়ে এসে দরজায় নিজের কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগলো কি বলছে ফায়েজ আর খেয়া?

ঠিক সেদিনের মতো আজও খেয়া আর ফায়েজ একাকি। ফায়েজ ঠিক সেদিনের মতো আজও শঙ্কিত খেয়ার সামনে। প্রথমবার নার্ভাস ছিল খেয়া পছন্দ করবে তো তাকে আর আজ দ্বিতীয়বার নার্ভাস এই ভেবে খেয়া কি তবে বিয়েটা করতে পারবে না? পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের কপালের ঘাম অনবরত মুছছে ফায়েজ ।

-আমার বাবা আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে এরকম ভাবে সবার সামনে আমাদের এনগেজমেন্টের এনাউন্সমেন্ট করবে আমরা কেউই ভাবতেও পারিনি। সবাই যেহেতু জেনে গেছে সেখানে পিছু হটবার পথ নেই। একদিকে আমার বাবার সম্মান অন্যদিকে আপনার ক্যারিয়ার। তাই মাঝখান দিয়ে আমাকে বলি হতে হচ্ছে। নায়ক সাহেব আপনি এতক্ষণে হয়তো বুঝতে পারছেন কেন আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি?

-কিন্তু, খেয়া আপনি চাইলে আমি আপনার এবং আমার পরিবারের সাথে কথা বলে এই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে হ্যান্ডাল করতে পারি।

ফায়েজের কথায় খেয়া মেকি হাসি দিয়ে বললো,

-আপনি জানেন? প্রথমত আমিও আপনার মতো ভেবেছিলাম কিন্তু আমার ধারনা পাল্টে গিয়েছে আপনার ফ্যানবেজ এবং আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভেচ্ছাবার্তা দেখে। আপনি হয়তো আমাকে বিয়ে করবেন ভেবে অতি আনন্দিত হয়ে আপনার ফেসবুক,ইন্সট্রাগ্রামে পেইজে যাননি, গিয়ে দেখুন কি হচ্ছে সেখানে?

ফায়েজ খেয়ার কথা শেষ হওয়ার আগে মোবাইল বের করে দেখলো, অসংখ্য মানুষের শুভেচ্ছায় পুরো টাইমলাইন ভরে যাচ্ছে। তার সহকর্মী, ডিরেক্টর, প্রডিউসার অনেকেই তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ফায়েজ দূর্বল দৃষ্টিতে খেয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।খেয়া ফায়েজের দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে বলতে শুরু করলো,

-আপনার ক্যারিয়ার এবার আমি বাঁচাবো তবে এর বিনিময়ে আমার কিছু শর্ত আছে।

খেয়ার শর্তের কথা শুনে ফায়েজ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-কেমন শর্ত?

-আপনার সাথে আমার বিয়ে হবার পর আমি আপনাদের বাড়িতে থাকবো না। যতদিন না আমি আমার পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে পারছি। বিয়ের দিন এবং এর পরদিন রিসিপশন পর্যন্ত আমি আপনার আওতাধীন থাকবো। এরপর, আমার জীবনের যেকোনো বিষয়ে আপনি আমাকে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। মোটকথা, আপনি আমার কাছে স্বামীর দাবী নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না যতদিন পর্যন্ত আমি না চাইছি।

খেয়া কথাগুলো শেষ করে ফায়েজের দিকে তাকালো উত্তরের আশায়। ফায়েজ মিনিট তিনেক চুপ থেকে উঠে দাঁড়ালো।হেঁটে দরজার সামনে গিয়ে খেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-আমি এবং আপনার পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছি আপনার জন্য,আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।

বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো ফায়েজ আর খেয়া অবাক হয়ে ফায়েজের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখা যাচ্ছে জব্বার ফায়েজের পিছু পিছু দৌঁড়ে যাচ্ছে। খেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও বের হয়ে গেলো সেই রুম থেকে,উদ্দেশ্য স্টেইজের দিকে।

অবশেষে, ফায়েজ রাজি হলো এখন খেয়া কিছুটা শান্তিবোধ করছে। অন্তত, কিছুটা দিন তো সে পাবে নিজের জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here