#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
মেয়েটি পুরো চৌধুরী বাড়িতে এলোমেলো হাঁটল। গুনগুন করে গান গাইল। তার বোধই হলো না এ বাড়িতে ডক্টর নেই। রাতের আধাঁরে শাড়ির আচঁল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মিনু আর রাইনা দেখে ভড়কে গেল। মেয়েটাকে এই ছয় সাতদিনে এতকিছু বুঝানোর চেষ্টা করল,কিন্তু মেয়েটি দিন হলে ঠিক থাকে। রাত নামলেই ভেবে বসে থাকে ডক্টর আছে। তার সাথে রাগ করে মনে হয় কোথাও লুকিয়ে আছে। মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে কান খাড়া করে রাখে। মনে হয় ডক্টর রেগেমেগে এই ডাক দিল, মিষ্টি।
কিন্তু না কেউ ডাক দেয়না। মেয়েটির কান্না পায়। এবার গান করার বদলে সে গুনগুন করে কাঁদে। তার কপাল সুখ নামক জিনিসটা সহজে ধরা দেয়না। দিলে ও খানিক সময়ের জন্য।
অনেকক্ষণ হাঁটাহাটির পর সে রুমে ডুকে পড়ল। ডক্টরের আলব্যাম হাতে নিল। হাসিমুখের ছবিটির উপর হাত বুলিয়ে বলল,ডক্টর আপনি আমাকে সত্যি সত্যি শাস্তি দিয়ে দিলেন। মিষ্টি আদৌ সহ্য করতে পারবে কিনা একবার ও ভেবে দেখলেন না। এই আপনার ভালোবাসা ডক্টর?
রাতের নৈঃশব্দ্যে দ্বিগুণ আওয়াজ করে মেয়েটির ফুঁপিয়ে কান্না। সে চোখমুখ মুছে নিয়ে শুয়ে পড়ে। মনে হয় রেগে কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে। মনে হয় কেউ রাগে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ইশা ফিরে তাকাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। সে বকুল ফুলের মালাটি হাতে নিল। গন্ধ শুঁকল। তারপর ডক্টরের আলব্যামে রেখে দিল। বলল, এই বকুল ফুলের মালাটি আমার কাছে নয় ডক্টর আপনার কাছে থাকুক। যদি কখনো আপনার মিষ্টি হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারি তাহলে সেদিন এই শুকনো কড়কড়ে বকুল ফুলের মালা আমি খোঁপায় দেব।
অভ্যাস অনুযায়ী মেয়েটি রাধেঁ পায়েস। কেউ মুখে দেয়না। সবাই তারকাজে অবাক হয়। আজিজ চৌধুরীর ধমকানিতে হাত থেকে পড়ে যায় সেই পায়েসের বাটি। আফির কুদৃষ্টি আবার এসে পড়ে তার উপর। আজিজ চৌধুরী চিন্তায় পড়ে যান। মেয়েটির ভালো না চাইলে ও খারাপ চাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। এর কিছু একটা বিহিত করতে হবে।
সবার সামনে ইশার হাত ধরে টানাটানি করায় ইশা লোকসম্মুখে চড় বসায় আফির গালে। ঘৃণা নিয়ে উচ্চারণ করে,আরেকবার ছোঁয়ার চেষ্টা করলে হাত কেটে রাখব।
আফির রাগ যেন আকাশ ছুঁল। আজিজ চৌধুরী না থাকলে বোধহয় সেদিন আফি জানে মেরে ফেলত ইশাকে। বিশ্রী গালিগালাজ, আর নানারকম ভাবে ইশাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে আফি। আজিজ চৌধুরী না থাকলে ইশা ভয়ে ভয়ে থাকে। এভাবে আর কতদিন। ডক্টর তাকে যে একেবারে নিঃস্ব করে চলে গেল। তাকে ভালোবাসার ও কেউ নেই। আগলে রাখার ও কেউ নেই। একজন মানুষের অভাবে কি একটা বাড়ি জাহান্নামে পরিণত পারে? ইশা দিশেহারা হয়ে পড়ল। আফির কুদৃষ্টি যে তার উপর পড়েছে সে বেশভালো ভাবেই নিশ্চিত। এ বাড়িতে থাকলে যেকোনো সময় তার বিপদ ঘটতে পারে।
কিন্তু তারপর ও তার ইচ্ছে করেনা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। এ বাড়িতে লেগে আছে ডক্টরের হাসি-খুশি,মান-অভিমান। এ বাড়ির প্রত্যেকটা আনাচেকানাচে ডক্টরের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ডক্টরের ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ লেগে আছে বিছানারচাদরে। ডক্টরের রেখে যাওয়া পান্জাবী পাশে রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে। সে কি করে ছাড়বে এ বাড়ির মায়া? আদৌ কি সম্ভব? ডক্টর কবে ফিরবে? তার প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
তারমধ্যে আজিজ চৌধুরী এলেন তার রুমে। হাতে চেক ধরিয়ে দিয়ে বলে মামার বাসায় চলে যেতে। এখানে থাকলে আফি তার ক্ষতি করবে। কথাটা শুনতে তিক্ত হলে ও ঠিকই বলেছে আজিজ চৌধুরী। অনেক কান্নাকাটির পর ইশার হুশ ফিরল। সে একছুটে বকুল তলায় গেল। কতগুলো ফুল কুড়িয়ে আলব্যামের পাতায় চাপা দিল। তার লিখে যাওয়া চিঠিগুলো আলব্যামের প্রত্যেক পাতায় পাতায় যত্নসহকারে রাখল। তার সব কাপড় চোপড় লাগেজে ডুকিয়ে নিল। কিছুই রাখল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মনে হলো তাকে ডক্টর ডাক দিয়েছে সে আচমকা পিছু ফিরল। মিনু আর রাইনা যেন লুকিয়ে কাঁদল। তাকে একটিবার ও থেকে যেতে বলল না। ইশা আজিজ চৌধুরীর মুখোমুখি হলো। জানতে চাইল,আমি আবার কবে ফিরব?
আজিজ চৌধুরী জবাব দিলেন না। যেন বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। ড্রাইভারকে বললেন, ওঁকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে এসো।
ইশা দ্বিতীয় বার চৌধুরী বাড়ির দিকে ফিরে তাকাল। সে উদ্ভট সুরে আবার আওয়াজ করে কাঁদল। কানে বাজল, এই মিষ্টি, এই আদি,এই ডক্টর ভালোবেসেছে তোমায়। তুমি বাসোনি। একটু ও বাসোনি।
ইশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,আমি আপনাকে সত্যি ভালোবেসেছি ডক্টর। আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব। আপনি আসবেন ডক্টর। আমার উপর রাগ করে থাকবেন না। ডক্টর মিষ্টির উপর রাগ করে থাকতে পারেনা ডক্টর। আপনি সত্যি আসবেন তো?
ড্রাইভারের হর্ন বাজানোর শব্দ পেয়ে ইশার সম্ভিৎ ফেরে। সে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। আর তাকায় না চৌধুরী বাড়ির দিকে। গাড়ি যখন ছেড়ে দেয়। আবার সে গাড়ির কাচ ভেদ করে গলা বের করে দেয়। মনে হচ্ছে রেগে গর্জন করে কেউ ডাকল,মিষ্টি!
খান বাড়িতে গিয়ে উঠল ইশা। গেইটে পেরিয়ে দরজায় কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল মুনা । সম্পর্কে মামার বড় ছেলের বউ। মুনার মুখে হাসি ফুটল ইশাকে দেখে। জাপটে জড়িয়ে ধরল। ইশা ছাড়তেই বলল, বড় দা কোথায়? মামা,মামি?
তার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এল তালহা বেগম। চোখ কপালে তুলে বলল, তুই এখানে, লাগেজটাগেজ নিয়া কোথা থেকে এলি।
ইশার সোজাসুজি জবাব,যেখানে বিক্রি করে দিয়েছিলে।
তালহা বেগম ভড়কে যান। ইশা ঘরে ডুকে পড়ে। সোজা তার রুমে চলে যায়। রাত্রে যখন জহির মিয়া আসে তখন ইশাকে দেখেই তার মাথা নিচু হয়ে যায়। বলে, আমাকে ক্ষমা কর ইশু। না হলে যে মরে শান্তি পাব না।
ইশা জাপটে ধরে মামাকে। কেঁদেকেঁদে বলে, আমাকে একটু থাকতে দেবে এখানে?
জহির মিয়া যেন সাথে সাথে কেঁদে দেয়। ধরে আসা কন্ঠে বলে, এসব কি বলছিস? তুই থাকলে থাকবি। কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?
ইশা কাউকে কিছু বলেনা। শুধু কাদেঁ। বলে, আমাকে একটু আশ্রয় দাও। আমার আর কিছু চাইনা। আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই মামা।
জহির মিয়ার চোখ ভিজে উঠে। তালহা বেগমের দিকে রেগে তাকায়। ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, তুই মাথা উঁচু করে থাকবি এ বাড়িতে। কেউ কিছু বললে আমাকে বলবি। তাকে বের করব আমি।
চৌধুরী বাড়ির পুত্রবধূ ইশা মানিয়ে নেয় খান বাড়িতে। খাওয়াদাওয়ার অনিয়মে, নির্ঘুম রাত কাটার ফলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে দিনকে দিন। পার হলো দুমাস।
শাড়ি পড়ে বেড়ালে তালহা বেগম কথা শোনায়। শাড়ি কেন পড়তে হবে এটুকুনি একটা মেয়ের। তখনি তার কানে বেজে উঠে ডক্টরের বলা কথাটি,শাড়িতে তোমায় খুব মিষ্টি লাগছে মিষ্টি।
ইশা হাসে। বলে, ডক্টর যদি হুট করে চলে আসে, আমাকে যদি শাড়ি পড়া অবস্থায় না দেখে খুব রাগ করবে। আমি শাড়িই পড়ব।
এক মন কেমন করা সন্ধ্যা নামল। তখন শীত শুরু হয়েছে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে ইশা। শাড়ি দিয়ে নিজেকে ডেকে তারপরে ও সে বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। গেইট দিয়ে কাউকে সে আসতে দেখল না। আজ তার খুশির দিন। কারণটা অন্যরকম। তালহা বেগমের ধমকে সে ঘরে ডুকে গেল। কিন্তু উত্তেজনা কমল না। এভাবে সেইরাতটা তার নির্ঘুম কাটল। তারপরের দিনটা ও সেভাবেই কাটল। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ পার হলো। চৌধুরী বাড়ি থেকে কোনো খোঁজ না আসায় সে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার চিন্তার অবসান ঘটল তার পনের দিন পর। সাদা শার্ট প্যান্ট পরিহিত একজন লোক তারহাতে একটি পেপার আর একটি চেক ধরিয়ে দিয়ে গেল। একে একে তিনটি ধাক্কা খেল ইশা। তিনটির মধ্যে একটি হলো টাকার চেক,অন্যটি ডিভোর্স পেপার অন্যটি খুবই ব্যক্তিগত। কোন ধাক্কা সামলাবে ইশা। ঠিক সে জায়গায় সে ধপ করে বসে পড়ল। খামটি খুলে পড়ে সে হাতের মুঠোয় নিয়ে মোচড়ে ফেলল। ছিঃ ছিঃ বলতে বলতে সে জ্ঞান হারায়। তার জ্ঞান ফিরে হসপিটালের বেডে। আজিজ চৌধুরীকে দেখতে পায়। আজিজ চৌধুরীর ঠোঁটের কোণায় হাসি। ইশা ঘৃণা নিয়ে বলে,আমি মানিনা ডিভোর্স পেপারে থাকা সইটা ওঁনার।
আজিজ চৌধুরী হেসে বলেন। বিশ্বাস না হলে কিছু করার নেই। সইটা আদিই দিয়েছে। হোক অজ্ঞানে কিংবা সজ্ঞানে। তাছাড়া ডিভোর্স পেপারে তুমি সই করলে ও কি না করলে কি? তেমাদের বিয়ের শর্ত যেমন ছিল তেমনই হয়েছে সব। জহির মিয়া মাথা নিচু করে থাকে। বলে,ইশুরে এ বিয়েটার কোনো মানে নেই। তুই সই করে দে। তোকে আমরা ভালো থেকে ছেলে দেখে আবার বিয়ে দেব।
ইশা হো হো করে হাসে। বলে, ভালো ঘরেই তো দিয়েছিলে। সম্ভ্রান্ত বাড়িতে বিয়ে দিয়েছ। আর চাইনা। সব চেনা হয়ে গেছে।
রাগে,ক্রোধে, অভিমানে ইশা সই করে দেয় ডিভোর্স পেপারে। এ সই দেওয়া যেই না দেওয়া ও সেই। তার এখন এসব ভাবার সময় নেই। তাকে এখন বাচঁতে হবে। নতুন করে বাঁচা শিখতে হবে। ডক্টরের আশা ছাড়াই বাঁচা শিখতে হবে। ডক্টর ভুলে গিয়েছে মিষ্টিকে।
রাস্তার পাশে ডক্টর বিরাট টেডিবিয়ার পাশে নিয়ে বসে থাকে বেঞ্চে। আস্তে আস্তে ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে মিষ্টি নামক মেয়েটির সব স্মৃতি। কি আজব সে টেডিবিয়ার নিয়ে কেন বসে থাকে? সে কি ছোট বাচ্চা? মিষ্টি মিষ্টি ডাকা টিয়ে পাখিটি কার? মিষ্টিটাই বা কে? বিছানা থেকে হেলে পড়ে তার মাথা। জড়িয়ে ধরে টেডিবিয়ারকে। কোনোএক চিন্তায় ডুব দেয় ডক্টর। টেডিবিয়ারকে ছাড়া তার এত খালি খালি লাগে কেন? বুকটাই খালি খালি লাগে।
ইশা নিজের ভাবনায় নিজেই হাসে। ডক্টরের সেসব ভাবার সময় কই? কিসব উলটপালট ভাবছে সে?
তালহা বেগম তার হাতের চুড়ি, নোজপিন খুলে নিল। সব শাড়ি নিয়ে ফেলল। বড় ছেলে রিকুকে দিয়ে সেলোয়ার কামিজ নিয়ে আসল। ছুড়ে মারল ইশার দিকে। ইশা মেনে নিল সবার সব শর্ত। নিজের জীবনটা এবার সেভাবেই চলুক। তার তো কোনো হাত নেই। সে আর কিছুই পাওয়ার আশা করেনা। কারো কাছে ফেরার আশা ও করেনা। তার শরীর ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়। সে শয্যাশায়ী হয়ে উঠে। খাওয়া-দাওয়াতে অরুচি বাঁধে। তালহা বেগম তার সাথে খ্যাঁক খ্যাঁক শুরু করে। সাথে মুনার সাথেও। মুনার দোষটা ও তার নিজের তৈরি করা নয়। প্রকৃতির লীলাখেলা।
অসুস্থ শরীরে টালমাটাল পায়ে ইশা চলে যায় ছাদে। রেলিং বিহীন ছাদ থেকে তার লাফ দিয়ে জীবনটা এখানেই থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু না তাকে বাঁচতে হবে। প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে। আবার বেঁচে উঠতে হবে। নিজের জন্য না হলে ও বাকিদের জন্য। সে ছুটে গিয়েছিল চৌধুরী বাড়িতে। বাড়ির দাড়োয়ান বলে দিল, তারা কবে ফিরবে নিশ্চিত নয়। আদৌ ফিরবে কিনা। তখন আদির চলে যাওয়ার পাঁচমাস মাত্র। সেসব মনে পড়তেই ইশার আবার ও কান্না পেল। স্বরপরিবার ইন্ডিয়া চলে গেল? রাইনার সাথে ও দেখা করা হয়ে উঠল না। হাতে থাকা পান্জাবীটি বুকে চেপে ধরল ইশা। কান্নাজলে পান্জাবী ভিজে গেল। বহুদিন পর ইশা মুখফুটে আওয়াজ করে ডাকল, ডক্টর? আপনার দেখা কি কখনো পাব না আমি? কবে ফিরবেন আপনি দেশে। কোনোদিন কি ফিরবেন না। ফেরার কোনো কারণ দেখছেন না? মিষ্টিকে কি করে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন ডক্টর? মিষ্টি যে আপনাকে ভুলতে পারছে না। আমার সাথে কেন এমনটা হলো ডক্টর? আমি আপনার সাথে ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। আপনার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। আপনার সাথে সারাটা জীবন একসাথে পথ চলতে চেয়েছিলাম। ডক্টর আদি চৌধুরীর পার্মানেন্ট পেশেন্ট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই আপনি আমায় রোগী বানিয়ে গেলেন কিন্তু সুস্থ হওয়ার ঔষধ বলে গেলেন না। আপনি জানেন ডক্টর আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা। খেতে ও ভালো লাগেনা। পড়তে ও ভালো লাগেনা। কারো সাথে কথা বলতে ও ভালো লাগেনা। হাসতে ও ভালো লাগেনা। আপনি ছাড়া আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না ডক্টর। এ আমার কি সর্বনাশ করে গেলেন ডক্টর? আমি কি করে বাকিগুলো দিন কাটাবো ডক্টর?
নতুন করে সব কি করে শুরু করব। ডক্টর শব্দটা যে আমার মস্তিষ্কে একেবারে গেঁথে গিয়েছে। আর ডক্টর নিজেই আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে। এ থেকে বাঁচার উপায় কেন বলে গেলেন না ডক্টর? এ কেমন শাস্তি দিলেন আমায়? হুট করে কি একদিন চলে আসতে পারেন না? আচমকা সবাইকে চমকে দিতে পারেন না। মিষ্টি বলে ডেকে উঠতে পারেন না। কেন এত বড় শাস্তি আমায় দিলেন ডক্টর? কেন?
তালহা বেগমের চেঁচামেচি শুনে ইশা চোখ মুছল। এখানে এই অবস্থায় দেখলে তাকে খুব বকবে মামি । তার কথা অনুযায়ী নতুন করে বকুল ফুলের গাছ লাগিয়েছে জহির মিয়া। সামান্য গাছই তো তার ভাগনীর আবদার। ইশা তাকিয়ে তাকে বকুল গাছটির দিকে। গাছটি কখন বড় হবে। কখন ফুল দেবে? কখন সুগন্ধ ছড়াবে? এভাবে সময় গড়ায়। মাস গড়ায়। তারপর বছর গড়ায়। এভাবে তিন তিনটা বছর গড়ায়। তিনটা বছর।
বর্তমান _______________________
মেয়েটি বকুল ফুল কুড়িয়ে নেয় ওড়নার আচঁলে। তালহা বেগমের ডাকে দৌড়ে দৌড়ে চলে আসে রুমে । ফুলগুলো সে নিজের বিছানার চাদরের উপর রেখে দৌড়ে ডুকে পড়ল রান্নাঘরে। তালহা রুষ্ট হয়ে বললেন, কাজ করিস না। জোর করব না। কিন্তু এত বড় মেয়েকে কি আমি নিজ হাতে খাইয়ে দেব? এত ন্যাকামির সময় কই বাপু?
ইশা অবাক হয়ে বলল, আমি খাইনি মামি?
তালহা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,নিজে খেয়েছে কিনা নিজেই জানেনা, আমাকে নাকি জিজ্ঞেস করছে?
মুনা হেসে এগিয়ে আসল। প্লেটে করে খাবার বেড়ে দিয়ে বলল, মা ও সবার খোঁজখবর রাখে,শুধু নিজের ছাড়া।
ইশা মাথা নামিয়ে হেসে বলে, সবার কই রাখলাম?
মুনা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর ইশার হাতে প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলে, যাহ খেয়ে নে।
ইশা প্লেট নিয়ে এগোয়। আবার পিছু ফিরে বলে, রিপুদা কখন ফিরছে মামি? আমার আর তর সইছে না।
তালহা বেগম চ্যানচ্যান কন্ঠে বলল, তর সইছে না ঢোল নিয়ে নাচা শুরু করো। মাঝরাস্তায় আছে। উনি তো ছেলেকে দেখে মোবাইল ও কোথায় ফেলে দিয়েছে মনে হয়। ফোন ও ধরছেনা।
ইশা ভাতগুলো পানি দিয়ে গিলল যেন । আজ তার সবচাইতে খুশির দিন।
খেয়েদেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে ডুকতেই তার চক্ষুচড়ক গাছ। কাধ অব্ধি গোল করে কাটা চুল,ধবধবে ফর্সা ছোট্ট মেয়েটি তার সব বকুল ফুল মাটিতে ছোট্টছোট্ট হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলছে। পায়ের নিচে দেওয়া একটি মোড়া। মোড়ার উপর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলছে বকুলফুল গুলো। ইশার হাসি পেল রাগ ও লাগল। তার উপস্থিতি টের পেতেই মেয়েটি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ফিপি ডাতি!
ইশা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। বলল, মাম্মাকে ডাকব? তুমি ফিপির সব ফুলগুলো ফেলে দিয়েছ পরী।
পরী রাগ করে মোড়া থেকে নিচে নেমে এল। হাঁটতে গিয়ে ধপ করে আবার পড়ে গেল। ইশা আতঁকে উঠে ধরতে যেতেই পরী উঠে দাঁড়াল। কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইশা ও পিছু পিছু গেল। মুনাকে জড়িয়ে ধরে পরী কাঁদল, অভিযোগ দিল, মাম্মা ফিপি,ফিপি। কথা স্পষ্ট নয় তার। তাই বাকিগুলো বলতে পারল না। তালহা তেড়ে এলেন। পরীকে কোলে নিয়ে শান্ত করতে করতে বলল, ওই বজ্জাতকে খুব মারব আমি। দাদুমণি আর কেঁদো না।
ইশা লুকিয়ে হাসে। হাত বাড়িয়ে বলে,পরী ফিপির কাছে আসো। চকলেট দেব। আমরা দুজন মিলে চাচ্চুকে আনতে যাব। যাবে?
পরী তালহা বেগমের কাঁধে মুখ চেপে ধরে। চিৎকার করে কাদেঁ। মুনা এসে বলে, তোর কি আর কোনো কাজ নেই রে ইশু। আমার মেয়েকে কাঁদানো ছাড়া কি আর কোনো কাজ নেই তোর?
ইশা খিক করে হেসে দেয়। বলে, তোমার মেয়ে ছাড়া ঝগড়া করার জন্য আর কে আছে?
মুনা মাথা নাড়াল। ইশা হাসতে হাসতে পা বাড়াল নিজের রুমে।
______________________
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। ইশা ছাদের এককোণায় দাঁড়িয়ে রইল। তার পড়নের নীল কমলা রঙের ওড়নাটা মৃদুমৃদু হাওয়ায় দুলছে। সে বিভোর অন্য এক জগতে। পরীক্ষা নিয়ে খুব চিন্তিত সে। গতবার অমনোযোগী হওয়ায় সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে সে। এবার তাকে যেকরেই হোক ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে। এই লেখাপড়াটাই এখন তার একমাত্র সম্বল। এই সম্বলটা আঁকড়ে ধরেই তার লড়াই। তাকে এ লড়াইয়ে জিততে হবে। রিপুদার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। বকুল গাছের দিকে চোখ গেল তার। সে বকুল ফুলগুলো একটি একটি গুনতে চাইল। গুনতে গুনতে চোখ আটকে গেল তার। হালকা ছাইরঙা শার্ট পড়া একজন সুদর্শন যুবকের পেছনে দেখতে পেল মামা আর রিকুদা কে। তারমানে ছেলেটি রিপুদা? রিপুদাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
সে আর কিছুই ভাবল না। টালমাটাল পায়ে নেমে এল ছাদ থেকে। গিয়ে থমকে দাঁড়াল ছেলেটির সামনে। ছেলেটি মুনার সাথে কথা বলা শেষ করে তাকায় হাঁপাতে থাকা মেয়েটির দিকে। অবাকচোখে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটির হাঁপাতে থাকা দৃশ্য দেখে আওয়াজ করে হেসে দেয়। ডাকে, ইশুরাণি,,,
ইশা রিপুকে কথা বলতে দেয়না। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে তার চোখ গলে জল বেরিয়ে আসে। শেষমেশ কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়ে দেয় রিপুর শার্ট। রিপু কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মেয়েটা তার ইশু?
তারপর দুষ্টুমির সুরে বলে, কি করছিস সবাই দেখছে। বিদেশি সুন্দর ছেলে দেখে ঝাপিয়ে পড়েছিস? ছিঃ,,,,
সাথে সাথে ইশা ছেড়ে দিল। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,তুমি আসতে না আসতেই আমার সাথে শুরু করে দিয়েছ?
রিপু হো হো করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে সে নিজে থেকে থেমে যায়। বলে, তুই কত বড় হয়ে গিয়েছিস ইশু? আমি যখন যাচ্ছিলাম তখন তো অনেক পিচ্চি। যদি ও তুই কোনোকালেই পিচ্চি ছিলি না।
ইশা হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, মামি ফুলেফেঁপে আছে। তুমি মামির সাথে আগে কথা বলে নাও। তারপরে বাকি কথা।
রিপু হাসল। বলল, তুই তো আর ও আর ও বড় হয়ে গিয়েছিস।
ইশা খুশির কারণে কথা বলতে পারেনা। রিপু একে একে সবার জন্য আনা জিনিস সবার হাতে তুলে দেয়। মা,বাবা,ভাই, মুনাকে। এমনকি পরীকে ও। পরী তাকে দেখলেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে। কিন্তু যখন চকলেট দিল,একলাফে কোলে উঠে পড়ল। রিপুর গালে লালা ঢলে দিল। রিপু মুনার কোলে দিয়ে ফেলল। ইশার দিকে এগিয়ে গেল। সবার সামনে বের করল,ইয়া বড় একটি টেডিবিয়ার । ইশা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে রিপু বলল, তুই দুষ্টুমি করে বললে ও আমি ঠিক নিয়ে এসেছি তোর টেডিবিয়ার। তুই খুশি হয়েছিস। ইশা যেন কেঁদে দিল। হাত বাড়িয়ে নিল। রিপু আবার ও বের করল অন্য একটি জিনিস। উপস্থিত সবাই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। রিপু প্যাকেট ছাড়িয়ে বের করল লাল টকটকে একটি বেনারসি। ইশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। সে ও তাকাল। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাল। রিপু তার চোখের ভাষা আড়াল করে ফেলল মুহূর্তে। বলল, আরেহ তোর বিয়ের শাড়ি। আর শাড়ি কেনা লাগবে না । তোর বরের টাকা বাচিয়ে দিলাম। বল?
ইশা কোনোকথা বলেনা। শাড়িটা হাতে নিয়ে একছুটে চলে যায় নিজের রুমে। তার কানে বেজে উঠে বিয়ে, বর!
বহুদিন পর। হ্যা বহুদিন পর। সে বালিশে শুয়ে পড়ে। মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। সে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভাঙতেই সে টেবিলে খাবার রাখা দেখতে পায়। মনে মনে বলে, আসার সাথে সাথে শুরু করে দিলে রিপুদা?
খেয়ে নিয়ে সে যখনি ঘুমোতে যায় তখনি চোখে পড়ে ওই টেডিবিয়ার আর শাড়ি। কি আশ্চর্য, তার কারণে অকারণে হাসি পাচ্ছে। আলতোভাবে সে টেডিবিয়ার আর শাড়িটা হাতে নেয়। ধীরপায়ে হেঁটে ঝলমল করা ছাদের এককোণায় গিয়ে দাঁড়ায়। আজ কেন জানি তার মনে হচ্ছে বকুল ফুল গুলো আজ বেশি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। সে আকাশের দিকে মুখ করে তাকাল। সাথে সাথে দুচোখের কোণা ঘেষে দুফোটা জল গড়িয়ে চিবুক অব্ধি পৌছাল। আজ অনেকদিন পর,অনেক মাস ডক্টর নামক মানুষটির কথা মনে পড়ল তার। যদি ও সে শয়নেস্বপনে থাকে। তারপর ও বহুদিন পর সে হালকা আওয়াজ করে ডাকল, ডক্টর? মনে আছে মিষ্টিকে?
আজব হলে ও আজ মনে হলো ডক্টর শব্দটি শোনা যাচ্ছে চারপাশে। ইশা মনে করার চেষ্টা করল,ডক্টরের চেহারা। ডক্টরের চাহনি। ডক্টরের হাসি। ডক্টরের স্পর্শ।
তারমনে পড়ল। ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটল। সে পরক্ষণে ব্যঙ্গ করে বলল, আমি আপনাকে আর চাইনা ডক্টর।
বলা শেষ না করতেই সে আবার হাসল। হাসি ডিঙিয়ে কান্না চলে আসল। শাড়ির ভাজ খুলে সে মাথায় দিল। টেডিবিয়ার বুকে চেপে ধরল। মিনমিন করে বলল, এই দুটোই আমার জীবন থেকে আমি হারিয়ে ফেলেছি ডক্টর। আপনাকে ভালোবাসার জরিমানা আমি দিয়ে দিয়েছি। আর কিছু বাকি নেই।
রাতের আলো আধাঁরিতে ছাদের আরেককোণায় রেলিংয়ে হেলান দেওয়া ছেলেটি তো নির্ঘুম রাত কাটানোর জন্য ছাদে এসেছে। মেয়েটিকে দেখেই তার চোখ স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ আটকে গেল। সে ডুবে গেল ঘোমটা মাথায় দাঁড়িয়ে মেয়েটির মায়াবী মুখপানে। এ মেয়েটা আর কত মারবে তাকে? আর কত নিঃস্ব করবে? এবার কি একটু স্বস্তি মিলবে না? এবার ও কি সে জানাতে পারবেনা তার মনের কথা। এভাবে আর কতদিন? আর কতকাল?
#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১০
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে ইশা। হাঁটুতে দুহাত দিয়ে সে জোড়াল শ্বাস নিল। সূর্যি মামা তার দ্রুতি ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষের সমাগম বাড়ছে। রাস্তাঘাট ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। তাকে ডিঙিয়ে যাওয়া ছেলেটি কিছুদূর গিয়ে পিছু ফিরে তাকাল। হাঁপাতে হাঁপাতে ডাক দিল, কি হলো ইশু,আর দৌড়াতে পারছিস না।
ইশার মেরুদণ্ডে হঠাৎ চিনচিন ব্যাথা করে উঠল। সে বসে পড়ল ঘাসের উপর। বলল, রিপুদা আমি আর কখনো তোমার সাথে মর্নিং ওয়াকে বের হবোনা।
রিপ হাসল। এগিয়ে এসে ইশার কাছে হাটুগেড়ে বসল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। আর আসিস না। এখন উঠে পড়। মা যদি দেখে এই অবস্থা, সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ইশা উঠতে পারল না। ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে। সে চোখবন্ধ করে বলল, কিছুক্ষণ বসি। তারপর যাব।
রিপ বসে পড়ল ইশার পাশে। ইশার যন্ত্রণাদগ্ধ মুখটা দেখতেই বুক ধ্বক করে উঠল। কন্ঠে একরাশ উৎকন্ঠা মিশিয়ে জানতে চায়,
ইশা তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে?
ইশা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, তেমন কিছুনা। পিঠে একটু ব্যাথা করে উঠল। অনেকদিন পর দৌড়েছি তো তাই হয়ত।
ইশা চোখ মেলে তাকাল রিপের দিকে। হেসে বলল, চিন্তা করোনা, তেমন কিছু হয়নি।
রিপ মুখ অন্যদিকে করে বলে, কে জানে? তুই তো আজকাল কোনোকিছুই শেয়ার করিস না আমার সাথে।
ইশা রিপের মুখের দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওড়নার আচঁল দিয়ে রিপের মুখ মুছে দিতে দিতে বলে, কিভাবে ঘেমে গিয়েছ তুমি রিপুদা। ওদিকে ফিরো তো।
একটুখানি অভিমানে দগ্ধ হওয়া মনটা আবার ও প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেল। রিপ তাকিয়ে থাকল মেয়েটির মুখটার দিকে। আজকাল সে প্রচন্ড খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে ইশু কিছু বুঝে যাচ্ছে না তো? বুঝলে তো ভালো। কিন্তু এ মুহূর্তে রিপের মনে হচ্ছে না মেয়েটি কিছুই বুঝতে পারছে। কিংবা পারবে। তার জন্য ছেলেটির এত চিন্তা, এত উৎকন্ঠা এতসব কিছুর ছেলের আড়ালে যে ভালোবাসাটা লুকিয়ে আছে মেয়েটা তা কখন বুঝবে? কখন ও কি বুঝবে না?
বাড়িতে পৌছানোর সাথে সাথে তালহা বেগম অবাক চোখে তাকালেন রিপ আর ইশার দিকে। কিচ্ছুটি না বলে ইশাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। রিপ বলল, মা ওর কোনো দোষ নেই। আমি নিয়ে গেছি ওঁকে।
তালহা ধমক দিলেন। বললেন,তুই চুপ থাক।
ইশা রুমে গিয়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে। তালহা চেঁচিয়ে বললেন, আজ যদি ব্যাথায় কান্নাকাটি করিস তাহলে খবর আছে তোর। আমি কি তোর কামলা কাটি?
ইশা চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকল। ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে লাগল তার। অনেকক্ষণ পর আর সইতে না পেরে ডুকরে কেঁদে দেয় সে। আবার চেপে রাখে। আওয়াজ সামান্য শুনে যায় তালহা। চোখ পাকিয়ে দেখে বলে,এই তুই কাঁদছিস?
ইশা ধরে আসা কন্ঠে বলে, মামি দয়া করে চিল্লিও না। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি,ভালো হয়ে যাব।
মুনা আসতেই ইশাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বলে, তোর কি ব্যাথা উঠেছে ইশা? গরম পানি দেব?
ইশা হাত নাড়ায়। মাথা ঘুরিয়ে নেয়। কেউ বুঝেনা তার কষ্ট। তার কষ্ট হচ্ছে তারপর ও তারা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এভাবে দৌড়াটা উচিত হয়নি। এরকম ব্যাথা করবে জানলে সে কখনোই দৌড়াত না।
সন্ধ্যা নামল। ইশাকে কয়েকবার দেখতে এল রিপ। হাজারটা প্রশ্ন জুড়ে দিল। বড় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে বলল। কিন্তু ইশা নাছোড়বান্দা। সে কোনো ডক্টরের কাছে যাবে না। ব্যাথাটা সবসময় করেনা। মাঝেমাঝে করে। খুব সামান্য ব্যাথা। অন্যদের কাছে এই ব্যাথা সামান্য ব্যাপার। সে হয়ত সহ্য করতে পারছেনা। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আবার হোঁচট খেয়ে পরী আসল ইশার কাছে। ইশা তখন ভাঙা সোফাটাতে মাথা হেলিয়ে বসেছে। পরী কপালের কাছে আঙুল দিয়ে চুলকায়। চোখ পিটপিট করে মাথা হেলিয়ে তাকায় ইশার দিকে। ইশা শুধু চোখ মেলে তাকায় পরীর দিকে। যখন দেখল ইশা কোনো কথা বলছে না। তখন ইশার গায়ের উপর উঠে পড়ল বেয়ে বেয়ে। ইশা বলল, কি করছ পরী?
পরী চুপ থাকল। ইশার গায়ের উপর উঠে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে রাখল। তারপর গাল ইশার গালে লাগিয়ে আমমমা আমমমা আমমমা ছন্দ তুলে শব্দ করতে লাগল। ইশার গালে লালা লেপ্টে গেল তার। ইশা চোখ বন্ধ করে রইল। সে টের পেল তার চোখের কোণা ভিজে উঠেছে। পরীকে বলল, ফিপি ব্যাথা পাচ্ছে পরী,নেমে পড়ো।
পরী কথা শুনল না। ইশার ধমক খেয়ে ইশার ঘাড়ে মুখ গুজে রাখল। ইশা উঠাতে চেয়ে ও উঠাতে পারল। শক্ত করে ধরে পেঁচিয়ে রাখল। তারপর কাঁদতে লাগল। ইশার সম্ভিৎ ফিরতেই বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হয়নি। পরী এখনো ছোট বাচ্চা। সে ডাকল, পরী ফিপির কথা শোনো। আর কেঁদো না। ফিপি চকলেট দেবে,চিপস দেবে।
পরী মাথা তুলল। ডাগর ডাগর গোলাটে চোখদুটো লাল টকটকে। ইশা ভড়কে গেল। এ মেয়েটার রাগগুলো এমন কেন? নীরবে রাগ দেখায়। কার সাথে যেন মিলে যায়।
পরী ইশার গালে গাল লাগিয়ে শব্দ করল, পাপ্পি,পাপ্পি।
ইশা বুঝতে পারল পরী কি চাই। পুরোমুখে আদর দিয়ে বলল, হয়েছে? পাপ্পি দিয়েছি, এবার ভালো মেয়ের মতো মাম্মার কাছে চলে যাও। পরী নামল না। ইশার বুকে মাথা রেখে চেপে গেল। মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে কোথাও যাবেনা। ইশার কাছেই থাকবে। ইশা আর যেতে বলল না। কিছুক্ষণ পর পরীর ঘুমিয়ে যাওয়ার নির্দেশ হিসেবে নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেল। ইশা হাসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। দুজনই এভাবে ঘুমিয়ে গেল। রিপ পরীকে নিতে এসেই এই দৃশ্য দেখে অবাক হলো। এটি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য মনে হলো তার। সে ফোন বের করে কয়েকটা ছবি নিল। তারপর পরীকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। ইশাকে ও শুইয়ে দিল। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসল। তারপর তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। ওই ঘুমন্ত মোহনীয় মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাধ্যি তার নেই। সে খুন হয়ে যাবে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে ও । কে জানে কোনদিন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়?
_______________________________
লাল,নীল,হলুদ নানরকম কালারের লাইটিং। পুরো চৌধুরী বাড়িতে মানুষের সমাগম। কালো সাদা মিশেল ড্রেস পরিহিত অনেকগুলো ছেলে হাতে ছোট ছোট ট্রেতে করে সার্ভ করছে নানা ধরণের পানীয়। একেকজনের রুচি একেকরকম। রান্নাঘরে ব্যস্ত রাইনা। ছেলের জন্য নিজ হাতে সে পায়েস রাঁধছে। ছেলের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। এই তিনটা বছরে অনেককিছু পাল্টেছে। পাল্টেছে চৌধুরী বাড়ির কিছু মানুষের স্বভাব, অভ্যাস, রুচি। দূর হয়েছে তার একাকীত্ব। ছেলেকে পেয়ে। ছেলে রেহান তার নিজের ছেলে নয়। এই ছেলেটাকে দুই বছর থাকাকালীন সে দত্তক নিয়েছে। রেহান এখন চৌধুরী বাড়ির সকলের চোখের মণি। তার জন্মদিন উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সমাগম। অথচ বাবা নামক মানুষটিকে সে যখন কোথাও দেখল না তার বড্ড মন খারাপ হলো। নেশাখোর, নারীআসক্ত আফির খেয়াল নেই আজ তার ছেলের জন্মদিন। সে তার আর ছোট ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে মজামাস্তিতে নিমজ্জিত। মাতাল হয়ে ঢুলছে। রাইনার আজকাল আফির কাজকর্ম দেখলে কষ্ট লাগেনা। তার তো একটা ফুটফুটে ছেলে আছে। আর কি লাগে। আফির একটু দয়া,সহমর্মিতা সে এখন আর চায়না। তার পৃথিবী জুড়ে এখন শুধু মুখোরিত হয় রেহান নামটি।
আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী নাতির হাতে বড় বড় গিফটবক্স তুলে দিল। রেহান খুশি হলো। একে একে অনেকের গিফট জমা হলো। কিন্তু সেই গিফটগুলোর দিকে ফিরে ও তাকাল না রেহান। বাবা আর চাচ্চু কি তাকে গিফট দেবে না? কোথায় তারা?
জন্মদিনের শুভেচ্ছান্তে চারপাশ মুখোরিত হলো। কেক কাটা হলো। নাচ গান হলো। সবাই যখন উল্লাসে ব্যস্ত তখনই চুপিচুপি চৌধুরী বাড়িতে ডুকে পড়ে একটি ছেলে। গিফট বক্স মুখের সামনে রেখে শুভেচ্ছা জানায় রেহানকে। রেহান চমকে তাকায়। সাথে অনেকে। কোনো একটি টিয়ে পাখির ডাক ভেসে আসে। হেপি বাথডে প্রিন্স। হেপি বাথডে। মিনির ডাক শুনে সবাই হাসে। রেহান দৌড়ে যায়। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ছেলেটিকে। অভিমানী কন্ঠে বলে, চাচ্চু আমার গিফট। দেরী কেন?
ছেলেটি গিফট ধরিয়ে দেয় রেহানের হাতে। রেহান চাচ্চুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে বলে, লাভ ইউ চাচ্চু।
ছেলেটি হাসে নিঃশব্দে। বলে, লাভ ইউ টু মাই প্রিন্স ।
মিনি ডানা ঝাপটায়। ডাকে, লাভ ইউ, লাভ ইউ।
ছেলেটি এদিকওদিক তাকায়। রেহানকে বলে, ম্যাডাম কোথায়?
রেহান জিজ্ঞেস করে, আইমি আন্টি?
ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে বলে, ইয়াহ।
রেহান জবাব দেয়, ছাদে যেতে দেখেছিলাম। ছাদেই আছে হয়ত। রেগে আছে?
রেহানের দুষ্টুমি বুঝতে পারে ছেলেটি। মাথায় চাপড় দিয়ে বলে, হুম। ম্যাডাম আজকাল কথায় কথায় রাগ করে বসে থাকে। রাগ ভাঙাতে হবে। বাই মাই প্রিন্স।
রেহান হেসে দেয়। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলে, চাচ্চু আইমি আন্টিকে আমার বৌমা করে কখন আনবে?
ছেলেটি যেতে হাত নেড়ে বলে, ‘ ভেরি সুন।
রেহান বেজায় খুশি হয়। দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যায়। রাইনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাম্মা আইমি এবার আমার বৌমা হবেই।
রাইনা কথার ছলে জিজ্ঞেস করে,কে বলেছে?
রেহান গিফটবক্স রাখতে রাখতে জবাব দেয়, চাচ্চু বলেছে এক্ষুনি।
সাথে সাথে রাইনার হাত থেকে খসে পড়ে চামচ। রেহান ভড়কে যায়। বলে,কি হয়েছে মাম্মা ! এনি প্রবলেম?
রাইনা চট করে কথা ঘুরিয়ে ফেলে। চামচ কুড়িয়ে নিয়ে বলে, নো প্রবলেম রেহান। এটা তো খুশির খবর। কখন হবে বলেছে?
রেহান ভেবে বলে, না তা তো বলেনি? আমি জেনে নেব চাচ্চুর কাছ থেকে ওকে?
রাইনা সম্মতি দেয়। রেহান চলে যাওয়ার আগে রাইনা তার হাত টেনে ধরে। কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ পর চেয়ে থেকে বলে, কষ্ট পেয়েছে কি আমার বাচ্চা? ড্যাড গিফট করেনি বলে?
রেহানের মুখে অন্ধকার নেমে আসে। সে তা লুকিয়ে হাসিমুখে বলে, আমি অনেক গিফট পেয়েছি মাম্মা। বরং আমিই গিফট করব ড্যাডকে।
_________________________
ছাদে ও করা হয়েছে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা। ছাদের মৃদুমৃদু বাতাস মেয়েটির মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। দূরের সুপারিগাছ গুলো ও মৃদুমন্দ দুলছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কাঁঠাল চাপার গন্ধ। রেলিংয়ে দুহাত রেখে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়ানো মেয়েটি কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় না। ছেলেটি ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে নেয়। মেয়েটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটিকে ঘিরে রেলিংয়ে হাত রাখে। মেয়েটির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, মন খারাপ?
এত গভীর গরম নিঃশ্বাস মেয়েটির কানের কাছে পড়ায় মেয়েটি কেঁপে উঠে । জবাব দিতে পারেনা। ছেলেটি প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবার ও জিজ্ঞেস করে, খুব বেশি কষ্ট দিলাম? চলে যাব?
মেয়েটি এবার সাথে সাথে সামনে ফিরে। মুখোমুখি হয় ছেলেটির সাথে। ছেলেটির শার্টের কলার ধরে তার দিকে টেনে ধরে। বলে, চলে যাওয়ার কথা বললে একদম মেরে ফেলব।
ছেলেটি নিঃশব্দে হাসে। বলে, আদি চৌধুরীর কপালটাই খারাপ। শেষমেশ তাহলে রাগী বউ ই জুটবে? কান্না পাচ্ছে ভয়ে।
মেয়েটি ছেলেটির চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হাসি আসলে ও হাসেনা। বলে, একদম ইয়ার্কি মারবে না আদি। আমি এখন সেই মুডে নেই।
ছেলেটি হাসে আবার ও। তারপর গম্ভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তাকে কিছু বলতে না দেখে বলে, বিয়ে কবে করছি?
ছেলেটি নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে। এক ঠান্ডা বাতাস মৃদুভাবে নাড়িয়ে দিল ছেলেটির চুল। ছেলেটি হাসল। মেয়েটি চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বলল, অযথা হাসবে না। আমার রাগ হয়।
ছেলেটি আবার হাসে। বলে, তোমার রাগ দেখলে বিয়ে করার শখ আমার গুটিয়ে যায় ইমি।
মেয়েটি শার্টের কলার আর জোরে টানে। বলে, এগুলো তো খুব সামান্য রাগ। এখনো রাগের র দেখেছেন মাত্র ডক্টর আদি চৌধুরী। বাকিগুলো তো বাকি আছে ।
ছেলেটি হাসে। নিঃশব্দে তাও। হাসতে হাসতে গলার একপাশ উন্মুক্ত হয়। বাদামী রঙের দাগটি দেখে ভড়কে যায় আইমি । ছেড়ে দেয় শার্টের কলার। আচমকা এমনটা করায় আদি অবাক হয়। জানতে চায়, কোনো সমস্যা ইমি?
মেয়েটি চোখ তুলে তাকায় ছেলেটির দিকে। বলে,গলার পাশে দাগটা কিসের আদি? কোথায় আঘাত পেয়েছ?
আদি গলার পাশে হাত দেয়। বলে, ডোন্ট নৌউ। ড্রপ দিস ম্যাটার।
মেয়েটি চিন্তিত হয়ে তাকায়। ছেলেটি তার ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে,পকেটে হাত পুরে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, কে জানে তুমি হয়ত কামড়ে টামড়ে দিয়েছ।
মেয়েটি আকস্মিক এমন কথায় লজ্জা পায়। মাথা নামিয়ে এই প্রথম হাসে। বলে, যাহ,আমি কখন?
ছেলেটি তার নতবদনে হাসির দিকে তাকায়। পরক্ষণে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। কি আশ্চর্য সে মুগ্ধ হতে পারছেনা মেয়েটির হাসিতে। হারিয়ে যেতে পারছেনা। ডুবে যেতে পারছেনা। হঠাৎ তার মনে হলো তার পিঠে মাথা রেখেছে কেউ। বুকের দুপাশে উদয় হলো দুটো হাত। সে তাকাল। ছুঁয়ে বলল, আমি আছি ইমি।
মেয়েটি ও উচ্চারণ করে, আমি ও আছি আদি । থাকব।
_________________________
গভীর রাতে বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাথে ঝি ঝি পোকার আওয়াজ। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে সেই শব্দ তীব্রভাবে আঘাত হানছে ইশার কানে। আচমকা তার ঘুম ছুটে যায়। সে কান চাপা দেয়। অদ্ভুত আওয়াজ করে উঠে। বিছানা হাতড়ে কাউকে খুঁজে। কি আশ্চর্য, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা, সে কাকে খুঁজছে। চট করে বিছানা থেকে সে নেমে পড়ে। মাথা চুলকে চুলকে পুরো ঘর হাঁটে। বলে, কি খুঁজছি আমি?
দূরে উল্টে পড়ে থাকা টেডিবিয়ারটিকে সে দেখতে পায়। কাঁপাকাঁপা হাতে সেটি তুলে নেয়। ধুলোবালি ঝেড়ে বলে, খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না? শোন, আমি একা কষ্ট দিইনি কিন্তু। ডক্টরের ও দোষ আছে জানিস? ডক্টর ও দোষী। ডক্টর আমার কাছে ফিরে আসলে কি এতকিছু হতো? আমার সবকিছু আমার কাছে থাকত। কোনোকিছুই আর হারাত না। ডক্টর ও চলে গেল,আর ফিরল না। আমার শেষ সম্বলটুকু ও আমি হারিয়ে ফেললাম। সব ডক্টরের দোষ। সব।
আবোলতাবোল বকে মেয়েটি। বকতে বকতে টেডিবিয়ার বুকে চেপে শুয়ে পড়ে। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ ভাসে পুরো ঘরটিতে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে সে যখন চোখ তুলে তাকায় তার পাশে। সাদা ধবধবে পান্জাবীটার বদলে শুয়ে আছে সেই পান্জাবী পরিহিত একটি ছেলে। মেয়েটির কান্না থেমে যায়। সে নিজেকে একবার দেখে নেয়। ছেলেটিকে না ছুঁয়ে ডাকে, ডক্টর। ছেলেটি তার দিকে ফিরেনা। সে আবার ডাকে,এই ডক্টর?
ছেলেটি তারপর ও ফিরে না। তার কান্না পায়। গলা ধরে আসে। তারপর ও ডুকরে উঠে ডাকে, এই ডক্টর কথা বলুন না!
সাথে সাথে ছেলেটি তার দিকে ফিরে তাকায়। চোখদুটো ঘন লাল। চোয়াল শক্ত। শান্ত কন্ঠে অসহায় হয় ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘ আই হেইট ইউ মিষ্টি। রিয়েলি হেইট ইউ। তুমি আমার সাথে নয় তোমার আমার অস্তিত্বের সাথে ও অন্যায় করেছ। তুমি অপরাধী মিষ্টি। আমি ক্ষমা করব না তোমায় কখনো। কখনো না মিষ্টি।
ইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। এলোমেলো ভাবে উঠে বসে। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে ডাকে, ডক্টর আপনি কোথায় চলে গেলেন। আপনি আমাকে আবার ভুল বুঝলেন ডক্টর। আমার হাতে কোনোকিছু ছিল না ডক্টর। আমি অসহায় ছিলাম তখন। খুব অসহায়। আপনি না বুঝলে কে বুঝবে আমায়। কোথায় আপনি?
বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনে মেয়েটির সম্ভিৎ ফিরে। সে নিজেকে আর ও একবার দেখে নেয়। চোখের পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলে, আমি কাঁদছিলাম কেন? কে এসেছিল?
________________________
ওপাশের মেয়েটিকে রাগিয়ে দিয়ে ছেলেটি ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। ফোনের ওপাশের মেয়েটিকে রাগাতে তার বেশ ভালো লাগে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সে বের হয়ে আসে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় গলার পাশে হালকা বাদামী রঙের দাগটিতে। কিছুবছর আগে ও তো এই দাগটি ছিল না। হুট করে কোথা থেকে ভূমিষ্ঠ হলো। স্পট রিমুভার বের করে সে লাগিয়ে দেয়। তার মনে হলো সেই জায়গায় জ্বলছে। সেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সেই দাগ দেখে আওড়ায়,জ্বলুক।
বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ স্থির হয় একটি পুতুলের সামনে। এই পুতুলটি সে ইন্ডিয়া থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল। পুতুলটি একটি মেয়ের অবয়ব। শাড়ি পেঁচানো। তাকে পুতুলটি কে দিল মনে পড়ছে না। বাবা বলেছিল, সে নিজেই পছন্দ করে নিয়েছিল এ পুতুলটি। এমন একটি উদ্ভট পুতুল সে কেন কিনবে?মা, বাবা ফেলে দিতে বলেছিল, কিন্তু সে ফেলে দেয়নি। অন্য যাইহোক, পুতুলটি বেশ কিউট। তার পছন্দ হয়েছে। তাই সে ফেলে দেয়নি। সাজিয়ে রেখেছে নিজের বিছানায়। কি আশ্চর্য বিছানায় কোলবালিশ না রাখা ছেলেটির বিছানার অর্ধকে জুড়ে রয়েছে সেই পুতুলটি । সে নিজের কাজে মাঝেমাঝে নিজেই অবাক হয়।
পুতুলটিকে সে যখন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তখন দেখতে পায়। তার পড়নে লাল টকটকে শাড়ি, মাথার চুলগুলো যেন লেপ্টে আছে কাধঁ, গলা,কপাল,মুখের আশেপাশে। চুলগুলো কোমর অব্ধি লম্বা। ঠোঁটদুটো রাঙানো। চোখে মোটা কাজল। ছেলেটি হাসল। বলল, ডল লুকস লাইক এ ইমি।
_______________________
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিরতিহীন পড়ছে বৃষ্টির ফোটা। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে ইশার। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরবে কিভাবে? ছাতা ও আনেনি সে? বিরক্তি বাড়ছে তরতর করে। আশ্চর্য জনক ভাবে তার রাগ লাগছে প্রকৃতির উপর। বৃষ্টি নামার আর সময় পেল না। কয়েক বছর আগে ও বৃষ্টিবিলাস করার ইচ্ছে থাকলে ও এখন তার ইচ্ছে হয় না। মাথায় আসেনা। এমন একটা বৃষ্টির দিনে সে ভিজতে চেয়েছিল ডক্টরের সাথে। ডক্টরের চোখে চোখ রেখে সে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল দূর দূরান্তে। ডক্টর তার চোখে চোখ রেখে বলবে, এই বৃষ্টিবিলাসের দিনটি আদি মিষ্টির হয়ে যাক। আমাদের দুজনের হয়ে যাক। আজ বৃষ্টিটা মন কেমন করা,তাই না মিষ্টি?
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। ঝুম বৃষ্টিতে সে বেরিয়ে পড়ে। আধ-ভেজা হয়ে যায়। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার পাশে। রিকশা আসে বহুক্ষণ পর। রিকশায় উঠে পড়ে সে। আধ-ভেজা হয়ে রিকশায় বসে সে অস্বস্তি ভোগ করে। রিকশা ছেড়ে দিতেই তার কানে বেজে উঠে, মিহি সুরের একটি ডাক,মিষ্টি, মিষ্টি।
সে থমকে যায়। শক্ত হয়ে বসে থাকে। নড়ে না চড়ে না। তার ভেজা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। সে অস্ফুটভাবে ডাকে, মিনি? ডক্টর?
ভেজা চুপচপে হয়ে গেছে ছেলেটি, হাতের খাঁচায় টিয়ে পাখিটি ও। সে ডানা ঝাপটে ঝাপটে শুধু ডেকে উঠল, মিষ্টি, মিষ্টি। ছেলেটি আশপাশ তাকাল। বলল,মিনি স্টপ। বেশি চিৎকার করলে ফেলে চলে যাব।
মিনি তারপর ও চেঁচিয়ে গেল,মিষ্টি, মিষ্টি ।
ছেলেটি হাতের খাঁচাটি গাড়ির ভেতর রাখল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে টিয়ে পাখিটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, মিনি তুমি আমার কাছে কিভাবে এসেছ বলোতো? কে গিফট করেছে তোমাকে? তুমি একটা অসহ্য।
মিনি ডানা ঝাপটে ডাকে, ‘ মিষ্টি। মিষ্টি ।
ছেলেটি রেগে গাড়ি স্টার্ট দেয়। জোরে ড্রাইভিং করে।
মেয়েটি দৌড়াতে থাকে রিকশা থেকে নেমে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার খেয়াল হয় মিষ্টি ডাকটি থেমে গিয়েছে। চলে যাওয়া গাড়িটির পিছু পিছু সে আশপাশ না দেখে দৌড়াতে থাকে। বৃষ্টিজলে ভিজে একাকার হয়ে যায়। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার বুকে ব্যাথা শুরু হয়। তারপর ও সে দৌড়ায়। মাঝরাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে। গাড়িটা এগিয়ে যায়। গাড়ির লুকিং গ্লাসে ছেলেটির চোখ আটকে যায়। মাথা নিচু করে সাদা ওড়না পড়া মেয়েটি মাঝরাস্তায় বসে আছে কেন? চেহারাটা তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কে মেয়েটি?
মাঝরাস্তায় পিঠ ধরে বসে পড়ল ইশা। গাড়ি তার সাইড দিয়ে চলে যাচ্ছে। আশপাশের মানুষ তাকিয়ে রইল তার দিকে। পিঠের হাড়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব হয়। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কথা বলতে কষ্ট হয়। বৃষ্টিজলে তার শ্বাস আটকে আসে। ডুকরে ডুকরে সে কেঁদে উঠে। লোকজন ছুটে আসে। অদ্ভুতভাবে কান্নারত মেয়েটির ব্যাগ পড়ে রয়েছে,জুতোজোড়া পড়ে রয়েছে। সবার প্রশ্ন, মেয়েটি কেন এভাবে কাঁদছে?
আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে ইশার চোখের নিশ্চুপ জল ছেড়ে দেয়। ধোঁয়াশা হয়ে যাওয়া গাড়িটির পানে চেয়ে থাকে। বলে, আপনি এসেছেন ডক্টর। কিন্তু আমার কাছে আসেন নি। কেন ডক্টর। কিসের এত রাগ, অভিমান ডক্টর?
মেরুদণ্ডের ব্যাথা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণত্বর হয়। সে বসে থাকতে পারেনা। কথা বলতে পারেনা। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। অজ্ঞান হতে হতে ডুকরে ডুকরে উচ্চারণ করে,
‘ কেন এলেন না ডক্টর? আপনি কি আমায় আর ভালোবাসেন না ডক্টর। অন্য কাউকে ভালোবাসেন ? শাস্তিটা যে এবার খুব বড় হয়ে গেল ডক্টর? এত বড় শাস্তি কেন দিলেন আমায়? আপনার মিষ্টি এত বড় শাস্তি যে নিতে পারবেনা ডক্টর। মিষ্টির কথা কেন ভাবলেন না আপনি?
মিনমিন করে বলতে বলতে সে জ্ঞান হারায়। লোকজন জড়ো হয়। মেয়েটির মায়াবী মুখপানে চেয়ে থাকে সবাই। কে বলবে, এ মেয়েটি এক পৃথিবী সমান কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে। হাসিখুশি আছে। কে বলবে, এক পৃথিবী সমান যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে । কে বলবে, মেয়েটি এক আকাশ ব্যাথা নিয়ে দিনতিপাত করছে। ডক্টর নামক যন্ত্রণাটি কি কখনো তার পিছু ছাড়বে না। ডক্টর ছাড়লে ও মেয়েটি তো নিজেই ছাড়ছেনা। দোষটা ঠিক কার? দোষী কে?
চলবে,
( আপনাদের অনুভূতি জানাবেন)
চলবে,
( আপনাদেরর মতামত জানাবেন)