মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ১১+১২

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১১
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বাড়ির ছোট্ট পুঁচকু মেয়েটা সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে পুরো বাড়ি। যদি ও তার কথাগুলো স্পষ্ট নয়। গুটিগুটি পায়ে সে বিচরণ করে পুরো বাড়ি। মা, বাবা, দাদা,দাদু,চাচ্চু,ফিপি সবার চোখের মণি। আলুথালু হয়ে হাঁটার সময় হোঁচট খেয়ে একবার পড়ে যায় আবার উঠে বসে। কেউ দৌড়ে না এলে অনেকক্ষণ চুপটি মেরে বসে থাকে। যখন দেখল কেউ একদমই এগিয়ে আসছে তখন সজোরে কান্না করে দেয়।
নানানরকম খেলনাপাতি, পুতুল, গাড়ি, ঘোড়ার মাঝখানে বসে সে খেলা করে। রিক তার মেয়েকে সবকিছুর মাঝখান থেকে উঠিয়ে কোলে নিয়ে আদর করে। অফিসে যাওয়ার আগে মেয়ের সাথে তার সময় কাটানো লাগে। মেয়ে ও কম নয়। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। বাবাকে আদর করে দেয়। তখন মুনা ডাকলে ও আসেনা। যখন কেউ পারেনা রিকের কোল থেকে নিতে। এই কঠিন কাজটি চট করে সহজভাবে করে ফেলে ইশা। হাত বাড়িয়ে ডাকার সাথে সাথে পরী কোলে ঝাপ দেয় ইশার। এ ছোট্ট মেয়েটি একটু বেশিই বোধহয় ভালোবাসে ইশাকে। যতক্ষণ কোলে থাকবে ততক্ষণ ইশার গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখবে। সারামুখে লালা লাগিয়ে দেবে। ইশা ছোটছোট ঠোঁটগুলোর স্পর্শ পেয়ে হেসে কুটিকুটি হয়। এ ছোট্ট মেয়েটি দিনশেষে মন ভালো করার একমাত্র কারণ। দিনশেষে এ মেয়েটির আদুরে মুখটা দেখে ইশার সবকষ্ট ধুয়ে মুছে যায়।
রিপ এসেই কোল থেকে নিয়ে নিল পরীকে। ইশা অবাক হলো। রিপকে জিজ্ঞেস করল,তুমি ওঁকে নিয়ে নিলে কেন রিপুদা?
রিপ উত্তর দিল না। সে এই মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর দিতে জরুরী বলে মনে করছে না।
ইশা রিপের পিছু পিছু বাড়ি থেকে বের হয়। বলে, তুমি কি আমার উপর রেগে আছ রিপুদা?
রিপ পরীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শোনে ও যেন শোনেনা। ইশা এবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কোমরে হাত দিয়ে ফুঁসে উঠে বলে, রিপুদা তুমি কিছু বলবে?
রিপ পরীর সাথে কথা বলে। পরী খিলখিল করে হাসে। ইশাকে দেখে তার হাসির আওয়াজ বেড়ে যায়। ইশার রাগ হয়। সে রেগে বলে, রিপুদা, আমি তাহলে চলে যাচ্ছি।
রিপ দায়সারাভাবে বলে, যাহ।
ইশা চলে যেতে গিয়ে ও থেমে যায়। কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে, চলে যেতে বলছ? তুমি কেন রেগে আছ বলোতো? আমি কি কোনো দোষ করেছি?
রিপের মেজাজ এবার বিগড়ে গেল। বলল, যে তার কোনোকিছুই আমার সাথে শেয়ার করেনা, তার সাথে আমার কোনো কথা নেই। এখন যাহ। ভালো লাগছেনা।
ইশার মুখ কালো হয়ে যায়। বলে, কি শেয়ার করিনি।
রিপের মেজাজ চটে যায়। বলে, আমি সেই রাস্তা দিয়ে না গেলে তো তোকে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখতেই পেতাম না। কি হয়েছিল তোর সেসময়?
ইশা মাথা নিচু করে রাখে। পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে। ইশা পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিছুই হয়নি। ওই জ্বরের ঘোরে মাথা ঘুরে গিয়েছিল তাই।
রিপ শক্ত দৃষ্টিতে ইশার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর পরীকে শান্ত করতে করতে চলে যায়।
ইশা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। মিথ্যে বলতে বলতে আর কত মিথ্যের ঝুড়ি সাজাবে সে। তার খুব আপন মানুষ রিপুদাকে ও তার মিথ্যে শোনাতে হলো। এভাবে আর কতদিন চলবে? কবে সে মুক্তি পাবে?

_________

মেয়েটির ফোন ধরতে দেরী হলো। সে হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ছেলেটি তা বুঝতে চাইল না। এই অবেলায় কেন ঘুমোতে হবে? আর ঘুমোবে যখন ঘুমোক। তার উপর অভিযোগ আনবে কেন? কেঁদেকেটে বুক ভাসাবে কেন? সে কি সারাদিন বসে থাকে? ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর সে ফ্যামিলির সাথে একদিন ও ভালো করে সময় কাটাতে পারেনি। ডিউটির কারণে প্রচুর ব্যস্ত সময় কাটছে। মেয়েটি যখন ফোন ধরল না। ছেলেটি বিরক্ত হলো। সোজাসুজি ফোন দিল মেয়েটির বাবা আফাজ আহমেদকে। আফাজ আহমেদ টিভির নিউজ দেখছেন। রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল পাল্টিয়ে আয়েশ করে বসলেন। হঠাৎ ফোনকলের আওয়াজে পান্জাবীর পকেটে থাকা ফোন বের করে ‘আদি ‘ নামটি দেখেই
অবাক হলে ও দেখালেন না। ফোন কানে দিয়ে মজা করে বললেন,
‘ জামাই বাবাজি প্রেমিকা ছেড়ে প্রেমিকার বাবার সাথে প্রেম করার শখ জেগেছে?
বিক্ষিপ্ত মেজাজের আদি হঠাৎ এমন মশকরা শুনে হেসে ফেলল। কানের নিচে ফোন চাপা দিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, ইয়ে মানে আন্কেল। ওকে ফোনে পাচ্ছিনা। ব্যস্ততার কারণে আজ আমার ফোন দেওয়া হয়ে উঠেনি। যখনি দিতে গেলাম আপনার মেয়ে ফোন তুলছেই না। যদি একটু গিয়ে বলেন।
আফাজ আহমেদ আদির কথায় হেসে ফেললেন। বললেন,মেয়েটি ডাক্তারটাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে তাই না?
আদি আবার নিঃশব্দে হাসল। আফাজ আহমেদের কথায় সম্মতি জানাল। একদম ঠিক বলেছেন আন্কেল।
আফাজ আহমেদ আইমিকে ডেকে দিল।হেসে বলল, আপনার হবু বর তার হবু বউকে না পেয়ে টেনশনে পড়ে গিয়েছে। শেষমেশ শ্বশুরমশাইকে কল দিয়েছে।
ঘুম ঘুম জড়ানো কন্ঠে আইমি বাবাকে জানাল। আমি দিচ্ছি ফোন,তুমি তোমার ফোন রেখে দাও।
আফাজ আহমেদ চলে গেল। ব্যালকনির পাশে এসে দাঁড়াল আইমি। ওপাশের ছেলেটি কল ধরার সাথে সাথে বলল, এত আর্লি ঘুম কেন ইমি?
আইমির সোজা জবাব, রাত জেগে প্রেম করব বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম। টায়ার্ড থাকলে প্রেমালাপ কি জমবে?
আদির এতক্ষণ চেপে রাখা রাগ আর দেখানো হলোনা। বলল, আচ্ছা, আপনি তো ঘুমিয়ে নিয়েছেন। আমার ঘুমোনোর ব্যাপারটা? আমার ঘুমোনো লাগবে না?
আইমির খারাপ লাগল। বলল, তুমি টায়ার্ড ফিল করলে রেখে দিই। পরে কথা বলে নেব আমরা।
আদি না,না করে উঠল। বলল, আজ সারারাত গল্প করব। ফ্রেশ হতে হতে গল্প করব। খেতে খেতে গল্প করব। ঘুমোতে ঘুমোতে গল্প করব।
আইমি হেসে উঠল। বলল, ডক্টর আদি চৌধুরী আজকাল একটু বেশিই কথা বলছে মনে হচ্ছে।
আদি হেসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল, প্রেমিকার জন্য কথা তো বলতেই হবে। এবার বলুন মিসেস আদি চৌধুরী গল্প কি আজ জমবে? নাকি,আপনি নিজেই টায়ার্ড?
আইমি অবাক হলো। পরক্ষণে হেসে ফেলল। বলল, ডিরেক্ট মিসেস? বাহ গুড ইমপ্রুভ মিঃ আদি। এবার বলুন গল্পের শুরুটা ঠিক কোথা থেকে হবে। গল্পের বিষয়বস্তু ঠিক কি? গল্পের হিরো কে? হিরোইন কে? গল্পটির নাম কি হবে?
আদি এবার ঠোঁট চেপে হাসল। দাঁড়িয়ে পড়ল। হেঁটে বারান্দায় চলে আসল। এদিকওদিক হেঁটে অনেকক্ষণ পর একটি লোহার চেয়ার টেনে এনে বসল। বলল, গল্পটির নাম আদির স্মৃতিলোপের পরের কাহিনী। গল্পটিতে হিরোইন নেই। শুধু হিরো আছে। তা ও আদি নিজেই। ভিলেন আছে তবে তা হচ্ছে সাড়ে চারবছর আগের একটি রাতের সেই ভয়ংকর অ্যাক্সিডেন্ট। এবার গল্পটি শুরু করা যাক ইমি। আজ কোনো অজুহাত শুনতে চাই না ইমি। রিকোয়েস্ট প্লিজ।
আইমি ভড়কে গেল। আজিজ আন্কেলের বলা কথাগুলো কানে ভেসে আসল। আজিজ আন্কেলকে দেওয়া কথার গাফিলতি সে কি করে করবে?
যেখানে ক্ষতিটা তার ও। এসব বলে তো কোনো লাভ নেই। আদির তো কোনোকিছুই মনে পড়বে না। শুধু শুধু আদির টেনশন বাড়িয়ে কি লাভ?
আইমি কথা ঘুরাল। বলল, তুমি একজন ডক্টর আদি। আমি চায় তোমার রোগ তুমি নিজেই খুঁজে বের করো। গল্পটির শুরু শেষ আমি কিচ্ছু জানিনা। খুব কম জানি আমি। তোমাকে কি বলব আদি?
আদির মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, তুমি আমায় বলতে চাইছ না ইমি। তুমি ছাড়া কে বলবে আমায়?
আইমি আশ্বস্ত করে বলল, আচ্ছা ঠিকআছে। মন খারাপ করোনা। যতটুকু জানি ততটুকুই বলি তাহলে।
আদি খুশি হলো। বলল, থ্যাংকস ইমি।
আইমি হেসে বলল, গল্পটার শুরু তোমার অ্যাক্সিডেন্ট দিয়ে।
‘ তারপর? আদি জানতে চাইল।
‘ মাঝখানে তোমার স্মৃতি ছিল না। কাউকেই চিনলে না তুমি। আন্কেল আন্টিকে ও না। আমাকে ও না। পাগলের মতো মিসবিহেভ করতে। জিনিস ভাংচুর করতে। তোমাকে মানসিক হাসপাতালে রাখেনি আন্কেল। আদরের ছেলে। বাসাতেই রেখেছিল। ডক্টর এসে দেখে যেত। শেষমেশ যখন তুমি খানিকটা সুস্থ হলে তখন তোমাকে ডক্টর মেহতার কাছে নিয়ে গেলেন, তার ছ মাসের পর থেকে ধীরে ধীরে তুমি স্বাভাবিক হলে। নতুন করে সবাইকে চিনলে। আমাকে চিনলে। তারপর তোমাকে সবকিছু মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমি নিলাম। যখন তুমি পুরোপুরি সুস্থ হলে আমার আর কিছু মনে করিয়ে দেওয়া লাগল না। গল্পটা এখানেই সমাপ্তি বলা যায়।
আদি পুরোটা সময় অবাক হয়ে শুনল আইমির কথা। বলল, ডক্টর মেহতার কথা তুমি বলেছিলে তাই না ইমি।
আইমি চুপ থাকে। বলে, তোমার বিপদের সময় আমি তোমার পাশে থেকেছি এটুকুই। আর কিছুনা। আমি তো সবসময় তোমার পাশে থাকতে চেয়েছি আদি। চায়।
আদি আওয়াজ করে নিঃশ্বাস ফেলল। কপালের একপাশে আঙুল বুলিয়ে বলল, আমি ও। ইমি তুমি জানো আমি সত্যি লাকি যে তোমার মতো একজনকে পেয়েছি, যে আমার খারাপ সময়ে ও আমার পাশে ছিল। এগেইন থ্যাংকস ইমি।
আইমির একটু খারাপ লাগল। বলল, থ্যাংকস কেন আদি। আমাদের সম্পর্কটা কি আদৌ থ্যাংকস দেওয়া নেওয়ার?
আদি তার ভুল বুঝতে পারল। সাথে সাথে বলল, সরি ইমি আর বলব না।
আইমি এবার গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলে, আবার ও সরি?
আদি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সামান্য মজার সুরে বলে, কি বললে খুশি হবে?
আইমি এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায়। পরমুহূর্তেই কিঞ্চিৎ দুষ্টুমির সুরে বলে, আদির কাছ থেকে ইমি আর কি শুনতে চাইবে?
আদি কপালের একপাশে আবার ও আঙুল বুলায়। হেসে বলে, ইমি সামনাসামনি বলি?
আইমি হাসে। বলে, এই আদি তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ?
আদি নিঃশব্দে হেসে মাথা চুলকায়। এদিকওদিক হাঁটতে হাঁটতে বলে, লজ্জা? আদি চৌধুরী? ইমপসিবল।
আইমি বলে, ফোনে বলতে এত লজ্জা? আবার সামনাসামনি?
‘ সামনাসামনি নয় তোমার কানেকানে বলব। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বলতে পারিনা ইমি।
আইমি ধমক দিয়ে বলে, উহুম। চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে। নাহলে অ্যাক্সেপ্ট হবেনা ডক্টর আদি চৌধুরী।
আদি কথা বলতে বলতে রুমে ডুকে পড়ে। বলে, অ্যাক্সেপ্ট না হলো কি ক্যানসেল হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
আইমি রেগে যায়। ফুঁসে উঠে বলে, আদি এভাবে বললে মেরে ফেলব তোমায়।
আদি মজার সুরে বলে, তোমাকে ও মরতে হবে তাহলে। কারণ যেখানে আদি সেখানে ইমি।
আইমি ও আদির তালে সুর মিলিয়ে বলে, আদি যেখানে আইমি সেখানে। হোক জীবনে নয়ত মরণে।
আদি হাসে আবার ও নিঃশব্দে। কোনো এক প্রগাঢ় অনুভূতিদের আহ্বানে চুপ হয়ে থাকে দুজন । ফোন রাখার আগেই ওপাশ থেকে ডেকে উঠে আইমি।
‘ আদি?
ফোনের ওপাশ থেকে উচ্চারণ আসে।
‘ বলো
আইমি এক নিঃশ্বাসে বলে দেয়,
‘ ডি আমো
আদি এবার আওয়াজ করে হাসে। আইমির সাথে তাল মিলিয়ে হেসে সে ও আওড়ায়,
‘ আমো,
আইমি সাথে সাথে ফোন রেখে দেয়। ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ এদিকে বলল ফোনে বলবে না। আবার বলে দিল। দুমুখো। অসভ্য কোথাকার!

__________________

মাঝরাতে কারো কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। ইশার ঘুম ছুটে গেল। সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। কাঁপাকাঁপা হাতে জগ থেকে ঢেলে পানি খেল। কে কান্না করছে ভাবতেই কানে এসে আবার বাজল সেই কান্নার শব্দ। সে নিশ্চিত হয়ে গেল কান্নার শব্দটি পরীর। এতরাতে সে কাঁদছে কেন? দরজা খুলে বের হয় সে রুম থেকে। বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। ধীরে ধীরে তার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। সে মাথার একপাশে ওড়না দিয়ে চেপে ধরে তারপরে ও হাঁটতে থাকে। মাথার ব্যাথা একপাশ ছেড়ে অন্যপাশে চলে যায় এবার। সে আবার ও ওড়না দিয়ে সেইপাশ চেপে ধরে। হাতের মুঠো বারবার খুলে আর বন্ধ করে। আচমকা সে খেয়াল করল, কান্নার আওয়াজটির কারণেই তার মাথাব্যথা আর ও বেড়ে যাচ্ছে। অসহ্য। এই মেয়েটি এভাবে কাঁদছে কেন? তার মা বাবা কোথায়?
রিক বের হয়ে এল মেয়েকে কোলে নিয়ে। শান্ত হতে বলতে বলতে এদিকওদিক হাঁটাহাঁটি করে। ইশাকে দেখতেই সামান্য বিস্মিত হয় সে। বলে, এখনো ঘুমোস নি?
ইশা আমতাআমতা করে বলে, মাথাব্যথা করছে। ঘুম আসছিল না তাই হাঁটাহাঁটি করছিলাম।
রিক তার কথা পুরোপুরি শুনল কি না কে জানে। পরী সামান্য শান্ত হতেই আবার ঘরে ডুকে পড়ল। ফিডার হাতে তার পেছন পেছন ঘোরাঘুরি করছে মুনা। মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তিত মা,বাবা দুজন। পরীতো সারাদিন খুব শান্ত ছিল। খেলাধুলা ও করেছে। হঠাৎ কি হলো তার। একটু শান্ত হতেই রিক আর মুনার কলিজায় যেন পানি পড়ল। দুজনই ফিসফিস আওয়াজ করে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত।
ঢুলুঢুলু চোখে ঘুম থেকে উঠে আসল রিপ। রিকের ঘরে ডুকে পড়ার আগেই আনমনা হয়ে এদিকওদিক হাঁটতে থাকা ইশাকে দেখেই তার ভ্রুকুঞ্চন হয়। এগিয়ে এসে বলে, কি হয়েছে রে ইশু। পরীমা কাঁদছে কেন?
ইশা হঠাৎ এমন প্রশ্নে চমকায়। বলে, কি জানি ? ঘুম থেকে উঠেছে তাই বোধহয়।
রিপ অন্যকিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগমুহূর্তে আবার ও পিছু ফিরল। বলল, তুই এখনো ঘুমোসনি?
ইশা তারপর ও এদিকওদিক হাঁটা বন্ধ করল না। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ঘুম আসছিল না তাই। তুমি যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।
রিপ দাঁড়াল না। রিকের ঘরে উঁকি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমন্ত পরীকে দেখে আবার নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল সে।
ইশা টের পেল তার মাথার ব্যাথা ধীরে ধীরে কমছে। সে একটু স্বস্তি পেল। ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। চোখ বুজতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। ঘুমের দেশে গিয়ে ও বোধহয় শান্তি নেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঘুমের ঘোরে সে দেখতে পেল অগ্নিবর্ণ ধারণ করা দুটো চোখ। ইশা ঘুমের ঘোরে উঁ উঁ শব্দ করল। মনে হচ্ছে ওই চোখদুটোর রাগ তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে। এভাবে যেতে যেতে তার ঘুম কিছুক্ষণ পর আবার ছুটে যায়। হুড়মুড় করে উঠে বসতেই বুঝতে পারল তার পুরো শরীর ঘেমে একাকার। যদি ও মাথার উপর পাখা ঘুরছে অবিরত। সে নিজের চুলের মুঠো শক্ত করে ধরে বসে রইল। টের পেল দুইনয়ন ভিজে উঠেছে তার। সাথে দুই গাল ও। সে দেখল বিছানার একপাশে পড়ে আছে একটি টেডিবিয়ার আর একটি সাদা পান্জাবী। এই দুই জিনিস এখন তার জীবনের সবচাইতে বড় আতঙ্ক। সে না পারছে এদের ছেড়ে বাচঁতে। না পারছে এদের নিয়ে বাচঁতে। কবে সে শান্তিতে একটু নিঃশ্বাস নিতে পারবে?
ইশা শান্ত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। আচমকা সে হাওয়ায় প্রশ্ন ছুড়ে,
‘ আপনি এসেছেন ডক্টর। আপনি সুস্থ হয়ে গিয়েছেন? একদম পুরোপুরি সুস্থ? মিষ্টিকে কি একটিবার ভুলে ও মনে পড়ে না।
খানিকক্ষণ পর তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। একে একে মনে পড়ে যায় ওই পাষন্ড মানুষগুলোকে দেওয়া কথা। সে কেন ভুলে যাচ্ছে বারবার ওই অবাঞ্চিত শর্তের কথা?
মাথা ছেড়ে দিয়ে সে চোখদুটো চেপে জমানো জল ছেড়ে দেয়। ফুঁপিয়ে উঠে বলে, আমি ডাকলে ও আপনি আসবেন না ডক্টর। আমি পাগল তাই এতকিছুর পরে ও আপনাকে চেয়ে বসি। কিন্তু আপনি আসবেন না। কষ্ট হলে ও আসবেন না। ফিরে তাকাবেন না। আপনি ফিরে তাকানো মানে আমার জীবনের সবচাইতে বড় সর্বনাশ হওয়া। আমি এটুকু আঁকড়ে ধরে বাচঁতে চায়। আপনি ফিরে তাকালে আমি আমার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলব। তাই আমার কাছে ফিরবেন না। আমার কাছে আসবেন না। কখনো আসবেন না ডক্টর। আমি হাজারবার ডাকলে ও আসবেন না।

____________________

কানের নিচে ফোন। কাঁধ আর কান দিয়ে একপাশে চেপে ধরেছে আদি। ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর তার ব্যাগপত্র কিছুই গোছানো হয়নি। একে একে সব কাপড়চোপড় বের করে সে ড্রবে রাখছে। বেশ অনেকক্ষণ পর সে কথা বলা শেষ করে ফোনটা নামিয়ে রাখল। তারপর পরই অন্য ফোনকল এল। কানে দেওয়ার সাথে সাথে ওপাশের মেয়েটি বলল,
‘ আদি কাল বৃষ্টি হলে খুব ভালো হয়। দুজন একসাথে অনেকগুলো দিন বৃষ্টিবিলাস করব। ভালো হবে না?
আদি নিশ্চুপ হাসল। বলল, দারুণ আইডিয়া ইমি। তোমাকে এত বুদ্ধি দেয় কে?
ওপাশের মেয়েটি হাসল। বলল, বুদ্ধি দেওয়া লাগেনা মিষ্টার। আপনাআপনি মাথায় চলে আসে। অটোমেটিক। আচ্ছা রাখি। এটাই জানানোর ছিল। তোমার ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম। গুড নাইট।
আদি ফোন রেখে দিল।
ব্যস্ত হয়ে কাপড়চোপড় বের করল। কয়েকটা সাদা পান্জাবী বেরোলো ছোট্ট ব্যাগটা থেকে। পান্জাবী গুলো অনেক পুরোনো হবে বুঝাই যাচ্ছে। কিন্তু সাদা ধবধবে। এমন পান্জাবী এই ব্যাগটাতে কি করে এল। ব্যাগটা কার। এসব পান্জবীই বা কার। সবগুলো পান্জাবী হাতে নিয়ে সে দৌড়ে যায় মা বাবার রুমে। দরজায় ঠোকা দিয়ে বলে,,,,গল্প হচ্ছে মিস এন্ড মিসেস চৌধুরী?
আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী কথা বলতে বলতে থেমে গেলেন। ছেলের মুখে এমন সম্বোধন দেখে উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন। বললেন, আদি কাম,কাম ব্যাটা। এনি প্রবলেম?
আদি বিছানায় পান্জাবীগুলো ছুড়ে মেরে আয়েশ করে বিছানায় বসে বলে,
‘ এসব কার পান্জাবী মা। আমার ব্যাগে কি করে এল?
আজিজ চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন,
‘ কোন ব্যাগ?
‘ ওই যে মাঝারি সাইজের কালো ব্যাগটা। ব্যাগটার উপর ধুলোবালি পড়েছে,তাই ভাবলাম কাপড়চোপড় সব বের করে ফেলি। গিয়ে দেখলাম এসব।
আজিজ চৌধুরী হাসলেন। বললেন,
‘ তুমি যখন অসুস্থ ছিলে তখন এসব পড়তে বেশি ভালোবাসতে। সাদা পান্জাবী মোট দশ বারোটা ছিল তোমার। এগুলো এখন আমাকে দিয়ে দাও। আমি অন্যকোথাও ফেলে দেব। নয়ত কাউকে,,,,,
আজিজ চৌধুরীর কথার মাঝে আদি হেসে উঠল। পান্জাবীগুলো হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলে,
‘ আমি পড়তাম এসব? বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক। আচ্ছা আমাকে তখন উইআর্ড লাগত না। আইমি দেখে হাসত না?
আলিয়া হেসে বলে, হাসবে কেন? উইয়ার্ড লাগত না বরঞ্চ সুন্দর লাগত।
আদি দুষ্টুমির সুরে বলে, আচ্ছা! থাকুক আমার কাছে স্মৃতি হিসেবে। বিরল ঘটনা হয়ে থাকবে আমার লাইফে এই স্মৃতি লোপ।
গুড নাইট মা। গুড নাইট বাবা।
আলিয়া আর আজিজ হেসে ছেলেকে ও গুডনাইট জানায়।
আদি রুমে চলে আসে। পান্জাবীগুলো একজায়গায় রেখে দেয়। ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাগটা অন্য জায়গায় রাখতে গিয়ে খেয়াল হয় ভেতরে আর ও ভারী কিছু আছে।
হাত দিয়ে টেনে বের করতেই তার চোখের সামনে মেলে পড়ে লাল টকটকে বেনারসি। একটা ছেলের ব্যাগে এমন শাড়ি কেন থাকবে? দেখে মনে হচ্ছে বিয়ের শাড়ি। বেশ ভারী শাড়িটা। সে মা বাবার কাছে ছুটতে চাইল। কিন্তু তারা ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে আর এগোলো না। আইমিকে কয়েকবার ফোন দিল। সে ও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে,তাই সে আর কল তুলল না। আদির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। শাড়িটা থেকে অদ্ভুত ভাবে ভেসে আসছে একটি মিষ্টি ঘ্রাণ। যা নাসারন্ধ্র ভেদ করে একেবারে কলিজায় গিয়ে পোঁচ মারল। তার বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা লাগল। অসহ্যরকম ব্যাথা। নিমেষেই আবার চলে গেল। এমন অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার ঘটছে চিন্তায় এমনটা হওয়ার কথা। সে অন্য কোনোকিছু ভাবতে পারল না। মাথায় এলো শুধু ঘুমোতে হবে এখন। নাহলে মাথা ব্যাথা বাড়বে। রাত কম নয়। বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ার পর ডিমলাইটের আলোয় সে দেখতে পেল,ঝলমল করা শাড়িটি। নাকে এল সেই ঘ্রাণ। তার চোখমুখ কুঁচকে এল। উফ শাড়িটা রেখে দেওয়া হয়নি। সকাল হলেই জেনে নিতে হবে। এটা কি আমি ইমির জন্য কিনেছি?
নানারকম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। আজ সে অন্যরকম ভাবে ঘুমোলো। এদিকওদিক নড়াচড়া করার দরুন শাড়িটা তার বুকের নিচে চাপা পড়ল।
গভীর রাতে আচমকা সেই শাড়িটা সে মেঝেতে ছুড়ে বলল। উল্টাপাল্টা আওড়াল, হেইট ইউ ইমি। রিয়েলি হেইট ইউ।
ধড়ফড় করে উঠতেই নিজেকে এভাবে এলোমেলো ঘুমোতে দেখে নিজেরই রাগ লাগল। এত অগোছালো তো সে না? বিছানা থেকে শাড়ি পড়া পুতুলটিকে দূরে ছুড়ে ফেলল। শাড়িটিকে ও দূরে ছুড়ে ফেলল। শাড়িটি গিয়ে পুতুলটির গায়ের উপর পড়ল। ছেলেটি দেখল কি দেখল না কে জানে? পুতুলটির গায়ে শাড়িটিকে অদ্ভুতভাবে মানাল।

_________________

আকাশে ঘন কালো মেঘ। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে গুডুম গুডুম। বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। ঘোর অন্ধকার। চারপাশটা ভয়ংকর দেখাচ্ছে। এই বৃষ্টিবাদলের দিনে ও নিস্তার নেই বখাটেদের। মেয়েটি যখনই ছাতা মাথায় হেঁটে বাসার দিকে এগোচ্ছিল। পড়ল দুজন বখাটের পাল্লায়। মাথার কাপড় আর ও টেনে দিল। জামার হাতা ও টেনে নামাতে লাগল যেন। বুকের ভেতর ভয়ে ধড়ফড়ানি শুরু হলো। বাতাসের ঝাপটায় ছাতাটা ও উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে কাঁপছে ঠকঠক করে। আর কিছূদূর এগোলেই খান বাড়ি। মেয়েটির খেয়াল হলো ব্যাগে তার ফোন বাজছে। মনে হয় রিপুদা। সে কল ধরতে পারল না। বখাটেগুলো কেমন চাহনি নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। তাদের হাত থেকে পালানোর জন্য সে আবার ও উল্টো দিকে দৌড়ানো শুরু করল। কোথায় যাবে সে নিজে ও জানেনা। তার আগে নিজেকে এই নরপশুগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সে পিছু ফিরে একবার দেখল। আর একটুর জন্য বখাটেগুলো তাকে ছুঁতে পারেনি। সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াল সে। কিন্তু অমন বলিষ্ঠ দুজন পুরুষের সাথে কি করে পারবে সে! শেষমেশ ধরা দিতেই হলো। তার দুচোখ ফেটে জল বেরোলো। সে চিৎকার ও করতে পারল না। চিৎকার করে কাঁদতে ও পারল না। তার মুখ লেগে গেল কিছু একটার সাথে। সে পুরোপুরি বন্দী হয়ে গেল যেন। তার হাত পা অনঢ় হয়ে গেল। সে তার পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিল লোকটির গায়ে। ঢলে পড়ল লোকটির উপর।

পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠল। ছেলেটি দেখল মেসেজ এসেছে। সে পড়ল। তাতে লেখা আছে, বৃষ্টি আমাদের খুব ভালোবাসে। দেখো এই মন কেমনের বৃষ্টি নেমে এল আমাদের দুজনের জন্য। আমাদের বৃষ্টিবিলাসটাই হবে মন কেমন করা। তাই না আদি?
ছেলেটি মুচকি হেসে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল। মেয়েটিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আর রিপ্লাই করল না। কিন্তু ঘটল অঘটন। গাড়ির দিকে পিছু তাকিয়ে তাকিয়ে দৌড়ে আসছে একটি মেয়ে। সে চট করে গাড়ি থামিয়ে রাখল। মেয়েটি কি মেন্টালি সিক? অসহ্য। এভাবে দৌড়ায় কেউ! গাড়ি থেকে নামিয়ে মেয়েটিকে থামাতে চেষ্টা করল সে। পুরোপুরি বিপরীত কিছু ঘটল। সে না পারল মেয়েটাকে বকতে না পারল নিজে নড়তে। তার মুখ দিয়ে বেরোলো না কথা। বুকের এত কাছাকাছি কারো মুখের স্পর্শে সে পুরোপুরি নীরব হয়ে গেল। এই ঠান্ডা বৃষ্টিজলের মাঝে তার বুকের কাছে গরম নিঃশ্বাস অনুভূত হলো। কেটে গেল এভাবে বেশ কয়েকমিনিট। সে কিভাবে সম্বোধন করবে বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটিকে হাত দিয়ে ছুঁবে কিনা সেটা ও বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটি এমনভাবে ধরে রয়েছে যেন তার খুব পরিচিত, শান্তির জায়গায় সে মাথা রেখেছে।
মেয়েটি বিড়বিড় করে কি যেন বলল। আর ও শক্ত করে চেপে ধরায় ছেলেটি দু পা পিছিয়ে গেল। গাড়ির সাথে লেগে গেল। তার হুশ ফিরল মেয়েটির ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার তালে সে ঠকঠক করে কাঁপছে ও। ছেলেটি এখন ও কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। শুধু আওড়াল,
‘ ছাড়ুন প্লিজ। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
মেয়েটি কর্ণকুহরে গিয়ে আঘাত করল শব্দগুলো। আঘাত করল কথাগুলো। আঘাত করল কথার ছন্দ গুলো। আঘাত করল সেই কন্ঠ। সেই চেনাপরিচিত নিঃশ্বাসের আওয়াজ। সেই চেনাপরিচিত স্পর্শ। সে ভয়ে কেঁপে উঠল। মুখ তুলে তাকাতে ভয় পেল। ছেলেটির বুকে হাত রাখতেই সে যেন এক ঝটকা খেল। এ কি করে হয়? এতটা কাছে সে? এতটা কাছে।
যখনি সে মুখ তুলে তাকাল ধীরে ধীরে সে দেখতে পেল তার মুখের উপর জল পড়ছে ছেলেটির মুখ থেকে চুয়ে চুয়ে। কি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। আর মুহূর্ত। এখানেই কি সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যেতে পারেনা?
এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে মেয়েটি তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। সে যে ছেলেটির হাতের বাঁধনে কখন আটকা পড়েছে বুঝতেই পারল না। বহুদিন পর তার ঠোঁটের কোণায় একটু হাসির দেখা মিলল। বহুদিন পর। তার এত কাছাকাছি থাকা ছেলেটা একসময় তার স্বামী ছিল। তার রোগী। যদি ও সে ডক্টর নয়। ছেলেটি নিজেই ডক্টর। ছেলেটার মৃদু মৃদু প্রত্যেকটা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সে পরিচিত। খুব করে পরিচিত। ছেলেটার স্পর্শ তাকে নতুন করে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটার তাকানো,চাহনিগুলোর মাঝে খুব পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে তার স্পর্শগুলোতে ও। আগে তার স্পর্শে মেশানো থাকত নির্ভরশীলতা হয়ত ভালোবাসা ও। কিন্তু এখন তার স্পর্শগুলো একদম অপরিচিত। সে স্পর্শ করেছে খুব অপরিচিত একজনকে। চেনাজানার গন্ডিটা যদি ও খুবই সীমিত। সেহেতু অচেনাই বলা যায়। ছেলেটির মুখ,কপাল,ঠোঁট,গাল,তাকানোর ভঙ্গি একদম আগের মতো। শুধু আজ মেয়েটিই তার কাছে অচেনা,অপিরিচিত একজন। ছেলেটি কপালে ভাঁজ ফেলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। ছেলেটি আগে মেয়েটিকে মিষ্টি করে ডাকত, মিষ্টি। কিন্তু এ মুহূর্ত সে ডাক শোনার কোনো সম্ভাবনা না থাকলে ও তার খুব করে ইচ্ছে হলো একটিবার, শুধু একটিবার মিষ্টি ডাকটি শুনতে। কিন্তু তার ভাবনার সুতো ছিড়ে দিয়ে ছেলেটি তাকে হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিল। বলল, বৃষ্টির দিনে রাস্তায় এভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেন? আজকে যদি গাড়ির নিচে চাপা পড়তেন? দোষটা আমার হতো। অসহ্য।
ছেলেটার কন্ঠে ঝড়ে পড়ল বিরক্তি। মেয়েটার খুব ভালো লাগল। খুব ভালো লাগল ছেলেটার কন্ঠে বিরক্তি দেখে। খুব ভালো লাগল ছেলেটির এত বিস্তর পরিবর্তন দেখে। খুব ভালো লাগল ছেলেটির এমন গম্ভীর রূপ দেখে। সে তো এটাই চেয়েছিল। ছেলেটির মেয়েটির মুখ থেকে কোনো কথা বেরোতে না দেখে দ্বিগুণ বিরক্ত লাগল। এই মেয়েটা এতদিন পর কোথা থেকে উড়ে আসল। তারসাথে সবসময় কেন মন কেমন করা বৃষ্টির সময় দেখা হয়? কেন?
মেয়েটির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল বৃষ্টিজলে মিশে একাকার হয়ে গেল। ছেলেটি দেখল না। টের ও পেল না। মেয়েটি ছেড়ে দিল ছেলেটিকে। খুব কষ্ট হলো ছাড়তে। তারপর ও ছাড়তে হলো। মেয়েটির উপর বিরক্ত হয়ে গটগট পায়ে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে যায় ছেলেটি । মেয়েটিকে একা দাঁড় করিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। মেয়েটির দিকে তাকায়না। গাড়িতে থাকা টিয়ে পাখিটি আচমকা ডানা ঝাপটানো শুরু করে। ডেকে উঠে, মিষ্টি, মিষ্টি।
ছেলেটি অবাক হয়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি হঠাৎ চমকে উঠে। ছেলেটির চোখ আপনাআপনি মেয়েটির দিকে চলে যায়। দুজনই আবার চোখাচোখি হয়। টিয়ে পাখিটি দ্বিগুণ হারে ডানা ঝাপটানো শুরু করে। ছেলেটি ধমক দিয়ে বলে, মিনি স্টপ, স্টপ। কে মিষ্টি?
মেয়েটি চোখ মুছে নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটি হাতে নিয়ে আবার উল্টো পথে দৌড়াতে থাকে। ছেলেটির দিকে আর পিছু ফিরে তাকায়না। মিনির ডাক ও শোনে না। তার ধরা দিলে চলবে না। ছেলেটি অবাক হয়ে বলে, কি আশ্চর্য! আবার দৌড়াচ্ছে।
মিনি ডানা ঝাপটানো ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সামান্য আওয়াজ করে আবার বলে , মিষ্টি!
ছেলেটি মিনির উপর চরম বিরক্ত হয়। বলে, মিনি তোমাকে এসব কে শিখিয়েছে? শুধু আমার নাম ডাকবে। আদি, আদি। শুধু আদি ডাকবে। ওকে!
মিনি এবার শেষবার ডানা ঝাপটায়। ডাকে, আদি মিষ্টি। মিষ্টি আদি।
আদি এবার গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ঘুষি মারে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে, কে মিষ্টি? কে? মিনি চুপ হয়ে যায় আদির রাগ দেখে। মাথা নিচু করে পায়ে ঠোকা দিতে থাকেে ঠোঁট দিয়ে।

মেয়েটি বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই হামলে পড়ল কারো বুকে। ছেলেটি দু পা পিছিয়ে গেল। হঠাৎ এমন অযাচিত আক্রমণে সে হতবাক। বলল,কি হয়েছে ইশু, কাঁদছিস কেন? মেয়েটি কিছুক্ষণ কান্না করে। তারপর মাথা তুলে বলে,রিপুদা আমি দেখেছি।
ছেলেটি অবাক হয়ে জানতে চায়, কাকে দেখেছিস? কি দেখেছিস?
মেয়েটি এবার আর উত্তর দেয়না। শুধু ছেলেটির বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে অবিরত। ছেলেটি কিছুই বুঝেনা। বুঝতে ও চায়না। মেয়েটির স্পর্শে তার অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। সে ভালোবাসে এই ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটাকে। বড্ড বেশি ভালোবাসে। খুব শীঘ্রই সে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেবে মেয়েটাকে। খুব শীঘ্রই।

_______________________

বারান্দায় হেঁটে আসল ছেলেটি। পড়নের ভেজা সাদা শার্টটি এখনো গায়ে আছে। তার পুরো শরীর এখনো ভিজে আছে। আলিয়া এসে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিল মাথা, মুখ। ছেলেটি তারপর ও নির্বিকার। তার হোলদোল নেই। শুধু বলল, চেন্জ করে নিচ্ছি, তুমি যাও মা। আলিয়া বেগম ছেলের দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু পড়তে পারেনা। ছেলেটি বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বহুদূরে দৃষ্টি স্থাপন করল। এখনো সেই ঝুম বৃষ্টি। বাতাসের সাথে ভেসে আসছে মৃদুমধুর কাঁঠাল চাপার কড়া গন্ধ। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে সে গন্ধে। কিন্তু এই আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির আজ মন ভালো নেই। তার চেন্জ করতে কেন জানি ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছেনা কিছুই। তার ফোনকল বেজে উঠল। সে ধরল না। প্রায় পাঁচ পাঁচ বার ফোনকলে আসায়। সে ফোন তুলল। ওপাশের মেয়েটি চিন্তিত গলায় বলল, আদি তুমি ঠিক আছ? আসতে দেরী হচ্ছে কেন?
ছেলেটি বারান্দার গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বাঁকা বাঁকা করে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ঠিক নেই ইমি। বাই দ্য ওয়ে, আমার কি কোথাও যাওয়ার কথা ছিল?
#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১২
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আইমির বাসা থেকে কিছুটা দূরে একটি হাইস্কুল আর কলেজ। তারপাশেই একটি ছোটখাটো পার্ক। স্কুল কলেজের স্টুডেন্টদের বেশিই দেখা যায় সেই পার্কে । ছুটির দিন হওয়ায় স্টুডেন্ট নেই। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আছে। দ্রুত গতিতে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে আদি। মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। আইমিকে দেওয়া কথা সে কি করে ভুলে গেল। এদিকওদিক তাকাতেই লম্বা একটি বেঞ্চে বসে থাকতে দেখা গেল আইমিকে। আদির রাগ লাগল। এমন বৃষ্টির মাঝে কেউ এভাবে বসে থাকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে গেল আইমির দিকে। ধপ করে আইমির পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আইমি তাকাল না। দাঁড়িয়ে পড়ে হাটঁতে লাগল। আদি ডাক দিল,
‘ আমি এসেছি আর তুমি চলে যাচ্ছ ইমি?
আইমি সরাসরি তাকাল আদির দিকে। আদি তার লাল হওয়া চোখ দেখে ভড়কে গেল। অসহায় হয়ে বলল,
‘ কাঁদার কি হলো ইমি? আমার ভুল হয়েছে। বলেছি কিন্তু একবার।
আইমি কন্ঠ ধরে এল। বলল,
‘ তুমি কোথায় গিয়েছ আদি? তুমি প্রায় দুইঘন্টা আগে আমাকে বলেছিলে তুমি মাঝরাস্তায়। তারপর উদাও। ম্যাক্সিমাম আধঘন্টা লাগে এখানে আসতে। আর তোমার আড়াই ঘন্টা। কোথায় ছিলে আদি?
আদি অবাক হয়। বলে,
‘ ইমি ব্যাপারটা অত সিরিয়াস কিছুনা। আমার কি হয়েছে আমি নিজেই জানিনা। এখানে আসার কথা মাথায় ছিলনা। যখন বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গেলাম, তোমার মেসেজ দেখে মনে পড়ল। এগেইন সরি ইমি । এত সরি কিন্তু আমি কাউকে বলিনি কোনোদিন।
আইমি হিচঁকি তুলে কাঁদে। বলে,
এসেছ কেন? না আসলেই ভালো হত। আমি আজ রাতটা এখানেই কাটাতে পারতাম। ভালোই হতো।
আদি আইমির কথায় হেসে দেয়। বলল,
‘ বখাটেদের বখাটেপনা সহ্য করতে পারতে?
আইমি চোখ লাল করে তাকায়। বলে,
‘ পারতাম।
আদি হো হো করে হেসে উঠে। আইমির এতে দ্বিগুণ রাগ বাড়ে। বলে,
‘ তুমি হাসো ভালো করে। আমি যে বুড়ি হয়ে যাচ্ছি, সেদিকে তোমার খেয়াল নেই।
আদি আবার ও হাসে। বলে, ইমি টুয়েন্টি থ্রি হলে কেউ বুড়ি হয়ে যায়না। টুয়েন্টি ফাইভ হতে হবে। আমি পিচ্চি বউ সামলাতে পারব না।
আইমির প্রচন্ড রাগ লাগে। বলে,
‘ কিন্তু আমার বুড়া বর চাইনা। তুমি ও তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। বিয়ে হয়ে গেলে এতদিনে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে যেতাম। আর তুমি বাবা।
আদি হাসতে সামনের দিকে ঢলে পড়ে। আইমি ধরে। বলে,
এভাবে হাসবে না আদি। রাগ হয়।
আদি তারপর ও হেসে যায়। বলে,
‘ ইমি তোমার বাচ্চাকাচ্চার মা হওয়ার এত শখ। আমি আর ও ভাবছি বিয়ের দুইবছর বাচ্চাকাচ্চার নাম নেওয়া যাবেনা। আর তুমি বিয়ে হওয়ার আগেই কিসব ভেবে আছ?
ইমি কিল দেয় জোরে। বলে,
‘ না আমার চাই। বিয়েটা কবে হচ্ছে? বাবা কিন্তু এবার সিরিয়াস।
আদি এবার নিশ্চুপ হাসে। বলে,
‘ এবার আমিও সিরিয়াস। বিয়ে করে সোজা এব্রোড। হানিমুনটা ও সেখানেই সেড়ে ফেলব। এক ঢিলে দুই পাখি। এই দেখো আমাদের বৃষ্টিবিলাস অলরেডি শেষের দিকে। জ্বর সর্দি বাধালে কিন্তু এই ডক্টর নিজেই মরবে সাথে আপনি পেশেন্টকে ও সামলাতে পারবে না।
আইমি নাক ফুলে তাকায়। বলে,
” এইটা কোনো বৃষ্টিবিলাস হলো আদি।
আদি আইমির নাকে টোকা দেয়। বলে,
‘ আচ্ছা এখন না। বিয়ের পর শিখিয়ে দিও।
আইমি আদির দুষ্টুমি বুঝতে পারে। বলে,
‘ তোমাকে আমি খুব মারব আদি।
আদির হাসি মুখোরিত হয় বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজের সাথে। আইমির রাগ ধীরে ধীরে শূন্যেতে নেমে আসে সেই হাসিতে মত্ত হয়ে।

__________________________

নীরা আর অর্পি দুইজনই ইশার বান্ধবী। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার কারণে বেশ জমকালো বন্ধুমহল নেই তার। কারো সাথে তেমন হুটহাট মিশে যেতে পারেনা। কারো সাথে তেমন যেচেপড়ে কথা ও বলতে জানেনা। নিজের এসব বাজে অভ্যাসের কারণে নিজের প্রতি সে বড্ড বিরক্ত। কেন সে অন্য দশজনের মতো হেসেখেলে কথা বলতে পারেনা। কেন কারো সাথে সহজে মিশতে পারেনা।
নীরা অর্পি দুজনই তার ভালো বন্ধু হলে ও তার অতীত জানা নেই তাদের। জানায়নি ইশা। তার জীবনে অতীত বলতে কিছুই নেই। যা আছে তাই তার অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ। তার জীবনের এখন একমাত্র লক্ষ্য পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করা। যাতে কেউ তাদের ইচ্ছে, মর্জি তার উপর চাপিয়ে দিতে না পারে। যার কতদিন অন্যের দয়ায় বাঁচবে সে। আর কতদিন অন্যের কাধেঁর উপর বোঝা হয়ে থাকবে। রিপুদা আর কত করবে তার জন্য। তার ও তো ভবিষ্যৎ আছে।
রিকশায় তিন বান্ধবী কোনোমতে চেপে বসল। রিকশা চলতে লাগল। তিন বান্ধবীর কথা,হাসিতে পথ ফুরোতে লাগল। আচমকা বাইক এসে আক্রমণ করে বসল রিকশায়। রিকশাচালক পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। লোকজন ছুটে এল। ইশা মাঝখানে বসায় অর্পির গায়ের উপর পড়ল। হাতে ব্যাথা পেল। তার পিঠের উপর পড়ল নীরা। পিঠে ও অসহ্য ব্যাথা অনুভূত হলো। অর্পি হাতে ভীষণ আঘাত লাগল। সে জ্ঞান হারাল। নীরার উপর পুরো রিকশা উল্টে পড়ায় সে ও মারাত্মকভাবে আহত হলো। মুহূর্তেই সেখানে এক অঘটন ঘটে গেল। লোকজন এসে বাইকের মালিককে গালিগালাজ করল। বাইকওয়ালা সহমর্মিতা না দেখিয়ে উল্টোসুরে বকাঝকা করতে লাগল রিকশাচালককে। রিকশাচালক তাতে কান দিল না। মেয়ে তিনটাকে তোলার চেষ্টা করল। ইশা আহত দুই বান্ধবীদের দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। নিজের ব্যাথা ভুলে দুই বান্ধবীকে ডাকাডাকি করল। নীরা আওয়াজ করলে ও অর্পি আওয়াজ করল না। তার নাক দিয়ে রক্ত বেরোলো। ইশা লোকজনের সাহায্যে কোনোমতে দুইজনকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করল। হাত ব্যাথায় ঠনঠন করে উঠল। রিপকে ফোন দিতে গিয়ে ও দিল না। মানুষটা শুধু শুধু টেনশনে পড়বে। নীরা আর অর্পির মা বাবাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিল।
প্রিয় দুই বান্ধবীর এমন মারাত্মক জখম নিজ চোখে দেখে সে কান্না আটকে রাখতে পারল না। কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে সে চোখের জল ফেলল। আর্তনাদ শোনা গেল আর বেশ কিছু রোগীর পরিবার পরিজনদের। রিকশাচালক হাতে ব্যাথা পেয়েছে। ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। রিকশাচালককে দেখে ইশার কষ্ট লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্পির মা আর নীরার বাবা চলে এল। বেশ চিন্তিত হয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলতে দেখা গেল। ইশার হাতের ব্যাথা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। ব্যাথায় সে চোখমুখ কুঁচকে রাখল। অর্পির মা এসে একদফা চেঁচামেচি করল ইশার উপর। ইশা ব্যাথা পায়নি অথচ অর্পির নাকমুখ হাতে জখম হলো। বিষয়টা অদ্ভুত না। ইশার মনে হলো অর্পির মতো আঘাত তার পাওয়া উচিত। তারজন্য তো এভাবে ভেবে দেখার কেউ নেই। তাই সে এমন ব্যাথা পেলে তেমন কিছুই হতোনা। সে কেন এমন আঘাত পেল না?
সূর্য হেলে পড়ল পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যা নামতে চলল। ইশাকে বাড়ি ফিরতে না দেখে জহির মিয়া বাড়িতে চিল্লাচিল্লি শুরু করল। রিপ বাসায় ফিরে ইশা ফিরেনি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল। মেয়েটি আবার কোনো বিপদে পড়ল না তো?
ইশার ফোনে কল দিতেই ইশা ফোন ধরল। বলল, আমি হসপিটালে রিপুদা। বান্ধবীর জন্য এসেছি।
রিপ চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল, তোর কিছু হয়নি তো। তুই মিথ্যে বলছিস আমায়?
ইশা না না করে বলল। কিচ্ছু হয়নি আমার। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় ফিরছি। রিপ ধমক দিয়ে বলল, আসবি না আমি যাচ্ছি। চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাক।
ইশা আর বারণ করতে পারল না। চুপচাপ কেবিনের সামনের রাখা লোহার লম্বা টুলের উপর বসে রইল। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। পিঠের যন্ত্রণা বেড়ে গেল। হাত আর পিঠের ব্যাথা মারাত্মক রূপ নিতে লাগল। সে উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। কিছুক্ষণ পর সেই হাঁটাহাঁটি করার শক্তিটা ও যেন ফুরিয়ে এল। সে ক্লান্ত হয়ে টুলটায় বসে পড়ল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে সে চোখ বুজল। চোখের জল গড়াল। সহ্যশক্তি এবার ফুরিয়ে আসল। যেন সে চেতন হারাল। নিজেকে আর খুঁজে পেল না।

_______________________

পিটপিট করে চোখ খুলে ইশা নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। হাত নাড়াতেই ব্যাথা অনুভব হলো। ঠান্ডা কিছু অনুভব হতেই হাতের উপর ভারী কিছু দেখতে পেল। একজন নার্স এসে ভারী জিনিসটি তুলে নিল। বলল, আপনার হাত মচকে গিয়েছে আপু। আপনি ট্রিটমেন্ট না নিয়ে বসেছিলেন কেন? আপনি জ্ঞান হারিয়েছেন।
ইশা তার ব্যাগ দেখতে পেল পাশে। ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, বিলটা কিছুক্ষণ পর দিলে হবে?
নার্স মাথা দুলিয়ে চলে গেল। ইশা কাঁপাকাঁপা পায়ে বেড থেকে নেমে এল। অর্পি আর নীরার কেবিনের দিকে যেতেই সেখানে তাদের পরিবার পরিজনের ভীড় দেখতে পেল। নিজের অজান্তেই হাসল সে। বাইরে বের হয়ে দেখতে পেল,পুরো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তার পাশে রিকশার জন্য সে দাঁড়িয়ে থাকল। ফোনে চার্জ শেষ। রিপকে ফোন ও দিতে পারল না।
পুরো হসপিটালে তন্নতন্ন করে খু্ঁজল রিপ ইশাকে। দুইটি কেবিনে অর্পি আর নীরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেল। নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানাল, ওনি আবার বিল পে করার জন্য আসবেন বলেছিলেন। রিপের মেজাজ বিগড়ে গেল । মেয়েটা তাকে আজ আবার ও মিথ্যে বলল? একটু ও আপন মনে করেনা মেয়েটা তাকে। এতটা পর সে। এতটা।

সামনে কালো কার এসে থামাতেই ইশা খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ল। সরে অন্যদিকে দাঁড়াল। ড্রাইভিং সিটে বসা ছেলেটি কাচ ভেদ গলা বের করে দিল। বলল,’ কোথায় যাবেন মিস?
ইশা মাথা তুলে তাকাল না। বলল,
‘ কোথাও না।
কিন্তু পরক্ষণে কন্ঠটি চেনা মনে হতেই সে চমকে চোখ তুলে তাকাল। হাত পা অনবরত কাঁপাকাঁপি শুরু করল। সে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। খেয়াল করল,তরতর করে তার ঘাম ঝড়ছে। সে ছেলেটির চোখ থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। কিছুই বলল না। দাঁড়িয়ে থাকল।
ছেলেটি আবার বলল, আমি কিন্তু কোনো কিডন্যাপার নয়। একজন ডক্টর। বলতে পারেন আপনার।
ইশা কেঁপে উঠল। সরাসরি ছেলেটির দিকে তাকাল। বলল,
‘ আমার?
ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে হাসল। বলল,
‘ উঠে বসুন। বুঝিয়ে বলি।
ইশা উঠতে চাইল না। বলল,
‘ আমি রিকশায় যাব।
ছেলেটির কেন জানি রাগ উঠল। বলল,
‘ এজন্যই বলে কাউকে যেচে পড়ে সাহায্য করতে নেই। অসহ্য।
ইশার হাসি পেল। আদি গাড়ির হর্ন বাজানোর সাথে সাথে বলল,
‘ যাচ্ছি।
আদি চুপ করে বসল। ইশা তার পাশে এসে বসতেই হাত নেড়ে বলল,
‘বাহ গুড জব। আমি তো ভেবেছিলাম পেছনে গিয়ে বসবেন?
ইশা চুপ থাকল। ডক্টরের পাশাপাশি কতদিন পর,কতমাস পর বসল সে। গাড়ি চলতে লাগল। দুজন নীরব সময় কাটল অনেকক্ষণ। আদির ফোনে কল এল । ওপাশের মেয়েটি জানতে চাইল,
‘ কি করছ?
আদি তার পাশে বসে থাকা নীরবচারীকে একবার দেখে নিয়ে বলল,
‘ বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা রোগীকে কোলে ছড়াচ্ছি। তারপর সেবা করছি। আবার ড্রাইভার সেজে ড্রপ দিচ্ছি। ব্যাপারটা কেমন হচ্ছে ইমি?
ইশা নড়েচড়ে বসল। ফোনের ওপাশে মেয়েটি আদিকে বলল,
” এত ফাজিল তুমি আদি? রাখছি এখন। ফ্রি হয়ে কল দিও।
ইশা বুঝল না। লোকগুলো এসব কি বলেছে? মাথা ঠিকঠাক আছে তো? নাকি আগের চাইতে ও পাগল বেশি হয়ে গেল?
আদি গাড়ি চালাতে মনোযোগ দিল। গান ছেড়ে দিল। ইশা শুধু সামনে তাকিয়ে থাকল। নড়ল না চড়ল না। আদি বিরক্ত হলো। এই মেয়েটি কি গুণে গুণে কথা বলে নাকি? অসহ্য?
খান বাড়ির সামনে আসতেই ইশা হাত নাড়াল। বলল, নামব। আদি তাকাল সরাসরি তার দিকে। বলল,
‘ আমি নামব বললে কি হয়?
ইশা নীরবে হাসল। গাড়ি দরজা খুলতে গিয়ে খুলতে পারেনা। আদি নিঃশব্দে হেসে লক খুলে দেয়। ইশা ততক্ষণে চেপে থাকে গাড়ির সিটের সাথে। এই লোকটা সব মেয়ের সাথে এমন করে। সব মেয়ের গায়ে ঝুঁকে পড়ে নাকি? আদি লক খুলে দেয়, কিন্তু সরেনা। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় ইশার দিকে। এত কাছাকাছি। একে অপরের নিঃশ্বাসের আওয়াজ আদানপ্রদান হচ্ছে যেন। ইশা চোখবন্ধ করে চেপে রইল। বিড়বিড় করে কি যেন বলল। আদি ও চোখবন্ধ করে রাখল। ইশা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ মেলে দেখল। আদিকে এভাবে চোখবন্ধ করে থাকতে দেখে ভড়কে গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই আদি হাতের আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ এইট
তারপর পরই সরে গেল। ইশা জোরে জোরে শ্বাস নিল। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। বলল,
‘ নাইন।
আদি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইশার দিকে। ইশা চোখ সরিয়ে নিল। বলল,
‘ ড্রাইভার সাজার জন্য থ্যাংকস ডক্টর আদি চৌধুরী।
আদি দ্বিতীয় বার অবাক হলো। বলল,
‘ নাম ও জানা আছে?
ইশা শুধু হাসল। ঘাড় ঘুরিয়ে চলে গেল।
আদি অবাক হলো। বলল,
‘ নাইন হয় কেমনে? গুনে গুনে আটবার দেখা হয়েছে। নয় কিভাবে হয়?
ইশা গেইটের ভেতর ডুকে পড়ল। গেইট বন্ধ করে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
আদি গাড়ির কাচ ভেদ করে গলা বের করে দিল। বলল,
‘ চলে গেল? নাইন কিভাবে হয় বলল না কেন? এমন মেয়ে আদি চৌধুরীর বড্ড অপছন্দ। অসহ্য। ইমির মতো হতে হবে। অপ্রয়োজনে না বললে ও প্রয়োজনে কথা বলতে হবে।
সে আওয়াজ করে গাড়ির দরজা ধপ করে বন্ধ করে দিল। গাড়ি যে পথে এসেছে সেইপথে আবার ঘুরিয়ে নিল।
ইশা গেইট সামান্য আলগা করে দিল। গলা উঁচিয়ে দেখল গাড়িটা ঠিক যে পথে এসেছে সেই পথে আবার ও ফিরে যাচ্ছে। সে অবাক হলো। বলল, আপনি কি সত্যিই আমার ডক্টর? মিষ্টির এত কাছে থেকে ও চিনতে পারলেন না? মিষ্টি কি তাহলে আইমির কাছে হেরে গেল? আইমি কি আপনাকে মিষ্টির চাইতে ও বেশি ভালোবাসে? এ প্রথম আপনার সাথে আমার মন কেমনের সন্ধ্যায় দেখা হলো। এই সন্ধ্যাটি আমার কাছে সবসময় স্পেশাল হয়ে থাকবে। আপনার ও কি থাকবে ডক্টর?
আদি গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন বের করল। ফোন দিল আইমিকে। আইমি ফোন ধরার সাথে সাথে বলল,
‘ মিস করছেন নাকি ডক্টর আদি চৌধুরী?
আদি রাগ দমন করে হাসল। বলল,
‘ হ্যা। এই মন কেমনের সন্ধ্যায় আদির ইমিকে খুব বেশি মনে পড়ছে। খুব বেশি মিস করছে। তাই ফোন দেওয়া।

চলবে,
( আপনাদের মতামত জানাবেন)
চলবে,
( আপনাদের মতামত জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here