মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ৩৩+৩৪

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৩+৩৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আদালতে প্রবেশ করার আগে আজিজ চৌধুরী তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসল। রিকের পান্জাবীর কলার চেপে ধরল, উগ্র রোষে বলল, ‘ আমার ছেলের মেয়েকে নিজের বলে দাবি করছ কোন সাহসে? আবার কেসটা একসেপ্ট ও করেছ?
শান্তশিষ্ট গম্ভীর প্রকৃতির রিক কোনো উচ্চবাচ্য করল না। টু শব্দ ও বেরোলো না তার মুখ দিয়ে।
আজিজ চৌধুরী হাত থেকে চট করে সেই পান্জাবীর কলার ছাড়িয়ে নিল ইশা। তার শান্তশিষ্ট চোখ দিয়ে ঘৃণার্হ ছুড়ে মারল। কিন্তু দুই ভাইবোন কোনো শব্দ করল না। এমন একটা জঘন্য মানুষকে মুখের কথা দিয়ে জব্দ করা সম্ভব নয়। কাজে করে দেখানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আদি আসতে চাইনি আদালতে। সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে আজিজ চৌধুরীর উপর। কিন্তু নিজের মেয়েকে একটিবার চোখে দেখার জন্য সে আসল আদালত শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে। কিন্তু দেখতে পেলনা। এভাবে হন্য হয়ে এদিকওদিক তাকানো ছেলেটাকে সবাই অবাক চোখে দেখল। আজিজ চৌধুরী তাকে সিটে বসিয়ে দিল । চোখ ঘুরাতেই অন্য সারির সিটে সে দেখতে পেল ওই কাঙ্ক্ষিত মেয়েটিকে। বাহ সে তো অনেক আগে এসেই বসে আছে। ইশা দেখে ও না দেখার ভান করার মতো বসে রইল। আলিয়া চৌধুরী নিজের ছেলের হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। যার অর্থ সান্ত্বনা বাণী। আদি বারবার সরিয়ে নিচ্ছে হাত। বলছে পরীকে কখন আনবে?
আদি অবাক হলো আর ও একজন ছেলেকে হন্য হয়ে আদালতে প্রবেশ করতে দেখায়। রিপ!
রিপ দেরী হয়েছে ক্ষমা চেয়ে নিল জজের কাছ থেকে। হাতের সব ফাইলগুলো দিয়ে দিল। তারপর নিজের অ্যাসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলে চোখ তুলতেই চোখাচোখি এক নিঃস্ব মায়ের সাথে। যার উপর নির্ভর করে আছে তার সন্তান কার কাছে মানুষ হবে। ইশা অসহায় চোখে তাকাল রিপের দিকে।। মুখ ফুটে কিংবা ইশারায় কিছু না বললে তার রিপদার চোখে ঢেউ খেলে একরাশ সান্ত্বনা। আর সান্ত্বনার অর্থ, কিচ্ছু হবেনা ইশু, সব ঠিক হয়ে যাবে।
অন্যদিকে রিপ মনে মনে হাসল মেয়েটার কাতর চোখ দেখে। সে বলল, তুই যেমনটা চাইবি তেমনটা হবে।
রিপের চোখ আটকে গেল আর ও একজনের কাছে গিয়ে। সে ও তো তার বাল্যকালের বন্ধু। কি আশ্চর্য আজ কোথায় সে বন্ধুত্ব। লড়াই হচ্ছে নীরবে দুজনের সাথে। রিপ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু আদির চোখ সরল না তার উপর থেকে। তার এমনভাবে তাকানোর এই মানে, আমার মেয়েকে কেড়ে নিস না আমার কাছ থেকে।
রিপ চোখ ফিরিয়ে নিল। আদালতের কাজকর্ম শুরু হলো। আজিজ চৌধুরীর রাখা উকিল মনির পদে পদে হেনস্ত করল রিপকে। রিপ পুরোটা সময় চুপ থাকল। মনির এমন ও অপবাদ দিল যে, মিঃ রিক জবরদস্তি করে ইশার হাত থেকে দলিলে স্বাক্ষর নিয়েছে।
এমন অপবাদ আনায় ভরা আদালতে ইশা চেঁচিয়ে উঠল, সবটা মিথ্যে। সব আজিজ চৌধুরী বলে দেওয়া মনগড়া কথা। এতটা নিচে মানুষ কি করে নামতে পারে?
রিপ হাত দিয়ে তাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে।
ইশাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সবটা বলতে বলে জজ। ইশা তাকায় একবার আদির দিকে। আদি মাথা নাড়ায় দুপাশে নিষ্প্রভ চোখে। মিনতি করে মিষ্টিকে, আমাকে এতবড় শাস্তি দিওনা মিষ্টি।

ইশা কাঠগড়ায় দাঁড়াল। জজ তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি আপনার মেয়েকে কেন তুলে দিয়েছেন ভাইয়ের হাতে? যেখানে আপনার স্বামী জীবিত ছিল। উনি অসুস্থ ছিল ঠিক, কিন্তু উনি তো জীবিত ছিল। আপনি কেনই বা চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন। আপনার সন্তানের উপর তার বাবার ও অধিকার আছে।
ইশা চাপাস্বরে জবাব দিল, আমি সন্তানসম্ভবা জানানোর পরেই তারা আমার দিকে ডিভোর্স পেপার ছুড়ে মেরে ছিল। আমাদের সেদিনই ডিভোর্স হয়ে যায়।

আদি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলে উঠল, আমি কোনো ডিভোর্স পেপারে সাইন করিনি। সব মিথ্যে। তুমি মিথ্যে বলছ মিষ্টি।

জজ সাহেব বললেন। আপনাকে বলতে দেওয়া হবে,আপনি বসুন। ইশাকে বললেন, শুরু থেকে সবটা খুলে বলুন।
ইশা তাকাল রিপ আর মুনার দিকে। কেমন অসহায় অবলা দেখাচ্ছে দুজনকে। ইশার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। সাথে অন্য ছেলেটির তাকানো দেখে। সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল। বলল,

‘ বিয়ের আটমাস পেরোতেই মিঃ চৌধুরীকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসার জন্য। আর আমাকে আজিজ চৌধুরী পাঠিয়ে দেন আমার মামার বাসায়। মাস না পেরোতেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থতার কারণে আমি শুয়ে থাকি বিছানায় দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। এই অসুস্থতার কারণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে জানতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা।
একটা মেয়ের জীবনে এমন একটি বার্তা অনেক খুশির,অনেক আনন্দের। আমার ও ঠিক তেমন খুশি লেগেছিল। তেমন আনন্দ হয়েছিল। আমি ভুলে গেলাম নিজের পারিপার্শ্বিক সব দুঃখকষ্ট বেদনা। আশায় বুক বাধলাম আমার এই কষ্ট একদিন ঘুচবে। আমার পাশে তখন চৌধুরী বাড়ির কেউ ছিল না। ছিল না মিসেস আলিয়া চৌধুরী,ছিল না মিঃ আদি চৌধুরী। কেউ ছিল না। ছিল আমার মামি, যে আমাকে নাকি ভালোবাসেনা। আসলে সে আমায় কতটা ভালোবাসে তা দেখায় না। আমার অমন দুর্দিনে আমি তাকে পাশে পেয়েছি। আর আমার বড়দা। তার কয়েকমাস আগে বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে যায় আমার ভাবির। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে সে আর কখনো মা হতে পারবে না । সন্তান নিতে গেলে তার মৃত্যুঝুঁকি আছে। এই সন্তান হারানোর,পেয়ে ও না পাওয়ার যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরছিল আমার বড়দা। যখন দেখল আমি সন্তানসম্ভবা। আমাকে সবরকম পরিস্থিতিতে সাপোর্ট দিয়ে গেছে। আমাকে একজন বড় ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে। আমি জানিয়েছিলাম আজিজ চৌধুরী আর আলিয়া চৌধুরীকে। যে আমি সন্তানসম্ভবা। কিন্তু তারা কি করল? তারপরের দিন পাঠিয়ে দিয়েছিল, একটি কাগজ,টাকা,ডিভোর্স পেপার।
টাকা দিয়েছিল যাতে আমি এবরশন করিয়ে নিই। আর টাকাটা সেই অপারেশনের। আর ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দেওয়ার জন্য। দেখলাম সেখানে আদি চৌধুরী স্বাক্ষর করে দিয়েছে। বহুকষ্ট যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে আমি সাইন করে দিয়েছি। আমার চোখের জলে সেদিন ভিজে গিয়েছিল ডিভোর্স লেটার। কতটা কষ্টে কাটিয়েছি আমি সেইদিন গুলো ভাবতে পারে কেউ। আমি চলে ও গিয়েছিলাম এবরশন করানোর জন্য। কারণ যার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই তার সন্তানকে কেন আমি রাখব? যে নিজেই চায়না,আমি কেন চাইব? কিন্তু সেইদিনের সেই ভুল কাজটি করা থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে আমার বড়দা। আজকের পরী বেঁচে আছে বড়দার জন্য। রিকদা নকল এবরশন সার্টিফিকেট দেখায় আজিজ চৌধুরীকে। বলে, আমি এবরশন করিয়ে নিয়েছি।
একটা মেয়ের সে সময় প্রয়োজন হয় ভরসাস্থল। চোখবন্ধ করে মাথা রাখার জন্য একটি কাঁধ। নিজের স্বামীকে প্রয়োজন হয় তখন। আর আমার বেলায় তখন সেই স্বামী তো বহুদূর। সে জানেই না তখন তার স্ত্রী আছে, আর সেই স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।
আমার পাশে আমি পেয়েছিলাম আমার মামা,মামি,বড়দা আর ভাবিকে। তারা সবটা দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছে। আমার কতশত আবদার পূরণ করেছে তারা। আমার কতকিছু খেতে ইচ্ছে করত। সব বলার আগেই যেন আমার সামনে এনে দিত আমার বড়দা। মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, সবার কপালে জোটেনা এই সুখ। তোর কপালে জুটেছে, তুই আগলে রাখিস,যত্নে রাখিস, ভালো রাখিস তোর সন্তানকে। সেই তোর ভবিষ্যৎ।
আমি কেঁদেছিলাম সেদিন। সত্যিই তো মুনা ভাবির সব আছে। অমন ভালো একটা পরিবার,স্বামী, শ্বশুড় শ্বাশুড়ি। কিন্তু সবটা থেকে ও সে সুখী নয়। তার সন্তান নেই। আর আমি? আমার কিচ্ছু নেই কিন্তু একটি সন্তান আছে। সে কি আমার পৃথিবী হয়ে উঠতে পারেনা?
তার কথা ভেবে আমি দিনতিপাত করতে লাগলাম। আমার ফিকে হয়ে আসা ধূসর পৃথিবীটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে লাগল রঙিন । যেদিন সে কান্নার আওয়াজ দ্বারা জানান দিল সে এসেছে আমার কাছে, যেদিন আমি দুচোখ খোলার সাথে সাথে দেখেছিলাম হাত পা ছুড়ে সে কান্না করছে। সেদিন আমি একেবারেই ভুলে গেলাম সব। তাকে কোলে তুলে বুকে নিয়ে চুপটি করে বসে রইলাম কতক্ষণ? সে ও যেন চুপ হয়ে বসে রইল। আমি ভেবে নিলাম,মেনে নিলাম আমার ভাগ্যকে।
সে যখন আমার বুকে ঘুমোতো,আমার বুক আঁকড়ে ধরত আমি যেন স্বর্গসুখ পেতাম। আমি তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম ডক্টরের পথ চেয়ে। যেন এইমাত্র ডক্টর ফিরল। আমায় চিনল,তার সন্তানকে চিনল। কিন্তু আমার ভাবনা ভাবনায় রয়ে গেল। ডক্টর আসত না, আসেনি। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি অসুস্থ হয় মাসে দু তিনবার। লেগে থাকে জ্বর, কাশি,কফের সমস্যা। আমার পাশে তখন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার বড়দা। ছোট্ট পরীর সবকিছু এমনকি চিকিৎসা খরচ চালাত বড়দা। আমার দিনগুলো ছোট্ট পরীকে নিয়ে ভালোই কাটছিল। পরী বড় হতে লাগল। আজিজ চৌধুরী একদিন আমাকে দেখলেন পরীকে কোলে অবস্থায় হসপিটালে। আজিজ চৌধুরী অবাক হয়ে তেড়ে এসে বলেছিলেন, এই মেয়ে তুমি এবরশন করাওনি। কে এই বাচ্চাটি।
আমি ভয়ে সেদিন কোলে দিয়ে ফেলেছিলাম আমার ভাবির। বলেছিলাম, ও আমার বাচ্চা না। ও আমার ভাইয়ের মেয়ে।
আজিজ চৌধুরী অবিশ্বাস্য তাকিয়ে সেদিন চলে গেলেন। আমার ভয় বাড়ল। পরী যতই বড় হতে লাগল আমার ভয় হতে লাগল। তার ভবিষ্যৎ?
সে ও কি আমার মতোই পরিবারহীন হবে? একটি সুস্থ সুন্দর পরিবেশ পাবে না? বাবার আদর, স্নেহ,ভালোবাসা পাবেনা? আমি সারাদিন ভেবে কূল পাইনি। অন্যদিকে আজিজ চৌধুরী। সত্য চাপা থাকেনা। সে যদি জানতে পারে পরীই তাদের ছোট ছেলের মেয়ে তাহলে তার ক্ষতি করতে দুদন্ড ও ভাববেনা। আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। সবার চোখের আড়ালে পরীকে রেখে এসেছিলাম এক ভদ্রলোকের বাড়িতে। ভদ্রলোক পরীকে দত্তক নেবে বলেছিলেন। আমি টাকা চাইনি। পরী যাতে ভালো থাকে, একটি সুস্থ সুন্দর পরিবেশ পাই সেজন্য পরীকে আমি দিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু রেখে আসার সাথে সাথে তা জানাজানি হয়ে যায়। বড়দার চোখে আমি সেদিন জল দেখেছি, দেখেছি পরীর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা। বড়দা সেদিন কষে আমায় চড় মেরেছিল।
বলেছিল,তোকে আমি লিখে দিতাম পুরো বাড়ি,তোর এতই যদি টাকার দরকার হয়েছে তুই আমাকে বলতে পারতি।
আমি সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার মেয়েকে। আমি আবার ছুটে গিয়েছিলাম সেই ভদ্রলোকের বাড়ি। বড়দাকে দেখে তারা চিনতে পারল। জানা গেল তারা পূর্বপরিচিত। বড়দার বন্ধু। সে যাত্রায় আমি বেঁচে গেলাম। আমার কোলে ফিরে এল পরী। তার অনুপস্থিতি আমাকে বুঝিয়ে দিল,তাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। আমি থাকতে পারব স্বামী ছাড়া,কিন্তু সন্তান ছাড়া নয়। সেদিন কাঁপাকাঁপা হাতে বড়দা আমার কোলে পরীকে তুলে দিতে গিয়ে বলেছিল, ইশু আর যায় কর,আমাদের চোখের আড়াল করিস না ওকে। ও শুধু তোর মেয়ে নয়, এই বাড়িটার প্রাণ। আমি সেদিন হেসেছি সুখে,আনন্দে। আমার মেয়েটাকে সবাই এতটা ভালোবাসে?
আমি কঠিন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। আমার ছোট্ট মেয়েটার অভিভাবক হিসেবে তো আমিই একমাত্র। তার কোনো পরিবার নেই। তার বাবা নেই। তার দাদু নেই। তার দাদা নেই। কিচ্ছু নেই। মায়ের দায়িত্ব পালন করলাম আমি। আমার মেয়েকে দিলাম একটি পরিবার, একটি বাবা,একটি মা,একটি দাদু,একটি দাদা। একটি সুস্থ সুন্দর পরিবেশ। আমি যখন তুলে দিলাম বড়দার হাতে পরীকে আমি বড়দার চোখে সেদিন পৃথিবীর বুকে একজন বাবার হাসি দেখতে পেয়েছিলাম। একজন সুখী মানুষকে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি বড়দাকে সেদিন কাঁদতে দেখেছি। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সেদিন তার চোখ চকচক করেছিল। সেইরাতটি আমার কষ্টে কেটেছিল। আমার বুক খালি হয়ে গিয়েছিল। সেইদিনের পর থেকে তার কান্নার আওয়াজ শুনে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম বড়দার রুমের বাইরে। তারা আর না পেরে আমার কাছে ছুটে আসত। বলত, ইশু একটু ঘুম পাড়িয়ে দে।
আমি চোখের জলে ভেসে ভেসে ঘুম নামাতাম তার চোখে। আমার কাছে আসতে না আসতেই সে যেন ঘুমিয়ে পড়ে। শান্ত হয়ে যায়। তার ছোট্ট হাতের মুঠো শক্ত করে আঁকড়ে ধরত আমার গায়ের ওড়না। যেন আমি তাকে ছেড়ে না যায়।
ঘুমন্ত অবস্থায় ও যদি আমি তাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে সে ঠোঁট টেনে টেনে কাঁদে। কিন্তু নিজেকে আমি শক্ত খোলসে ঢেকে ফেলি। তাকে আমার চোখের সামনে রাখার,তাকে ভালো রাখার জন্য আমাকে এমনটা করতেই হতো। সে বড় হয় ধীরে ধীরে। তার ছোট্ট মুখটা দিয়ে বের বাবা ডাক, মা ডাক। সে আমাকে প্রথমে ডাকল, আমমা!
রিকদাকে ডাকল বাবা, ভাবিকে ডাকল মা। তার ছোট্টছোট্ট পা দিয়ে সে হাঁটা শিখল। আমার সাথে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিতে মেতে থাকল। তার কাছে আমি পরিচিত হলাম ফিপি নামে। এভাবেই যেতে লাগল দিন। আমি মেনে নিয়েছি আমার ভাগ্যকে। মেয়েটা ভালো আছে, এটাই আমার সুখ। আমি আর কিছুই চায়নি। কিন্তু আমার এই সামান্য সুখটাই সহ্য হলোনা কারো। আজিজ চৌধুরী তার ছেলে দেশে ফেরার সাথে সাথে আমাকে ধমকানো শুরু করল। যেন আমি তার ছেলের দিকে না তাকায়। তার কাছে ফেরার চেষ্টা না করি। রীতিমত সেই ধমকা ধমকি আর ব্ল্যাকমেল করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল পরীকে। পরীকে নিয়ে নানান হাবিজাবি কথা বলে আমাকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার ছেলের মুখোমুখি আমি নই, তার ছেলেই হতো। তিনি পাহারা দিয়ে রাখতেন তার ছেলেকে। কিন্তু তার নিজের ছেলের দোষ দেখতেন না। দেখতেন আমার গুলো। আমাকে তার ছেলের পেছন থেকে মুখ বেঁধে ঝোপঝাড়ে ফেলে দিয়েছিল আজিজ চৌধুরীর লোক। হাত মুখ বেঁধে দিয়ে লাতি মেরে ফেলে রেখেছিল। সেদিন দয়া দেখিয়েছে আদি চৌধুরী। তারপরে ও থেমে থাকেনি আজিজ চৌধুরী। তারমতে তার ছেলের পেছন পেছন ঘুরি আমি। তিনি ভুলে গিয়েছেন আমি নই,তার ছেলেই আমার পিছু নেই। তা ও আবার তার সন্তানের মাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। কি পাষাণ আজিজ চৌধুরী নিজের নাতনীকে আর না পারতে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল। আর এখন এসেছে পরীকে নাতনী দাবি করতে। নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতে। আমি প্রত্যেকটা দিন,প্রত্যেকটা রাত ভয়ে ভয়ে কাটাতাম যে পরী কখন ও আমার চোখের আড়াল হয়ে যাবেনা তো। ঠিক সেটাই হলো। আমার করুন অবস্থার সময় আমি কাছে পাইনি তাদের কাউকে। আমার দুঃসময়ে আমি তাদের আমার পাশে পাইনি। আমি পাইনি ডক্টরকে। আমি অসহায় ছিলাম সেসময়। আমি কিচ্ছু চাইনি। আমি ডক্টরকে আর চাইনি। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম আমার মেয়েকে নিয়ে। ছোট্ট পরীর মুখটা দেখে দূর হয়ে যায় আমার সারাদিনের ক্লান্তি। কিন্তু আমার এই সামান্য সুখটা ও সহ্য হলোনা চৌধুরী বাড়ির মানুষের। এমনকি ডক্টরের ও। তিনি এসেছেন এতকাল পর নিজেকে বাবা দাবি করতে। মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে। কিন্তু এই মেয়েটার বড় হওয়ার পেছনে,বেঁচে থাকার পেছনে কার অবদান তা একবার ও ভেবে দেখল না। যে বড়দার কারণে পরী আজ আমাদের মাঝে সেই বড়দার কলার চেপে তাকে মন্দ কথা শোনাতে কারো বুক কাঁপেনা। যে বড়দা আর ভাবি রাতের পর রাত, দিনের পর দিন পরীর অসুখের সময় রাত জেগেছে,খাওয়া দাওয়া ছেড়েছে তাদের বুক খালি করতে কারো হাত কাঁপেনা। যারা তাদের পৃথিবীটা সাজিয়েছে পরী দিয়ে তাদের রঙিন পৃথিবীটা ধূলিসাৎ করে দিয়ে পরীকে কেড়ে নিতে তাদের লজ্জা লাগেনা। তাদের কষ্টগুলো কেউ দেখতে চায়না। তাদের একটাই দোষ, তারা জন্মদাতা আর জন্মদাত্রী নয়। পরী অন্যের সন্তান। অন্যের সন্তানকে নিয়ে তারা কেন টানাটানি করছে। তারা কেন নাক গলাচ্ছে। কেউ ভেবে দেখছেনা তাদের অবস্থা। আর পরীর। সে ও তো পাপা মাম্মা বলতে পাগল। মা বাবা হিসেবে সে জেনে এসেছে, বুঝে এসেছে,চিনে এসেছে বড়দা আর ভাবিকে। সে তাদেরকে ভালোবাসে। হাঁটতে হাঁটতে, চলতে ফিরতে পরী তাদের নাম জপ করে। পরী তাদের ভালোবাসে। তাদের চাই। কিন্তু পরীর চাওয়ার কি দাম আছে? না তার মায়ের? এখন শুধু আজিজ চৌধুরী আর আদি চৌধুরী যেটা চাইবে সেটা হবে। তাদেরই তো রক্ত। বড়দা যে এতকিছু করল তা কিচ্ছু নয়। কিচ্ছু না। এখন পরীর প্রতি ভালোবাসা উতলে উঠছে আদি চৌধুরীর আর আজিজ চৌধুরীর। পরীর উপর একান্তই তার পরিবারের অধিকার। তার বাবা বলতে যদি কেউ তাহলে সেটা রিক রেজওয়ান , আর মা মায়মুনা খানম। অন্য কেউ না। আমি নিজেই যেখানে কাগজেকলমে দিয়ে দিয়েছি পরীকে। সেখানে অন্য কেউ দাবি করতে কি করে আসে। কি করে অধিকার দেখাতে আসে?

নীরবতায় ছেয়ে যায় পুরো আদালত। ইশা গুনগুন করে কাঁদে। পুরো আদালতের নীরবতা ভেঙে দিয়ে ভেসে আসে একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের কন্ঠস্বর।
‘ পাপপা!
রিক আচমকা পরীর কন্ঠস্বর শুনে ভড়কে যায়। মহিলা পুলিশটির কোল থেকে নেমে পরী ছুটে যায় রিকের দিকে। রিক থ মেরে বসে থাকে। পরী রিকের গা বেয়ে তার কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে। শক্ত করে চেপে ধরে ডাকে, পাপপপা!
রিক কথা বলতে পারেনা। রিপ ও অবাক হয়। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। পরী মাথা নেড়ে বলে, পাপপা দুক্কু। পরীইই দুক্কু। মাম্মা নাই?
রিক ধরা গলায় বলল, আছে তো। এইতো পাশেই। পরী দেখল মুনাকে। হেসে উঠে ডাকল, মাম্মা রিইই নাই?
মুনা দেখিয়ে দিল রিপকে। জোরে আওয়াজ করে বলল, রিইইই ইশআআ নাই?
রিপ হেসে দিল। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ইশাকে। ইশা ততক্ষণে নিচে নেমে এল । পরীকে কোলে নিল। আদর দিল। বলল, মা কেমন আছে?
পরী তাকিয়ে থাকল ইশার দিকে। বলল, ইশআআ এববা নাই?
ইশা বুঝল না। বলল, এববা কি মা?
পরী তার মাথা দিয়ে মারল ইশাকে। বলল, দিইইই নাই। নাই।
হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল, দিইই নাই নাই।
ইশা হতবাক হয়ে চেয়ে রইল মেয়ের মুখের দিকে। ততক্ষণে সুনানি শেষ হয়ে গেল। আজিজ চৌধুরীকে কেস শেষ না হওয়া অব্দী জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। কিডন্যাপিংয়ের মতো অপরাধ করায়। আদি তাকাল ও না। আফি হাসল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার মজা লাগছে। আজিজ চৌধুরী কি করতে চাইল,কি হয়ে গেল? অতি চালাকির ফল। টাকা দিয়ে কি আইনকে নিজের বশে আনা যায়?
পরীকে দিয়ে দিল ইশার কাছে। ও না আদির কাছে থাকবে না রিকের কাছে। ইশার কাছে থাকার পারমিশন দিল আদালত।

ইশার কাঁধে পড়ে রইল পরী। ইশা দাঁড়িয়ে রইল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল না কাউকে। পরী ইশার কাঁধে পড়ে ইশার চুল নিয়ে খেলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তার চোখ গেল তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা ছেলেটার দিকে। পরী হাসল ঠোঁট এলিয়ে। চোখ টিপে দিল আদিকে। আদি তার টলমলে চোখ নিয়ে হাসল। পরী আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ওততততো দিইইইই!
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। আলিয়া হাসল পরীর কথা শুনে। পরী হাত তুলল, আদির দিকে হাত ছুড়ে বলল, দিইইইইই মাববো।
আদি হেসে দিল এবার। আদি উঠে দাঁড়ানোর আগেই ইশা বেরিয়ে গেল তাকে নিয়ে। রিক বলল, আদির কাছে কি তুই ফিরবি না?
ইশা বলল, এমন প্রশ্ন করোনা বড়দা।
আদি বেরিয়ে গেল ইশার পিছু পিছু। ইশা লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতেই সামনে এসে পড়ল আইমি। ইশা তাকে দেখে হাসল,বলল, অল দ্য বেস্ট।
আইমি হাসতে পারল না । দুঃখ প্রকাশ কিংবা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারল না। ইশাকে দেখতেই তার মনে হলো এতটা কষ্ট নিয়ে ও কি বাঁচা যায়? এতটা ত্যাগ ও কি করতে পারে একজন মেয়ে? আদি আসলেই খুব লাকি। মেয়েটা আজ ও ভালোবেসে গেল তাকে। ভালোবেসেই যাবে। আদি যদি জানত সত্যিটা ?

ইশা চলে যেতেই আদির সামনে এসে পড়ল আইমি। আদির মাথার রক্ত চড়ে বসল। কিন্তু সে কিচ্ছু বলল না। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আইমি কেঁদে দিল হু হু করে। আদি থমকাল। পিছু ফিরে বলল, কি চাই?
আইমি তার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলো না আদি। আমার কষ্ট হয়।
আদি সরে দাঁড়াল। বলল, এটা পাবলিক প্লেস আমি আপাতত কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছিনা।
আইমি কেঁদে দিল আবার। বলল, আদি আমি সরি। আমাকে ক্ষমা……
আদি দাঁড়াল না একমুহূর্ত ও। আলিয়া চৌধুরীর মুখোমুখি হলো আইমি। বলল, আন্টি আমি এখন কি করব?
আলিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, জানিনা আমি। কিচ্ছু জানিনা। আদি পাগল হয়ে যাবে। আমি শাস্তি পাচ্ছি, আমার পাপের শাস্তি। আদি পাচ্ছে আমাদের পাপের শাস্তি।

তিনদিন পর আবার ও সুনানি হলো। আফির সব কুকর্ম সামনে আনল রিপ। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির আবেদন করল সে নিজেই। ইশার বারণ শুনল না। ইশার আর আজিজ চৌধুরীর প্রত্যেকটা ফোন কলের রেকর্ড সে আদালতে পেশ করল। আজিজ চৌধুরীর মুখোশ খুলে দিল। মিথ্যে বিবৃতি,মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে আইনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাই তাকে আর আফিকে জরিমানা করল। ছ মাসের জেল দিল। রিপ ইশার আকুতি সে শুনল না।
সব কাগজপত্র, প্রমাণ দলিল, সবকিছু বিবেচনা করে আদালত তার রায় জানাল। পরীর কাস্টেডি পাবে রিক। তার জন্মদাতা নয়। যেহেতু সব আদির অগোচরে হয়েছে সেহেতু আদিকে এসে দেখে যাওয়ার পারমিশন দেওয়া হলো। কিন্তু নিজের মেয়ে বলে দাবি করতে পারবে না। রিক চাইলে পরী আসা যাওয়া করতে পারবে আদির কাছে। ইশা সেদিন পুরোটা সময় চুপ ছিল। কোনো শব্দ করল না। তার কোনোকিছুই বুঝা গেল না। সে নিস্তেজ চাহনি দিয়ে চেয়ে রইল আদির দিকে। আদি ও সেদিন কোনো উচ্চবাচ্য করল না। কোনো কথা বলল না। শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল পরীর দিকে। পরী হাত তুলে বলেছিল,দিইইই মাববো।
আদি হেসে বলেছিল, মেরেছ তো। আর কত মারবে?
ইশা নিজের চোখের জল লুকিয়ে কোনোমতে বাড়ি ফিরেছিল। মাঝরাতে আদি ফোন দিয়ে উল্টাপাল্টা বলেছিল। ইশা বুঝে গিয়েছে আদি নেশা করেছে। পাগল হয়ে গিয়েছে। আদি বারবার এক কথাই বলে গিয়েছে,
‘ ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর আমি এসেছিলাম তোমার বাসার নিচে। তুমি দেখে ও দেখো নি
আমি ও তোমাকে দেখায়নি। কারণ আইমি বলেছে, তুমি নাকি আমার শুধুই ভালোলাগা ছিলে। ভালোলাগাকে প্রশয় দিতে নেই। আমি ভেবে রেখেছিলাম তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরে দেখলাম না তুমি এখন ও স্টাডিতেই আছ। আমার অবচেতন মন আবার তোমার দিকে ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু বাঁধা দিত মিষ্টির স্মৃতিগুলো। আমি যখন হন্য হয়ে মিষ্টিকে খুঁজছি তখন জানতে পারলাম, তুমি সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিয়েছ।আমার সেদিন কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই কষ্টগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে আবার ও মিষ্টির খোঁজে পাগলপারা হলাম। আর তুমি বলো,আমি নাকি তোমায় খুঁজিনি। আমি তোমাকে খুঁজেছি মিষ্টি। আমার চারপাশে খুঁজেছি। স্বপনে ও খুঁজেছি। কিন্তু তুমি কি বললে?
তুমি কতটা কষ্টে ছিলে ওইদিন আদালতে না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না। আমি স্বীকার করছি আমার দোষ। কিন্তু তুমি তারপর ও ফিরে তাকাচ্ছ না মিষ্টি। আমি হারিয়ে ফেললাম তোমাকে। হারিয়ে ফেললাম নিজের সন্তানকে। নিজের পরিবার আমার শত্রু মিষ্টি। এখানে আমার দোষটা কোথায়? আমি ভালো নেই মিষ্টি। ভালো নেই আমি। আমি অসুস্থ মিষ্টি। আবার কি পাগল হলে তুমি আমার কাছে ফিরবে? আবার পাগল হতে হবে আমায়?
ইশা সেদিন আদির মুখের উপর বলে দিল, আপনি আইমিকে বিয়ে করে নিন। সংসারী হোন। ভালো থাকুন। মিষ্টিকে ভুলে যান। পরীকে ও। পাগলামি আপনাকে মানায় না। আদি সেদিন আওয়াজ করে ডেকেছে,মিষ্টি!
ইশা উত্তর না দিয়ে সেদিন ফোন কেটে দিয়েছে। কেন ডক্টর তাকে ফোন দেয়? সে ফোন দেয় তারপর আইমিকে। অনেক কথা বলার আছে।

_______________

এভাবে চলে যায় বেশ কয়দিন। রিপ আদালতের সব কাজ ছেড়ে এবার একটু জিরোলো। ইশার সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি সে দিয়েছে। কিন্তু আদির তো কোনে দোষ নেই। বেচারা কেন কষ্ট পাবে। সে বলল আমি চলে যাব লন্ডনে।। কিন্তু তার আগে ইশা আফরোজাকে পাঠিয়ে দেব চৌধুরী বাড়িতে। ডক্টর আদি চৌধুরীর কাছে। ইশা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়েছিল রিপের দিকে। তুমি আবার চলে যাবে বলেছ রিপদা?
ইশা দৌড়ে গেল তালহার কাছে। বলল, মামি রিপদার জন্য একটি ভালো পাত্রী আছে আমার কাছে। তুমি কথা বলে দেখতে পারো। তালহা বেগম ছেলেকে নিজের কাছে রাখার এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করল না। কথা বলাবলি হলো নীরার বাবার সাথে। দুপক্ষের মতামত এক হলো। দু পরিবার সিদ্ধান্তে পৌছাল। কিন্তু যেদিন রিপ জানল। সে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো ঘর মাথায় তুলল। লন্ডনে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া করল।
প্রায় সবকিছু ঠিকঠাক। এবার চলে যাওয়ার পালা। আচমকা কোথা থেকে তার পা জড়িয়ে ধরল ইশা। বলল, তুমি চলে গেলে, এই বিয়েটা না করলে আমি কোনোদিন ফিরব না ডক্টরের কাছে। তুমি চলে যাও। আমাকে ও এভাবে রেখে যাও। আমি যেটা বলি সেটাই করে দেখায়।

সেদিন জোরে কষে চড় বসিয়েছিল রিপ ইশার গালে। ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলেছিল,
‘ আমাকে মারার কোনো পথ বাকি রেখেছিস তুই। যাহ চলে যাহ তোর ডক্টরের কাছে, আমি করে নেব বিয়ে। তোকে তো ভালো থাকতে হবে তাই না? তোর ভালো থাকাটা জরুরী। আমার ভালো থাকাটা কোথায় ভেবেছিস কখনো?
ইশা সেদিন রাজী করিয়ে ফেলেছিল রিপকে। রিপ ছুড়ে মেরেছিল তার দিকে ঘৃণার কার্তুজ। ইশা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে রিপের বুকে পড়ে বলেছিল,
‘ নীরা তোমায় ভালোবাসে রিপদা। ভালোবাসার মানে তুমি বুঝো? বুঝে না। কাউকে কখনো ভালোবাসোনি তো তাই এমনটা বলছ। যেদিন ভালোবাসবে নীরাকে,, সেদিন বুঝবে সবটা। সেদিন আমাকে বলতে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব।
রিপ তাকে ধাক্কা মেরে চলে গিয়েছিল। বাইক নিয়ে ছুটে গিয়েছিল ওই দীঘির পাড়ে। পানিতে পা ডুবিয়ে নীরব কান্নায় ভেসে গিয়ে বলেছিল,
‘ আমি ভালোবাসিনি কাউকে তাই না? শুধু তুই ভেসেছিস? তুই জানিস ভালোবাসতে। আর কেউ জানেনা? কি করে বলতে পারলি এত বড় কথা? আমি যে তোকে ভালোবাসি এটা কি কিছুই না। এটা ভালোবাসা নয়?
উল্টাপাল্টা বকে শান্ত হয়ে গিয়েছিল রিপ। নীরার সাথে দেখা করার জন্য বলে নীরাকে ডেকে এনেছিল দীঘির পাড়ে। সোজাসুজি প্রশ্ন করে বসল লজ্জা,আড়ষ্টতায় মুড়ে থাকা নীরাকে,
‘ কাউকে ভালোবেসেছেন কখনো।
‘ জী
‘ কাকে?
‘ যে আমার বর হতে চলেছে তাকে।
নীরার সোজাসুজি উত্তর।
রিপ বলল,
‘ কোনোদিন যদি মনে হয় আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেনা, বিয়েটা করে আপনি ভুল করেছেন, তাকে ভালোবাসাটাই ভুল, সেদিন কি করবেন?

নীরার বোকা মাথায় শুধু ডুকে গিয়েছিল সে ভালোবাসে বৃষ্টিপথিককে। আর কিছু না। তাই সে উত্তর দিয়েছিল,
‘ নাই বা ভাসবে। আমি তো ভাসব। আমার একার ভালোবাসা যথেস্ট।
রিপ ব্যঙ্গ করে হেসেছিল। বলেছিল,
‘ কষ্টটা না পেলে বুঝবেন না কেমন কষ্ট। মুখে মানুষে অনেক কিছু বলতে পারে। একপাক্ষিক ভালোবাসার মতো যন্ত্রণা দ্বিতীয়টাতে নেই।
নীরা কিছুই যেন বুঝল না। কিন্তু একটি জরুরি প্রশ্ন করতে ভুলল না।
‘ আপনি কি কাউকে কখনো ভালোবেসেছেন?
রিপ নড়েচড়ে বলল,
‘ যদি বলি হ্যা তখন কি জিজ্ঞেস করবেন কাকে????
নীরা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেছিল,
‘ উহুম। আমিই আপনার বর্তমান। আপনার ভবিষ্যৎ। আমি থেকে যাব আপনার হয়ে। আপনি না বাসলে ও আমি বাসব।
রিপ চলে যাওয়ার আগে নীরা ডেকে দাঁড় করাল তাকে,
” এডভোকেট সাহেব আমাকে তুমি করে বললে মন্দ হয়না।

_________________

বিয়েটা হয়ে গেল চোখের পলকে। বিয়ের দিন রাতে কোথায় যেন চলে গেল রিপ। কারো ফোন ধরল না। কাউকে কিছু বলল না। মাঝরাতে বাড়ি ফিরল হাতে মদের বোতল নিয়ে। ইশার পায়ের কাছে ধপ করে বসে পড়ে বলেছিল, ইশু তুই যাস না। যাস না। আমার কষ্ট হচ্ছে,কেন হচ্ছে?
ইশা ও সেদিন কেঁদেছিল। বলেছিল, রিপদা তুমি তো প্রত্যেকটা ছেলের জন্য আদর্শ। এ তোমার কেমন আচরণ? আজ নীরা তোমার বউ হয়ে এসেছে, তোমার অপেক্ষায় আছে। আর তুমি?
রিপ সেদিন ঢলে পড়েছিল ইশার কোলে। ইশা ছাড়া বাকি সবাই রিপের এমন অবস্থা দেখে কেঁদেছে লুকিয়ে। ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেল?
নীরা দেখল রিপের পাগলামি। তাহলে কেউ কি ছিল রিপের মনে? আছে? কে সে?
ইশা বিলি কেটে দিয়েছিল রিপের চুলে। রিকের সাহায্যে কোনোমতে শুইয়ে দিয়েছিল বিছানায়।
কিন্তু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তার অন্যরূপ। ইশার হাতের বাহু খামচে ধরে বলল, এই তুই যাচ্ছিস না কেন আদির কাছে? যাবি বলেছিলি না?
ইশা নিজের রুমে দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বলেছিল, আমি যাব না ডক্টরের কাছে, যেতে পারিনা। পারব না। ডক্টরকে আইমির সাথে ভালো থাকতে হবে।
কাঁদতে কাঁদতে আচমকা গায়ে জ্বর অনুভব হলো তার। প্রায় দুদিন পার হয়ে গেলে কমল না তার জ্বর। প্রায় অসুস্থ হতে হতে আবার খানিকটা সুস্থ হলো সে।

পরী সাথে সাথে থাকল নীরার। নীরাকে কিছুক্ষণ ডাকে, বউ। কিছুক্ষণ ডাকে, রাআআ।
নীরা তার বন্ধু হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। ইশা পালিয়ে থাকে রিপের কাছ থেকে। রিপ ও ফিরে না বাড়ি। তার যে বউ আছে তা বোধহয় মনে ও নেই তার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন খান বাড়ি আসে আদি। হাতে পুতুলটি,শাড়ি,বকুল ফুলের মালা। ইশারা হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘ এই নাও তোমার জিনিস। এবার আমারগুলো ফিরিয়ে দাও।
পরী দৌড়ে এল আদিকে দেখে। আদির হাত থেকে নিয়ে নিল পুতুল। সেটিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলল, আমমমমাল।
তারপর বকুল ফুলের মালাটি গলায় দিল। শাড়িটা মাথায় দিয়ে বলল, বউউউ। পরররীইই বউ। ওয়াহ না?
আদি মেঝেতে হাঁটুগেড়ে মেয়ের মুখ ছুয়ে ডাকলল, মা…..
সাথে চোখ টলমল করে উঠল তার। পরীইই তার গালে ঠুস করে চুমু খেয়ে ডাকল, আবববববা।
ইশা মুখ লুকিয়ে কাঁদল।
আদি দাঁড়িয়ে পড়েছে। ইশাকে বলল, আমি যদি আজ পরীকে নিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ইশা দিতে না চাইলে ও রিক এসে দিয়ে দিল। বলল, যত্নে রেখো।
ইশার দিকে তাকিয়ে আদি বলেছিল, তুমি আমার জিনিসগুলো দাও মিষ্টি।
আমি যাই।
নীরা অবাক হয়ে দেখল ইশা আদির কান্ড। নিজের কান, চোখকে তার মিথ্যে মনে হলো।কি আশ্চর্য!
ইশা দৌড়ে তার রুমে গেল। ছেড়া পান্জাবিটি বাড়িয়ে দিল আদির দিকে। আদি আলতোভাবে পান্জাবিটি ছুতে না ছুতেই কাটা কাটা পান্জবীর টুকরোগুলো পড়ল নিচে। সবাই তা অবাক চোখে দেখল। আদি হেসে দিয়েছিল উচ্চস্বরে। হাসতে হাসতে বলেছিল,
‘ বাহ, এতটা ভালোবাসো তুমি আমায়? ধন্য আমি।
আদি চলে গিয়েছিল পরীকে নিয়ে। ইশা পান্জাবীর টুকরোগুলো ছুয়ে ছুয়ে কাঁদল। গলগল করে বমি করল। রক্তবমি। ভেসে গেল সাদা বেসিন রক্তে।
কেউ দেখল না। ইশা দেয়াল ঘষে পড়ে গেল। সেভাবেই পড়ে রইল। নীরা এসে দেখল তাকে ওভাবে পড়ে থাকতে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার আগেই ইশা উঠে গেল। বলল, আমার ভালো লেগেছে তাই মেঝেতে শুয়েছি। এত চিন্তা করোনা তো।
আদি সারাদিন ঘুরল মেয়েকে নিয়ে। সন্ধ্যার আগে দিয়ে গেল পরীকে। পরী বেজায় খুশি।

_______________

দিনশেষে রাত নেমে আসে। চাঁদের আবছা আবছা জ্যোৎস্না ডুকে নীরার সাজানো ছোট্ট ঘরটায়। ঘরটা পরিপূর্ণ সবকিছু দিয়ে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আসেনা। কি আশ্চর্য! কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। রিপ কাজের ব্যস্ততা দেখায় নীরাকে। দুটো ভালোমন্দ কথা ও বলেনা নীরার সাথে। অভিমানে নীরার চোখ গলে পানি বেরিয়ে আসে। তার রাতগুলো কাটেনা। কয়েকদিন পর রিপ আসে। কিন্তু ফিরে ও দেখে না নীরাকে। নীরা তার মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে কতকিছু করে। নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে কতভাবে। কিন্তু রিপ চোখতুলে ও তাকায় না। নীরা কাঁদে হু হু করে। সেই কান্না পৌঁছায় না রিপের কান অব্ধি। রিপ শোনেনা। এভাবে পার হয় রাতগুলো অভিমানে,অবহেলায়। দুজন দুদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে বিসর্জন দেয় চোখের জল। একজন না পাওয়ার যন্ত্রণায়,অন্যজন পেয়ে ও অবহেলায়। নীরা জোর করে পাওয়ার চেষ্টা করে রিপের মনোযোগ, রিপের একটুখানি ভালোবাসার স্পর্শ। কিন্তু রিপের মুখ বেরিয়ে আসে তিক্ত কথা, নির্লজ্জ!
নীরা কাঁদে মুখে শাড়ির আঁচল গুজে। রিপের বুকে পড়ে বিসর্জন দেয় নোনা জল। সেই জল স্পর্শ করতে পারেনা রিপের প্রেমিক স্বত্বাকে। নীরার মন কাঁদে। তাহলে এই হৃদয়টা তার জন্য নয়। কার জন্য?
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে রিপ ধড়ফরিয়ে উঠে বসতে চাইলে ও পারেনা। নিজের বুকের উপর মাথা রেখে শোয়া মেয়েটিকে দেখে সে অবাক হয়। কি আশ্চর্য! মেয়েটি চাইছেটা কি?
রিপের নড়াচড়া দেখে নীরা আর ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। ছাড়েনা। রিপ শক্ত গলায় বলে,
‘ ছাড়ো নীরা।
নীরা তারপরে ও ছাড়ল না। মাথা তুলে আচমকা স্পর্শ করল রিপের ওষ্ঠদ্বয়। যেন তৃষ্ণায় খাঁ খাঁ করা হৃদয়ের জমিনে একটু বৃষ্টি নামল। নীরা খুব করে কাছে চাইল রিপকে। কিন্তু রিপ সাড়া দিল না। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল নীরাকে। চলে যেতে যেতে উচ্চারণ করল, ছিঃ…..
সেই রাতটা আর হয়ে উঠল না মধুময়। মন কেমনের রাতটা আর রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল না।

_________________

কলেজ থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোনো ইশার নাকে রুমাল শুকিয়ে অজ্ঞান করে গাড়িতে তুলল আদি। প্রায় সন্ধ্যা নামার কিছু আগেই জ্ঞান ফিরল ইশার। নিজের পড়নে দেখতে পেল শাড়ি। আশেপাশে চোখ বুলাতেই খেয়াল হলো সে জীবনে ও দেখেনি এই বাড়িটা। সে দরজা ঠেলে নিচে নেমে আসল। আদিকে দেখল রান্নাঘরে। পড়নে তার সাদা পান্জাবী। ঠিক আগের মতো। আগের ডাক্তার। ইশা রেগেমেগে তেড়ে গেল তারদিকে। বলল, আমি এখানে কেন? আপনি আমাকে ছুঁয়েছেন। আমাকে চেন্জ? এটা কারর বাড়ি?

আদির সহজ সরল জবাব, আমি তোমার স্বামী। এ বাড়িটা তোমার আমার।
ইশা আদির হাতের বাটি ছুড়ে ফেলল দূরে। বলল, আমি মানি না। আপনি আমাকে ছুঁয়েছেন কোন সাহসে? আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আদি একটু ও রাগ করল না। শান্ত গলায় বলল, আমি মানি না। আমি সাইন করিনি। তুমি আমার বউ। তোমাকে ছোঁয়ার পুরোপুরি রাইট আছে আমার।
ইশা অন্যকিছু খুঁজল ছুড়ে মারার জন্য। আদি ছুটে এল তার কাছে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ইশাকে। ইশা কাঁপতে কাঁপতে শান্ত হয়ে গেল। ঢলে পড়ল আদির বুকে। আদি কোলে তুলে নিল। ব্যঙ্গ করে বলল, কোলে চড়ার শখ হয়েছে, সেটা বললেই পারতে।
ইশা তার হাত ছুড়ে আদির দিকে। আদি কিচ্ছু বলেনা। ইশাকে নিয়ে চলে আসে বাইরে। তখন সন্ধ্যা নেমে আবছা আবছা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ।
ইশা আদির কোলে থাকা অবস্থায় চেঁচায়। ছাড়ুন আমায়। আমি আপনার মতো বেয়াদব লোক দুটো দেখিনি।
আদি হাসতে হাসতে চেয়ে থাকে ইশার মুখপানে। বসিয়ে দেয় বাইরে লনের উপর। নিজে ও বসে পড়ে। ইশা অবাক হয়। এখানে কেন?
আদি হেসে বলল, কেন বাসর ঘরে বসার কথা ছিল?
ইশা রেগে ফুলে ফেঁপে উঠে। আদি তার রাগ দেখে হাসে আজ। চট করে শুয়ে পড়ে ইশার কোলে। চাঁদের একটুকরো আলো আলোকিত করল দুজনের মুখখানা। ইশা চমকাল। কি করছেন? উঠুন। আমাকে সবাই খুঁজবে।
আদি বলল, আমি বলে এসেছি সবাইকে।কেউ খুঁজবে না।
ইশা আর ও অজুহাত দেখাতে চাইল কিন্তু দেখাতে পারল না। আদি চেপে গেল ইশার দিকে। জড়িয়ে ধরল ইশার কোমর। মুখ গুজে দিল। ইশা কেঁপে উঠল। বলল, ছাড়ুন।
আদি ছাড়ল না। কিছুক্ষণ পর জ্বলজ্বল চোখ নিয়ে মুখ তুলে তাকাল ইশার দিকে। বলল, আমার মিষ্টিকে চাই। খুব করে চাই। পরীর মাকে চাই। পরীর মা কি আমার হবে আবার?
ইশা মুখ অন্যদিকে করে নিল। আদি তার হাত দিয়ে মুখ ফিরিয়ে টেনে আনল তার দিকে। মিষ্টির ঠোঁটের কোণায় গাঢ় চুম্বন করে বলল, আই লাভ ইউ মিষ্টি। আই ওয়ান্ট ইউ। ফর দ্য হোল লাইফ। প্লিজ মিষ্টি। প্লিজ। ফিরে এসো। আমি নিঃস্ব তুমি ছাড়া।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here