মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_১৯ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১৯
#মৌরিন_আহমেদ

“শহরের প্রতিটা কোণায়,
চেনা অচেনা হাজার লোকের ভীড়ে,
এ দু’চোখ শুধু তাহাকেই খুঁজে ফিরে~”

[ শব্দগুচ্ছ: মৌরিন আহমেদ ]

অনন্যার আরও ক’টা দিন কেটে যায় ধ্রুবের বিরহে। ওকে খুঁজে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা চালায় অনন্যা। সাহস করে ওই বিল্ডিংয়েও যায়। সেখানে গিয়ে আরেক বিপাকে পড়ে ও। প্রতিটা তলায় তিন ইউনিট করে বিল্ডিংয়ে মোট আঠারোটা ফ্ল্যাট আছে। এর মধ্যে কোন ফ্ল্যাটে ধ্রুব থাকে সেটা তো জানে না সে। তবুও চেষ্টা করেকরে তে তলা পর্যন্ত খোঁজ নেয়। তৃতীয় তলাতেই বাড়ির মালিক থাকেন। তার কাছে জিজ্ঞেসও করে ধ্রুবের কথা। এখানে এসেই সবচেয়ে হতাশা জনক খবরটা জানতে পারে ও। ভাড়াটিয়া লিস্টে ধ্রুব নামে নাকি কেউ নেই! কখনো ছিলও না!

কথাটা অনু বিশ্বাস করতে পারে না। বাড়ি ওয়ালাকে বারবার অনুরোধ করে ভালো করে দেখতে। ওর অনুরোধ ফেলেন না উনি। বারংবার চেক করে দেখেন। কিন্তু কোনো লাভ হয় না! ভাড়াটিয়া লিস্টে ধ্রুব বলে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না!

– অনু রে, হিমু তোকে ধোঁকা দিয়েছে!

মন খারাপের গলায় কথাটা বলে ওঠে কানিজ। পাশে তাকিয়ে দেখে অনন্যা মাথা নিচু করে আছে। ওর চোখের পাপড়িগুলো কেমন চিকচিক করছে, ভিজে গেছে জলে। ও বুঝতে পারে অনন্যার মনের অবস্থা। মেয়েটা কাঁদছে! কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলে। ধ্রুবকে খোঁজার চেষ্টা তো ওও করেছে! সত্যিই ছেলেটা এভাবে গায়েব হয়ে যাবে ভাবতে পারে নি!

অনন্যা বাঁ হাতে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো মুছে নেয়। একবার নাক টেনে বলে,

– ধ্রুব সাহেব আমাকে মিথ্যে বলেছেন। ওনার মাম নিশ্চয় ধ্রুব ছিল না!

বলেই আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বহু কষ্টে আটকে ফেলা। চোখের জলের বাঁধ ভেঙে যায়। অশ্রুর ঢল নেমেছে নেত্রকোণে!

– অনু, চোখ মোছ প্লিজ! দারোয়ান কাকু তোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে সন্দেহ করবে! প্লিজ, চোখ মুছে ফেল!

কানিজের কথা অনুযায়ী চোখ মুছে ফেলে দ্রুত। শুধু হাতে কাজ হচ্ছে না দেখে চোখে ওড়না চাপা দেয়। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের দূর্বলতার কথা কারো কাছে স্বীকার না করতে।
___________________

বেল টিপে বাড়ীওয়ালার ফ্ল্যাটের সামনে দাড়িয়ে আছেন করিম চাচা। উদ্দেশ্য বাড়ীওয়ালার সাথে দেখা করে কিছু কথা বলা। দু’ বার বার বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন বাড়িওয়ালা স্বয়ং!

ফজল সাহেব। মোটাসোটা একজন ভদ্রলোক। এই বিল্ডিংয়ের মালিক তিনি। তাকে দেখে আন্দাজই করা যায় না মানুষের সাথে কতোটা নরম সুরে কথা বলেন উনি। একটু আগেই দুটো মেয়ে এসেছিল এখানে। “ধ্রুব” নামের কাউকে খুঁজতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। কারণ এ নামে এখানে কেউ থাকে না কেউ!

এবার দেখা যাচ্ছে একজন ভাড়াটিয়াকে। উনি পাঁচতলায় ভাড়া নিয়েছেন। দরজা খুলেই নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বললেন,

– কী চাই?

– জ্বি, আপনার এ মাসের ভাড়াটা দিতে আইলাম। আমরা এ মাসেই বাসা ছাইড়া দিবো।…

– বাসা ছেড়ে দেবেন? কেন?

হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে নিতে প্রশ্ন করলেন বাড়িওয়ালা। করিম চাচা সহজ উত্তর,

– এই এলাকায় আর থাকবো না তাই!

– ওহ্, আচ্ছা।

– ঠিক আছে।..

বলেই চলে যেতে উদ্যত হলেন চাচা। ফজল সাহেবও দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ কি যেন একটা মনে হতেই লাগানো দরজা খুলে ফেললেন। মুখ বের করে ডাক দিলেন,

– করিম সাহেব!

– জ্বে।

সিঁড়িতে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন করিম চাচা। নিচের ধাপে ফিরে এসে বললেন,

– কোন দরকার হইছে?.. আমারে ফিইরা ডাকলেন যে..

বাড়ীওয়ালা ভদ্রলোকের মধ্যে এবার কেন যেন অস্বস্তি ভাব প্রকাশ পেল। ইতস্তত করে বললেন,

– মানে… আপনার সাথে যে লোকটা থাকে, উনি কে হন আপনার? আপনার ছেলে?

এক মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবলেন চাচা। হয় তো ভদ্রলোকের প্রশ্ন বুঝতে পারেন নি। তারপর একসময় খানিকটা হেসে উত্তর দিলেন,

– কে, সাহেব? উনি তো আমার স্যার। আমিই ওনার বাসার কেয়ারটেকার। ওনার বদলি হইয়া গেছে দেইখাই তো বাসা ছাইড়া দিলাম।…

– ওনার নামটা কী?

– ধ্রুব।

“ধ্রুব” নামটা শুনেই চমকালেন ফজল সাহেব। এই নামেরই তো খোঁজ করছিল মেয়ে দু’টো! আশ্চর্য! ওনার বাড়িতে কে কে থাকেন এর তো দেখা যায় সঠিক তথ্যই নেই তার কাছে। যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে তার নাম না তুলে, উনি তুলেছেন কেয়ারটেকারের নাম! কী একটা অবস্থা! ইসস! ছেলেটার কোন খোঁজ না পেয়ে মেয়ে দুটো যে মন খারাপ করেছিল, সেটা তিনি ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন। একটা মেয়ে তো আবেগে কেঁদেই ফেললো! নিশ্চয় ছেলেটাকে কোন দরকার ছিল ওদের!

– কেন কিছু হইছে?

করিম চাচার কথায় ধ্যান ভাঙে ওনার। থতমত খেয়ে বললেন,

– না.. না.. কিছু না।.. এমনি…

– ঠিক আছে। আমি যাই তাহলে?

– হ্যাঁ, যান…

অনুমতি নিয়ে প্রস্থান করেন করিম চাচা।
_______________________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে অনন্যা। খোলা জানালায় তার নির্নিমেষ দৃষ্টি। বাইরে থেকে আসা শীতল হাওয়ায় শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে খোলা চুল তীব্রবেগে মুখে আঁচড়ে পড়ছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। কেমন একটা উদাসী উদাসী ভাব!

ওর ঠিক পাশেই চিন্তিত মুখে বসে আছে কানিজ। চিন্তার তালে তালে অনবরত বাঁ হাতের নখ খুঁটে খাচ্ছে। ওরা দু’ জনেই এই মুহূর্তে ধ্রুবকে নিয়ে চিন্তা করছে। কিন্তু শেষমেষ কেউই কিছু ভেবে উঠতে পারছে না!

ধ্রুবের এমন হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না অনন্যা। কানিজ যদিও প্রথমে খুশিই হয়েছিল তবুও এখন অনন্যার কথা ভেবে মন খারাপ হচ্ছে। ছেলেটা এমন না করলেও পারতো!
__________________________

গভীর রাত। চারিদিকে নিঝুম, নিস্তব্ধতা বিরাজমান! অন্ধকার ঘরে একা একা বসে আছে কেউ। রকিং চেয়ারের উপর এলিয়ে দেয়া তার শরীর বার বার দুলে উঠছে। দু’ হাত একত্র করে চেয়ারের উপর রাখা। চেয়ারের দুলুনিতে সমান তালে কী যেন ভাবছে তার মস্তিষ্ক। দূর থেকে আসা রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের। টিমটিমে আলো ঘরে প্রবেশ করছে। ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকছে হিমেল হাওয়া। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলা গাড়িগুলোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো গাড়ি জোরে জোরে হর্ন বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। তাদের প্যা পো শব্দ কানে লাগছে খুব!

হঠাৎ করে চেয়ারের দুলুনি বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ারে এলিয়ে রাখা মাথাটা চট করে উঠে এলো। কিছু বুঝে ওঠার সময় নেই, তার আগেই পেছনে থাকা ব্যক্তিটির উদ্যত হাত সবেগে ধরে ফেললো। মুহূর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক লোকটার মুখ দেখে নিলো। আলো-আঁধারিতে চেহারা স্পষ্ট নয়। তবে তার হাতে থাকা চকচকে ধাতুর ছুরিটা বেশ স্পষ্ট! ল্যাম্প পোস্টের আলোয় সেটা ঝিলিক দিয়ে উঠছে!

হঠাৎই আক্রমনকারী তার অন্য হাতে কিছু একটা তুলে নিয়ে মারতে উদ্যত হয় ওকে। ব্যাপারটা বোধ গম্য হতেই নিজের অন্য হাতটাও ছুটিয়ে আনে ধ্রুব। দু’ হাতে লোকটার হাত দুটোকে ধরে একপাক ঘুরিয়ে সজোরে ছুড়ে দেয় ঘরের অন্য প্রান্তে!

ব্যক্তিটি ছিটকে গিয়ে বারি খায় বিছানার রেলিংয়ের সাথে। থুতনি কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। কিন্তু সেদিকে পাত্তা দেয় না সে। উঠে দাড়িয়ে টি টেবিলের ওপর ফ্লাওয়ার ভ্যাস টা তুলে আবারও মারতে আসে ধ্রুবকে। ধ্রুবও ছাড় দেয় না! লোকটার ডান হাতে একটা বারি দিলে তার হাতের ভ্যাসটা উড়ে যায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্য হাত দিয়ে লোকটার শার্টের কলার চেপে ধরে। ভ্যাস টা উড়ে গিয়ে সশব্দে টি টেবিলের উপর পড়ে। সেখানকার উপরের কাঁচটা তখন রিনরিনে আওয়াজে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়!

কাঁচ ভাঙার আওয়াজ কানে যেতেই একবার সেদিকে দৃষ্টি ফেরায় ধ্রুব। কিন্তু আর সময় নেয় না। চোখ ফিরিয়েই এক হাতে মুষ্ঠি পাকিয়ে বাগিয়ে দেয় লোকটার দিকে। প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে আবারও ছিটকে পড়ে লোকটা। কিন্তু এবার আর উঠে আসার সুযোগ পায় না। ধ্রুব ছুটে গিয়ে আরো কয়টা এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মারে। তারপর কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে দাড় করায়। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

– বল্, কে পাঠিয়েছে তোকে? কার কথায় এসেছিস এখানে?

আলো আঁধারের মাঝে হঠাৎ ধ্রুবের চেহারাটা দেখেই চমকে ওঠে লোকটা। সামনে দাড়ানো ব্যক্তিটির কী ভয়াবহ রূপ! রাগে কটমট করা গাল দু’ টোতে শক্ত করা চোয়ালের হাড় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে! অগ্নিঝরা চোখ দু’ টোতে শুধু হিংস্রতাই বিদ্যমান। লোকটা হালকা পাতলা গড়নের হলেও গায়ে তার অশুরের শক্তি! নাকে মুখে যে কয়েকটা ঘুষি মেরেছে তাতেই তার গালটা তুবড়ে গেছে!

লোকটা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়েই রইলো। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না। এতক্ষণে বেশ বুঝতে পারছে ‘বস’ কেন তাকে এই লোকটাকে মারার জন্য এতো টাকা অফার করেছিল! সে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে, এ লোক কোন সাধারণ লোক না। পুরোপুরি মিলিটারি ট্রেইন্ড পার্সন!

– বল্, কে পাঠিয়েছে তোকে?

লোকটার কলার ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করে ধ্রুব। কিন্তু কোন উত্তর পায় না। দুবার ঝাঁকাতেই খেয়াল করলো লোকটার শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে! চোখ মুখ কেমন টলটলে লাগছে।

একমুহুর্ত নির্বাক তাকিয়ে থাকে ধ্রুব। তারপর মড়া লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে যায়। নিজের রাগ আর ক্ষোভ দমনের জন্য চুলের ভেতর হাত চালিয়ে দেয়। বাঁ হাতে নিজেই নিজের চুল খামচে ধরে বিড়বিড় করে বললো,

– শীট্! এদের কাছে যে পটাশিয়াম সায়নাইড থাকে এটা ভুললাম কি করে? ওহ্ নো!..

#চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here