মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_২৪ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২৪
#মৌরিন_আহমেদ

গভীর রাত। চারদিকে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঝিঁঝিঁ ডাক শোনা যাচ্ছে। কাছে পিঠে কোথাও আস্তানা গেড়েছে সেটা। জানালা দিয়ে ল্যাম্প পোস্টের আলো এসে পড়েছে বিছানায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে গ্রীলের ছায়া ফেলেছে সেখানে। আলোটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনন্যা। তিরতির করে ঘড়ির কাঁটায় সময় চলে যাচ্ছে। তবুও চোখের তারায় ঘুম নেই ওর। একটু পর পর পাশ বদলাচ্ছে। অক্ষিগোলকের মণিটা পুরো ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। মস্তিষ্কের ভেতর জাল বুনছে মাকড়সা। তবে সেটা নিজের ভেতরে জমানো আঠালো রস দিয়ে নয়, ধ্রুবকে নিয়ে অজানা বিনুনির জাল। রহস্যের জাল!

ওকে নিয়ে সব জল্পনা কল্পনা গুলোই তো দু চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ওর। চাইলেও আর দুচোখের পাতা এক করতে পারে না! রহস্যময় সেই ছেলেটা ওর ভেতরটা ছারখার করে দিয়েছে! ওর হৃদয়, মন ছুঁয়ে দিয়েছে। ওর বুকের ভেতর জমানো অসীম প্রেম নিয়ে গেছে কিন্তু তার ঠিকানা দিয়ে যায় নি!

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে অনন্যা। ল্যাম্প পোস্টের ঝুলন্ত তারগুলো সব সার বেঁধে আছে। এরমাঝে একটা তারে বসে আছে দুটো ফিঙে পাখি। কুচকুচে কালো তাদের শরীর। শুধু লম্বা লম্বা কালো মশমশে লেজ দুটোই আলাদা বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে তাদের। পাখি দুটো ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে কী যেন করছে। মনে হচ্ছে, সুনসান এ এলাকায় তারে বসে একজোড়া প্রেমিক জুটি চুটিয়ে প্রেম করছে। কী সাবলীল তাদের ভঙ্গি! অনু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। ইনসোমনিয়ার বেদনা সে ভুলে গেছে।

-‘ ধুপ!’

হঠাৎ কি যেন পড়ার শব্দ হলো। ভারী কিছু মেঝেতে পরেছে। কিন্তু কী? অনন্যা চকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। ব্যালকনির দরজাটা ‘হা’ করা। ঝুলন্ত পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে। তার ফাঁক দিয়ে ব্যালকনিতে সোজা দৃষ্টি গেল ওর। একটা কালো অবয়ব দাড়িয়ে আছে। কালো প্যান্ট, কালো হুডি, সর্বাঙ্গই কালোর আস্তরণে মোড়ানো! হুডি দিয়ে মাথা আর মুখের অর্ধেকটাই ঢাকা। চোখে কালো সানগ্লাস আর তার নিচে নিনজা মাস্কে মুখটা ঢাকা। অজানা ব্যক্তিটি ধীর পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে আসে।…

অনন্যা লাফ দিয়ে উঠে বসে। ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে! কে এই লোকটা? কেন আসছে এইদিকে? ভয় পেয়ে ঢোক গিলতে শুরু করে। চিৎকার করার চেষ্টা করে। কিন্তু আশ্চর্য! গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না! ও বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

লোকটা আরও এগিয়ে আসছে। ওর রুমে, ওর বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। কালো হ্যান্ড গ্লাভস পরা হাতটা মুখের কাছে তোলে। দৃশ্যমান ধবধবে ফর্সা আঙুলের ছোঁয়ায় সানগ্লাসটা খুলে রাখে। তার সুন্দর দৃশ্যমান দুটি চোখ দৃশ্যমান হয় অনন্যার কাছে। ও কেমন করে যেন তাকায়। এ চোখ তার পরিচিত, ভীষণ পরিচিত!

ধীরে ধীরে লোকটা নিজের মাস্কটাও খুলে ফেলে। মাস্কের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো তার ঝলমলে সাদা দাঁতগুলো! অনেকদিন পর ওর এই হাসি প্রত্যক্ষ করলো অনন্যা। এটা সেই হাসি যে হাসি দেখেই সে মুগ্ধ হয়ে যেত! গুলিয়ে ফেলতো নিজের সাজানো কথামালা।
সে মিষ্টি করে হেসে বললো,

– ভয় পেয়েছিলে নাকি, অনন্যা?

কী বলবে ভেবে পায় না ও। বুকের ভেতরে নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে। হৃদস্পন্দন থেমে গিয়ে হার্ট এ্যাটাকের মতো লাগে ওর কাছে। রুদ্ধ শ্বাসে কোনমতে বললো,

– আপনি?

– আমিই তো!.. আমি ছাড়া এতরাতে কে আসবে?.. আর প্রায় রাতেই তো আমি আপনার ঘরে আসি.. কেন, জানেন না বুঝি?

বলে আবারও হাসে। ও মুগ্ধময় দৃষ্টিতে তার হাসিটা দেখে। বুকের ভেতর তার একরাশ অভিমান জমে ছিল। এখন তা নেই। তার হৃদয় জুড়ানো হাসি দেখেই সব অভিমান-অভিযোগেরা দল বেঁধে পালিয়ে গেছে। ও অবাক কন্ঠে বললো,

– কই আমি দেখি নি তো!… আমি তো রোজই জেগে থাকি আপনি তো আসেন নি!… আমায় মিথ্যে বলছেন?

– মিথ্যে কেন বলবো? আমি প্রায়ই আসি। তবে দেরি করে। আপনি ঘুমান না বলেই তো দেরি হয়ে যায়… আচ্ছা, সরুন দেখি। আমি একটু বসবো।

বলেই অনন্যার পাশে জায়গা করে নেয় ধ্রুব। ও এখনো বিস্ময়ের রেশ কাটাতে পারে নি। ধ্রুব হঠাৎ করে কেন, কীভাবে এলো, পুরোটাই মাথার উপর দিয়ে গেছে ওর।

– আপনি আমার ওপর অভিমান করেছিলেন? রাগ হয়েছিলেন?

– নেই কেন?

– এই যে, আপনি চলে এলেন, তাই! আচ্ছা, আপনি হঠাৎ করে চলে গেলেন কেন? জানেন, আমি আপনাকে কতো খুঁজেছি?

– কেন খুঁজেছেন? কোনো দরকার ছিল? কিছু বলবেন?

– বলবোই তো।

বলেই লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নেয়। ধ্রুব বিস্ময়ে বললো,

– কী?

– ভালোবাসি!

– জ্বি?

– বলেছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি!

– তাই?

অনন্যার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায় ধ্রুব। ও কী করবে ভেবে পায় না। মৃদু কন্ঠে ‘হুম’ বলেই জড়িয়ে ধরে ওকে। এ তার কতো অপেক্ষার পর প্রাপ্ত! কতো প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ! তার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া এই ছেলেটাকে তার নিজের করে পাওয়া। শুধুই তার ব্যক্তিগত করে!
ছেলেটা হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে। আবার ফিরে এসেছে। এখন ও আর কখনোই ওকে যেতে দেবে না। কিছুতেই না। ভেবেই আরও বেশি আঁকড়ে ধরলো ওকে।

কিন্তু হঠাৎ কি হলো ঠিক বোঝা গেল না। ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেল ধ্রুব নামের ছেলেটা। অনন্যা হকচকিয়ে চারপাশে তাকালো। দুর্বল কণ্ঠে ডাক দিল,

– ধ্রুব?

নিজের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তার কানে। উত্তেজিত হয়ে আবারও অন্ধকারে ডাক ছোঁড়ে,

– ধ্রুব সাহেব, কোথায় আপনি?

হঠাৎ নিজেকে পাগল পাগল মনে হয় ওর কাছে। টান দিয়ে গা থেকে কাঁথাটা ফেলে দেয়। তড়িঘড়ি করে খাট থেকে নেমে দাড়ায়। চারপাশে দৃষ্টি ফেলে আবারও ডাকে,

– আপনি কোথায়? প্লিজ, আমার সামনে আসুন!

ও দৌড়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজায় এসে দাড়ায়। পুরো ব্যালকনিটা ভালো করে দেখে। একদম নিচ পর্যন্ত চেক করে। কোথাও কেউ নেই! বৃথা জেনেও শেষবারের মতো বলে,

– ধ্রুব সাহেব!.. কোথায় হারিয়ে গেলেন? আপনি জানেন না, আমি আপনার অপেক্ষায় থাকি? জানেন না, আমার মন ছুঁয়েছেন আপনি?
________________________

চিফ স্যারের কেবিনে বসে আছে বর্ষণ। পাশেই প্রদোষ। আর তাদের ঠিক সামনে চিফ স্যার। ছিমছাম পরিবেশের ঠাণ্ডা একটা ঘর। সাদা টাইলসে মেঝে ঢাকা। দেয়ালে আঁকা হালকা আকাশী রঙের পেইন্ট। সে রং এতোই হালকা যে সাদার সঙ্গেই যেন মিলিয়ে গেছে বলে মনে হয়। রুমে একটি মাত্র জানালা কিন্তু সেও সারাজীবন পর্দার আড়ালেই আবৃত থাকে। চিফ স্যার থমথমে মুখ করে একটা ফাইলে চোখ বুলাচ্ছেন। ফাইলটা প্রদোষের করা। বহুত খাটাখাটনি করে বেচারা এই ফাইলটা বানিয়েছে। আর এখন এটা সাইন করাতে এনেছে চিফ স্যারের কাছে।

চিফ মহাশয় গভীর মনোযোগ দিয়ে সে ফাইলখানা চেক করছেন আর মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছেন প্রদোষের দিকে। প্রদোষ ভীত চাহনিতে নতমুখে বসে আছে। বর্ষণের অবশ্য ভাবনা চিন্তা নেই। সে বেশ আরামপ্রিয় ভঙ্গিতে বসে বসে চিফ স্যার আর প্রদোষের মুখখানা পর্যবেক্ষণ করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর ফাইলটায় সাইন করলেন স্যার। সেটা প্রদোষের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন,

– সাত দিনের পানিশমেন্টের পরও প্রদোষ সাহেবের ভুঁড়ি কমেনি দেখছি!

কথাটা যে ব্যাঙ্গাত্মক সেটা বলাই বাহুল্য। বর্ষণ সে কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। আর প্রদোষ কিছুটা লজ্জায় পরে গিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। বিনীত গলায় বললো,

– কী করবো, স্যার!.. খেতে যে এতো ভালো লাগে!

– কিন্তু খেতে খেতে ফুটবল হয়ে গেলেও তো সমস্যা!.. চাকরি-বাকরি করে খাবেন কী করে?

স্যারের কথার সূক্ষ্ম খোঁচাটা ঠিক ধরতে পারে প্রদোষ। এই স্যার টা এমন হেসে হেসেই খোঁচা মারেন! আবার কখনও ডিরেক্ট অ্যাকশনে গিয়েও বাঁশ দেয়! তাই সাবধানে থাকতে হয় সবসময়। ফাইলের কাজ যেহেতু শেষ তাই চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলো। উঠতে উঠতে বললো,

– আমি তাহলে আসি, স্যার?

– আমি কী আপনাকে আসতে বলেছি?

কেমন একটা হাসি দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন স্যার। প্রদোষ তার ফাটা বেলুনের মতো মুখ নিয়ে বললো,

– জ্বি না।

– তাহলে বসুন।

প্রদোষ বিরস মুখে বসে পড়ে। উনি এবারে বর্ষণের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– মি. রাইয়ান আমি এবং আমার পুরো টিম আপনার সাম্প্রতিক কালের কাজটার জন্য খুবই আনন্দিত। এতো বড় একটা মাদক চক্রকে আপনি ধরিয়ে দিয়েছেন, সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার!

– Thank you, sir!

কৃতজ্ঞ চিত্তে মাথা নাড়ে সে। উনি আবারও বললেন,

– আপনার জন্য নতুন সেক্টর ঠিক করা হয়েছে…. প্রজেক্ট খাগড়াছড়ি। ডিটেইলস সবকিছু প্রদোষ সাহেবের এই ফাইলটাতেই আছে।.. আমি চাই দু’ একদিনের মধ্যেই আপনি আর প্রদোষ সাহেব খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরুন।.. যত তাড়াতাড়ি যাবেন, ততো তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারবেন।

– ঠিক আছে, স্যার। আমরা তাহলে পরশুই চলে যাবো!

বলেই সম্মতির জন্য প্রদোষের দিকে তাকায়। সেও মাথা নেড়ে সায় জানায়,

– হুম। যাবো।

– ok! তাহলে যান!

এরপর একসাথেই রুম থেকে বেরিয়ে আসে বর্ষণ আর প্রদোষ।

#চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here