মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_২৫ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২৫
#মৌরিন_আহমেদ

– এইসব তুই কী বলছিস অনু? ধ্রুব এসেছিল?

কানিজ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অনন্যাকে মাথা নেড়ে সলজ্জ হাসতে দেখা যায়। তাতেই যা বোঝার বুঝে ফেলে কানিজ। অবাক হয়ে বললো,

– এটা কি করে সম্ভব!.. ও তো এখানে নেই, ঢাকায় চলে গেছে!

– গিয়েছিল কিন্তু এসেছে। জানিস, উনি আমায় কাল কী বললেন?

বলতে বলতেই লজ্জায় নুইয়ে পড়ে অনন্যা। কানিজ ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে বলে,

– কী বলেছে?

– বলেছেন উনি নাকি রাতে আমাদের বাসায় আসেন। প্রায়ই আসেন। আমি ঘুমিয়ে গেলেই একবার এসে দেখে যায়!…

– কী সব উল্টা পাল্টা বকছিস তুই? ওই ছেলে তো বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে। ও কী করে তোর কাছে আসবে?.. তুই কী পাগল হয়ে গেছিস?

– তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না, কানিজ! সে এখন কোথায় আছে সেটা বড় কথা না… বড় কথা হচ্ছে, সে রাতে কোথায় থাকবে। কাকে দেখতে আসবে!..

কিছুটা যুক্তি খাটানোর চেষ্টা করে। হঠাৎ লজ্জাবতী লতিকার মতোন লজ্জায় নুইয়ে গিয়ে বললো,

– তুই ভাবতে পারছিস, কানিজ… ছেলেটা আমার জন্য কোথায় না কোথায় ঘুরে-টুরে রাতের বেলা পাঁচতলার ব্যালকনি টপকায়।… কতো রিস্কি কাজ তাও করে, কেন করে? শুধু ভালোবাসে বলে….

বলেই উজ্জ্বল চোখে তাকায় ওর দিকে। কানিজ কেমন বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টিকে পাত্তা দেয় না সে। লাফ দিয়ে পিলারের উপর থেকে নামে। দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে ছাদের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাড়ায়। গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে পাগলের মতো হাসতে শুরু করে। আকাশের দিকে তাকিয়ে খুশিতে উল্লসিত কণ্ঠে বললো,

– আমি জিতে গেছি কানিজ! আমি জিতে গেছি!.. ধ্রুব সাহেবের মন আমি ছুঁয়ে ফেলেছি! সেও আমায় ভালোবাসে।… আজ আমি অনেক খুশি, অনেক!

অনন্যা সোল্লাসে লাফাতে থাকে। কিন্তু কানিজ খুশি হতে পারে না। ও বুঝতে পারে অনন্যার মানসিক অবস্থা। ধ্রুবকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলেই ও এমন ভুলভাল বকছে! প্রিয় বন্ধুর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি দেখে ভীষণ মন খারাপ হয় ওর। মেয়েটার ভালোবাসা যে কত গভীর সেটা বুঝতে পারে। ইসস্! কী ক্ষতি হতো ধ্রুব ছেলেটা থেকে গেলে? এতো ভালোবাসা, এতো গভীর প্রেম ও আর কোথায় পাবে? যে রত্ন সে হারিয়েছে তা কী কখনো ফিরে পাবে সে?

দুজনে ছাদ থেকে নেমে ফ্ল্যাটে ঢোকে। ড্রইং রুমে বসে কথা বলছেন জোহরা বেগম আর ওর ফুপি লতা। আজকাল এ বাসায় নিয়মিত আসেন উনি। অনন্যার মা জোহরা বেগম কে নাকি তার ভীষণ ভালো লেগেছে। মহিলার সরলতা তাকে মুগ্ধ করেছে। আর তাছাড়া তিনি যেমন সুদক্ষ গৃহিণী তেমনই গল্পের আসর জমাতেও পটু। তার সাথে কথা বলে বেশ মজা। এতো মজার মহিলা অথচ তার দিন কাটে একা একা, নিঃসঙ্গ। বাড়ির সবাই যে যার মতো ব্যস্ত, ওনাকে সময় দেয়ার কেউ নেই। তাছাড়া মহিলা যত সুন্দর বাংলা বলেন আর ওকে বাঙালিয়ানা সংস্কৃতির যত সব মজার মজার জিনিস দেখান তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয় সে। প্রায় প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের, স্বাদের বাঙালি খাবার খাওয়ান। তার হাতের রান্না চমৎকার!

ফ্ল্যাটে ঢুকেই নিজের ঘরে চলে যায় অনন্যা। আর কানিজ এসে বসে সোফায় ওদের সঙ্গে। নিজের ফুপিনের উদ্দেশ্যে বললো,

– তা কেমন জমছে গল্প?

– ভীষণ ভালো! তুমিও এসে যোগ দাও…. ভালো লাগবে তোমার।

কানিজও এসে গল্পে মেতে ওঠে। কথায় কথায় ওঠে লতা দেশে এসেছে থেকে কোথাও বেড়াতে যেতে পারে নি। ওর ভীষণ ইচ্ছে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি দিকটায় বেড়াবে। অনন্যার মন মানসিকতা ভালো নেই। কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে না। ওকে এমন অবস্থায় রেখে কানিজও যেতে পারবে না। ওদিকে কানিজের বাবা-মা দুজনই এখন জাপানে আছেন। দেশে শুধু কানিজ আর লতা। কিন্তু লতা এখনই চাচ্ছেন কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। তাই ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ ভাবছে ওরা।

লতা প্রতিবছর দেশে আসেন না। দশ বারো বছর পর যখন আসে তখন কী একটু ঘুরতে চাইবেন না? উনি তো রোজই এখানে ওখানে যেতে চাইছেন, কিন্তু কি করবে ও? জোহরা বেগমের বাঁত ব্যাথা। বেচারি সেভাবে বাড়ির বার হনই না। তাকে দিয়েও এসব ঘোরাঘুরি চলবে না। অবশ্য আরেকজন আছেন যে কী না চাইলেই লতাকে নিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন। লোকটা কে?

সে আর কেউ না, আমাদের লেবু মামা। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই খুশি হয়ে উঠলো কানিজ। জোহরা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– আন্টি, আমরা এতো ভাবছি কেন? লেবু মামাকে বললেই তো হচ্ছে। উনি তো সারাদিন বাড়িতেই থাকেন। ফুপিনকে সাথে নিয়ে একটু খাগড়াছড়ি বেড়াতে ওনার কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?… তুমি একটু বলো না মামুকে…. দেখ, আমি তো ব্যস্ত পড়াশুনা নিয়ে, অনুও ব্যস্ত…

কথাটা শুনে হঠাৎ খুশি হয়ে ওঠেন জোহরা। উনি যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। লেবু মামার সাথে লতাকে ঘুরতে পাঠানোর! এই সুযোগে তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে নিতে পারবে। আর তাহলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেও সুবিধা হয়ে যাবে। আহা! এতো সোনায় সোহাগা! উনি বললেন,

– বাহ, ভালো বলেছিস তো!.. আমি তো এটা ভেবেই দেখি নি। সত্যিই তো লেবুকে বললেই তো হয়ে যায়…. লতার সাথে সাথে ওরও ঘোরা হয়ে যাবে। আলসেটা তো বাড়ি থেকে বেরোতেই চায় না!..

অবশেষে সেই কথাই ঠিক হলো লেবু মামা আর কানিজের ফুপিনই যাবেন খাগড়াছড়ি অঞ্চলে। জোহরা তো এটাও ঠিক করে ফেললেন যে কালই তাদের বাসে তুলে দেবেন। তিনি সব কিছু করলেন অথচ একবারও লেবু মামাকে জিজ্ঞেস অবধি করলেন না! উনি আসলে যাবেন কী না সেটা না জেনেই টিকেট পর্যন্ত কনফার্ম করে দিলেন।

গতমাসে নতুন একটা মুভি রিলিজ হয়েছে। নাম “PUSHPA: The Rise” রিভিউ গুলোতে দেখা গেছে মুভিটার রিলিজের পর পরই ভিউ হয়েছে প্রচুর। ব্যবসা সফল হয়েছে তো বটেই সাথে নামও কামিয়েছে অনেক। সবাই সেটা দেখে ফেলেছে অথচ মামা সেটা দেখেন নি? এটাও কি সম্ভব? মুভি রিলিজ হওয়ার পর পরই সেটা দেখে ফেলা মামুর একান্ত কর্তব্য। অথচ প্রায় একমাস হয়ে যাওয়ার পরও তিনি একটা হিট মুভি দেখেন নি! ব্যাপারটা সত্যিই তার প্রেস্টিজে লাগার মতো!

আজ তাই অনেকটা জেদ নিয়েই মুভিটা ডাউনলোড করেছেন উনি। যাতে দেখার সময় ‘নেট প্রবলেম’ কোনোভাবেই বিরক্ত করতে না পারে। বেশ আয়োজন-টায়োজন করেই, খানা-পিনার যথাযথ ব্যবস্থা করেই বসেছেন মুভি দেখতে। মুভি চলছে। পুষ্পা বনের ভেতর গেছে লাল চন্দন কাঠ কাটতে। হঠাৎ সেখানে রেট পড়েছে পুলিশের। ওরা এখন কী করবে?

মুভির টানটান উত্তেজনার এ দৃশ্যপট যখন চলমান তখনই ঘরের দরজা খুলে ঢুকলেন জোহরা বেগম। সাথে করে একটা লাগেজ এনে সরাসরি চলে গেলেন আলমিরার সামনে। সেখান থেকে কাপড়-চোপড় বের করতে করতে বললেন,

– কী কী কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দেব, বল্ তো?.. শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবী… কোন রঙের পাঞ্জাবি নিবি রে? লাল?.. ওটা কিন্তু তোকে হেবি মানায়।… লতা নিশ্চয় পছন্দ করবে।… এই কথা বলছিস না কেন, তুই? কিছু একটা বল্ না!

বলতে বলতেই টিভির সামনে এসে দাড়ালেন উনি। মামা অধীর আগ্রহে বাকি অংশে কী হলো সেটা দেখার জন্য এপাশ ওপাশ করে স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু দেখতে পারছেন না তার সম্মানীয় বড় বোনের কারণে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বললেন,

– আপা, সরো না!

– সরবো না।.. তুই কথা বলিস না কেন? কখন থেকে বলছি কী কী নিবি বল্, গুছিয়ে দেই। তুই কি না কিছুই বলছিস না!

এতক্ষণে তার কথার কর্ণপাত করলেন মামা। কিছুটা অবাক আর বিরক্ত স্বরে বললেন,

– কী বলবো, আপা? তুমি যে কী বলছো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।.. আমি কোথায় যাবো যে তুমি কাপড় গোছাচ্ছ?

– কোথায় যাবি মানে? তুই জানিস না, কাল তোকে খাগড়াছড়ি যেতে হবে?

– খাগড়াছড়ি!.. কেন?

হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়লেন উনি। জোহরা বেগম কিছুক্ষণ তার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ করেই মনে হলো, আরে তিনি রাগছেন কেন? লেবুকে তো বলাই হয় নি তিনি তাকে লতার সঙ্গে পাঠাবেন। কাল বাসের টিকেটও কাটা হয়ে গেছে অথচ তাকে এখনও জানানোই হয় নি? আচ্ছা, ও যেতে রাজি হবে তো? তারপরই ভাবলেন, রাজী হবে না কেন? আলবৎ হবে। হতেই হবে!

– লতা মেয়েটা দেশে এসেছে অনেকদিন হলো… কিন্তু এখনও কোথাও বেড়াতে যেতে পারে নি। অনু-কানিজ দুজনই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত, যেতে পারছে না। মেয়েটা এখন দেশটা ঘুরে দেখতে চাইছে আমাদের কী উচিৎ না সে ব্যবস্থা করা?

– হ্যাঁ, অবশ্যই।

মাথা নাড়লেন লেবু মামা।

– তা তুমি নিয়ে যাও না?

– আমি? কীভাবে? আমার বাঁত ব্যাথা তুই জানিস না? এতদূরের জার্নি আমার সইবে?.. তারচেয়ে তুইই যা না, লেবু। লতা মেয়েটাকে একটু সময় দে!

– আমি?.. কী বলছো আপা তুমি এসব?.. আমি কী করে যাবো?

– কীভাবে যাবি মানে? বাসে করে যাবি…

– কিন্তু আপা, আমি…

– কোনো কিন্তু না। আমি যা বলেছি তাই হবে। কাল তোর বাস, আমি এখন কাপড় গোছাচ্ছি। তুই যাবি, ব্যস!

তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না জোহরা। ধমক মেরে চুপসে দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

#চলবে——-

[সম্ভবত আগামীকাল গল্প দিতে পারবো না। অগ্রিম দুঃখিত..💔]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here