মাঝরাতে গভীর ঘুমের মধ্যে হঠাৎ বুকের মাঝখানটা ভেজা ভেজা অনুভব হতেই ঘুম হালকা হয়ে যায় আমার।ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে এবার চোখ খুলেই তাকালাম।কাঞ্চনা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদছে।হৃদয়টা দু*ম*ড়ে মু*চ*ড়ে উঠলো।তাও তেমন সহানুভূতি দেখালাম না।হাত দিয়ে ছিটকে পাশে সরিয়ে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেলাম।আমি জেগে গেছি দেখে হয়তো বেচারী আরো বেশী ভয় পেয়ে গেছে।
এই ঘটনা আজ নতুন নয়।প্রায়ই এমন করে ও।যেদিন ওর গায়ে হাত তুলি সেদিন।আমি সত্যিই বুঝিনা একটা মেয়ে এতটা সহনশীল কিভাবে হয়।এর মধ্যে কি ঘৃনা বলতে কিচ্ছু নেই।এতো অত্যাচার করার পরেও কি করে এখনো পরে আছে আমার কাছে।
এইতো রাতেই বেল্ট দিয়ে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছি।তার বেদানাতুর চিৎকারেও মন গলেনি আমার।রাগ হলে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।কিন্তু অদ্ভুত!প্রত্যেকবার মারার পরেও রাতে আমি ঘুমালে লুকিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে কাদে।এ যেন এক নির্জীব নিষ্ক্রিয় অভিযোগ ঘুমন্ত আমি টার কাছে।
এটুকু পড়েই ডায়েরীর পাতাটা বন্ধ করে দিল সেলিম।কাল থেকে আবার ডিউটিতে যেতে হবে।সেবার গুলি খাওয়ায় মাত্র পনেরো দিনের জন্য ছুটি পেয়েছিল সে।কত টা রাত ব্যাথায় যন্ত্রনায় গুমড়ে মরেছে, নির্ঘুম কাটিয়েছে সেটা হয়তো আল্লাহ ব্যাতীত কেউই জানে না।তবে এত যন্ত্রনার সময়েও নিজের অতি প্রিয় ডায়েরীটা পড়তে ভুলেনি।মোবাইল ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো রাত বারো টা। এবারে ঘুমানো প্রয়োজন ভেবেই ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো সে।
রৌদ্রজ্জ্বল দিন শেষে মেঘ সহ সন্ধ্যা নেমে এলো ধরনীতে।সেই সন্ধ্যা থেকে একটানা নয়টা পর্যন্ত মুষলধারায় বৃষ্টি পড়লো।মেইন রাস্তায় পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পানি উঠেছে।তারই মধ্যে অজস্র রিকশা সহ বিলাসবহুল গাড়ি গুলো নিজস্ব গন্তব্যে যাচ্ছে।সামনেই একজায়গায় একসিডেন্ট হয়েছে।পুলিশ কর্মকর্তারা বাশ দিয়ে চারপাশটা আটকে দিয়েছে।একটা সি এনজিকে বিলাসবহুল মাইক্রো ধাক্কা দিয়েছে।সি এনজি ড্রাইভার রক্তমাখা কপালে হাত চেপে ধরে সেটাই বলে যাচ্ছে।পুলিশ যখন তার কথা কে গ্রাহ্য না করে সেই মাইক্রোর মালিকের কথা শুনছিলো।তখনই পিছনের রিক্সা থেকে মধ্য বয়সী এক যুবতী মহিলা নেমে এলো।গায়ের নীল রঙের শাড়িটাকে উচু করে পানির ফাকে ফাকে পা দিয়ে এগিয়ে গেল সেখানে।
কুচকুচে নয়,শ্যামকালো বলা যায় তাকে।কপালের মাঝখানে নীল রঙের একটা ছোট্ট টিপ যেন তার মুখকে আরো মায়াবী করতে বাধ্য করছে।
উনিই নিজেই ইচ্ছে করে আগে যাওয়ার জন্য এই সি এন জি টাকে ধাক্কা দিয়েছে।আমি সচোক্ষে দেখেছি।
প্রান ফিরে পেল সি এনজি ড্রাইভার। চল্লিশোর্ধ্ব ড্রাইভার চেচিয়ে বললেন-
হ হ।এই আফায় পিছনেই আছিলো।হের কথা তো বিশ্বাস করেন। আমার গাড়ি ভাইংগা দিলো এই বড়লোকের ব্যাটায়।(বলেই মাথায় হাত দিয়ে কাদতে লাগলেন)
পুলিশ কর্মকর্তা বিরক্তির চোখে মহিলার দিকে তাকালো।তারপর বললো-
আপনি যখন দেখছেন তাহলে থানায় চলেন।সাক্ষী দিবেন বড়বাবুর কাছে।এই আপনারাও চলেন(সিএনজি ড্রাইভার ও মাইক্রোর মালিক কে বললো)
রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে।এখনো বাড়ি পৌছাতে পারেনি মহিলাটি।থানায় গেলে আরো দেরি হবে।চিন্তায় কপালে ভাজ পড়লো।তারপরেও ড্রাইভারের দিকে একবার তাকিয়ে থানায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
বৃষ্টি এবং বাতাসের ঝাপটায় বিদ্যুৎ এর লাইন বিচ্ছিন্ন হয়েছে।যার দরুন,এলাকায় কারেন্ট নেই।থানায় নিভু নিভু মোমবাতি জ্বলছে।সামনের একটা বেঞ্চিতে মহিলাটি এবং মধ্যবয়সী ড্রাইভার টি বসে আছেন।অপরপাশের বেঞ্চে সেই মাইক্রোর মালিক।কনস্টেবল সাহেব ভিতরের কক্ষে সেই যে ঢুকেছে বের হওয়ার আর নাম নেই।প্রায় পনেরো মিনিট পার হয়ে গেছে।যুবতী মহিলাটি একজন হাবিল দারকে ডেকে তাড়া দিলে সে ভিতরে গেল।এরইমধ্যে কনস্টেবল সাহেব প্রায় বিরক্ত হয়ে বাইরে এসে চেচিয়ে বললেন-
সাক্ষী হতে চেয়েছেন ভালো কথা।একটু অপেক্ষাও করতে পারবেন না তো আপনাকে আসতে কে বলেছে।
ভ্রু কুচকে কঠিন চোখে সেদিকে তাকালো মেয়েটি।সাথে সাথেই লোকটি বললো-
আসুন,বড়বাবু ভিতরে আছেন।আপনি সাক্ষি দিয়ে সই করে যান।
ধীর পায়ে তিনজনই ভিতরে প্রবেশ করলো।ইনস্পেকটর এর সামনের টেবিলের অপর পাশের চেয়ারে বসলো মহিলাটি।টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে।কথা বলার উদ্দেশ্যে সেদিকে তাকাতেই থমকে গেল ইনস্পেকটর সেলিম।মুখ দিয়ে অতি ছোট্ট স্বরে বেরিয়ে এলো-
কাঞ্চনা…..
আজ প্রায় তেরো বছর পর এই মুখটি দেখলো সে।
চলবে ইনশাআল্লাহ?
#সূচনা_পর্ব
#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি