মায়াবতী কাঞ্চনা পর্ব -০৬+৭

##মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৬

ব্যর্থ পথিকের মতো চোখের অশ্রুগুলো লুকানোর চেষ্টা করলো সেলিম।সিড়ি দিয়ে নামতেই মুখোমুখি হলো শেফালীর।রান্নাঘরেই ধোয়া-মোছা করছিলেন তুমি।চারদিকে তাকিয়ে অশ্রুগুলো সংবরন করে শেফালীকে বললেন-

ও বাড়ি এতো মানুষ কেন চাচী?আজ’ই কি বিয়ে?

হাতের প্লেটগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে শেফালী বললেন-

না বাজান,বিয়া না।তয় কহিনুর বুবু কইলো আইজ নাকি কাঞ্চনারে আংটি পড়াইতে আইবো।

বুকের ভেতরটা কেমনা চি*ন চি*ন করে উঠলো সেলিমের।নিজের রুমে যেতে যেতে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বের করলো –

ওহ!

তুমি কিন্তু চাইলেই সুজন মির্জার উপরে কেস করতে পারো।

ভ্রু কুচকে পিছনে তাকালো সেলিম।শেফালি কাজ করতে করতে পুনরায় বললো-

দেহ বাজান।এই দুনিয়ায় কেউ কেউওর না।তোমার এই ভালোমানুষি কেউ দেখবো না।সবার সামনে শক্ত হও দেখবা মানুষেও তোমারে সম্মান করবে। তারা তোমারে কোনো ফয়সালা না দিয়াই মাইয়া বিয়া দেতাছে।তুমি এহনো কাঞ্চনার স্বামী।হেই মাইয়া নিজের তেজ নিয়া চইলা গেছে। না হে তালাক দিছে আর নাতো তুমি।তার পুরা পরিবার আইজ কতগুলো বছর ধইরা লাপাত্তা।আইজ এতো বছর পর বাড়ি আইসা তোমারে কোনো ফয়সালা না দিয়াই হেরা মাইয়া বিয়া দেওয়ার লাইগা উইঠ্যা পইর‍্যা লাগছে।ক্যা,পাইছে ডা কি হ্যারা।এই এত্তগুলো বছরের মধ্যে যদি তুমি বিয়া করতা তাইলে তো তারা কবে কেস কইরা দিতো।

থেমে, তুমি আমার কথা শোনো বাজান,গ্রামে সালিশি দাও।এইভাবে জীবন চলে না।একটা সিদ্ধান্ত নিয়া তারপর নতুন কইরা বিয়া করো।তোমার হেই বান্ধবী সুবর্না তো বাড়িই…….

আর বলতে দিল না সেলিম।তার আগেই কঠিন চিত্তে বলে উঠলো-

চাচী,আজকে আমি বাড়িতেই আছি।রান্না করে নিবো।আপনি যেতে পারেন।

থমথম করতে করতে চলে গেলেন শেফালী বেগম।আর সেলিম ধীর পায়ে রুমের মধ্যে ঢুকে গেল।চোখ জলছে ভীষন।শরীর ভীষন ব্যাথা করছে।গায়ে জ্বর উঠেছে।সেভাবেই না খেয়ে পড়ে রইলো বিছানার মাঝখানে।

_____________
_____________
রাত আটটা।নির্জন নিরিবিলি ধানক্ষেত।বর্তমানে তা ভরে উঠেছে বর্ষার পানিতে।তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে অজস্র শাপলা। বাড়ি থেকে বের হয়ে ক্ষেতের পাশে গিয়ে দাড়ালো সেলিম।বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই চোখে পড়লো এক মানবীয় ছায়া।

কাঞ্চনা।হাত পাচেক দুরেই আম গাছের সাথে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে বিশাল বিলের বুকের দিকে।ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সেলিম।না চাইতেও দাড়ালো গিয়ে তার পিছনে।পিছনে কারো অস্তিত্ব পেতেই দুম করে পিছু ফিরলো কাঞ্চনা।সেলিমকে দেখামাত্রই আবারো মনযোগী হলো নিজের ধ্যানে।

বিয়ে যখন করবেই তখন এতো বছরে করলেই পারতে।বাড়ি এসে করার কি দরকার ছিল?

গম্ভীর কন্ঠে কথাগুলো বললো সেলিম।কাঞ্চনা নিরব।মেনে নিতে পারলো না সেলিম।এই দাম্ভিকতা, এই তেজের জন্যেই আজ দুজনের পরিণতি এমন।ডানহাত মোচড় দিয়ে ধরে বসলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তাল সামলাতে না পেরে সেলিমের বুকের সাথে ধাক্কা খেল কাঞ্চনা।হাত মোচড়ালো কিন্তু ছাড়াতে পারলো না।তৎক্ষনাৎ অপর পাশ থেকে শুনতে পেল।

এই তেজ অন্য কাউকে দেখাতে পারো না।যখন বিয়ের আগেই অন্যপুরুষ হাত ধরে জড়াজড়ি করে।তখন কোথায় থাকে এই আত্নসম্মান?(ক্ষোভ নিয়ে বললো সেলিম)

কাঞ্চনা বেশ ভালোই বুজতে পারলো সেলিমের রাগের কারন।তারপরেও নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস করে বললো-

আপনিও তো অনধিকার চর্চা করছেন।আপনার কোনো অধিকার নেই আমার হাত ধরার।

পুনরায় আরো জোরে ঝাপটে ধরলো কাঞ্চনাকে।দাতে দাত খিচিয়ে বললো-

অধিকার আছে আমার।তোর উপর খাটানো সকল অধিকার আছে আমার।ভুলে যাস না আমি তোকে তালাক দেইনি আর নাতো তুই দিয়েছিস।

নিশ্চুপ কাঞ্চনার চোখ দিয়ে টুপ করে অশ্রু ঝরে পড়লো।এই জোরটা সে আরো বছর কয়েক আগেও খাটাতে পারতো।তাকে ফেরাতে পারতো। কিন্তু ফেরায়নি।

আমার ঠিক দোষটা কোথায় ছিলো বলতে পারো কাঞ্চনা?তোমার জেদের কারনে আজ আমাদের পরিনতি টা দেখো-না তুমি সুখে আছো আর না তো আমাকে সুখে রেখেছো।না জেনে,না বুঝে,পরিস্থিতিকে না ঘাটিয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে আজ এই পরিনতি তোমার।কিন্তু তুমি কি করলে?আমাকে দায়ী বানালে।পুরো গ্রামের কাছে চরিত্র*হীন বানালে।একদম একাকীত্বের মধ্যে ঠেলে দিলে।
থেমে,
কই একবার খোজ তো নিতে পারতে আমার।নাও নি।একবার আমার কাছে আসতে পারতে,আসো নি।আচ্ছা তোমার কি আমাকে একবার ও দেখতে ইচ্ছে করেনি?
সদ্য বাবা-মা-স্ত্রী, নিজের চরিত্র সবকিছু হারিয়ে গ্রামের সবার লাঞ্ছনা সয়ে কি করে ছিলাম আমি।রান্না করা,সংসার চালানো,পড়াশোনা করা,দোকান চালানো,নিজেকে মানষিক ভাবে সামলানো আমার কাছে সহজ ছিল না কাঞ্চনা।অসুস্থ হয়ে মরে গেলেও খোজ নেওয়ার কেউ ছিল না।দিনের পর দিন জ্বরে কাতরে মরেছি,খোজ নেওয়ার কেউ ছিল না।এতটা স্বার্থপর কি করে হতে পারলে?

থেমে,তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে।

স্বার্থপর তো তুমি নও ,স্বার্থপর আমি।আমরা সেলিমরা সবসময় স্বার্থপর হই।আমরা তো তোমাদের মতো চিৎকার করে,লোক জড়ো করে কাদতে পারি না।আর নাতো আমাদের কান্না দেখে সমাজ দূর্বল হয়।আমরা বুকে পাহাড় সমান কষ্ট/যন্ত্রনা/ব্যথা চেপে রেখে কঠিন চিত্তে তাকিয়ে থাকি।সমাজের চোখে হই পাষান/অমানুষ/চরিত্রহীন।
তোমরা কাঞ্চনা’রা কাদলে সমাজের কাছে হও নিরীহ,আর আমরা সেলিম’রা হই ঠাট্টার পাত্র।

কাঞ্চনা অবিরাম ভাবে সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।সব সময় নিরব/শান্তভাবে সবকিছু সয়ে যাওয়া মুখটায় আজ যেন কথার বুলি ফুটেছে। মনের মধ্যে জমানো সমস্ত অভিমান যেন আজ মুখের মাধ্যমে লেপে দিচ্ছে কাঞ্চনার শরীরে।
লোমশো হাতটা ছুতেই শিউরে উঠলো।হাতটা অস্বাভাবিক ভাবে গরম।জ্বর ভেবে কপালে হাত দিতেই দু-কদম পেছনে সরে যায় সেলিম।অস্পষ্ট স্বরে কাঞ্চনার গলা দিয়ে বের হয়-

আপনার গায়ে অ-অনেক জ্বর।

তেজি কন্ঠে বলে ওঠে সেলিম।

দরকার নেই‌।যখন গুলি খেয়ে জ্বরে ভুগে রাতের পর রাত একটা অন্ধকার রুমে কাতরে মরেছি,তখন কপালে এরকম একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ খুব দরকার ছিল ।আফসোস তখন পাইনি।এখন আর দরকার নেই।অভ্যাস হয়ে গেছে একা থাকার।

থেমে,
শেফালী চাচিকে রেখেছি কেন জানো?যাতে হূট করে মরে গেলে লাশটা অন্তত পায়।এমন যেন না হয় ,দিনের পর দিন ওই বদ্ধ ঘরেই আমার লাশ পচতে থাকে।

শব্দ করে কেদে দিল কাঞ্চনা।সেলিম হাসলো‌।কাঞ্চনার থুতনি ধরে নিজের দিকে তাকালো।শান্ত কন্ঠে বলল-

তুমি কি ভেবোছ?এসব কথা আমি তোমাকে বলে দূর্বল করার চেষ্টা করছি।তোমার বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছি?নাহহ!আমি শুধু তোমার থেকে সামান্য দয়া চাইছি।প্লিজ!চলে যাও এখান থেকে,অনেক দূরে ,আমার দৃষ্টিসীমানার বাইরে ।গিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে কর।আমি কিচ্ছু বলবো না।এখানে থেকে আমাকে আর পুড়িও না।
আর হ্যা,দু-তিন দিনের মধ্যেই তোমার ভাইয়ের দেওয়া টাকাসহ ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে।

চলবে?

বার্তা:আপনারা অনেক আগে থেকেই জানেন,আমার নিজস্ব কোনো ফোন নেই।মায়ের ফোন ব্যবহার করি।হঠাৎ বাড়িতে অনুপস্থিত থাকায় কালকে গল্প দেওয়া সম্ভব হয়নি।এমনকি আজকেও এক কাজিনের ফোন দিয়ে লিখেছি।পর্ব ছোট হওয়ার কারনে দুঃখিত।মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৭

নিস্তব্ধ সরোবরের জলের মতোই কাঞ্চনার দুচোখ ভরে উঠেছে। তবে পার্থক্য হলো-সরোবর একদম নিরব আর কাঞ্চনার চোখ দুটো অবিরাম ধারায় বার বার ভরে আসছে আবার উপচে পড়ছে দুগাল গড়িয়ে।হাটু মুড়িয়ে আম গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো কাঞ্চনা।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হেচকি তুলে কাদতে লাগলো।

হ্যা,দোষ তো তার। সেটা সে মেনেও নিয়েছে । তাই বলে সেলিম কি তাকে ফেরাতে পারতো না।অবশ্যই পারতো।কিন্তু ফেরাই নি।তেজ কি শুধু কাঞ্চনাই দেখিয়েছে, সেলিম দেখায়নি।পুনরায় গুমড়ে কেদে উঠলো কাঞ্চনা।

____________________
____________________
কেটে কেছে আরো পনের দিন।চারুর মৃত্যুর আজ আড়াই মাসে পড়েছে।স্বাভাবিক ভাবে সেলিম কাঞ্চনার সংসার ভালো চললেও অশান্তি সৃষ্টি করলো প্রতিবেশীরা । নিত্য নতুন ভাবে চারপাশের সবাই কানপড়া দিতে লাগলো তিনজনকেই।কোনোদিন কাঞ্চনার কাছে এসে বলতো-

কালা ধলা তো আল্লায়ই বানাইছে এইডা নিয়া ওতো কষ্টের কি আছে?এমন ভাবে মুখ চোউখ কইরা রাখছে তোমার স্বামী/শশুর, যেন তোমার একটা হাতই নাই।শুকুর করা উচিত,মির্জা বাড়ির মাইয়া বিয়া করছে তারপরেও দেহ এমন একটা ভাব যেন তুমি জোর কইরা আইয়া বইয়া রইছো তাগো ঘাড়ের উপর ।

প্রথম প্রথম কাঞ্চনা নিশ্চুপ থাকলেও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতো –

কেন কাকী,এসব বলছেন কেন?

বেশ সুযোগ পেয়ে যেতো তারা।আয়েশ করে বসে মুখে পান সাজিয়ে বলতো-

আর বইলো না মা৷ ওই তোমার শশুররে আমার আব্বায় জিগাইছিলো পোলা ডা তো বিয়া দিলা,একবার জানাইলাও না। কি দেমাগ হের জানো তুমি?মুখ চোউখ আন্ধার কইরা এমনভাবে তাকাইলো যেন তোমারে হের পোলার লইজ্ঞা বিয়া করাইয়া ভীষন অন্যায় করছে।সেলিমরেও কেউ জিগাইলে এইরম মুখ চোউখ আন্ধার কইরা ফালায়।আমার আর এইসব ভালো লাগে না রে মা।রাজার ঘরে জন্ম হইছে,হেই মাইয়ায় এহন সারাদিন কালি-পাতিল বাসন,রান্দা-বারার মধ্যে পইড়া থাহে হেরপরেও তাগো সুখ হয় না।

কাঞ্চনা নিশ্চুপ হয়ে সবকিছু শুনতো। কখনো হেসে উড়িয়ে দিতো আবার কখনো মন খারাপের বাসা বাধতো সারা মন জুড়ে।

কাঞ্চনার কাছে বেশী সুবিধা না পেয়ে যেত মজিদ হাওলাদারের কাছে।ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ রেশ ধরে বলতো-

কি একটা বউ আনলেন ভাইজান।একটামাত্র পোলা আপনের আর আপনে কিনা টাকা বিয়া কইরা আনলেন।কয় টাকাই বা পাইছেন।এই যেই জেদি মাইয়া এর বাপের বাড়ি দিয়া এক কানাকড়িও পাইবেন না।আহারে,পোলাডার মুখের দিকে তাকোন যায় না।চান্দের নাহান পোলাডা,আর বউ আনছেন একটা পেত্নির মতো।সারাদিন শেষে কই বউডার মুখ দেইখা পরাণ ডা জুড়াইবো তা না আপনে তো এমন একখান কাম করলেন এহন পোলাডা না পারে সইতে আর নাতো পারে কইতে।

মজিদ হাওলাদার এসব কথা শুনে বেশ ভেঙে পড়েন। কষ্টে /যন্ত্রনায় বুক ছিড়ে যায় তার।সত্যিই তো খুব ভালো ঘরের রুপসী মেয়ে আনতে পারতেন তিনি।আর সামান্য কটা টাকার জন্য ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিলেন।ছেলের মুখ সারাক্ষণ কালো হয়ে থাকে।হয়তো এই জন্যই।এসব ভাবতে ভাবতে তিনিও অশান্তির আগুনে দাউদাউ করে পুড়েন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

কাঞ্চনা কালো,অসুন্দর এসব কথা নিয়ে প্রতিবেশীরা তার কাছে খুব একটা ঘেষতে পারে না।সেলিম না শোনার ভান ধরে অন্য কাজে মগ্ন থাকে। তারপরেও হাল ছাড়েনি প্রতিবেশীরা।এরা যেন বিষধর সাপ।কোনো পরিবারকে শেষ করে দিতে এক অতৃপ্ত পৈশাচিক আনন্দ পায়।বন্ধুবান্ধব/পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি নিজের বাবার মুখেও কাঞ্চনার কালো রঙ নয়ে অসন্তুষ্টি শুনে নিজেকে আর সামলাতে পাড়লো না।

সন্ধ্যাবেলা, আকাশে মেঘ জমেছে।বৃষ্টি পড়বে পড়বে ভাব।ঘরের কাজ শেষ করে পানি ভর্তি বালতি হাতে ঘরে ঢুকলো কাঞ্চনা।এরইমধ্যে হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকলো সেলিম।অসস্তিতে হাস-ফাস করতে করতে কাঞ্চনার হাতে দিল ব্যাগটি।নির্লিপ্ত কাঞ্চনা মাথা নাড়িয়ে বললো-

কি এটা?

খুলে দেখো।

হাসিমুখে ব্যাগ খুলে ভিতরের সামগ্রী গুলো দেখতেই স্তব্ধ হয়ে গেল কাঞ্চনা।এটা স্বাভাবিকের মধ্যেও অস্বাভাবিক ঘটনা।ব্যাগের মধ্যে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম,বডি লোশন এবং ফেসওয়াশ।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেলিমের মুখের দিকে তাকালো কাঞ্চনা।তাহলে প্রতিবেশীদের কথাই সত্য। কাঞ্চনার রঙে অসন্তুষ্ট সে।চোখগুলো টলমল করে উঠলো।

আমার গায়ের রঙ নিয়ে যদি আপনার এতই সমস্যা, তাহলে বিয়ে কেন করেছিলেন?বিয়ের আগে কেন বলেননি?(চিৎকার করে কঠিন কন্ঠে)

সেলিম নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো-

বলি নি, ইচ্ছে করে নি তাই।এখন এগুলো এনে দিয়েছি,রেগুলার ব্যাবহার করবে ।কোনো কৈফিয়ত দিতে পারবো না।

সারা শরীর রাগে গজগজ করতে লাগলো কাঞ্চনার। হাতের ব্যাগটা ছুড়ে মারলো ঘরের কোনায়। কাঠের তক্তার বেড়ায় পড়ে কাচের বোতলটি চুরমার হয়ে গেল।ফুসে উঠে বললো-

আমি মরে গেলেও এইসব ব্যাবহার করবো না। আপনার আমাকে ভালো না লাগলে বলে দিবেন। ব্যাস চলে যাবো এখান থেকে।

মাথা গরম হয়ে গেল সেলিমের।টিউশনির টাকা হাতে পেয়েই ভালো ব্রান্ডের কসমেটিকস গুলো কিনেছে সে। রে*গে গিয়ে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো কাঞ্চনাকে। দুগাল চেপে ধরে বললো-

তোর তেজ বেড়ে গেছে তাই না।এত্তো তেজ কাকে দেখাস তুই?এগুলো ভাঙলি কেন?এগুলো মাগনা পাওয়া যায়। তিনজন স্টুডেন্টের পুরো এক মাসের বেতন এখানে।এটা কি তোর বাপের বাড়ি পেয়েছিস।ইচ্ছে মতো,খেয়াল খুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করবি।আমি এনে দিয়েছি মানে এগুলো সব তুইই ব্যাবহার করবি।

মুশলধারে বৃষ্টি।মজিদ হাওলাদার দোকানে।একা বাড়িতেই একের পর এক দুজনেই বিভিন্ন কথা বলে ঝগড়া করতে লাগলো।কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে সেলিম বেশ ভালোভাবেই মারলো কাঞ্চনাকে।সেদিন প্রথম কাঞ্চনা বেল্টের আঘাতের স্বাদ পেয়েছিলো।পুরো তিনদিন জ্বরে ভুগেছে।সেলিমই অসুধ এনে খাইয়েছে তাকে।বাবার বাড়িতে কখনো যাবে না এমন জেদ ধরেই বসে ছিলো কাঞ্চনা।সেলিম যে পাড়া-প্রতিবেশীর কু মন্ত্রনায় পড়েই তার জন্য কসমেটিকস গুলো এনেছিলো সেটাও বেশ বুজতে পেরেছিলো সে।নিজেকে বুঝিয়ে/সামলে থেকে গিয়েছিলো সেবার ও।

মজিদ হাওলাদারের সৎ ভাই ওরফে সেলিমের বড় চাচা-চাচীরা হায়নার মতো পড়েছিলো তাদের পিছনে। সামান্য জায়গাটুকু ভোগ-দখলের জন্য মেতে ছিলো নানা কু-মন্ত্রনা দিতে।চারু মারা গেছে,কাঞ্চনাকে তাড়াতে পারলেই দুই বাপ-ছেলে ছন্নছাড়া হয়ে যাবে এমনটা ভেবেই পড়েছিল তাদের পিছনে।মির্জা বাড়ির মেয়ের সাথে ততোটা পেরে ওঠা যাবে না দেখেই পুনরায় তাকে তাড়ানোর জন্য নতুন চাল চালে। সেলিম,মজিদ হাওলাদের যাকেই পায় তাদের কাছে কাঞ্চনার দুর্নাম রটতে থাকে।
কাঞ্চনা বড়দেরকে সম্মান করতে জানে না,সবার সাথে ঝগড়া করে,অসম্মান করে,অবহেলা করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

চোখ বুঝেই বিশ্বাস করে নেয় সেলিম।কেননা কাঞ্চনাকে কেউ কিছু বললে যে কাঞ্চনা তাকে ছাড় দেবে না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।নিশ্চয়ই এমন কিছু কথাবার্তা বলে যার কারনে কাঞ্চনা তাদের অপমান করতে বাধ্য হয়।
তারপরেও সেলিম কাঞ্চনাকে বোঝায়,কেউ কিছু বললে না শোনার ভান করে থাকতে।সবার কথার দাম দিতে হবে এমনটা নয়।কিন্তু অষ্টাদশীর তেজী মন তাতে সায় দিতে নারাজ।কাউকে ছাড় দেবে না সে।এরকমভাবে প্রায়ই টুকটাক কথা নিয়ে ঝগড়া লেগে যেতো তাদের মাঝে।নিজেকে সংযত করতে না পেরে সেলিম ও গায়ে হাত তুলতো।

তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে বুদ্ধিমতী কাঞ্চনার মন তাতে সায় দেয় না।সে চলে গেলে যে সবার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে।রাত হলে সেলিমের ওই ঘুমন্ত মুখ দেখে সবকিছু ভুলে যেত কাঞ্চনা।হামলে পড়তো সেলিমের লোমশ বুকের উপর।লোকটা তো তাকে অপমান করে না।এমনকি নিজস্ব কোনো বিষয়েও তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় না।শুধুমাত্র বাইরের বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়। বোকা লোকটা যে বোঝে না এই যুগে কাউকে ছাড় দিতে নেই তাহলেই সে ধারালো থাবা নিয়ে পরবর্তীতে আক্রমন করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।অষ্টাদশী নিজের মনকে বোঝায় হয়তো ধীরে ধীরে সেলিম সব বুজতে পারবে।
হয়েছেও তাই।সেলিম বুঝেছে, কিন্তু ভাগ্য বুঝলো না।ধেয়ে এলো নিষ্ঠুর ভাগ্য যা কাঞ্চনার ভাবনার ও অতীত ছিলো।

বাপের বাড়ি যাবে না যাবে না করেও ঠেকাতে পারলো না কাঞ্চনা।ভাই সুজন মির্জার ভয়াবহ জ্বরে ছুটে গিয়েছিলো একদিন।একরাত থেকেছিলো সেখানে। কিন্তু পরের দিন সকালেই প্রতিবেশীর মুখের কথা তার পুরো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিলো।

সেলিম দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, চাদের মতো সুন্দর সেই বউ।গত রাতেই তাকে ঘরে তুলেছে।সকাল হতেই সারা গ্রামময় ছড়িয়ে পড়লো সেই কথা।অষ্টাদশী, নরম চিত্তের কাঞ্চনা নিতে পারলো না এমন ধারালো সত্য। অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো সেখানেই।

চলবে?

বাড়ি ফিরেই বড় করে দিব ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here