#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা-০২+০৩
০২
রাত সাড়ে এগারোটা।বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভুগছে পুরো পিরোজপুর জেলার মানুষ। টেবিলের ওপর জ্বলন্ত মোমবাতির আলোয় পরিচিত মানুষটাকে দেখে বেশ চমকে যায় কাঞ্চনা।কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না।আজ প্রায় তেরো বছর পরে তাকে চিনতে সামান্য হিমশিম খায় সে।আগে দাড়ি না থাকলেও এখন সারা মুখ জুড়ে চাপ দাড়ি এবং গোফে ভর্তি।পেটানো শরীর টাও বুঝি আগের সেই পরিচিত মানুষ টাকে অচেনা করে তুলছে।নিজেকে সং*যত করে মাথা নিচু করলো কাঞ্চনা।সেলিম নয়,ইনস্পেকটর সেলিমের উদ্দেশ্যে কঠিন কন্ঠে বললো-
এই ভদ্রলোক(মাইক্রোর মালিক কে উদ্দেশ্য করে) দ্রুত যাওয়ার জন্য বেশ স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো।সামনে ছোট্ট অটোটাকেও পরোয়া করে নি।নিজের বিলাসবহুল গাড়িটি দিয়ে ধাক্কা মেরে দেয়।ফলস্বরূপ ড্রাইভারের মাথা ফেটে যায় আর সি এনজির বেশ ক্ষতি হয়।আশা করি ইনস্পেকটর সাহেব ওনার ক্ষতি পুষিয়ে দিবেন।
থেমে,
কোথাও সাক্ষর লাগলে বলুন, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
গলার ভেতর সমস্ত কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে সেলিমের।চোখটাও কেমন জ্বলছে।নিজেকে সামলে নিয়ে কাঞ্চনার উদ্দেশ্যে বললো-
আমাকে পাচ মিনিট সময় দিন।
বলেই পাশ থেকে একটা ফাইল বের করে সেখানে কিছু লেখা শুরু করলো।লেখার ফাকেই মনযোগ কে বিচ্ছিন্ন করে উচ্চ শব্দে বেজে উঠে ফোনের রিংটোন।কাঞ্চনা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে কোনো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পায় সাথে কোনো এক মহিলার কন্ঠ।বৃষ্টির কারনে নেটওয়ার্কের সমস্যার কারনে বাধ্য হয়েই স্পিকারটাকে লাউডে দেয়।সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে আসে_
কই তুই?প্রায় বারোটা বাজতে চললো।কখন আসবি বাড়িতে?এদিকে সুহা এখনো কিছু খাচ্ছে না।বারবার কাদছে।হয়তো তোকে দেখতে না পেয়েই।
কন্ঠকে বেশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কাঞ্চনা বললো-
তুমি ওকে আর কিছুক্ষণ সামলাও আমি আসছি।
___________
___________
ফোন কেটে দিলো কাঞ্চনা।সেলিমের লেখা শেষ হতেই ফাইলটাকে কাঞ্চনার সামনে দিয়ে নির্দিষ্ট এক জায়গায় সিগনেচার করতে বললো।কোনোরুপ বাক বিতন্ডা না করেই সেখানে একবার চোখ বোলালো।
শাস্তিস্বরূপ সকল ক্ষতিপূরণ মাইক্রোর মালিক দিবে এবং পরবর্তীতে এরকম ছন্নছাড়া হয়ে স্পিডে গাড়ি চালালে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হবে এমনটা পড়েই সেখানে সিগনেচার করলো কাঞ্চনা।
সময় ব্যয় না করেই ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে বাইরে চলে আসলো।
ম্যাডামকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসো।
কাঞ্চনা কক্ষ থেকে বের হতেই সেলিম নিচু কন্ঠে গম্ভীর ভাবে কনস্টেবল কে বলল।
দ্রুতপায়ে কাঞ্চনার সামনে গিয়ে বিরক্ত চোখে তাকালো কনস্টেবল। থমথমে কন্ঠে বললো-
স্যার আপনাকে বাড়ি পৌছে দিতে বলেছে।একা মেয়েমানুষ ক্ষতি হতে পারে তাই।চলুন।
অপমানে চিবুক শক্ত হয়ে এলো কাঞ্চনার।বজ্রকন্ঠে কন্সটেবল কে বললো-
আপনার স্যারকে গিয়ে বলবেন,কাঞ্চনা দুর্বল নয়।না আগে ছিল,আর না তো এখন।মেয়েদের সম্পর্কে এমন ভাবনাকে পরিবর্তন করতে বলবেন।আসি।
বলেই দ্রুতপায়ে সেখান থেকে চলে গেল।কথাগুলো বেশ উচ্চস্বরে বলায় সেলিম ও শুনতে পেল।না চাইতেই ঠোট এলিয়ে হেসে ফেললো সে।মনে মনে আওড়ালো”একটুও বদলাও নি তুমি”।
প্রতিদিন দশটার পরে বাড়ি পৌছালেও আজকে বৃষ্টির কারনে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলো সেলিম।বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হতেই কনস্টেবল আবার ঝামেলা নিয়ে হাজির হলো।সব ঝামেলা চুকিয়ে কাঞ্চনা যাওয়ার পরপরই বের হয়ে গেল থানা থেকে।
_________
_________
বাজার পেরিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকতেই হাত-পা শিরশির করে উঠলো কাঞ্চনার।বড় ভাইয়ের নাম্বারে ফোন দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বললো।প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে মোটরবাইক নিয়ে হাজির হয় কাঞ্চনার বড় ভাই সুজন মির্জা।বোনকে নিয়ে সোজা চলে যায় বাড়িতে।বসার রুমে ঢুকতেই বড় ভাবী চেচিয়ে উঠে বললো-
এতটা দেরী কি করে হলো তোমার?সেই তিনটার সময় ঘর থেকে বেরিয়োছে।ছয় টার মধ্যেই তো বাসায় ফেরার কথা।তোমাকে নিয়ে কি আমাদের চিন্তা হয় না।তোমার এই খাম খেয়ালি পনা কবে ছাড়বে বলতো পারো কাঞ্চনা?
ভাবী রেগে গেছে দেখে কাঞ্চনা আর কিছু বললো না।শান্ত স্বরে কোল থেকে দেড় বছরের ছোট্ট সুহাকে কোলে নেয় সে।এখনো ঘুমায় নি।কাঞ্চনার কোলে যেতেই ঢুকরে কেদে ওঠে সুহা।আদো আদো কন্ঠে বুলায়-মা*মু*নি*
বড় ভাইয়ের মেয়ে সুহা।এর আগে সাত বছরের একটা ছেলেও আছে।একসাথে থাকার ফলে মায়ের থেকেও ফুপিকে চেনে এই দুই ভাই বোন।মা না থাকলেও ফুপির কাছে থাকতে পারে কিন্তু ফুপিকে কিছুক্ষণ না দেখলেই ছোট্ট সুহা সারাক্ষণ কাদে।এমনকি ফুপির হাতেই খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এই দুই ভাইবোন।
রাত দুইটা।খাটের উপর শুয়ে কপালের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছে সেলিম।মাথায় শুধুমাত্র একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে”আর কিছুক্ষণ সামলাও আমি আসছি”।ফোনে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ও শুনতে পেয়েছে সেলিম।
বাচ্চাটা কি তাহলে কাঞ্চনার।তাহলে কি সে বিয়ে করেছে?
উফফ আর ভাবতে পারছে না।মাথা যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে।শেফালী চাচী খাবার দিয়ে গেছে সেই অনেক আগে।কিন্তু খাওয়ার কোনো রুচি নেই।এদিকে ওষুধ ও খেতে হবে।শেষে না খেয়েই ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো সেলিম।বিছানার পাশ থেকে ডায়েরিটা নিলো।পুনরায় পৃষ্ঠা গুলো উল্টাতে শুরু করলো।একসময় হারিয়ে গেল সেই সূদুর অতীতে।
____________
____________
তপ্ত দুপুর।ঘড়ির কাটা দেড়টায় ছুয়েছে।আধ মাঝারি এক টিনের ঘর।সামনের বারান্দা বাদে মোট দুটো রুম আর রান্নাঘর।মাঝের রুমের খাটে শোয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত চারুলতা বেগমের শিউরে বসে পাতলা খিচুড়ি খাইয়ে দিচ্ছে কাঞ্চনা।চারুলতা বেগমের মাথা পুরো টাক হয়ে আছে।কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীরের সব লোম, ভ্রু,পিসি, চুল ঝরে গেছে।গরমের ঘেমে -নেয়ে দ্রুতপায়ে হাতে কিছু ঔষধ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সেলিম।তাকে দেখা মাত্রই চট করে উঠে বসলো কাঞ্চনা।দম বন্ধ লাগছে তার।দ্রুতবেগে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেল তাদের বাড়ি থেকে।সেলিম একবার সেদিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মায়ের ঔষধ খাওয়াতে মনযোগ দিলো।
বিশাল এক বাড়ি।দেখতে মনে হচ্ছে এ যেন কোনো রাজবাড়ির চেয়ে কম নয়।এই জেলার নামকরা ইঞ্জিনিয়ার শামসুল মির্জা। ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতিচ্ছবি হিসেবে নিজের বাড়ি টাকেই একটা ভাস্কর্যে পরিণত করেছেন তিনি।দশ গ্রামের মধ্যে কোনো বাড়িতে এই মধ্যযুগে এতটা আধুনিকতা বা রুচিশীলতার প্রকাশ ঘটেনি।কিন্তু অত্যাধুনিক এই বাড়িতে মাত্র দুদিন বাস করতে পেরেছেন।এর মধ্যেই পরলোকগমন করেছেন।স্বামীর মৃত্যুর সাত দিনের মাথায় স্ত্রী ও চলে গিয়েছেন ওপারে।বেচে ছিলো একমাত্র ছেলে এবং ষোলো বছরের ছোট মেয়ে কাঞ্চনা।তাদের জন্য ব্যাংকে জমানো টাকা-পয়সার অভাব রেখে যাননি বাবা শামসুল মির্জা।আজ দু বছর পার হয়ে গেলেও এই বাড়িটা দেখে দীর্ঘ শাস ফেলে কাঞ্চনা।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন কহিনুর বেগম।ছেলেমেয়ে দুটোকে লালন-পালন এবং রান্নাবান্না করে খাওয়ানোর জন্যই এ বাড়িতে তাকে রাখা হয়েছে।
তোমারে কত্তবার বারন করছি ছোড আম্মা,এই ভাবে ভর দুপুরে কোথাও যাইয়ো না,তাও কথা শোনো না কেন?এমনিতেই তোমার গায়ের রঙ চাপা তার উপর রোদে পুড়লে আরো কালা হইয়া যাবা তো।
শাসনের সুরে বললো কহিনুর।
ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে কাঞ্চনা বললো-
তোমাকে কতদিন বলবো কাকি,এইসব কালা-ধলা নিয়ে আমার সামনে কথা বলবে না।আমি কালো হলে তোমার যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে রাখবা।
বলে হনহন করে দোতলায় উঠে গেল।সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো সুজন মির্জা।হেসে দিয়ে বললো-
কাকি,তুমি তো জানোই ও একটু জেদি।তারপরেও এতো কথা বলো কেন?
আমি তো খালি খালি কিচ্ছু কই না আব্বা।আম্মায় তো ওই চারুগো বাড়ি যাইয়া প্রায়ই বইসা থাহে।চারুর ক্যান্সার, হের সেবা যত্ন করে বইসা বইসা।আল্লাহ না করুক ওই রকম রোগীর ছোয়া লাগলে যদি খারাপ কিছু হয়।
দোতলায় বসেই চিৎকার করে কাঞ্চনা বললো-
কি হবে?আমার ও ক্যান্সার হবে।হলে হোক,তাতে তোমাদের কি?কি সব স্বার্থপরের মতো কথা বলো তোমরা?মজিদ চাচা সারাদিন দোকানে থাকে।নইলে সংসার চলে না।তাদের ছেলে যায় টিউশনি করাতে।চারু কাকি একা অসুস্থ মানুষ বাড়িতে থাকে।আমি গেলে তাতে তোমাদের কি সমস্যা?
কহিনুর বেগম উপর তলায় চেয়ে কাঞ্চনা কে বললো-
আমি তো আর এমনি এমনি বলি না আম্মা।পাড়ার সবাই কওয়া কওয়ি করে –
জোয়ান একটা পোলা আছে চারুর।আর তুমি জোয়ান মাইয়া সারাক্ষণ ওই বাড়ি গিয়া বইয়া থাহো। মানষে কি ভালভাবে এই সব নেয়। তুমিই কও আব্বা(সুজনকে উদ্দেশ্য করে)
পুনরায় তেতে উঠলো কাঞ্চনা।বললো-
মানুষ কি ভাবে, আমি প্রেম করি ওই বাড়ির ছেলের সাথে, নাকি বিয়ে করবো।কোনটা?যার যা ইচ্ছা সে সেটাই ভাববে।আমি কিছুর ধার ধারি না।তুমি পরের বার এই ধরনের পাড়া-প্রতিবেশীর কথা নিয়ে ঘরে বসে আমাকে জ্বালালে সারা রাত দিন ওই চারু কাকিদের বাড়ি বসে থাকবো।তখন দেখবো কি করো?
কথাগুলো বলেই হনহন করতে করতে রুমে ঢুকে গেল কাঞ্চনা।নিচে সোফায় বসে সুজন মির্জা বোনের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে।বোনটা তার একটু স্বাধীনচেতা হলেও খুব নরম মনের। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারে না।কিন্তু তার পরেও চারু কাকিদের বাসায় যাওয়ার অন্যতম কারন হলো সেলিম।প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে সেলিমকে দেখতে দেখেছে সুজন।অষ্টাদশী বোন যে সেলিমের প্রতি দুর্বল সেটা বুজতে তার একটুও অসুবিধা হয় না।বোন তার শ্যামকালো।কালকেই প্রস্তাব রাখবে মজিদ চাচার কাছে।সব দেখেশুনে যদি তারা রাজি হয় তাহলে আর দ্বিমত করবে না সে।খুব তাড়াতাড়ি পাড়ার মানুষের মুখ বন্ধ করা উচিত।
চলবে?
#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৩
আমার বোনটাকে কি আপনার ঘরের পুত্রবধু হিসেবে নিবেন মজিদ চাচা?
চমকে উঠলো মজিদ হাওলাদার। নিজেকে আরেকবার ধাতস্থ করে সুজন মির্জার দিকে তাকালেন।এ যেন ভাগ্য আজ নিরুপায় হয়ে তার সামনে ধরা পড়েছে।কাঞ্চনাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে আনা মানেই ঘরে লক্ষীর ঘট তোলা।মজিদকে নিরব দেখে পুনরায় সুজন বললো।
চাচা,আমার কাঞ্চনা শ্যামকালো।যদি এই গায়ের রঙের জন্য ওকে আপনি বা আপনার ছেলে পছন্দ না করেন তাহলে বলে দিবেন।অন্য জায়গা থেকেও কাঞ্চনার সম্বন্ধ আসে,সেখানেই বিয়ে দিবো। তাতে যা লাগে।
মজিদ হাওলাদার আমতাআমতা করে বলেই ফেললেন-
গায়ের রঙ না বাবাজি।তুমি তো জানো চারুর অবস্থা।চারদিকে ধার -দেনায় ভইরা গেছে।এই অবস্থায় আরো একজনের দায়িত্ব নেওয়া তো কঠিন হইয়া পড়বে।আর পোলাডাও তো বেকার।
মুখে আলতো হাসি ফুটিয়ে সুজন বলল-
চাচা এটা তো কোনো সমস্যাই না।আপনাদের যা লাগে আমি সব দেবো।এইসব নিয়া আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।তবে একটা অনুরোধ,কাঞ্চনা যেন জানে না।
চোখ চকচক করে উঠলো মজিদ হাওলাদারের।সুজনের হাত ধরে উত্তেজিত হয়ে বললেন-
নানা,এই সব চিন্তা করার কোনো দরকার নাই তোমার।আর আমিও চাই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার টা তোমার আর আমার মধ্যে থাকলেই ভালো হয়।
আমি কালকেই তোমারে পাকা কথা জানামু।
কথা শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সুজন হাওলাদার।মুখে মুচকি হাসি নিয়ে ভাবছেন-
যদিও এই বিয়েটা টাকার জন্য হবে।তবুও হোক না।বোনটা তো তার একটু সুখ পাবে।তাছাড়া হয়তো চারদিকের ধার-দেনায় মজিদ হাওলাদার একটু টাকার প্রতি লোভীই হয়ে গেছে।
দুপুরবেলা,চারুলতার পাশে বসেই মজিদ আর সেলিন দুপুরের খাবার খাচ্ছে।খাবার মাঝখানে মজিদ হাওলাদার বললেন-
সেলিম,আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি।আশা করি তুমি না করবা না।আমাগো সবার ভালোই হইবো এইটা হইলে।
চমকে উঠলো সেলিম।ভাত চিবুতে চিবুতে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো-
কি সিদ্ধান্ত আব্বা?
তোমার বিয়ের।
বলামাত্রই অবাক হয়ে তাকালো সেলিম।ভাত দলা হাত থেকে প্লেটে রেখে বাবার উদ্দেশ্যে বললো-
তুমি কি পাগল হইছো?এই সব কেমন ধরনের কথা।চারদিকে ধার-দেনায় ডুবু-ডুবু অবস্থা আর তুমি বিয়ের কথা বলতেছো।এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার উপর আবার আরেকজন।
থেমে,
আব্বা, আমি বিসিএসের প্রস্তুতি নিতেছি তুমি তো জানোই।দয়া করে এর ভেতর আর কোনো ঝামেলা ঢুকাইয়ো না।
নড়ে চড়ে উঠলেন চারুলতা।মা বসতে চাইছে দেখে দুহাত দিয়ে আলগোছে বালিশে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল সেলিম।চারু এক হাত তুলে সেলিমের মাথায় রেখে বললো-
ও আব্বা,তুই তো সারাদিন বাইরে থাকিস।তোর বাপেও দোকানে।আমার আর একা একা ভালো লাগে না।কাঞ্চন মা আইসা সারাদিন আমার কাছে বইসা থাকে।সারাদিন সেবা-যত্ন করে।খুব ভালো মাইয়াডা।তুই বিয়াডা কইরা নে আব্বা।
চমকে উঠলো সেলিম।তাহলে কাঞ্চনার সাথে তার বিয়ের কথা হচ্ছে।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
মা,তুমি তো তোমার ছেলের জন্য পরীর মতো বউ আনতে চাইতা।তাহলে এখন কাঞ্চনাকে বিয়ে কেন করাতে চাইছো।
আব্বা,আমি জানি তুই কাঞ্চন কালা দেইখা বিয়া করবি না।কিন্তু বাপ,আইজ তুই ধলা চামড়া দেইখা বিয়া করবি,হেই মাইয়া কাইল আইয়াই আমারে দেইখা নাক ছিটাইবো,ঘেন্না করবো আমারে।ও বাবা,এমনেও তো আর কয়দিন বাচমু।তুই কাঞ্চনরে বিয়া কর।মায় আর কিচ্ছু চাইবো না তোর ধারে।
খাবার রেখে উঠে গেল সেলিম।আর খাওয়ার মতো রুচি নেই তার।হাত ধুয়ে নিজের ঘরে বিছানায় শুলো।বিয়ে তো আজ না হয় কাল করতেই হবে।তাই বলে একটা কালো মেয়েকে।সকলেই সৌন্দর্য খোজে।আবার মায়ের কথাই ফেলা যায় না।সত্যিই তো যদি সুন্দরী বউ ঘরে আনে তারপরে সে যদি মাকে অবজ্ঞা করে তাহলে কি করবে সে।কাঞ্চনা আর যাই হোক,মাকে যে খুব ভালোবাসবে সে বিষয়ে নিশ্চিত সেলিম।সারারাত ভেবে চিনতে মায়ের একজব সংগী আনার জন্য বিয়েতে রাজি হয়ে গেল সেলিম।
বেশ ঘরোয়া ভাবেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো।তবে অনানুষ্ঠানিক ভাবেই সবার থেকে লুকিয়ে মজিদ হাওলাদার সুজন মির্জার কাছ থেকে পাচ লাখ টাকা আদায় করলেন সে বিষয়ে না কাঞ্চনা জানে আর নাতো সেলিম।সুজন ও হাসিমুখে বোনের জন্য সামান্য টাকা গুলো দিয়ে দিলো।কবুল বলার পরপরই বউ নিয়ে আসা হলো হাওলাদার বাড়িতে।সামান্য কিছু আত্নীয়-স্বজন এনে ঘরোয়া ভাবে বউভাতের আয়োজন করলো মজিদ হাওলাদার।
রাত সাড়ে দশটা।অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিয়ম পালনের জন্য বাসর ঘরে প্রবেশ করল সেলিম।দামী শাড়ি-গহনা পড়ে টিনের চালার নিচে সস্তা খাটের মাঝখানে বসে আছে কাঞ্চনা।ধীর পায়ে হেটে গিয়ে বসলো কাঞ্চনার পাশে।ভীষন অসস্তি লাগছে তার।তারপরেও কন্ঠে গম্ভীরতা এনে জিজ্ঞেস করলো-
ওই রাজকীয় বাড়িঘর ছেড়ে এই টিনের চালায় আসা টা কি খুব জরুরী ছিলো।আদোও কি রাজী ছিলে তুমি?নাকি জোর করা হয়েছে।
কাঞ্চনা মাথার ঘোমটা ফেললো।সেলিমের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি উত্তর দিলো।
আমার কোনো বিষয়ে কখনো কেউ জোর খাটাতে পারেনি।ভাগ্যে ছিলো প্রাসাদে জন্মে টিনের চালায় থাকতে হবে।তাই বিয়ে হয়েছে আপনার সাথে।
দমে গেল সেলিম।এই মেয়ের যে সবার আগে মুখ চলে সেটা আগে পাড়া-প্রতিবেশীর থেকে শুনলেও আজ সরাসরি শুনলো।নিজেকে ধাতস্থ করে বললো-
এই মুহুর্তে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিলো না।মা একা বাড়িতে থাকে,সে জন্যই বিশেষ করে তোমায় বিয়ে করা।তাছাড়া মাও চায় এটাই।আশা করি, মায়ের কোনো অবহেলা করবে না।আর এখানে অনেক আত্নীয়-স্বজন আছে,তাই কারো মুখের উপর জবাব না দেওয়াটাই শ্রেয় যদি আমার অসম্মান টা না চাও।
মুখে ভেংচি দিলো কাঞ্চনা।তবে সেটা সেলিমের অগোচরে।গায়ের গহনা গুলো খুলে হাতে নিয়ে সেলিমের টেবিলে রাখলো।ফিরে আসতেই দেখলো সেলিম কপালের উপর হাত রেখে শুয়ে পড়েছে।ভ্রু কুচকে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
আমার গায়ের রঙ নিয়ে কি আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে?
চটান করে হাত সরিয়ে কাঞ্চনার দিকে চাইলো সেলিম।কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো-
যদি সমস্যা থাকতো তাহলে সেটা বিয়ের আগেই বলতাম।বিয়েটা হুট করে হলেও আশা করি নিজেদের ব্যাক্তিগত রিলেশনটা হুট করে না হওয়াই ভালো।শুয়ে পড়,সময় দিলাম তোমায়।এই বাড়িতে থাকতে যদি কোনো অসুবিধা হয় তাহলে যথাশীঘ্রই বলবে।
মুখ খুলে উত্তরটা বলার আগেই সেলিম পুনরায় ধমক মারলো।বলল-
কথা বলতে বলে নি।চুপ করে ঘুমিয়ে পড়।যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে কাল সকালে বলো।
কাঞ্চনা আর টু শব্দটিও করলো না।সেলিমের ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।প্রায় আধ-ঘন্টা যাবৎ বিছানায় এপার-ওপার করে শেষে উঠে বসলো সেলিম।ঘরটায় মেয়েলি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।যেটা তার সহ্যশক্তি কে ক্ষণে ক্ষণে কমিয়ে তুলছে।শেষে বাধ্য হয়ে উঠে গেল পড়ার টেবিলে।বই খুলে নির্ধিদায় পড়তে লাগলো। একসময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।
___________
___________
সকাল সাতটা।ঘুম থেকে উঠে হাত -মুখ ধোয়ার জন্য পিছনের পুকুরপাড়ে গেল কাঞ্চনা।খেজুর গাছের ঘাট।তার উপর জমে আছে সবুজ শেওলা যা ঘাটকে আরাও পিচ্ছিল করে তুলেছে।অনভ্যস্ত কাঞ্চনা বেশ সাহস করেই নামলো ঘাটে মুখ ধুতে।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।উঠতে গিয়েই ঠাস করে উলটো হয়ে পড়ে গেল পুকুরের মধ্যে।ধড়াস করে পড়ার আওয়াজ হতেই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সেলিমের চাচি।মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলো-
আয়-হায় হায়।এই ভর-দুপুরে উঠছো গোসল করতে। আমগো সময় তো রাইত চারটার আগে গোসল করতাম। তোমাগো লজ্জাসরম ও নাই।কি জমানা আইলো।সকাল সকাল ফরজ গোসলটাও সবাইরে দেখাইয়া করতে হবে।
মাথা ফাকা হয়ে গেল কাঞ্চনার।প্রথমে কথার আগা-মাথা না বুঝলেও শেষে কথার ইংগিত ধরতে পেরেছে সে।কিছু বলার আগেই পিছন থেকে শুনলো-
তুমি ঘাটে নামলে কেন?পানির দরকার হলে আমাকেই বলতে পারতে।
চমকে পিছনে তাকালো কাঞ্চনা।সেলিম ঘাটে নামছে।শেষ খোপে পা দিয়ে হাত বাড়ালো কাঞ্চনার দিকে।একবার চাচী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে সেলিমের হাত ধরলো।ঘাট থেকে উপরে উঠতেই হাটুর ছিলে যাওয়া অংশটা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো।চোখটা পানিতে টলমল করছে। সেলিম এক দিয়ে ওর হাত ধরে গোসলখানায় নিয়ে এলো।স্বভাবতই গোসল করে এখানে পালটায় মহিলারা।
কাঞ্চনাকে রেখে দ্রুতপায়ে ঘরে প্রবেশ করলো।ব্যাগের মধ্য থেকে থ্রিপিস এনে কাঞ্চনার হাত দিলো।
পালটানো শেষ হলে পুনরায় হাত ধরে ঘরে আনলো।বিছানায় বসিয়ে মায়ের ঘর থেকে বায়োডিজেল আর তুলা আনলো।ছিলে যাওয়া অংশটা মুছে দিয়ে বললো।
ঘাটে নামার কোনো দরকার নেই।আমি বালতিতে পানি ভরে দিয়ে যাচ্ছি।আর একটু পরেই বাড়ির অতিথিরা চলে যাবে।তাদের সাথে তোমার কোনোরকম কথা বলার দরকার নেই।কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্যাস সেটারই উত্তর দেবে।এখন এখানেই বসে থাকো।
খালা নাস্তা করছেন।পুকুর থেকে পানি তুলে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা করলো সেলিম।তারপর কাঞ্চনার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলো।টেবিলের উপর নাস্তা রেখে বললো-
আমি টিউশনিতে যাচ্ছি।নাস্তাটা খেয়ে নিও।
কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।সেলিম যাওয়ার পর নাস্তা হাতে শাশুড়ির ঘরে ঢুকলো কাঞ্চনা।তার পাশে বসে গল্প পড়ছে আর অল্প কিছু নুডুলস হাত দিয়ে ডলে নরম করে মুখে তুলে দিচ্ছে চারুর।
প্রতিদিন বাপ-ছেলে কাজে যাওয়ার আগেই রান্না করে তারপর বের হয়।কিন্তু আজ আর তেমন হলো না।বেলা দশটা বাজতেই বাজার ভর্তি ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো মজিদ।বাড়িতে শুধুমাত্র কাঞ্চনা আর চারুর বোন অরু রয়ে গেছে।অরুর হাত ব্যাগ দিয়ে কাঞ্চনার সাথে হাসিমুখে দুটো কথা বলেই দোকানে গেলেন মজিদ।
প্রায় তিন কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ এনেছে মজিদ।শুনেই চারুর চোখ ছলছল করে উঠলো।মুখে ঘায়ের কারনে ঝাল খেতে পারে না সে।কাঞ্চনাকে ইলিশ মাছ খাওয়ার কথা বলতেই সে শাশুড়ির জন্য আলাদা ভাবে দু টুকরো মাছা ঝাল ছাড়া রান্না করলো।
দুপুর বেলা,সবাই মিলে চারুর ঘরে বসেই খাবার খাচ্ছে।কাঞ্চনা চারুকে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছে।তার সেবা যত্ন দেখে বেশ খুশী হলো সেলিম।খাবার শেষে ঘরে আসলো বিশ্রাম নিতে।কাঞ্চনাও আসলো।আজ সারাদিন খুব খাটনি পড়েছে তার উপর।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমেরা হানা দিলো চোখে।
হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচির শব্দ শুনতেই লাফ দিয়ে উঠলো।চারুর ঘর থেকে আওয়াজ আসছে।ওড়না গায়ে মাথায় জড়িয়ে দ্রুতপায়ে সেদিকে চললো।
গিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল সে।চারুর চোখ উলটে আসছে।মুখ দিয়ে ঘড়-ঘড় আওয়াজ আসছে।সেলিমের চোখ পানিতে টলমল করছে।মা মা বলে চিৎকার করছে আর কতক্ষণ পর পর মুখে চা চামচ দিয়ে পানি দিচ্ছে।কিন্তু সে পানি মুখ বেয়ে গালে গড়িয়ে পড়ছে।প্রায় বেশ কতক্ষণ এমনটা করতেই হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল চারুলতা।
চলবে?