#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী
এদিকে ইশান নিশ্চুপ থেকে ওদের কথা শুনছে।
সাদিফ নামটা শোনা মাত্রই রিশার চমকে ওঠা ওর দৃষ্টি এড়ায়না।
কিন্তু তানিশার বিষয়টা জানার জন্য ওর মন ঠিকই আঁকুপাঁকু করছে। কিভাবে রিশাকে কথাটা জিজ্ঞেস করবে ভেবে পায়না।
সাদিফ সেই কখন চলে গেছে। কিন্তু ইশানের এখনো তানিশার কথা জানা হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রিশাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, ” বেইবি, একটু আগের ঘটনা কি এই অধম জানতে পারে? ”
রিশা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইশানের দিকে।
” এই লু*চু ব্যাডা তানিশার খবর জেনে আপনি কি করবেন? ও মনে পরেছে, ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে কয়দিন যেন জিজ্ঞেস করেছিলেন তানিশার কথা? এবার বলুন আপনি ওকে চিনলেন কেমন করে? ”
ইশানের কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। কি উত্তর দিবে সে! শুকনা ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার।
” আমার মরিচের ফ্যাক্টরি, ধানিলঙ্কা, আমার প্রোডাকশনের গোডাউন তুমি মাইন্ড খাচ্ছো কেন! তোমার ফ্রেন্ডকে আমি একবার বখাটেদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। তখন থেকেই পরিচয়। এর বেশি কিছু নয়। আমি মাঝেমধ্যে ওর সাথে দুষ্টুমি করতাম এই যা। ” আলাভোলা মুখভঙ্গিতে বলে ইশান। রিশার ওর মুখাবয়ব দেখে ভিষণ হাসি পায় কিন্তু আর একটু বাজিয়ে দেখতে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, ” অন্যের বউয়ের সাথে কিসের দুষ্টুমি? বুইড়া বেটা, এতদিন একারনেই বিয়ে করেনি বোধহয়! খালি রাস্তার মেয়েদের সাথে লাইন মেরে বয়স বেড়িয়েছে! ”
এবার ইশান পারলে সেখানে বসেই হাউমাউ করে কাঁদে। মনে পরে বলে, কোন দুঃখে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। আমি নাকি বুড়া! আল্লাহ আরো দিন বাকি আছে, পরে না আর কত কিছু শুনতে হবে! ”
” কি বিরবির করছেন? আমাকে গালি দিচ্ছেন না কি? ”
” তওবা তওবা, তোমাকে গালি দিতে যাব কেন! তুমি আমার একটাই জান্স। আমিতো ভাবছিলাম এতক্ষণ যদি শপিংয়েই লাগে তাহলে আমরা কিভাবে পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ানোর কাজে লাগব! পৃথিবীর আমাদের থেকে কিছু পাওনা আছে। আমরা নিজেদের কাজে অবহেলা করছি বলে তোমার মনে হচ্ছেনা? ”
রিশা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ শুনছে কি না।
” ছিহ্ লু*চু বেডা। পাপী মন,মস্তিষ্কের পুরুষ। ”
ইশান রাজ্য জয়ের হাসি দেয়।
তানিশা অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছে। আজ পারলে দুই দিনের ছুটি নিবে। তূর্ণার জিদ চেপে গেছে দাদুকে দেখবে।
দুই-তিনমাস পরপর দূর থেকে দাদুকে দেখিয়ে আনে, তাতেই মেয়ের শান্তি।
তূর্ণা বিছানায় বসে বসে মাম্মার তৈরী হওয়া দেখছে।
” তোমাকে থুন্দল নাগচে ( তোমাকে সুন্দর লাগছে)।
মেয়ের কথায় মুচকি হেসে কোলে তুলে নেয়।
” তোমাকেও সুন্দর লাগছে মাম্মা। ঠিক যেন পরীর মত। ”
আজকে ওকে নিয়েই অফিসে যেতে হবে। কারন রিশার নানিমনি ঢাকা আছে, কাজের খালা আসবেনা। মেয়েকে আগেই তৈরী করে দিয়েছে।
মেয়েকে নিয়ে নিচে নামতেই কলিংবেল বেজে ওঠে।
” এখন আবার কে আসল! ” বলতে পারেনা দরজা খুলে দেয়।
কিন্তু সামনের মানুষটাকে দেখেই ভয়ানক চমকে উঠে। সে কি ঠিক দেখছে! না কি মস্তিষ্কের বিভ্রম মাত্র!
” পাপাই এথেথে! আমাল পাপাই! ( পাপাই এসেছে আমার পাপাই)
ছোট্ট পুতুলের মুখে পাপাই ডাক শুনে কেঁদে ফেলে সাদিফ। দু হাত সামনে বাড়াতেই ওর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তূর্ণা। লেপ্টে থাকে সাদিফের বুকে। সাদিফ আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকে মেয়েকে।
আর তানিশা যেন নিজের জায়গায় জমে গেছে। ওর নড়াচড়ার শক্তিটুকুও নেই। দু-চোখ ভরে দেখছে সামনের পুরুষটিকে। এত বছরেও একটুও বদলায়নি। সুদর্শন চেহারার মলিন মুখখানি যেন সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গালে অযত্নে বেড়ে ওঠা চাপদাড়িতে আরো আকর্ষনীয় লাগছে। এই পুরুষটি একান্তই ওর! কথাটা ভাবতেই তানিশার তনু-মনে শিহরণ জাগায়।
আর এদিকে মেয়ের সাথে দরজায় দাঁড়িয়ে খুনসুটির ফাঁকে ফাঁকে তানিশাকে দেখছে সাদিফ। তার চেহারায় মাতৃত্বের প্রবল ছাপ দেখে তৃপ্ত হয়। আগের থেকে ওজন বেড়েছে, সেই সাথে চেহারার উজ্জ্বলতাও। তার রমনী আজ তার সামনে এক নতুন রুপে আবির্ভূত হয়েছে! লাস্যময়ীর রুপের অগ্নিচ্ছ্বটায় আজ ভীষণভাবে পু*ড়*তে ইচ্ছে করছে।
দরজার দুইপাশে দুইজন নিজেদের কল্পনার জাল বুনছে।
” পাপাই লুমে তলো (পাপাই রুমে চলো)। ”
মেয়ের কথায় দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় তানিশা। তানিশা বেশ বুঝতে পারছে আজ আর অফিস
যাওয়া হচ্ছেনা। বাপ-মেয়ের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা ছাড়া দুনিয়ায় তৃতীয় কোন মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
তানিশা সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে সাদিফ না খেয়েই এসেছে।
তানিশা রান্না করতে করতে ভাবছে সাদিফ ওর ঠিকানা জানলো কেমন করে! রিশা দিয়েছে?
তূর্ণা পাপাইয়ের সাথে খেলতে খেলতেই ঘুমিয়ে পরেছে। সাদিফ ওকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে পাহারা দিচ্ছে।
তানিশা পরোটা আর গরম গরম মাংস ভুনা টেবিলে রেখে সাদিফকে ডাকতে আসে।
” ফ্রেশ হয়ে আসুন। টেবিলে খাবার দিয়েছি। ”
” কি! ও হ্যাঁ, চার বছর কিছুই খাইনি। তাই আজ এখানে খেতে এসেছি। তা মিসেস তানিশা মেহজাবিন চৌধুরি, সরি সরি মিস তানিশা মেহজাবিন শেখ। আচ্ছা এখন নামের শুরুতে কি লিখেন মিস না মিসেস? জানা থাকতে ডাকতে সুবিধা হত। ”
সাদিফের ভাবভঙ্গি খুব একটা ভালো লাগেনা তানিশার কাছে।
” আমার জীবন থেকে চার বছর কেড়ে নিয়েছেন আপনি। আপনার জীবন থেকেও কি নয়? এই চার বছরের এমন একটা রাতও যায়নি যেদিন আমি কাঁদিনি, না খেয়ে থাকিনি। কেন কেঁদেছি? কেন খাইনি? আপনার জন্য, শুধু আপনার জন্য। কই তখন তো আমার জন্য খাবার নিয়ে আসেননি আপনি? আমার কান্নায় আপনার ভালোবাসার প্রলেপ লাগাননি? আজ যখন সামনে এসেছি তখন খুব দ্বায়িত্ববান হওয়ার চেষ্টা করছেন? নাকি করুণা করছেন? এই কে চেয়েছে তোর করুণা! তুই একটাবারও ভেবে দেখেছিস কি অবস্থায় আমি দিন-রাত গুলো কাটিয়েছি। যখন বুঝলাম ভুল করেছি, ধীরে ধীরে তোকে মেনে নিতে শুরু করেছিলাম তখনই তুই আমাকে নিঃস্ব করে হারিয়ে গেলি। একটাবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিলিনা। বাবার অসুস্থতায় যখন তোকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল তখন তুই চোরের মতো লুকিয়ে গেছিস। কত অসহায় পিতা আমি! যখন জানলাম বাবা হবো তুই তখন অনেক দূরে। ওর বেড়ে ওঠা আমি দেখতে পেলামনা। ওকে ছোঁয়ার অনুভূতি আমাকে জানতে দিলিনা। সবকিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছিস তুই। আমাকে যদি শাস্তিই দেয়ার ছিল, কাছে থেকে শাস্তি দিতি। অন্তত মনকে এই বলে মানাতাম, তুই আমার চোখের সামনে আছিস। বল, কেন করলি এমন? ” সাদিফের দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে।
তানিশাও ভয়ে মাথা নিচু করে আছে। তার চোখেও পানি।
” তোর প্রয়োজন আমাকে শাস্তি দেয়া, তাইনা? যা ব্যাগ গুছিয়ে নে। আমার সাথে ঢাকায় যাবি, সেখানে গিয়ে যত ইচ্ছে শাস্তি দিবি। অন্যায় যখন করেছি তার শাস্তিও পেতেই হবে। চল জলদি কর। ”
তানিশা হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সাদিফকে এমন রুপে আজ প্রথম দেখছে ও। কিন্তু মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে তানিশার বড্ড মায়া হয়।
” আপনি আগে খেয়ে নিন। আমি এরপর সব গুছিয়ে নিচ্ছি। ”
” আবারও একই কথা বলছে দেখি! এই তুই শুনতে পাসনা? নাকি আমার ক……. সাদিফকে শেষ করতে না দিয়েই হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ডাইনিং টেবিলের কাছে। চেয়ার টেনে জোর করে বসিয়ে দেয়।
” আগে পেট ঠান্ডা করুন। এরপর যত ইচ্ছে তত বকুনি দিন। ” প্লেটে পরোটা দিতে দিতে কথা বলছে। সাদিফ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার রমনীর দিকে। এই রমনী তার নিজস্ব সম্পদ, কথাটা ভাবলেই সব রাগ উবে যায়।
গতকাল দুপুর থেকে না খাওয়ায় পেটে ক্ষুধার পরিমান যথেষ্ট বেশি। তাই আর উচ্চবাচ্য না করে খেতে শুরু করে। আহ! কতদিন পর সেই মজাদার খাবার খাচ্ছে। খাবারের প্রতিটা কোনায় যেন অমৃত মাখা রয়েছে।
তানিশা ঠোঁটে হাসি নিয়ে দেখছে সাদিফের তৃপ্তি সহকারে খাওয়া।
ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে মেয়ের কাছে যায়। তূর্ণা ততক্ষণে জেগে গেছে। সাদিফ মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখে। মেয়েও চুপচাপ বাবার আদর খাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎই সাদিফের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়।
” প্রিন্সেস, তুমি আমাকে চিনলে কিভাবে! আমাকে তো আগে দেখনি! ”
তূর্ণা ঝুঁটি দুলিয়ে হেসে জবাব দেয়, ” তোমাল থবি দেতেচি ( তোমার ছবি দেখেছি)। মাম্মা সব থময় তোমাল ছবি দেথে তাঁদত আল আমাতে বলত ইতা তোমাল পাপাই ( মাম্মা সব সময় তোমার ছবি দেখে কাঁদত আর আমাকে বলত এটা তোমার পাপাই)। ”
সাদিফ মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে।
এদিকে তানিশার তো লজ্জায় ম*রি ম*রি অবস্থা।
” এই মেয়ে মানসম্মানের দফারফা করে দিবে দেখছি! কি বজ্জাত মেয়ে! মানুষ করলাম আমি, আদর দিলাম আমি আর সে একদিনের দেখা বাপকে সব উগরে দিচ্ছে! ” মনে মনে বকবক করছে তানিশা।
” আমি ব্যাগ গোছাতে বলেছি অনেক আগেই।তোমার যদি যাওয়ার ইচ্ছে না থাকে তবে ওয়েলকাম। তবে সেক্ষেত্রে আমি প্রিন্সেসকে নিয়ে চলে যাব। আর যদি যাওয়ার ইচ্ছে থাকে তবে মোস্ট ওয়েলকাম। দশ মিনিটে রেডি হও। দশ মিনিটের এক সেকেন্ডও দেরি হলে আমি প্রিন্সেসকে নিয়ে বেরিয়ে যাব। ”
তানিশা কথা শেষ হওয়া মাত্র দৌড়ে রুমে আসে। আলমারি থেকে ব্যাগ নিয়ে সব গোছাতে শুরু করে। গোছানোর ফাঁকে ফোন দেয় কাজের খালাকে, অফিসে। সবাইকে জানিয়ে দেয় সে সিলেট ছাড়ছে। অফিসে রিজাইন লেটার দুই-এক দিনেই পাঠানোর কথা বলে।
সবশেষে ফোন দেয় রিশাকে। কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে। জানিয়ে দেয় ও ঢাকা ফিরছে।
গোছানো শেষ করে ব্যাগ নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। একটা ব্যাগ রেখে আবার ভেতর যেতে লাগলে সাদিফ মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে তানিশার পিছুপিছু যায়। রুমে আরো দুইটা ব্যাগ রাখা। সাদিফ স্বশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাগদুটো দুই হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। একে একে সব গাড়িতে তুলে। তানিশা বাসা ভালোভাবে লক করে, কেয়ারটেকার চাচার কাছে চাবি দেয়।
এরপর রওনা দেয় চিরচেনা সেই গন্তব্যে। সারা রাস্তা বাপ-মেয়েতে মিলে কতশত গল্প, কত খুনসুটি করল! তানিশা শুধু দেখে যায়।
ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে যায়। সাদিফ খুব ধীরে ড্রাইভ করেছে। তারপর বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মেয়েকে আশপাশ দেখিয়েছে। এতে করেই একটু দেরি হয়েছে।
গাড়ি যতই চৌধুরী বাড়ির নিকট যাচ্ছে তানিশার ততই বুক কাঁপছে। না জানি কি হয়!
শায়লা চৌধুরী রাতের রান্না করছে। সাইরাও সাহায্য করছে মাকে। তবে তিনি বেশ চিন্তায় আছেন। গতকাল থেকে সাদিফ বাসায় ফিরেনি। ফোন করলেই বলেছে ব্যস্ত আছে। ছেলেটা কখন আসবে কে জানে!
ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। সাইরাকে রান্নার দ্বায়িত্ব দিয়ে শায়লা চৌধুরী দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলতেই তার চোখ ফেটে পানি ঝরতে থাকে।
” সামনে সাদিফের কোলে একটা জীবন্ত পুতুল ঠিক যেন ছোটবেলার সাদিফের কার্বন কপি! পাশেই তানিশা। ”
শায়লা চৌধুরী হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। তার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকেনা। একবার নাতনিকে কোলে নিয়ে আদর করছেন তো আরেকবার তানিশার মুখ-মন্ডলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শায়লা চৌধুরীর কান্নার আওয়াজে সাইরা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে তানিশাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। একি! সাইরাও যে কাঁদছে! এত ঝাটকা একসাথে নিতে কষ্ট হয় তানিশার। ওকে ভিতরে নিয়ে আসে সাইরা। সরাসরি নিয়ে যায় বাবার কাছে। জামিল চৌধুরী বিছানায় আধাশোয়া হয়ে বাম হাতে পত্রিকা নিয়ে পড়ছিলেন। তানিশাকে দেখেই তিনি হাউমাউ করে কিছু একটা বলতে লাগলেন। তানিশা সোজা এসে শ্বশুরের পাশে বসে জড়িয়ে ধরে । জামিল চৌধুরী আনন্দে কাঁদছেন। শায়লা চৌধুরী এসে নাতনিকে তার কাছে দিলেই, তূর্ণা আধোআধো গলায়, ” দাভাই বলে ডাক দিয়ে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে। ” সকলে অবাক হয়ে যায় তূর্ণার আচরণে।
অথচ তারা কেউই বুঝতে পারছেনা এই মেয়েকে নিয়ে প্রতিমাসেই তানিশা ঢাকা আসত। বিকেলে যখন জামিল চৌধুরীকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতে তখন দূর থেকে মেয়ে দেখত তার দাদুকে। এতেই সে চিনে রেখেছে দাদুকে।
শায়লা চৌধুরী তখন তূর্ণাকে জিজ্ঞেস করে, ” তুমি দাদুকে চিনো সোনা পাখি? ”
তূর্ণা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ” আমি মাম্মাল ছাতে দাভাইকে দেকতে আথতাম তো। দুল থেকে দেকতাম। (আমি মাম্মার সাথে দাভাইকে দেখতে আসতাম তো। দুর থেকে দেখতাম।) ”
পেছনে দাঁড়ানো সাদিফের কথাটা শুনে বুকের ভিতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। তার মেয়ে আসত অথচ সে জানতনা। আর একই সাথে তানিশার উপর রা*গ উঠে। এই বে*য়া*দ*ব মেয়ের সাহস কত! সে মেয়েকে নিয়ে এসেছে অথচ বাবার সামনে আসেনি!
তানিশা আড়চোখে সাদিফের দিকে তাকাতেই দেখল সাদিফ ওর দিকেই ঈগলের চোখে তাকিয়ে আছে। তানিশা শুকনো ঢোক গিলে অন্য দিকে তাকায়।
রাতে সবার খাওয়া শেষ হলে যে যার মত নিজের রুমে যায়। সন্ধ্যার পরপরই সাইরা শ্বশুর বাড়িতে ফিরে গেছে। আবার কয়েকদিন পর আসবে বলে গেছে।
তূর্ণা ওর বাবার সাথে ওদের রুমে খেলছে। তানিশা ড্রয়িংরুমে বসে বেশ খানিকক্ষণ রহিমা খালার সাথে গল্প করে। এদিকে রহিমা খালার ঘুম পাওয়ায় সেও ঘুমাতে গেছে। তানিশা পরেছে ফ্যাসাদে। কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। বাধ্য হয়ে টিভি ছেড়ে চ্যানেল পাল্টাতে থাকে।
তূর্ণা ঘুমিয়ে গেলে সাদিফ ওকে শুইয়ে দিয়ে নিচে আসে তানিশার খোঁজে। তানিশাকে বিরতিহীন চ্যানেল পাল্টাতে দেখে বেশ বুঝতে পারে তানিশা রুমে যেতে সংকোচবোধ করছে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আপনমনেই বলে, ” কেউ ঘুমাতে চাইলে রুমে আসতে পারে। আর যদি একান্তই সোফায় ঘুমাতে চায় এতে আমার অবশ্য আপত্তি নেই। কারন মেয়েকে নিয়ে আমি আরাম করে বিছানায় ঘুমাতে পারব। ”
” আমি প্রোগ্রামটা শেষ করেই আসছি। ”
সাদিফ স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখল অ্যাড চলছে। আরকিছু না বলে মুচকি হেসে রুমে আসে।
তানিশা অনেকক্ষণ ধরে চ্যানেল পাল্টিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে।
অগত্যা উপায় না দেখে গুটিগুটি পায়ে রুমে আসে। সাদিফ ততক্ষণে মেয়েকে মাঝখানে শুইয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। তানিশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়ের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে।
গভীর রাতে কপালে উষ্ণ পরশে ঘুম ভেঙে যায় তানিশার। সাদিফ ওর মুখটা দুহাতের আঁজলায় ধরে পরপর কয়েকটা চুম্বন আঁকে কপালে। তানিশা ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকে।
” লাভ ইউ জানপাখি। খুব বেশি ভালোবাসি তোমাকে। তুমি না চাইলে তোমার কাছে আসবনা আমি। আগের সেই সাদিফ এখন আর নেই। সে বদলে গেছে। তোমার অনুপস্থিতি তাকে বদলে দিয়েছে। ” সাদিফের আবেগে জড়ানো কথায় মুচকি হেসে পাশ ফিরে শোয় তানিশা।
ওর হৃদয়ে অজানা অনুভূতিরা দোলা দিচ্ছে। এই সাদিফকেই তো একটা সময় চেয়েছে। এই সাদিফের বাহুডোড়ে নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছে বারবার। তবে কি আজ সেই স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে!
চলবে……