মারিয়া,পর্ব:১৬

0
479

“মারিয়া”
পর্ব:- ১৬
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
~~~~~~~~~~~~~~~

দরজায় করাঘাতের শব্দে সুরাইয়া বেগম আঁতকে উঠেন। এই সময়ে কে এলো? ভাবতেই তার গা বেয়ে একটা হিম শীতল বাতাস বয়ে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে নগ্ন শরীরে কাপড় তুললেন। বিছানায় আধশোয়া থাকা অর্ধউলঙ্গ লোকটিকে বললেন,
“দেখছেন কী? জলদি লুকিয়ে পড়ুন। পোড়া কপাল! কে আসলো?”
শরীরে কোনরকম করে কাপড় জড়ালেন তিনি। একনাগাড়ে কে যেন কলিং বেল বাজাচ্ছে। দ্রুত পায়ে দরজা খুলে দিতেই তার চক্ষু ছানাবড়া! এ কী দেখছেন তিনি? তার ছেলে শান্ত দরজায় দাঁড়িয়ে… তখনও তিনি ব্লাউজ পরেননি, শাড়ির ফাঁক দিয়ে শরীরের ভাঁজ বুঝা যাচ্ছে। শান্ত ওতকিছু খেয়াল করেনি। বাচ্চা মানুষ, এসেই মাকে জরিয়ে ধরলো। বাহির থেকে ব্যাগ আনতে আনতে বলল,
“কতদিন তোমায় দেখি না, ওদিকে বুবুও আমাকে একদম ভুলে গেল!”

তখনই ভেতর রুম থেকে লোকটি উঠে আসলেন। লোমশ বুকে হাত বুলাতে বুলাতে এগিয়ে এসে বললেন,
“কে এলো?”
অপরিচিত কণ্ঠ শুনে শান্ত ঘুরে তাকায়। মায়ের রুমের সামনে লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে অবাক হয়। মায়ের দিকে তাকাতেই খেয়াল হয়, মা তো ঠিকমতো কাপড় পরা নেই। ভাবতেই তার গা ঘিনঘিন করে উঠে! এসব কী?
শান্তর ভেতর অশান্ত হয়ে যায়। রোবটের মতো স্থির দু’পায়ে ভর দিয়ে রইলো সে। মায়ের দিকে আবার তাকায়, তিনি মাথা নিচু করে নিজের গা ঢাকার চেষ্টা করছেন। শান্ত শক্ত মেজাজে বলল,
“এর মানে কী আম্মু? এজন্যেই আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়েছিলে? আব্বু কই?”
সুরাইয়া জবাব দিতে পারলেন না। শান্ত তেড়ে এসে বলল,
“আমি কি জিজ্ঞেস করি? আমার বাবা কই?”
সুরাইয়া কখনওই তার ছেলেকে এত গরম মেজাজে কথা বলতে দেখেননি। তার পিত্তি চমকে উঠে! ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলেন।

লোকটি ভেতরে গিয়ে কাপড় পরে আসেন। কাউকে কিছু না বলেই সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দেখতে পেয়ে শান্ত কড়া গলায় তাকে ডাক দিলো,
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন? পরকিয়া করতে আসছেন? আপনার ঘরে বউ বাচ্চা নাই? আরেকজনের ঘর নষ্ট করেন আপনি! লজ্জা করে না আপনার?”

লোকটির ভীষণ রাগ উঠে। সেও শান্তর দিকে ছুটে আসে। বলল,
“কাকে কী বলছ? কার ঘর আমি নষ্ট করি? আর কীসের পরকিয়া?”
শান্ত অবাক হয়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,
“আমার চোখের সামনে আপনি আমার মায়ের রুম থেকে বের হলেন। তাও আবার খালি গায়ে। আপনার প্যান্টের হুক খোলা। আমার মায়ের গায়ের শাড়ি ঠিক নেই। এরপরও আপনি অস্বীকার করছেন?”
লোকটি এবার তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“দেখো ছেলে, আমি কারও ঘর নষ্ট করতে আসিনি। এর বদলে না আমি হাজার খানেক টাকা দিয়েছি। আর তোমার মাকে আমি ঘণ্টার জন্য ভাড়া করেছিলাম। ঠিক আছে? কোনো পরকিয়া করি না আমি। এর সাথে তো আমার কখনও কথাও হয়নি। আমি আমার কাজ করে টাকা দিব, শেষ এরপর।”
লোকটি যেন শান্তর কানে গরম শিশা ঢেলে দিয়েছে। শান্ত তখনও স্থির, ঠায় দাঁড়িয়ে। তার মুখে কোনো রাও ফুটছে না… কী শুনলো সে?

লোকটি চলে গেল। সুরাইয়া একবার ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। শান্তও তার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে। আগুন বুঝি ঠিকড়ে বের হচ্ছে। ভয়ে তিনি কুঁকড়ে যান। শান্তকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। শান্ত ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে সামনে এগিয়ে আসে। মায়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার বাবা কই? তার থেকে লুকিয়ে তুমি এইসব করছিলে?”
সুরাইয়া মিনমিন করে বললেন,
“তোমার বাবা মারা গেছেন।”
শান্তর হৃদস্পন্দন বুঝি থেমে গেল! দিশেহারা হয়ে সে এদিক ওদিক তাকালো। হা করে কতক্ষণ উপরে তাকিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
“বাবা মারা… কী বলছ তুমি? বাবা… কীভাবে?”
শান্তর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঠিক করে প্রশ্নও করতে পারছে না সে। সুরাইয়া বেগম চোখের পানি মুছে বললেন,
“একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি।” বলে তিনি কাপড় বদলাতে চলে গেলেন। শান্ত লজ্জায়, রাগে, ক্ষোভে দম বন্ধের মতো পড়ে আছে। তাদের সুখের ঘরটায় এ কার বদনজর লাগলো…?

🍁

সুরাইয়া বেগম এসে ছেলের পাশে দাঁড়ালেন। আমতা আমতা করে বলতে শুরু করলেন,
“আমি পারছিলাম না সব কাটিয়ে তুলতে। তোমাদের বাবা তো এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আরামে পড়ে ছিল। খরচ পাতি কে করছিল? তোমাদের দু’ভাইবোনের খরচ, ঘরের খরচ, তোমাদের বাবার চিকিৎসার খরচ… জমানো টাকায় একটা মানুষ ক’দিন চলতে পারে? আমি কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তোমার বোন চলে গেল কাজের দোহাই দিয়ে। কোথায় সে? আজ অবধি একটা টাকা পাঠিয়েছে সে? আজ অবধি একটা কল দিয়েছে? নিজের মতো সে খুশিতে আছে হয়তো। আর এদিকে? একবেলা খাওয়ার আগে চিন্তা করেছ? এই যে খাচ্ছ। খাওয়ার টাকাটা কই থেকে আসছে? পারি নাই আর। ওষুধের পেছনে এত টাকা ঢালতে পারব না। ওষুধ ছাড়াই সে যতদিন বাঁচার বেঁচেছে। এরপর? এরপর দিনাতিপাত করার জন্যও তো খরচ দরকার?”
বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
শান্তর এখনও এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে কোনরকম চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। ধীর কণ্ঠে বলে,
“পৃথিবীতে সংসার চালাতে, খরচ উঠাতে আরও কত হালাল পথ আছে। সেগুলোর মধ্যে একটা বেছে নিতে পারতে না? তাহলে আজ আমার চোখে এত ঘৃণার শিকার হতে না…”

শান্তর কথায় যুক্তি আছে। সুরাইয়া বেগম মানেন সে চাইলে ভালো কাজ করে আজ খেতে পারতো। কিন্তু অল্পবয়সে নিজের থেকে ২০ বছরের বড়ো পুরুষের সাথে বিয়ে। অল্পবয়সে দুটো বাচ্চার মা হওয়া… তার নিজেরও একটা শারীরিক চাহিদা ছিল। শান্তর কথা যুক্তিযুক্ত হলেও তিনি ক্ষেপে বললেন,
“আমাকে বুঝাতে আসবা না!”
শান্তও পাল্টা বলল,
“খবরদার আমার উপর কোনো অধিকার খাটাতে আসবে না। পতিতাবৃত্তি করতে হলে পতিতালয়ে যাও! আমার বাবার বাসায় তুমি একদিনও আর এই নোংরা পায়ে হাঁটবা না! খবরদার! খুনি তুমি! আমার বাবাকে মেরে ফেলেছ তুমি!”
শান্তর রুক্ষ ব্যবহারে সুরাইয়া বেগম দমে গেলেন। তার নিজের ছেলে কি তাকে পতিতা বলল? অবশ্য দোষ কোথায়? অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি… নিজের ভেতর অপরাধবোধ জাগলেও ছেলের সামনে তিনি সেটা প্রকাশ করতে পারছেন না।

🍁

একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙলো ইয়াসিরের। রোদের তীব্রতা তার চোখেমুখে একদম লেপ্টে গেছে। আর ঘুমাতে পারলো না সে। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বারান্দার কাউচে আবিষ্কার করে। রাতে এখানেই ছিল। মারিয়ার কথা মনে পড়তেই দ্রুত ফোন হাতে নেয় সে। রাফির ২১টা মিসড কল। আর শেষে একটা মেসেজ,
“I need to go somewhere… Rimi is here… come soon..”

তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। পকেটে নিজের আর মারিয়ার ফোন দু’টোই ঢুকায়। এরপর তড়িঘড়ি করে খালি মুখেই বাসা ত্যাগ করে। হাসপাতালে পৌঁছতেই রিমি তার কাছে ছুটে আসে।
“তোরা দুই বন্ধু কই চলে গেলি? আমি এখানে একা পড়ে ছিলাম সারারাত। এর উপর পরিচিত কেউ নেই!”
ইয়াসির রিমির দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো। মুখে বলল,
“তোকে অনেক ধন্যবাদরে। সারারাত এখানে মারিয়ার জন্য ছিলি।”
বলেই সে রিমির দিকে হাসি দিয়ে আইসিউর দিকে পা বাড়ায়। ডাক্তার মাত্র রুম থেকে বের হলেন। ইয়াসিরকে দেখতে পেয়েই বললেন,
“ইয়াসির। কাম ফাস্ট। উই নিড টু টক উইথ পেশেন্ট’ স ফ্যামিলি ম্যাম্বার। হার কন্ডিশন ইজ টু মাচ হার্ড!”
ইয়াসির চমকে গেল। ডাক্তারের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”
ডাক্তার হতাশ সুরে বললেন,
“ইয়াহ। মারিয়ার এখনও হুঁশ আসছে না। যে কোনো মুহূর্তে কিছু হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।”

ডাক্তার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইয়াসির থমকে গেছে। সে কী করবে এখন? অমনি আইসিইউ থেকে নার্স ছুটে এলো। ডাক্তারকে কাছে পেয়েই দ্রুত বলল,
“স্যার, পেশেন্ট মারিয়া ইজ ব্যাক নাও। সে চোখ খুলেছে।”
ডাক্তার হতবম্ব হয়ে গেলেন। ইয়াসিরের দিকে ফিরে বললেন,
“ইউ আর সো লাকি!”
নার্সও একবার তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। পরক্ষণেই দৌড়ে তারা কেবিনে ঢুকে। ইয়াসির তখন চুপসে গেছে। রাফির অপেক্ষায় সে… রাফি কোথায়? এই মুহূর্তে রাফিকে তার খুব প্রয়োজন। ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,
“তুই জানিস? আমার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল! আমার চোখের সামনে আমি অন্ধকার দেখছিলাম…”
কিন্তু রাফি নেই! ফোন বের করলো ইয়াসির। রাফিকে কল দিলো। ফোন সুইচ অফ!

পিছন থেকে রিমি আসলো। ইয়াসিরের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“মারিয়ার বাসায় খবর দিবে না? ওর পরিবারকে জানানো দরকার তো?”
রিমির কথায় মাথা নাড়ায় ইয়াসির। মারিয়ার ফোন বের করে ডায়াল প্যাড চেক করে। সবার উপরেই ছোটু নামে একটা নাম্বার, অনেকবার কল দিয়েছিল। নিজের ফোনে নাম্বারটা টুকে সে কল দিলো…
রিমি পাশে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়াকে এসে ওর পরিবার তাড়াতাড়ি নিয়ে যাক। তবেই রিমি বাঁচে!

🍁

শান্ত তখনও ডাইনিং রুমে। চেয়ারে বসে ঢকঢক করে পানি গিলছে সে। সুরাইয়া বেগম নিজের রুমে। ফ্রিজ খুলে শান্ত। ফ্রিজভর্তি খাবার! তাচ্ছিল্যের স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
“এখন তো টাকার অভাব নেই!” হাত বাড়িয়ে খাবার বের করতে গেলেই সে থেমে যায়। এই নোংরামির টাকার কেনা খাবার সে মুখে তুলবে? কোনোদিনও না! ঠাস করে ফ্রিজের দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমের কাছে যেতেই পকেটের ফোন বেজে উঠে। সুরাইয়া বেগম রুম থেকে একবার বাহিরে তাকায়। আবার নিজের কাজে মনোযোগী হোন।
ফোনের ওপাশে ইয়াসির বলল,
“আপনি কি মারিয়ার পরিবারের কেউ?”
শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে জি বলল। ফের তাকে প্রশ্ন করে,
“আপনি কে?”
“দেখুন, আমি মারিয়ার বন্ধুর মতোই। ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনারা কাইন্ডলি আসতে পারবেন? ও হাসপাতালে ভর্তি।”
মুহূর্তেই শান্তর চেহারার রঙ পাল্টে যায়। সে ধরা গলায় বলল,
“কোথায় বুবু? কীভাবে হলো? এখন কেমন আছে বুবু?”
ইয়াসির আশ্বস্ত করে বলল,
“দেখুন, আপনার বুবু ঠিক আছে। আমি আপনাকে ঠিকানা দিচ্ছি। আপনি আসুন।”

ফোনে ঠিকানা পাঠায় ইয়াসির। সুরাইয়া বেগম রুম থেকে বেরিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে মারিয়ার?”
নিমিষেই যত রাগ সব মায়ের দিকে ছুঁড়ে মারে শান্ত। যতটুকু পারে গলার জোর বাড়িয়ে বলে,
“বলেছিলে না, আমার বোন টাকা কেন পাঠায় না? ফোন কেন দেয় না? সে নিজেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। সব তোমার দোষ! তোমার পাপের বোঝা নিশ্চিত আমার বুবুর ঘাড়ে পড়েছে!”
বলেই সে নিজের রুমে চলে যায়। পার্সোনাল ড্রয়ারে কিছু টাকা জমা ছিল। সেগুলো উঠিয়ে নেয়। গুনে দেখে তিন চারেক হাজার।হাসপাতালের খরচও হয়তো আছে। বের হবে সে মুহূর্তে সুরাইয়া বেগম তাকে দাঁড় করালেন। ভেতর থেকে আলমারির তালা খুলে স্বামীর জমানো কিছু টাকা নিয়ে আসেন। শান্তর হাতে ধরিয়ে বললেন,
“এগুলো নোংরা টাকা না। তোমাদের বাবার উপার্জনেরই। শেষ কিছু রেখেছিলাম। এটা নিয়ে যাও অন্তত।” শান্ত হাত বাড়িয়ে টাকাটা নেয়। মায়ের সামনেই ইয়াসিরকে ফোন দেয়। ভেজা গলায় বলল,
“শুনুন, আপনি একটু আমার বুবুর পাশে থাকবেন প্লিজ। আমি আসছি… আপনি আমার বুবুকে একা রেখে কোথাও যাবেন না দয়া করে। ও অনেক ভয় পায় একা থাকতে!”
ফোন কেটে যায়। শান্ত মায়ের দিকে না তাকিয়েই বের হয়। তার এখন অন্যকিছু দেখার সময় নেই। জলদি বাস ধরতে হবে তাকে!

ওপাশে ইয়াসির শান্তর কথায় হারিয়ে যায়। সে ভীত গলায় বলছিল, আমার বুবু একা থাকতে ভয় পায়। আর এরকম ভীতু একটা মেয়ে কিনা শুধুমাত্র পরিবারের খরচ চালাতে অপরিচিত কোনো শহরে এসে দাঁড়ালো। হায়রে দুনিয়া! বাস্তব মানুষকে কত কিছুই না দেখায়…

মারিয়াকে রুমে শিফট করা হয়। রিমি গিয়ে তাকে একবার দেখে আসে। ইয়াসির যায় না। তার ভেতরে মারিয়াকে দেখার অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু সামনে গেলেই সে হয়তো পাগলের মতো আচরণ শুরু করবে! তাই সে যাবে না। একেবারে মারিয়ার ভাইয়ের সাথেই দরকার পড়লে রুমে ঢুকবে।
রিমি এসে ইয়াসিরের পাশে বসে। তার হাত ধরে নিজের দিকে মনোযোগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। ইয়াসির তাকায়। রিমি আহত হয় সে চোখে। হায়, এই আকুলতা যদি একটাবার সে তার নিজের জন্য দেখতে পেত…

খানিকবাদে রাফি আসে। থমথমে মুখ। ইয়াসির উঠে দাঁড়ায়। বন্ধুর দিকে এগিয়ে বলল,
“রাফি, কী হয়েছে তোর? তোকে আমি কালকে থেকে এরকম দেখছি। কোনো বিষয়ে টেন্সড তুই?” বলেই একবার রিমির পানে তাকায় ইয়াসির। যদি ওদের দু’জনের ভেতর কিছু হতো, তবে তো রিমিও একটু বিচলিত থাকতো। কিন্তু ওর ভেতর তো তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাহলে রাফি একা কোনো কিছু হ্যান্ডেল করছে?

একপলক ভেবে ইয়াসির রাফিকে নিয়ে আড়ালে যায়। জোর দিয়ে বলল,
“বলবি?”
রাফি চুপ। ইয়াসির সময় দেয় তাকে। এবার রাফির মুখ ফুটলো। বলল,
“কিছু মনে করিস না… আমি আসলে দেশের বাহিরে চলে যাব। বাবার সাথে কথা বলছি। উনি সব এরেঞ্জ করে দিচ্ছেন। ক’দিন পর চলে যাব। তাই যাওয়ার আগে লয়ারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
ইয়াসির চুপচাপ রাফির কথা শুনে। তার ভেতরে অজানা ভয় ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। রাফি বলল,
“রিমি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। ওর মনে সবসময় অন্য কেউ ছিল। এভাবে একসাথে থাকা সম্ভব না ইয়াসির। আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাব…”
চমকে উঠে ইয়াসির। বলল,
“তুই ঠিক আছিস তো? রিমি তো…”
পরমুহূর্তেই ইয়াসিরের মনে পড়ে, এখানে আসার পর থেকে রিমি ওর পিছনেই পড়ে ছিল। এছাড়াও ইয়াসির নিজেও দেখেছে, সবার সামনেও রাফির সাথে মুহূর্ত কাটাতে সে বিরক্ত প্রকাশ করে। ইয়াসিরের বাসায় আসলে সবসময় রাফিকে ছেড়ে তার পিছনে পড়ে থাকত। ইয়াসির তো ভেবেছিল, হয়তো রাফির সাথে বনিবনা ঠিক নয় বলে বন্ধু হিসেবে ও… “না না এসব কী ভাবছি আমি” ভেবেই সে রাফির দিকে তাকায়। রাফি অন্যপাশে ঘুরে বলল,
“তুই খুব ভালো করে জানিস আমি কার কথা বলছি। কিন্তু তোকে আমি কখনও দোষ দিব না। আমি তো তোকে চিনি তাই না? তুই তো কখনও ওকে সে নজরে দেখিসওনি। ভুল আমারই ছিল, ওকে অন্ধবিশ্বাস করেছিলাম!”
ইয়াসির থামায় রাফিকে। ওকে করিডোরের একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল,
“দেখ, এত বড়ো ভুল বুঝাবুঝির কোনো দরকার নেই। আমি যাই, ওকে বুঝাই? বিয়ের এত বছর পর ও এরকম করছে কেন?”
“বিয়ের এত বছর পর না। ও আমাকে বিয়েই করেছিল, যেন তোর আশেপাশে থাকতে পারে!” বলেই রাফি মুখ নিচু করে। তার গলা ধরে আসছে। কিন্তু আফসোস, সে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে পারবে না… চিৎকার করে রিমিকে জিজ্ঞেস করতে পারবে না। তার সাথেই কেন এমনটা করলো!

🍁

রিসিপশনে এসে দাঁড়ায় শান্ত। বারবার ফোনে ইয়াসিরের পাঠানো লোকেশন দেখে। মিলিয়ে দেখে, হ্যাঁ, এটাই তো!
রিসিপশনিস্টকে ডেকে বলল,
“এক্সকিউজ মি, মারিয়া নামের কোনো পেশেন্ট আছে এখানে? ভর্তি হয়েছে রিসেন্ট?”
রিসিপশনিস্ট একবার ডেটা চেক করলো। রিসেন্ট এডমিটেড পেশেন্ট লিস্ট চেক করতেই তার চোখে মারিয়া নাম পড়ে। শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইয়েস ডিয়ার। আইসিইউ পেশেন্ট। আজকেই কেবিনে শিফট করা হয়েছে। পুলিশ কেস তো এটা!”
শান্ত ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলল,
“কত নাম্বার কেবিন?”
“চার তলার পাঁচ নাম্বার।”
শান্ত দ্রুত লিফট বেয়ে উপরে উঠে। চার তলাতে এসে করিডোর পাস করতেই তার চোখে ইয়াসির আর রাফি পড়ে। দু’জন বসে কথা বলছে। শান্ত সেদিকে খেয়াল করলো না। সে পাঁচ নাম্বার কেবিন খুঁজতে লাগলো। ফোনের ছেলেটাকে খুঁজতে এদিক ওদিক তাকায়। কেবিনের কাছে এসে দরজা খুলতে গিয়েই বাঁধা পায়। একজন নার্স তাকে আটকে বলল,
“আপনি কে? পেশেন্টের কেউ হোন?”
“জি, আমার বড়ো বোন সে। প্লিজ আমি একটু দেখে আসি?”
নার্স একটু আহত কণ্ঠে বললেন,
“এখন তো ভিজিটিং আওয়ার না। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে!”

শান্ত আর কিছু বলল না। একটু সরে গিয়ে ইয়াসিরের নাম্বারে কল করে। কিছুক্ষণ পরই ফোন রিসিভ হয়।
শান্ত তড়িৎ গতিতে বলল,
“আমি তো আপুর কেবিনের সামনেই। আপনি কি চলে গেছেন?”
“না আমি তো কোথাও যাইনি” বলে কেবিনের কাছে আসতেই শান্ত তাকে চিনে ফেলে। একেই তো তখন আরেকজনের সাথে কথা বলতে দেখেছিল!

“চলবে”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here